মুহূর্তের মধ্যে কান্ডটা ঘটে গেল। সুমন হাত সরাতেই মাটির বাড়ির সোনালি গম্বুজটা পড়ে একেবারে খানখান। সুমন নিজের চোখকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিল না।
তাদের মাস্টারমশাই পরেশদা প্রায় পনেরো-ষোলোদিন ধরে এই ছোট্ট সুন্দর বাড়িটা তৈরি করছিলেন। লাল-নীল-গোলাপি রং মিলিয়ে-মিশিয়ে এই বাড়ির মাথায় সোনার কলসির মতন চমৎকার একটি গম্বুজ। আর এইখানেই এবার সরস্বতী পুজো হওয়ার কথা। আর দু’মাস পরেই পুজো। তার তোড়জোড় বেশ কিছুদিন থেকেই হস্টেলে শুরু হয়। নতুন করে বাগান সাজানো। রকমারি গাছ লাগানো হয়। হস্টেলের সমস্ত ঘর-বারান্দা একেবারে ঝকঝকে ছবির মতন হয়ে ওঠে।
এই সময়টা সুমনের খুব ভাল লাগে। বিশেষ করে এই হাতে-গড়া আশ্চর্য বাড়িটা রোজ একবার করে দেখা চাই। কিন্তু ভাঙল কী করে? সুমন বুঝতে পারে মাটিটা কাঁচা ছিল। সোনার কলসির মতন গম্বুজটা ভাল করে আটকায়নি।
সুমনের চোখ জলে ভরে ওঠে। সে তার নীল জামাটার কোনায় চোখের জল মুছে ফেললেও খুব ভয় পেয়ে যায় হঠাৎ। এত সুন্দর একটা জিনিস কত কষ্ট করে মাস্টারমশাই তৈরি করেছিলেন। সুমন সেটা ভেঙে ফেলেছে। সুমন কী করবে বুঝতে পারছিল না। ভাঙা বাড়িটার দিকে তাকালেই বুকের ভেতর কেমন একটা কষ্ট গুমরে উঠছে। সেইসঙ্গে ভয়। সুমন চোখ মুছল। অথচ হস্টেলের এই সবুজ ফুলে-ভরা বাগানটায় বেড়াতে এলে সুমনের মনে অদ্ভুত একটা আনন্দ আসে। চারদিকে কত গাছ। কত রকমের ফুল। আগে সব ফুলের নামই জানত না। এখন জিজ্ঞেস করে-করে জেনে গেছে। আর এই গাছগাছালি-ঘেরা জায়গাটাতেই মস্ত অশ্বত্থ গাছটার ঠিক নীচে তৈরি হচ্ছিল এমন সুন্দর জিনিসটা।
সুমন অশ্বত্থ গাছটার দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকে। গাছটা কেমন চুপচাপ। একটাও পাতা নড়ছেনা। ডালপালা স্থির। অন্যদিনের মতন অশ্বত্থ গাছটার সঙ্গে সুমন আজ কথা বলতে সাহস পায় না। সুমন জানে গাছটা......... আসলে সুমন, এসব জানতে পারে। যেদিন থেকে সুমন জানতে পেরেছে গাছেরও প্রাণ আছে, গাছ খায়; মানুষের মতন বড় হয়। তারও একদিন মৃত্যু হয়। সেদিন থেকে সুমন নিজে নিশ্চিতভাবে জেনে গেছে, মানুষের মতন গাছও দেখতে পায়। কথাও নিশ্চয় বলে। কিন্তু মানুষ তাদের ভাষাটা ঠিক বুঝতে পারে না বলে গাছদের বোবা মনে করে।
ভাঙা বাড়িটার টুকরোগুলো সাজাতে সাজাতে সুমন সব দেখতে থাকে। গাছটা এখন একটুও নড়ছে না। সুমন অপরাধীর মতন গাছটার গুঁড়িতে হাত রাখতেই স-স-স শব্দ ওঠে। শব্দটা শুনেই চমকে ওঠে। চারদিকে তাকায়। হঠাৎ ভয়-ভাবনা সব ঝেড়ে ফেলে শান্তভাবে অশ্বত্থ গাছের ডালে হাত রেখে বলে, হ্যাঁ, তোমার এই প্রিয় জিনিসটা আমি ভেঙে ফেলেছি, কিন্তু ইচ্ছে করে যে নয়, সেটা তো তুমি নিজের চোখেই দেখতে পেয়েছ।
আসলে সুমন প্রথম থেকেই জানে, গোটা বাগানের সমস্ত গাছপালার মধ্যে থেকেও হট্টগোল ভালবাসে এই অশ্বত্থ গাছটা। বাড়িটা হবে। আর এইখানেই সরস্বতী পুজো। একেবারে জমজমাট হইহই ব্যাপার। গাছটা তো খুশি হত। কিন্তু এখন? ভাঙা বাড়িটা যদি তৈরি না হয়?
সুমন চুপ করে থাকল। তারপর টান-টান হয়ে দাঁড়িয়ে শপথের ভঙ্গিতে বলে ওঠে, -আমি কথা দিচ্ছি, বাড়িটা তৈরি হবে। কেউ না করলে আমিই করে দেব। হ্যাঁ, এইখানেই পুজো হবে। তুমি তো জানো আমার কথার দাম আছে।
গাছটা যেন একটু নড়েচড়ে ওঠে। সুমন খুশি হয়। আবার সঙ্গে সঙ্গে ভয়। ভীষণ ভয়। জিনিসটা সে ভেঙে ফেলেছে। শাস্তি তার হবেই। সুমন ঢিপঢিপ বুকে হস্টেলের দিকে চলতে থাকে।
এ-বছরই সুমন ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছে। স্কুলের লাগোয়া এই বিবেকানন্দ মন্দির হস্টেলে থাকে। এই তো সেদিন মা, বাবা, কাকু, পিসিদের সঙ্গে কলকাতা থেকে কত দূরে এই সাগরদ্বীপের কাছাকাছি হস্টেলে ভর্তি হয়ে গেল। দেখতে দেখতে দুটি বছর কেটে গেছে। প্রথমদিকে বেশ কষ্ট হত। কী মন খারাপ! মায়ের জন্যে, বাবার জন্যে। ছোটপিসি, কাকু। বাড়িতে রান্না করে বাবুদা। ইশ্! ভাবতেই পারত না সুমন—
এখন তার বেশ লাগে। এত বন্ধু। মাস্টারমশাই। মুক্তি মহারাজ। মনেই হয় না দু’বছর আগে সুমন এদের চিনত না। তবে সুমন জানে, আসলে ওর সব চাইতে বেশি ভালবাসা এই গাছগুলোর সঙ্গে। এদের সঙ্গে কত কথা! রোজ। লুকিয়ে-লুকিয়ে। আর কেউ জানে না। শুধু ছোটপিসি একবার কী করে জেনে ফেলেলেন, সুমন গাছের সঙ্গে কথা বলে। তাদের কলকাতার বাড়ির পাতাবাহার গাছে জল দেওয়ার সময় সুমন যখন কথা বলছিল তখন ছোটপিসির সে কী হাসি! তুই গাছের সঙ্গে কথা বলিস? ও মা, সত্যি রে গাছ তোর কথা বুঝতে পারে? পরে সন্ধেবেলা ছোটপিসি কেমন গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন, আমার কী মনে হয় জানিস, তুই খুব বড় উদ্ভিদ-বিজ্ঞানী হবি। নতুন করে গাছ সম্বন্ধে অনেক কিছু আবিষ্কার করবি, একেবারে হইহই পড়ে যাবে।
সে হয়তো যাবে। কিন্তু এখন এই সুন্দর জিনিসটা ভাঙার জন্যে কী হবে? হস্টেলের দক্ষিণের বারান্দায় বসে সাত-পাঁচ ভাবল। হাওয়ায় স্-স্-স্ শব্দ। সুমন চমকে উঠে। শিমুলগাছটা বলছে, সুমন বলে দাও, সত্যি কথাটা বলে দাও। ভয়ের কিছু নেই। আমি বলছি...। সুমন গাছটার দিকে তাকায়। বলতে তো হবেই। কিন্তু বলবে কেমন করে? সেটাই কথা।
