লেখক: নীরদ হাজরা
প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
সাত
আলম বাড়ি ফিরে আসতে গোটা বাড়ি জুড়ে উৎসব শুরু হয়ে গেল।
মা ছুটে এলেন, বাবা এলেন, এলেন প্রতিবেশীরা। সংবাদ পওয়া মাত্র ছুটে এলেন মধুমালতীদিদি। হাসি-আনন্দ-কান্না, অথচ সব মিলিয়ে উৎসব। সবাই খুশি।
শুধু সে উৎসবে প্রাণ খুলে যোগ দিতে পারল না আলম নিজে। অবশ্য সাত-আট বছরে যে ছেলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছে, প্রায় ন বছর পরে যোল-সতের বছরে সেই ছেলে ফিরে এলে বাড়িকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। এটাই স্বাভাবিক। এজন্যে আলমের গম্ভীর হয়ে থাকায় কেউ কিছু মনে করলেন না।
থাকুক আলম গম্ভীর, না মিশুক সে সকলের সঙ্গে, তবু সকলে খুশি। খুশির মন্ত্রটা আরো বেশি এই কারণে যে, তারা অলমের যে পরিবর্তন আশঙ্কা করেছিলেন, তার কিছুই নেই আলমের মধ্যে। সেই গোবেচারা, সেই বোকা-বোকা ছেলেটই মাথায় কিছু লম্বা হয়ে ফিরে এসেছে। অথচ তারা কত দুশ্চিন্তাই না করেছিলেন!
অবশ্য দুশ্চিন্তা করাটা তাদের পক্ষে অন্যায় নয় কারণ সেকালে লোকে কলকাতা সম্পর্কে ভাল ধারণা পোষণ করতেন না। কলকাতা এক কুহকের দেশ। সেখানে আকাশ-ছোঁয়া বাড়ি, সান-বাঁধানো পথ, কল টিপলে জল। সেখানে মেয়েরা পুরুষের সামনে পথে বের হয়, বাজার করে, ঘোড়ায় চড়ে। সেখনে যে ছেলে যায়, সে কি আর ভাল থাকে? তার ওপরে যিনি আলমের কলকাতায় থাকার সংবাদ এনেছিলেন, তিনি প্রচার করেছিলেন যে, আলমকে তিনি কোন ভদ্র জায়গায় দেখেন নি। যেখানে মেয়েরা রঙ মেখে নাচে গায়, পুরুষের সঙ্গে মিশে থ্যাটার করে, সেই নরকের দ্বারে তিনি দেখে এসেছেন আলমকে।
এই সংবাদ শুনেই আরো কন্নাকাটি শুরু করেছিলেন আলমের মা। নইলে ন বছরে শোক তাঁর কমে এসেছিল। হারিয়ে-যাওয়া ছেলের জন্যে তাঁর চোখের জল যে কখনই ঝরত না, মন কখনই ভার হয়ে উঠত না, তা নয়, তবে মৃত্যুশোকের মত এ হারানোর শোকও তিনি মেনেই নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ছেলে বেঁচে আছে অথচ আছে অতি নোংরা জায়গায়, একথা শুনে তিনি আর স্থির থাকতে পারেন নি। আফতার মাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, তুমি শান্ত হও মা, আমি নিজে যাচ্ছি, তাকে নিয়ে ফিরে আসব।
সত্যিই নিয়ে এলেন আফতার, কিন্তু এ কোন আলমকে নিয়ে আসা হল?
মধুমালতীদিদি বললেন, সদ্য কলকাতা ছেড়ে এসেছে। ওর মন খারাপ থাকতেই পারে। এখানে মন বসতে সময় লাগবে।
একটু থেমে বললেন, এক কাজ করলে হয় না?
মা বললেন, কী?
আলমের বিয়ে দাও।
কথাটা মন্দ লাগল না মার। নূতন বাঁধনে বাঁধতে পারলে নিশ্চয়ই মন বসবে ছেলের। সত্যি সত্যি তো আর বিগড়ে যায় নি ছেলেটা। তাহলে এ কদিনে কিছুই বোঝা যেত না?
আলমের বিয়ের কথা সদু খাঁকে বললেন আলমের মা।
সদু খাঁ বললেন, বেশ কথা। দাও বিয়ে। কনে তো ঠিকই আছে।
মধুমালতীর মনে পড়ল কথা একটা দেওয়া আছে বটে। বাবার বন্ধু বসির মিয়া, তিনিও গানের রাজ্যের মানুষ। বাজান বাঁশি। এই বাজানোর সূত্রেই দুজনে বন্ধু। এই-সূত্রেই অনেক কাল আগে বসির মিয়ার মেয়ে মদনমঞ্জরীর সঙ্গে আলমের বিয়ের কথা হয়েছিল দুই বন্ধুতে। কিন্তু আজ কি বসির মিয়া মানবেন সে কথা? তাঁর মেয়ে মদনমঞ্জরীর বয়স বছর আট-নয় হল। মেয়েটিকে দেখেছেন মধুমালতী। ভারী মিষ্টি মুখখানা। সুন্দর গড়ন। ও মেয়ের পাত্রের অভাব হবে না। মধুমালতী ভাবছেন, এদিকে আমাদের ছেলের আবার বদনাম রটেছে-ঘর-পালানো ছেলে, কলকাতায় থেকেছে, তাকে দেখা গেছে অতি খারাপ জায়গায়। যদি বসির মিয়া রাজি না হন!
সদু খাঁ বললেন, হুঁ, রাজি না হলেই হল!
বাদানুবাদে আর কালক্ষেপ না করে পরদিনই পুরনো প্রস্তাব নূতন করে তোলা হল। বসির মিয়া লাফিয়ে উঠলেন, রাজি হব না মানে? কথার খেলাপ করব না কি? ও মেয়ের দুমাস বয়সে আমি কথা দিয়েছি না!
অতএব সাজ-সাজ রব পড়ে গেল দুই বাড়িতে। যাদের বিয়ে, তাদের একজন লাফিয়ে এক্কা-দোক্কা খেলতে থাকল, অন্য জন বসে রইল গুম হয়ে। তাদের জিজ্ঞাসা করবার কথা কেউ মনেও আনল না।
ধুমধামের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল আলমের।
সবচেয়ে আনন্দ করলেন মধুমালতীদিদি। তাঁর সবচেয়ে আদরের ভাই আলমের বৌ এল ঘরে, দিদি বৌকে যে কত ভাবে সাজালেন তার ঠিক নেই। আহা! ঘর আলো করা বৌ! এমন বৌ না এলে মানায়।
অনেক রাত হয়ে গেল শুতে।
নব বর-বধূকে ঘরে রেখে সকলে চলে গেলেন। সারাদিনের ধকলে মেয়েটা তখন অবসন্ন। কথা বলা দুরে থাক, যৌতুক পাওয়া টাকাগুলোও ভালো করে গুছিয়ে রাখতে পারল না সে। কোন ক্রমে সেগুলো মাথার কাছে ছড়িয়ে রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।
আলম এই প্রথম ভালো করে দেখল মেয়েটিকে। আহামরি কিছু বলে বোধ হল না তার। তার মনে প্রশ্ন জাগল? এই মেয়েটিই কি এসেছে তাকে সুরের জগৎ থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে?
কী করবে আলম? সে কি তার সুরের জগৎকে বিদায় জানাবে? এখানে এই গ্রামে বসে জমি চাষ করবে? মাছ ধরবে? মুরগী পুষবে? ছাগল পুষবে? গরুর দুধ দুইবে আর জাবনা মাখবে? মাথাটা গরম হয়ে উঠল আলমের। ঘুম এল না চোখে।
একসময় উঠে বসল আলম। মেয়েটার দিকে আবার তাকাল। তারপর ওর মাথার কাছে ছড়িয়ে থাকা যৌতুকের টাকাগুলো তুলে নিয়ে দরজা খুলে নেমে এল উঠোনে। বেশ সাবধানে পার হল বাড়ির উঠোন। আড়ালে আড়ালে পার হল গ্রাম। তারপর দে দৌড়!
একেবারে মানিকগঞ্জের স্টীমারঘাটে এসে থামল আলম।
* * * *
কলকাতায় এসে এবারও প্রথম গঙ্গার ঘাটে এল আলম। স্নান করতে নামতে সাহস পেল না। খানিক বসে থেকে হাঁটা শুরু করল পূবমুখো। টাকাগুলোর একটা গতি করা দরকার। এ টাকা যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণই হারাবার ভয়। তার থেকে যে জন্যে বৌয়ের টাকা চুরি করে এনেছে আলম সেটা সেরে নেওয়া যাক।
চিৎপুর রোডের ওপরে একটা বাদ্যযন্ত্রের দোকান আলমের পরিচিত। মিনার্ভার তবলা ছইতে বা অন্যান্য যন্ত্র সারাতে এ- দোকানে এসেছে আলম। অনেক সময় মালিক সুর বাঁধতে বাঁধতে বলেছেন, শোন তো প্রসন্ন, সুরটা ঠিক উঠছে কি না! আশ্চর্য কান লোকটার, প্রসন্নের কানকেও তারিফ করেন তিনি। সেই দোকানের সামনে গিয়ে বসে রইল আলম।
দোকান খুলতে এসে আলমকে দেখে দোকানী বললেন, কী গো প্রসন্ন বিশ্বেস, পালিয়েছিলে কোথায়? আজ হঠাৎ কী মনে করে?
আলম বলল, একখান বেহালা কিনুম।
বেহালা কিনবে? দোকান খুলতেই এমন খদ্দের! মনে মনে খুবই খুশি হলেন দোকানী। প্রসন্ন তাঁর স্নেহেরও পাত্র। অপাত্রে কত যন্ত্রই তো বিক্রি করেন, তাতে লাভও হয়, কিন্তু মন ভরে না। যোগ্য হাতে একটা নিজের তৈরি যন্ত্র তুলে দেওয়ার আনন্দ কম নয়।
দোকানী অনেক বেছে একটি যন্ত্র তুলে দিলেন প্রসন্নের হাতে। যন্ত্র হাতে নিয়েও যেন বিশ্বাস হয় না আলমের ষে, এ যন্ত্র তার। ভাগ্যিস দাদা নিয়ে গিয়েছিলেন আর দিদি বিয়ে ঠিক করেছিলেন। এই মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়া মেয়েটিকে মনে পড়ল আলমের। দুঃখ হল। তবু ভাবল, দুঃখ কর। তুমিও দুঃখ কর, আমিও। এই দুঃখ দিয়েই আমরা একদিন সুরকে জয় করব, তোমাকেও সুরের স্বর্গে নিয়ে যাব দেবী।
দোকানীর সামনে সব টাকা নামিয়ে দিল আলম।
দোকানী গুনে বললেন, এত টাকা কী হবে প্রসন্ন? আলম বলল, বেশী হইছে? তবে, একখান ক্ল্যারিওনেটও দিয়ে দেন। হিসাব কষলেন দোকানী, কয়েক টাকা কম হয়। তাহোক, তিনি সেরা ক্লারিওনেটখানা এনে দিলেন আলমকে। যন্ত্রদুটো হাতে পেয়ে কি ভেবে দোকানীকে একটা প্রণাম করে ফেলল আলম। দোকানী তাকে বুকে জড়িয়ে বললেন, তুমি মস্ত মানুষ হবে প্রসন্ন, হবেই!
দোকান থেকে নেমে আলম যেন শূন্য দিয়ে হেঁটে চলল। দুহাতে দুই যন্ত্র। বুকভরা আনন্দ। কিন্তু মগজে কোন চিন্তা-ভাবনাই আসছে না। অভ্যাসবশে একেবারে পাথুরেঘাটা ঠাকুরবাড়ি গিয়ে উঠল আলম। গেটের সেপাইদের দেখে হঠাৎ তার মনে হল, এখানে কার কাছে এসেছে সে? গুরু তো নেই তার, অনেক আগে স্বর্গে গেছেন। তবে?
সেখান থেকে ঘুরে একবার ডাক্তার কেদার বোসের বাড়ির সামনে থামল আলম। ওঁর দয়াতেই আলমের শিক্ষার শুরু। গুরুর গুরু তিনি। কিন্তু সেখানেও এখন ওঠা যায় না। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, ঘরের টানাটানি। দেখলে অবশ্যই ডাক্তার-গিন্নি ওকে টেনে নেবেন। সাক্ষাৎ জননী। কিন্তু অন্যকে বিব্রত করবে না আলম। দুঃখ যা বইবার, নিজেই বইবে। অবশ্য এখন দুঃখের ভাগ নেবার আরো একজন হয়েছে। নিচ্ছেও। ভাগীদার পাওয়ার গর্বে আলম পথেই হাঁটতে থাকে। একসময় মিনার্ভা থিয়েটারের সামনে এল আলম। এবার ক্ষিদে লেগেছে। এখন আর সে কলকাতার দোকানকে ভয় করে না, যে কোন খাবারের দোকানে ঢুকে খাবার কিনে খাওয়ার সাহস তার আছে। কিন্তু পকেট যে শূণ্য, সব উজাড় করেই তো হাতে এসেছে বেহালা আর ক্ল্যারিওনেট। যন্ত্রদুটো বুকে চেপে ধরে ক্ষিদে ভুলতে চেষ্টা করল আলম।
অবশেষে সেই লঙ্গরখানাতেই খাবার মিলল আলমের। খেয়েদেয়ে সে ছুটল লেবো সহেবের বাড়ি। সেখানেও হতাশ হল আলম। সাহেব-মেমসাহেবে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, মেমসাহেব চলে গেছেন কোথায়। আর সেই থেকে লেবো সাহেব দিন-রাত অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় থাকেন।
লেবো সাহেবের বাড়ি থেকে বের হল যখন আলম তখন গভীর রাত। অকল্যাণ্ড প্যালেসের বারান্দায় শুয়ে রাত কাটিয়ে দিল সে। যন্ত্র দুটোর জন্য ঘুম গাঢ় হল না। চোর-ছ্যাঁচড়ও জেগে ওঠবার আগে উঠল আলম।
গঙ্গার পাড়ে যন্ত্র রেখে যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়েই কটা ডুব মারল। তারপর গা মুছে শুদ্ধ হয়ে বসে নদীর পাড়েই বেহালা খুলে বসল।
অনেকক্ষণ বাজাল আলম। কিন্তু তন্ময় হতে পারল না। মন তার অস্থির। গুরু চাই, শিক্ষার যে অনেক বাকি, জীবন যে খুবই ছোট! একটা দিন ব্যর্থ হওয়া মনে যে অনেক পিছিয়ে যাওয়া। আলম কোথায় যাবে? কার সঙ্গে পরামর্শ করবে? হঠাৎই হাবু দত্তের কথা মনে হল আলমের। ছুটল।
কিন্তু এই কটা দিনের ব্যবধানে তার পৃথিবীর যে কত পরিবর্তন ঘটেছে, তা জানে না আলম। হাবু দত্তের স্বাস্থ্য কোন দিনই ভালো নয় তেমন। নিয়মরীতিও কিছুই মানেন না তিনি, হাঁপানির টানে প্রায়ই কষ্ট পান। এখন না কি বুকের দোষ ধরা পড়েছে।
হাবু দত্তের অবস্থা দেখে বুকের ভিতর কেমন করে উঠল আলমের। নিজের জীবনের ভাগ দিয়ে যদি গুরুর বেদনা দূর করা যায়, করবে আলম। ওকে দেখে টেনে টেনে থেমে থেমে কথা বললেন হাবু দত্ত। তারপর বিছানায় শুয়ে হাঁপাতে থাকলেন। গভীর মমতায় আলম হাবু দত্তের পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে থাকল।
অনেকক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়লেন হাবু দত্ত। আলম আস্তে আস্তে উঠল। শেষ, আলমের সুর শেখা শেষ! আর গুরু কই?
হঠাৎই একদিন আলমের মনে ভেসে উঠল একটা নাম। কোনদিন তাঁকে দেখে নি সে। মিয়া তানসেনের বংশধর তিনি। একসময় নিজেই আগ্রহভরে শিখিয়েছিলেন আলমের বাবাকে৷ তার বাবার বাজানো সে সুর আজও তার বুকের মধ্যে বেঁচে আছে। সে সুর সে কারো কাছে শেখে নি, অথচ রয়েছে তার রক্তে, তার চেতনায়।
আর এমনই মূর্খ সে যে, তাঁর কাছে না গিয়ে কলকাতার পথে পথে ঘুরে মরছে!
কিন্তু কোথায় কাশেম খাঁ? তিনি কি তখনও আছেন রাজা জগৎকিশোরের বাড়ি? সেসব কিছুই ভাবল না আলম। যন্ত্রদুটো নিয়ে সোজা ছুটে চলল।
আট
রেলগাড়িতে, স্টীমারে এবং তারপর পায়ে হেঁটে প্রায় দুশো মাইল পথ অতিক্রম করে এল আলম। এসে পৌঁছল মুক্তগাছায় রাজা জগৎকিশোরের বাড়িতে।
কিন্তু কেমন করে রাজার সামনে, উপস্থি৩ হবে আলম? সিংহদরজার দুটি সিংহ, হাঁ করে লাফিয়ে পড়ে বুঝি! না, ওগুলো মাটির। আলমের মনে হল, গোটা বাড়িটাই বুঝি হাঁ করে আছে ওর দিকে। ও কি পালাবে? নাঃ। শেষ না দেখে ও ফিরবে না।
যন্ত্রদুটো আবার বুকের ওপর চেপে ধরল আলম। যেন মস্ত আশ্বাস পেলে। তারপর রাজবাড়ির চারিদিকে ঘুরতে থাকল।
দেখার জিনিস তো কম নেই! দুচোখ ভরে দেখতে থাকল আলম। হাঁ করেই দেখতে থাকল। সহসা এক চিৎকারে চমকে ওঠে সে। কে একজন তার পিঠে খোঁচা দিয়ে বলছে, এই, কী চাস?
এক সিপাই। আলম ভাবলঃ রাজবাড়িতে তো ঢুকিনি বাপু? তবে এত হাঁক-ডাক কেন? আলম জানত না ষে রাজবাড়ির বাইরেও রাজার বাড়ির অংশ থাকে। সেখানে ঢোকাও নিষেধ।
আলম আসলে তখন রাজার উদ্যানে ঘুরছে। পাশেই পুকুর। রাজা জগৎকিশোর তখন বন্ধুদের সঙ্গে মাছ ধরছেন। সিপাই তাকে ঐ যন্ত্রদুটির চোর ভেবেই ধরেছিল।
ব্যাপারটা অন্যরকম হতে পারত। কিন্তু আলমের ভাগ্য ভালো, ঘটনাটা জগৎকিশোরের চোখে পড়ে গেল। তিনি সিপাইকে ডাকলেন, লোকটাকে তাঁর কাছে আনতে বললেন।
আলম তখন কি ছাই জানে, যে লোকটির সামনে তাকে উপস্থিত করা হচ্ছে, তিনিই স্বয়ং রাজা? হালকা মাজা গায়ের রঙ, মুখে পাতলা দাড়ি, ফতুয়া গায়ে, ছিপ-হাতে লোকটাই যে রাজা, একথা স্বপ্নেও ভাবে নি আলম। এমন একটা লোকের সামনে যখন তাকে উপস্থিত করা হল, সঙ্গী লোকগুলো যখন তাকে ছিঁচকে চোর বলে বিদ্রুপ করল, তখন কোথা থেকে একটা তেজি মন ফুঁসে উঠল আলমের মধ্যে। সে বলল, আমি উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। আমার পিতা উস্তাদ সদু খাঁ। বাড়ি শিবপুর। কলকাতায় আমার ন্যায় উস্তাদ নাই।
হালকা দাড়ি-মুখে লোকটি গভীর মনোযোগে শুনলেন আলমের কথা। সস্নেহে বললেন, তুমি কলকাতা থেকে এসেছ? ওস্তাদ?
আলম সেলাম জানাল। বলল, জি হাঁ।
লোকটি তাকালেন প্রহরীর দিকে। বললেন, ওর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও। কাল ওকে রাজদরবারে উপস্থিত করবে।
সিপাহীটি এবার সমীহের সঙ্গে নিয়ে গেল আলমকে। লোকটির সঙ্গীরাও আর উপহাস করল না। আলম বুঝল, এ জয় প্রকৃত জয় নয়, তার প্রকৃত পরীক্ষা হবে আগামীকাল সকালে।
রাজার অতিথিশালায় ষোড়শোপচারে খেয়ে কোমল শয্যায় শুয়ে ঘুম এল না আলমের। তার গোটা সঙ্গীতশিক্ষার জীবনটা যেন ছায়াছবির মতো ভেসে গেল চোখের সামনে। কাল কি সে পরবে রাজার চিত্ত জয় করতে? খানিকটা আশ্বাসও পেল। সে তো কম শেখে নি। গোপালকৃষ্ণের কাছে সাত-সাতটা বছরের তালিম, হাবু দত্তের শিক্ষণ, লেবো সাহেবের দান, হাজারী ওস্তাদের আশীর্বাদ, এসবের পরেও থিয়েটারের চুটকি গান। মাঠে-ঘাটে ছড়িয়ে থাকা ভাটিয়ালি, বাউল, রামপ্রসাদী-কী না সংগ্রহ করেছে সে? তাল-বাদ্য, তার-বাদ্য ফুঁ-বাদ্য-কী না শিখেছে? এত শেখে কজন?
এমন সব কথা ভাবতে ভাবতে একটা ভরসায় বুক ভরে গেল আলমের, শান্তিতে চোখ বুজে এল। কখন এক সময় ঘুমিয়েও পড়ল সে।
গাঢ় ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল আলম। সে যেন এক বিচিত্র পরিবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নানা রঙের আলোর ফোয়ারা যেন এক অবিরল ধারায় এসে মিলে-মিশে জলের মতো বিন্দু বিন্দু ঝরে পড়ছে। সেই আলোর জালের নেপথ্যে বুঝি বা এক রহস্য অপেক্ষা করছে।
কিসের রহস্য? কান পেতে শুনল আলম, একটা সুর। একটা মিঠে সুর। সুরটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যেন। আশ্চর্য সুরটা দৃশ্যমান রূপ ধরে আলমের চোখের সামনে ছায়া-ছায়া ভেসে বেড়াতে থাকল। অর্ধেক ঘুমে, অর্ধেক জাগরণে আলম উপলব্ধি করতে পারল কোমল রে’-র ছায়াটা রূপ নিতে নিতে যেন সা’-র স্পর্শে ভিন্ন রূপের আভাসে থরথর করে কাঁপতে থাকল। সঙ্গীতের এ-কী রূপ? এ রাজ্যে কোথা থেকে এল আলম? এসব সুর কি তার বুকের ভিতর থেকে জন্মাচ্ছে? যেখান থেকেই জন্মাক, এ সুরের কাছে তার সব শিক্ষা তুচ্ছ বোধ হল, তার এতদিনের সাধনা, এতদিনের শিক্ষা, একলহমায় অর্থহীন প্রমাণিত হয়ে গেল। .
সঙ্গীতের যদি এত রূপ থেকে থাকে, তবে সঙ্গীতের রাজ্যে প্রবেশ তো দূরের কথা, তার সিংহদ্বারেও উপস্থিত হতে পারে নি আলম। গতকাল পুকুরপাড়ের লোকগুলোর উপহাস শুনতে শুনতে আলমের মনে যে আত্মগৌরব-বোধ জেগে উঠেছিল, এই মুহূর্তে তার সবটুকু নির্মূল হয়ে গেল। একটা হাহাকার-ভরা মন নিয়ে জেগে উঠল আলম।
কিন্তু এ কী! জাগরণেও সে সুর কেন? তবে তো এ সুর স্বপ্নের নয়! এ তো তার বুকের ভিতর থেকে ওঠে নি, দৃশ্যমান এই জগতেরই সরোদের ওপর কারো ছড়ের টানে জেগে উঠছে এ সুর। যিনি বাজাচ্ছেন, তিনি মহাগুণী। ইনিই কি তবে মিয়া তানসেনের বংশধর, তার বাবার গুরু সেই কাশেম আলি? ভাবতেই সমস্ত দেহে শিহরণ খেলে গেল আলমের।
একটু বেলা হতেই আলমকে ডেকে আনা হল দরবারে। দরবারে ঢুকে প্রথমেই অবাক হল আলম। কালকের সেই অল্পদাড়িওয়ালা মানুষটি বসে আছেন সবচেয়ে দামী আসনে। ইনিই তবে রাজা জগৎকিশোর!
হায়রে, ভোরবেলা যে সুর শুনে নিজেকে নিঃস্ব বলে বোধ হয়েছে, সেই সুর যিনি অবিরত শুনছেন, তাঁরই সামনে কিনা সে নিজের পরিচয় দিয়েছে ওস্তাদ বলে! নিজেকে ঠক, প্রবঞ্চক, মিথ্যাবাদী বলে বোধ হল আলমের। ওস্তাদ হতে গিয়ে আলম হল কিনা প্রতারক?
আলম ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বলল, মহারাজ, আমি মিথ্যা কইছি। ভোরবেলা যে সুর শুনছি, তাতে বুঝছি, আমি সঙ্গীতের স-ও জানি না। আমারে শাস্তি দেন মহারাজা, শাস্তি দেন!
দরবারের সব নিয়ম লঙ্ঘন করে মহারাজের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল আলম।
জগৎকিশোর কি যেন ভাবলেন। তারপর তিনি তাকালেন তাঁর সভার ওস্তাদ আহম্মদ আলির দিকে। ইনিও তানসেনের আত্মীয়ের বংশের লোক। ইনি এমন কিছু রাগ জানেন, যা শুনলে মনে হয়, অন্য সব সঙ্গীতশিক্ষা, অর্থহীন। ওস্তাদ কি তেমন কিছু বাজিয়োছলেন ভোরে? তাই কি শুনেছে ছেলেটি?তা যদি হয়, তবে এ ছেলেটিও কম দরদী নয়। আহম্মদ খাঁর তারিফ করাও কম শিক্ষার কাজ নয়। জগৎকিশোর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন ওস্তাদের দিকে।
ওস্তাদ বললেন, জি হাঁ, আজ ভোরে আম টোরী রাগে আলাপ করেছি। এ বাচ্চা তা শুনে থাকতে পারে। আলম আবার পাগলের মতো বলে উঠল, মহারাজ! উনি বাজাইছিলেন ঐ বাজনা! হেই খোদা! আমারে ওনার গোলাম কইরা দেন মহারাজ!
এমন সরল এবং আবেগময় আকৃতি অনেককাল শোনেন নি জগৎকিশোর। তাঁর মন গলে গেল। তিনি তাকালেন ওস্তাদের দিকে। ওস্তাদ বললেন, আপনি যদি চান, আমি ওকে তালিম দেব রাজা।
আলম আবার কেঁদে উঠল।
রাজা আদেশ ঘোষণা করলেনঃ এই ছেলেটিকে এখন থেকে বরাদ্দমতো খাবার, পোশাক সব দেবে। ও ওস্তাদজির কাছে শিখবে।
আলমকে রাজার লোকেরা পৌঁছে দিল ওস্তাদজির বাড়িতে।
আর এক নূতন সাধনা শুরু হল আলমের।
* * * *
ক্রমে আলমের ভুল ভাঙ্গল। তার বাবার গুরু কাশেম খাঁ ইনি নন, তাঁরই এক আত্মীয় আহম্মদ আলি। তা হোক, গুরু তবু স্বর্গের দেবতা। আলম যেন তার ভৃত্যের ভৃত্য। গুরু দরজায় গেলে তাড়াতাড়ি চপ্পল এগিয়ে দেয় আলম, মুখে পানের পিক জমলে এগিয়ে ধরে পিকদানি। একটু গরম বাতাস বইলে আলম পাখা নিয়ে হাজির। ঘুমের আগে চলে পদসেবা। গুরুর কখন কী দরকার যেন আগে থেকে বোঝে আলম। নিত্য এমন সেবায় আহম্মদ আলি এমন হয়ে পড়লেন যে, আলম নইলে তাঁর এক মুহূর্ত চলে না।
কিন্তু শিক্ষা?
আহম্মদ আলি ভুলেও সে কথা মুখে আনেন না।
না আনুন। আলম তাতে পরোয়া করে না, নিজের ভিতর আর এক শক্তির সন্ধান পেয়েছে সে। গভীর মন দিয়ে সুর শুনলে ওর মনের ভিতরে যেন শিলালিপিতে তৈরী হয়ে যায় তার স্বরলিপি। আর কিছু চায় না আলম, আহম্মদ আলি যেন তাকে অবিরত তাঁর সঙ্গে থাকতে দেন।
এদিকে রামপুর ছেড়ে, বাড়ি-ঘর ছেড়ে অনেককাল এদেশে কাটিয়ে দিয়েছেন আহম্মদ আলি। এবার তাঁর মনে ঘরে ফেরার বাসনা জাগল। অর্থও জমেছে কম নয়। এবার বাঁধ গাঁটরি, চল মুসাফির।
কিন্তু না, অত সহজে তাঁকে ছাড়লেন না জগৎকিশোর। আহম্মদ আলি যদি চলেই যাবেন তো যাবার আগে আর একটা শিকার-যাত্রা হয়ে যাক। বিখ্যাত শিকারী রাজাসাহেব, ভারতজোড়া তাঁর নাম। মাঝে মাঝেই শিকারে যান তিনি। মস্ত তার আয়োজন। সঙ্গে যান রাজ গায়কের দল। দিনে শিকার, রাত্রে জলসা। দিন দশ-পনের পর ফেরেন রাজা। সঙ্গে চিতাবাঘ বা হাতীর মাথা। লোকে লোকারণ্য হয়ে ষায় রাজবাড়ি। ধন্য-ধন্য করে সবই।
আহম্মদ আলিকে নিয়ে আবার শিকারে গেলেন রাজা জগৎকিশোর। আলম রইল আহম্মদ আলির সকল কিছুর তত্ত্বাবধানে।
রাজবাড়িতে একটা হাল ছাড়া নৌকার ভাব এখন। কে কার খোঁজ রাখে। রাজা ফিরলে আবার শুরু হবে তৎপরতা। এখন অবসর।
কিন্তু বেশীদিন অবসর মিলল না এবার। তাড়াতাড়ি ফিরলেন রাজা। অপ্রত্যশিতভাবে সহজেই শিকার মিলেছে। খুব খুশি রাজা। কিন্তু রজবাড়িতে ফিরে উৎকর্ণ হয়ে উঠলেন ওস্তাদজি। ও কিসের সুর ভেসে আসে? এ যে তাঁরই নিজের সুর। কে বাজায়? প্রায় ছুটে চললেন ওস্তাদজি। তাঁরই ঘরের বন্ধ দরজা ভেদ করে আসছে আওয়াজ। জিন না কি? কিন্তু পাশের জানালা দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন আহন্মদ আলি। তার আসনের পায়ের কাছে বসে তণ্ময় হয়ে তাঁরই সুর বাজিয়ে চলেছে আলম। তাজ্জব কি বাত। ওকে শেখাল কে? হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন ওস্তাদ, দরওয়াজা খুল্ বেত্তমিজ।
দরজা খুলে মাথা নীচু করে দাঁড়াল আলম। তাড়াতাড়ি চপ্পল এগিয়ে দিয়ে বলল, দের হো গিয়া। গুস্তাকি মাপ কিজিয়ে ওস্তাদ।
আলমের সেবায় গোস্তাকি ভুললেন ওস্তাদ। কিন্তু তাঁর মনে একটা কাঁটা বিঁধে রইল। না শেখালেও নির্ভুল সুর তুলে নেয়, এ কে তার সঙ্গী? সুরের ডাকাত!
আহম্মদ আলি তবু আলমকে সঙ্গে নিয়েই বাড়ির দিকে-যাত্রা করলেন।
ওস্তাদ সোজা বাড়ি ফিরলেন না, রয়ে-বসে, এখানে থেমে, ওখানে দাঁড়িয়ে সর্বত্র দু পয়সা কামিয়ে তহবিল্ ভারী করতে করতে চললেন। এসব উপার্জনের ছিটেফোঁটাই আলমের ভাগ্যে জুটতে থাকল। না পেলেও আপত্তি নেই আলমের। সে চায় শুধু ওস্তাদের সঙ্গে থাকতে, শুনতে চায় তাঁর সুর।
অবশেষে পৌঁছল তারা রামপুরে। পাহাড়ী দেশ। নূতন আবহাওয়া, অতিরিক্ত শ্রম। দেহ যেন আর বইছে না আলমের, তবু সব জড়তা ঝেড়ে ফেলে আলম। শ্রম আর সেবার মূল্যেই যে তাকে কিনতে হবে সুর।
বাড়ি পৌঁছে আলমকে একেবরেই চাকর সাজালেন ওস্তাদ। বাড়ির সব কাজ বর্তাল আলমের ওপর, এমনকি গরু চরানোও। পরিবর্তে তার ভাগ্যে জেটে ঝড়তি-পড়তি খাবার, আর তার শোবার জায়গাটি মনোরম-- গোয়ালে গরুর বাচ্চার পাশে। ঝাঁঝে নাক জ্বলে যায়। আর কোথায়ই বা তাকে শুতে দেবেন গুরু, ঘরের সংখ্যা যে খুবই কম!
অবশেষে নিরূপায় আলম একদিন সঞ্চিত সব অর্থ তুলে দিল ওস্তাদের মায়ের হাতে। মিনার্ভার পাওনা টাকা, লেবো সাহেবের ব্যাণ্ডের মাইনে, ওস্তাদের সঙ্গে ঘোরার ভাগ--সব মিলিয়ে কয়েক হাজার। টাকা পেয়ে ওস্তাদের মা খুশি হলেন। আলমের থাকার স্থান বদল হল। খাবার মতো খাবার আসতে থাকল।
আলমের টাকায় ইঁট কাটানো হল, পোড়ানো হল, মজুরদের সঙ্গে আলমকেও বয়ে আনতে হল ইঁট। এখন শরীর আর বয় না আলমের। থেকে থেকে পেটে হয় অসহ্য যন্ত্রণা। আলম কি শেষে মুখ থুবড়ে পড়ে মরবে?
হয়ত আলমকে দেখে মনে মনে খুশি হলেন আহম্মদ আলি। তাঁর কাছে শিখতে চওয়ার যোগ্য পুরস্কার দিয়েছেন ছেলেটা কে। ব্যাটা দুফোঁটা চোখের জল ফেলেই কিনতে চেয়েছিল মিয়া তানসেনের সাধনার ধন! মনে মনে হয়ত আরো কঠোর কোন শাস্তির পরিকল্পনা ছিল তাঁর। কিন্তু তার আগেই ঘটনার মোড় ঘুরল অন্যদিকে।
গোয়ালিয়র থেকে তাঁর এক আত্মীয়ের আহ্বানে সেখানে গেছেন আহম্মদ আলি, বাড়ির সকলেও গেছে তাঁর সঙ্গে। আলমের মতো বিশ্বাসী লোক যখন রয়েছে, তখন ভাবনা কি? বাড়ির ভার অছে আলমের ওপর। নিশ্চিন্তে তাই গেছেন আহম্মদ আলি।
গোয়ালিয়র থেকে যথাকলে রামপুরে ফিরে বাড়ির কাছাকাছি এসেই চক্ষ চড়কগাছ তাঁর। আবার সেই সুর! উন্মত্তের মত ক্ষেপে গেলেন ওস্তাদ। সেবারের মত এবার আর ঘরের দরজা বন্ধ নেই। ওস্তাদ হিড়হিড় করে টেনে আনলেন আলমকে। বাড়ির বাইরে ঠেলে দিয়ে বললেন, নিকালো।
মাটিতে পড়ে গেল আলম। গুরু ফিরেও তাকালেন না। .
কিন্তু পড়ে যাওয়া ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মায়া হল আহম্মদ আলির মায়ের। তিনি তুললেন আলমকে। নিজের ছেলেকে চেনেন তিনি। ওখানে আলমের যে আর ভরসা নেই, তা তিনি বুঝেছেন। আহম্মদ আলির মা বললেন, বেটা! এ হেকিমে বেমার না সারলে দুসরা হেকিম দেখাতে হয়। দুনিয়ায় হেকিমের কি অভাব?
দুসরা হেকিম খোঁজার পালা শুরু হল আলমের।
নয়
সে রাতটা রামপুরেরর বড় মসজিদের দাওয়াতেই কাটিয়ে দিল আলম। ভোরবেলাতেও সেখানেই বসে রইল সে। এ ভোরেই এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল তার জীবনে। তখনকার ভারতের সবচেয়ে মানী গায়ক ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর দেখা পেল সে ঐ মসজিদের সামনেই এক জুড়িগাড়ির ভিতরে। তখনও তাঁর পরিচয় জানে না আলম। গাড়িটা যেতেই সকলে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল। আলম জিজ্ঞাসাকরল, উনি কে ভাই? জিজ্ঞাসিত লোকটি বললেন, ওঁকে চেন না! উনি ওয়াজির খাঁ। মিয়া তানসেনের কন্যার সাক্ষাৎ বংশধর।
গায়ে শিহরণ খেলে গেল আলমের। মনে হল, ওঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটাবার জন্যেই ভাগ্য তাকে এনে ফেলেছে এখানে। সে স্থির করল, যেমন করেই হোক, ওয়াজির খাঁর কাছে শিখতেই হবে।
এক উন্মাদনায় সারাদিন পাগলের মতো ঘুরে বেড়াল আলম, নাওয়া-খাওয়ার কথাও ভুলে গেল। সন্ধ্যায় এক সৈনিক-ক্লাবের কাছে আসতেই তার হাতে বেহালা আর ক্ল্যারিওনেট দেখে চেপে ধরল এক পাঠান সৈনিক।
চিৎকার করে উঠল- এতক্ষণে বুঝি শুধু তোকে পাঠিয়েছে? কে কাকে পাঠিয়েছে কিছুই বুঝল না আলম। পাঠানের হাত থেকে রেহাই পেল না। সৈনিকপ্রবর তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখল ব্যাণ্ডবাদকদের খাঁচায়।
ওদিকে সৈনিক-ক্লাবের গোটা হলটায় তখন উৎসবের আয়োজন চলছে। এখন উৎসব আলম না দেখেছে, এমন নয়। লেবো সাহেবের ব্যাণ্ডের দলে থাকাকালে এমন অনেক উৎসব দেখেছে সে। কিন্তু তাকে এনে আটকানো হল কেন?
সেই পাঠান সৈনিকটি আরো কয়েকবার ধমকে গেল আলমকে। ভয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করবার ভরসা পেল না আলম। ইতিমধ্যে সেখানে দলে দলে ক্যাপ্টেন, লেফটেন্যান্ট, মেজররা আসতে শুরু করেছেন। টেবিলে টেবিলে ডিকেন্টারে পানীয় সরবরাহ করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও তাস খেলা হচ্ছে। একসময় বিশেষ একজন অফিসার উপস্থিত হতেই সেই পাঠান এসে আলমকে বলল, বাজাও।
লেবো সাহেবকে স্মরণ করে আলম এক উত্তেজক বাজনা বাজাতে শুরু করল। উপস্থিত অফিসারদের রক্তে জাগল সুরের মাতন। কেউ কেউ উঠে নাচতে নাগলেন। একসময় আলম থামতেই চিৎকার উঠল-’দুসরা’। সেটা থামতেই আবার চিৎকার। একটার পর একটা বাজিয়েই চলল আলম। অফিসাররা লাফাচ্ছেন, নাচছেন, লুটিয়ে পড়ছেন। আলমের মনে হচ্ছে, ঐ পুতুলগুলোকে খেলাবার দড়ি তার হাতে। সে খুশিমতো হাসাতে পারে, কাঁদাতে পারে তাদের।
গভীর রাতে থামল আলম। উৎসব শেষ হল। সকলেই তারিফ করে গেল আলমের বাজনার। বিশেষ অফিসারটিও পিঠ চাপড়ে গেলেন তার। পাঠান সৈনিকটির পাথরের মতো মুখের অন্তরালেও যেন খুশির আবেশ। সকলে চলে যেতে পাঠান বলল, তোর জন্যে তোর বাবুকে ক্ষমা করলাম। যা।
কিন্তু কোথায় যাবে আলম? তার বাবুই বা কে?
আলমের কথায় পাঠান সৈনিকটি তো অবাক! তাহলে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত ষে ব্যান্ডমাস্টার সেদিন বাজাবার জন্যে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন, আলম তাঁর কেউ নয়! কে তবে? যেই হোক, সে না এলে যে পাঠান সৈনিকটিকে বেইজ্জত হতে হত! ছেলেটকে যেন ভগবান পাঠিয়েছিলেন ক্লাবের সামনে। আর ভাগ্যিস সে ভুল ভেবে টেনে এনেছিল আলমকে! আলমের প্রতি অতিরিক্ত প্রসন্ন হয়ে উঠল পাঠানটি। জিজ্ঞাসা করে করে সে জেনে নিল আলমের জীবন কথা। সব জেনে সৈনিকটি বলল, তাহলে এখন তোর থাকবার জায়গা নেই?