সুমন তার ঘরে ফিরে এল। হস্টেলে এই ঘরে ওরা চারজন থাকে। বেশ সুন্দর ঘর। খোলামেলা। চারদিকে ফুলের গন্ধ। হাওয়া। মাঝরাতে ধুপধাপ তাল পড়ার শব্দ। পুব দিকে একটা পুকুরে পদ্ম ফোটে। বৃষ্টি পড়ে পুকুরের জলে। সুমন মুগ্ধ হয়ে দেখে। কেমন যেন গা ছমছম করে ওঠে ওর। এই সময়টা একলা থাকলে খুব ছবি আঁকতে ইচ্ছে করে ওর। আবার কখনও ছড়া লেখে। অবশ্য এইসব লেখার কথা দু-একজন ছাড়া আর কেউ জানে না। এখন ঘরে কেউ নেই। বিকেলবেলা সবাই মাঠে গেছে। সত্যি, সুমনও যদি মন্দিরটা দেখতে না গিয়ে ওদের সঙ্গে মাঠে যেত? তা হলে হয়তো এইসব ভাঙাভাঙি হত না।
আজ শনিবার। কাল রবিবার ছুটির দিন বলে সারা হস্টেলে আজ থেকেই ছুটির হাওয়া। মাস্টারমশাইরা আজ তেমন কড়াকড়ি করেন না। ইচ্ছে করলে কেউ নিজের মতো কাজ করতে পারে। বিকেলে মাঠে যেতে পারে, নারকোল-বাগানে বসা যায়। ছবি আঁকা, বই পড়া কিছুতেই কোনও নিষেধ নেই। তবে প্রার্থনার সময় বসতেই হবে। আর পড়াটা ঠিকঠাক করা চাই। পড়াতে ফাঁকি দেওয়া কেউ পছন্দ করে না।
শনিবার দিনটা এমনিতেই সবার খুব ভাল লাগে। সুমনেরও মনটা খুব খুশি থাকে। মা আসবেন। বাবা আসবেন। দেখা হবে। কত গল্প। তবে বেশিরভাগ দিন মা আসেন। বাবার অফিসের কাজ। বাবা বেশি আসতে পারেন না। কখনও-কখনও সুমনকে চমকে দেওয়ার জন্যে বাবা আসেন। সুমন কিন্তু চমকায় না, আগে থেকেই ওর মন বলে আজ যেন মা আসবেন না, বাবা আসবেন। সঙ্গে মায়ের চিঠি। সুমন চুল আঁচড়ে, নীল জামা পরে দক্ষিণের বারান্দা থেকে রাস্তার দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে। বাবা না মা-কে? অমনি টিকটিকিটা টিকটিক করে ওঠে, দ্যাখো সুমন, সত্যি সুমন, তোমার বাবা এসেছেন। ভিজিটিং রুমে বসে আছেন। এরকম অনেকদিন হয়েছে। টিকটিকিটার কথা সত্যি হয়েছে। আবার কখনও হয়নি। সুমন তখন টিকটিকিটার ওপরেই রেগে গেছে। কথায়-কথায় এরকম টিকটিক করা। এ কেমন স্বভাব? এটা নিশ্চয়ই তা হলে আগের টিকটিকিটা নয়। তার কথার দাম ছিল। সুমনের বুকের ভেতর হঠাৎ কেমন গুরগুর করে ওঠে। সেই টিকটিকিটা আবার বেঁচে আছে তো? একটা টিকটিকি কতদিন বাঁচে?
হঠাৎ একটা হইহই শব্দ। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে চমকে ওঠে সুমন। এত গণ্ডগোল কেন? তার মন্দির ভাঙবার খবর কি তা হলে জানাজানি হয়ে গেল? এত জোর শব্দ উঠছে যে সুমন ভয় পেয়ে গেল।
সাহস করে সুমন জানলা থেকে মুখ বাড়ায়।
কল্যাণের ছিপে মাছ ধরা পড়েছে। তাই হট্টগোল। কল্যাণও সুমনের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। ওর মাছ ধরার খুব শখ। শনিবার দিন অত কড়াকড়ি নেই বলে ও মাছ ধরতে যায়। বাগানের পাশেই ছোট্ট একটা খালমতন আছে, সেখানে ঘণ্টা-দুই বসলে মাছ একটা মিলবেই। মাছ পাওয়া গেলে সবাই খুব হইহই করে। সুমনেরও খুব আনন্দ হয়। এই মাছটা এখন সতীশ-মাস্টারমশাইয়ের ঘরে ভাজা হবে। মাস্টারমশাই খুব চা-কফি খান। তাঁর ঘরে হিটার আছে। নিজেই টুকটাক কত কী তৈরি করতে পারেন। সুমনদের মাঝে-মাঝে টোস্ট, ওমলেট করে খাওয়ান।
এখন মাস্টারমশাই এই মাছ ভাজতে বসবেন। যত ছোট মাছই হোক, সবাই ঠিক একটুকরো করে পাবে। সুমন ভাবে, কী আশ্চর্য-- বাড়ির মাছগুলো যেন কেমন বিচ্ছিরি, কাঁটা দু-একটা ফুটবেই। কিন্তু মাস্টারমশাই এমন সুন্দর করে কী যে করে দেন! মা শুনলেই হাসেন। সুমনও তখন হাসে। আজ সুমনের ওখানে যাওয়ার উপায় নেই। ভয়ে-ভাবনায় খুব শরীর খারাপ করছে। দূর থেকেই সুমন অশ্বত্থ গাছটার দিকে তাকাল। ভাঙা মন্দিরটা খানখান হয়ে পড়ে আছে। গাছটা জানে। গাছটা সাক্ষী। গাছটা কি কোনও উপায় বলে দিতে পারে না? স্-স্ শব্দ। সুমন তুমি আগে তোমার বন্ধুদের বলো, বন্ধুরা ঠিক একটা উপায় বলে দেবে। সুমন চোখ বন্ধ করে অশ্বথ গাছটার কথা শুনছিল। এমন সময় ঘরে ঢুকল প্রদীপ। ওরা চারজন পাশের ঘরেই থাকে প্রদীপ, প্রসূন, প্রতাপ আর পার্থ। চারজনের নামের প্রথম অক্ষরই প। সুমনরা তাই ওদের নাম দিয়েছে প্রচার। প্রচার বললেই চারজনের একজনকে বোঝাবে। অথবা একসঙ্গে সবাইকে। তা ছাড়া এখানে সবার একটা করে নাম আছে। যেমন সুমনের নামই তো সুমন সেনাপতি। নামটা দিয়েছিলেন মুক্তি-মহারাজ।
তাদের ক্লাসের ফাস্ট বয় পার্থর নাম আবার ‘ন্যাড়া’৷ তার মাথার চুল ছোট। খুব কম। আশিস আর সুমিত তিন নম্বর ঘরে থাকে, ওরা ঘুড়ি ওড়াতে ভালবাসে বলে ওদের নাম ঘুড়ি -লাটাই। চার নম্বর ঘরে থাকে সৌমিত্র, রাহুল আর সৈকত। সৌমিত্রর স্বাস্থ্য একটু বেশি ভাল বলে ওর নাম দারা সিং। সৈকতের গায়ের রং সবচেয়ে কালো। তার কথা বেশ মিষ্টি। সেজন্য সে হচ্ছে কোকিল। ওদের মধ্যে অমলের নামটাই অনেকদিন ধরে পাওয়া যাচ্ছিল না। কী নাম রাখা হবে সবাই যখন ভাবনা-চিন্তা করছে তখন দেখা গেল অমল শালুক ফুলের ডাঁটা চিবিয়ে খাচ্ছে। ব্যস্। ছেলেরা হইহই করে ওর নাম দিয়েছিল ‘শালুক’।
প্রদীপ বলল, জানিস, সেনাপতি, আজ. একটা ব্যাপার ঘটেছে....।
অমল বলল জানি, আমাকে কোকিল বলল। এখন কী হবে? কে এ কাজ করল বল্ তো?
গুটি-গুটি অনেকেই এসেছে। ক্লাস সেভেনের দুই, তিন, চার নম্বর ঘরের অনেকেই তা হলে জানে। সুমন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে আছে। এর মধ্যে মন্দির ভাঙার খবরটা জানাজানি হয়ে গেল? সুমন শুনতে পেল অশ্বথ গাছ হাওয়া পাঠাচ্ছে, সুমন, বন্ধুদের বলে দাও, হ্যাঁ এখনই বলে দাও।
সুমনের বুক কাঁপছে। কাকে বলা যায়? এ ব্যাপারে অমলকে বলাই ভাল, ও বেশ বুদ্ধি দিতে পারে কিন্তু অমলের সঙ্গে যে আবার তিন দিন ধরে কথা বন্ধ। মোহনবাগান জিতেছিল বলে সুমন সেদিন সবাইকে চকোলেট খাইয়েছিল। শুধু অমল খায়নি। সে ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার। সে কেন খাবে? অমল রাগ করে কথা বলেনি। বন্ধুরা বলেছে, সেনাপতির উচিত হয়নি শালুককে চকোলেট দেওয়া, দেখতেই পাচ্ছে মন খারাপ করে বসে আছে।
সব শুনে মুক্তি-মহারাজও রাগ করে বলেছিলেন, খেলা নিয়ে এত রাগারাগি, ঝগড়া খুব খারাপ ব্যাপার। কে ভাল খেলেছে, কার খেলায় কতটা উন্নতি হচ্ছে -- এই নিয়েই আলোচনা হওয়া ভাল। হার-জিত নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে রাগারাগি খুব খারাপ জিনিস।

মুক্তি-মহারাজের কথা শুনে সুমন মাথা নিচু করে ফেলেছিল। এই হস্টেলে সকলকে পছন্দ করলেও সুমন মুক্তি-মহারাজকে বড্ড বেশি করে ভালবাসে। মুক্তি-মহারাজের মুখখানা কেমন যেন ঝলমলে। খুব শান্ত, ঝকঝকে চোখ। বয়স কত আর হবে? চব্বিশ-পঁচিশ। পরনে গেরুয়া। মুন্ডিত মস্তক। মুক্তি-মহারাজ সন্ন্যাসী। কতদিন আগে সবাইকে ছেড়ে তিনি সন্ন্যাসী হয়ে এখানে চলে এসেছেন। শুধু কাজ আর কাজ। আর তার মধ্যেই সুমনদের কী ভালবাসেন! গেরুয়া পোশাক পরা মুক্তি-মহারাজ রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলেই সুমনের বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে ওঠে। মুক্তি-মহারাজের কাছে এখনই একবার যাব। সুমন চমকে উঠল। অশ্বত্থ গাছ হাওয়া পাঠাচ্ছে --স্-স্ সুমন বন্ধদের আগে বলো।
সুমন শুনতে পেল আশিস আর অমল কী একটা কথা আস্তে আস্তে বলাবলি করছে। সুমনের কথা? ওরা কি জানতে পেরেছে সুমন এই মন্দিরটা ভেঙে ফেলেছে?
অমল বলছে, কে এই কাজ করল, এমন একটা সুন্দর জিনিস কেউ ভাঙতে পারে বলে আমার বিশ্বাস হয় না।
আশিস বলল, কে ভেঙেছে বলে মনে হয়? এ ক’দিনের মধ্যে একবারও যাইনি, একটা মন্দির তৈরি হচ্ছে তার এত দেখাদেখির কী আছে?
অমল বলল, একজনের জন্যে আমাদের সবার শাস্তি! সুমন অমলের দিকে তাকাতে পারে না। সাত-পাঁচ ভাবে। অমলের খুব উপস্থিত বুদ্ধি। ও কি এখন একটা কিছু বলতে পারে না যার জন্যে হস্টেলের ছেলেদের শাস্তি পাওয়া বন্ধ হয়, আবার সুমনকেও মিথ্যেবাদী হতে হয় না।
সুমন অশ্বত্থ গাছটার দিকে তাকায়। স্পষ্ট শুনতে পেল, বন্ধুদের বলো, সুমন আর দেরি কোরো না।
আশিস বলল, শাস্তিটা কী হবে রে?
অমল বলল, যে এত পরিশ্রমের জিনিসটা ভেঙেছে তাকে কান ধরে গোটা হস্টেলে ঘোরানো উচিত।
এমন সময় সৌমিত্র হাঁপাতে-হাঁপাতে এল। একটা কাণ্ড হয়েছে। পরেশদা সবাইকে ডেকে ডেকে জিজ্ঞেস করছেন। সোনার মতন গম্বুজটা এমন করে কে যে ভেঙে ফেলেছে --ইশ্! ভাগ্যিস আমরা আজ এখনই মাঠ থেকে ফিরছি...
শুধু সৌমিত্র নয়, এক-এক করে সবাই জড়ো হয়েছে দক্ষিণের বারান্দায়৷ মন্দির ভাঙার কথা সবাই জেনে গেছে। এখন শুধু কে ভেঙেছে এটাই খুঁজতে হবে।
ক্লাসের ফার্স্ট বয় পার্থ একজনকে বলল, আমার মামা শ্রুতিধর বোসের নাম তো তোরা সবাই শুনেছিস। গোয়েন্দা গল্প লেখেন, ওঁকে একবার খবর দেব? শালুক, তুই কী বলিস?
অমল বলল, যা হোক একটা-কিছু করা দরকার৷ একজনের জন্যে সবাই শাস্তি পাবে, এটা হতে পারে না।
আশিস বলল, সুমন সেনাপতিরই সবচেয়ে মন খারাপ। দ্যাখো না, ও একেবারে চুপ করে আছে।
সৌমিত্র বলল, হ্যাঁ ওই তো সবসময় মন্দিরটা দেখতে যেত। অমল সুমনের দিকে তাকাতেই সুমন দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ওটা আমি ভেঙে ফেলেছি, তবে ইচ্ছে করে নয়। গম্বুজটা ছুঁতেই...., আমি বুঝতে পারিনি।
সবাই প্রায় একসঙ্গে বলে ওঠে, অ্যাঁ! সে কী!
অমল বলল, চুপ, চুপ, আস্তে।
আশিস বলল, এখন কী হবে?
অমল বলল, মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবতে হবে।
সৌমিত্র রাগ করে বলে, সত্যি সুমন যেন কী। একটা কিছু দেখলে এমন আরম্ভ করিস না....।
আশিস বলল, শাস্তিটা কী হবে ? সেই ক্লাস এইটের তিলকদা’র মতন হাতে ইঁট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে!
অমল গম্ভীর মুখে জানাল, তিলকদা দোষ করেও স্বীকার করেনি। আবার মুখে মুখে তর্ক করেছিল।
আশিস বলল, দোষ স্বীকার করলে পরেশদা কিছুই বলবেন না?
ঢং-ঢং করে টিফিনের ঘণ্টা বাজল। এখন সবাই ডাইনিং হলে যাবে। সুমন যেতে চাইছিল না। বালিশে মুখ গুঁজে চুপ করে শুয়েছিল। অমলই ওকে ওঠায়। সুমন-সেনাপতি এত ভেঙে পড়লে কি চলে? ওঠ।
আশিস বলল, শালুক, সেনাপতির সঙ্গে তোর ঝগড়া মিটে গেল?