আলম ঘাড় নাড়ল।
সৈনিক কিছু বলবার আগেই তার পিছন থেকে রিনরিনে গলায় দুর্বোধ্য ভাষায় কে যেন কী বলে উঠল। আলম কিছু না বুঝলেও খুশি হয়ে উঠল সৈনিকটি। আলমের দিকে ফিরে বলল, আমার মেয়ে। তোর এখানে থাকবার ব্যবস্থা হল। আমি এখানকার কেয়ারটেকার। আমি যত দিন আছি, তত দিন তুইও থাকবি।
আলম তাকাল মেয়েটির দিকে। সালোয়ার-পাঞ্জাবী-পরা ফুটফুটে ফরসা মেয়েটা, একেবারে ডল পুতুলের মতো দেখতে। আলম বুঝল, এরই কথায় তার থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে। আলম মাথা নুইয়ে মেয়েটিকে সেলাম জানাল।
থাকবার ব্যবস্থা হল বটে আলমের, কিন্তু দেহ তার সেই রাতেই বিদ্রোহ ঘোষণা করল- শুরু হল অসহ্য পেটের যন্ত্রণা। দেড়দিন বেঘোরে তার জন্যে নির্দিষ্ট ঘরে পড়ে রইল আলম। দ্বিতীয় দিনের বিকেলে ক্লান্ত দেহে বাইরে এল সে। কিন্তু কেথায় সেই আশ্রয়দাতা পাঠান? অনুসন্ধান করে জানল, তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। পাঠানদের দেশে নাকি ইংরেজ পাঠানে যুদ্ধ হয়েছে। ঐ মেয়েটির স্বামী নাকি লড়েছে ইংরেজদের সঙ্গে। সেই সংবাদ পেয়ে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেছে পাঠানটিকে।
কিন্তু মেয়েটি? সে না কি কোথায় পালিয়েছে। পুলিশও তার সন্ধান পায় নি। মেয়েটির জন্যে স্বস্তি বোধ করল আলম। কিন্তু তার নিজের কি হবে? ভারপ্রাপ্ত আফসারটি জানাল, আলমকে কোথাও যেতে হবে না, সে নিজে থাকতে পারে এখানে। এখানকার ব্যাণ্ড দলে যোগও দিতে পারে। মাইনে হবে মাসে বারো টাকা।
উপস্থিত এ সুযোগ ছাড়ল না আলম। রামপুরে থাকতে গেলে এ সহায় তার চাই-ই। নইলে ওয়াজির খাঁর সঙ্গে সে মিলবে কী করে?
কিন্তু রামপুরে থেকেও ওয়াজির খাঁর সামনে যাওয়ার কোন সুযোগ করতে পারল না আলম। ওস্তাদের বাড়ির দারোয়ানেরা তাকে পাগলা কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিল। শহরের লোক তার কথা শুনে তাকে ভাবল পাগল। একজন বলল, স্বয়ং খোদাকে পাওয়া যেতে পারে, ওয়াজির খাঁকে নয়। তোমার দেহে কি তানসেনী রক্ত আছে? তবে?
হতাশা-চরম হতাশা ঘিরে ধরল আলমের মন। ওয়াজির খাঁর কাছে যদি তালিম না পাওয়া গেল তবে কিসের এ জীবন? তবে মরণই ভালো। মাসমাইনে হাতে পেতে দু তোলা আফিং কিনে ফেলল আলম। এখন হে মৃত্যু, তুমি এসে আমায় এ ব্যর্থ জীবন থেকে মুক্তি দাও।
সেই বড় মসজিদের দাওয়ায় এসে বসল আলম। তাকে দেখে ইমামের কেমন যেন সন্দেহ হল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার মনে কিসের মতলব, বাপধন?
আলম মিথ্যা বলে না। সত্যও গোপন করে না, বিশেষত মসজিদে দাঁড়িয়ে ইমামের সামনে। সত্যটাই বলল আলম।
ছেলেটার স্পষ্টবাদিতায় এবং সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহে খুবই খুশি হলেন ইমাম। এও তো একরকম সাধক, পূণ্যাত্মা। একে তো মরতে দেওয়া যায় না।
কিন্তু ওয়াজির খাঁও তো কম শক্ত ঠাঁই নন। ভারতীয় সঙ্গীত জগতে এক আভিজাত্য ও অহমিকার প্রতিমূর্তি তিনি। রামপুরে বাড়ি তাঁর। তাই রামপুরের রাজদরবারে যান মাত্র। স্বয়ং রাজা এবং রাজার বিশেষ অতিথি ছাড়া কাউকে গান শোনান না তিনি। একবার কাশ্মীরের মহারাজা নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ওয়াজির খাঁকে। তিনি যান নি। সেই ওয়াজির কি শেখাবেন এই চালচুলোহীন ছেলেটিকে?
অনেক ভেবে আলমকে এক আরজি লিখে দিলেন ইমাম। বললেন, তুমি এক কাজ কর। নবাবের সঙ্গে দেখা কর এই আরজি নিয়ে।
সহজ পথে যখন নবাবের সঙ্গে দেখা হল না তখন এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল আলম। সন্ধ্যায় নবাব যখন চলেছেন তাঁর আটঘোড়ায় টানা গাড়িতে চড়ে, বেহালা আর ক্ল্যারিওনেট নিয়ে আলম লাফিয়ে পড়ল গাড়ির সামনে। হৈহৈ করে উঠল সকলে। কোচোয়ান সবেগে রাশ টেনে সংযত করল ঘোড়াগুলোকে। নবাবের দেহরক্ষীরা হিঁচড়ে টেনে সরিয়ে আনল আলমকে। তারা হয়ত তাকে মেরেই ফেলত, কিন্তু নবাব দেখলেন, একখানা কাগজ তুলে কী যেন বলতে চাইছে ছেলেটা। নবাবের কৌতুহল হল। তিনি ওকে তাঁর সামনে আনতে বললেন। আলম এবার তার আরজিটা পেশ করার সুযোগ পেল।
নবাবের পি. এ. সেই আরজি পড়ে শোনালেন নবাবকে। ভ্রু কুঁচকে আলমের দিকে তাকালেন নবাব। লোকটা বাঙালী, বোমা-মারা বাঙালী! সারাদেশে বাঙালী মাত্রই আতঙ্ক। নবাব ভালো করে সার্চ করতে বললেন আলমকে। উঁহু, মতলব বোঝা যাচ্ছে না ওর।
কিন্তু সার্চ করে কিছুই বের হল না। শুধুই বেহালা আর ক্ল্যারিওনেট, আর পকেট থেকে বের হল কালো মতো একদলা কি যেন। গন্ধেই সেটা মালুম হল, আফিং।
বটে! নবাব আবার তাকালেন ছেলেটার দিকে। তাহলে আরজিতে যা লিখেছে, তা মিথ্যে না হতেও পারে। পাগল! পৃথিবীতে যে কত রকম পাগলই আছে! কী যেন ভাবলেন নবাব, একে বললেন, ওকে হামিদ মঞ্জিলে উপস্থিত কোরো।
অবাক হয়ে গেলেন নবাবের পি.এ.। হামিদ মঞ্জিল! নবাবের সঙ্গীতালয় হামিদ মঞ্জিল! সেখানে কয়েকশ সঙ্গীতশিল্পী থাকেন। তাঁদের সব ব্যয় নবাবের। সেখানে নবাব এবং তাঁর অনুমতি পাওয়া লোক ছাড়া আর কেউ ঢুকতে পারে না, সেখানে ঐ ভিখিরিটাকে?
নবাব বললেন, ব্যান্ড-মাস্টার মহম্মদ হুসেন খাঁ কে বলে দাও, ওর পরীক্ষা নিক। যদি পারে, আমার ব্যান্ড-দলে ওকে ভর্তি করে নাও। উচিতমতো বেতন মহম্মদ খাঁকেই সুপারিশ করতে বলো।
আলম সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করল -- না, আমি চাকরি করব না। হয় ওয়াজির খাঁর কাছে শিখব, নয় মরব। নবাব যদি ওয়াজির খাঁর কাছে আমার শিখবার ব্যবস্থা না করতে পারেন, তবে আমাকে মরতেও বাধা দিতে পারবেন না।
মনে মনে ক্ষেপে গেলেন নবাব। গোটা রামপুরে তাঁর সামনে এভাবে কেউ কথা বলতে পারে না। আশ্চর্য ঐ ছোকরার সাহস! অবশ্য ওর সাহসে এক নবীনতার স্পর্শে আনন্দও বোধ করলেন নবাব। রাগে এবং অনুরাগে গাড়ি ঘোরালেন নবাব। সোজা চললেন হামিদমঞ্জিলে। আলমকে টেনে নিয়ে গেলেন তাঁর নিজের সঙ্গীতসাধনার ঘরে। বললেন, পারবে আমার সঙ্গে সঙ্গত করতে?
বাঙ্গালের গোঁ ধরে আলম বলল, জি, পারুম।
নবাব বেহাগের হোরিতে এক গান ধরলেন। আলম অবলীলাক্রমে বাজিয়ে গেল তাঁর সঙ্গে। ছেলেটার তাল, মাত্রা, লয়ের জ্ঞান দেখে খুশি হলেন নবাব, গান থামল।
থামতেই আবেগে উছলে উঠল আলম--আহা হা! কি গান! হুজুর, মেহেরবান, আর একটা।
হাত জোড় করল আলম। .
নবাবকে এভাবে বলা. আদবের বিরুদ্ধ। কিন্তু আলমের কথার মধ্যে এমন অকৃত্রিম আবেদন ছিল যে, নবাব খুশিই হলেন। প্রশ্রয় দিলেন আলমকে, শুরু করলেন এক বিচিত্র গিটকিরি ভরা টপ্পা। আলম বেহালায় সুর হারিয়ে ফেলল। বলল, এ আমি জানি না নবাব, শিখবার চাই।
খুব খুশি নবাব। ছেলেটার শিক্ষা আছে, শিক্ষার আগ্রহও আছে। সত্যকার সঙ্গীত-পাগল। ওয়াজির খাঁকে তলব করলেন নবাব।
ওয়াজির খাঁ এলে নবাব তাঁকে নিভৃতে ছেলেটার সব কথা বললেন। বললেন আফিং এবং মৃত্যুর প্রতিজ্ঞার কথাও। তাঁর কথায় ওয়াজির খাঁর অটল গাম্ভীর্যে চিড় না ধরলেও কৌতূহলের ঝিলিক দেখা গেল তাঁর চোখে-মুখে।
আলমের ডাক পড়ল আবার। আবার তার হাতে তুলে দেওয়া হল বেহালা। আবার বাজাতে বলা হল।
এবার আলম বাজাতে শুরু করল সেই সুর যা শৈশবে তার কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশে ছিল, ষে সুর আলম মাঝে মাঝে শুনতে পায় রক্তের দোলায়। তা থেকেই সে নিজের চেষ্টায় তুলেছিল বেহালায়। সেই সুরই বাজিয়ে দিল আলম।
চমকে উঠলেন ওয়াজির খাঁ। বললেন, থাম! এ সুর তুমি কোথায় পেলে বালক?
আলম বলল, এ সুর বাবা বাজাতেন।
খাঁ সাহেব বললেন, কে তোমার বাবা? এ সুর কোথায় পেলেন তিনি।
আলম বলল, আমার বাবার নাম সফদর হুসেন খাঁ। গাঁয়ের লোক বলে সদু খাঁ। তিনি এ সুর শিখেছিলেন ত্রিপুরার রাজদরবারের ওস্তাদ কাশেম খাঁর কাছ থেকে।
কাশেম খাঁ! নামটা শুনে ওয়াজির খাঁ চমকে উঠলেন। নবাবের দিকে ফিরে বললেন, তাই বলি, সুদূর বাংলা মূলুকের এই ছোঁড়ার তারে তানসেনি সুর আসে কোথা থেকে? হুজুর! এই কাশেম আলি ছিলেন আমার মামা।
নবাব যেন আলো পেলেন। বললেন, ওস্তাদ, আপনার মামা যদি এর বাবাকে শিখিয়ে থাকেন, তবে আপনিও ওকে শেখাতে পারেন।
নবাবের দিকে তাকালেন ওয়াজির খাঁ। বললেন, আপনার ইচ্ছা, আমি ওকে শেখাই। বেশ, আপনার ইচ্ছাপূরণ হবে। আমি ওকে শিষ্য করে নেব।
শেষ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
Showing posts with label জীবনভিত্তিক. Show all posts
Showing posts with label জীবনভিত্তিক. Show all posts
বাজাও আমারে বাজাও (দ্বিতীয়াংশ)
লেখক: নীরদ হাজরা
প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
চার
দিনটা আলমের জীবনে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মায়ের মার বা বকাঝকা কিছুই তেমন করে গায়ে লাগে নি আলমের। কারণ, আলম তার আগেই বুঝে নিয়োছল কি চায় তার মন। গান আর বাজনা ছাড়া কিছুতেই বাঁচবে না আলম। আকাশের মাঝে, বাতাসের শব্দে, নদীর জলে কিসের যেন সুর শুনতে পায় সে। ঠিক না বুঝলেও তার মনে যেন কিসের ইশারা। কিন্তু কী করে সে সাড়া দেবে সেই ডাকে? বাবার স্নেহ, মায়ের ভালবাসা, দিদির আদর তাকে সব ভুলিয়ে রাখে। আলম বোঝে, এখানে থাকলে মায়ের শাসন এড়িয়ে সুরের রাজ্যে যাওয়া হবে না তার। কিন্তু এতজনের স্নেহের বন্ধনই বা সে কাটাবে কি করে? সেদিন মারের নির্যাতন এসেছিল আশীর্বাদ বহন করে। গোয়ালঘরে থাকতে থাকতেই সে স্থির করে ফেলেছে, এ বাড়িতে আর নয়, এ বাড়িতে কেউ সত্যিকারের ভালবাসে না তাকে। যদি ভালবাসত, তবে বুঝত তার মনের কথা। সেটাই যখন কেউ বুঝল না, তখন থাক পড়ে সবাই। আলম এ বাড়ি ত্যাগ করবে। এই মধুমালতীদিদি বের করে এনেছে তাকে, আদর করে খাইয়েছে, ঘুম পাড়িয়েছে। একটিও কথা বলে নি আলম, ঘুমের ভান করে পড়ে ছিল। একসময় মধুমালতীদিদি চলে গেছে, সকলের খাওয়া-দাওয়া সাঙ্গ হয়েছে, শুয়ে পড়েছে সবাই। তখনও অপেক্ষা করে থেকেছে আলম। রান্নাঘরে রয়েছেন মা। উঁকি দিয়ে দেখে বিছানা থেকে সন্তর্পণে নেমেছে সে। মা কোন হাঁড়িতে টাকা-পয়সা রাখেন তা জানা ছিল আলমের। আস্তে আস্তে গিয়ে সেই হাঁড়ি থেকে একখাবলায় যা উঠেছে তুলে নিয়েছে। তারপর আলনা থেকে নিজের একটা জামা নিয়ে টাকা কটা পুঁটলি করে রেখে দিয়েছে বালিশের নীচে।
তারপর একসময় মা এসে ঘরের দরজা বন্ধ করেছেন, রোজকার মতো শোবার আগে এসে দাঁড়িয়েছেন আলমের সামনে। গুটি মেরে ঝিম ধরে পড়ে থেকেছে আলম। মা একটা চাদর টেনে দিয়েছেন আলমের গায়ের উপর, ঘুমন্ত ছেলের মাথায় হাত বুলিয়েছেন। কিন্তু তাতে আলমের অভিমান বেড়েছে বই কমে নি, ওপাশ ফিরে শুয়েছে সে। একটু পরে মা চলে গেছেন।
তারপর নিঃশব্দে অপেক্ষা করেছে আলম। একসময় নিশ্চিন্ত হয়েছে মায়ের ঘুম সম্পর্কে। তখন ধীরে ধীরে উঠে তুলে নিয়েছে টাকা আর জামার পুঁটলিটা। তারপর দরজা খুলে দে-দৌড়। বন-বাদাড় ভেঙে পথ বিপথ মাড়িয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত না বেদম হয়েছে, ততক্ষণ ছুটেই চলেছে সে। ছেলেটা যেন এক দৌড়ে তার মা, বাবার স্পর্শকাতর এই পৃথিবীটা ছাড়িয়ে সুরের অন্য এক পৃথিবীতে গিয়ে পৌঁছাতে চায়।
খানিক থামল আলম। ঠিক পথেই এগুচ্ছে সে। এ তো মানিকনগরের আগের সেই হাওর। হাওরটার এদিক ওদিক দেখা যায় না, এত বড়। এই হাওর পেরিয়ে মানিকনগর। তারপর নদীর তীরে শ্যামগঞ্জের লঞ্চের ঘাট। এসব পথে কোনদিন যায় নি আলম। কিন্তু সাধুদের মুখে পথের বর্ণনা শুনে শুনে সব তার মুখস্থ।
এই হাওর সম্পর্ক আরো একটা কথা শুনেছে আলম। এখানে না কি অনেক জলার ভূত বাস করে। রাত হলে আগুন জ্বালে তারা। এখানে ওখানে দপদপিয়ে বেড়ায়। ইংরেজি পাঠশালায় পড়া বাবুদের বাড়ির ছেলেরা যদিও বলে ওগুলো ভূত নয়, আসলে একরকম গ্যাস, কিন্তু তা বিশ্বাস করে না আলম। গ্যাস যদি তবে অনবরত জ্বলে না কেন? বার বার জ্বলে নেভে কেন? কে বার বার জ্বালায়-নেভায়? হুঁ হুঁ বাবা, অত বোকা পাও নি আলমকে যে, যা-তা বলবে আর সে বিশ্বাস করবে! অনেক কিছু অবিশ্বাস করতে পারে আলম, কিন্তু ভূতকে নয়। শেষে অবিশ্বাসীকে বিশ্বাস করতে ঘাড়ে ধরুক আর কি!
এসব চিন্তা করে কিন্তু হাঁটা থামায় না আলম, তাকে যে সব পরিচিতের গণ্ডি ছাড়াতেই হবে! ভূতের কথা ভাবলে কী হবে, সত্যিকারের ভয়ডর বলে বোধ হয় কিছু নেই ছেলেটার। না হলে এই রাতে মাত্র আট বছরের ছেলে এমন করে পথ পাড়ি দিতে পারে?
কিন্তু ও কী! এই দুর্জয় সাহসী ছেলেটাও থমকে দাঁড়াল একবার। ঐ দূরে কটা আলো যেন জ্বলছে-নিভছে! কিসের একটা শোরগোল যেন। ভূতেদের মজলিস বসেছে বোধ হয়। তাই অত রোশনাই। কিন্তু রোশনাই করে আসর বসাবে কেন ভূতেরা? তারা তো অন্ধকারকেই ভালবাসে। দুহাতে ভালো করে চোখ মুছল আলম। আরো ক পা এগিয়ে এল। নাঃ, আলোগুলো তো জ্বলছেই শুধু, নিভছে না। নড়াচড়া করছে মাত্র। তবে কিসের আলো? ছুটতে থাকল আলম। আরো, কিছু পথ এসে বুঝল, সে হাওর ছাড়িয়ে, মানিকনগর ছাড়িয়ে শ্যামগঞ্জের লঞ্চঘাটে এসে গেছে। ঐ তো লঞ্চ!
সব দ্বিধা কাটিয়ে একদৌড়ে লঞ্চে গিয়ে উঠল আলম। খুবই ক্লান্ত শরীর। একটা কোণ দেখে যুত করে শুয়ে পড়ল আলম। যখন লঞ্চ ছাড়ে, ছাড়ুক।
আলমের যখন ঘুম ভাঙল, তখন বেশ বেলা হয়েছে। কিন্তু তখনও লঞ্চখানা দাঁড়িয়ে। ধক করে উঠল আলমের বুক, তবে কি সারারাত চলে নি লঞ্চখানা!
বাইরে এল আলম। না, এ তো ভিন্ন নদী, ভিন্ন শহর। তার সামনে যেন এক মস্ত মেলা। কত রকমের দোকান, কত রঙ, কত লোক!
ধীরে ধীরে লঞ্চ থেকে নামল আলম। তীরের দোকানগুলোর সামনে দিয়ে ঘুরল বারকয়েক। নানারকম দোকান থাকলেও বেশীর ভাগই খাবারের দোকান। আহার্যের বিচিত্র সুগন্ধে আলমের পেটের ভিতর থেকে ক্ষিধে যেন পাকিয়ে উঠতে লাগল। একটু নিরিবিলি জায়গা দেখে জামার পুঁটলি খুলল আলম। গুনল, গতরাতে অন্ধকারে একখাবলা যা এনেছে, তা নেহাত কম নয় -- বারো টাকা, তবু ভয় পেল আলম। সাহস করে কোন দোকানে ঢুকতে পারল না, পাছে তাকে ছোট বলে বের করে দেয়? কিংবা কেড়ে নেয় টাকা! থাক্ খাওয়া।
আপনমনে ঘুরতে লাগল আলম।
হঠাৎ এক জায়গায় যেন পরম প্রার্থিত বস্তু দেখে থমকে দাঁড়াল আলম। মুড়ি! একটা লোক মুড়ি বিক্রি করছে। আলমের মনে হল, লোকটা যেন তার কত দিনের চেনা। দোকানীর কাছে এসে এককোঁচড় মুড়ি নিল সে। দোকানী একটা টাকা ভাঙিয়ে তিন পয়সা নিয়ে বাকীটা ফেরত দিয়ে দিল।
কিন্তু ধীরেসুস্থে মুড়ি খাওয়া হল না আলমের। দৈত্যের মতো ভোঁ করে আওয়াজ করে জল তোলপাড় করতে করতে একখানা মস্ত বড় লঞ্চ এসে লাগল স্টেশনে। লোকজন স্টীমার এসেছে, স্টীমার এসেছে বলে তুমুল শোরগোল তুলল। আলম জানল, ঐ বড় লঞ্চগুলোকে স্টীমার বলে। একটা লোককে সে শুধাল, এটা কোথাকার স্টীমার?
লোকটা বলল, গোয়ালন্দের।
ভিড় ঠেলে পায়ে পায়ে আলম গিয়ে উঠল ঐ স্টীমারে। হৈ চৈ-চেঁচামেচি কাটিয়ে, প্রচুর লোক ও মাল নামিয়ে উঠিয়ে অবশেষে স্টীমারটা চলতে শুরু করল একসময়। একটা অদ্ভুত উল্লাসে ভরে উঠল আলমের মন। যেন সরস্বতীদেবীর হাঁস নিজে এসে ডানা মেলে তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সুরের রাজ্যে। আঃ কী তৃপ্তি! কী আনন্দ!
অবশ্য আলমের পক্ষে আরো আনন্দের এইজন্যে যে, গোটা স্টীমারটা ও তার জলযাত্রা দু-ই তার কাছে নতুন।
তাই বেশ কৌতূহলের বস্তু। ছেলেটা ভুলে গেল সব কিছু। গুটি গুটি পায়ে কৌতূহলী চোখ মেলে ঘুরে বেড়াতে লাগল একতলা-দোতলা, দেখল ইঞ্জিনঘর, ডেকের যাত্রীদের, দেখল কেবিন, মুরগীর খাঁচা, খালাসীদের থাকবার জায়গা। উপরে সারেংয়ের ঘরে উঠতে গিয়ে একবার ধমকও খেল সে। অবশেষে এসে দাঁড়িয়ে রইল রেলিংয়ের ধারে।
দুরে দূরে গ্রামগুলো কেমন করে মিলিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও পারে ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে, ফেনার রাজ্য তৈরি করে কত দূর পিছন পর্যন্ত চিহ্ন রেখে এগিয়ে যাচ্ছে স্টীমারটা!
আলমের সবচেয়ে মজা লাগছে, স্টীমার যখন কোথাও থামছে। স্টীমারের চাকা ঘোরায় নদীর জল তখন উথাল-পাথাল করছে। কী বড় বড় ঢেউ! যেন অত বড় স্টীমারটাকে গিলে ফেলবে। তারই মধ্যে মোচার খোলার মতো নৌকোগুলো নিয়ে এল ব্যাপারীরা। ঢেউয়ের মাথায় লাফিয়ে উঠছে নৌকোগুলো পাঁচ-সাত হাত, আবার নেমে যাচ্ছে দুই ঢেউয়ের মাঝে। এই বুঝি গেল ডুবে! না, ঐ তো ভেসে উঠেছে! আশ্চর্য, এই ওঠানামার ছন্দেই ওরা স্টীমারের যাত্রীদের হাতে তুলে দিচ্ছে দৈয়ের ভাঁড়, রসগোল্লা বা এরকম সব সওগাত। নিচ্ছে টাকা, দিচ্ছে খুচরো পয়সা। তন্ময় হয়ে লোকগুলোর অদ্ভুত কৌশল দেখতে থাকে আলম।
কিন্তু এ থামা কতক্ষণেরই বা! চলতেই থাকল স্টীমার। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। স্টীমারের মধ্যেও খাবারের দোকানের সন্ধান পেল আলম। কিন্তু কিনতে সাহস পেল না, যদি ছোট বলে তাকে না দেয়, যদি ধরে ফেলে যে, সে বাড়ি থেকে পালিয়েছে, যদি তাকে ধরে আবার বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। অতএব না খেয়েই দিনটা কাটিয়ে দিল আলম।
সন্ধ্যার গভীরে স্টীমার এসে থামল এক ঘাটে। লোকের কথা থেকে আলম বুঝল, এটাই গোয়ালন্দ ঘাট। সব যাত্রীই নেমে যাচ্ছে। অতএব জনস্রোতের সঙ্গেই নামল আলম। টিকিট-ফিকিট কেউ চাইল না তার কাছে। লক্ষ্যই করল না হয়ত।
কিন্তু এখানে কোথায় যাবে আলম! ভাবনা-চিন্তা না করে বেশীর ভাগ লোক যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকেই চলল সে। ওমা, এ কী! এ কিসে উঠছে সকলে? বাড়ির মতো মস্ত বড় বড় বাক্স। তাতে আবার চাকা লাগানো। লোকের কথা থেকে সে বুঝল, একে না কি রেলগাড়ি বলে। এও না কি গাড়ি! কলে চলে। হেই আল্লা! পৃথিবীতে কতই না জাদু! তাদের গাঁয়ের লোক এসবের কিস্যু জানে না। এদিক-ওদিক ঘুরে একটা গাড়িতে উঠে পড়ল আলম। তারপর প্রতীক্ষা করতে করতে কখন, যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে, তা নিজেও খেয়াল করে নি।
ভোরে ঘুম ভাঙল আলমের। গাড়িতে তখন তল্পি বাঁধবার তোড়জোড়-শিয়ালদহ আসছে। সেখানে গাড়ি একবারে থেমে যাবে। কেউ যাবেন হাওড়া, কেউ ঠনঠনিয়া, কেউ শ্যামবাজার। ধর্মতলারও নাম শুনল আলম। কেমন বিচিত্র সব নাম, দেশগুলিও বিচিত্র। তাহলে এখানে নামতে হবে আলমকেও। কিন্তু এই কি সেই দেশ? এই দেশেই কি পাবে আলম সেই সুরের সন্ধান? এখানেই কি আছেন তার সুরের গুরু? কে জানে! আলম তার ছোট্ট পুঁটলিতে এগারো টাকা একষট্টি পয়সা বেঁধে নিয়ে নেমে পড়ল শিয়ালদহে।
বাইরে এসে স্তম্ভিত হয়ে গেল আলম। এত বড় বাড়ি সে কল্পনাও করতে পারে না। ভেঙে পড়বে না তো মাথায়! থমকে দাঁড়াল আলম। নাঃ, পড়বে না। ঐ তো নদীর স্রোতের মতো লোক ছুটে চলেছে। কত রকমের গাড়ি! ঘোড়ায় টানা গাড়িগুলোরই বা বাহার কত!
কতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে দেখা যায়, অতএব সামনের রাস্তা বরাবর হাঁটতে থাকল আলম।
খানিকদূর এসে আলম একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যদিও পোশাক-আশাক ভিন্নরকম, তবু একদল ছেলেকে দেখতে পেল সে। বইপত্র নিয়ে চলেছে তারা। এই পরিচিত দৃশ্য দেখে বুঝি বা একটু খুশি হয়েই তাদের দিকে এগিয়ে গেল আলম। হিতে বিপরীত হল- এই মাথামোটা গাঁইয়া ছেলেটি তাদের খেলার উপাদান হয়ে উঠল। তারা কেউ আলমের জামা ধরে টান দেয়, কেউ দেয় মাথায় টোকা, কেউ বা ওর কান ধরেই নেড়ে দেয়। কটা ছেলে তো ওর টাকার পুঁটলি ধরেই টানাটানি শুরু করে দিল।
এ কি বিপদ। প্রাণপণে দুহাতে বুকের মধ্যে পুঁটলি জড়িয়ে ধরে দ্রুত হাঁটতে থাকল আলম। ছেলেগুলিও ছুটতে থাকল তার পিছনে। অবশ্য কয়েক মিনিট মাত্র, ওদের পাঠশালার পথ ছাড়িয়ে বেশী দূরে এল না তারা। আলম সেযাত্রা অব্যাহতি পেল। একবার পিছন ফিরে ওদের দেখল আলম। এই না কি শহরের ছেলে! বাবাঃ, দরকার নেই ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। হাঁটতে থাকল সে।
এবার বেশ ক্ষিদে পেয়েছে আলমের। তেষ্টাও। আশপাশে কোথাও খানা-ডোবা বা পুকুর দেখতে পেল না আলম। কী দেশ রে বাবা! এরা কি জল খায় না! জল না পেলে বাঁচবে কী করে আলম! হায় খোদা! এ কোথায় নিয়ে এলে তাকে?
ভাবতে না ভাবতেই আলমের চোখের সামনে ভেসে উঠল বিশাল এক নদীর ঘোলাটে জলের প্রবাহ। নদ নালার দেশের মানুষ আলম, নদী দেখেই ছুটে গেল সে। এই তো তার চেনা পৃথিবী। নদীতে নদীতে ভেদ নেই, সেই একই জল, একই গতি। খুশিতে আঁজলা ভরে জল তুলে মুখে দিল আলম।
হায় খোদা! এ কী জল! দেড় দিন আগে খাওয়া মুড়িগুলো পর্যন্ত পেট থেকে উঠে এল আলমের। নুনগোলা জল। থুথু করে উঠে পড়ল আলম। এদেশের ছেলেগুলোই শুধু বিচিত্র নয়, জলও। নিরুপায় ক্ষোভে কেঁদেই ফেলল আলম। এ কোন্ কুহকের দেশে এল সে!
পাঁচ
ক্ষুধা ও তৃষ্ণা-এ দুটি জৈবিক তাড়না একসময় আলমের কান্নাও থামিয়ে দিল। দুপুর গড়িয়ে হল বিকেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। হঠাৎই তার নজরে পড়ল নদীর ধারে --নদীটা যে গঙ্গা তখনও জানে নি সে -- একদল লোক কী যেন ভাজছে। খাচ্ছেও অনেক লোক। তাদের পোশাক-পারচ্ছদ খুব যে পরিষ্কার তা নয়।
অনেক সাহস সঞ্চয় করে দোকানের কাছে গেল আলম। খানিক দাঁড়িয়ে থেকে জানল, যা ভাজা হচ্ছে, তাকে বলে ডালপুরী। সেও গিয়ে হাত পেতে বসল। দুপয়সার ডালপুরী আর জল খেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেল আলম। কলকাতায় এই প্রথম স্বস্তিলাভ করল সে।
এবার ঘুম। খুব বেশি চিন্তা করল না আলম। কাছেই এক গাছতলায় জামার পুঁটলিটা মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়ল সে। ঘুম আসতে একটুও দেরি হল না।
সারারাত বেঘোরে ঘুমোল সে। চোখে সূর্যের আলো লাগতে ঘুম ভেঙে গেল তার। উঠে বসে চোখ রগড়ে ভালো করে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেল আলম -- মাথার তলার জামার পুঁটলিটা নেই! এদিক-ওদিক তন্নতন্ন করে খুঁজলে সে। কিন্তু নাঃ, কলকাতার জাদুতে টাকাসহ জামাটা হাওয়া হয়ে গেছে! নিঃসম্বল ছেলেটা হু-হু করে কাঁদতে থাকল।
খানিক বাদে আলমের কান্না থামল পিঠে এক খোঁচা খেয়ে। তাকিয়ে দেখল, ডাণ্ডা হাতে এক পুলিশ। পুলিশটা তার পিঠে খোঁচা দিয়ে বলল, এই ছোকরা, কাঁদছিস কেন?
-- আমার বোঁচকা চুরি গেছে সিপাইজি!
-- চুরি! কেইসে?
সব বলল আলম। কেঁদে কেঁদেই বলল। শুনে সিপাইটি দার্শনিকের মতো হাসল। বলল, কলকাতা আজব জায়গা বাবা। এখানে টাকাওয়ালা পুঁটলি যাবেই। যা, ভাগ্!
বলে এক গর্জন করে সিপাইজি নিজেই চলে গেলেন।
সেদিকে তাকিয়ে চোখ মুছল আলম। কেঁদে ফল নেই। এখানে বাবা নেই, মধুমালতীদিদিও নেই। এই অচেনা রাজ্যে তাকে একা লড়াই করতে হবে, বাঁচতে হবে। পূরণ করতে হবে নিজের আকাঙ্ক্ষা। আবার উঠে দাঁড়াল আলম। হাঁটতে থাকল নদীর ধার বরাবর।
হাঁটতে হাঁটতে আলম এসে পৌঁছল এক শ্মশানঘাটে। লোকের মুখে নাম শুনল নিমতলা শ্মশানঘাট।
শ্মশান এড়িয়ে চলল আলম। শ্মশান তো জীবনের শেষ, সে তো সুরহীনের রাজ্য। অতএব সেখানে গিয়ে আলমের লাভ? তবু চোখ ফেরাতে গিয়েও ফেরানো হল না। ওখানে তিন সাধু না? হ্যাঁ, সাধুই বটে।
গ্রামের শিব মন্দিরে সাধু-সংসর্গে এসেছে আলম, পেয়েছে সুরের ছোঁয়া। তাই সাধু দেখে এগিয়ে গেল আলম। কিন্তু কলকাতার সাধুরাও কি ভিন্ন রকমের? কণ্ঠে তাদের গান কোথায়? আলম দেখল, তাদের গলায় জবার মালা, হাতে রুদ্রাক্ষ, সামনে কাঠের স্তুপে আগুন। কেউ বা সিদ্ধি ঘুঁটছে। হতাশায় আলমের চোখে জল এল। হঠাৎ এক সাধু হাতের ইশারায় ডাকল তাকে।
আলম এাগিয়ে যেতে সাধু বলল, কাঁদছিস কেন রে ব্যাটা? কাকে খোয়ালি?
আলম আরো কাঁদে। বলে, সব সাধুবাবা সব। আমার যা কিছু টাকা-পয়সা, আমার জামা।
সাধু ব্যাপারটা আন্দাজ করে নেন। বলেন খেয়েছিস?
আলম ঘাড় নাড়ে।
সাধু বলেন, হাত পাত।
হাত পাততেই কী যেন দিলেন সাধু। বললেন, নে, খেয়ে ফেল্। খেয়ে ফেলল আলম। সাধু বললেন, যা ব্যাটা, হাঁটতে থাক্ পুবমুখো। খাবার মিলে যাবে। যা।
সাধুর কথামতো পুবমুখো তাই হাঁটতে থাকে আলম। দুপুর শেষ, হয়ে তখন বিকেল ছুঁই-ছুঁই। হাঁটতে হাঁটতে ডান হাতে এক মস্ত মাঠ পেরোতেই বহু লোককে রাস্তায় বসে খেতে দেখল আলম। একদল লোক বড় বড় পাত্র থেকে লোকগুলিকে খাবার দিচ্ছে। কে একজন ঠেলা দিল আলমকে। বলল, ব্যাটা আবার সঙের মতো দাঁড়িয়ে রইলি কেন! একখানা পাতা নিয়ে বসে পড় ওখানে।
ছুটে গিয়ে পাতার স্তুপ থেকে একখানা পাতা টেনে বসে পড়ল আলম। খেতে খেতে শুনতে পেল, এক ব্যবসায়ী না কি রোজ এমনি করে কাঙালী ভোজন করান। আলম মনে মনে বলল, বেঁচে থাকুন তিনি।
বারকয়েক চেয়ে নিয়ে পেটটা বেশ করে বোঝাই করে নিল আলম। সাধু বোধ হয় এখানে খাবার বিলির কথা জানতেন। তাই সোজা পুবমুখো হাঁটতে বলেছিলেন।
খাওয়া শেষ করেই জলের কথা মনে হল তার। অন্যরা কি করে লক্ষ্য করল আলম। দেখল, রাস্তার পাশে কী একটা টিপতেই জল ঝরছে। দিব্যি খাচ্ছে লোকে। সেও খেল। খুব মজা লাগল তার। নদীর জল খাওয়া যায় না, লবণগোলা, অথচ এখানে টুপ করে টিপলেই জল! যত ইচ্ছে খাও। সত্যিই আজব শহর কলকাতা!
খাওয়া-দাওয়া শেষ হতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। কি আর করবে আলম, পাশেই এক ভদ্রলোকের বাড়ির বাইরের রকে গা এলিয়ে দিল।
কয়েকটা দিন-রাত ঐ একই বারান্দায় কাটিয়ে দিল আলম। সারাদিনে আশপাশে একটু একটু ঘুরল সে। জানল, ঐ রাস্তাটার নাম বিডন স্ট্রীট। আসবার পথে ডানদিকে যে বাগান পড়েছিল, তার নাম কোম্পানির বাগান। সোজা পশ্চিমে গেলে নিমতলা শ্মশান আর তার পাশেই মা গঙ্গা। নোনা অপেয় জল হলেও গঙ্গাকে এখন ভক্তি করে আলম। ভোর না হতেই যারা গঙ্গা স্তোত্র পাঠ করতে করতে স্নান করতে ছোটে, আলমের বড় ভালো লাগে তাদের। ভালো লাগে স্তোত্রের সুরটাও। মন কাড়া সুর। আলম আরো একটা খবর সংগ্রহ করল।
যে ভদ্রলোকের বাড়ির বারান্দায় সে ঘুমোয়, তাঁকে লোকে বলে কেদারনাথ ডাক্তার। দূর থেকে উঁকি মেরে দেখেছে আলম, ডাক্তারবাবুর কী গম্ভীর মুখ! দেখলেই ভয় করে।
সারাদিন ঘোরে-ফেরে আলম আর ভাবে, এমনি করে আলস্যে দিন কাটাতেই কি বাড়ি থেকে পালাল সে? কোথায় সেই সুরের রাজ্য?
সেদিন বিকেলে আশ্চর্যভাবে এক বিচিত্র সুর কানে এল আলমের।
কোথায় বাজছে সেই সুর? ডাক্তারবাবুর বাড়িতেই কি? এ কোন্ বাজনা? ঠিক ধরতে পারল না আলম। ধরা সম্ভবও নয় তার পক্ষে, তার শোনার দৌড় তো খোল-করতাল, বাঁশি, একতারা আর তবলা-সেতার অবধি! পিয়ানোর মতো বিদেশী যন্ত্র আলম দেখেও নি, নামও শোনে নি। ডাক্তারবাবুর বাড়িতে পিয়ানো আছে। ডাক্তারবাবু নিজেই উদ্যোগী হয়ে কিনেছিলেন। সময় পেলে বাজান। ছেলেমেয়েরাও বাজায়। তেমনই কোন বাজনা এসেছে আলমের কানে।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো ডাক্তারবাবুর দরজার পাশে গিয়ে, কান পেতে রইল আলম। শুনতে শুনতে সে এত তন্ময় হয়ে গেল যে, কখন দরজা খুলে ডাক্তারবাবুর স্ত্রী বেরিয়ে এসেছেন তা সে খেয়ালই করে নি। ছেলেটাকে এভাবে থাকতে দেখে তিনি জিজ্ঞসা করলেন, কী চাস রে?
ছেলেটা যেন শুনতেই পেল না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে, কী চাস্ তুই?
এবার চোখ তুলে তাকাল আলম। বক্তার কণ্ঠস্বরে কোন বিরক্তি নেই৷ খানিক ভরসা পেল আলম। খাঁটি ত্রিপুরী ভাষায় বলল, আমি বাজনা শুনতাম আইছি।
-- বাজনা শুনবি? তুই থাকিস কোথায়?
এইটুকু স্নেহের স্পর্শও বুঝি সইতে পারল না আলম, ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ডাক্তারবাবুর স্ত্রী আদর করে তার চোখ মুছিয়ে দিলেন। তারপর প্রশ্ন করে জেনে নিলেন, ছেলেটি শুধু গান শিখবে বলে পালিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে। খায় নি ক’দিন, হারিয়েছে তার শেষ সম্বল। এখন সারাদিনে একবার খায়। তবু ভিক্ষে করে না।
ছেলেটার কথার সারল্যে, তার আকাঙ্খার বিশিষ্টতায় কী যেন একটা খুঁজে পেলেন ডাক্তারবাবুর স্ত্রী। আলমকে ডেকে ঘরে আনলেন তিনি। চাকরকে ডেকে কচুরি আনিয়ে পেট ভরে খাওয়ালেন ওকে। ওর নিজের কণ্ঠের গান শুনলেন। তারপর বললেন, তুই থাক্ আমার বাড়িতে। দেখি তোর কি ব্যবস্থা করা যায়।
ভেতরে ভেতরে তারপর কি কথাবার্তা হল জানে না আলম, তবে সেই রাত থেকে ডাক্তারবাবুর চিলেকোঠায় থাকা ব্যবস্থা হল তার। বাড়ির ছেলেদের পুরোনো কটা জামা-কাপড় ওর জুটল। চিলেকোঠায় শুয়ে আলমের আবার মনে হল, আজব কলকাতা! কোথা থেকে কী হয় কে বলবে!