অমল রাগ করে বলে, বিপদের সময় ঝগড়া রাখলে কি চলে?
ইচ্ছে নেই। তবু সুমনকে যেতে হয়। আজ টিফিনে আবার দুধ, বিস্কুট আর কলা। এইসব টিফিন আবার সুমনের একেবারে পছন্দ নয়। সুমন পছন্দ করে মশলামুড়ি, চিঁড়েভাজা, কিংবা লুচি-তরকারি। বেশিরভাগ দিনই এ-সব খাবারের কিছুটা সে লুকিয়ে-চুরিয়ে আমলকি বনে নিয়ে যায়। সেখানে তার প্রিয় চারটে কাঠবেড়ালি আছে। সুমনকে দেখলেই তারা হাজির হয়। সুমনের খাবারের টুকরো মুখে নিয়েই দৌড়ে পালায় কাঠবেড়ালিরা। এত ভাল লাগে সুমনের। খুব ইচ্ছে করে কাঠবেড়ালির লেজে একবার হাত বোলায়। কিন্তু কাছে আসা দূরে থাক, সুমন তাকালেই তরতর করে গাছে উঠে যায়।
অমল দুধের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, তুই এখন নিশ্চয়ই আমলকী বনে যাবি?
সুমন মাথা নেড়ে বলল, না। গরম দুধ কাঠবেড়ালি খাবে কী করে?
যাবে না যাবে না করেও সুমন একবার আমলকী বনে গেল। আর ঠিক সেই সময়ই দেখল পরেশদা স্কুলবাড়ির দিকে যাচ্ছেন। সুমন ঝুপ করে শিমুলগাছের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হস্টেলের রান্নাবাড়িতে চলে আসে।
রান্নাঘরের কাজ করছিল বিবেক। বেশ দোহারা চেহারা। সাদাসিধে স্বভাব। আঠারো-উনিশ বছরের ছেলে বিবেককে হস্টেলের সবাই ভালবাসে। সুমনের সঙ্গেও তার বেশ ভাবসাব। সুমনকে এই সময় রান্নাবাড়ির দিকে আসতে দেখে বিবেক অবাক হল না। সে জানে সুমন এখনই কাঠবেড়ালিদের জন্যে মুড়ি-ছোলা এইসব চাইতে এসেছে। বিবেক রাগ করে বলল, দুধ-কলা তো খেলে, আবার ঝালমুড়ি কিসের জন্যে ? সুমন মনে মনে রাগ করে। এই এক স্বভাব বিবেকদা’র। জানে সব। তবু জিজ্ঞেস করবে। বিবেক বলল, আজ আর হবে না। হাতে টেইম নেই। ক্লাস সিক্সের সিক্-রুমে যেতে হবে, শরবত নিয়ে।
সুমন জানে সকাল থেকেই স্নেহাশিসের শরীর ভাল নেই। সিক-রুমে পাঠানো হয়েছে তাকে। ভাতটাত খাওয়া বারণ। তার জন্যেই ডাবের শরবত। খুব সুন্দর শরবত তৈরি করতে পারে বিবেকদা। সুমন ভাবে, কবে যে ওর একটু অসুখ-বিসুখ হবে? কতদিন যে ডাবের শরবত খাওয়া হয়নি!
বিবেক কিছুটা মুড়ি কাগজের ঠোঙায় দিয়ে বলল, এই নাও,আজ এই খাওয়াও। ওরা তো সবসময় ফলমূল খাচ্ছে, তোমার রোজ-রোজ টেফিন খাওয়াবার দরকারটা কী?
সুমন অভিমানী-মুখে তাকায়। একেবারে শুকনো মুড়ি। একটু তেল পর্যন্ত মেখে দেয়নি। কাঠবেড়ালি বলে কি একটুও আদর-যত্নও করতে নেই?
ক্লাস ফাইভের রঘুনাথও কখন যেন গুটি-গুটি এসে হাজির হয়েছে, সে চুপি-চুপি বলল, একটু বিস্কুটের জন্যে তোমার কাছে এলাম বিবেকদা।
বিবেক বলল, বিস্কুট অত শস্তা হয়নি যে মাছকে খাওয়াব। এখন বিরক্ত কোরো না তো, আমার কাজ আছে।
রঘুনাথ ফিসফিস করে সুমনকে বলল, তোমার ঠোঙায় কী সুমনদা? মুড়ি? একটুখানি দেবে? দাও না, মাছগুলোকে খাওয়াতে হবে। এখনই গ্রুপের ঘন্টা পড়ে যাবে। রঘুনাথেরর চোখে কাকুতি-মিনতি। সুমন পুরো ঠোঙাটা দিয়ে দিল।
রঘুনাথ বলল, সবটাই? রাগ করে দিলে না তো? সুমন সামান্য হাসল।
প্রায়দিনই রঘুনাথ বিকেলের দিকে ওই জলার ধারে গিয়ে বসে। কেউ আর ওখানে যায় না। নিরিবিলি জায়গাটায় কাঁটাঝোপের আড়ালে কাদাভর্তি জলার মধ্যে বসে মুড়ি ছিটোয়। মাছেরা খায়। বেশ কয়েকটা মাছ পোষ মেনে গেছে রঘুনাথের। রঘুনাথ প্রায়ই বলে। লালঝুঁটিওয়ালা একটা মাছও নাকি ওর মধ্যে আছে। মাছটা কী করে এখানে এল, সেটা ভাবলেই সুমন অবাক হয়। লাল ঝুঁটিওয়ালা মাছটাকে সুমন অনেকবার ঘোরাঘুরি করেও দেখতে পায়নি।
আজ এখনই একবার গেলে হয়। কিন্তু কাঠবেড়ালিগুলোর কী হবে?
সুমন নিজের মনেই বলল, আজ আর কাঠবেড়ালিগুলোর খাওয়া হল না। সে আর কী করবে? ওই শুকনো মুড়ি দিতেও লজ্জা। তার চাইতে না দেওয়াই ভাল। বরং রঘুনাথকে দিয়ে সে খুশিই হয়েছে। অমন করে দাদা বলে ডাকলে না দিয়ে পারা যায়?
সত্যি, ফাইভ-সিক্সের ছেলেরা যখন ‘সুমনদা’ বলে ডাকে তখন মনেই হয় না যে সে এখনও ছোট। সত্যিই. তো ছোট নয়। বড় হয়েছে। নিজের জামা-প্যান্ট নিজে কাচে। থালা-বাটি ধোয়। নিজের ঘর ঝাঁট দেয়। বাগান দেখে। কারও অসুখ করলে সুমন নাকি সবচেয়ে ভাল সেবাযত্ন করতে পারে, সবাই তো তাই বলে। অথচ বাড়িতে তার মা, ছোটপিসি তাকে কোনও কাজ করতে দেন না। ছোটপিসি আবার চান করিয়ে চুল আঁচড়ে দেন। মা মাছের কাঁটা বেছে খাইয়ে দিতে চান।
আর সত্যি কথা বলতে কী, বাড়িতে কোনও কাজ যেন ভাল করে করতে পারে না সে। কেন পারে না? সুমনের মনে হয় সব কিছুর মূলে ওই ঘন্টা।
ঘণ্টার আওয়াজ। ঘণ্টা পড়লো, সুমন ওঠো, ওঠো, ওঠো শিগ্গির, ভোর চারটে বেজে গেল যে! সুমন মুখ ধোও, ওই শোনো প্রার্থনার ঘণ্টা। শিগগির ধুতি-চাদর পরে নাও। পাঁচটা বাজল, প্রার্থনা শেষ। ছটা ! ছটার ঘণ্টা। টিফিন। খুব চটপট, এখন একটুও সময় নষ্ট কোরো না, সকালবেলা তো! সকালের পড়া একটুও নষ্ট কোরো না। মনে নেই মাস্টারমশাইরা কী বলেন? সকালের পড়াটাই হল আসল পড়া। যা পড়বে সব মনে থাকবে। সকাল সাড়ে-ছটা থেকে নটা পর্যন্ত একটানা পড়া। তখন একটাও কথা নয়। অবশ্য পড়া বিষয়ে কথা বলা যাবে। তবে একেবারে ভোরবেলা -- তাও নয়। তখন শুধু মনে মনে পড়া।
সাড়ে-দশটার মধ্যে চান-খাওয়া শেষ। স্কুল। কলকাতায় বাসে-ট্রামে করে স্কুলে যেতে হত -- এখানে সে-সব নেই। কী সুন্দর একটুখানি ছায়ামাখা গাছগাছালি পেরিয়ে একটুখানি রাস্তা। তারপরেই একটা পুকুর, পুকুর পেরিয়ে দু’ধারের সাজানো বাগান পার হলেই স্কুল।
গোলাপি রঙের অতবড় বাড়ি। কী গমগম করে! স্কুল বসলেই সব চুপচাপ। কারও মুখে কোনও কথা নেই। স্যার নাম ডাকছেন, একের পর এক। কেউ বলছে ‘প্রেজেন্ট প্লিজ’ কেউ উপস্থিত। তারপরেই পড়া শুরু।
প্রথম ঘণ্টাতেই অঙ্ক থাকে সুমনদের। বাড়ির কাজ মানে বেশ কিছু হোম-ওয়ার্ক। আবার বোর্ডেও অঙ্ক করতে ডাকেন স্যার। সুমনরা বলে ললিতদা। দেখতে কী সুন্দর। কিন্তু অঙ্ক না করতে পারলেই ললিতদা’র ভুরু কুঁচকে যায়, সুমনের তখন বুক টিপটিপ করে। বোর্ডে অঙ্ক কষার ডাক পড়লে সুমনের গলার কাছটা কেমন আঠা-আঠা হয়ে যায়। প্রথমে বোর্ডের কাছে গিয়ে ও কিছুই দেখতে পায় না। তারপর একটু-একটু করে অঙ্কটা পড়তে পড়তে...। সুমনের অঙ্কটা হয়তো হয়েও যায়। ললিতদার চোখ ঝিকমিক করে। কিন্তু বেশিক্ষণ নয়। একটুখানি। তা হলেও সুমনের ভাল লাগে। ললিতদা পিঠে হাত রাখলেই ভয়টয় সব চলে যায়। তা, অঙ্কে সুমনের বেশ ভয়। হাফ-ইয়ারলিতে নম্বরও কম পেয়েছিল। ললিতদা রাগ করে বলেছিলেন, এত কম নম্বর কেন সুমন? প্র্যাকটিস করোনি নিশ্চয়ই।
সুমন জবাব দিতে পারেনি।
ছোটকাকু হস্টেলে এসে সব শুনে বলেছিল, রোজ কুড়িটা করে অঙ্ক করবি। দেখবি অঙ্কই তোর কাছে ভয়ে জড়োসড় হয়ে থাকবে।
আর, অঙ্কের ক্লাসে ললিতদা তো সুমনের দিকেই যেন তাকিয়ে তাকিয়ে বলেন, যাকে তুমি এড়িয়ে যাবে, সে তোমাকে তাকিয়েও দেখবে না। সত্যিকারের ভালবাসা চাই। ভালবেসে কাজ না করলে সে কাজ কিছুতেই ভাল হবে না।
ললিতদা হাসতে হাসতে বললেন, মানুষকে ভাল না বাসলে সে যেমন বুঝতে পারে, অঙ্কও তেমন পারে। ভাল ব্যবহার না পেলে আমরা সবাই দুঃখ পাই। পাই না ?
উত্তরে ক্লাসের সবাই বলে উঠেছিল, হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ স্যার।
অঙ্কের বেলায় কী হয় বলো তো ? দুঃখ, অভিমান কিছু নয়। তার মেজাজ চড়ে যায় সপ্তমে। সে তখন সব ঘ্যাঁচ-ঘ্যাঁচ করে কেটে বড়-বড় রসগোল্লা বসিয়ে দ্যায়৷ সেইসব গোল্লা কি খুব মিষ্টি লাগে তোমাদের?
সবাই হেসে উঠলেও সুমন চুপ। মাথা নিচু। চোখ ছলছল। কথাগুলো কি ললিতদা তাকেই বলছেন? তবে সুমন তো এখন আর অঙ্ককে অবহেলা করে না। অঙ্ক না করলে কেমন যেন ফাঁকা-ফাঁকা লাগে তার। মনে হয়, কী যেন করা হয়নি!
প্রার্থনার ঘণ্টা পড়ল। মুহুর্তে নিস্তব্ধ হয়ে গেল হস্টেল। সুমন পা চালিয়ে তার ঘরে এল এবার। চটিটা খুলে রেখে এক মিনিটের মধ্যে ধুতি-চাদর পরে নিয়ে ঠাকুরঘরে৷ ওখানে ঠাকুরের বিরাট ছবি, ধূপধুনো, ফুলের গন্ধের ভেতরে চোখ বুজে গান গাইতে হয়। সুমন ঠাকুরঘরে ঢুকতে যাচ্ছে, এমন সময় বিবেক ইশারা করে। সুমন চোখ তুলল, কী?
বিবেক মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, এসোই না একবার।
সুমন ঘাড় নাড়ল, না, এখন না।
বিবেক ইশারা করে বলল, শরবত।
শরবত! ডাবের শরবত রেখেছে বিবেকদা তার জন্যে !
তা বলে প্রার্থনার সময়। বিবেকদাও যেন কেমন! এতক্ষণ ছিল না, যেই ঠাকুরঘরে এসেছে, অমনি ডাকাডাকি।
প্রতাপ আস্তে-আস্তে বলল, যা না সেনাপতি, খেয়ে আয়। সৌমিত্র বলল, কোকিল চুপ, চুপ, ডাকিস না, প্রার্থনা শুরু হয়ে গেছে।
প্রতাপ বলল, দারা সিংটা এমন করে!