পরদিন সকালে ডাক্তারবাবু স্বয়ং তাকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে চললেন। কোথায় চলেছেন জিজ্ঞেস করতে সাহস হল না তার। এপথ-ওপথ করে একটা মস্ত বড় বাড়ির সামনে এলেন ডাক্তারবাবু। আলম স্বপ্নেও এত বড়, এত সুন্দর বাড়ির কল্পনা করতে পারে না। যেদিকে তাকায়, তাতেই বিস্ময় আলমের। কত ফুল, কী বিরাট বিরাট থাম! ঘোড়াগুলো কেমন তেজস্বী। কী সুন্দর ঐ গাড়িটা। হেইরে! ওগুলো জ্যান্ত নয়, পাথরের মানুষ!
কিল্তু তার থেকেও বেশি বিস্ময় বোধ করল আলম, এত বড় পাথুরে বাড়িটার ভেতর থেকে সুর আসছে। সুর! যে সুরের জন্যে এমন করে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে আলম, এত কষ্ট সয়েছে, সেই সুর। ভেতর থেকে কি এক বেগ ঠেলে নিয়ে চলল আলমকে। ডাক্তারবাবু ছেলেটার সঙ্গে তাল রাখতে একটু জোরে পা চালাতে থাকলেন।
একটা ঘরের সামনে গিয়ে থমকে গেল আলম। ঘরের মধ্যে দরজার দিকে পিছন ফিরে বসে আছেন যিনি, কেমন করে আলমের মনে হল, তিনিই রাজা। আর তার উলটো দিকে ঐ তো চোখ বুজে গাইছেন গায়ক। পাশে তানপুরা বাজছে, সঙ্গত হচ্ছে মৃদঙ্গ। আলমের বুকের ভেতরটা সেই সুরে সুরে যেন নাচতে থাকল। কী করবে আলম? সে কি আনন্দে বিবশ হয়ে পড়ে যাবে? পাশের চৌকাঠ চেপে ধরল আলম।
একটু পরে সে ধাতস্থ হয়ে দেখে, ডাক্তারবাবু গিয়ে বসেছেন রাজার পাশে। এবার গায়কের হাতদুটির দিকে নজর গেল আলমের। কেমন যেন সরু সরু, সুরের সঙ্গে সঙ্গে কেমন থরথরিয়ে কাঁপছে। কে লোকটা?
একসময় গান শেষ হল। ডাক্তারবাবু রাজার সঙ্গে কী সব কথাবার্তা বললেন। রাজামশাই ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন আলমকে। ডাকলেন। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল আলম। বিশাল ঘরটার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল।
এপাশ থেকে রাজামশাই আর ওপাশ থেকে সেই গায়ক ভদ্রলোক দেখছেন আলমকে। আলম প্রথমে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। কিন্তু অচিরেই সে তন্ময় হয়ে গেল ঘরের অসংখ্য বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে। এত রকমের বাদ্যযন্ত্র আছে! আলম সব শিখবে, সব! এমন সময় গায়ক বললেন, হ্যাঁরে, তুই গান শিখবি বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিস?
আলম ঘাড় নাড়ল।
গান শিখতে গেলে যে কষ্ট সইতে হয়, তা সহ্য করতে পারবি?
আলম বলল, যে কোন কষ্ট আমি সইতাম পারুম। রাজা হাসলেন। বললেন, ওর মধ্যে নিষ্ঠা আছে গোপালবাবু। আপনি ওকে শেখান।
গোপালবাবু বললেন, রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের যখন ইচ্ছে, তখন নুলো গোপাল নিশ্চয়ই তার মূল্য দেবে।
বলে আলমের দিকে তাকিয়ে বললেন, কাল থেকে ভোরবেলা আমার বাড়িতে যাবি। আমি তোকে শেখাব। মনে রাখবি বারো বছর শুধু গলা সাধতে হবে। পারবি তো?
আবার ঘাড় নাড়ল আলম।
ছয়
পরদিন থেকে শুরু হয়ে গেল আলমের সঙ্গীতশিক্ষা।
ক্রমে সকলের পরিচয় জানল আলম। তাকে যিনি গান শেখাবার দায়িত্ব নিয়েছেন, তাঁর নাম গোপালকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। পক্ষাঘাতে তাঁর হাতদুটো শুকিয়ে গিয়েছিল বলে লোকে তাঁকে বলে নুলো গোপাল। তিনি নিজেও বলেন। কলকাতায় তো বটেই, কলকাতার বাইরেও ছড়িয়েছে গোপালের নাম।
গোপালকৃষ্ণ থাকেন রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়িতে। প্রথম দিন ঠিকই ভেবেছিল আলম। সেদিন যিনি ঘরের মধ্যে বসে গান শুনছিলেন, তিনি রাজা-ই। রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর। দ্বারকানাথ - দেবেন্দ্রনাথ - রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারেরই এক শাখা এই ঠাকুর পরিবার। এঁরাও সমপরিমাণে বিদ্যানুরাগী ও ধনী। সেকালের গান-বাজনায় ও নানারকম সাংস্কৃতিক উন্নতিতে এই ঠাকুরবাড়ির অবদানও কম নয়। সৌরীন্দ্রমোহনের আমল থেকে পাথুরেঘাটা ঠাকুরবাড়িতে বাংলাদেশের প্রায় সকল জ্ঞানী-গুণীজনেরই পদধূলি পড়েছে। সেই বাড়িতেই আলমের সঙ্গীত-সাধনা শুরু হল।
প্রতিদিন ভোরে নিমতলায় গিয়ে গঙ্গাস্নান করে আলম। তারপর সোজা চলে আসে পাথুরেঘাটায়। রাজার বাড়ি গুরু গোপালকৃষ্ণের ঘর তার চেনা, সোজা সেই ঘরে চলে যায় আলম। গুরুর নির্দেশমতো কাজ করে চলে। একবার মাত্র দুপুরের শেষে সেই ধনী বাড়ির কাঙালী-বিদায়ের খাওয়া খেতে যায়, রাত্রে আসে ডাক্তারবাবুর চিলেকোঠায়। এছাড়া একমুহূর্তও সময় নষ্ট করে না আলম, স্থির অবিচলভাবে মেতে থাকে তার সাধনায়।
গোপালকৃষ্ণ তাঁর এই ক্ষুদে শিষ্যের নিষ্ঠায় খুব খুশি, এই তো চাই। উপযুক্ত উপাদান পাওয়া গেছে, এখন একটু-একটু করে পালিশ দিতে হবে এর উপর, খাঁটি হীরে করে তুলতে হবে। এতে ধৈর্যহারা হলে হবে কেন?
ধৈর্যের এতটুকু কমতি নেই আলমের। চার বৎসর শুধু গুরুর গান আর তানপুরা-বাদন শুনেই কাটিয়ে দিল আলম। ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত হতে থাকল তার কান আর মন। একদিন স্বরগ্রামের সঙ্গে গলা মেলাতে দিলেন গুরু। সাতটি স্বরকে কত বিচিত্র সজ্জায় কত বিচিত্র ক্রমেই না সাজিয়ে দিলেন তিনি! আলম গুনে দেখল, একে একে তিনশ ষাট রকম পদ্ধতিতে গলা সাধার অভ্যাস করিয়েছেন গুরু।
আলমের স্বর-সাধনা কান পেতে শুনলেন গোপালকৃষ্ণ। যা চেয়েছিলেন, তা-ই হচ্ছে। সহজাত মিঠে গলা আলমের, এখন তাতে প্রত্যেকটা স্বরের প্রত্যেক শ্রুতি স্পষ্ট এবং শুদ্ধভাবে ধরা পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে দমও বেড়েছে। এইবার এর সঙ্গে মৃদঙ্গের বোল শেখাতে শুরু করলেন গুরুজি।
মৃদঙ্গ অবশ্য নিজে শেখালেন না গোপালকৃষ্ণ। তাঁর গানের সঙ্গে মৃদঙ্গ বা তবলা বাজাতেন, নন্দ ভট্টাচার্য। গুরুজির নির্দেশে তাঁর কাছেই আলমের শিক্ষা শুরু হল।
বেশ চলছে আলমের দিনগুলো। অসীম ধৈর্যে সে নুলো গোপাল আর নন্দ ভট্টাচার্যের সব বিদ্যা তিল তিল করে আয়ত্ত করে নিচ্ছে। এমন সময় এক আকস্মিক দুর্বিপাক আলমকে আবার অসহায় করে দিল। বিমূঢ় হয়ে গেল আলম।
অকস্মাৎ কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ল এক আতঙ্ক -- প্লেগ। ইঁদুর মরা দেখলেই লোকে ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালাতে লাগল। লোক যেমন মরছে, তেমন চলেও যাচ্ছে দূরে দূরান্তরে। সেখানেও বিপদ। কেউ কলকাতা থেকে এসেছে শুনলে ঠাঁই মেলে না। তবু প্রাত্যহিক মৃত্যু আর পলায়নে কলকাতা ফাঁকা হয়ে এল।
এই সাত বছরে ভোরে নিত্য গঙ্গাস্নান আলমের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ইদানীং নিমতলায় এলে আলমের মনটা উদাস হয়ে যায়। অবিরত হরিধ্বনি দিয়ে লোক আসছেই, সার সার চিতা জ্বলছেই। মৃত্যুর এই অবাধ লীলা দেখতে দেখতে হঠাৎ নিজের প্রতি মমতা জন্মায় আলমের। যদি সেও মারা যায়! জানতেও পারবেন না তার বাবা-মা, মধুমালতীদিদি কিংবা বড়দা আফতার হোসেন। কিংবা যদি তাদের কেউই! অমঙ্গল আশঙ্কায় চিন্তাটা তাড়াতাড়ি ঝেড়ে ফেলে আলম। দ্রুত স্নান সেরে সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। গত রাতে গুরু বলেছেন অজ নূতন পাঠ দেবেন। অধীরতায় আলমের আর সবুর সইছে না।
কিন্তু কী হয়েছে আজ পাথুরেঘাটার এই বাড়িটায়? এত ভোরে এত জনসমাগম কেন? উৎসব? উৎসব হলে সবাই নীরব কেন; সকলের পাশ কাটিয়ে একতলার এক কোণে গানের ঘরের দিকে এগোতে থাকে আলম।
ঘরের দরজা খোলা। ভেতরে উঁকি দিল আলম। ডাকল গুরুজিকে। কিন্তু কোন সাড়া এল না। আলম ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকল। ঘর ফাঁকা। বিছানাটা পর্যন্ত নেই। শুধু যন্ত্রগুলো যেমন সাজানো থাকে, ঠিক তেমনি রয়েছে।
হঠাৎ একটা তীব্র কান্নার শব্দে চমকে উঠল আলম। লোকটির নাম ঠিক জানে না সে, তবে লোকটা আসত গোপালকৃষ্ণের বাজনা শুনতে। ঘরে ঢুকে বিছানাছাড়া খাটটার ওপরেই লুটিয়ে পড়েছেন। কী ব্যাপার!
একটু পরেই ব্যাপারটা শুনল আলম। গত রাতে সে বাড়ি যাওয়ার পর গোপালকৃষ্ণের শরীরে প্লেগ আক্রমণের চিহ্ন প্রকাশ পায়। ঐ রোগে চিকিৎসার অবসর মেলে না। রাজাসাহেব তবু ডাক্তার ডেকে আনেন। কিন্তু তার আগেই গোপালকৃষ্ণ ইহলোক ত্যাগ করেছেন।
রাজবাড়ির লোকেরা কাউকেই বেশীক্ষণ থাকতে দিল না ঐ ঘরে। ঘরের সব কিছু ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতে হবে। কে জানে, কোথায় কোথায় লুকিয়ে আছে প্লেগের জীবাণু!
শূন্য মনে রাজবাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল আলম। গত রাতেও সস্নেহে যে মানুষ নূতন পাঠ দেবার অঙ্গীকার করেছেন, মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তিনি চলে গেলেন সকলরকম স্নেহ-মমতার বাইরে। এবার কী করবে আলম? কোথায় যাবে?
ডাক্তারবাবুর চিলেকোঠায় পাথরের মতো পড়ে রইল আলম। খেতেও ভালো লাগছে না তার।
দিন সাতেক এমন শূন্যতার মধ্যে কেটে গেল আলমের। তারপর ধীরে ধীরে আবার সে লোকের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করল। ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না, তাকে যে নূতন গুরু খুঁজে নিতে হবে, তাকে যে - সঙ্গীতের রাজ্য জয় করতেই হবে।
হঠাৎই সেদিন নন্দ ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আলমের। হনহন করে চলেছেন ভট্টাচার্যমশাই। আলম ডাকল মৃদুস্বরে। পিছু ডাকার জন্য যদি ভট্টাচার্যমশাই রেগে যান! তার চেয়ে বরং পিছ পিছু যাওয়া যাক তাঁর। আলম নন্দবাবুর পিছু নিল।
নন্দ ভট্টাচার্য চলতে চলতে সিমুলিয়ার এক মস্ত বাড়িতে ঢুকলেন। আলম বাড়িটা চিনল। এটাকেই বলে সিমলের দত্তবাড়ি। ঐ বাড়ির ছেলে হাবু দত্তের নাম শুনেছে আলম গোপালকৃষ্ণের মুখে। বিলিতী বাজনায় হাবু দত্তের না কি জুড়ি নেই। রামপুরের নবাব খবর পেয়ে তাঁকে না কি অনেক সাধ্যসাধনা করে কিছুদিনের জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের দরবারে। সেখানে সমান আদরে রেখেছিলেন নিজ ওস্তাদ উজির খাঁর সঙ্গে।
দত্তবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রইল আলম।
এই দত্তবংশকে সিমুলিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন রামমোহন দত্ত। সুপ্রিম কোর্টের বিখ্যাত উকিল ছিলেন তিনি। বিপুল বিত্ত রেখে তিনি মারা যান। কিন্তু তাঁর পুত্র দূ্গার্চরণ মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে বিশ্বনাথ নামে এক শিশুপুত্র রেখে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে যান। এই বিশ্বনাথ দত্তের পুত্র নরেন্দ্রনাথই পরে বিবেকানন্দ নামে জগদবিখ্যাত হন।
হাবু দত্ত হলেন বিবেকানন্দের জ্ঞাতি ভাই। দত্তবাড়ি তখন শরিকী অনেক টুকরো হয়ে গেছে। তবু দত্তবাড়ি তখনকার কলকাতার এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র! গোটা বংশে তখন বিশ ত্রিশটি যুবক। এক-একজন এক-এক দিকে দিকপাল। জ্ঞান-বিজ্ঞানে, স্বাস্থ্যচর্চায়, নূতন নূতন সামাজিক আন্দোলনে দত্তবাড়ি পুরোধাদের অন্যতম।
গান-বাজনার চর্চাও কম নেই এ বাড়িতে। স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ যে কী ভালো গান গাইতে পারেন, তা তখনকার বহু মানুষ ভালো করেই জানেন, বিশেষ করে জানেন রামকৃষ্ণ-শিষ্যেরা।
কিন্তু নরেন্দ্রনাথের ঐ জ্ঞাতি ভাইটি হলেন একেবারে দলছাড়া। বাপ-মা মারা গেছেন আগেই। না বিয়ে-থা, না লেখাপড়া। শুধু গান আর বাজনা। এ শুধু হাবু দত্ত নয়, তাঁর ভাই টম দত্তও। পোশাকী নাম তাঁদের অমৃতলাল আর সুরেন্দ্রনাথ। তাঁদের বাজনা এত জনপ্রিয় যে, পোশাকী নামের বদলে ডাকনামেই তাঁরা সর্বজনে পরিচিত ছিলেন।
কোন্ বাজনা বাজান হাবু দত্ত? ক্ল্যারিওনেট বাজনায় তাঁর জুড়ি ছিল না। শুধু কি ক্ল্যারিওনেট, বেহালা, বাঁশি, সেতার, ম্যাণ্ডোলিন, ব্যাঞ্জো ইত্যাদি যত দেশী-বিদেশী বাদ্যযন্ত্র সবেতেই তিনি সিদ্ধহস্ত।
হাবু দত্তই দেশী-বিদেশী বাদ্যযন্ত্র একত্রে মিশিয়ে কনসার্ট বাজানো চালু করেন। সেটা চালু হল আমাদের, যাত্রায়, থিয়েটারে। সেই ন্যাশনল থিয়েটারের আমল থেকে থিয়েটারের নাটকে কত যে গানের সুর দিয়েছেন হাবু দত্ত তার ঠিক-ঠিকানা নেই। এহেন হাবু দত্তের বাড়ির সামনে দুরুদুরু বক্ষে দাঁড়িয়ে রইল আলম।
কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেই আলম বুঝল, এ বাড়িতে পাথুরেঘাটার ঠাকুরবাড়ির মতো অত দারোয়ানও নেই, প্রবেশ প্রস্থানের অত কড়াকড়িও নেই।
তব ঢুকবে কিনা ভাবছে, এমন সময় ডানাদকের দালানগুলো থেকে ভেসে এল বিচিত্র বাজনার সুর। বুকের ভিতরটা যেন উদ্দাম হয়ে উঠল আলমের, কিছু ভাবনাচিন্তা না করেই সে ছুটে গেল সেই ঘরটার সামনে, যে ঘর থেকে আসছে বাজনার শব্দ।
ঘর-বোঝাই শৌখিন মানুষ। বসে, দাঁড়িয়ে নানা ধরনের বাজনা বাজচ্ছেন নানা জন। রোগা মতো একটা মানুষ সমস্ত বাদ্যযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করছেন ঘাড় দুলিয়ে, হাত নাড়িয়ে। আলম বুঝল, উনিই হাবু দত্ত। তার মনে হল, এ বাদনের বিদ্যা আয়ত্ব না করতে পারলে জীবন বৃথা।
বাজনা থামতেই পাগলের মতো ছুটে গিয়ে আলম লুটিয়ে পড়ল হাবু দত্তের পায়ে। হাবু দত্ত পা ছাড়াবার চেষ্টা করে বললেন, কী চাস? কী চাস তুই?
আলম বলল, শুধু আপনার পায়ের তলায় পড়ে থাকতে চাই। বলে চোখের জলে ভিজিয়ে দিল তাঁর পা।
আলমের কান্না থামিয়ে তার সব কথা শুনলেন হাবু দত্ত। শুধু তিনিই শুনলেন না, শুনলেন উপস্থিত সবাই। সব শুনে একজন রসিকতা করলেন - বহুৎ আচ্ছা। তুই তাহলে থাকিস রাস্তায়, খাস লঙ্গরখানায়, আর চাইছিস হাবু দত্তের কাছে বাজনা শিখতে। বুঝলে হে হাবু দত্ত, তোমার শিষ্য হবার উপযুক্ত পুরুষই বটে।
লোকটির বলার কায়দায় সকলে হো-হো করে হেসে উঠলেন।
আলম তাকাল সকলের দিকে। বুঝল, তার মতো পথের ভিখারির এখানে আসা ঠিক হয় নি, এখানে দয়া করবে না কেউ।
কিন্তু হাবু দত্তের দিকে তাকিয়ে যেন অন্যরকম লাগল আলমের। তাঁর চোখে তো উপহাস নেই। তিনি তো আগ্রহের চোখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। তবে কি আলমের ইচ্ছা পূরণ হবে? আলম তার দেশী ভাষায় বলল, এ বাজনা না শিখলে আমি বাঁচতাম না।
হাবু দত্ত তার পিঠে থাবড়া মেরে বললেন, সাবাস ব্যাটা। এই তো চাই। জীবনের সব কিছু না ছাড়লে সুরের রাজ্যে ঢোকা যায় না। তুই যখন সকলের স্নেহের মায়া কাটিয়ে এসেছিস, তোর হবে। আমি তোকে শেখাব।
* * * *
হাবু দত্তের সঙ্গে আলমের স্বভাবে খুব মিলে গেল। এতখানি নিষ্ঠা এর আগে আর কারো মধ্যে দেখেন নি হাবু দত্ত। ফলে ভাণ্ডার উজাড় করে শেখাতে লাগলেন তিনি আলমকে। গোপালকৃষ্ণ সাত বছরে আলমের কানটাকে এমন তৈরি করে দিয়েছেন যে, কোন কিছুই বার বার দেখাতে হয় না তাকে। অন্যে যা শিখতে এক বছর সময় নেয়, আলম তা তুলে নেয় এক মাসে। ষতরকম বাদ্যযন্ত্র ছিল হাবু দত্তের সংগ্রহে, সবরকম বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শিখছে আলম। শিখছে স্বরলিপি তৈরি করতে।
শিষ্যের আগ্রহ আর তৎপরতা দেখে হাবু দত্ত বিস্তর গৎ শেখালেন তাকে। একদিন বললেন, তুই কি ডাকাত না কি রে আলম? তুই যে আমাকে ফতুর করে দিলি!
কিছুদিন বাদে হাবু দত্ত বললেন, চল্ আলম, তোর একটা চাকরি ঠিক করেছি। তুই সেখানে চাকরি করবি।
আলমকে নিয়ে হাবু দত্ত গেলেন মিনার্ভা থিয়েটারে। সে থিয়েটারের ম্যানেজার তখন নটগুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষ। তাঁর একটার পর একটা নাটক অভিনয় হচ্ছে আর লোকে যেন পাগল হয়ে উঠছে, এমনি তাঁর লেখার গুণ, এমনই পরিচালনা ও অভিনয়ের ক্ষমতা। এসব নাটকে গান-নাচের আয়োজনও কম নেই। নৃপেন বসু বা নেপা বসুর নাচ বাজার মাত করেছে তখন। অন্য থিয়েটারেও চলছে নেপা বসুর নাচের নকল। মিনার্ভা থিয়েটারে তখন এসব নাচের সঙ্গে তবলা বাজান শশী সাহা। সাহামশাই বাজান ভালোই, তবে না তখন তিনি একে হয়েছেন বৃদ্ধ, তায় শুরু করেছেন আফিংয়ের নেশা। ফলে ঝিমুতে থাকেন অবিরাম। কয়েকদিন নাচের সময় ঠিকমতো বাজাতে ভুলেই গেলেন।
বিরক্ত হয়েই গিরিশচন্দ্র হাবু দত্তকে বলেছিলেন একজন তবলচি যোগাড় করে দিতে। সেখানেই আলমকে নিয়ে এলেন হাবু দত্ত।
গিরিশচন্দ্র চাকরকে ইঙ্গিত করলেন, সে একজোড়া বাঁয়া তবলা এনে দিল। গিরিশচন্দ্র বললেন, বাজাও।
আলম বাজাতে শুরু করল।
অতটুকু ছেলের অত নির্ভুল বাজনা শুনে নটগুরু হাবু দত্তকে বললেন, তোমার সংগ্রহটি তো খাসা। কিন্তু এখানে এসে আবার টেঁসে না যায়।
হাবু দত্ত বললেন, সম্ভবত তা হবে না। অনেক পোড় খাওয়া মেটে হাঁড়ি।
গিরিশচন্দ্র বললেন, তবে আজ থেকেই লেগে যাক।...ওরে, তোর নাম কী রে?
আলম তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বলল, আজ্ঞে আলাউদ্দিন খাঁ।
-- উঁহু। ওসব মুসলমান নাম এখানে চলবে না। তোর মুখটা বেশ খুশি-খুশি, প্রসন্ন। তোর নাম দিলুম প্রসন্ন বিশ্বাস। দেখিস বাবা, বিশ্বাসভঙ্গ করিস নি যেন।
বলেই হো-হো করে হেসে উঠলেন বঙ্গরঙ্গালয়ের জনক।
সেই দিন থেকেই আলম ‘প্রসন্ন বিশ্বাস’ হয়ে লেগে গেল থিয়েটারের দলে। এখানে কত জ্ঞানী-গুণী আসেন। সৎসঙ্গে অনেক কিছু জানতে পারবে, এ-ই তার আশা।
কাজ খুব বেশি নয়। কিন্তু যা ভেবেছিল আলম, তা হল না। থিয়েটারে একঘেয়ে জীবন, নূতন কিছুই সেখানে শিখতে পেল না আলম, ব্যথাভরা মন নিয়ে অবসরের দিনগুলো ঘুরে বেড়ায় সে।
এক সান্ধ্য অবকাশে ফোর্ট উইলিয়ামের পাশে গঙ্গার ধারে চুপ করে বসে আছে আলম। সহসা বেজে উঠল ফোর্টের ব্যান্ড। গোরাদের ব্যান্ড বাজনার নাম শুনেছে আলম, কিন্তু সেটা যে এমন তা জানত না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে সেই বাজনা শুনল আলম। তারপর মনে মনে ঠিক করল, এ বাজনা তাকে শিখতেই হবে। নইলে এ জীবন বৃথা।
দূর থেকে বাজনদারদের দেখে কে তাদের প্রধান বুঝে নিল আলম। সাহেবটি বের হতেই তার পিছন পিছন চলতে থাকে সে। এখন কলকাতা আলমের অচেনা নয়। ময়দান পার হয়ে সাহেব চলেছে ধর্মতলার পথ ধরে। খানিক এগিয়ে এক গলিতে ঢুকল সাহেব।
বাড়িটা দেখে নিল আলম।
সামনের একটা পান-সিগারেটের দোকান থেকে সাহেবের পরিচয় জেনে নিল আলম। লেবো সাহেব নামে পরিচিত তিনি। জাতে গোয়ানীজ, ভারী বদরাগী লোক। মেম সাহেবকে নিয়ে বাস করেন এ বাড়িতে। ছেলেমেয়ে নেই।
আলমের ভয় হল বদরাগী শুনে। কিন্তু ঐ বদরাগী মানুষটাকে রাজি না করাতে পারলে তো চলবে না। কি করবে আলম? হাল না ছেড়ে দিনের পর দিন লেবো সাহেবের পিছনে এবং তার বাড়ির চারিদিকে ঘোরাঘুরি করতে থাকল আলম।
লেবো সাহেবকে রাজি করাতে পারার আগেই আর এক জায়গায় বাঁধা পড়ল আলম। একদিন মেছোবাজারের কাছ দিয়ে যেতে যেতে সানাই-এর সুরে তন্ময় হয়ে গেল আলম। বাজাচ্ছেন হাজারী ওস্তাদ। তেলাপোকা যেমন কাঁচপোকাকে টানে, হাজারী ওস্তাদের সুরও তেমন আলমকে টেনে নিয়ে গেল, বাজনা শেষ হতেও আবিষ্ট ভাব কাটল না আলমের।
ছেলেটার ভাব দেখে খুশি হলেন হাজারী ওস্তাদ। বাজনা শুনে এমন আবেশ তো যার-তার ভিতর আসে না। ওস্তাদ শুধালেন, তোমার কী চাই বাপজান?
আলম বলল, ওস্তাদ। আমি আপনের পায়ের নখেরও যোগ্যও না। আমারে একটু সানাইয়ে তালিম দিবেন?
হাজারী ওস্তাদ জীবনে এমন আবেদন শোনেন নি। তিনি বললেন, যদি তুমি নিতে পার, আমার সব তোমাকে দেব।
সত্যই উজাড় করে দিলেন হাজারী ওস্তাদ। আলম নিলও৷ ক’মাসের মধ্যেই সানাই, টিকারা, নাকাড়া শেখা হল আলমের।
কিন্তু লেবো সাহেবের বেহালা? তাঁর ব্যান্ড? তখনও হাল ছাড়ে নি আলম। লেবো সাহেবের পিছনে তখনও ঘোরে, তখনও পাক খায় বাড়িটার চারদিকে। লুকিয়ে লুকিয়ে বাজনা শুনে মনে মনে সুর তুলে নেয়।
কিন্তু যন্ত্র কোথায়? কোথায় গুরুর শিক্ষা? এখনও যে সাহেবের সামনে দাঁড়াতেই সাহস হয় না। একদিন সাহেব দরজা খুলে-বের হতেই বেপরোয়ার মতো তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াল আলম। সাহেব থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, ক্যা মাংতা?
যেন সিংহ- গর্জন হল।
ভয়ে ভয়ে আলম বলল, বেহালা বাজনা শিখুম।
নাক-মুখ কুঁচকে সাহেব বললেন, ক্যা?
তারপরেই আলমের প্রার্থনাটার অর্থ বুঝে আঙুল নেড়ে হাত ছুঁড়ে চীৎকার করে উঠলেন -ভাগ হিঁয়াসে!
আলম ভয় পেলেও ভাগতে পারল কই? এমন করে কোথাও ব্যাহত হয় নি আলমের ইচ্ছা, কেউই তাকে তাড়িয়ে দেয় নি। এমন বিতাড়নের সামনে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়েই রইল আলম। একটা হুঙ্কার ছেড়ে পাশ কাটিয়ে নিজেই চলে গেলেন লেবো সাহেব।
এবার কি কান্নায় ভেঙে পড়বে আলম? কিন্তু তার আগেই তার জামার কলারে টান পড়ল। কে? ঘুরে আরো হতবাক হয়ে গেল আলম, তাকে ডাকছেন স্বয়ং মেমসাহেব! সাহেবের হাত থেকে যদি বা নিস্তার মিলেছে, মেমসাহেব এবার তাকে চপ-কাটলেট না বানিয়ে ফেলেন! আলম নির্বোধের মতো চোখ তুলে তাকাল মেম-সাহেবের দিকে।
মেমসাহেব বললেন, তুম বেহালা বাজনা শিখিতে চাও?
ঘাড় নাড়ল আলম।
মেমসাহেব তাকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন। বসালেন বৈঠকখানায়। তার হাতে বেহালা দিয়ে বললেন, বাজাও।
মাথা নীচু করল আলম। বলল, আমি বাজাতে জানি না মেমসাহেব। আমি শিখবার চাই।
মেমসহেব আর একটা বেহালা আনলেন। তিনি বাজালেন একবার। মুহূর্তে আলম নিজের বেহালায় তা তুলে বাজিয়ে দিল। মেমসাহেব অবাক। আর একরকম বাজালেন তিনি। আলম সেটাও তুলে বাজিয়ে দিল। মেমসাহেব আনন্দে বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ইউ নটি বয়! তুমি বাজাইতে জানে।
আলম বলল, না, জানি না মাইজি। শিখতাম।
মেমসাহেব খুশিতে হাসলেন!
সেই থেকে সাহেব ফোর্টে গেলে লুকিয়ে লুকিয়ে আলমকে বেহালা বাজানো শেখাতে লাগলেন মেমসাহেব, আর আলমও যত দ্রুত পারল মেমসাহেবের গোপন দান তুলে নিতে লাগল।
কিন্তু এ চুরি বেশিদিন চলল না। একদিন অসময়ে বাড়ি ফিরে এলেন লেবো সাহেব, হাতেনাতে ধরা পড়ে পড়ে গেল আলম আর মেমসাহেব। কিন্তু ও কি! সাহেব তো আগুনের মতো জ্বলে উঠলেন না! উলটে তাঁর চোখ-মুখ থেকে খুশির ঝলক ঝরে পড়ছে!
আলমের পিঠ চাপড়ে তিনি বললেন, তুমি এত ভালো বাজাইতে শিখিয়াছ? তবে আমিই শিখাইব। আলম যেন হতে স্বর্গ পেল। কিন্তু শুধু লেবো সাহেবের কাছে শিখলেই তো হবে না, নিজের রেওয়াজের জন্য যন্ত্রও তো কেনা চাই। অনেক যন্ত্র।
টাকা?
তারও একটা ব্যবস্থা হল। লেবো সাহেব আলমকে ফোর্টের ব্যাণ্ডে ভর্তি করে দিলেন। এদিকে মিনার্ভার চাকরিও চলছে। কোন আয় থেকে একটা পয়সাও খরচ করে না আলম, সব জমায়। এখনও খায় সেই লঙ্গরখানায়। তাতেই দিন চলে যায় আলমের। একদিকে লেবো সাহেব, অন্যদিকে হাজারী ওস্তাদ। টাকাও জমছে। যন্ত্রগুলো নিশ্চয়ই হবে। আঃ, স্বর্গ কত দূর?
কিন্তু সে স্বর্গে আর পৌঁছানো হল না আলমের।
একদিন মিনার্ভা থেকে বের হতেই ভূত দেখার মত চমকে উঠল আলম। সামনে কে দাঁড়িয়ে! তার দাদা আফতারউদ্দিন!
আফতার হাত চেপে ধরলেন আলমের। বললেন, সকলকে কাঁদিয়ে এ তুই কোথায় পড়ে আছিস? ফিরে চল্ বাড়িতে।
আফতারউদ্দিন আলমকে টেনে নিয়ে চললেন শিয়ালদহের দিকে। সেখান থেকে ট্রেনে করে গোয়ালন্দ, গোয়ালন্দ থেকে ক্রমে শ্যামগঞ্জের লঞ্চ হয়ে শিবপুরে।
আলম এসে দাঁড়াল তার অতিপুরাতন বন্দীশালায়।
পরবর্তী পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
চার
দিনটা আলমের জীবনে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মায়ের মার বা বকাঝকা কিছুই তেমন করে গায়ে লাগে নি আলমের। কারণ, আলম তার আগেই বুঝে নিয়োছল কি চায় তার মন। গান আর বাজনা ছাড়া কিছুতেই বাঁচবে না আলম। আকাশের মাঝে, বাতাসের শব্দে, নদীর জলে কিসের যেন সুর শুনতে পায় সে। ঠিক না বুঝলেও তার মনে যেন কিসের ইশারা। কিন্তু কী করে সে সাড়া দেবে সেই ডাকে? বাবার স্নেহ, মায়ের ভালবাসা, দিদির আদর তাকে সব ভুলিয়ে রাখে। আলম বোঝে, এখানে থাকলে মায়ের শাসন এড়িয়ে সুরের রাজ্যে যাওয়া হবে না তার। কিন্তু এতজনের স্নেহের বন্ধনই বা সে কাটাবে কি করে? সেদিন মারের নির্যাতন এসেছিল আশীর্বাদ বহন করে। গোয়ালঘরে থাকতে থাকতেই সে স্থির করে ফেলেছে, এ বাড়িতে আর নয়, এ বাড়িতে কেউ সত্যিকারের ভালবাসে না তাকে। যদি ভালবাসত, তবে বুঝত তার মনের কথা। সেটাই যখন কেউ বুঝল না, তখন থাক পড়ে সবাই। আলম এ বাড়ি ত্যাগ করবে। এই মধুমালতীদিদি বের করে এনেছে তাকে, আদর করে খাইয়েছে, ঘুম পাড়িয়েছে। একটিও কথা বলে নি আলম, ঘুমের ভান করে পড়ে ছিল। একসময় মধুমালতীদিদি চলে গেছে, সকলের খাওয়া-দাওয়া সাঙ্গ হয়েছে, শুয়ে পড়েছে সবাই। তখনও অপেক্ষা করে থেকেছে আলম। রান্নাঘরে রয়েছেন মা। উঁকি দিয়ে দেখে বিছানা থেকে সন্তর্পণে নেমেছে সে। মা কোন হাঁড়িতে টাকা-পয়সা রাখেন তা জানা ছিল আলমের। আস্তে আস্তে গিয়ে সেই হাঁড়ি থেকে একখাবলায় যা উঠেছে তুলে নিয়েছে। তারপর আলনা থেকে নিজের একটা জামা নিয়ে টাকা কটা পুঁটলি করে রেখে দিয়েছে বালিশের নীচে।
তারপর একসময় মা এসে ঘরের দরজা বন্ধ করেছেন, রোজকার মতো শোবার আগে এসে দাঁড়িয়েছেন আলমের সামনে। গুটি মেরে ঝিম ধরে পড়ে থেকেছে আলম। মা একটা চাদর টেনে দিয়েছেন আলমের গায়ের উপর, ঘুমন্ত ছেলের মাথায় হাত বুলিয়েছেন। কিন্তু তাতে আলমের অভিমান বেড়েছে বই কমে নি, ওপাশ ফিরে শুয়েছে সে। একটু পরে মা চলে গেছেন।
তারপর নিঃশব্দে অপেক্ষা করেছে আলম। একসময় নিশ্চিন্ত হয়েছে মায়ের ঘুম সম্পর্কে। তখন ধীরে ধীরে উঠে তুলে নিয়েছে টাকা আর জামার পুঁটলিটা। তারপর দরজা খুলে দে-দৌড়। বন-বাদাড় ভেঙে পথ বিপথ মাড়িয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত না বেদম হয়েছে, ততক্ষণ ছুটেই চলেছে সে। ছেলেটা যেন এক দৌড়ে তার মা, বাবার স্পর্শকাতর এই পৃথিবীটা ছাড়িয়ে সুরের অন্য এক পৃথিবীতে গিয়ে পৌঁছাতে চায়।
খানিক থামল আলম। ঠিক পথেই এগুচ্ছে সে। এ তো মানিকনগরের আগের সেই হাওর। হাওরটার এদিক ওদিক দেখা যায় না, এত বড়। এই হাওর পেরিয়ে মানিকনগর। তারপর নদীর তীরে শ্যামগঞ্জের লঞ্চের ঘাট। এসব পথে কোনদিন যায় নি আলম। কিন্তু সাধুদের মুখে পথের বর্ণনা শুনে শুনে সব তার মুখস্থ।
এই হাওর সম্পর্ক আরো একটা কথা শুনেছে আলম। এখানে না কি অনেক জলার ভূত বাস করে। রাত হলে আগুন জ্বালে তারা। এখানে ওখানে দপদপিয়ে বেড়ায়। ইংরেজি পাঠশালায় পড়া বাবুদের বাড়ির ছেলেরা যদিও বলে ওগুলো ভূত নয়, আসলে একরকম গ্যাস, কিন্তু তা বিশ্বাস করে না আলম। গ্যাস যদি তবে অনবরত জ্বলে না কেন? বার বার জ্বলে নেভে কেন? কে বার বার জ্বালায়-নেভায়? হুঁ হুঁ বাবা, অত বোকা পাও নি আলমকে যে, যা-তা বলবে আর সে বিশ্বাস করবে! অনেক কিছু অবিশ্বাস করতে পারে আলম, কিন্তু ভূতকে নয়। শেষে অবিশ্বাসীকে বিশ্বাস করতে ঘাড়ে ধরুক আর কি!
এসব চিন্তা করে কিন্তু হাঁটা থামায় না আলম, তাকে যে সব পরিচিতের গণ্ডি ছাড়াতেই হবে! ভূতের কথা ভাবলে কী হবে, সত্যিকারের ভয়ডর বলে বোধ হয় কিছু নেই ছেলেটার। না হলে এই রাতে মাত্র আট বছরের ছেলে এমন করে পথ পাড়ি দিতে পারে?
কিন্তু ও কী! এই দুর্জয় সাহসী ছেলেটাও থমকে দাঁড়াল একবার। ঐ দূরে কটা আলো যেন জ্বলছে-নিভছে! কিসের একটা শোরগোল যেন। ভূতেদের মজলিস বসেছে বোধ হয়। তাই অত রোশনাই। কিন্তু রোশনাই করে আসর বসাবে কেন ভূতেরা? তারা তো অন্ধকারকেই ভালবাসে। দুহাতে ভালো করে চোখ মুছল আলম। আরো ক পা এগিয়ে এল। নাঃ, আলোগুলো তো জ্বলছেই শুধু, নিভছে না। নড়াচড়া করছে মাত্র। তবে কিসের আলো? ছুটতে থাকল আলম। আরো, কিছু পথ এসে বুঝল, সে হাওর ছাড়িয়ে, মানিকনগর ছাড়িয়ে শ্যামগঞ্জের লঞ্চঘাটে এসে গেছে। ঐ তো লঞ্চ!
সব দ্বিধা কাটিয়ে একদৌড়ে লঞ্চে গিয়ে উঠল আলম। খুবই ক্লান্ত শরীর। একটা কোণ দেখে যুত করে শুয়ে পড়ল আলম। যখন লঞ্চ ছাড়ে, ছাড়ুক।
আলমের যখন ঘুম ভাঙল, তখন বেশ বেলা হয়েছে। কিন্তু তখনও লঞ্চখানা দাঁড়িয়ে। ধক করে উঠল আলমের বুক, তবে কি সারারাত চলে নি লঞ্চখানা!
বাইরে এল আলম। না, এ তো ভিন্ন নদী, ভিন্ন শহর। তার সামনে যেন এক মস্ত মেলা। কত রকমের দোকান, কত রঙ, কত লোক!