সুমন অসহায়ভাবে মাথা নেড়ে বলল, পরে খাব।
প্রার্থনা শুরু হয়ে গেল। প্রার্থনার গান সুমন গাইছিল ঠিকই। কিন্তু মন একেবারে অন্যদিকে। প্রার্থনার পরেই পরেশদা আসবেন, গ্রুপে। ইতিহাস পড়াবেন, ভূগোল পড়াবেন। কিন্তু আগে তো ওই সুন্দর বাড়ি ভাঙার জন্যে শাস্তিটা হবে। কঠিন শাস্তি? সুমন অবশ্য এখনও কোনও শাস্তি পায়নি। যদিও দোষটোস একেবারে যে করেনি, তা নয়। কয়েকদিন আগেই তো বড়-বড় দুটো লাল গোলাপ তুলে ফেলেছিল। অথচ গোলাপ গাছে হাত দেওয়া সবার বারণ। ফুলগাছে অবশ্য কেউ হাত দেয় না। সারা হস্টেলেই ফুলগাছ। চলতে-ফিরতে ফুলগাছের সঙ্গে একশোবার ছোঁয়াছুয়ি।
মা বাবাকে প্রায়ই বলেন, সুমনদের কী মজা, ফুলের গন্ধে ঘুমিয়ে পড়ে, আবার ফুলের গন্ধে জেগে ওঠা।
কথাটা সুমনেরও খুব ভাল লেগেছিল। এখানে ফুলের গন্ধ আলাদা কোনও গন্ধ বলেই মনে হয় না। ওটা যেন হস্টেলেরই একটা গন্ধ। আর রাত্রিবেলা, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে এই হস্টেলটাই একেবারে ফুলপরিদের রাজ্য মনে হয়। সুমন গভীর রাত্রে ফুলপরিদের দেখার জন্যে একদিন এ-বাগানে এসেছিল। ভয় করছিল। তবু ভাল লাগছিল। দরজা খুলতেই চারদিকে মিষ্টি-মিষ্টি গন্ধ৷ কিসের গন্ধ? চন্দন? চন্দন গাছ তো সুমনদের হস্টেলে নেই। তা হলে কি কাছাকাছি অন্য কোথায়ও আছে? হাওয়ায় ভেসে আসছে সেই গন্ধ। চন্দন গাছে কি ফুল হয়? মিষ্টি সাদা ফুল ! চন্দন ফুলের কথা ভাবতে ভাবতে শুধু দেখে আকাশ জুড়ে মস্ত একখানা চাঁদ। নারকেল গাছের মাথার ওপর। আলোয় ভরিয়ে দিচ্ছে গোটা হস্টেল। একসঙ্গে সব ফুল ফুটে গেছে। শুধু ফুল নয়, ঘাস, পাতা সবকিছুর মধ্যেই যেন সুন্দর গন্ধ। একটুও কাঁপছে না পুকুরের জল।
সুমনের ইচ্ছে হল সবাইকে ডেকে দেখায়। কিন্তু ভয় করছে। রাত্রিবেলা মুক্তিদা মাঝে-মাঝে দেখে যান। সবাই ঠিকঠাক ঘুমোচ্ছে কি না। সুমন মাঝরাতে বাইরে এসে বসে আছে দেখলেই তো মুশকিল। তা ছাড়া সুমনের মনে হল এই আলো, এই গন্ধ, এই হাওয়া -- এরা যেন ভিড় ভালবাসে না। এরা ভালবাসে চুপচাপ একলাটি থাকতে।
প্রার্থনা শেষ। এবার মাথার ওপর দুলছে সেই শাস্তি। সুমন জামাকাপড় পালটে আয়নায় তার মুখ দ্যাখে। মুখ কেমন যেন কান্না-কান্না। ভয়-ভয়। ঘরে ঢুকতেই সুমন দেখতে পায় আশিস আর সুমিত দরজায় চাপ দিয়ে পেয়ারা ভাঙছে। সুমনকেও একটুকরো দিল। সুমন বলল, না, থাক। সুমিত বলল, বাহ্,খাবে না কেন? তুমি পেয়ারা ভালবাস না সুমন তবু খেল না। পাশে-বসে-থাকা দিব্যজ্যোতির দিকে তাকায়। দিব্যজ্যোতির সঙ্গে তার তেমন ভাবসাব নেই. দিব্যর কলম ভেঙে দিয়েছিল বলে কথা বন্ধ। আজ আবার তারই সামনে পরেশদা কী বলবেন কে জানে! দিব্য কি জানে সুমনই এ-বাড়িটা ভেঙেছে?
সত্যি কিছুদিন ধরে সুমনের যে কী হয়েছে! যা করতে চায় না, তাই করে ফেলে! দিব্য খুব শান্ত ছেলে। কিন্তু তার সঙ্গেও সুমনের আড়ি। অথচ এই নীল জামা দিব্যরই, যেটা সুমন গায়ে দিয়ে বসে আছে। দিব্য জানে নীল রং সুমন খুব ভালবাসে, তাই জামাটা আর নিতেই চায় না।
সুমন ঠিক করল, কাল মা এলে একটা ভাল কলমের জন্যে বায়না ধরবে। সে কলমটা ও দিব্যকে দিয়ে তবে নিশ্চিন্ত। কী ব্যাপার, তোমরা রিডিং-রুমে পেয়ারা খাচ্ছ?
সুমন তাকিয়ে দেখে সোমনাথদা। ক্লাস টেনের সোমনাথদা গম্ভীর মুখে আশিস আর সুমিতকে বকুনি দিলেন।
আশিস, সুমিত মুখ মুছে লজ্জার হাসি হাসে। সোমনাথদা বললেন, তোমরা উঁচু ক্লাসে পড়ো, আর তোমরাই কিনা রিডিং-রুমে বসে এইসব করছ? ফাইভ-সিক্সের ছেলেরা দেখলে কী ভাববে? তোমাদের দেখে তারা যদি এইসব শেখে?
আশিস, সুমিত দুজনেই বলল, আর কোনওদিন করব না সোমনাথদা।
সুমন অবাক হয়ে ভাবে, এখন সোমনাথদা কেন? এখন তো পরেশদা’র আসার কথা।
সোমনাথ বলল, তোমরা এখন বিবেকানন্দ-হলে চলো।
বিবেকানন্দ-হলে? আজ তো কোনও অনুষ্ঠান নেই সেখানে। ওরা সবাই একসঙ্গে বলে উঠল।
শুধু সুমন চুপ। বিবেকানন্দ-হলে সবার সামনে বিচার হবে নাকি সুমনের? পরেশদা কখন কার কাছ থেকে জানলেন সুমনের অপরাধের কথাটা।
সোমনাথ বলল, মুক্তিদা আজ চলে যাচ্ছেন, তাঁকে আমরা ফেয়ারওয়েল দিচ্ছি। এসো তোমরা, দেরি কোরো না।
মুক্তিদা চলে যাচ্ছেন? কোথায় চলে যাচ্ছেন?
বিদেশে। আজ রাত্রে দিল্লি, সেখান থেকে-- তোমরা কিছু জানো না? না, ওরা কেউ কিছু জানে না। মুক্তিদা তো কিছু বলেননি। সবাই থমথমে মুখে কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে বিবেকানন্দ-হলে এসে হাজির হল। মস্ত, হলঘর গমগম করছে। সবাই এসেছে। মাস্টারমশাইদের মাঝখানে হেডস্যার। লাল ভেলভেটে মোড়া একখানা চেয়ারে বসে আছেন মুক্তিদা। হাসিমুখে। আজ রাত্রেই চলে যাবেন! কী আশ্চর্য, ওরা কেউ কিছুই জানে না!
ক্লাস সিক্সের সুনীল বলল, আমি মুক্তিদাকে এই সবুজ খাতাটা দিচ্ছি, তুই কী দিবি অমল?
অমল বলল, কী দেব? কিছুই আনিনি, জানি না তো। আমরা তো একটু আগে শুনলাম।
সুমন দেখল ক্লাস নাইন-টেনের ছেলেরা বেশ সুন্দর একটা প্যাকেটে কী যেন একটা দিচ্ছে।
অমল বলল, সত্যি আমরা একেবারে যা-তা ! নাইন-টেনকে দ্যাখ, এরই মধ্যে উপহারের ব্যবস্থা করে ফেলেছে।
এমন সময় দিব্যজ্যোতি ফিসফিস করে বলল, ক্লাস সেভেনও মুক্তিদাকে এই বুদ্ধমূর্তি আর কলমটা দেবে।
সবাই জানে ওটা দিব্যজ্যোতির একেবারে নিজস্ব জিনিস। মাত্র দু’দিন আগে ওর সেজোমামা ওকে পাঠিয়েছেন। দিব্যজ্যোতি বলল, সুমন, যা তুই এটা মুক্তিদা’র হাতে দিয়ে আয়। আশিস বলল, ঝগড়া ফিনিশ?
অমল বলল, তুই না এমন করিস! এখন আবার ঝগড়া কী? ক্লাস সেভেনে পড়ি।
সুমন বলল, না, আমি যাব না দিব্য, তুই দিয়ে আয়, আমি মুক্তিদা’র সঙ্গে আর কখনও কথা বলব না, কখনও না।
না, সুমন মুক্তিদা’র সঙ্গে আর কখনও কথা বলবে না। মুক্তিদা কী নিষ্ঠুর, হাসিমুখে চলে যাচ্ছেন! সুমন কখনও পারবে? বাড়িতে ছুটি কাটাতে গেলেও মুক্তিদা’র জন্যে ওর মাঝেমধ্যে কী মন খারাপ করে!
মা রাগ করে বলতেন, এ ছেলেকে নিয়ে আমি এখন কী করি? হস্টেলে থাকলে বলবে, কবে বাড়ি যাব? আবার বাড়ি এসেও হস্টেল-হস্টেল করে পাগল?
সুমন ভাবে, সত্যি তার মনটা যেন কেমন!
হস্টেলে কতদিন মা’র কথা ভেবে কষ্ট পেয়েছে। বাবার ওপর অভিমান। ছোটপিসি, ছোটকাকুকে রাগ করে লিখেছে, তোমরা তো বেশ আছ, বাড়িতে কত মজা করো। আর, আমি হস্টেলে-- আমার বুঝি কষ্ট হয় না?
প্রথম দিনই মুক্তিদা ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, একেবারে মিথ্যে কথা বলিস না, আর সবাইকে ভালবাসবি।
সুমনও তো তাই চেয়েছিল। সবাইকে সমান ভাবে ভালবাসতে। কিন্তু মুক্তিদাই সব কিছু অন্যরকম করে দিলেন। অন্য স্যাররা কি মুক্তিদার মতো চকোলেট, বিস্কুট কেড়েকুড়ে খান? মজাও কিছু কম করেন মুক্তিদা? ক্রিকেট খেলা শুরু হলেই বলবেন, আমি তোদের গোলকিপার হব। ক্রিকেটে আবার গোলকিপার কী? কিন্তু মুক্তিদা বলবেন, তা আমি জানি না -- আমার ভীষণ গোলকিপার হতে ইচ্ছে করছে।
কত ছুটির বিকেলে মুক্তিদা কত দেশ-বিদেশের গল্প করেছেন। মুক্তিদার আলমারি-বোঝাই বই। যখন-তখন সুমনরা নাড়াচাড়া করে দেখে। ছবি দেখে। গল্প শোনে। সুমনদের পরীক্ষা খারাপ হলেও মুক্তিদা কখনও বকবেন না। খুব দুঃখী-দুঃখী গলায় বলবেন, তোদের ওপর আমার অনেক আশা ছিল রে। তোরা যে শেষকালে এমনটি করবি আমি ভাবতেই পারিনি।
সৌমিত্র হঠাৎ বলল, তুই তো কোনও খবরই রাখিস না সেনাপতি। মুক্তিদা’র তো অনেক আগেই চলে যাওয়ার কথা। বাইরে যে-সব মিশন আছে সেগুলো দেখাশোনা করবেন।
সুমন বলে বসল, মুক্তিদা আমাকে চিঠি দিলেও আমি উত্তর দেব না।
সৌমিত্র কী যেন বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় পার্থরা ছুটে এসে বলল, সুমন, মুক্তিদা তোকে ডাকছেন, শিগগির। ওরা প্রায় জোর করেই মুক্তিদা’র কাছে নিয়ে গেল সুমনকে।
কাছে যেতেই মুক্তিদা বললেন, এই তুই আমার ওপর এত রেগেছিস কেন রে? বুঝেছি, সেদিন দু’গোলে হারিয়েছিলাম বলে তোর রাগ এখনও পড়েনি। কতবার তোকে বলেছি না খেলায় হারজিত নিয়ে মন-কষাকষি করা ভাল নয়।
সুমন হঠাৎ থমথমে গলায় বলে ওঠে, তুমি, তুমি চলে যাচ্ছ মুক্তিদা?
মুক্তিদা অবাক হয়ে বললেন, চলে যাচ্ছি মানে? তোদের ছেড়ে আমি আবার কোথায় যাব? যেতে পারি? আমি তো আবার ফিরে আসব। মুক্তিদা সুমনকে জড়িয়ে ধরলেন।
পরেশদা এসে বললেন, এই দুষ্টু ছেলেটাকে আপনি আর আদর দেবেন না তো। ও কী করেছে জানেন? আমি বাগানের ভেতরে যে বাড়িটা তৈরি করছিলাম, সেটা ভেঙে ফেলেছে।
মুক্তিদা বললেন, সে কী!
পরেশদা বললেন, ওই বড়িটাতে আমি হাত দেওয়ার সময় থেকেই ও বাগানে ঘোরাঘুরি করত। মাঝেমধ্যে হাত দিয়েও দেখত। এখন গেল তো ভেঙে! দিব্যজ্যোতি, অমল, আশিস, সুমিত প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল, পরেশদা!
একটু অপ্রস্তুত মুখে পরেশদা বললেন, তোমাদের সেনাপতিকে কি কিছুই বলা যাবে না? শুনেছি তোমাদের কাছে ও কান্নাকাটি করেছে, দোষ স্বীকার করেছে। কিন্তু একটুখানি বকুনি দেওয়া উচিত ওকে।
মুক্তিদা বললেন, সেনাপতির কী শাস্তি হওয়া উচিত, বলে দিচ্ছি। ঠিক ওইরকম একটা বাড়ি সুমনকে তৈরি করে দিতে হবে। পুজোর সময় ওই সুন্দর বাড়িটার মাঝখানে থাকবে একটা সোনালি ঘট আর তার পাশেই থাকবেন মা-সরস্বতী।
পরেশদা হাসলেন। বন্ধুরাও হাসল। সুমনের মস্ত ফাঁড়াটা কেটে গেল। তারা জানে, সুমন ঠিক পারবে। ওর এইসব দিকে খুব মাথা আছে।
মুক্তিদা চলে গেলেন। এই হস্টেল ছেড়ে, কলকাতা ছেড়ে, এমনকী, এত বড় এই ভারতবর্ষর মতন বিশাল দেশটা ছেড়ে সুদূর আমেরিকায়। কবে ফিরবেন --সুমন জানে না।
কিন্তু সুমনের মনেই হয় না যে, মুক্তিদা হস্টেলে নেই। মনে হয় এই একটু আগেই যেন উনি কোথাও বেরিয়েছেন। এখনই এসে পড়ে বলবেন, এ কী রে সেনাপতি, তুই চুপচাপ রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে যে!
সুমনের চোখ জলে ভরে ওঠে। মুক্তিদা’র বারান্দার কোণে ফুটে আছে টকটকে লাল গোলাপ। ওদিকে চাঁপার গাছটা ফুলে ফুলে হলুদ।
রবিবার দুপুরবেলা সুমন ঘর-বারান্দা করছে। এই সময়টা সুমনের খুব অস্থির-অস্থির লাগে। কে আসবেন -- মা, বাবা, না ছোটপিসি আর ছোটকাকু? সেই রবিবার মা আর পিসি এসেছিলেন, তারপর সাত-সাতটা দিন পার হয়ে গেছে। দুপুরের একটু পরেই সুমন তো অবাক। মা, বাবা, ছোটকাকু, ছোটপিসি তো এসেইছেন, সঙ্গে আছেন আবার সোমনাথকাকু। মাত্র তিন দিন আগে নিউ ইয়র্ক থেকে ফিরেছেন সোমনাথকাকু। তিনিই সকলকে সঙ্গে নিয়ে সুমনকে দেখতে এসেছেন।
এতজন একসঙ্গে! মনেই হয় না যে সুমন বাড়িতে নেই। গোটা বাড়ি আজ হস্টেলে চলে এসেছে।
আশিস বলল, এই সেই সোমনাথকাকু? কী সুন্দর দেখতে রে! ছ’ ফুট লম্বা আর...।
অমল বলল, খুব নামকরা ইঞ্জিনিয়ার। আমার মামার মুখেই কাকুর গল্প শুনেছি।
সুমনের সব বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করলেন সোমনাথকাকু, তারপর আর ঠিক ছ’দিন পর সরস্বতী পুজো, তখন আমি এসে নিয়ে যাব। ছুটিটা বাড়িতে কাটাবি। মা-বাবারও তাই মত।
বন্ধুরা শুধু ফিস ফিস করে বলল, কিন্তু সেনাপতি সেই কথা তুই ভুলে গেলি?