ধীরে ধীরে লঞ্চ থেকে নামল আলম। তীরের দোকানগুলোর সামনে দিয়ে ঘুরল বারকয়েক। নানারকম দোকান থাকলেও বেশীর ভাগই খাবারের দোকান। আহার্যের বিচিত্র সুগন্ধে আলমের পেটের ভিতর থেকে ক্ষিধে যেন পাকিয়ে উঠতে লাগল। একটু নিরিবিলি জায়গা দেখে জামার পুঁটলি খুলল আলম। গুনল, গতরাতে অন্ধকারে একখাবলা যা এনেছে, তা নেহাত কম নয় -- বারো টাকা, তবু ভয় পেল আলম। সাহস করে কোন দোকানে ঢুকতে পারল না, পাছে তাকে ছোট বলে বের করে দেয়? কিংবা কেড়ে নেয় টাকা! থাক্ খাওয়া।
আপনমনে ঘুরতে লাগল আলম।
হঠাৎ এক জায়গায় যেন পরম প্রার্থিত বস্তু দেখে থমকে দাঁড়াল আলম। মুড়ি! একটা লোক মুড়ি বিক্রি করছে। আলমের মনে হল, লোকটা যেন তার কত দিনের চেনা। দোকানীর কাছে এসে এককোঁচড় মুড়ি নিল সে। দোকানী একটা টাকা ভাঙিয়ে তিন পয়সা নিয়ে বাকীটা ফেরত দিয়ে দিল।
কিন্তু ধীরেসুস্থে মুড়ি খাওয়া হল না আলমের। দৈত্যের মতো ভোঁ করে আওয়াজ করে জল তোলপাড় করতে করতে একখানা মস্ত বড় লঞ্চ এসে লাগল স্টেশনে। লোকজন স্টীমার এসেছে, স্টীমার এসেছে বলে তুমুল শোরগোল তুলল। আলম জানল, ঐ বড় লঞ্চগুলোকে স্টীমার বলে। একটা লোককে সে শুধাল, এটা কোথাকার স্টীমার?
লোকটা বলল, গোয়ালন্দের।
ভিড় ঠেলে পায়ে পায়ে আলম গিয়ে উঠল ঐ স্টীমারে। হৈ চৈ-চেঁচামেচি কাটিয়ে, প্রচুর লোক ও মাল নামিয়ে উঠিয়ে অবশেষে স্টীমারটা চলতে শুরু করল একসময়। একটা অদ্ভুত উল্লাসে ভরে উঠল আলমের মন। যেন সরস্বতীদেবীর হাঁস নিজে এসে ডানা মেলে তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সুরের রাজ্যে। আঃ কী তৃপ্তি! কী আনন্দ!
অবশ্য আলমের পক্ষে আরো আনন্দের এইজন্যে যে, গোটা স্টীমারটা ও তার জলযাত্রা দু-ই তার কাছে নতুন।
তাই বেশ কৌতূহলের বস্তু। ছেলেটা ভুলে গেল সব কিছু। গুটি গুটি পায়ে কৌতূহলী চোখ মেলে ঘুরে বেড়াতে লাগল একতলা-দোতলা, দেখল ইঞ্জিনঘর, ডেকের যাত্রীদের, দেখল কেবিন, মুরগীর খাঁচা, খালাসীদের থাকবার জায়গা। উপরে সারেংয়ের ঘরে উঠতে গিয়ে একবার ধমকও খেল সে। অবশেষে এসে দাঁড়িয়ে রইল রেলিংয়ের ধারে।
দুরে দূরে গ্রামগুলো কেমন করে মিলিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও পারে ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে, ফেনার রাজ্য তৈরি করে কত দূর পিছন পর্যন্ত চিহ্ন রেখে এগিয়ে যাচ্ছে স্টীমারটা!
আলমের সবচেয়ে মজা লাগছে, স্টীমার যখন কোথাও থামছে। স্টীমারের চাকা ঘোরায় নদীর জল তখন উথাল-পাথাল করছে। কী বড় বড় ঢেউ! যেন অত বড় স্টীমারটাকে গিলে ফেলবে। তারই মধ্যে মোচার খোলার মতো নৌকোগুলো নিয়ে এল ব্যাপারীরা। ঢেউয়ের মাথায় লাফিয়ে উঠছে নৌকোগুলো পাঁচ-সাত হাত, আবার নেমে যাচ্ছে দুই ঢেউয়ের মাঝে। এই বুঝি গেল ডুবে! না, ঐ তো ভেসে উঠেছে! আশ্চর্য, এই ওঠানামার ছন্দেই ওরা স্টীমারের যাত্রীদের হাতে তুলে দিচ্ছে দৈয়ের ভাঁড়, রসগোল্লা বা এরকম সব সওগাত। নিচ্ছে টাকা, দিচ্ছে খুচরো পয়সা। তন্ময় হয়ে লোকগুলোর অদ্ভুত কৌশল দেখতে থাকে আলম।
কিন্তু এ থামা কতক্ষণেরই বা! চলতেই থাকল স্টীমার। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। স্টীমারের মধ্যেও খাবারের দোকানের সন্ধান পেল আলম। কিন্তু কিনতে সাহস পেল না, যদি ছোট বলে তাকে না দেয়, যদি ধরে ফেলে যে, সে বাড়ি থেকে পালিয়েছে, যদি তাকে ধরে আবার বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। অতএব না খেয়েই দিনটা কাটিয়ে দিল আলম।
সন্ধ্যার গভীরে স্টীমার এসে থামল এক ঘাটে। লোকের কথা থেকে আলম বুঝল, এটাই গোয়ালন্দ ঘাট। সব যাত্রীই নেমে যাচ্ছে। অতএব জনস্রোতের সঙ্গেই নামল আলম। টিকিট-ফিকিট কেউ চাইল না তার কাছে। লক্ষ্যই করল না হয়ত।
কিন্তু এখানে কোথায় যাবে আলম! ভাবনা-চিন্তা না করে বেশীর ভাগ লোক যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকেই চলল সে। ওমা, এ কী! এ কিসে উঠছে সকলে? বাড়ির মতো মস্ত বড় বড় বাক্স। তাতে আবার চাকা লাগানো। লোকের কথা থেকে সে বুঝল, একে না কি রেলগাড়ি বলে। এও না কি গাড়ি! কলে চলে। হেই আল্লা! পৃথিবীতে কতই না জাদু! তাদের গাঁয়ের লোক এসবের কিস্যু জানে না। এদিক-ওদিক ঘুরে একটা গাড়িতে উঠে পড়ল আলম। তারপর প্রতীক্ষা করতে করতে কখন, যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে, তা নিজেও খেয়াল করে নি।
ভোরে ঘুম ভাঙল আলমের। গাড়িতে তখন তল্পি বাঁধবার তোড়জোড়-শিয়ালদহ আসছে। সেখানে গাড়ি একবারে থেমে যাবে। কেউ যাবেন হাওড়া, কেউ ঠনঠনিয়া, কেউ শ্যামবাজার। ধর্মতলারও নাম শুনল আলম। কেমন বিচিত্র সব নাম, দেশগুলিও বিচিত্র। তাহলে এখানে নামতে হবে আলমকেও। কিন্তু এই কি সেই দেশ? এই দেশেই কি পাবে আলম সেই সুরের সন্ধান? এখানেই কি আছেন তার সুরের গুরু? কে জানে! আলম তার ছোট্ট পুঁটলিতে এগারো টাকা একষট্টি পয়সা বেঁধে নিয়ে নেমে পড়ল শিয়ালদহে।
বাইরে এসে স্তম্ভিত হয়ে গেল আলম। এত বড় বাড়ি সে কল্পনাও করতে পারে না। ভেঙে পড়বে না তো মাথায়! থমকে দাঁড়াল আলম। নাঃ, পড়বে না। ঐ তো নদীর স্রোতের মতো লোক ছুটে চলেছে। কত রকমের গাড়ি! ঘোড়ায় টানা গাড়িগুলোরই বা বাহার কত!
কতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে দেখা যায়, অতএব সামনের রাস্তা বরাবর হাঁটতে থাকল আলম।
খানিকদূর এসে আলম একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যদিও পোশাক-আশাক ভিন্নরকম, তবু একদল ছেলেকে দেখতে পেল সে। বইপত্র নিয়ে চলেছে তারা। এই পরিচিত দৃশ্য দেখে বুঝি বা একটু খুশি হয়েই তাদের দিকে এগিয়ে গেল আলম। হিতে বিপরীত হল- এই মাথামোটা গাঁইয়া ছেলেটি তাদের খেলার উপাদান হয়ে উঠল। তারা কেউ আলমের জামা ধরে টান দেয়, কেউ দেয় মাথায় টোকা, কেউ বা ওর কান ধরেই নেড়ে দেয়। কটা ছেলে তো ওর টাকার পুঁটলি ধরেই টানাটানি শুরু করে দিল।
এ কি বিপদ। প্রাণপণে দুহাতে বুকের মধ্যে পুঁটলি জড়িয়ে ধরে দ্রুত হাঁটতে থাকল আলম। ছেলেগুলিও ছুটতে থাকল তার পিছনে। অবশ্য কয়েক মিনিট মাত্র, ওদের পাঠশালার পথ ছাড়িয়ে বেশী দূরে এল না তারা। আলম সেযাত্রা অব্যাহতি পেল। একবার পিছন ফিরে ওদের দেখল আলম। এই না কি শহরের ছেলে! বাবাঃ, দরকার নেই ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। হাঁটতে থাকল সে।
এবার বেশ ক্ষিদে পেয়েছে আলমের। তেষ্টাও। আশপাশে কোথাও খানা-ডোবা বা পুকুর দেখতে পেল না আলম। কী দেশ রে বাবা! এরা কি জল খায় না! জল না পেলে বাঁচবে কী করে আলম! হায় খোদা! এ কোথায় নিয়ে এলে তাকে?
ভাবতে না ভাবতেই আলমের চোখের সামনে ভেসে উঠল বিশাল এক নদীর ঘোলাটে জলের প্রবাহ। নদ নালার দেশের মানুষ আলম, নদী দেখেই ছুটে গেল সে। এই তো তার চেনা পৃথিবী। নদীতে নদীতে ভেদ নেই, সেই একই জল, একই গতি। খুশিতে আঁজলা ভরে জল তুলে মুখে দিল আলম।
হায় খোদা! এ কী জল! দেড় দিন আগে খাওয়া মুড়িগুলো পর্যন্ত পেট থেকে উঠে এল আলমের। নুনগোলা জল। থুথু করে উঠে পড়ল আলম। এদেশের ছেলেগুলোই শুধু বিচিত্র নয়, জলও। নিরুপায় ক্ষোভে কেঁদেই ফেলল আলম। এ কোন্ কুহকের দেশে এল সে!
পাঁচ
ক্ষুধা ও তৃষ্ণা-এ দুটি জৈবিক তাড়না একসময় আলমের কান্নাও থামিয়ে দিল। দুপুর গড়িয়ে হল বিকেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। হঠাৎই তার নজরে পড়ল নদীর ধারে --নদীটা যে গঙ্গা তখনও জানে নি সে -- একদল লোক কী যেন ভাজছে। খাচ্ছেও অনেক লোক। তাদের পোশাক-পারচ্ছদ খুব যে পরিষ্কার তা নয়।
অনেক সাহস সঞ্চয় করে দোকানের কাছে গেল আলম। খানিক দাঁড়িয়ে থেকে জানল, যা ভাজা হচ্ছে, তাকে বলে ডালপুরী। সেও গিয়ে হাত পেতে বসল। দুপয়সার ডালপুরী আর জল খেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেল আলম। কলকাতায় এই প্রথম স্বস্তিলাভ করল সে।
এবার ঘুম। খুব বেশি চিন্তা করল না আলম। কাছেই এক গাছতলায় জামার পুঁটলিটা মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়ল সে। ঘুম আসতে একটুও দেরি হল না।
সারারাত বেঘোরে ঘুমোল সে। চোখে সূর্যের আলো লাগতে ঘুম ভেঙে গেল তার। উঠে বসে চোখ রগড়ে ভালো করে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেল আলম -- মাথার তলার জামার পুঁটলিটা নেই! এদিক-ওদিক তন্নতন্ন করে খুঁজলে সে। কিন্তু নাঃ, কলকাতার জাদুতে টাকাসহ জামাটা হাওয়া হয়ে গেছে! নিঃসম্বল ছেলেটা হু-হু করে কাঁদতে থাকল।
খানিক বাদে আলমের কান্না থামল পিঠে এক খোঁচা খেয়ে। তাকিয়ে দেখল, ডাণ্ডা হাতে এক পুলিশ। পুলিশটা তার পিঠে খোঁচা দিয়ে বলল, এই ছোকরা, কাঁদছিস কেন?
-- আমার বোঁচকা চুরি গেছে সিপাইজি!
-- চুরি! কেইসে?
সব বলল আলম। কেঁদে কেঁদেই বলল। শুনে সিপাইটি দার্শনিকের মতো হাসল। বলল, কলকাতা আজব জায়গা বাবা। এখানে টাকাওয়ালা পুঁটলি যাবেই। যা, ভাগ্!
বলে এক গর্জন করে সিপাইজি নিজেই চলে গেলেন।
সেদিকে তাকিয়ে চোখ মুছল আলম। কেঁদে ফল নেই। এখানে বাবা নেই, মধুমালতীদিদিও নেই। এই অচেনা রাজ্যে তাকে একা লড়াই করতে হবে, বাঁচতে হবে। পূরণ করতে হবে নিজের আকাঙ্ক্ষা। আবার উঠে দাঁড়াল আলম। হাঁটতে থাকল নদীর ধার বরাবর।
হাঁটতে হাঁটতে আলম এসে পৌঁছল এক শ্মশানঘাটে। লোকের মুখে নাম শুনল নিমতলা শ্মশানঘাট।
শ্মশান এড়িয়ে চলল আলম। শ্মশান তো জীবনের শেষ, সে তো সুরহীনের রাজ্য। অতএব সেখানে গিয়ে আলমের লাভ? তবু চোখ ফেরাতে গিয়েও ফেরানো হল না। ওখানে তিন সাধু না? হ্যাঁ, সাধুই বটে।
গ্রামের শিব মন্দিরে সাধু-সংসর্গে এসেছে আলম, পেয়েছে সুরের ছোঁয়া। তাই সাধু দেখে এগিয়ে গেল আলম। কিন্তু কলকাতার সাধুরাও কি ভিন্ন রকমের? কণ্ঠে তাদের গান কোথায়? আলম দেখল, তাদের গলায় জবার মালা, হাতে রুদ্রাক্ষ, সামনে কাঠের স্তুপে আগুন। কেউ বা সিদ্ধি ঘুঁটছে। হতাশায় আলমের চোখে জল এল। হঠাৎ এক সাধু হাতের ইশারায় ডাকল তাকে।
আলম এাগিয়ে যেতে সাধু বলল, কাঁদছিস কেন রে ব্যাটা? কাকে খোয়ালি?
আলম আরো কাঁদে। বলে, সব সাধুবাবা সব। আমার যা কিছু টাকা-পয়সা, আমার জামা।
সাধু ব্যাপারটা আন্দাজ করে নেন। বলেন খেয়েছিস?
আলম ঘাড় নাড়ে।
সাধু বলেন, হাত পাত।
হাত পাততেই কী যেন দিলেন সাধু। বললেন, নে, খেয়ে ফেল্। খেয়ে ফেলল আলম। সাধু বললেন, যা ব্যাটা, হাঁটতে থাক্ পুবমুখো। খাবার মিলে যাবে। যা।
সাধুর কথামতো পুবমুখো তাই হাঁটতে থাকে আলম। দুপুর শেষ, হয়ে তখন বিকেল ছুঁই-ছুঁই। হাঁটতে হাঁটতে ডান হাতে এক মস্ত মাঠ পেরোতেই বহু লোককে রাস্তায় বসে খেতে দেখল আলম। একদল লোক বড় বড় পাত্র থেকে লোকগুলিকে খাবার দিচ্ছে। কে একজন ঠেলা দিল আলমকে। বলল, ব্যাটা আবার সঙের মতো দাঁড়িয়ে রইলি কেন! একখানা পাতা নিয়ে বসে পড় ওখানে।
ছুটে গিয়ে পাতার স্তুপ থেকে একখানা পাতা টেনে বসে পড়ল আলম। খেতে খেতে শুনতে পেল, এক ব্যবসায়ী না কি রোজ এমনি করে কাঙালী ভোজন করান। আলম মনে মনে বলল, বেঁচে থাকুন তিনি।
বারকয়েক চেয়ে নিয়ে পেটটা বেশ করে বোঝাই করে নিল আলম। সাধু বোধ হয় এখানে খাবার বিলির কথা জানতেন। তাই সোজা পুবমুখো হাঁটতে বলেছিলেন।
খাওয়া শেষ করেই জলের কথা মনে হল তার। অন্যরা কি করে লক্ষ্য করল আলম। দেখল, রাস্তার পাশে কী একটা টিপতেই জল ঝরছে। দিব্যি খাচ্ছে লোকে। সেও খেল। খুব মজা লাগল তার। নদীর জল খাওয়া যায় না, লবণগোলা, অথচ এখানে টুপ করে টিপলেই জল! যত ইচ্ছে খাও। সত্যিই আজব শহর কলকাতা!
খাওয়া-দাওয়া শেষ হতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। কি আর করবে আলম, পাশেই এক ভদ্রলোকের বাড়ির বাইরের রকে গা এলিয়ে দিল।
কয়েকটা দিন-রাত ঐ একই বারান্দায় কাটিয়ে দিল আলম। সারাদিনে আশপাশে একটু একটু ঘুরল সে। জানল, ঐ রাস্তাটার নাম বিডন স্ট্রীট। আসবার পথে ডানদিকে যে বাগান পড়েছিল, তার নাম কোম্পানির বাগান। সোজা পশ্চিমে গেলে নিমতলা শ্মশান আর তার পাশেই মা গঙ্গা। নোনা অপেয় জল হলেও গঙ্গাকে এখন ভক্তি করে আলম। ভোর না হতেই যারা গঙ্গা স্তোত্র পাঠ করতে করতে স্নান করতে ছোটে, আলমের বড় ভালো লাগে তাদের। ভালো লাগে স্তোত্রের সুরটাও। মন কাড়া সুর। আলম আরো একটা খবর সংগ্রহ করল।
যে ভদ্রলোকের বাড়ির বারান্দায় সে ঘুমোয়, তাঁকে লোকে বলে কেদারনাথ ডাক্তার। দূর থেকে উঁকি মেরে দেখেছে আলম, ডাক্তারবাবুর কী গম্ভীর মুখ! দেখলেই ভয় করে।
সারাদিন ঘোরে-ফেরে আলম আর ভাবে, এমনি করে আলস্যে দিন কাটাতেই কি বাড়ি থেকে পালাল সে? কোথায় সেই সুরের রাজ্য?
সেদিন বিকেলে আশ্চর্যভাবে এক বিচিত্র সুর কানে এল আলমের।
কোথায় বাজছে সেই সুর? ডাক্তারবাবুর বাড়িতেই কি? এ কোন্ বাজনা? ঠিক ধরতে পারল না আলম। ধরা সম্ভবও নয় তার পক্ষে, তার শোনার দৌড় তো খোল-করতাল, বাঁশি, একতারা আর তবলা-সেতার অবধি! পিয়ানোর মতো বিদেশী যন্ত্র আলম দেখেও নি, নামও শোনে নি। ডাক্তারবাবুর বাড়িতে পিয়ানো আছে। ডাক্তারবাবু নিজেই উদ্যোগী হয়ে কিনেছিলেন। সময় পেলে বাজান। ছেলেমেয়েরাও বাজায়। তেমনই কোন বাজনা এসেছে আলমের কানে।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো ডাক্তারবাবুর দরজার পাশে গিয়ে, কান পেতে রইল আলম। শুনতে শুনতে সে এত তন্ময় হয়ে গেল যে, কখন দরজা খুলে ডাক্তারবাবুর স্ত্রী বেরিয়ে এসেছেন তা সে খেয়ালই করে নি। ছেলেটাকে এভাবে থাকতে দেখে তিনি জিজ্ঞসা করলেন, কী চাস রে?
ছেলেটা যেন শুনতেই পেল না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে, কী চাস্ তুই?
এবার চোখ তুলে তাকাল আলম। বক্তার কণ্ঠস্বরে কোন বিরক্তি নেই৷ খানিক ভরসা পেল আলম। খাঁটি ত্রিপুরী ভাষায় বলল, আমি বাজনা শুনতাম আইছি।
-- বাজনা শুনবি? তুই থাকিস কোথায়?
এইটুকু স্নেহের স্পর্শও বুঝি সইতে পারল না আলম, ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ডাক্তারবাবুর স্ত্রী আদর করে তার চোখ মুছিয়ে দিলেন। তারপর প্রশ্ন করে জেনে নিলেন, ছেলেটি শুধু গান শিখবে বলে পালিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে। খায় নি ক’দিন, হারিয়েছে তার শেষ সম্বল। এখন সারাদিনে একবার খায়। তবু ভিক্ষে করে না।
ছেলেটার কথার সারল্যে, তার আকাঙ্খার বিশিষ্টতায় কী যেন একটা খুঁজে পেলেন ডাক্তারবাবুর স্ত্রী। আলমকে ডেকে ঘরে আনলেন তিনি। চাকরকে ডেকে কচুরি আনিয়ে পেট ভরে খাওয়ালেন ওকে। ওর নিজের কণ্ঠের গান শুনলেন। তারপর বললেন, তুই থাক্ আমার বাড়িতে। দেখি তোর কি ব্যবস্থা করা যায়।
ভেতরে ভেতরে তারপর কি কথাবার্তা হল জানে না আলম, তবে সেই রাত থেকে ডাক্তারবাবুর চিলেকোঠায় থাকা ব্যবস্থা হল তার। বাড়ির ছেলেদের পুরোনো কটা জামা-কাপড় ওর জুটল। চিলেকোঠায় শুয়ে আলমের আবার মনে হল, আজব কলকাতা! কোথা থেকে কী হয় কে বলবে!
পরদিন সকালে ডাক্তারবাবু স্বয়ং তাকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে চললেন। কোথায় চলেছেন জিজ্ঞেস করতে সাহস হল না তার। এপথ-ওপথ করে একটা মস্ত বড় বাড়ির সামনে এলেন ডাক্তারবাবু। আলম স্বপ্নেও এত বড়, এত সুন্দর বাড়ির কল্পনা করতে পারে না। যেদিকে তাকায়, তাতেই বিস্ময় আলমের। কত ফুল, কী বিরাট বিরাট থাম! ঘোড়াগুলো কেমন তেজস্বী। কী সুন্দর ঐ গাড়িটা। হেইরে! ওগুলো জ্যান্ত নয়, পাথরের মানুষ!
কিল্তু তার থেকেও বেশি বিস্ময় বোধ করল আলম, এত বড় পাথুরে বাড়িটার ভেতর থেকে সুর আসছে। সুর! যে সুরের জন্যে এমন করে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে আলম, এত কষ্ট সয়েছে, সেই সুর। ভেতর থেকে কি এক বেগ ঠেলে নিয়ে চলল আলমকে। ডাক্তারবাবু ছেলেটার সঙ্গে তাল রাখতে একটু জোরে পা চালাতে থাকলেন।
একটা ঘরের সামনে গিয়ে থমকে গেল আলম। ঘরের মধ্যে দরজার দিকে পিছন ফিরে বসে আছেন যিনি, কেমন করে আলমের মনে হল, তিনিই রাজা। আর তার উলটো দিকে ঐ তো চোখ বুজে গাইছেন গায়ক। পাশে তানপুরা বাজছে, সঙ্গত হচ্ছে মৃদঙ্গ। আলমের বুকের ভেতরটা সেই সুরে সুরে যেন নাচতে থাকল। কী করবে আলম? সে কি আনন্দে বিবশ হয়ে পড়ে যাবে? পাশের চৌকাঠ চেপে ধরল আলম।
একটু পরে সে ধাতস্থ হয়ে দেখে, ডাক্তারবাবু গিয়ে বসেছেন রাজার পাশে। এবার গায়কের হাতদুটির দিকে নজর গেল আলমের। কেমন যেন সরু সরু, সুরের সঙ্গে সঙ্গে কেমন থরথরিয়ে কাঁপছে। কে লোকটা?
একসময় গান শেষ হল। ডাক্তারবাবু রাজার সঙ্গে কী সব কথাবার্তা বললেন। রাজামশাই ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন আলমকে। ডাকলেন। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল আলম। বিশাল ঘরটার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল।
এপাশ থেকে রাজামশাই আর ওপাশ থেকে সেই গায়ক ভদ্রলোক দেখছেন আলমকে। আলম প্রথমে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। কিন্তু অচিরেই সে তন্ময় হয়ে গেল ঘরের অসংখ্য বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে। এত রকমের বাদ্যযন্ত্র আছে! আলম সব শিখবে, সব! এমন সময় গায়ক বললেন, হ্যাঁরে, তুই গান শিখবি বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিস?
আলম ঘাড় নাড়ল।
গান শিখতে গেলে যে কষ্ট সইতে হয়, তা সহ্য করতে পারবি?
আলম বলল, যে কোন কষ্ট আমি সইতাম পারুম। রাজা হাসলেন। বললেন, ওর মধ্যে নিষ্ঠা আছে গোপালবাবু। আপনি ওকে শেখান।
গোপালবাবু বললেন, রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের যখন ইচ্ছে, তখন নুলো গোপাল নিশ্চয়ই তার মূল্য দেবে।
বলে আলমের দিকে তাকিয়ে বললেন, কাল থেকে ভোরবেলা আমার বাড়িতে যাবি। আমি তোকে শেখাব। মনে রাখবি বারো বছর শুধু গলা সাধতে হবে। পারবি তো?
আবার ঘাড় নাড়ল আলম।
ছয়
পরদিন থেকে শুরু হয়ে গেল আলমের সঙ্গীতশিক্ষা।
ক্রমে সকলের পরিচয় জানল আলম। তাকে যিনি গান শেখাবার দায়িত্ব নিয়েছেন, তাঁর নাম গোপালকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। পক্ষাঘাতে তাঁর হাতদুটো শুকিয়ে গিয়েছিল বলে লোকে তাঁকে বলে নুলো গোপাল। তিনি নিজেও বলেন। কলকাতায় তো বটেই, কলকাতার বাইরেও ছড়িয়েছে গোপালের নাম।
গোপালকৃষ্ণ থাকেন রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়িতে। প্রথম দিন ঠিকই ভেবেছিল আলম। সেদিন যিনি ঘরের মধ্যে বসে গান শুনছিলেন, তিনি রাজা-ই। রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর। দ্বারকানাথ - দেবেন্দ্রনাথ - রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারেরই এক শাখা এই ঠাকুর পরিবার। এঁরাও সমপরিমাণে বিদ্যানুরাগী ও ধনী। সেকালের গান-বাজনায় ও নানারকম সাংস্কৃতিক উন্নতিতে এই ঠাকুরবাড়ির অবদানও কম নয়। সৌরীন্দ্রমোহনের আমল থেকে পাথুরেঘাটা ঠাকুরবাড়িতে বাংলাদেশের প্রায় সকল জ্ঞানী-গুণীজনেরই পদধূলি পড়েছে। সেই বাড়িতেই আলমের সঙ্গীত-সাধনা শুরু হল।
প্রতিদিন ভোরে নিমতলায় গিয়ে গঙ্গাস্নান করে আলম। তারপর সোজা চলে আসে পাথুরেঘাটায়। রাজার বাড়ি গুরু গোপালকৃষ্ণের ঘর তার চেনা, সোজা সেই ঘরে চলে যায় আলম। গুরুর নির্দেশমতো কাজ করে চলে। একবার মাত্র দুপুরের শেষে সেই ধনী বাড়ির কাঙালী-বিদায়ের খাওয়া খেতে যায়, রাত্রে আসে ডাক্তারবাবুর চিলেকোঠায়। এছাড়া একমুহূর্তও সময় নষ্ট করে না আলম, স্থির অবিচলভাবে মেতে থাকে তার সাধনায়।
গোপালকৃষ্ণ তাঁর এই ক্ষুদে শিষ্যের নিষ্ঠায় খুব খুশি, এই তো চাই। উপযুক্ত উপাদান পাওয়া গেছে, এখন একটু-একটু করে পালিশ দিতে হবে এর উপর, খাঁটি হীরে করে তুলতে হবে। এতে ধৈর্যহারা হলে হবে কেন?
ধৈর্যের এতটুকু কমতি নেই আলমের। চার বৎসর শুধু গুরুর গান আর তানপুরা-বাদন শুনেই কাটিয়ে দিল আলম। ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত হতে থাকল তার কান আর মন। একদিন স্বরগ্রামের সঙ্গে গলা মেলাতে দিলেন গুরু। সাতটি স্বরকে কত বিচিত্র সজ্জায় কত বিচিত্র ক্রমেই না সাজিয়ে দিলেন তিনি! আলম গুনে দেখল, একে একে তিনশ ষাট রকম পদ্ধতিতে গলা সাধার অভ্যাস করিয়েছেন গুরু।
আলমের স্বর-সাধনা কান পেতে শুনলেন গোপালকৃষ্ণ। যা চেয়েছিলেন, তা-ই হচ্ছে। সহজাত মিঠে গলা আলমের, এখন তাতে প্রত্যেকটা স্বরের প্রত্যেক শ্রুতি স্পষ্ট এবং শুদ্ধভাবে ধরা পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে দমও বেড়েছে। এইবার এর সঙ্গে মৃদঙ্গের বোল শেখাতে শুরু করলেন গুরুজি।
মৃদঙ্গ অবশ্য নিজে শেখালেন না গোপালকৃষ্ণ। তাঁর গানের সঙ্গে মৃদঙ্গ বা তবলা বাজাতেন, নন্দ ভট্টাচার্য। গুরুজির নির্দেশে তাঁর কাছেই আলমের শিক্ষা শুরু হল।
বেশ চলছে আলমের দিনগুলো। অসীম ধৈর্যে সে নুলো গোপাল আর নন্দ ভট্টাচার্যের সব বিদ্যা তিল তিল করে আয়ত্ত করে নিচ্ছে। এমন সময় এক আকস্মিক দুর্বিপাক আলমকে আবার অসহায় করে দিল। বিমূঢ় হয়ে গেল আলম।
অকস্মাৎ কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ল এক আতঙ্ক -- প্লেগ। ইঁদুর মরা দেখলেই লোকে ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালাতে লাগল। লোক যেমন মরছে, তেমন চলেও যাচ্ছে দূরে দূরান্তরে। সেখানেও বিপদ। কেউ কলকাতা থেকে এসেছে শুনলে ঠাঁই মেলে না। তবু প্রাত্যহিক মৃত্যু আর পলায়নে কলকাতা ফাঁকা হয়ে এল।
এই সাত বছরে ভোরে নিত্য গঙ্গাস্নান আলমের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ইদানীং নিমতলায় এলে আলমের মনটা উদাস হয়ে যায়। অবিরত হরিধ্বনি দিয়ে লোক আসছেই, সার সার চিতা জ্বলছেই। মৃত্যুর এই অবাধ লীলা দেখতে দেখতে হঠাৎ নিজের প্রতি মমতা জন্মায় আলমের। যদি সেও মারা যায়! জানতেও পারবেন না তার বাবা-মা, মধুমালতীদিদি কিংবা বড়দা আফতার হোসেন। কিংবা যদি তাদের কেউই! অমঙ্গল আশঙ্কায় চিন্তাটা তাড়াতাড়ি ঝেড়ে ফেলে আলম। দ্রুত স্নান সেরে সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। গত রাতে গুরু বলেছেন অজ নূতন পাঠ দেবেন। অধীরতায় আলমের আর সবুর সইছে না।
কিন্তু কী হয়েছে আজ পাথুরেঘাটার এই বাড়িটায়? এত ভোরে এত জনসমাগম কেন? উৎসব? উৎসব হলে সবাই নীরব কেন; সকলের পাশ কাটিয়ে একতলার এক কোণে গানের ঘরের দিকে এগোতে থাকে আলম।
ঘরের দরজা খোলা। ভেতরে উঁকি দিল আলম। ডাকল গুরুজিকে। কিন্তু কোন সাড়া এল না। আলম ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকল। ঘর ফাঁকা। বিছানাটা পর্যন্ত নেই। শুধু যন্ত্রগুলো যেমন সাজানো থাকে, ঠিক তেমনি রয়েছে।
হঠাৎ একটা তীব্র কান্নার শব্দে চমকে উঠল আলম। লোকটির নাম ঠিক জানে না সে, তবে লোকটা আসত গোপালকৃষ্ণের বাজনা শুনতে। ঘরে ঢুকে বিছানাছাড়া খাটটার ওপরেই লুটিয়ে পড়েছেন। কী ব্যাপার!
একটু পরেই ব্যাপারটা শুনল আলম। গত রাতে সে বাড়ি যাওয়ার পর গোপালকৃষ্ণের শরীরে প্লেগ আক্রমণের চিহ্ন প্রকাশ পায়। ঐ রোগে চিকিৎসার অবসর মেলে না। রাজাসাহেব তবু ডাক্তার ডেকে আনেন। কিন্তু তার আগেই গোপালকৃষ্ণ ইহলোক ত্যাগ করেছেন।
রাজবাড়ির লোকেরা কাউকেই বেশীক্ষণ থাকতে দিল না ঐ ঘরে। ঘরের সব কিছু ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতে হবে। কে জানে, কোথায় কোথায় লুকিয়ে আছে প্লেগের জীবাণু!
শূন্য মনে রাজবাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল আলম। গত রাতেও সস্নেহে যে মানুষ নূতন পাঠ দেবার অঙ্গীকার করেছেন, মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তিনি চলে গেলেন সকলরকম স্নেহ-মমতার বাইরে। এবার কী করবে আলম? কোথায় যাবে?
ডাক্তারবাবুর চিলেকোঠায় পাথরের মতো পড়ে রইল আলম। খেতেও ভালো লাগছে না তার।
দিন সাতেক এমন শূন্যতার মধ্যে কেটে গেল আলমের। তারপর ধীরে ধীরে আবার সে লোকের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করল। ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না, তাকে যে নূতন গুরু খুঁজে নিতে হবে, তাকে যে - সঙ্গীতের রাজ্য জয় করতেই হবে।
হঠাৎই সেদিন নন্দ ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আলমের। হনহন করে চলেছেন ভট্টাচার্যমশাই। আলম ডাকল মৃদুস্বরে। পিছু ডাকার জন্য যদি ভট্টাচার্যমশাই রেগে যান! তার চেয়ে বরং পিছ পিছু যাওয়া যাক তাঁর। আলম নন্দবাবুর পিছু নিল।
নন্দ ভট্টাচার্য চলতে চলতে সিমুলিয়ার এক মস্ত বাড়িতে ঢুকলেন। আলম বাড়িটা চিনল। এটাকেই বলে সিমলের দত্তবাড়ি। ঐ বাড়ির ছেলে হাবু দত্তের নাম শুনেছে আলম গোপালকৃষ্ণের মুখে। বিলিতী বাজনায় হাবু দত্তের না কি জুড়ি নেই। রামপুরের নবাব খবর পেয়ে তাঁকে না কি অনেক সাধ্যসাধনা করে কিছুদিনের জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের দরবারে। সেখানে সমান আদরে রেখেছিলেন নিজ ওস্তাদ উজির খাঁর সঙ্গে।
দত্তবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রইল আলম।
এই দত্তবংশকে সিমুলিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন রামমোহন দত্ত। সুপ্রিম কোর্টের বিখ্যাত উকিল ছিলেন তিনি। বিপুল বিত্ত রেখে তিনি মারা যান। কিন্তু তাঁর পুত্র দূ্গার্চরণ মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে বিশ্বনাথ নামে এক শিশুপুত্র রেখে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে যান। এই বিশ্বনাথ দত্তের পুত্র নরেন্দ্রনাথই পরে বিবেকানন্দ নামে জগদবিখ্যাত হন।
হাবু দত্ত হলেন বিবেকানন্দের জ্ঞাতি ভাই। দত্তবাড়ি তখন শরিকী অনেক টুকরো হয়ে গেছে। তবু দত্তবাড়ি তখনকার কলকাতার এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র! গোটা বংশে তখন বিশ ত্রিশটি যুবক। এক-একজন এক-এক দিকে দিকপাল। জ্ঞান-বিজ্ঞানে, স্বাস্থ্যচর্চায়, নূতন নূতন সামাজিক আন্দোলনে দত্তবাড়ি পুরোধাদের অন্যতম।
গান-বাজনার চর্চাও কম নেই এ বাড়িতে। স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ যে কী ভালো গান গাইতে পারেন, তা তখনকার বহু মানুষ ভালো করেই জানেন, বিশেষ করে জানেন রামকৃষ্ণ-শিষ্যেরা।
কিন্তু নরেন্দ্রনাথের ঐ জ্ঞাতি ভাইটি হলেন একেবারে দলছাড়া। বাপ-মা মারা গেছেন আগেই। না বিয়ে-থা, না লেখাপড়া। শুধু গান আর বাজনা। এ শুধু হাবু দত্ত নয়, তাঁর ভাই টম দত্তও। পোশাকী নাম তাঁদের অমৃতলাল আর সুরেন্দ্রনাথ। তাঁদের বাজনা এত জনপ্রিয় যে, পোশাকী নামের বদলে ডাকনামেই তাঁরা সর্বজনে পরিচিত ছিলেন।
কোন্ বাজনা বাজান হাবু দত্ত? ক্ল্যারিওনেট বাজনায় তাঁর জুড়ি ছিল না। শুধু কি ক্ল্যারিওনেট, বেহালা, বাঁশি, সেতার, ম্যাণ্ডোলিন, ব্যাঞ্জো ইত্যাদি যত দেশী-বিদেশী বাদ্যযন্ত্র সবেতেই তিনি সিদ্ধহস্ত।
হাবু দত্তই দেশী-বিদেশী বাদ্যযন্ত্র একত্রে মিশিয়ে কনসার্ট বাজানো চালু করেন। সেটা চালু হল আমাদের, যাত্রায়, থিয়েটারে। সেই ন্যাশনল থিয়েটারের আমল থেকে থিয়েটারের নাটকে কত যে গানের সুর দিয়েছেন হাবু দত্ত তার ঠিক-ঠিকানা নেই। এহেন হাবু দত্তের বাড়ির সামনে দুরুদুরু বক্ষে দাঁড়িয়ে রইল আলম।
কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেই আলম বুঝল, এ বাড়িতে পাথুরেঘাটার ঠাকুরবাড়ির মতো অত দারোয়ানও নেই, প্রবেশ প্রস্থানের অত কড়াকড়িও নেই।
তব ঢুকবে কিনা ভাবছে, এমন সময় ডানাদকের দালানগুলো থেকে ভেসে এল বিচিত্র বাজনার সুর। বুকের ভিতরটা যেন উদ্দাম হয়ে উঠল আলমের, কিছু ভাবনাচিন্তা না করেই সে ছুটে গেল সেই ঘরটার সামনে, যে ঘর থেকে আসছে বাজনার শব্দ।
ঘর-বোঝাই শৌখিন মানুষ। বসে, দাঁড়িয়ে নানা ধরনের বাজনা বাজচ্ছেন নানা জন। রোগা মতো একটা মানুষ সমস্ত বাদ্যযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করছেন ঘাড় দুলিয়ে, হাত নাড়িয়ে। আলম বুঝল, উনিই হাবু দত্ত। তার মনে হল, এ বাদনের বিদ্যা আয়ত্ব না করতে পারলে জীবন বৃথা।
বাজনা থামতেই পাগলের মতো ছুটে গিয়ে আলম লুটিয়ে পড়ল হাবু দত্তের পায়ে। হাবু দত্ত পা ছাড়াবার চেষ্টা করে বললেন, কী চাস? কী চাস তুই?
আলম বলল, শুধু আপনার পায়ের তলায় পড়ে থাকতে চাই। বলে চোখের জলে ভিজিয়ে দিল তাঁর পা।
আলমের কান্না থামিয়ে তার সব কথা শুনলেন হাবু দত্ত। শুধু তিনিই শুনলেন না, শুনলেন উপস্থিত সবাই। সব শুনে একজন রসিকতা করলেন - বহুৎ আচ্ছা। তুই তাহলে থাকিস রাস্তায়, খাস লঙ্গরখানায়, আর চাইছিস হাবু দত্তের কাছে বাজনা শিখতে। বুঝলে হে হাবু দত্ত, তোমার শিষ্য হবার উপযুক্ত পুরুষই বটে।
লোকটির বলার কায়দায় সকলে হো-হো করে হেসে উঠলেন।
আলম তাকাল সকলের দিকে। বুঝল, তার মতো পথের ভিখারির এখানে আসা ঠিক হয় নি, এখানে দয়া করবে না কেউ।
কিন্তু হাবু দত্তের দিকে তাকিয়ে যেন অন্যরকম লাগল আলমের। তাঁর চোখে তো উপহাস নেই। তিনি তো আগ্রহের চোখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। তবে কি আলমের ইচ্ছা পূরণ হবে? আলম তার দেশী ভাষায় বলল, এ বাজনা না শিখলে আমি বাঁচতাম না।
হাবু দত্ত তার পিঠে থাবড়া মেরে বললেন, সাবাস ব্যাটা। এই তো চাই। জীবনের সব কিছু না ছাড়লে সুরের রাজ্যে ঢোকা যায় না। তুই যখন সকলের স্নেহের মায়া কাটিয়ে এসেছিস, তোর হবে। আমি তোকে শেখাব।
* * * *
হাবু দত্তের সঙ্গে আলমের স্বভাবে খুব মিলে গেল। এতখানি নিষ্ঠা এর আগে আর কারো মধ্যে দেখেন নি হাবু দত্ত। ফলে ভাণ্ডার উজাড় করে শেখাতে লাগলেন তিনি আলমকে। গোপালকৃষ্ণ সাত বছরে আলমের কানটাকে এমন তৈরি করে দিয়েছেন যে, কোন কিছুই বার বার দেখাতে হয় না তাকে। অন্যে যা শিখতে এক বছর সময় নেয়, আলম তা তুলে নেয় এক মাসে। ষতরকম বাদ্যযন্ত্র ছিল হাবু দত্তের সংগ্রহে, সবরকম বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শিখছে আলম। শিখছে স্বরলিপি তৈরি করতে।
শিষ্যের আগ্রহ আর তৎপরতা দেখে হাবু দত্ত বিস্তর গৎ শেখালেন তাকে। একদিন বললেন, তুই কি ডাকাত না কি রে আলম? তুই যে আমাকে ফতুর করে দিলি!
কিছুদিন বাদে হাবু দত্ত বললেন, চল্ আলম, তোর একটা চাকরি ঠিক করেছি। তুই সেখানে চাকরি করবি।
আলমকে নিয়ে হাবু দত্ত গেলেন মিনার্ভা থিয়েটারে। সে থিয়েটারের ম্যানেজার তখন নটগুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষ। তাঁর একটার পর একটা নাটক অভিনয় হচ্ছে আর লোকে যেন পাগল হয়ে উঠছে, এমনি তাঁর লেখার গুণ, এমনই পরিচালনা ও অভিনয়ের ক্ষমতা। এসব নাটকে গান-নাচের আয়োজনও কম নেই। নৃপেন বসু বা নেপা বসুর নাচ বাজার মাত করেছে তখন। অন্য থিয়েটারেও চলছে নেপা বসুর নাচের নকল। মিনার্ভা থিয়েটারে তখন এসব নাচের সঙ্গে তবলা বাজান শশী সাহা। সাহামশাই বাজান ভালোই, তবে না তখন তিনি একে হয়েছেন বৃদ্ধ, তায় শুরু করেছেন আফিংয়ের নেশা। ফলে ঝিমুতে থাকেন অবিরাম। কয়েকদিন নাচের সময় ঠিকমতো বাজাতে ভুলেই গেলেন।
বিরক্ত হয়েই গিরিশচন্দ্র হাবু দত্তকে বলেছিলেন একজন তবলচি যোগাড় করে দিতে। সেখানেই আলমকে নিয়ে এলেন হাবু দত্ত।
গিরিশচন্দ্র চাকরকে ইঙ্গিত করলেন, সে একজোড়া বাঁয়া তবলা এনে দিল। গিরিশচন্দ্র বললেন, বাজাও।
আলম বাজাতে শুরু করল।
অতটুকু ছেলের অত নির্ভুল বাজনা শুনে নটগুরু হাবু দত্তকে বললেন, তোমার সংগ্রহটি তো খাসা। কিন্তু এখানে এসে আবার টেঁসে না যায়।
হাবু দত্ত বললেন, সম্ভবত তা হবে না। অনেক পোড় খাওয়া মেটে হাঁড়ি।
গিরিশচন্দ্র বললেন, তবে আজ থেকেই লেগে যাক।...ওরে, তোর নাম কী রে?
আলম তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বলল, আজ্ঞে আলাউদ্দিন খাঁ।
-- উঁহু। ওসব মুসলমান নাম এখানে চলবে না। তোর মুখটা বেশ খুশি-খুশি, প্রসন্ন। তোর নাম দিলুম প্রসন্ন বিশ্বাস। দেখিস বাবা, বিশ্বাসভঙ্গ করিস নি যেন।
বলেই হো-হো করে হেসে উঠলেন বঙ্গরঙ্গালয়ের জনক।
সেই দিন থেকেই আলম ‘প্রসন্ন বিশ্বাস’ হয়ে লেগে গেল থিয়েটারের দলে। এখানে কত জ্ঞানী-গুণী আসেন। সৎসঙ্গে অনেক কিছু জানতে পারবে, এ-ই তার আশা।
কাজ খুব বেশি নয়। কিন্তু যা ভেবেছিল আলম, তা হল না। থিয়েটারে একঘেয়ে জীবন, নূতন কিছুই সেখানে শিখতে পেল না আলম, ব্যথাভরা মন নিয়ে অবসরের দিনগুলো ঘুরে বেড়ায় সে।
এক সান্ধ্য অবকাশে ফোর্ট উইলিয়ামের পাশে গঙ্গার ধারে চুপ করে বসে আছে আলম। সহসা বেজে উঠল ফোর্টের ব্যান্ড। গোরাদের ব্যান্ড বাজনার নাম শুনেছে আলম, কিন্তু সেটা যে এমন তা জানত না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে সেই বাজনা শুনল আলম। তারপর মনে মনে ঠিক করল, এ বাজনা তাকে শিখতেই হবে। নইলে এ জীবন বৃথা।
দূর থেকে বাজনদারদের দেখে কে তাদের প্রধান বুঝে নিল আলম। সাহেবটি বের হতেই তার পিছন পিছন চলতে থাকে সে। এখন কলকাতা আলমের অচেনা নয়। ময়দান পার হয়ে সাহেব চলেছে ধর্মতলার পথ ধরে। খানিক এগিয়ে এক গলিতে ঢুকল সাহেব।
বাড়িটা দেখে নিল আলম।
সামনের একটা পান-সিগারেটের দোকান থেকে সাহেবের পরিচয় জেনে নিল আলম। লেবো সাহেব নামে পরিচিত তিনি। জাতে গোয়ানীজ, ভারী বদরাগী লোক। মেম সাহেবকে নিয়ে বাস করেন এ বাড়িতে। ছেলেমেয়ে নেই।
আলমের ভয় হল বদরাগী শুনে। কিন্তু ঐ বদরাগী মানুষটাকে রাজি না করাতে পারলে তো চলবে না। কি করবে আলম? হাল না ছেড়ে দিনের পর দিন লেবো সাহেবের পিছনে এবং তার বাড়ির চারিদিকে ঘোরাঘুরি করতে থাকল আলম।
লেবো সাহেবকে রাজি করাতে পারার আগেই আর এক জায়গায় বাঁধা পড়ল আলম। একদিন মেছোবাজারের কাছ দিয়ে যেতে যেতে সানাই-এর সুরে তন্ময় হয়ে গেল আলম। বাজাচ্ছেন হাজারী ওস্তাদ। তেলাপোকা যেমন কাঁচপোকাকে টানে, হাজারী ওস্তাদের সুরও তেমন আলমকে টেনে নিয়ে গেল, বাজনা শেষ হতেও আবিষ্ট ভাব কাটল না আলমের।
ছেলেটার ভাব দেখে খুশি হলেন হাজারী ওস্তাদ। বাজনা শুনে এমন আবেশ তো যার-তার ভিতর আসে না। ওস্তাদ শুধালেন, তোমার কী চাই বাপজান?
আলম বলল, ওস্তাদ। আমি আপনের পায়ের নখেরও যোগ্যও না। আমারে একটু সানাইয়ে তালিম দিবেন?
হাজারী ওস্তাদ জীবনে এমন আবেদন শোনেন নি। তিনি বললেন, যদি তুমি নিতে পার, আমার সব তোমাকে দেব।
সত্যই উজাড় করে দিলেন হাজারী ওস্তাদ। আলম নিলও৷ ক’মাসের মধ্যেই সানাই, টিকারা, নাকাড়া শেখা হল আলমের।
কিন্তু লেবো সাহেবের বেহালা? তাঁর ব্যান্ড? তখনও হাল ছাড়ে নি আলম। লেবো সাহেবের পিছনে তখনও ঘোরে, তখনও পাক খায় বাড়িটার চারদিকে। লুকিয়ে লুকিয়ে বাজনা শুনে মনে মনে সুর তুলে নেয়।
কিন্তু যন্ত্র কোথায়? কোথায় গুরুর শিক্ষা? এখনও যে সাহেবের সামনে দাঁড়াতেই সাহস হয় না। একদিন সাহেব দরজা খুলে-বের হতেই বেপরোয়ার মতো তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াল আলম। সাহেব থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, ক্যা মাংতা?
যেন সিংহ- গর্জন হল।
ভয়ে ভয়ে আলম বলল, বেহালা বাজনা শিখুম।
নাক-মুখ কুঁচকে সাহেব বললেন, ক্যা?
তারপরেই আলমের প্রার্থনাটার অর্থ বুঝে আঙুল নেড়ে হাত ছুঁড়ে চীৎকার করে উঠলেন -ভাগ হিঁয়াসে!
আলম ভয় পেলেও ভাগতে পারল কই? এমন করে কোথাও ব্যাহত হয় নি আলমের ইচ্ছা, কেউই তাকে তাড়িয়ে দেয় নি। এমন বিতাড়নের সামনে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়েই রইল আলম। একটা হুঙ্কার ছেড়ে পাশ কাটিয়ে নিজেই চলে গেলেন লেবো সাহেব।
এবার কি কান্নায় ভেঙে পড়বে আলম? কিন্তু তার আগেই তার জামার কলারে টান পড়ল। কে? ঘুরে আরো হতবাক হয়ে গেল আলম, তাকে ডাকছেন স্বয়ং মেমসাহেব! সাহেবের হাত থেকে যদি বা নিস্তার মিলেছে, মেমসাহেব এবার তাকে চপ-কাটলেট না বানিয়ে ফেলেন! আলম নির্বোধের মতো চোখ তুলে তাকাল মেম-সাহেবের দিকে।
মেমসাহেব বললেন, তুম বেহালা বাজনা শিখিতে চাও?
ঘাড় নাড়ল আলম।
মেমসাহেব তাকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন। বসালেন বৈঠকখানায়। তার হাতে বেহালা দিয়ে বললেন, বাজাও।
মাথা নীচু করল আলম। বলল, আমি বাজাতে জানি না মেমসাহেব। আমি শিখবার চাই।
মেমসহেব আর একটা বেহালা আনলেন। তিনি বাজালেন একবার। মুহূর্তে আলম নিজের বেহালায় তা তুলে বাজিয়ে দিল। মেমসাহেব অবাক। আর একরকম বাজালেন তিনি। আলম সেটাও তুলে বাজিয়ে দিল। মেমসাহেব আনন্দে বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ইউ নটি বয়! তুমি বাজাইতে জানে।
আলম বলল, না, জানি না মাইজি। শিখতাম।
মেমসাহেব খুশিতে হাসলেন!
সেই থেকে সাহেব ফোর্টে গেলে লুকিয়ে লুকিয়ে আলমকে বেহালা বাজানো শেখাতে লাগলেন মেমসাহেব, আর আলমও যত দ্রুত পারল মেমসাহেবের গোপন দান তুলে নিতে লাগল।
কিন্তু এ চুরি বেশিদিন চলল না। একদিন অসময়ে বাড়ি ফিরে এলেন লেবো সাহেব, হাতেনাতে ধরা পড়ে পড়ে গেল আলম আর মেমসাহেব। কিন্তু ও কি! সাহেব তো আগুনের মতো জ্বলে উঠলেন না! উলটে তাঁর চোখ-মুখ থেকে খুশির ঝলক ঝরে পড়ছে!
আলমের পিঠ চাপড়ে তিনি বললেন, তুমি এত ভালো বাজাইতে শিখিয়াছ? তবে আমিই শিখাইব। আলম যেন হতে স্বর্গ পেল। কিন্তু শুধু লেবো সাহেবের কাছে শিখলেই তো হবে না, নিজের রেওয়াজের জন্য যন্ত্রও তো কেনা চাই। অনেক যন্ত্র।
টাকা?
তারও একটা ব্যবস্থা হল। লেবো সাহেব আলমকে ফোর্টের ব্যাণ্ডে ভর্তি করে দিলেন। এদিকে মিনার্ভার চাকরিও চলছে। কোন আয় থেকে একটা পয়সাও খরচ করে না আলম, সব জমায়। এখনও খায় সেই লঙ্গরখানায়। তাতেই দিন চলে যায় আলমের। একদিকে লেবো সাহেব, অন্যদিকে হাজারী ওস্তাদ। টাকাও জমছে। যন্ত্রগুলো নিশ্চয়ই হবে। আঃ, স্বর্গ কত দূর?
কিন্তু সে স্বর্গে আর পৌঁছানো হল না আলমের।
একদিন মিনার্ভা থেকে বের হতেই ভূত দেখার মত চমকে উঠল আলম। সামনে কে দাঁড়িয়ে! তার দাদা আফতারউদ্দিন!
আফতার হাত চেপে ধরলেন আলমের। বললেন, সকলকে কাঁদিয়ে এ তুই কোথায় পড়ে আছিস? ফিরে চল্ বাড়িতে।
আফতারউদ্দিন আলমকে টেনে নিয়ে চললেন শিয়ালদহের দিকে। সেখান থেকে ট্রেনে করে গোয়ালন্দ, গোয়ালন্দ থেকে ক্রমে শ্যামগঞ্জের লঞ্চ হয়ে শিবপুরে।
আলম এসে দাঁড়াল তার অতিপুরাতন বন্দীশালায়।
পরবর্তী পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
বাজাও আমারে বাজাও (শেষাংশ)
লেখক: নীরদ হাজরা
প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
তৃতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
দশ
নবাবের ইচ্ছায় পরদিনই নাড়া-বাঁধা উৎসব অনুষ্ঠিত হল। সে উৎসবে উপস্থিত থাকলেন যতেক দরবার-শিল্পীরা। বিতরণ করা হল প্রচুর মিঠাই। মুখে সকলেই হাসি আর উল্লাস প্রকাশ করলেও এক পুঁচকে ছোকরার এই আধিপত্যে ঈর্ষানল জ্বলল প্রায় সকলের বুকেই। স্বভাবত দরবার-শিল্পীদের মধ্যে আলমের বন্ধুত্বের সুযোগ কমে গেল।
অবশ্য বন্ধুত্ব করবার অবসরই বা কোথায় আলমের! ভোরবেলা কোনক্রমে দুটি মুখে দিয়ে সে দ্রুত ছোটে গুরুর বাড়িতে। গুরুর পায়খানা পরিষ্কার করে, জল ভরে রেখে তার গুরু-সেবা শুরু হয়। তারপর গুরুর আদেশের জন্যে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। কিন্তু দুর্ভাগ্য,দিনের পর দিন যায়, গুরুর খিদমতগারি ছাড়া আর কিছুই হয় না আলমের দ্বারা! গুরু বোধহয় আলমকে শিক্ষা দেওয়ার কথা ভুলেই গেছেন।
এমান করে কেটে গেল দু বছর তিন মাস।
অবশ্য এই সাতাশ মাসের মধ্যে আরো কতকগুলি ঘটনা ঘটেছে আলমের জীবনে। প্রথমত, ওয়াজির খাঁর শিষ্যত্ব লাভের পরেই ঠিকানা জানিয়ে আলম চিঠি দেয় বাবাকে, তার দীক্ষার কথাও জানায়। দ্বিতীয় ঘটনা -ব্যাণ্ডমাস্টার হুসেন খাঁর বন্ধুত্ব লাভ। হুসেন খাঁ আলমের কাছ থেকে যেমন গ্রহণ করেন, শেখানও তেমনি।
অনেক ধ্রুপদ আর হোরি এসে জমে আলমের ভান্ডারে। কিন্তু ওয়াজির খাঁর কাছে শিক্ষা?
বিচিত্রভাবেই ঘটনাটা ঘটল আলমের জীবনে। এজন্য নিজের স্ত্রীর প্রতি আলমের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ওর টাকাতেই আলম প্রথম যন্ত্র কিনতে পেরেছিল। ওর জন্যই অবশেষে ওয়াজির খাঁর করুণা লাভ করেহিল আলম। ও যত দূরেই থাকুক, আলমের চারদিকে মঙ্গলের আবরণ দিয়ে রক্ষা করেছে চিরকাল। স্ত্রীর এত প্রীতির প্রতিদান কী দেবে কাঙাল আলম। অবশেষে নিজের জীবন-সাধনার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান, তার আবিচ্কৃত নূতন রাগের নাম দিয়েছিল ‘মদনমঞ্জরী’; এ নামেই অক্ষয় হয়ে থাকবে স্ত্রীর প্রতি আলমের কৃতজ্ঞতা।
সেদিন দ্বিপ্রহরে গুরুর দরজা থেকে বাড়ি ফিরছে আলম। এমন সময় গুরুর মেজোছেলে নজির খাঁ এসে ডাকলেন তাকে, বাবুজি, শীঘ্র আসুন। পিতাজি আপনাকে ডাকছেন।
ছুটল আলম।
গুরুজি গম্ভীর। আলম বুঝল, অজ্ঞাতে কোন অপরাধ ঘটে গেছে। আলম মাথা নীচু করে বলল, গোস্তকি মাপ কিজিয়ে। কৈ গাফিলতি হো গিয়া!
গুরু মাথা ঝাঁকালেন। মরমে মরে গেল আলম। মাথা ঝুঁকে পড়ল ওর। গুরু বললেন, তুমি বিয়ে করেছ?
আলম বলল, জি, হাঁ। বাবা কথা দিয়েছিলেন আমার স্ত্রীর বাবাকে। পিতৃ-সত্য পালন করেছি।
--বুরবাক! কিন্তু মেয়েটির প্রতি কী ব্যবহার করেছ?
আলম আবার মাথা নীচু করল। .
গুরু বললেন, এই দেখ, তোমার বাবা তার করেছেন, তোমার স্ত্রী আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। ছিঃ! যার দিল এত কঠোর, সে শিখবে সঙ্গীত?
স্তব্ধ হয়ে রইল আলম।
গুরু বললেন, আজই বাড়ি ফিরে যাও।
হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল আলম।কি নিয়ে আমি বাড়ি ফিরব? আমি যে বড় গর্ব করে জানয়েছি, ওয়াজির খাঁ আমার হাতে শিষ্যের নাড়া বেঁধেছেন! অথচ আমি যে কিছুই শিখি নি!
গুরু ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, কিছুই শেখ নি? মানে? এই তিন বছর --
-- আপনি তো আমাকে শেখান নি!
-- আমি না শেখাই, আমার ছেলেরা? পর্যায়ক্রমে ছেলেদের দিকে তাকালেন ওয়াজির খাঁ।
ছেলেরা বলল, আমাদের তো সে আদেশ দেন নি।
স্তব্ধ হয়ে গেলেন ওয়াজির খাঁ। ইস্, কিছুই পায় নি ছেলেটা, অথচ গোলামের গোলামের মতো সেবা করে গেছে! ছিঃ ছিঃ, কী ভুল করেছেন তিনি! ছেলেদেরও শিক্ষা দেওয়ার কথা বলতে ভুলে গেছেন। ওয়াজির খাঁ ছেলেদের বললেন, আজ থেকে আলম তোমাদের ভাই হল। ওকে শেখাবার দায়িত্ব তোমাদের। আমিও শেখাব।
পরদিন থেকে শুরু হল আলমের শিক্ষা। আলম বুঝি পারলে চব্বিশ ঘণ্টাই পড়ে থাকে তরা সাধনা নিয়ে, কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। এদিকে অত্যচারে-অত্যাচারে শরীরও ভেঙে পড়েছে। তবু ক্লান্তি নেই আলমের।
গুরু ওয়াজির খাঁ বলেন, মাংস খা আলম। স্বাস্থ্য ভালো হবে, বুকে বল হবে, বেশি দম পাবি।
আলম হাসে। যে গোস্ত সে জীবনে খায় নি, তা আর খাবে না।
একদিন দরবারেও এই গোস্ত খাওয়া নিয়ে কথা উঠল। কথা চলতে চলতে ‘মছলিখোর’ আলমকে নিয়ে, কথা উঠল, কথা উঠল বাঙালীকে নিয়ে। মুহূর্তে চটে গেল আলম। তাকে নিয়ে বিদ্রুপ সইতে পারে আলম, কিন্তু তার জাতকে নিয়ে নয়। বাঙালী আলম সগর্বে বলে উঠল, গোস্ত খেয়ে তোরা যা ডান হাতে পারিস, মছলি খেয়ে বাঙালি তা বাঁ হাতে পারে। দেখবি?
বলে হাত বদলে বাঁ হাতে সরোদ ধরল আলম। বলল, আজ থেকে আমি আর তারবাদ্য ডান হাতে বাজাব না, বাজাব বাঁ হাতে।
আজীবন তাই বাজিয়ে গেছে আলম। এতখানি স্বজাতির প্রতি মর্যাদাবোধ আমাদের অনেক মহান নেতার মধ্যেও বিরল।
এমনিভাবে কেটে গেল আলমের শিক্ষার চার বছর। এক শরতের সকালে ওয়াজির খাঁ বললেন, এবার তোমার শিক্ষা সমাপ্ত। তুমি এবার দেশ-ভ্রমণে বেরিয়ে পড়। পরীক্ষা দাও। লোকের চিত্ত জয় কর। বিশ্বে নিজের স্থান খুঁজে নাও।
গুরর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে, নবাবের শুভেচ্ছা নিয়ে আলম ফিরে চলল কলকাতায়। শুরু হল তার বিশ্ব-পরিক্রমা। এই প্রসঙ্গেই সে উঠল পুঁটিয়ারাণীর বাড়িতে। সেখানেই পরিচয় ঘটল শ্যমলাল ক্ষেত্রীর সঙ্গে। তিনিই ভবানীপুর সঙ্গীত সম্মেলনে বাজাবার ব্যবস্থা করে দিলেন আলমের। সেখান থেকেই নাম ছড়িয়ে পড়ল আলমের।
* * * *
সঙ্গীত-সম্মেলনের শেষে শ্যমলাল ক্ষেত্রী আবার দেখা করলেন আলমের সঙ্গে। অবশ্য তখন কেউ আর তাঁকে আলম বলে না। বলে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ।
শ্যামলাল বললেন, ওস্তাদ, আপনি এখন কোথায় যাবেন?
আলাউদ্দিন গুরুর আদেশের কথা শুনিয়ে দিলেন শ্যামলাল ক্ষেত্রীকে।
শ্যামলাল বললেন, আমার কথা শুনুন ওস্তাদজি। আমার বন্ধু ব্রজনাথ সিংজি হচ্ছেন মাইহারের রাজা। রাজাজি একজন উপযু্ক্ত ওস্তাদ খুঁজছেন। আপনি তাঁর কছে যান। যে কোন কাজে এগুতে গেলে একজন যোগ্য পৃষ্ঠপোষক চাই তো!
আলাউদ্দিন খাঁ মানলেন ক্ষেত্রীমশাইয়ের যুক্তি। কিন্তু মাইহার যাবার অর্থ কোথায়? আজ তো আর তিনি অবুঝ নন যে, বিনা টিকিটে স্টীমারে বা রেলে চেপে বসবেন!
কিন্তু এই দারিদ্রের কথা বলাই বা যায় কী করে?
আলাউদ্দিনের নীরবতা এবং মুখের চেহারা দেখে শ্যামলাল নিজেই বুঝলেন অবস্থাটা। বললেন, দ্বিধা করবেন না, ওস্তাদজি। উঠুন, আজই রওনা হোন। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
সব ব্যবস্থাই শ্যামলাল করে দিলেন-ট্যাক্সি করে স্টেশনে নেওয়া, টিকিট কাটা, গাড়িতে খাওয়ার ব্যবস্থা।
সম্ভবত মাইহারে রাজার কাছে তারও করেছিলেন শ্যামলাল। তাই স্টেশনে রাজার পাঠানো গাড়ি উপস্থিত ছিল। বিকেলের দিকে মাইহার রাজপ্রাসাদে রাজার কাছে উপস্থিত হলেন আলাউদ্দিন।
তরুণ বয়সী রাজা। মন্দ লাগল না যুবককে। আলাউদ্দিন খাঁ কে সাদরে বসিয়ে গান শুরু করতে বললেন দেওয়ানজি।
পরীক্ষা! খুব সতর্ক হয়ে সময় ও শাস্ত্রের নির্দেশ মিলিয়ে নিজের প্রিয়তম রাগে গান ধরলেন আলাউদ্দিন খাঁ। দিন আর রাত এসেছে সন্ধ্যার প্রান্তে। এই সন্ধিক্ষণের প্রকাশই তো শ্রী রাগে, আর শ্রীরাগ আলাউদ্দিন খাঁ-র হাতে খেলে ভাল৷
কিন্তু ক মিনিট যেতে না যেতেই রাজা উসখুস করতে থাকলেন। মনে মনে বিরক্ত হলেন আলাউদ্দিন। এই সময়ে এমন রাগের বিশুদ্ধ প্রকাশেও যে তন্ময় হতে পারে না সে তো বেরসিক! হা আল্লা! ওয়াজির খাঁর শিষ্য হয়ে তাঁকে এমন এক বেকুফের কাছে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে! নিজের ভাগ্যকে মনে মনে ধিক্কার দিতে থাকলেন তিনি। এমন সময় বেকুফ রাজা চরম বেকুফি করলেন, থামতে বললেন আলাউদ্দিন খাঁকে। --এখন বিশ্রাম করুন, বলে রাজা চলে গেলেন।
অপ্রসন্ন মনে তাঁর জন্যে নির্দিষ্ট ঘরে চলে গেলেন আলাউদ্দিন। বুঝলেন, মাইহারে তাঁর অধিষ্ঠান হচ্ছে না, চলে যেতে হবে এখন থেকে। কিন্তু কোথায় যাবেন? যতক্ষণ রাজা বিদায় না দিচ্ছেন, ততক্ষণ যাওয়া হচ্ছে না। সেটা বেয়াদবি। তা করতে চান না আলাউদ্দিন খাঁ। কিন্তু এমন বেরসিকের রাজ্যে আর থাকতেও ইচ্ছে করছে না। এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকলেন তিনি।
ঘণ্টা কয়েক পর আবার তলব হল আলাউদ্দিনের। মন অপ্রসন্ন হলেও মুখে হাসি টেনে দরবারী ভঙ্গীতে তিনি দেওয়ানের পিছনে পিছনে যে ঘরে এলেন, সেটা একটা মস্ত হলঘর। একদিকে রেওয়াজের স্থান, তার চারদিকে থরে থরে সাজানো রয়েছে নানা জাতের যন্ত্র।
দেওয়ানজনী তাঁকে রেওয়াজের আসনে বসতে বললেন। আলাউদ্দিন খাঁ বসতে তাঁর হতে এগিয়ে দেওয়া হল প্রথম যন্ত্র-একটি ক্ল্যারিওনেট।
কী বাজাবেন আলাউদ্দিন? শ্রীরগে যাঁর বিরাগ, তাঁকে কী সুর শোনাবেন? মিনার্ভা থিয়েটারের হালকা চটুল গানের সুর তুললেন আলাউদ্দিন খাঁ।
খানিক বাজাতেই থামবার ইঙ্গিত হল। ক্রুদ্ধ মনে থামলেন তিনি।
আবার আর একটি যন্ত্র তুলে দেওয়া হল তাঁর হাতে। বাজানো শুরু হতে না হতে থামতে হল। একে একে প্রত্যেকটি যন্ত্র বাজাতে হল তাঁকে। বাজালেন হালকা থেকে গভীর, করুণ থেকে আনন্দঘন নানান সুর। কিন্তু কোন কিছুতেই খুশি হলেন না রাজা। দু মিনিট না বাজাতেই থামতে হল তাঁকে। ঘণ্টাদুয়েকে ঘরের সব বাদ্য বাজিয়েও বেরসিককে বাগে আনতে পারলেন না তিনি।
দেওয়ানজি এবার কণ্ঠ-সঙ্গীত শুরু করতে বললেন। কণ্ঠ-সঙ্গীত মিনিট কয় চলতে না চলতে রাজাজি অধৈর্যের মতো উঠে দাঁড়ালেন। গান থামিয়ে আলাউদ্দিন খাঁকেও উঠে দাঁড়াতে হল। রাজা ছুটে এলেন।
গালে চড় মারবেন না কি? না, আলাউদ্দিন খাঁ কে বিস্মিত করে রাজা তাঁর হাত জড়িয়ে ধরলেন।
বললেন, ওস্তাদজি, আপনি আমায় বিস্মিত করেছেন। আমার প্রতিজ্ঞা ছিল, আমার সংগ্রহের সব বাদ্য বাজাতে পারবেন যে ওস্তাদ, তাঁকে আমার সভাগায়কের পদে বরণ করব। আপনার আগে আর কেউ সব যন্ত্র বাজানো তো দূরের কথা, ধরতেও পারেন নি। এবার অনুগ্রহ করে আপনি মাইহার রাজ্যসভা অলঙ্কৃত করতে সম্মতি দিন।
ওঃ। বার বার থামতে বলা তাহলে বেরসিকপনা নয়, পরীক্ষায় পাসের ইঙ্গিত। আর এতক্ষণ কত ভেবে মরছিলেন তিনি। আলাউদ্দিন খাঁ অদ্ভুতভাবে হাসলেন। বললেন, আপনি যদি খুশি হয়ে থাকেন, তবে আমি সভা-গায়ক হতে সম্মত।
রাজাজি দেওয়ানের দিকে ফিরে বললেন, ওস্তাদজির থাকা খাওয়ার উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দিন। আর কাল দশহরা, পূণ্যদিন। যথাযোগ্য আয়োজন করুন, কালই ওস্তাদজির অভিষেক হবে।
ছোট রাজ্য হলেও যথেষ্ট জাঁক-জমকের সঙ্গে অভিষেক হল আলাউদ্দিন খাঁর। বিখ্যাত চন্দন চৌবে মহারাজের শিষ্য ঘোররে মহারাজ তখন রাজ-অতিথি হয়ে মাইহারে আছেন। ফৌজি কোট ছাড়িয়ে মহারাজের পাঠানো দরবারী পোশাক তিনিই পরিয়ে দিলেন আলাউদ্দিন খাঁর অঙ্গে, তাঁর মাথায় সুন্দর করে বেঁধে দিলেন জরির পাগড়ি। দরবারে উপস্থিত হয়ে এক বিচিত্র মানসিকতায় ভরে গেল আলাউদ্দিনের মন। আজীবন দারিদ্রে দিনপাতের বেদনা যেন দূর হয়ে গেল সম্মান ও সমারোহের প্রাচুর্যে। তবু যেন ভিতরে ভিতরে কী এক অব্যক্ত বেদনায় তাঁর মন কেঁদে চলল।
কিন্তু দরবারে তখন ভিন্ন পরিবেশ। সার দিয়ে খোলা তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় পঞ্চাশ জন সর্দার। অভ্যাগত জনে ভরপুর সকল আসন। স্বয়ং রাজা তাঁকে ফুল-চন্দন দিয়ে আপ্যায়ণ করলেন, দিলেন একথালা মোহর। তারপর হাত ধরে তাঁকে বসিয়ে দিলেন একটা শূন্য সিংহাসনে। চারদিক থেকে শঙ্খ বেজে উঠল। সকলে জয়ধ্বনি দিল তাঁর, রাজার, মাইহারের।
শঙ্খ আর জয়ধ্বনি থামতে রাজাজি বললেন, আজ এই পূণ্যদিনে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে আমি শুধু সভাগায়কের পদেই বরণ করলাম না, আমার সঙ্গীতগুরুর পদেও বরণ করলাম। মহামন্ত্রীর পরেই হল তাঁর স্থান। গুরুজিকে আপনারা সর্বতোভাবে সম্মান দান করবেন।
সমস্ত দরবার আবার ধ্বনি দিয়ে উঠল -- রাজার গুরু আমাদের গুরু। আমরা গুরুর সম্মান দিতে জানি, মহারাজ।
আলাউদ্দিন খাঁ আসন থেকে নেমে এসে বললেন, মহারাজা! আমি নিজে যে এখনও ছাত্র! আমার গুরু ওয়াজির খান আমাকে দেশ-ভ্রমণের আদেশ দিয়েছেন, শিষ্য করবার আদেশ তো দেন নি!
রাজাজি বললেন, বেশ তো, তিনি যদি আদেশ না দেন, তবে শিষ্য করবেন না। কিন্তু যদি আদেশ দেন, তবে করবেন তো? আমি চেয়ে পাঠালে ওয়াজির খাঁ নিশ্চয় সে আদেশ দেবেন।
তবে সে আদেশ চেয়ে পাঠান মহারাজ।
সঙ্গে সঙ্গে রাজার দূত ছুটল ওয়াজির খাঁর কাছে রামপুরে। সব শুনে উল্লসিত হলেন ওয়াজির খাঁ, আলাউদ্দিনের বিনয়ে আরো খুশি। যোগ্য শিষ্য। গুরুর সম্মান যে এমন করে রাখতে জানে, তাকে অদেয় কী থাকতে পারে? শিষ্য গ্রহণের আদেশই শুধু নয়, শিষ্যের হাতে বাঁধবার নাড়াটিও নিজে হাতে তৈরি করে পাঠালেন ওয়াজির খাঁ।
আর একটি উৎসব করে রাজা আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্য হলেন। এই দিনই রাজা শুধোলেন, গুরু হলে তাঁর দক্ষিণা স্থির করতে হয়। আপনার--
কথা সমাপ্ত করতে দিলেন না আলাউদ্দিন খাঁ, জিভ কাটলেন, কান মললেন। বললেন, গান শিখিয়ে আমি পয়সা নেব না। একটা পানও নেব না। যার মধ্যে সত্যিকারের দরদ দেখব, তাকে এমনি শেখাব।
আলাউদ্দিনের মহত্বে আর একবার চমকে গেলেন রাজা। কিন্তু মনে তাঁর অন্য চিন্তা! তবে গুরুজির চলবে কীভাবে? রাজা বললেন, বেশ। আজ থেকে আপনাকে আমি আমার সব দেবোত্তর সম্পত্তির ম্যানেজারও করে দিলাম। রাজ্যের নিয়ম অনুযায়ী আপনি মাসিক প্রণামী পাবেন দেড়শ টাকা অর একটি বাড়ি।
একট থামলেন রাজা। আগেই শুনেছেন আলাউদ্দিন খাঁর জীবন-কথা। সেই প্রসঙ্গ টেনে এবার বললেন, গুরুমাকে এখানে নিয়ে আসুন। স্থায়ী হয়ে বসুন। আমার রাজ্য সুরে সুরে ভরিয়ে দিন ওস্তাদজি।
সম্মতিসুচক মাথা নাড়লেন আলাউদ্দিন খাঁ, তাঁর জগৎটাই যে সুরময়!
এগারো
মাইহারের রাজা বললেন, শেখান গুরুজি।
চুপ করে রইলেন আলাউদ্দিন খাঁ।
রাজা বললেন, বলুন, কোথায় আপনার বাধা?
আলাউদ্দিন বললেন, বাধা আমার নয়, বাধা আপনার। সঙ্গীত-সাধনার জন্যে যে কষ্ট স্বীকার করতে হবে, তা কি আপনি সইতে পারবেন?
রাজা বললেন, আপনি আদেশ করুন।
আলাউদ্দিন বললেন, প্রথমেই আপনাকে সরাব ছাড়তে হবে।
-- ছাড়ব।
-- যতক্ষণ রেওয়াজ করতে বলব, ততক্ষণই রেওয়াজ করতে হবে।
-- করব।
-- বেশ, তবে শেখাব আমি।
পরদিন থেকে শুরু হল অন্নদাতার শিক্ষা। অনন্যমনা হয়েই রাজা শিখতে থাকলেন। ওস্তাদজিও শেখাতে লাগলেন প্রাণ ঢেলে। অনভ্যস্ত কণ্ঠ, অনভ্যস্ত দেহ ও মন। মাঝে মাঝে অবাধ্য হয়, অসংযত হয়ে ওঠে, তবু রাজা প্রাণপণে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে চলেন। তবে গুরু যা চান, তা যেন পেরে ওঠেন না তিনি। গুরুও হারিয়ে ফেলেন ধৈর্য্য। একদিন রেগে গিয়ে এক চড় কষিয়ে দিলেন রাজাকে, একদিন হাতই মুচড়ে দিলেন। কিন্তু আশ্চর্য! কতটুকু সময়ের মধ্যে রাজার রাসভনিন্দিত কণ্ঠস্বরেও সুরের আবেশ নামল, রাজা নিজেই অবাক হলেন নিজের কৃতিত্বে।
রাণীরাও সঙ্গীত শিখতে লাগলেন গুরুজির কাছে।
রাজা আবার একদিন গুরুকে বললেন, এবার গুরুমাকে এখানে নিয়ে আসুন। স্থায়ী হয়ে বসুন। মাইহার ধন্য হোক।
কথাটা মনে ধরল আলাউদ্দিনের। খাওয়া-দাওয়ার বড়ই অসুবিধা হচ্ছে, জীবনে যেন কোন হিসেব থাকছে না। অতএব চিঠি গেল ত্রিপুরা জেলার ব্রাহ্মণবেড়িয়ার শিবপুরে। দাদা আফতারউদ্দিন একদিন মদনমঞ্জরীকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন মাইহরে।
কিন্তু এ কে? কোথায় সেই নোলক-পরা সাত-আট বছরের মেয়ে? তার বদলে কে এই সুন্দরী রমণী? আলাউদ্দিন খাঁর মনে হল, তবে সত্যিই অনেক কাল মেয়েটিকে নির্বাসনে রেখেছেন তিনি, নিষ্ঠুরতা করেছেন। কিন্তু কত বছর? তা প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ বছর হল।
মনে মনে ক্ষমা চাইলেন আলাউদ্দিন খাঁ। মাইহারে নূতন জীবন শুরু হল। যুগপৎ গৃহস্থলি এবং শিক্ষাদান।
এমন সময় একদিন কালো রেখায় ঘেরা এক শোকের চিঠি এল আলাউদ্দিন খাঁর নামে। তিনি তখন বাড়ি নেই, গেছেন হাটে। মাইহারে গুরুজির কাজ সর্বাগ্রে করণীয়। অতএব পিয়ন ছুটলেন হাটে। হাটের মধ্যেই চিঠি নিলেন আলাউদ্দিন খাঁ। কম্পিত হতে চিঠি খুললেন।
গুরু ওয়াজির খাঁর চিঠি। তাঁর বড়ছেলে পিয়ারা সাহেব মারা গেছেন। আলাউদ্দিনের বুকে যেন শেল বাজল। পিয়ারা সাহেব যে গুরুজির বুকের পাঁজরা!
তাঁর মৃত্যুতে নিশ্চয়ই বুকখানা ভেঙ্গে গেছে গুরুজির। মূহূর্তেক দেরি করলেন না আলাউদ্দিন, পিয়নকে বাড়িতে সংবাদ দিতে বলে হাট থেকেই রওনা হয়ে গেলেন, রামপুর অভিমুখে।
আলাউদ্দিনকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন ওয়াজির খাঁ। আলাউদ্দিন তাঁকে স্বান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেই কেঁদে আকুল। গুরুশিষ্যর কান্না থামলে গুরু বললেন, আলাউদ্দিন, আমি পাপ করেছি,মহাপাপ! তাই ঈশ্বর আমাকে এই শাস্তি দিয়েছেন।
কী পাপ গুরুজি?
গুরু বললেন, তোর মতো শিষ্য পেয়েও তোকে কিছু শেখাই নি। তোর প্রতি আমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি আলম।
আলাউদ্দিন কান মললেন. নাক মললেন। বললেন, আমার পাপ আর বাড়াবেন না গুরুজি। আমাকে আপনি যে দয়া করেছেন তাতেই আমি ধন্য!
গুরু বললেন, না রে না। বীণা, রবাব, সুরশৃঙ্গার এসব তোকে কিছুই দিই নি। ধ্রুপদ-ধামারেরও কিছুই দিই নি তোকে। আসলে মিয়া তানসেনের যা কিছু সম্পদ, তা আমাদের পরিবারের। স্বয়ং তানসেনের লেখা পুঁথি আছে আমাদের বাড়িতে। তা আমরা সম্মান করে রেখে দিই, নিজেরও খুলি না, পাছে অন্যকে দেখিয়ে ফেলতে লোভ হয়। সেরা চিজ বংশের একজনকে শেখাই। এমনি করে রক্ষা হয় ঘরানা। এটাই ভারতীয় সঙ্গীতের গুপ্ত রহস্য। এমনি করে হঠাৎ এক-এক-জনের মৃত্যুতে লুপ্ত হয়ে গেছে কত ঘরানা! আমার ঘরানাও লুপ্ত হয়ে যাবে আলম!
আলাউদ্দিন বললেন, কেন গুরুজি? আপনার অন্য ছেলেদের শেখান না, নাতি-নাতনীদের শেখান।
মাথা হেট করলেন ওয়াজির খাঁ, বললেন, অন্য ছেলেদের ক্ষমতা নেই, নাতি-নাতনীরা ছোট।
-- তবে ঘরানা রক্ষা কী করে হবে গুরুজি?
ওয়াজির খাঁ বললেন, তুই, তুই রক্ষা করা আমার ঘরানা। শিষ্যই তো পুত্র। একদিন পিয়ারাকে বলেছিলাম, আলম তোমাদের ভাই, তাকে সব শেখাও। বলেছিলাম, কিন্তু শেখায় নি। আজ তুই আমার প্রকৃত ছেলের কাজ কর্, আমার ঘরানা রক্ষা কর্।
হাউহাউ করে কাঁদেন আলাউদ্দিন খাঁ। বলেন, আমার দাড়িতেও যে পাক ধরেছে গুরুজি, আমার দেহেও যে বল নেই। আমি কি পারব এখন শিখতে?
তবু শুরু হয় শিক্ষা--দুই বৃদ্ধের এক বিচিত্র সাধনা। ওয়াজির খাঁ বোঝেন, ঘনিয়ে আসছে দিন। আরো-আরো শিখে নাও আলম, আমার বুক উজার করে সব জেনে নাও। যদি না জেনে নাও, তাহলে আমার মৃত্যুর সঙ্গে শেষ হয়ে যাবে, লুপ্ত হয়ে যাবে প্রায় তিনশ বছরের এক সুপ্রাচীন শিল্পরীতি। না, তোমার কোন দায় রইল না, এবার তুমি বিলিয়ে দিতে পার সকলের মধ্যে। যে ঘরানা আমি গঙ্গোত্রী হিমবাহের মতো জমাট করে রেখেছিলাম, হে ভগীরথ, তোমার সাধনায় তুমি তাকে দ্রবীভূত করেছ। এবার তুমি তাকে বিলিয়ে দাও মহামানবের সমুদ্রনীরে। বংশপরম্পরায় যে পাপ করেছি রাজসভার মোহে সাধারণকে বঞ্চিত করে, তোমার প্রচারের মধ্য দিয়ে হোক তার অবক্ষয়। সুরের রাজ্যের ঘরানা-রীতির সামন্ততন্ত্রের অবলুপ্তি ঘটুক, উদয়, হোক গণতন্ত্রের।
কিন্তু দেহ যে আর সয় না গুরুজি. শক্তি যে আর অবশিষ্ট নেই! তবু, তবু হে অশক্ত দেহ, তোমাকে বইতে হবে। হে ক্লান্ত মন, তোমাকে গ্রহণ করতে হবে। যে সূর্যোদয়ের জন্যে প্রতীক্ষা করেছি সারাজীবন, মৃত্যুর মুখোমুখিই যদি তা এসে থাকে তবে হে দেহলীন দেবতা, ধৈর্য ধর তাকে গ্রহণ করতে।
তাই মরণপণ করে যেন শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকলেন আলাউদ্দিন। তাঁকে ওয়াজির খাঁর শিক্ষর শেষ বিন্দুও নিঃশেষে শুষে নিতে হবে। এ তো দেবী সারদা যেন প্রসন্ন মুখে আশীর্বাদ করছেন, দিচ্ছেন অভয়।
কিন্তু শিক্ষা কি শেষ হল?
তা হয়ত নয়, তবু, প্রসন্ন চিত্তে শিষ্যকে আশীর্বাদ করলেন ওয়াজির খাঁ। ভাগ্য তাঁর সুপ্রসন্ন। নইলে এমন শিষ্য লাখে মেলে এক। এ শিষ্য তিনি পেলেন কোন্ পূণ্যে?
পরিতৃপ্তি নিয়েই বড়ছেলের মৃত্যুর তিন বছর পর চোখ বুজলেন ওয়াজির খাঁ। আলাউদ্দিন বুকভরা বেদনা নিয়ে ফিরে এলেন মাইহারে। গুরুর শোক পালন করলেন পুত্রেরই মতো-এক বছর।
বিখ্যাত সেতারী ও সরোদ-বাদকেরা আসছেন মাইহারে আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্যত্ব নেবার জন্যে। অন্যান্যদের সঙ্গে ১৯২৫ সালে এলেন তিমিরবরণ।
ক্রমে ক্রমে তিন কন্যা আর এক পুত্র জন্মগ্রহণ করল আলাউদ্দিনের! আরো এক পুত্রের আকাঙ্খা ছিল, কিন্তু আর পুত্র হল না। শেষ বয়সে কন্যা অন্নপূর্ণার সঙ্গে রবিশঙ্করের বিয়ে দিয়ে বললেন, আল্লা আমার সাধ মেটালেন। পুত্র চেয়েছিলাম, জামাই পেলাম রবুকে।
১৯৩৫ সাল। উদয়শঙ্করর সঙ্গে বিশ্বভ্রমণে বের হলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ।
বোম্বাই থেকে জাহাজ ছাড়ল।
জাহাজের ডেক থেকে কূলের দিকে তাকিয়ে কি জানি কেন হঠাৎ দ্বিতীয় বার গৃহত্যাগের কথা মনে পড়ল আলাউদ্দিনের। তফাৎ কিছু আছে। সেবার ঘুমন্ত মদনমঞ্জরীর অজান্তে তার টাকা চুরি করে পালাতে হয়েছিল, এবার মদনমঞ্জরীর জ্ঞাতসারে তার শুভ কামনা নিয়ে হয়েছে যাত্রা। সেবারে ছিল কিছুই-না-জানা বালক, আজ পক্ককেশ প্রবীণ। তবে সেদিন ছিল অজানা কলকাতা সফর, আজ অজানা বিশ্ব।
কিন্তু সেদিনের কলকাতার চেয়ে আজকের বিশ্বে সমাদর মিলল বেশী। প্রথমেই পোর্ট সৈয়দে নেমে মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমির দেশগুলি। মিশর, আরব, জেরুজালেম ইত্যাদি সমস্ত প্রধান শহরগুলিতে অনুষ্ঠানের করলেন উদয়শঙ্করের ইহুদী ম্যানেজার গ্রাটা। বিপুল সম্মান পেল গোটা দল। অভিজ্ঞেরা বললেন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেউ এত বিপুল সংবর্ধনা পান নি এদেশে। পাবেনই বা কেন? কবিগুরুর পর এঁরা ছাড়া আর কোন্ সাংস্কৃতিক দল গেছে সংস্কৃতির আদান-প্রদান করতে?
প্রদান তো বটেই, আদানও। সর্বত্রই মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন আলাউদ্দিন খাঁ। সে দেশের মাটির সুর তুলে নিতে হবে। সুরের কাঙাল আমি, সুরর ভিক্ষা চাই সর্বত্র। তিলতিল করেই তো হবে তিলোত্তমা৷ এখানে এসে আবার আজানের সুর বিশ্লেষণ করলেন আলাউদ্দিন খাঁ। সেই দুর্গা! সেই সিন্ধুভৈরবী! কে বলে মুসলমান ধর্ম নৃত্যগীতবিরোধী? তাহলে আজানে এত সুর কেন? মুসলিম গ্রামের মানুষ গান গায় কেন? উদয়শঙ্করের হিন্দু দেব-দেবীর নাচ দেখে কেন? আলাউদ্দিন সে দেশের ভাষা বোঝেন না, কিন্তু সুরের স্পর্শে বোঝেন, সেই প্রাণ, সেই সুর সর্বত্র বেড়ে চলেছে। জগৎ জুড়ে একই সুরের মেলা।
কাছেই মক্কাশরিফ, মুসলমানদের শ্রেচ্ঠ তীর্থ। উদয়শঙ্কর বললেন, একদিন যান, ঘুরে আসুন মক্কা।
মন নড়ে উঠল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে পড়ল, তাঁকে একাই যেতে হবে মক্কা, উদয়শঙ্করেরা যেতে পরাবেন না! ওঁরা হিন্দু, কাজেই ধর্মের বাধ। ভারতেও কোন মন্দিরে ঢুকতে পান নি আলাউদ্দিন খাঁ। গিরিশচন্দ্রের নাট্য-মন্দিরে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু নাম বদলে। আলাউদ্দিন খাঁ ঢোকেন নি, ঢুকেছিল প্রসন্ন বিশ্বাস। সর্বত্র সেই ধর্মের ধ্বজাধারীদের শাসন। মনে মনে দেবী সরস্বতীকে স্মরণ করলেন আলাউদ্দিন খাঁ। না, থাক। সুরের বিশ্বজয়ে বেরিয়েছেন তিনি, এক আরাধ্যই তাঁর মাথায় থাকুক। মক্কা নয়। কাউকে রেখে একা তিনি মক্কায় যাবেন না। আকাশে বাতাসে আজানের ঘোষণায় মহম্মদের বাণী এসেছে তাঁর কানে। আল্লা যদি দয়া করেন, তবে বারান্তরে আসবেন তিনি।
মিশর থেকে তাঁরা এলেন গ্রীসে। আলেকজাণ্ডার গিয়েছিলেন সৈন্য নিয়ে, আলাউদ্দিন এলেন সুর নিয়ে। আলেকজাণ্ডার পিছন ফিরতেই তাঁর সাম্রাজ্য চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, আলাউদ্দিন যা গড়ে এলেন, তা চিরস্থায়ী।
গ্রীস থেকে ক্রমে ক্রমে তাঁরা এলেন বুলগেরিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, রুমানিয়া, হাঙ্গেরী, অস্ট্রিয়া চেকোশ্লোভাকিয়া, পোলাণ্ড, সুইডেন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডে।
প্রত্যেক দেশের প্রধান-প্রধান শহরগুলিতে অনুষ্ঠানের আয়োজন হল। রাজা থেকে সাধারণ প্রজা, প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী থেকে গ্রামের চাষী, কে এলেন না সেই সম্মেলনে? কি ভিড়, কি ভিড়! খবরের কাগজ ভর্তি ছবি আর শবিবরণ। সাময়িক পত্রিকায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের বিবরণ, ভারতীয় সঙ্গীত-নৃত্য সম্পর্কে আলোচনা। অনুষ্ঠান-শেষে হোটেলে ফেরার পথে অপেক্ষমান জনতার অভিনন্দন।
এলেন তাঁরা ভিয়েনায়, প্রাগে বুদাপেস্টে, অবশেষে প্যারিসে। শিল্প আর শিল্পের দেশ প্যারিস। এদেশের আয়োজন দেখে একদিকে বিস্মিত, অন্যদিকে অভিভূত হলেন আলাউদ্দিন খাঁ। এদের গোটা সঙ্গীত-জগতেই বহুর প্রভাব। এরা যখন বাজায়, একসঙ্গে দু-তিনশ জন শিল্পী বসে যায় একত্রে অর্কেস্ট্রা বাজাতে। যখন শোনে, তখন দশ-বারো হাজার মানুষ একত্রে শোনে।
কত কোটি টাকা ব্যয়ে এক-একটা হল ঘর তৈরী!
আলাউদ্দিন যখন বাজাতে থাকেন, তখন ঐ কয়েক হাজার দর্শক নিশ্চুপ। পিন পড়লে বুঝি সে শব্দ শোনা যায়। মনে হয়, প্রেক্ষাগৃহে একটিও লোক নেই, এত তন্ময় হয়ে শোনে তারা। যখন সরোদের মীড় নাট্যমন্দিরে পরিব্যপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, বহুর মাঝে নিজেকে সম্প্রসারিত করবার বিপুল আনন্দে আলাউদ্দিনের বুকের ভিতর, এক অসীম উচ্ছ্বাস আকুলি বিকুলি করতে থাকে।
বাজনা শেষ হলে হাততালি যেন থামতে চায় না! শ্রোতারা বুকের আনন্দ প্রকাশ করতে শিল্পীর দিকে ছুঁড়ে দেয় ফুলের তোড়া। তোড়ায় তোড়ায় ছয়লাপ হয়ে যায় মঞ্চ। আলাউদ্দিন খাঁ আনন্দে ভাসতে থাকেন।
আলাউদ্দিন খাঁ স্বীকার করেন, বাজিয়ে এত আনন্দ তিনি আর কোথাও পান নি।
প্যারিসের অভিজ্ঞতা বিচিত্র। একদিন হোটেলের ঘরে হুড়হুড় করে ঢুকে পড়ল একদল মেয়ে। কী তাদের বেশ-বাস! কি তাদের ভাব-ভঙ্গী। তাদের আবদার, তাঁর বাজনা শুনবে। এমন হাল্কা মেজাজের মেয়েরা কী শুনবে? বুঝবেই বা কি? অপ্রসন্ন মনে বিকেলের পড়ন্ত আলোর দিকে তাকিয়ে ওস্তাদ ভীমপলশ্রীতে ধরলেন সুরের ঝঙ্কার। ও মা! মুহূর্তে ওদের বাইরের হালকা মুখোশ খুলে গেল, ওরা যেন বুঝে নিতে চাইছে. তলিয়ে যেতে চাইছে সুরে। আমোদ লাগল আলাউদ্দিনের, খুশি হল মন। তিনিও ডুব দিলেন।
তিন ঘণ্টা বাদে যখন তিনি থামলেন, তখন মেয়েগুলির মুখে বিস্ময়। ওরা আন্তরিক শ্রদ্ধা নামিয়ে দিয়ে গেল এই ইন্ডিয়ান ওল্ড আর্টিস্টের পায়ে। ওরা যেন তাঁর স্পর্শ পেয়ে ধন্য হয়েছে।
ধন্য আলাউদ্দিনও। তিনিও যে ওদের সত্য পরিচয় জেনেছেন। মনে মনে প্রণাম করলেন গুরুকে। ঠিকই তো, দেশভ্রমণেই শিক্ষার চূড়ান্ত। শিক্ষার কি শেষ আছে!
প্যরিসের ধনীর দুলালী এলিস বোনার উদয়শঙ্করের ভক্ত। ক্রমে তিনি ভক্ত হয়ে পড়লেন আলাউদ্দিনেরও। তাঁরই প্রস্তাবক্রমে ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের এক প্রদর্শনী হল প্যারিসে। ওঁদের দলে তখন প্রায় চল্লিশ রকম যন্ত্র। প্রদর্শনীতে সাধারণ মানুষের কৌতুহলী ভিড়। আলাউদ্দিন খাঁ এক-এক করে যন্ত্র বাজিয়ে দেখান, দেন তাদের কৌতুহলের জবাব। দোভাষী বুঝিয়ে দেন বিষয়টি। ভারতীয় সঙ্গীতের প্রতি শ্রদ্ধা ঝরে পড়ে সকলের চোখে।
বুদাপেস্টে ওঁরা যখন সফর করছেন, তখন সে দেশের নামজাদা শিল্পীরা এলেন আলাউদ্দিনের সঙ্গে ভারতীয় সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করতে। তাঁরা প্রশ্ন করছেন, উদয়শঙ্কর বলে দিচ্ছেন তার বাংলা। আলাউদ্দিন খাঁ বলছেন বাংলায়, উদয়শঙ্কর তার ইংরাজি করে দিচ্ছেন। যতই শুনছেন, ততই যেন বিমুগ্ধ হচ্ছেন শিল্পীরা।
প্রথমেই তাঁরা প্রশ্ন করলেন, কী কী সঙ্গীতের সুর তৈরী করেছেন?
আলাউদ্দিন খাঁ বললেন, আমরা সঙ্গীতের সুর দিয়ে শিল্পীকে বিচার করি না। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ঋষিরা পেয়েছেন সাধনায়, আমরা তারই চর্চা করি, প্রকাশ করি। সময়, মনোভাব ইত্যাদির বিচার করে তৈরী আমাদের রাগ-রাগিনী। ভৈরবী বাজিয়ে শোনালেন আলাউদ্দিন খাঁ। বললেন, কী অনুভব হল? সমঝদার শ্রোতা বললেন, যেন কার জন্যে প্রতীক্ষা করছি, তবু তিনি এলেন না। আলাউদ্দিন খাঁ ভীমপলশ্রী বাজিয়ে শোনালেন। কান্না, যেন কান্নার সিন্ধু উথলে উঠল।
-- কেন গো, তোমাদের সুর এত কান্না আনে কেন?
আলাউদ্দিন খাঁ সাত সুর বাইশ শ্রুতি, একুশ মূর্ছনার হিসাব বোঝালেন, বাজিয়ে বোঝাতে চাইলেন এ সবের পার্থক্য। তালই আছে তিনশ ষাট রকম।
এবার তবলা নিয়ে বসলেন আলাউদ্দিন। মুখে মুখে বোল বলে নানারকম তালের পার্থক্য দেখাতে থাকলেন। ইউরোপীয় সঙ্গীতজ্ঞেরা কিছু বুঝলেন, কিছু বুঝলেন না। শুধু অবাক হয়ে বললেন, আপনাদের কান এত সূক্ষ্ম পার্থক্য ধরতে পারে!
হাসলেন আলাউদ্দিন খাঁ। বললেন, আপনাদের সঙ্গীতে এক সুর অন্য সুরের ঘাড়ে চেপে বসতে চায়। আমাদের সুর থাকে পাশাপাশি, একজন অন্যজনের উপর চেপে বসে না। যেন একেরই ক্রমবিকাশ, এ যেন তেত্রিশ কোটি দেবতা, অথচ এক ঈশ্বর।
-- তবে, অকপটে স্বীকার করলেন আলাউদ্দিন খাঁ, আপনাদের বেহালা বাজনা বড় মধুর। এ বাজনা শুনে মনে হয়, ও বাদনে আমি শিশু। স্থির করেছি, আমি আর বেহালা বাজাব না।
সত্যিই সেই থেকে বেহালা বাজানো ছেড়ে দিলেন খাঁ সাহেব।
বিদায় চাইলেন শিল্পীরা। হাতজোড় করে হাউমাউ করে উঠলেন আলাউদ্দিন। বললেন, আমার আলোচনা শুনে, আমার বাজনা শুনে ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রের উপর কোন খারাপ ধারণা করবেন না। আমি অক্ষম মানুষ। আমার শিক্ষাও সমাপ্ত হয় নি। আমি কি-ই বা দেখাতে পেরেছি, কি-ই বা শোনাতে পেরেছি? ভারতীয় গুণীরা গান গেয়ে ফুল ফোটাতে পারতেন, দীপ জ্বালাতে পারতেন, বৃষ্টি নামাতে পারতেন। সত্যিকারের গুণীর সন্ধান পেলে ভারতীয় সঙ্গীতের যথার্থ সংবাদ পেতেন।
এঁরা বললেন, আপনার কাছেও তো কম পেলাম না!
নাক মললেন আলাউদ্দিন, কান মললেন। হাতজোড় করে বললেন, সত্যিই যদি পেয়ে থাকেন, তবে সে আমাদের শাস্ত্রেরই গুণ, আমার নয়।
বারো
এলম হার্স্ট বাঙালির কাছে পরিচিত নাম। রবীন্দ্রনাথের জীবনাদর্শকে জীবনে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। বিশ্বভারতী গড়ে তুলতে এই ইংলণ্ডবাসী ধনীর সাহায্য কম ছিল না। বিশ্বভারতীর অনুকরণে তিনিও গড়েছিলেন এক প্রতিষ্ঠান, নাম - ভারটিংটন হল। এখানে এলম হার্স্ট ও তাঁর কন্যার আমন্ত্রণে উদয়শঙ্কর ও আলাউদ্দিন খাঁ কাটিয়ে গেলেন কয়েক মাস।
আর মন টিকছে না, দেশ টানছে। পুরো এক বছর বিদেশে কাটিয়ে আলাউদ্দিন ফিরে এলেন মাইহারে। প্রাণের-আকুতিতে নিজের বাড়ির দরজায় নিজেই আঁকা-বাঁকা অক্ষরে লিখলেন মদিনা-ভবন।
এবার আহ্বান এল রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। এক বিশ্ববিজয়ী ডাকলেন আর এক বিশ্ববিজয়ীকে। এ আহ্বানে সাড়া না দেবে কে? পথের কাঙাল আলমকে ডেকেছেন স্বয়ং বিশ্বকবি! সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছুটলেন শান্তিনিকেতনে। নিমন্ত্রিত অধ্যাপক-পদে সেখানে কাটিয়ে দিলেন ছ মাস। রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে যেন সমস্ত জ্বালা জুড়িয়ে ফিরলেন আলাউদ্দিন। বলতেন, বৃথাই বিশ্ব ঘুরলাম। গণেশ যেমন জননীকে প্রদক্ষিণ করে বলেছিলেন, বিশ্ব ঘোরা হল, ওঁর কাছে থাকলেও তাই।
বিদায়-দিনের একটা মজার গল্প বলতেন আলাউদ্দিন খাঁ। বিদয়ের দিনে গম্ভীর মুখে রবীন্দ্রনাথ না কি নন্দলাল বসুর দিকে তাকিয়ে আলাউদ্দিনকে দেখিয়ে বলেন, ওর মাথাটা রেখে দাও।
মাথা রাখবে! সে কি রে বাবা! ঘাবড়ে গেলেন আলাউদ্দিন খাঁ। এঁরা আবার কুকীদের মতো মাথা রাখার পাগলামি শুরু করেছেন কবে! দৌড় দেবেন কিনা ভাবছেন, এমন সময় নন্দলাল সঙ্গে করে আনলেন আর একজন কালো জল্লাদের মতো দেখতে লোককে?
নন্দলাল বললেন, রাম, এরই মাথা।
আরো ঘাবড়ে গেলেন আলাউদ্দিন।
খানিক পরে বিষয়টা পরিষ্কার হল। ও হরি! মাথা রাখা মানে এই! নন্দলাল বসুর প্রিয়তম ছাত্র রামকিঙ্কর বেইজ তৈরি করে রাখলেন আলাউদ্দিনের আবক্ষ মূর্তি।
* * * *
মাইহারে ফিরে ইউরোপীয় স্টাইলে একটা ব্যান্ডপার্টি গড়লেন আলাউদ্দিন খাঁ। ঢেঁড়া পিটিয়ে অক্ষরজ্ঞানশূন্য সাধারণ মানুষ জড়ো করা হল। তাঁর বাড়িতেই সকলের থাকা-খাওয়া। এদের দিয়েই তিনি গড়ে তুললেন এক অসাধারণ ব্যাণ্ডপার্টি। একশজন বাজায় একসঙ্গে। ইউরোপের মতো নোটেশন দেখে বাজাতে হয় না তাদের, তাল আর সরের ইঙ্গিতে ধরন-ছাড়ন, উত্থান পতন!
ভারতময় ছড়িয়ে পড়ল তার খ্যাতি। দেশদেশান্তর থেকে আসতে থাকল সঙ্গীত বিষয়ে নানা প্রশ্ন। কেউ যেন বিমুখ না হয়। নিজে সঙ্গীতের জন্যে যে কষ্ট ভোগ করেছ, অন্যে তা যেন না করে। নাড়া না বেঁধেও সকলেই তাঁর শিষ্য। আলাউদ্দিন খাঁ আর ব্যক্তি নন, তিনি এখন এক প্রতিষ্ঠান।
প্রস্তাব এল যোধপুর থেকে। সভা-গায়ক করতে চান তাঁকে। মস্ত রাজ্য, অনেক সুযোগ।
মাইহারের রাজা বললেন, গুরুজি, আমার ছোট্ট রাজ্য, সামান্য আয়। আপনাকে যোগ্য সম্মান দিতে পারি না। আপনি যান। আমি খুশিই হব।
তবু গেলেন না আলাউদ্দিন খাঁ। স্ত্রীকে বললেন, মাইহার আমার প্রথম অন্নদাতা। এ স্থান আমি ছাড়ব না।
থেকে গেলেন মাইহারেই।
স্বাধীনতার পূর্বে হিন্দু-মুসলমান রায়ট শুরু হল ভারতবর্ষ জুড়ে। এই সঙ্গীত-সাধকের বুক জুড়ে ব্যথা। কোন প্রচার নেই, কিন্তু নিজের জীবনে এত বড় সর্ব-ধর্মসমন্বয় ক’জন করেছেন? আল্লা আর সারদা একত্রে তাঁর আরাধনার বস্তু। যীশুর গল্প শুনে কান্নায় বুক ভাসান। কলকাতায় ছিলেন, অথচ রামকৃষ্ণদেবের চরণধূলি নেন নি জেনে তাঁর কী অনুশোচনা! কলকাতার শিষ্যকে তিনি লিখে পাঠান, বাবা, আমার ঘরে শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ, শ্রীশ্রী বিবেকানন্দের ফটো আছে। কিন্তু শ্রী গৌরাঙ্গের কুন ফটো নাই। তুমি অবশ্য একখানা শ্রীশ্রী গৌরহরির ছবি পাঠাইবা। এই আমার শেষ নিবেদন।
সেই মানুষ এই হানাহানিতে যেন আত্মগ্লানিতে ভরে গেলেন। এ যেন তাঁর নিজেরই পাপ।
দেশ স্বাধীন হল।
স্বাধীন সরকার করদ সব মিত্ররাজ্য নিজহাতে নিয়ে নিলেন। মাইহারের রাজ্যও সেই দলে হারিয়ে ফেলল নিজেকে। আলাউদ্দিনকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হল মাইহার সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়। তার অধ্যক্ষ আলাউদ্দিন খাঁ। সরকার নিজে দেন বেতন।
শুরু হল সম্মানের পালা।
১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে তাঁকে দিনেন্দ্র অধ্যাপক করে আবার শান্তিনিকেতনের সঙ্গীত-ভবনে নিয়ে যাওয়া হল।
১৯৫৮ সালে ভারত সরকার দিলেন ভারত-রত্ন উপাধি। বিশ্বভারতী উপাধি দিল দেশিকোত্তম।
১৯৬৪ সালে আলাউদ্দিন শেষবারের মতো দেখতে গেলেন নিজের জন্মস্থান সেই ত্রিপুরার ব্রাহ্মণবেড়িয়ার শিবপুর। ছোট ভাই আয়েত সেখানেই থাকেন। উঠলেন তাঁর বাড়িতে।
জনস্রোত আসছে আলাউদ্দিন খাঁকে দেখতে। ভলেনটিয়ার বাঁশ বেঁধে ঘিরে দিল বাড়ি। গেটে পয়সা দিয়ে ঢুকতে হচ্ছে। তাও ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। যেন মেলা বসে গেছে। দোকান-পাট মায় হোটেল পর্যন্ত।
মাত্র দশদিন ছিলেন সেখানে আলাউদ্দিন খাঁ। তাতেই দর্শনী বাবদ আদায় হয়োছল কয়েক হাজার টাকা। ভলেন্টিয়াররা তোড়া বেঁধে টাকাটা তুলে দিলেন আলাউদ্দিন খাঁর হাতে। আলাউদ্দিন টাকাটা মাথায় ছোঁয়ালেন। বললেন, এ আপনাদের স্নেহের দান। এর মূল্য আমি কিছুই দিতে পারব না। এই জন্মভূমির জন্যেই বা আমি কী করতে পেরেছি? আমি অক্ষম সন্তান। আপনাদের স্নেহ আমি মাথায় তুলে নিলাম। কিন্তু এ টাকায় আপনারা এই গ্রামে একটা মসজিদ আর একটা পাবলিক পুকুর করিয়ে দিন।
দেহ যেন আর সয় না। মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়েন, আলাউদ্দিনের দেহের আর দোষ কি? অত্যাচার তো কম করেন নি দেহের উপর! সারাদিনে একবার খাওয়া বা একেবারেই অনাহার। একটানা দিনভোর রেওয়াজ। অবশ্য বয়সও কম হল না, একশ বছরও পার হয়ে গেছে। আর কত কাল এই হানাহানির জগতে বসিয়ে রাখবে ঈশ্বর! তোমার সদানন্দের রাজ্যের স্বর্গীয় সুর কি আমায় শুনতে দেবে না!
অসুস্থ দেহে মাইহারের গরমে বড় কষ্ট হয়। রবিশঙ্কর বলেন, বাবা, অনুমতি দিন, একটা এয়ারকণ্ডিশনার বসিয়ে দিই। হাসেন আলাউদ্দিন। বলেন, যিনি আসছেন, তাঁকে সহজভাবেই আসতে দাও। তোমাদের ওসব যন্ত্র দেখে তিনি যদি ভয় পান, আমাকে যদি চিনতে না পারেন!
দিন দিন কেমন যেন উদাস হয়ে যান আলাউদ্দিন, চোখ জলে ভরে আসে। চোখ মেলে যাকে কাছে পান, তারই হাত জড়িয়ে ধরে বলেন, আমি মা সারদার ডাক শুনেছি! আহা, কী মধুর তাঁর স্বর! কী অপরূপ তাঁর সুরের রাজ্য! আমি সে সুর শুনতে পাই, কিন্তু ধরি ধরি করেও ধরতে পারি না।
আবার তাঁর চোখ বুজে আসে খানিক আনন্দ, খানিক শ্রান্তিতে।
১৯৭২ সালের ১৪ই জুন থেকে রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়লেন আলাউদ্দিন খাঁ। একদিন এক প্রিয় শিষ্যকে ডেকে বললেন, মরণের পর আড়ম্বর করবা না। আমারই এই উঠানের এক কোণে আমারে কবর দিবা। আমি মাটির সঙ্গে মিশা যামু। এই মাটির উপরে আমার নাতি-নাতনীরা বাজাবে, আমি শুয়া শুয়া শুনুম।
যাবার জন্য প্রস্তুত মন। অন্যরাও যেন প্রস্তুত হয়ে গেলেন। এই তো খাঁটি ভারতীয়ের মৃত্যু! ইহলোকের সব কাজ মিটিয়ে এ যেন লোকান্তরে যাত্রা। অতএব চোখের জল ফেলো না, যাত্রার আয়োজন কর। দেখো, যেন যাত্রায় কোন বিঘ্ন না ঘটে।
তবু, তবু কেন কান্না আসে তোমাদের চোখে? ওগো, আমি তো এপারের সব কাজ শেষ করেছি। সঙ্গীতের বন্ধনদশা ঘুচিয়েছি। আমার সব উজাড় করে শিখিয়েছি তোমাদের। এখন বাজাও, দেশ জুড়ে বাজাও। শুধু মাইহার নয়, সমগ্র ভারত সেই সুরে কেঁপে উঠুক। সমগ্র বিশ্ব প্রণত হোক সেই সুরের ঝঙ্কারে।
ভারত জুড়ে সত্যিই বাজছে সেই সুর। আলাউদ্দিন খাঁর শত শত শিষ্য-প্রশিষ্য বাজিয়ে চলেছেন সেই একই সুরের রেশ। কিন্তু সেই সুরের ভগীরথ আর আমাদের মধ্যে নেই।
প্রায় একশ দশ বৎসর বয়সে ১৯৭২ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর রাত ১১টা ১০ মিনিটে চিরস্মরণীয় এই সঙ্গীতসাধক চলে গেছেন অন্যত্র কোনও মহান সুরলোকের অভিসারে।।
শেষ
প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
তৃতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
দশ
নবাবের ইচ্ছায় পরদিনই নাড়া-বাঁধা উৎসব অনুষ্ঠিত হল। সে উৎসবে উপস্থিত থাকলেন যতেক দরবার-শিল্পীরা। বিতরণ করা হল প্রচুর মিঠাই। মুখে সকলেই হাসি আর উল্লাস প্রকাশ করলেও এক পুঁচকে ছোকরার এই আধিপত্যে ঈর্ষানল জ্বলল প্রায় সকলের বুকেই। স্বভাবত দরবার-শিল্পীদের মধ্যে আলমের বন্ধুত্বের সুযোগ কমে গেল।
অবশ্য বন্ধুত্ব করবার অবসরই বা কোথায় আলমের! ভোরবেলা কোনক্রমে দুটি মুখে দিয়ে সে দ্রুত ছোটে গুরুর বাড়িতে। গুরুর পায়খানা পরিষ্কার করে, জল ভরে রেখে তার গুরু-সেবা শুরু হয়। তারপর গুরুর আদেশের জন্যে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। কিন্তু দুর্ভাগ্য,দিনের পর দিন যায়, গুরুর খিদমতগারি ছাড়া আর কিছুই হয় না আলমের দ্বারা! গুরু বোধহয় আলমকে শিক্ষা দেওয়ার কথা ভুলেই গেছেন।
এমান করে কেটে গেল দু বছর তিন মাস।
অবশ্য এই সাতাশ মাসের মধ্যে আরো কতকগুলি ঘটনা ঘটেছে আলমের জীবনে। প্রথমত, ওয়াজির খাঁর শিষ্যত্ব লাভের পরেই ঠিকানা জানিয়ে আলম চিঠি দেয় বাবাকে, তার দীক্ষার কথাও জানায়। দ্বিতীয় ঘটনা -ব্যাণ্ডমাস্টার হুসেন খাঁর বন্ধুত্ব লাভ। হুসেন খাঁ আলমের কাছ থেকে যেমন গ্রহণ করেন, শেখানও তেমনি।
অনেক ধ্রুপদ আর হোরি এসে জমে আলমের ভান্ডারে। কিন্তু ওয়াজির খাঁর কাছে শিক্ষা?
বিচিত্রভাবেই ঘটনাটা ঘটল আলমের জীবনে। এজন্য নিজের স্ত্রীর প্রতি আলমের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ওর টাকাতেই আলম প্রথম যন্ত্র কিনতে পেরেছিল। ওর জন্যই অবশেষে ওয়াজির খাঁর করুণা লাভ করেহিল আলম। ও যত দূরেই থাকুক, আলমের চারদিকে মঙ্গলের আবরণ দিয়ে রক্ষা করেছে চিরকাল। স্ত্রীর এত প্রীতির প্রতিদান কী দেবে কাঙাল আলম। অবশেষে নিজের জীবন-সাধনার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান, তার আবিচ্কৃত নূতন রাগের নাম দিয়েছিল ‘মদনমঞ্জরী’; এ নামেই অক্ষয় হয়ে থাকবে স্ত্রীর প্রতি আলমের কৃতজ্ঞতা।
সেদিন দ্বিপ্রহরে গুরুর দরজা থেকে বাড়ি ফিরছে আলম। এমন সময় গুরুর মেজোছেলে নজির খাঁ এসে ডাকলেন তাকে, বাবুজি, শীঘ্র আসুন। পিতাজি আপনাকে ডাকছেন।
ছুটল আলম।
গুরুজি গম্ভীর। আলম বুঝল, অজ্ঞাতে কোন অপরাধ ঘটে গেছে। আলম মাথা নীচু করে বলল, গোস্তকি মাপ কিজিয়ে। কৈ গাফিলতি হো গিয়া!
গুরু মাথা ঝাঁকালেন। মরমে মরে গেল আলম। মাথা ঝুঁকে পড়ল ওর। গুরু বললেন, তুমি বিয়ে করেছ?
আলম বলল, জি, হাঁ। বাবা কথা দিয়েছিলেন আমার স্ত্রীর বাবাকে। পিতৃ-সত্য পালন করেছি।
--বুরবাক! কিন্তু মেয়েটির প্রতি কী ব্যবহার করেছ?
আলম আবার মাথা নীচু করল। .
গুরু বললেন, এই দেখ, তোমার বাবা তার করেছেন, তোমার স্ত্রী আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। ছিঃ! যার দিল এত কঠোর, সে শিখবে সঙ্গীত?
স্তব্ধ হয়ে রইল আলম।
গুরু বললেন, আজই বাড়ি ফিরে যাও।
হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল আলম।কি নিয়ে আমি বাড়ি ফিরব? আমি যে বড় গর্ব করে জানয়েছি, ওয়াজির খাঁ আমার হাতে শিষ্যের নাড়া বেঁধেছেন! অথচ আমি যে কিছুই শিখি নি!
গুরু ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, কিছুই শেখ নি? মানে? এই তিন বছর --
-- আপনি তো আমাকে শেখান নি!
-- আমি না শেখাই, আমার ছেলেরা? পর্যায়ক্রমে ছেলেদের দিকে তাকালেন ওয়াজির খাঁ।
ছেলেরা বলল, আমাদের তো সে আদেশ দেন নি।
স্তব্ধ হয়ে গেলেন ওয়াজির খাঁ। ইস্, কিছুই পায় নি ছেলেটা, অথচ গোলামের গোলামের মতো সেবা করে গেছে! ছিঃ ছিঃ, কী ভুল করেছেন তিনি! ছেলেদেরও শিক্ষা দেওয়ার কথা বলতে ভুলে গেছেন। ওয়াজির খাঁ ছেলেদের বললেন, আজ থেকে আলম তোমাদের ভাই হল। ওকে শেখাবার দায়িত্ব তোমাদের। আমিও শেখাব।
পরদিন থেকে শুরু হল আলমের শিক্ষা। আলম বুঝি পারলে চব্বিশ ঘণ্টাই পড়ে থাকে তরা সাধনা নিয়ে, কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। এদিকে অত্যচারে-অত্যাচারে শরীরও ভেঙে পড়েছে। তবু ক্লান্তি নেই আলমের।
গুরু ওয়াজির খাঁ বলেন, মাংস খা আলম। স্বাস্থ্য ভালো হবে, বুকে বল হবে, বেশি দম পাবি।
আলম হাসে। যে গোস্ত সে জীবনে খায় নি, তা আর খাবে না।
একদিন দরবারেও এই গোস্ত খাওয়া নিয়ে কথা উঠল। কথা চলতে চলতে ‘মছলিখোর’ আলমকে নিয়ে, কথা উঠল, কথা উঠল বাঙালীকে নিয়ে। মুহূর্তে চটে গেল আলম। তাকে নিয়ে বিদ্রুপ সইতে পারে আলম, কিন্তু তার জাতকে নিয়ে নয়। বাঙালী আলম সগর্বে বলে উঠল, গোস্ত খেয়ে তোরা যা ডান হাতে পারিস, মছলি খেয়ে বাঙালি তা বাঁ হাতে পারে। দেখবি?
বলে হাত বদলে বাঁ হাতে সরোদ ধরল আলম। বলল, আজ থেকে আমি আর তারবাদ্য ডান হাতে বাজাব না, বাজাব বাঁ হাতে।
আজীবন তাই বাজিয়ে গেছে আলম। এতখানি স্বজাতির প্রতি মর্যাদাবোধ আমাদের অনেক মহান নেতার মধ্যেও বিরল।
এমনিভাবে কেটে গেল আলমের শিক্ষার চার বছর। এক শরতের সকালে ওয়াজির খাঁ বললেন, এবার তোমার শিক্ষা সমাপ্ত। তুমি এবার দেশ-ভ্রমণে বেরিয়ে পড়। পরীক্ষা দাও। লোকের চিত্ত জয় কর। বিশ্বে নিজের স্থান খুঁজে নাও।
গুরর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে, নবাবের শুভেচ্ছা নিয়ে আলম ফিরে চলল কলকাতায়। শুরু হল তার বিশ্ব-পরিক্রমা। এই প্রসঙ্গেই সে উঠল পুঁটিয়ারাণীর বাড়িতে। সেখানেই পরিচয় ঘটল শ্যমলাল ক্ষেত্রীর সঙ্গে। তিনিই ভবানীপুর সঙ্গীত সম্মেলনে বাজাবার ব্যবস্থা করে দিলেন আলমের। সেখান থেকেই নাম ছড়িয়ে পড়ল আলমের।
* * * *
সঙ্গীত-সম্মেলনের শেষে শ্যমলাল ক্ষেত্রী আবার দেখা করলেন আলমের সঙ্গে। অবশ্য তখন কেউ আর তাঁকে আলম বলে না। বলে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ।
শ্যামলাল বললেন, ওস্তাদ, আপনি এখন কোথায় যাবেন?
আলাউদ্দিন গুরুর আদেশের কথা শুনিয়ে দিলেন শ্যামলাল ক্ষেত্রীকে।
শ্যামলাল বললেন, আমার কথা শুনুন ওস্তাদজি। আমার বন্ধু ব্রজনাথ সিংজি হচ্ছেন মাইহারের রাজা। রাজাজি একজন উপযু্ক্ত ওস্তাদ খুঁজছেন। আপনি তাঁর কছে যান। যে কোন কাজে এগুতে গেলে একজন যোগ্য পৃষ্ঠপোষক চাই তো!
আলাউদ্দিন খাঁ মানলেন ক্ষেত্রীমশাইয়ের যুক্তি। কিন্তু মাইহার যাবার অর্থ কোথায়? আজ তো আর তিনি অবুঝ নন যে, বিনা টিকিটে স্টীমারে বা রেলে চেপে বসবেন!
কিন্তু এই দারিদ্রের কথা বলাই বা যায় কী করে?
আলাউদ্দিনের নীরবতা এবং মুখের চেহারা দেখে শ্যামলাল নিজেই বুঝলেন অবস্থাটা। বললেন, দ্বিধা করবেন না, ওস্তাদজি। উঠুন, আজই রওনা হোন। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
সব ব্যবস্থাই শ্যামলাল করে দিলেন-ট্যাক্সি করে স্টেশনে নেওয়া, টিকিট কাটা, গাড়িতে খাওয়ার ব্যবস্থা।
সম্ভবত মাইহারে রাজার কাছে তারও করেছিলেন শ্যামলাল। তাই স্টেশনে রাজার পাঠানো গাড়ি উপস্থিত ছিল। বিকেলের দিকে মাইহার রাজপ্রাসাদে রাজার কাছে উপস্থিত হলেন আলাউদ্দিন।
তরুণ বয়সী রাজা। মন্দ লাগল না যুবককে। আলাউদ্দিন খাঁ কে সাদরে বসিয়ে গান শুরু করতে বললেন দেওয়ানজি।
পরীক্ষা! খুব সতর্ক হয়ে সময় ও শাস্ত্রের নির্দেশ মিলিয়ে নিজের প্রিয়তম রাগে গান ধরলেন আলাউদ্দিন খাঁ। দিন আর রাত এসেছে সন্ধ্যার প্রান্তে। এই সন্ধিক্ষণের প্রকাশই তো শ্রী রাগে, আর শ্রীরাগ আলাউদ্দিন খাঁ-র হাতে খেলে ভাল৷
কিন্তু ক মিনিট যেতে না যেতেই রাজা উসখুস করতে থাকলেন। মনে মনে বিরক্ত হলেন আলাউদ্দিন। এই সময়ে এমন রাগের বিশুদ্ধ প্রকাশেও যে তন্ময় হতে পারে না সে তো বেরসিক! হা আল্লা! ওয়াজির খাঁর শিষ্য হয়ে তাঁকে এমন এক বেকুফের কাছে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে! নিজের ভাগ্যকে মনে মনে ধিক্কার দিতে থাকলেন তিনি। এমন সময় বেকুফ রাজা চরম বেকুফি করলেন, থামতে বললেন আলাউদ্দিন খাঁকে। --এখন বিশ্রাম করুন, বলে রাজা চলে গেলেন।
অপ্রসন্ন মনে তাঁর জন্যে নির্দিষ্ট ঘরে চলে গেলেন আলাউদ্দিন। বুঝলেন, মাইহারে তাঁর অধিষ্ঠান হচ্ছে না, চলে যেতে হবে এখন থেকে। কিন্তু কোথায় যাবেন? যতক্ষণ রাজা বিদায় না দিচ্ছেন, ততক্ষণ যাওয়া হচ্ছে না। সেটা বেয়াদবি। তা করতে চান না আলাউদ্দিন খাঁ। কিন্তু এমন বেরসিকের রাজ্যে আর থাকতেও ইচ্ছে করছে না। এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকলেন তিনি।
ঘণ্টা কয়েক পর আবার তলব হল আলাউদ্দিনের। মন অপ্রসন্ন হলেও মুখে হাসি টেনে দরবারী ভঙ্গীতে তিনি দেওয়ানের পিছনে পিছনে যে ঘরে এলেন, সেটা একটা মস্ত হলঘর। একদিকে রেওয়াজের স্থান, তার চারদিকে থরে থরে সাজানো রয়েছে নানা জাতের যন্ত্র।
দেওয়ানজনী তাঁকে রেওয়াজের আসনে বসতে বললেন। আলাউদ্দিন খাঁ বসতে তাঁর হতে এগিয়ে দেওয়া হল প্রথম যন্ত্র-একটি ক্ল্যারিওনেট।
কী বাজাবেন আলাউদ্দিন? শ্রীরগে যাঁর বিরাগ, তাঁকে কী সুর শোনাবেন? মিনার্ভা থিয়েটারের হালকা চটুল গানের সুর তুললেন আলাউদ্দিন খাঁ।
খানিক বাজাতেই থামবার ইঙ্গিত হল। ক্রুদ্ধ মনে থামলেন তিনি।
আবার আর একটি যন্ত্র তুলে দেওয়া হল তাঁর হাতে। বাজানো শুরু হতে না হতে থামতে হল। একে একে প্রত্যেকটি যন্ত্র বাজাতে হল তাঁকে। বাজালেন হালকা থেকে গভীর, করুণ থেকে আনন্দঘন নানান সুর। কিন্তু কোন কিছুতেই খুশি হলেন না রাজা। দু মিনিট না বাজাতেই থামতে হল তাঁকে। ঘণ্টাদুয়েকে ঘরের সব বাদ্য বাজিয়েও বেরসিককে বাগে আনতে পারলেন না তিনি।
দেওয়ানজি এবার কণ্ঠ-সঙ্গীত শুরু করতে বললেন। কণ্ঠ-সঙ্গীত মিনিট কয় চলতে না চলতে রাজাজি অধৈর্যের মতো উঠে দাঁড়ালেন। গান থামিয়ে আলাউদ্দিন খাঁকেও উঠে দাঁড়াতে হল। রাজা ছুটে এলেন।
গালে চড় মারবেন না কি? না, আলাউদ্দিন খাঁ কে বিস্মিত করে রাজা তাঁর হাত জড়িয়ে ধরলেন।
বললেন, ওস্তাদজি, আপনি আমায় বিস্মিত করেছেন। আমার প্রতিজ্ঞা ছিল, আমার সংগ্রহের সব বাদ্য বাজাতে পারবেন যে ওস্তাদ, তাঁকে আমার সভাগায়কের পদে বরণ করব। আপনার আগে আর কেউ সব যন্ত্র বাজানো তো দূরের কথা, ধরতেও পারেন নি। এবার অনুগ্রহ করে আপনি মাইহার রাজ্যসভা অলঙ্কৃত করতে সম্মতি দিন।
ওঃ। বার বার থামতে বলা তাহলে বেরসিকপনা নয়, পরীক্ষায় পাসের ইঙ্গিত। আর এতক্ষণ কত ভেবে মরছিলেন তিনি। আলাউদ্দিন খাঁ অদ্ভুতভাবে হাসলেন। বললেন, আপনি যদি খুশি হয়ে থাকেন, তবে আমি সভা-গায়ক হতে সম্মত।
রাজাজি দেওয়ানের দিকে ফিরে বললেন, ওস্তাদজির থাকা খাওয়ার উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দিন। আর কাল দশহরা, পূণ্যদিন। যথাযোগ্য আয়োজন করুন, কালই ওস্তাদজির অভিষেক হবে।
ছোট রাজ্য হলেও যথেষ্ট জাঁক-জমকের সঙ্গে অভিষেক হল আলাউদ্দিন খাঁর। বিখ্যাত চন্দন চৌবে মহারাজের শিষ্য ঘোররে মহারাজ তখন রাজ-অতিথি হয়ে মাইহারে আছেন। ফৌজি কোট ছাড়িয়ে মহারাজের পাঠানো দরবারী পোশাক তিনিই পরিয়ে দিলেন আলাউদ্দিন খাঁর অঙ্গে, তাঁর মাথায় সুন্দর করে বেঁধে দিলেন জরির পাগড়ি। দরবারে উপস্থিত হয়ে এক বিচিত্র মানসিকতায় ভরে গেল আলাউদ্দিনের মন। আজীবন দারিদ্রে দিনপাতের বেদনা যেন দূর হয়ে গেল সম্মান ও সমারোহের প্রাচুর্যে। তবু যেন ভিতরে ভিতরে কী এক অব্যক্ত বেদনায় তাঁর মন কেঁদে চলল।
কিন্তু দরবারে তখন ভিন্ন পরিবেশ। সার দিয়ে খোলা তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় পঞ্চাশ জন সর্দার। অভ্যাগত জনে ভরপুর সকল আসন। স্বয়ং রাজা তাঁকে ফুল-চন্দন দিয়ে আপ্যায়ণ করলেন, দিলেন একথালা মোহর। তারপর হাত ধরে তাঁকে বসিয়ে দিলেন একটা শূন্য সিংহাসনে। চারদিক থেকে শঙ্খ বেজে উঠল। সকলে জয়ধ্বনি দিল তাঁর, রাজার, মাইহারের।
শঙ্খ আর জয়ধ্বনি থামতে রাজাজি বললেন, আজ এই পূণ্যদিনে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে আমি শুধু সভাগায়কের পদেই বরণ করলাম না, আমার সঙ্গীতগুরুর পদেও বরণ করলাম। মহামন্ত্রীর পরেই হল তাঁর স্থান। গুরুজিকে আপনারা সর্বতোভাবে সম্মান দান করবেন।
সমস্ত দরবার আবার ধ্বনি দিয়ে উঠল -- রাজার গুরু আমাদের গুরু। আমরা গুরুর সম্মান দিতে জানি, মহারাজ।
আলাউদ্দিন খাঁ আসন থেকে নেমে এসে বললেন, মহারাজা! আমি নিজে যে এখনও ছাত্র! আমার গুরু ওয়াজির খান আমাকে দেশ-ভ্রমণের আদেশ দিয়েছেন, শিষ্য করবার আদেশ তো দেন নি!
রাজাজি বললেন, বেশ তো, তিনি যদি আদেশ না দেন, তবে শিষ্য করবেন না। কিন্তু যদি আদেশ দেন, তবে করবেন তো? আমি চেয়ে পাঠালে ওয়াজির খাঁ নিশ্চয় সে আদেশ দেবেন।
তবে সে আদেশ চেয়ে পাঠান মহারাজ।
সঙ্গে সঙ্গে রাজার দূত ছুটল ওয়াজির খাঁর কাছে রামপুরে। সব শুনে উল্লসিত হলেন ওয়াজির খাঁ, আলাউদ্দিনের বিনয়ে আরো খুশি। যোগ্য শিষ্য। গুরুর সম্মান যে এমন করে রাখতে জানে, তাকে অদেয় কী থাকতে পারে? শিষ্য গ্রহণের আদেশই শুধু নয়, শিষ্যের হাতে বাঁধবার নাড়াটিও নিজে হাতে তৈরি করে পাঠালেন ওয়াজির খাঁ।
আর একটি উৎসব করে রাজা আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্য হলেন। এই দিনই রাজা শুধোলেন, গুরু হলে তাঁর দক্ষিণা স্থির করতে হয়। আপনার--
কথা সমাপ্ত করতে দিলেন না আলাউদ্দিন খাঁ, জিভ কাটলেন, কান মললেন। বললেন, গান শিখিয়ে আমি পয়সা নেব না। একটা পানও নেব না। যার মধ্যে সত্যিকারের দরদ দেখব, তাকে এমনি শেখাব।
আলাউদ্দিনের মহত্বে আর একবার চমকে গেলেন রাজা। কিন্তু মনে তাঁর অন্য চিন্তা! তবে গুরুজির চলবে কীভাবে? রাজা বললেন, বেশ। আজ থেকে আপনাকে আমি আমার সব দেবোত্তর সম্পত্তির ম্যানেজারও করে দিলাম। রাজ্যের নিয়ম অনুযায়ী আপনি মাসিক প্রণামী পাবেন দেড়শ টাকা অর একটি বাড়ি।
একট থামলেন রাজা। আগেই শুনেছেন আলাউদ্দিন খাঁর জীবন-কথা। সেই প্রসঙ্গ টেনে এবার বললেন, গুরুমাকে এখানে নিয়ে আসুন। স্থায়ী হয়ে বসুন। আমার রাজ্য সুরে সুরে ভরিয়ে দিন ওস্তাদজি।
সম্মতিসুচক মাথা নাড়লেন আলাউদ্দিন খাঁ, তাঁর জগৎটাই যে সুরময়!
এগারো
মাইহারের রাজা বললেন, শেখান গুরুজি।
চুপ করে রইলেন আলাউদ্দিন খাঁ।
রাজা বললেন, বলুন, কোথায় আপনার বাধা?
আলাউদ্দিন বললেন, বাধা আমার নয়, বাধা আপনার। সঙ্গীত-সাধনার জন্যে যে কষ্ট স্বীকার করতে হবে, তা কি আপনি সইতে পারবেন?
রাজা বললেন, আপনি আদেশ করুন।
আলাউদ্দিন বললেন, প্রথমেই আপনাকে সরাব ছাড়তে হবে।
-- ছাড়ব।
-- যতক্ষণ রেওয়াজ করতে বলব, ততক্ষণই রেওয়াজ করতে হবে।
-- করব।
-- বেশ, তবে শেখাব আমি।
পরদিন থেকে শুরু হল অন্নদাতার শিক্ষা। অনন্যমনা হয়েই রাজা শিখতে থাকলেন। ওস্তাদজিও শেখাতে লাগলেন প্রাণ ঢেলে। অনভ্যস্ত কণ্ঠ, অনভ্যস্ত দেহ ও মন। মাঝে মাঝে অবাধ্য হয়, অসংযত হয়ে ওঠে, তবু রাজা প্রাণপণে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে চলেন। তবে গুরু যা চান, তা যেন পেরে ওঠেন না তিনি। গুরুও হারিয়ে ফেলেন ধৈর্য্য। একদিন রেগে গিয়ে এক চড় কষিয়ে দিলেন রাজাকে, একদিন হাতই মুচড়ে দিলেন। কিন্তু আশ্চর্য! কতটুকু সময়ের মধ্যে রাজার রাসভনিন্দিত কণ্ঠস্বরেও সুরের আবেশ নামল, রাজা নিজেই অবাক হলেন নিজের কৃতিত্বে।
রাণীরাও সঙ্গীত শিখতে লাগলেন গুরুজির কাছে।
রাজা আবার একদিন গুরুকে বললেন, এবার গুরুমাকে এখানে নিয়ে আসুন। স্থায়ী হয়ে বসুন। মাইহার ধন্য হোক।
কথাটা মনে ধরল আলাউদ্দিনের। খাওয়া-দাওয়ার বড়ই অসুবিধা হচ্ছে, জীবনে যেন কোন হিসেব থাকছে না। অতএব চিঠি গেল ত্রিপুরা জেলার ব্রাহ্মণবেড়িয়ার শিবপুরে। দাদা আফতারউদ্দিন একদিন মদনমঞ্জরীকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন মাইহরে।
কিন্তু এ কে? কোথায় সেই নোলক-পরা সাত-আট বছরের মেয়ে? তার বদলে কে এই সুন্দরী রমণী? আলাউদ্দিন খাঁর মনে হল, তবে সত্যিই অনেক কাল মেয়েটিকে নির্বাসনে রেখেছেন তিনি, নিষ্ঠুরতা করেছেন। কিন্তু কত বছর? তা প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ বছর হল।
মনে মনে ক্ষমা চাইলেন আলাউদ্দিন খাঁ। মাইহারে নূতন জীবন শুরু হল। যুগপৎ গৃহস্থলি এবং শিক্ষাদান।
এমন সময় একদিন কালো রেখায় ঘেরা এক শোকের চিঠি এল আলাউদ্দিন খাঁর নামে। তিনি তখন বাড়ি নেই, গেছেন হাটে। মাইহারে গুরুজির কাজ সর্বাগ্রে করণীয়। অতএব পিয়ন ছুটলেন হাটে। হাটের মধ্যেই চিঠি নিলেন আলাউদ্দিন খাঁ। কম্পিত হতে চিঠি খুললেন।
গুরু ওয়াজির খাঁর চিঠি। তাঁর বড়ছেলে পিয়ারা সাহেব মারা গেছেন। আলাউদ্দিনের বুকে যেন শেল বাজল। পিয়ারা সাহেব যে গুরুজির বুকের পাঁজরা!
তাঁর মৃত্যুতে নিশ্চয়ই বুকখানা ভেঙ্গে গেছে গুরুজির। মূহূর্তেক দেরি করলেন না আলাউদ্দিন, পিয়নকে বাড়িতে সংবাদ দিতে বলে হাট থেকেই রওনা হয়ে গেলেন, রামপুর অভিমুখে।
আলাউদ্দিনকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন ওয়াজির খাঁ। আলাউদ্দিন তাঁকে স্বান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেই কেঁদে আকুল। গুরুশিষ্যর কান্না থামলে গুরু বললেন, আলাউদ্দিন, আমি পাপ করেছি,মহাপাপ! তাই ঈশ্বর আমাকে এই শাস্তি দিয়েছেন।
কী পাপ গুরুজি?
গুরু বললেন, তোর মতো শিষ্য পেয়েও তোকে কিছু শেখাই নি। তোর প্রতি আমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি আলম।
আলাউদ্দিন কান মললেন. নাক মললেন। বললেন, আমার পাপ আর বাড়াবেন না গুরুজি। আমাকে আপনি যে দয়া করেছেন তাতেই আমি ধন্য!
গুরু বললেন, না রে না। বীণা, রবাব, সুরশৃঙ্গার এসব তোকে কিছুই দিই নি। ধ্রুপদ-ধামারেরও কিছুই দিই নি তোকে। আসলে মিয়া তানসেনের যা কিছু সম্পদ, তা আমাদের পরিবারের। স্বয়ং তানসেনের লেখা পুঁথি আছে আমাদের বাড়িতে। তা আমরা সম্মান করে রেখে দিই, নিজেরও খুলি না, পাছে অন্যকে দেখিয়ে ফেলতে লোভ হয়। সেরা চিজ বংশের একজনকে শেখাই। এমনি করে রক্ষা হয় ঘরানা। এটাই ভারতীয় সঙ্গীতের গুপ্ত রহস্য। এমনি করে হঠাৎ এক-এক-জনের মৃত্যুতে লুপ্ত হয়ে গেছে কত ঘরানা! আমার ঘরানাও লুপ্ত হয়ে যাবে আলম!
আলাউদ্দিন বললেন, কেন গুরুজি? আপনার অন্য ছেলেদের শেখান না, নাতি-নাতনীদের শেখান।
মাথা হেট করলেন ওয়াজির খাঁ, বললেন, অন্য ছেলেদের ক্ষমতা নেই, নাতি-নাতনীরা ছোট।
-- তবে ঘরানা রক্ষা কী করে হবে গুরুজি?
ওয়াজির খাঁ বললেন, তুই, তুই রক্ষা করা আমার ঘরানা। শিষ্যই তো পুত্র। একদিন পিয়ারাকে বলেছিলাম, আলম তোমাদের ভাই, তাকে সব শেখাও। বলেছিলাম, কিন্তু শেখায় নি। আজ তুই আমার প্রকৃত ছেলের কাজ কর্, আমার ঘরানা রক্ষা কর্।
হাউহাউ করে কাঁদেন আলাউদ্দিন খাঁ। বলেন, আমার দাড়িতেও যে পাক ধরেছে গুরুজি, আমার দেহেও যে বল নেই। আমি কি পারব এখন শিখতে?
তবু শুরু হয় শিক্ষা--দুই বৃদ্ধের এক বিচিত্র সাধনা। ওয়াজির খাঁ বোঝেন, ঘনিয়ে আসছে দিন। আরো-আরো শিখে নাও আলম, আমার বুক উজার করে সব জেনে নাও। যদি না জেনে নাও, তাহলে আমার মৃত্যুর সঙ্গে শেষ হয়ে যাবে, লুপ্ত হয়ে যাবে প্রায় তিনশ বছরের এক সুপ্রাচীন শিল্পরীতি। না, তোমার কোন দায় রইল না, এবার তুমি বিলিয়ে দিতে পার সকলের মধ্যে। যে ঘরানা আমি গঙ্গোত্রী হিমবাহের মতো জমাট করে রেখেছিলাম, হে ভগীরথ, তোমার সাধনায় তুমি তাকে দ্রবীভূত করেছ। এবার তুমি তাকে বিলিয়ে দাও মহামানবের সমুদ্রনীরে। বংশপরম্পরায় যে পাপ করেছি রাজসভার মোহে সাধারণকে বঞ্চিত করে, তোমার প্রচারের মধ্য দিয়ে হোক তার অবক্ষয়। সুরের রাজ্যের ঘরানা-রীতির সামন্ততন্ত্রের অবলুপ্তি ঘটুক, উদয়, হোক গণতন্ত্রের।
কিন্তু দেহ যে আর সয় না গুরুজি. শক্তি যে আর অবশিষ্ট নেই! তবু, তবু হে অশক্ত দেহ, তোমাকে বইতে হবে। হে ক্লান্ত মন, তোমাকে গ্রহণ করতে হবে। যে সূর্যোদয়ের জন্যে প্রতীক্ষা করেছি সারাজীবন, মৃত্যুর মুখোমুখিই যদি তা এসে থাকে তবে হে দেহলীন দেবতা, ধৈর্য ধর তাকে গ্রহণ করতে।
তাই মরণপণ করে যেন শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকলেন আলাউদ্দিন। তাঁকে ওয়াজির খাঁর শিক্ষর শেষ বিন্দুও নিঃশেষে শুষে নিতে হবে। এ তো দেবী সারদা যেন প্রসন্ন মুখে আশীর্বাদ করছেন, দিচ্ছেন অভয়।
কিন্তু শিক্ষা কি শেষ হল?
তা হয়ত নয়, তবু, প্রসন্ন চিত্তে শিষ্যকে আশীর্বাদ করলেন ওয়াজির খাঁ। ভাগ্য তাঁর সুপ্রসন্ন। নইলে এমন শিষ্য লাখে মেলে এক। এ শিষ্য তিনি পেলেন কোন্ পূণ্যে?
পরিতৃপ্তি নিয়েই বড়ছেলের মৃত্যুর তিন বছর পর চোখ বুজলেন ওয়াজির খাঁ। আলাউদ্দিন বুকভরা বেদনা নিয়ে ফিরে এলেন মাইহারে। গুরুর শোক পালন করলেন পুত্রেরই মতো-এক বছর।
বিখ্যাত সেতারী ও সরোদ-বাদকেরা আসছেন মাইহারে আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্যত্ব নেবার জন্যে। অন্যান্যদের সঙ্গে ১৯২৫ সালে এলেন তিমিরবরণ।
ক্রমে ক্রমে তিন কন্যা আর এক পুত্র জন্মগ্রহণ করল আলাউদ্দিনের! আরো এক পুত্রের আকাঙ্খা ছিল, কিন্তু আর পুত্র হল না। শেষ বয়সে কন্যা অন্নপূর্ণার সঙ্গে রবিশঙ্করের বিয়ে দিয়ে বললেন, আল্লা আমার সাধ মেটালেন। পুত্র চেয়েছিলাম, জামাই পেলাম রবুকে।
১৯৩৫ সাল। উদয়শঙ্করর সঙ্গে বিশ্বভ্রমণে বের হলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ।
বোম্বাই থেকে জাহাজ ছাড়ল।
জাহাজের ডেক থেকে কূলের দিকে তাকিয়ে কি জানি কেন হঠাৎ দ্বিতীয় বার গৃহত্যাগের কথা মনে পড়ল আলাউদ্দিনের। তফাৎ কিছু আছে। সেবার ঘুমন্ত মদনমঞ্জরীর অজান্তে তার টাকা চুরি করে পালাতে হয়েছিল, এবার মদনমঞ্জরীর জ্ঞাতসারে তার শুভ কামনা নিয়ে হয়েছে যাত্রা। সেবারে ছিল কিছুই-না-জানা বালক, আজ পক্ককেশ প্রবীণ। তবে সেদিন ছিল অজানা কলকাতা সফর, আজ অজানা বিশ্ব।
কিন্তু সেদিনের কলকাতার চেয়ে আজকের বিশ্বে সমাদর মিলল বেশী। প্রথমেই পোর্ট সৈয়দে নেমে মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমির দেশগুলি। মিশর, আরব, জেরুজালেম ইত্যাদি সমস্ত প্রধান শহরগুলিতে অনুষ্ঠানের করলেন উদয়শঙ্করের ইহুদী ম্যানেজার গ্রাটা। বিপুল সম্মান পেল গোটা দল। অভিজ্ঞেরা বললেন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেউ এত বিপুল সংবর্ধনা পান নি এদেশে। পাবেনই বা কেন? কবিগুরুর পর এঁরা ছাড়া আর কোন্ সাংস্কৃতিক দল গেছে সংস্কৃতির আদান-প্রদান করতে?
প্রদান তো বটেই, আদানও। সর্বত্রই মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন আলাউদ্দিন খাঁ। সে দেশের মাটির সুর তুলে নিতে হবে। সুরের কাঙাল আমি, সুরর ভিক্ষা চাই সর্বত্র। তিলতিল করেই তো হবে তিলোত্তমা৷ এখানে এসে আবার আজানের সুর বিশ্লেষণ করলেন আলাউদ্দিন খাঁ। সেই দুর্গা! সেই সিন্ধুভৈরবী! কে বলে মুসলমান ধর্ম নৃত্যগীতবিরোধী? তাহলে আজানে এত সুর কেন? মুসলিম গ্রামের মানুষ গান গায় কেন? উদয়শঙ্করের হিন্দু দেব-দেবীর নাচ দেখে কেন? আলাউদ্দিন সে দেশের ভাষা বোঝেন না, কিন্তু সুরের স্পর্শে বোঝেন, সেই প্রাণ, সেই সুর সর্বত্র বেড়ে চলেছে। জগৎ জুড়ে একই সুরের মেলা।
কাছেই মক্কাশরিফ, মুসলমানদের শ্রেচ্ঠ তীর্থ। উদয়শঙ্কর বললেন, একদিন যান, ঘুরে আসুন মক্কা।
মন নড়ে উঠল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে পড়ল, তাঁকে একাই যেতে হবে মক্কা, উদয়শঙ্করেরা যেতে পরাবেন না! ওঁরা হিন্দু, কাজেই ধর্মের বাধ। ভারতেও কোন মন্দিরে ঢুকতে পান নি আলাউদ্দিন খাঁ। গিরিশচন্দ্রের নাট্য-মন্দিরে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু নাম বদলে। আলাউদ্দিন খাঁ ঢোকেন নি, ঢুকেছিল প্রসন্ন বিশ্বাস। সর্বত্র সেই ধর্মের ধ্বজাধারীদের শাসন। মনে মনে দেবী সরস্বতীকে স্মরণ করলেন আলাউদ্দিন খাঁ। না, থাক। সুরের বিশ্বজয়ে বেরিয়েছেন তিনি, এক আরাধ্যই তাঁর মাথায় থাকুক। মক্কা নয়। কাউকে রেখে একা তিনি মক্কায় যাবেন না। আকাশে বাতাসে আজানের ঘোষণায় মহম্মদের বাণী এসেছে তাঁর কানে। আল্লা যদি দয়া করেন, তবে বারান্তরে আসবেন তিনি।
মিশর থেকে তাঁরা এলেন গ্রীসে। আলেকজাণ্ডার গিয়েছিলেন সৈন্য নিয়ে, আলাউদ্দিন এলেন সুর নিয়ে। আলেকজাণ্ডার পিছন ফিরতেই তাঁর সাম্রাজ্য চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, আলাউদ্দিন যা গড়ে এলেন, তা চিরস্থায়ী।
গ্রীস থেকে ক্রমে ক্রমে তাঁরা এলেন বুলগেরিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, রুমানিয়া, হাঙ্গেরী, অস্ট্রিয়া চেকোশ্লোভাকিয়া, পোলাণ্ড, সুইডেন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডে।
প্রত্যেক দেশের প্রধান-প্রধান শহরগুলিতে অনুষ্ঠানের আয়োজন হল। রাজা থেকে সাধারণ প্রজা, প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী থেকে গ্রামের চাষী, কে এলেন না সেই সম্মেলনে? কি ভিড়, কি ভিড়! খবরের কাগজ ভর্তি ছবি আর শবিবরণ। সাময়িক পত্রিকায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের বিবরণ, ভারতীয় সঙ্গীত-নৃত্য সম্পর্কে আলোচনা। অনুষ্ঠান-শেষে হোটেলে ফেরার পথে অপেক্ষমান জনতার অভিনন্দন।
এলেন তাঁরা ভিয়েনায়, প্রাগে বুদাপেস্টে, অবশেষে প্যারিসে। শিল্প আর শিল্পের দেশ প্যারিস। এদেশের আয়োজন দেখে একদিকে বিস্মিত, অন্যদিকে অভিভূত হলেন আলাউদ্দিন খাঁ। এদের গোটা সঙ্গীত-জগতেই বহুর প্রভাব। এরা যখন বাজায়, একসঙ্গে দু-তিনশ জন শিল্পী বসে যায় একত্রে অর্কেস্ট্রা বাজাতে। যখন শোনে, তখন দশ-বারো হাজার মানুষ একত্রে শোনে।
কত কোটি টাকা ব্যয়ে এক-একটা হল ঘর তৈরী!
আলাউদ্দিন যখন বাজাতে থাকেন, তখন ঐ কয়েক হাজার দর্শক নিশ্চুপ। পিন পড়লে বুঝি সে শব্দ শোনা যায়। মনে হয়, প্রেক্ষাগৃহে একটিও লোক নেই, এত তন্ময় হয়ে শোনে তারা। যখন সরোদের মীড় নাট্যমন্দিরে পরিব্যপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, বহুর মাঝে নিজেকে সম্প্রসারিত করবার বিপুল আনন্দে আলাউদ্দিনের বুকের ভিতর, এক অসীম উচ্ছ্বাস আকুলি বিকুলি করতে থাকে।
বাজনা শেষ হলে হাততালি যেন থামতে চায় না! শ্রোতারা বুকের আনন্দ প্রকাশ করতে শিল্পীর দিকে ছুঁড়ে দেয় ফুলের তোড়া। তোড়ায় তোড়ায় ছয়লাপ হয়ে যায় মঞ্চ। আলাউদ্দিন খাঁ আনন্দে ভাসতে থাকেন।
আলাউদ্দিন খাঁ স্বীকার করেন, বাজিয়ে এত আনন্দ তিনি আর কোথাও পান নি।
প্যারিসের অভিজ্ঞতা বিচিত্র। একদিন হোটেলের ঘরে হুড়হুড় করে ঢুকে পড়ল একদল মেয়ে। কী তাদের বেশ-বাস! কি তাদের ভাব-ভঙ্গী। তাদের আবদার, তাঁর বাজনা শুনবে। এমন হাল্কা মেজাজের মেয়েরা কী শুনবে? বুঝবেই বা কি? অপ্রসন্ন মনে বিকেলের পড়ন্ত আলোর দিকে তাকিয়ে ওস্তাদ ভীমপলশ্রীতে ধরলেন সুরের ঝঙ্কার। ও মা! মুহূর্তে ওদের বাইরের হালকা মুখোশ খুলে গেল, ওরা যেন বুঝে নিতে চাইছে. তলিয়ে যেতে চাইছে সুরে। আমোদ লাগল আলাউদ্দিনের, খুশি হল মন। তিনিও ডুব দিলেন।
তিন ঘণ্টা বাদে যখন তিনি থামলেন, তখন মেয়েগুলির মুখে বিস্ময়। ওরা আন্তরিক শ্রদ্ধা নামিয়ে দিয়ে গেল এই ইন্ডিয়ান ওল্ড আর্টিস্টের পায়ে। ওরা যেন তাঁর স্পর্শ পেয়ে ধন্য হয়েছে।
ধন্য আলাউদ্দিনও। তিনিও যে ওদের সত্য পরিচয় জেনেছেন। মনে মনে প্রণাম করলেন গুরুকে। ঠিকই তো, দেশভ্রমণেই শিক্ষার চূড়ান্ত। শিক্ষার কি শেষ আছে!
প্যরিসের ধনীর দুলালী এলিস বোনার উদয়শঙ্করের ভক্ত। ক্রমে তিনি ভক্ত হয়ে পড়লেন আলাউদ্দিনেরও। তাঁরই প্রস্তাবক্রমে ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের এক প্রদর্শনী হল প্যারিসে। ওঁদের দলে তখন প্রায় চল্লিশ রকম যন্ত্র। প্রদর্শনীতে সাধারণ মানুষের কৌতুহলী ভিড়। আলাউদ্দিন খাঁ এক-এক করে যন্ত্র বাজিয়ে দেখান, দেন তাদের কৌতুহলের জবাব। দোভাষী বুঝিয়ে দেন বিষয়টি। ভারতীয় সঙ্গীতের প্রতি শ্রদ্ধা ঝরে পড়ে সকলের চোখে।
বুদাপেস্টে ওঁরা যখন সফর করছেন, তখন সে দেশের নামজাদা শিল্পীরা এলেন আলাউদ্দিনের সঙ্গে ভারতীয় সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করতে। তাঁরা প্রশ্ন করছেন, উদয়শঙ্কর বলে দিচ্ছেন তার বাংলা। আলাউদ্দিন খাঁ বলছেন বাংলায়, উদয়শঙ্কর তার ইংরাজি করে দিচ্ছেন। যতই শুনছেন, ততই যেন বিমুগ্ধ হচ্ছেন শিল্পীরা।
প্রথমেই তাঁরা প্রশ্ন করলেন, কী কী সঙ্গীতের সুর তৈরী করেছেন?
আলাউদ্দিন খাঁ বললেন, আমরা সঙ্গীতের সুর দিয়ে শিল্পীকে বিচার করি না। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ঋষিরা পেয়েছেন সাধনায়, আমরা তারই চর্চা করি, প্রকাশ করি। সময়, মনোভাব ইত্যাদির বিচার করে তৈরী আমাদের রাগ-রাগিনী। ভৈরবী বাজিয়ে শোনালেন আলাউদ্দিন খাঁ। বললেন, কী অনুভব হল? সমঝদার শ্রোতা বললেন, যেন কার জন্যে প্রতীক্ষা করছি, তবু তিনি এলেন না। আলাউদ্দিন খাঁ ভীমপলশ্রী বাজিয়ে শোনালেন। কান্না, যেন কান্নার সিন্ধু উথলে উঠল।
-- কেন গো, তোমাদের সুর এত কান্না আনে কেন?
আলাউদ্দিন খাঁ সাত সুর বাইশ শ্রুতি, একুশ মূর্ছনার হিসাব বোঝালেন, বাজিয়ে বোঝাতে চাইলেন এ সবের পার্থক্য। তালই আছে তিনশ ষাট রকম।
এবার তবলা নিয়ে বসলেন আলাউদ্দিন। মুখে মুখে বোল বলে নানারকম তালের পার্থক্য দেখাতে থাকলেন। ইউরোপীয় সঙ্গীতজ্ঞেরা কিছু বুঝলেন, কিছু বুঝলেন না। শুধু অবাক হয়ে বললেন, আপনাদের কান এত সূক্ষ্ম পার্থক্য ধরতে পারে!
হাসলেন আলাউদ্দিন খাঁ। বললেন, আপনাদের সঙ্গীতে এক সুর অন্য সুরের ঘাড়ে চেপে বসতে চায়। আমাদের সুর থাকে পাশাপাশি, একজন অন্যজনের উপর চেপে বসে না। যেন একেরই ক্রমবিকাশ, এ যেন তেত্রিশ কোটি দেবতা, অথচ এক ঈশ্বর।
-- তবে, অকপটে স্বীকার করলেন আলাউদ্দিন খাঁ, আপনাদের বেহালা বাজনা বড় মধুর। এ বাজনা শুনে মনে হয়, ও বাদনে আমি শিশু। স্থির করেছি, আমি আর বেহালা বাজাব না।
সত্যিই সেই থেকে বেহালা বাজানো ছেড়ে দিলেন খাঁ সাহেব।
বিদায় চাইলেন শিল্পীরা। হাতজোড় করে হাউমাউ করে উঠলেন আলাউদ্দিন। বললেন, আমার আলোচনা শুনে, আমার বাজনা শুনে ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রের উপর কোন খারাপ ধারণা করবেন না। আমি অক্ষম মানুষ। আমার শিক্ষাও সমাপ্ত হয় নি। আমি কি-ই বা দেখাতে পেরেছি, কি-ই বা শোনাতে পেরেছি? ভারতীয় গুণীরা গান গেয়ে ফুল ফোটাতে পারতেন, দীপ জ্বালাতে পারতেন, বৃষ্টি নামাতে পারতেন। সত্যিকারের গুণীর সন্ধান পেলে ভারতীয় সঙ্গীতের যথার্থ সংবাদ পেতেন।
এঁরা বললেন, আপনার কাছেও তো কম পেলাম না!
নাক মললেন আলাউদ্দিন, কান মললেন। হাতজোড় করে বললেন, সত্যিই যদি পেয়ে থাকেন, তবে সে আমাদের শাস্ত্রেরই গুণ, আমার নয়।
বারো
এলম হার্স্ট বাঙালির কাছে পরিচিত নাম। রবীন্দ্রনাথের জীবনাদর্শকে জীবনে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। বিশ্বভারতী গড়ে তুলতে এই ইংলণ্ডবাসী ধনীর সাহায্য কম ছিল না। বিশ্বভারতীর অনুকরণে তিনিও গড়েছিলেন এক প্রতিষ্ঠান, নাম - ভারটিংটন হল। এখানে এলম হার্স্ট ও তাঁর কন্যার আমন্ত্রণে উদয়শঙ্কর ও আলাউদ্দিন খাঁ কাটিয়ে গেলেন কয়েক মাস।
আর মন টিকছে না, দেশ টানছে। পুরো এক বছর বিদেশে কাটিয়ে আলাউদ্দিন ফিরে এলেন মাইহারে। প্রাণের-আকুতিতে নিজের বাড়ির দরজায় নিজেই আঁকা-বাঁকা অক্ষরে লিখলেন মদিনা-ভবন।
এবার আহ্বান এল রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। এক বিশ্ববিজয়ী ডাকলেন আর এক বিশ্ববিজয়ীকে। এ আহ্বানে সাড়া না দেবে কে? পথের কাঙাল আলমকে ডেকেছেন স্বয়ং বিশ্বকবি! সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছুটলেন শান্তিনিকেতনে। নিমন্ত্রিত অধ্যাপক-পদে সেখানে কাটিয়ে দিলেন ছ মাস। রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে যেন সমস্ত জ্বালা জুড়িয়ে ফিরলেন আলাউদ্দিন। বলতেন, বৃথাই বিশ্ব ঘুরলাম। গণেশ যেমন জননীকে প্রদক্ষিণ করে বলেছিলেন, বিশ্ব ঘোরা হল, ওঁর কাছে থাকলেও তাই।
বিদায়-দিনের একটা মজার গল্প বলতেন আলাউদ্দিন খাঁ। বিদয়ের দিনে গম্ভীর মুখে রবীন্দ্রনাথ না কি নন্দলাল বসুর দিকে তাকিয়ে আলাউদ্দিনকে দেখিয়ে বলেন, ওর মাথাটা রেখে দাও।
মাথা রাখবে! সে কি রে বাবা! ঘাবড়ে গেলেন আলাউদ্দিন খাঁ। এঁরা আবার কুকীদের মতো মাথা রাখার পাগলামি শুরু করেছেন কবে! দৌড় দেবেন কিনা ভাবছেন, এমন সময় নন্দলাল সঙ্গে করে আনলেন আর একজন কালো জল্লাদের মতো দেখতে লোককে?
নন্দলাল বললেন, রাম, এরই মাথা।
আরো ঘাবড়ে গেলেন আলাউদ্দিন।
খানিক পরে বিষয়টা পরিষ্কার হল। ও হরি! মাথা রাখা মানে এই! নন্দলাল বসুর প্রিয়তম ছাত্র রামকিঙ্কর বেইজ তৈরি করে রাখলেন আলাউদ্দিনের আবক্ষ মূর্তি।
* * * *
মাইহারে ফিরে ইউরোপীয় স্টাইলে একটা ব্যান্ডপার্টি গড়লেন আলাউদ্দিন খাঁ। ঢেঁড়া পিটিয়ে অক্ষরজ্ঞানশূন্য সাধারণ মানুষ জড়ো করা হল। তাঁর বাড়িতেই সকলের থাকা-খাওয়া। এদের দিয়েই তিনি গড়ে তুললেন এক অসাধারণ ব্যাণ্ডপার্টি। একশজন বাজায় একসঙ্গে। ইউরোপের মতো নোটেশন দেখে বাজাতে হয় না তাদের, তাল আর সরের ইঙ্গিতে ধরন-ছাড়ন, উত্থান পতন!
ভারতময় ছড়িয়ে পড়ল তার খ্যাতি। দেশদেশান্তর থেকে আসতে থাকল সঙ্গীত বিষয়ে নানা প্রশ্ন। কেউ যেন বিমুখ না হয়। নিজে সঙ্গীতের জন্যে যে কষ্ট ভোগ করেছ, অন্যে তা যেন না করে। নাড়া না বেঁধেও সকলেই তাঁর শিষ্য। আলাউদ্দিন খাঁ আর ব্যক্তি নন, তিনি এখন এক প্রতিষ্ঠান।
প্রস্তাব এল যোধপুর থেকে। সভা-গায়ক করতে চান তাঁকে। মস্ত রাজ্য, অনেক সুযোগ।
মাইহারের রাজা বললেন, গুরুজি, আমার ছোট্ট রাজ্য, সামান্য আয়। আপনাকে যোগ্য সম্মান দিতে পারি না। আপনি যান। আমি খুশিই হব।
তবু গেলেন না আলাউদ্দিন খাঁ। স্ত্রীকে বললেন, মাইহার আমার প্রথম অন্নদাতা। এ স্থান আমি ছাড়ব না।
থেকে গেলেন মাইহারেই।
স্বাধীনতার পূর্বে হিন্দু-মুসলমান রায়ট শুরু হল ভারতবর্ষ জুড়ে। এই সঙ্গীত-সাধকের বুক জুড়ে ব্যথা। কোন প্রচার নেই, কিন্তু নিজের জীবনে এত বড় সর্ব-ধর্মসমন্বয় ক’জন করেছেন? আল্লা আর সারদা একত্রে তাঁর আরাধনার বস্তু। যীশুর গল্প শুনে কান্নায় বুক ভাসান। কলকাতায় ছিলেন, অথচ রামকৃষ্ণদেবের চরণধূলি নেন নি জেনে তাঁর কী অনুশোচনা! কলকাতার শিষ্যকে তিনি লিখে পাঠান, বাবা, আমার ঘরে শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ, শ্রীশ্রী বিবেকানন্দের ফটো আছে। কিন্তু শ্রী গৌরাঙ্গের কুন ফটো নাই। তুমি অবশ্য একখানা শ্রীশ্রী গৌরহরির ছবি পাঠাইবা। এই আমার শেষ নিবেদন।
সেই মানুষ এই হানাহানিতে যেন আত্মগ্লানিতে ভরে গেলেন। এ যেন তাঁর নিজেরই পাপ।
দেশ স্বাধীন হল।
স্বাধীন সরকার করদ সব মিত্ররাজ্য নিজহাতে নিয়ে নিলেন। মাইহারের রাজ্যও সেই দলে হারিয়ে ফেলল নিজেকে। আলাউদ্দিনকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হল মাইহার সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়। তার অধ্যক্ষ আলাউদ্দিন খাঁ। সরকার নিজে দেন বেতন।
শুরু হল সম্মানের পালা।
১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে তাঁকে দিনেন্দ্র অধ্যাপক করে আবার শান্তিনিকেতনের সঙ্গীত-ভবনে নিয়ে যাওয়া হল।
১৯৫৮ সালে ভারত সরকার দিলেন ভারত-রত্ন উপাধি। বিশ্বভারতী উপাধি দিল দেশিকোত্তম।
১৯৬৪ সালে আলাউদ্দিন শেষবারের মতো দেখতে গেলেন নিজের জন্মস্থান সেই ত্রিপুরার ব্রাহ্মণবেড়িয়ার শিবপুর। ছোট ভাই আয়েত সেখানেই থাকেন। উঠলেন তাঁর বাড়িতে।
জনস্রোত আসছে আলাউদ্দিন খাঁকে দেখতে। ভলেনটিয়ার বাঁশ বেঁধে ঘিরে দিল বাড়ি। গেটে পয়সা দিয়ে ঢুকতে হচ্ছে। তাও ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। যেন মেলা বসে গেছে। দোকান-পাট মায় হোটেল পর্যন্ত।
মাত্র দশদিন ছিলেন সেখানে আলাউদ্দিন খাঁ। তাতেই দর্শনী বাবদ আদায় হয়োছল কয়েক হাজার টাকা। ভলেন্টিয়াররা তোড়া বেঁধে টাকাটা তুলে দিলেন আলাউদ্দিন খাঁর হাতে। আলাউদ্দিন টাকাটা মাথায় ছোঁয়ালেন। বললেন, এ আপনাদের স্নেহের দান। এর মূল্য আমি কিছুই দিতে পারব না। এই জন্মভূমির জন্যেই বা আমি কী করতে পেরেছি? আমি অক্ষম সন্তান। আপনাদের স্নেহ আমি মাথায় তুলে নিলাম। কিন্তু এ টাকায় আপনারা এই গ্রামে একটা মসজিদ আর একটা পাবলিক পুকুর করিয়ে দিন।
দেহ যেন আর সয় না। মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়েন, আলাউদ্দিনের দেহের আর দোষ কি? অত্যাচার তো কম করেন নি দেহের উপর! সারাদিনে একবার খাওয়া বা একেবারেই অনাহার। একটানা দিনভোর রেওয়াজ। অবশ্য বয়সও কম হল না, একশ বছরও পার হয়ে গেছে। আর কত কাল এই হানাহানির জগতে বসিয়ে রাখবে ঈশ্বর! তোমার সদানন্দের রাজ্যের স্বর্গীয় সুর কি আমায় শুনতে দেবে না!
অসুস্থ দেহে মাইহারের গরমে বড় কষ্ট হয়। রবিশঙ্কর বলেন, বাবা, অনুমতি দিন, একটা এয়ারকণ্ডিশনার বসিয়ে দিই। হাসেন আলাউদ্দিন। বলেন, যিনি আসছেন, তাঁকে সহজভাবেই আসতে দাও। তোমাদের ওসব যন্ত্র দেখে তিনি যদি ভয় পান, আমাকে যদি চিনতে না পারেন!
দিন দিন কেমন যেন উদাস হয়ে যান আলাউদ্দিন, চোখ জলে ভরে আসে। চোখ মেলে যাকে কাছে পান, তারই হাত জড়িয়ে ধরে বলেন, আমি মা সারদার ডাক শুনেছি! আহা, কী মধুর তাঁর স্বর! কী অপরূপ তাঁর সুরের রাজ্য! আমি সে সুর শুনতে পাই, কিন্তু ধরি ধরি করেও ধরতে পারি না।
আবার তাঁর চোখ বুজে আসে খানিক আনন্দ, খানিক শ্রান্তিতে।
১৯৭২ সালের ১৪ই জুন থেকে রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়লেন আলাউদ্দিন খাঁ। একদিন এক প্রিয় শিষ্যকে ডেকে বললেন, মরণের পর আড়ম্বর করবা না। আমারই এই উঠানের এক কোণে আমারে কবর দিবা। আমি মাটির সঙ্গে মিশা যামু। এই মাটির উপরে আমার নাতি-নাতনীরা বাজাবে, আমি শুয়া শুয়া শুনুম।
যাবার জন্য প্রস্তুত মন। অন্যরাও যেন প্রস্তুত হয়ে গেলেন। এই তো খাঁটি ভারতীয়ের মৃত্যু! ইহলোকের সব কাজ মিটিয়ে এ যেন লোকান্তরে যাত্রা। অতএব চোখের জল ফেলো না, যাত্রার আয়োজন কর। দেখো, যেন যাত্রায় কোন বিঘ্ন না ঘটে।
তবু, তবু কেন কান্না আসে তোমাদের চোখে? ওগো, আমি তো এপারের সব কাজ শেষ করেছি। সঙ্গীতের বন্ধনদশা ঘুচিয়েছি। আমার সব উজাড় করে শিখিয়েছি তোমাদের। এখন বাজাও, দেশ জুড়ে বাজাও। শুধু মাইহার নয়, সমগ্র ভারত সেই সুরে কেঁপে উঠুক। সমগ্র বিশ্ব প্রণত হোক সেই সুরের ঝঙ্কারে।
ভারত জুড়ে সত্যিই বাজছে সেই সুর। আলাউদ্দিন খাঁর শত শত শিষ্য-প্রশিষ্য বাজিয়ে চলেছেন সেই একই সুরের রেশ। কিন্তু সেই সুরের ভগীরথ আর আমাদের মধ্যে নেই।
প্রায় একশ দশ বৎসর বয়সে ১৯৭২ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর রাত ১১টা ১০ মিনিটে চিরস্মরণীয় এই সঙ্গীতসাধক চলে গেছেন অন্যত্র কোনও মহান সুরলোকের অভিসারে।।
শেষ
বাজাও আমারে বাজাও (প্রথমাংশ)
লেখক: নীরদ হাজরা
এক
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের কথা, না তার থেকেও অনেক বেশিদিন আগের কথা, ঠিক কবেকার কথা, কেউ তার হিসেব রাখে নি।
শুরু হয়েছে ভবানীপুর সঙ্গীত-সম্মেলন।
শুধু সঙ্গীত-সম্মেলন বললে এর প্রকৃত পরিচয় বোঝানো যাবে না, একে বলতে হবে উচ্চাঙ্গ বা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত-সম্মেলন। এখনে লোকসঙ্গীত বা কোন রকম লঘুসঙ্গীতের স্থান নেই, শুধুই রাগ-রাগিনীর আলাপ-কলাপ। এ গান যে কেউ গাইতে পারে না, যে কেউ এ গান শুনতেও যায় না।
কারণ কী? কারণ, অন্য দেশের মতো ভারতীয় সঙ্গীত সাধকেরা গানকে সা থেকে নি পর্যন্ত সাতসুরের মধ্যে বেঁধেই খুশি হন নি, ঐ সাত সুরকে বাইশ শ্রুতিতে ভাগ করেছেন তাঁরা। সা থেকে রে-র মধ্যেই রেখেছেন চার-চারটে ঘাট। এই বাইশ শ্রুতির আবার তিনশ ষাটটি তাল। এত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ধ্বনির পার্থক্য নিয়ে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কারবার। এইসব ধ্বনির নানারকম বিন্যাসে গড়ে উঠেছে এক-এক রাগ, এক-এক রাগিণী, এদের মিলনে সৃষ্ট হয়েছে আরো কত নূতন রূপ! এত কিছু আয়ত্ত করতে পারলেই তবে হওয়া যায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গায়ক বা বাদক; স্বরের এই সূক্ষ্ম পার্থক্য ধরতে না পারলে বা রাগ-রাগিণীর পার্থক্য সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান না থাকলে হওয়া যায় না শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শ্রোতা। এ সঙ্গীতের আসরে সাধারণ মানুষ গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনলে হয়ত তন্ময় হতে পারবেন, কিন্তু তারিফ করতে পারবেন না।
ভাবছ, তাহলে এ সম্মেলনে কি শ্রোতা হয়? হয়, খুবই হয়। কারণ, সারা দেশে যত সঙ্গীত-পাগল লোক আছেন, তাঁরা তো এমন সম্মেলনের সংবাদের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন। একবার ঘোষণা হলেই হয়, অমনি তাঁরা তল্পিতল্পা বেঁধে এসে হাজির, বিশেষ করে ভবানীপুর সঙ্গীত-সম্মেলনের নাম শুনলে। কারণ, ভবানীপুর সঙ্গীত-সম্মেলনের বিশেষ মর্যাদা আছে, ভারত-বিখ্যাত বিশেষ-বিশেষ ঘরানার শিল্পীরা এ সম্মেলনে এসে হাজির হন। তাঁদের জন্যেই এই সম্মেলনের এত কদর।
বুঝেছি, প্রশ্ন করছ, ঘরানা কী? ভারতীয় সঙ্গীতের জগতে ঐ এক বিপদ। যদি কোন সঙ্গীত-ওস্তাদ বিশেষ কিছু আবিষ্কার করে ফেললেন, তবে সেই বিশেষ কায়দা তিনি নিজের উত্তরাধিকারী বা আত্মীয় ছাড়া আর কাউকে শেখান না। ফলে ঐ সঙ্গীত-সম্পদ তাঁর ঘর ছাড়া হতে পারে না। একেই বলে ঘরানা। ঐ ঘরানার কিছু শুনতে চাইলে ঐ বংশের শিল্পীকেই আনাতে হবে। কিন্তু আসা না আসা তো তাঁর মর্জি। এ যেন সঙ্গীতের রাজ্যে সাম্রাজ্যবাদ।
ভবানীপুর সঙ্গীত-সম্মেলনে এমন অনেক সঙ্গীত-সম্রাট আসেন। তাই শ্রোতাদের কাছে এ সম্মেলনের আকর্ষণ প্রবল।
সেবার জমে উঠেছে সম্মেলন। কয়েক রাত গাওয়া হয়ে গেছে। সম্মেলনের শেষ দিক। যতই শেষ হয়ে আসছে, ততই জমে উঠছে আসর। বিখ্যাত শিল্পীরা ততই আগ্রহে তাঁদের সাধনার ধন উপহার দিচ্ছেন শ্রোতাদের। শ্রোতারাও নূতন-নূতন প্রগতির আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠছেন। উৎকণ্ঠায়, আগ্রহে অপেক্ষা করছেন আরো নূতন কিছু পাওয়।র জন্যে।
সেবারে শ্রোতার আসরে বসে আছেন মুর্শিদাবাদের মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী। সুরের আবেশে ভরপুর তাঁর মন। পাশের লোকটিকে একসময় তিনি বললেন, শ্যামলবাবু, আপনার নূতন সংগ্রহ এই আসরের সুর কেটে দেবে না তো?
শ্যামলাল হাসলেন। তিনি নিজে শিল্পী নন, তবে অদ্ভুত সঙ্গীত-পাগল লোক। ছিলেন বড়বাজারের ব্যবসায়ী। ব্যবসা আছেও। কিন্তু তিনি ঘুরে বেড়ান খ্যাত-অখ্যাত শিল্পীর দুয়ারে দুয়ারে যদি কিছু অবিস্মরণীয় শোনা যায়, এই আশায়।
এই শ্যামলাল ক্ষেত্রী দিন কয় আগে হেদুয়ার কাছে পুঁটিয়ারাণীর বাড়িতে গিয়েছিলেন কয়েকজন ভারত-খ্যাত শিল্পীর সন্ধানে। এসব শিল্পী কলকাতায় এলে ওঠেন পুঁটিয়ারাণীর বাড়িতে। সেবার এসেছিলেন লছমীপ্রসাদ, এমদাদ খাঁ, বিশ্বনাথ রাও প্রমুখেরা। শ্যামলাল সেখানে গিয়ে একজন নূতন শিল্পীর সন্ধান পেলেন। বীনকার লছমীপ্রসাদ তাঁকে গোপনে ডেকে বললেন, শ্যামলাল, ঐ যে লোকটাকে দেখছ, ও আমাকে অবাক করেছে। বাজায় সরোদ। আমি বলছি, লোকটা ভারত জয় করবে।
লোকটাকে দেখে শ্যামলালের পছন্দ হয় নি। এ-ই না কি ওস্তাদের চেহারা! তবু লছমীপ্রসাদের কথা তো অবহেলা করা যায় না। তাঁর মতো মানুষ বাজে কথা বলবেন না। সেই কথার উপর নির্ভর করেই লোকটিকে সম্মেলনে টেনে এনেছেন শ্যামলাল। তার কথাই বলেছেন মনীন্দ্র নন্দীকে। সম্মেলনের মেজাজ যে স্তরে উঠেছে, তাতে শ্যামলালের মনেও সন্দেহ জাগছে যে, এত উঁচু সুরে বাঁধা শ্রোতার মনে কি দাগ ফেলতে পারবে লোকটা?
লোকটি কিন্তু নির্বিকার। একটা ফৌজিমার্কা কোট গায়ে, পাজামা পরে বসে আছে শিল্পীদের জন্যে নির্দিষ্ট স্থানে। বড় বড় ওস্তাদেরা আসছেন তাঁদের শিষ্যসম্প্রদায়কে নিয়ে। কর্মকর্তারা ব্যস্ত হয়ে উঠছেন তাঁদের আদর আপ্যায়নে। এদিকে এ লোকটিও যে আমন্ত্রিত শিল্পী, একেও যে আদর-যত্ন করা দরকার সেটা ভুলে গেছেন কর্মকর্তারা। তা হোক, কিন্তু লোকটার নামটা ডাকে না কেন? এখানে বসে থাকাই কি ওর সার হবে শেষতক? এ সম্মেলনে কি তার আসরে ওঠার সৌভাগ্যই হবে না?
অবশেষে ঘোষক বোধ হয় শিল্পী-তালিকায় তার নামে এসে পৌঁছেলেন। অপরিচিত নাম, একটু থমকে গেলেন ঘোষক। এসব কী কান্ড! এই সময় কিনা এমন এক অখ্যাত শিল্পী! হবে হয়ত কোন কর্মকর্তার পেয়ারের কেউ, কিছু টাকা পাইয়ে দেবার জন্যে নাম ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কেন রে বাপু? দিতেই যদি হয়, তবে ভিক্ষে দিলেই তো হয়। এসব করে জমাট আসর ভঙ্গ করার কী অর্থঃ ঘোষক আর চিন্তা না করে নামটা ঘোষণা করে দিলেন। ঘোষণা শেষ হতে বেঢপ পোশাক-পরা সেই লোকটা মঞ্চে উঠে এল। ঘোষক এতক্ষণ একে কোন ওস্তাদের চাকর-বাকর ভেবেছিলেন। এবার অবাক হয়ে বললেন, তুমিই বাজাবে নাকি!
লোকটি ঘাড় নুইয়ে দরবারী কায়দায় সেলাম করে বললে, জি।
ঘোষক উপেক্ষার ভঙ্গী করলেন। লোকটি গিয়ে বসল আসরে।
তবলচি দর্শন সিং এসে বসলেন।
এদিকে দর্শকরাও বাদককে দেখে থ। ছ্যা, ছ্যা! এ কে উঠল? ওস্তাদের চেয়ে যে তবলচিও অনেক সুদর্শন। তাঁরা ভাবলেন, যাক্ গে। এই ভেড়ুয়ার বাজনা চলুক। ততক্ষণে আমরা বরং বাইরে গিয়ে চা-টা ধ্বংস করে আসি। এই ভেবে উঠে দাঁড়ালেন দর্শকবৃন্দ।
লোকটি চেয়ে চেয়ে দেখল সব। উপেক্ষা, চারদিকেই উপেক্ষা! বেশ, এই উপেক্ষাকেই জয় করব আমি। চোখ বুজে বুঝি গুরুপদ স্মরণ করল লোকটা। তানপুরার সুর বেঁধে নিল। তরপর শুরু করল সরোদ বাদন।
চমকে উঠলেন প্রস্থানোদ্যত দর্শকেরা। বাঃ মিঠে হাত তো! বাইরে যাওয়া হল না, আবার চেয়ারে এসে বসলেন তাঁরা।
লোকটার প্রথম দফায় জয় হল। লোকটা মাথা নুইয়ে সেলাম জানাল দর্শকদের।
এর পর পুরিয়া রাগে বিলম্বিত আলাপ চলল প্রায় আধ ঘণ্টা। দর্শকেরা তন্ময়। কিন্তু এখনও শিল্পীর চরম পরীক্ষা হয়নি। আসুক ঝালায়, দেখা যাক তার কবজির জোর, তালের ঠেকা।
একসময় বাদক পুনর্বার সেলাম জানিয়ে পদার্পণ করল ঝালায়। আহা! আহা! কী বাজনা! শ্রোতাদের বুকের ভিতরে সুর-সমদ্রের উত্তাল ঢেউ যেন আছড়ে পড়ছে। ঢেউগুলো যেন ক্রমেই উদ্দাম হয়ে উঠছে প্রমত্ত পবনে।
না, শেষ পর্যন্ত ওর সঙ্গে আর তাল রাখতে পারলেন না তবলচি দর্শন সিং। বেদম হয়ে পরাজয় বরণ করে সরে পড়লেন তিনি। এলেন নূতন তবলচি। প্রায় চার ঘণ্টা একটানা বাজিয়ে থামল নূতন শিল্পী। দর্শক তখন স্তব্ধ, ভাষাহারা। ঘোষকের চোখে তীব্র বিস্ময়।
স্তব্ধ মনীন্দ্র নন্দীও। জীবনে কম বাদন শোনে নি তিনি। কিন্তু আজ এ কী শুনলেন। না, সুরের মায়ায় মণ্ডপের কোন প্রদীপ জ্বলে ওঠে নি, শুরু হয়নি বারিপাত। কিন্তু অন্তরে অন্তরে ও কোন্ আলোর স্পন্দন, কিসের রিনিরিনি বারিপাত? শ্যামলালের হাত চেপে ধরলেন তিনি, বললেন, আপনি খাঁটি জহুরী। খাঁটি জহর খুঁজে বের করেছেন। কী যেন নাম ঘোষণা হল এঁর?
শ্যামলাল বললেন, আলাউদ্দিন খাঁ।
নন্দীমশাই বললেন, দেখবেন, এ বিশ্ব জয় করবেই।
* * * * *
সত্যিই বিশ্বজয় করেছিলেন আলাউদ্দিন। সারা পৃথিবীর প্রায় সব দেশে বাজনা শুনিয়ে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে এসেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে শান্তিনিকেতনে করেছিলেন অধ্যাপনা। তাঁর পুত্র,পুত্রী, নাতি এবং শিষ্যের দল আজও বিশ্বময় তাঁর সাধনার ধন প্রচার করে ফিরছেন। রবিশঙ্কর, তিমিরবরণ, পান্নালাল ঘোষ, আয়েত আলি খাঁ, আলি আকবর খাঁ, অন্নপূর্ণা দেবী, বাহাদুর খাঁ, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, আরো কত নাম বলব! আধুনিক ভারতের সব খ্যাত বাদন শিল্পীরাই তাঁর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ছাত্র। গুরুমুখী যে বিদ্যা কয়েক শত বছর পারিবারিক ধন হয়ে গোপন ছিল, এই মানুষটি তা এনে বিলিয়ে দিয়েছেন গোটা জাতির মধ্যে, গোটা পৃথিবীর সামনে। অথচ কপর্দকহীন এক গেঁয়ো বাঙাল হিসাবে তাঁর যাত্রা শুরু। এত বড় প্রতিষ্ঠার শিখরে উঠেছিলেন তিনি আপন নিষ্ঠায়, আপন একাগ্রতায়।
আমরা সাধারণ মানুষ তাঁর কাছ থেকে গানের সুর শিখতে না পারি, কিন্তু প্রাণের সুর শিখে নিতে দ্বিধা কোথায়? এস, তাঁর জীবন খুঁজে সেই সুরের সন্ধান করি।
শুরু হোক সেই নিষ্করুণ সাধনার ইতিহাস।
দুই
ইতিহাসেরও একটু ইতিহাস আছে। আলাউদ্দিন খাঁকে বুঝতে গেলে ওঁর বংশকেও একটু বুঝতে হবে। বংশটাই বিচিত্র। কয়েক পুরুষ ধরেই তারা খাপছাড়া। কী যে আছে তাদের মনের মধ্যে, তা তারাই জানে। কিসের যেন যন্ত্রণা, কিসের যেন আকাঙ্খা। তার জ্বালায় যেন ছটফট করে বেড়ায় ওরা। কী যেন পেলে তবে শান্ত হবে, কিন্তু পাওনাটা কী?
আলাউদ্দিনের ছ পুরুষ আগে ছিলেন দীননাথ দেবশর্মা- খাঁটি ব্রাহ্মণ! পুরোদস্তুর গৃহস্থ। কিন্তু পাগল, একেবারেই পাগল। বিয়ের পর বৌ-ছেলে নিয়েও পাগল হয়ে উঠলেন। বৌয়ের হল আকস্মিক মৃত্যু। দিশেহারা হয়ে পড়লেন দীননাথ। কদিন না খেয়ে, না নেয়ে পড়ে রইলেন। তারপর একরাতে ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে পড়লেন অজানার উদ্দেশ্যে।
চলতে চলতে দীননাথ বাংলা ছাড়িয়ে, আসাম ছাড়িয়ে একেবারে কুকীদের রাজ্যে গিয়ে পৌঁছলেন। কুকীরা সেদিন আজকের কুকী নয়। তারা তখন একেবারেই অসভ্য, অচেনা! মানুষ দেখলেই তীর মারে। মানুষ মেরে তার মুন্ডু কেটে নিয়ে ঝুলিয়ে রাখে নিজের কুঁড়ের সামনে। যার বাড়িতে যতগুলো মুন্ডু, সে তত বড় বীর। নরমাংস খায় তারা। বুড়ো বাপ-মা মারা গেলে তাদের মাংস খাওয়া পূণ্য কাজ। ওদের বিশ্বাসঃ একদিন যাদের পেটে ছিলাম আমরা, আজ তারাই আমাদের পেটে থাক। সেই কুকীদের রাজ্যে পৌঁছলেন দীননাথ। সেখানে এক ভাঙা মন্দির আবিষ্কার করে সেখানে করালবদনা কালিকামূর্তির হোমার্চনা শুরু করলেন।
কুকীদের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎটা হল বিচিত্রভাবে। একদিন কুকীরা বিস্মিত হয়ে দেখলে,উলঙ্গ বীভৎস দেবীটার ভাঙা মন্দির থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ওরা চমকে উঠল। তবে নিশ্চয়ই দেবী জেগেছেন। নিশ্চয়ই পাপ ঘটেছে। হায় হায়, কিসে হবে সমাজরক্ষা! ওরা আকুল স্বরে কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে পৌঁছল মন্দিরে। উপুড় হয়ে পড়ল সাষ্টাঙ্গে, মা গো রক্ষা কর।
ওরা তখনও জানে না ওদের জন্যে কত বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছে। ওদের চীৎকারে দেবী নন, দেবীর পুরোহিত রক্তবস্ত্রধারী দীননাথ বেরিয়ে এলেন। দীর্ঘ পদযাত্রায় প্রলম্বিত দাড়ি তাঁর, মাথায় জটা। স্তম্ভিত এবং প্রণত করবার মতো ভঙ্গী তাঁর। দীননাথ কুকীদের ভাষা জানেন না। হয়ত দেবমন্ত্রই উচ্চারণ করলেন তিনি। কুকীরা আন্দাজে বুঝে নিল, ওটা দৈববাণী, দেবতার ভাষা। তাহলে দেবী রুষ্ট হন নি। খুশি হয়ে স্বর্গ থেকে পাঠিয়েছেন সেবাইত। কুকীরা ছুটে গিয়ে নিয়ে এল দুধ, ফল। নিয়ে এল আহার্য। দীননাথ একই সঙ্গে তাদের পুরোহিত আর নেতা হয়ে সেই নির্জনে বাস করতে থাকলেন।
আর তাঁর পুত্র?
পুত্রও বড় হয়ে উঠতে লাগল। কুকীরা তার সঙ্গী, পিতা শিক্ষক। দীননাথের কাছে সে শেখে পুঁথিপাঠ, জানে শাস্ত্র, নানা টোটকা ওষুধ, আর কুকীদের কাছে শেখে তীর ধনুকের ব্যবহার, অরণ্যের ভাষা। দেখতে দেখতে দীননাথের পুত্রও হয়ে উঠল তাদের আর এক দুর্জয় নেতা। অরণ্যভূমিতে তাদের অখণ্ড আধিপত্য। এই সময়েই দীননাথ গত হলেন। পুত্র হলেন সবদিক থেকে তাদের অবিসংবাদী নেতা।
দীননাথ-পুত্র হয়ত কুকীদের মাঝে সেই অরণ্য-জীবনেই তাঁর দিনগুলো কাটিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু পরিস্থিতি তা হতে দিল না। এল সতের শ ছিয়াত্তর সাল। দেশ জুড়ে দূর্ভিক্ষ। দুই-তৃতীয়াংশ লোক গেল অনাহারে মরে। ইংরেজদের সেই নিঃসীম অত্যাচারে বাংলা দেশে বিদ্রোহী হল সন্ন্যাসীর দল, ইংরেজরা যার নাম দিলেন ‘সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’।
দীননাথ-পুত্র কুকী-বাহিনী নিয়ে যোগ দিলেন এই বিদ্রোহে। তখন কুকী-বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন রতন পুঁইয়া। ১৭৬২ সাল থেকে ইংরেজরা রতন পুঁইয়াকে শান্ত রাখবার জন্যে বারবার তার সঙ্গে সন্ধি করেছে, আর সুযোগ পেলেই আক্রমণ চালিয়েছে। উত্তেজিত কুকীরা ১৭৭৯ সালে চাংশীলবাজার লুঠ করল। বাজারের বণিক মহাজনেরা কাছাড়ে পালিয়ে গেল। ১৭৮৩ সালে তারা আক্রমণ করল টেপাই মুখের কুকীবাজার। ১৭৮৮ সালে ইংরেজ সেনাপতি লেফটেনান্ট স্টুয়ার্ট কুকী-অধ্যুসিত অঞ্চল জরীপ করতে এলে কুকীরা তাঁর বাহিনী এবং তাঁকে একেবারে ধ্বংস করে ফেলল। দুবছর পরে সেনাপতি ক্যাপ্টেন ব্রাউন এসেও নিহত হলেন। এবার ইংরেজরা তাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে কুকীদের মোকাবিলা করতে এলেন।
এসব অভিযানের ঠিক কোন্-কোনটিতে দীননাথ-পুত্র অংশগ্রহণ করেছিলেন তার সঠিক নথি না পাওয়া গেলেও তিনি যে ইংরেজদের কাছে বিভীষিকার বস্তু হয়ে উঠেছিলেন, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাই, বিদ্রোহীদের পরাজয়ের সঙ্গে দীননাথ-পুত্রকে ধ্বংস করা ইংরেজদের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে উঠল। আর দীননাথ-পুত্রও একের পর এক সংগ্রামে হেরে গভীর থেকে গভীরতর অরণ্যে আশ্রয় নিতে থাকলেন।
এমনি সময় এক যুদ্ধে আহত হলেন দীননাথ-পুত্র। সঙ্গীরা পালাতে পালাতেও দলনেতার দেহ কাঁধে করে নিয়ে চলল। কিছুদূর গিয়ে তারা যখন বুঝল, নেতা মৃত, তাঁর দেহ পথপ্রান্তে ফেলে গেল তারা।
নেতা কিন্তু মরেন নি। কদিন তন্দ্রায় কাটিয়ে যেদিন তিনি চোখ মেললেন, সেদিন বুঝতে পারলেন না তিনি কোথায়! কী যেন একটা মিঠে সুর কানে আসছে তাঁর, অনেকটা মায়ের ঘুম পাড়ানী গানের মতো। তেমনি যেন গায়ে মাথায় হাত বোলানো-- সব অস্বস্তি মুছে নেবার প্রয়াস।
ধীরে ধীরে একসময় চেতনা ফিরে এল তাঁর। তিনি দেখলেন একটি শান্ত স্নিগ্ধ মেয়ে তাঁর সেবা করছে। মাঝে মাঝে সুর করে পড়ছে কী একটা বই। লম্বা সাদা দাড়িওয়ালা এক ফকির মাঝে মাঝে এসে খোঁজ নিচ্ছেন।
কারা এরা? এখানে তিনি এলেনই বা কী ভাবে? সুস্থ হয়ে সবই শুনলেন দীননাথ-পুত্র। এই বৃদ্ধ এক মুসলমান ফকির। মেয়েটি তাঁরই বিধবা কন্যা নয়তন। আহত মানুষ দেখে ফকির বয়ে আনেন তাঁকে। ইংরেজরা অনেকবার খোঁজ করেছে। কিন্তু মানী লোক দেখে ফকিরের বাড়ি আর খোঁজ করে নি। কোরাণ পাঠ করে আর সেবা দিয়ে নয়তনই বাঁচিয়ে তুলেছে তাঁকে।
মেয়েটির প্রতি কৃতজ্ঞতায় অশ্রুসজল হয়ে ওঠেন দীননাথ-পুত্র। বৃদ্ধকে বলেন, আপনাদের ঋণ ভুলবার নয়। আপনারা আমার প্রাণদাতা। কিন্তু কত দিন আর বসে বসে আপনাদের অন্নধ্বংস করব? এবার আমায় বিদায় দিন।
বৃদ্ধ বলেন, কোথায় যাবে? বিদ্রোহীরা পরাজিত। চারিদিকে ইংরেজরা তোমায় হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার থেকে আমার এখানেই থেকে যাও।
দীননাথ-পুত্র ভাবলেন। তারপর বললেন, তা নাহয় থাকলাম। কিন্তু কী সুবাদে?
বৃদ্ধ বললেন, সুবাদ যদি চাও, দিতে পারি। আমার নয়তন বাল্য-বিধবা। আমি ওর বিয়ে দিতে চাই। যদি তুমি ওকে বিয়ে কর!......
দীননাথ-পুত্র বললেন, কিন্তু আপনি যে মুসলমান, আমি যে হিন্দু।
বৃদ্ধ বললেন, না, আমরা দুজনেই মানুষ।
দীননাথ-পুত্র বৃদ্ধের জবাবে বুঝি বা বেদ, কোরাণ আর সব ধর্মগ্রন্থের সার শুনতে পেলেন। মেনে নিলেন বৃদ্ধের কথা। থেকে গেলেন সেখানে। বিবাহ করলেন নয়তনকে। পাঠ করতে লাগলেন কোরাণ। তাঁর নূতন নাম সিরাজউদ্দিন, সংক্ষেপে সিরাজু। কিন্তু দীননাথ -- প্রতিষ্ঠিত কালীমূর্তিটি আনিয়ে তাকেই গৃহদেবতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি।
কোরাণ-পাঠ আর কালীপূজা দু-ই চলতে থাকল।
* * * *
কিন্তু শান্ত জীবনযাত্রা বুঝি সিরাজুর জীবনে লেখেন নি বিধাতা। তাই নয়তনের কোল জুড়ে ছেলে এলেও শান্ত গৃহস্থ হতে পারলেন না সিরাজু। জমিদার-মহাজনের অত্যাচারে জর্জরিত মানুষ যখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর আকাশের দিকে হাত তুলে দোয়া মাঙে, তখন সিরাজুর বুকের ভেতর কেমন করতে থাকে। এ অত্যাচার কি বন্ধ করা যায় না? যদি বন্ধ নাই করা যায়, তবে অন্ততঃ এর প্রতিবাদও কি জানানো যায় না? নিষ্ফল আক্রোশে গুমরে মরেন সিরাজউদ্দিন।
উপায় মেলে। একে একে সিরাজুর পাশে এসে সমবেত হয় আহত মানুষের দল। সিরাজু জানেন কেমন করে তপ্ত লোহায় আঘাত করে তরবারি তৈরি করা যায়। জানেন কোন্ গোপন শিক্ষায় এক একটা মানুষ পরিণত হয় এক-একটা ধারালো অস্ত্রে, তৈরী হয় সুশিক্ষিত এক বাহিনী। এবার প্রস্তুত সিরাজু। আসুক অত্যাচারের সংবাদ, অত্যাচারীর মুখোমুখি দাঁড়াবেন তিনি।
সংবাদ এল। সঙ্গে সঙ্গে জমিদারবাড়ি পত্র পাঠালেন সিরাজু। তুমি অমুক প্রজার এই সর্বনাশ করেছ। আজ সারাদিনের মধ্যে তার প্রতিকার যদি না কর, সূর্যাস্তের পর, সিরাজ যাবে ন্যায়ের বিধান নিয়ে। সাবধান!
দু-এক জমিদারবাড়ি উপস্থিত হতেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল জমিদার-মহাজনদের ভিতর। তাঁরা তাড়াতাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলেন ইংরেজ প্রভুদের কাছে। হুলিয়া বেরোল সিরাজু ডাকাতের নামে।
হলে কী হবে। সিরাজুর ক্ষতি করবে কে? হাজার হাজার মানুষ, যারা অত্যাচারের ভয়ে কেঁপে মরত দিন-রাত, তারা যে অভয় পেয়েছে সিরাজুর কাছে! অতএব তারাই সিরাজুর অভয় মন্ত্র, তারাই সিরাজুকে রক্ষা করে চলল। অত্যাচার কিছু কমলেও একেবারে থামল না। সংবাদ এল, ইংরেজরা যাকে বলে সিলেট, সেই শ্রীহট্ট অঞ্চলের এক জমিদার অন্নপ্রাশনের নামে প্রজাদের ওপর এক বাড়তি কর চাপিয়ে জবরদস্তি আদায় করছে। না দিলে ঘর জ্বালানো, কয়েদ, শ্যামচাঁদ সব কিছুরই প্রয়োগ চলছে। সিরাজুর সাকরেদরা সংবাদের সত্যতা যাচাই করতে ছুটল। কদিন পর ফিরে এসে তারা জানাল, সংবাদ সত্য। সিরাজু পাঠালেন পত্র। সন্ধ্যায় পত্রবাহক এসে উপস্থিত হল জমিদারবাবুর বাড়ি। তার হাঁক-ডাকে বেরিয়ে এলেন নায়েবমশাই। কিন্তু নায়েবের হাতে তো পত্র দেবার হুকুম নেই। কাজেই নায়েব আলো ধরে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন জমিদার-বাবুর কাছে। তাঁর হাতে পত্র দিতেই তিনি তা নায়েবের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, পড় তো।
পড়তে গিয়ে গা কেঁপে উঠল নায়েবের। পত্রের সারমর্ম বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর কণ্ঠ দিয়ে সপ্ত সুর নির্গত হল। অনেক কষ্টে তিনি বলতে পারলেন, আজ রাতে সিরাজউদ্দিনবাবু আসছেন।
কে সিরাজউদ্দিনবাবু? জমিদারবাবু শুধালেন।
হোহো করে হেসে উঠল পত্রবাহক। বললে, সিরাজউদ্দিনবাবুকে চেনেন না? তিনি আপনাদের পেয়ারের সিরাজু ডাকাত!
শুনেই জামদারবাবু উঠে দাঁড়াতে গেলেন। পত্রবাহক তাঁকে ধরে বসিয়ে দিয়ে বললে, ব্যস্ত হবেন না। সবে সন্ধ্যে। তিনি দুপুররাতের আগে আসবেন না। আপনি অনায়াসে পারবেন তাঁর অভ্যর্থনার ভালো আয়োজন করতে। সাবধান! আয়োজন যেন ভালো হয়।
বলেই সেলাম করে বেরিয়ে গেল পত্রবাহক।
জমিদারবাবু তাকে আর একবার দেখবার সুযোগ পেলেন না।
সেদিনই গভীর রাতে সিরাজু যখন দলবল নিয়ে এসে হাঁক ছাড়লেন জমিদারবাড়ির সদর দরজায়, তখন গোটা বাড়ি অন্ধকার, কোথাও প্রাণের সাড়া নেই। কী ব্যাপার? কেউ নেই না কি? না কি কোন ফাঁদ পাতা হয়েছে? একটু পরখ করে নিলেন সিরাজু। নাঃ ডরফুক্! একেবারে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। সবার আগে কাছারিতে প্রবেশ করলেন সিরাজু। যা দলিল দস্তাবেজ পেলেন. পুড়িয়ে দিলেন। ঘুরলেন ঘরে ঘরে। তামা, পেতল, কাঁসা, দামী কাপড় সংগ্রহ হল। বাধা এল না কোনখান থেকে। সত্যি, কেউ নেই কোথাও।
একসময় দোতলার সবচেয়ে বড় ঘরে এসে উপস্থিত হলেন সিরাজু। ও কী! বিছানায় কী যেন নড়ে! মশাল উঁচিয়ে ধরে দেখেন, একটা ছোট্ট শিশু। কাঁথাখানা টান মেরে সরিয়ে নিতে দেখা গেল, একটা মেয়ে। মাথা নোয়ালেন সিরাজু মেয়েটাকে ভালো করে দেখবার জন্য। অমনি একগাল হেসে একখানা ক্ষুদে হাত মুঠো করে বাড়িয়ে দিল সিরাজুর গাল স্পর্শ করতে। কী এক মমতায় বুকটা শিরশির করে উঠল সিরাজুর। দুহাত বাড়িয়ে মেয়েটাকে বুকে নিলেন তিনি। তারপর বিস্মিত সঙ্গীদের চোখের ওপর দিয়ে মেয়েটাকে বাড়ি নিয়ে এলেন সিরাজু।
এ কাকে নিয়ে এলে? নয়তন জিজ্ঞাসা করল।
সিরাজু হেসে বললেন, তোমার ব্যাটার বৌকে। আমি ওর সঙ্গে তোমার ব্যাটার বিয়ে দেব।
কথাটা বললেন বটে সিরাজ, কিন্তু তিনি জানেন, ডাকাতির বাড়ির মেয়ে এনে বড় করে ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া অসম্ভব। এ মেয়ের খোঁজেই একদিন পুলিশ এসে হাজির হবে, সর্বনাশ হবে তাঁর। তবে কী করবেন সিরাজু? ফেলে দেবেন মেয়েটাকে? মেরে ফেলবেন? না কি ফেরত দিয়ে আসবেন?
অবশেষে এল সেই রাত। বিছানায় উঠে বসলেন সিরাজু। পড়ে রইল বসতবাটি, পড়ে রইল সব। নয়তন, তাঁর ছেলে, কুড়োনো মেয়ে আর গৃহদেবতাকে নিয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা করলেন সিরাজু। নূতন দেশ, নূতন নাম, নূতন জীবন! পুরাতনকে মুছে ফেলবার আগ্রহে পা চালালেন সিরাজু।
এসে থামলেন ত্রিপুরা জেলার নদী-হাওরে ঘেরা এক গ্রামে, নাম শিবপুর। শিবপুরে সম্পূর্ণ ভিন্ন জীবন শুরু করলেন সিরাজু। বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হল কালীমন্দির। কালীর পূজা আর কোরাণ-পাঠ দুই নিয়ে মেতে রইলেন এককালের ডাকাতসর্দার।
জমিদারের মেয়ে আর ডাকাতের ছেলে বেড়ে উঠতে লাগল একসঙ্গে।
তিন
শিবপুর গ্রামে সিরাজউদ্দিন যে বংশের পত্তন করলেন, সেখানে দু-তিন পুরুষ অবধি তাঁদের বিদ্রোহী উদ্দামতা যেন কিছুটা স্তিমিত হয়ে রইল। ক্ষেত-খামার, জমি-জিরেত, পুজো-আর্চা-এই নিয়ে কাটল তাঁদের। গ্রামের লোক সম্মানের চেখেই দেখল পরিবারটিকে।
সিরাজুর ছেলের ছোট ছেলে জাফর হোসেন। জাফরের ছেলে সফদর হুসেন খাঁ। গাঁয়ের লোকে আদর করে ডাকে সদন খাঁ বা সাধু খাঁ। যোগ্য নাম, সাধু খাঁই বটে। কারো সাতে-পাঁচে নেই, সংসারও দেখে না। নেশা বা পেশা যাই বল, সে হল সেতার। এই সেতার