সুমন মাথা নাড়ে দু’দিকে। না, মোটেই সে ভোলেনি। পরেশদা’র হাতে তৈরি বাড়িটার মতন আর একটা বাড়ি সুমন তৈরি করে ফেলেছে প্রায়। পরেশদাই সাহায্য করেন। সরস্বতী পুজোর সময় সোনার মতন ঝকঝকে সেই গম্বুজটা ঠিক লাগানো হয়ে যাবে। এ-সব ফেলে সুমন এখন কী করে বাড়ি যায়! বাড়ির সবাই হয়তো দুঃখ পাবেন। মা রাগ করে মুখ ভারী করবেন। কিন্তু!
সুমন যে মুক্তিদাকে কথা দিয়েছিল। সে ভাঙা জিনিস জোড়া লাগাবে না। নতুন করে তৈরি করবে সব। সে-কথা এখন ও কী করে ভোলে? সুমন ভাবে আর ভাবে। কয়েক মুহূর্ত৷ সুমন আস্তে-আস্তে কপালে তিনটে টোকা মারে।
মুক্তিদা ঠিক এইরকম করতেন, কোনও কিছু ঠিক করার আগে।
আমি যাব না। আমি আমার কথা রাখব। সরস্বতী পুজোর দিন মণ্ডপের মাঝখানে ওই সুন্দর বাড়িটাকে বসাব। তার ঠিক মাথার ওপর ঝলমল করবে সোনার কলসির মতন গম্বুজ।
ঘোষণা করার ভঙ্গিতে সুমন বলল, আমি কিন্তু পুজোর সময় এখানেই থাকছি।
আশিস, অমল, প্রদীপ মন দিয়ে টিনটিন পড়ছিল। ওরা একসঙ্গে সুমনের দিকে তাকাল। ওরা বেশ ভাল করেই জানে যে, সুমন খুব বাড়ি-পাগল ছেলে। সেই সুমন বাড়ি যেতে চাইছে না। পুজোর এতগুলো দিন হস্টেলে থাকবে!
এমন সময় হাঁপাতে-হাঁপাতে ঘরে এসে ঢোকে সৌমিত্র, ওর মুখে-চোখে উত্তেজনা।
সৌমিত্র একটু দম নিয়ে বলে, সুমন এবার অঙ্কে ফাস্ট হয়েছে। একশোর মধ্যে একশো। ললিতস্যার গল্প করছিলেন হেডস্যারের সঙ্গে। আমি শুনতে পেয়েই দৌড়ে এসেছি।
আশিস অবাক হয়ে বলল, একশোর মধ্যে একশো! সুমন তুই?
অমল গম্ভীরমুখে বলল, আমি জানতাম। সুমন এ-কথাটাও রাখবে। রোজ রাত্রে শোবার আগে আমরা যখন গল্প করতাম ও কী করত মনে নেই? সমানে অঙ্ক প্র্যাকটিস করেছে ও। তার ফল তো পাবেই।
বন্ধুরা হইহই করছিল। এমন সময় টিফিনের ঘণ্টা বাজল। লাইন দিয়ে টিফিন খেতে গেল সবাই। হাতে টিফিন নিয়ে সুমনের মন খারাপ। গরম দুধ আর রসগোল্লা। কোনওটাই কাঠবেড়ালি খাবে না।
গোমড়া মুখে সুমন ঢক-ঢক করে দুধটা খেয়ে ফেলে রসগ্নোল্লা দুটো তুলে নেয়। কাঠবেড়ালি কি রসগোল্লা খায়?
বিবেক রাগ করে বলল, মিষ্টিটা খেয়ে ফেল দেখি দয়া করে। তোমার জিনিস মজুত আছে।
বিবেকের হাতে মুড়ির ঠোঙা, বাদাম-ছোলা মেশানো, যাও যাও তোমার তেনাদের খাইয়ে এসো তাড়াতাড়ি।
বিবেক রাগ করে। বকুনি দেয়। কিন্তু সুমনের কাঠবেড়ালিদের পছন্দসই খাবারও জোগাড় করে। সুমন তাই কিছুতেই বিবেকের ওপর রাগ করতে পারে না। মুড়ির ঠোঙা হাতে নিয়ে সুমন বলল, বিবেকদা,আমার মা তোমাকে একটা জিনিস উপহার দিয়েছে। লাল টকটকে জামা তোমার খুব পছন্দ, না?
বিবেক হাত পাতে। দাও, এখনই দাও। আগে বলোনি কেন?
নারকেল বাগানের দিকে সুমন ছুট লাগায়। পেছন ফিরে বলল, আমার সুটকেসের মধ্যে জামাটা প্যাকেটে মোড়া আছে, তুমি নিয়ে নাও বিবেকদা।
বিবেকের.গায়ের রং কুচকুচে কালো। কিন্তু তার লাল জামা পরার খুব শখ। অন্য রং তার মনে ধরে না।
মুড়ির ঠোঙা হাতে নিয়ে সুমন বাগানের পাশ দিয়ে অশ্বত্থ গাছটার নীচে এসে দাঁড়ায়। চারদিক ছায়া-ছায়া। বিকেলবেলার আলো। সুমনের গা ছমছম করে। সুমন গাছের গুঁড়িতে মুখ রেখে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, তোমার কথা রেখেছি কিন্তু। কী, তুমি খুশি তো? মুক্তিদাকেও চিঠি দিয়ে জানিয়েছি।
অমনি স্-স্-স্ করে আওয়াজ উঠল। কে যেন পিঠের কাছে হাত রেখেছে। সুমন ভয় পায়। আবার খুশিও হয়। অশ্বত্থ গাছটা সত্যি যদি কথা বলতে পারত! কিংবা যদি চলতে-ফিরতে হেঁটে বেড়াতে পারত! সুমন তার কাকুর মুখে শুনেছে আফ্রিকার কোনও একটা জঙ্গলে এইরকম গাছ নাকি আছে। তারা ডাকলে সাড়া দেয়। গায়ে হাত দিলে চমকে ওঠে। আবার শব্দ ! ওহ্, কাঠবেড়ালি দুটো এসেছে। সুমন মুড়ি ছড়িয়ে দেয়। কাঠবেড়ালিরা টুকটাক মুখে তোলে। মাঝে-মাঝে দুটো পা তুলে দাঁড়িয়ে সুমনের দিকে তাকায়। সুমন হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, কী রে, হ্যান্ডশেক করবি নাকি? অন্যদিন হলে ওরা ঠিক পালিয়ে যেত। আজ দাঁড়িয়েই থাকে। ভয় পায় না। খুশিতে ঝিকমিক করে।
সুমন ভাবে, কাঠবেড়ালিগুলোও কি জানতে পেরেছে সুমন এবার পুজোর সময় বাড়ি যাবে না? হস্টেলে থাকবে। সেই গোলাপি বাড়িটার মাথায় লাগাবে সোনার গম্বুজ। তার সেই কথা রাখার ব্যাপারটা কি কাঠবেড়ালিরাও জেনে গেছে? তাই এত খুশি? নাকি সুমন অঙ্কে একশো পেয়েছে সে-কথাটাও বুঝে আজ এমন করে কাছে আসছে?
কোনটা সত্যি?
ঝুপ করে মস্ত একটা নারকেল পড়ল। সুমনের পাশে। সুমন অবাক। অশ্বত্থ গাছটার এদিকে নারকেল এল কীভাবে? এরকম তো কখনও হয়নি। সুমন নারকেলটা হাতে নিয়েই চমকে ওঠে। অশ্বত্থ গাছটা ডাকছে। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সুমন। অশ্বত্থ গাছটার কথা। সুমন, আমি সত্যিই খুশি। তুমি কথা রেখেছ সুমন। তোমার কথার দাম আছে। যাদের কথার দাম থাকে তারা জীবনে অনেক বড় হয়, আমি জানি তুমি অনেক বড় হবে।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment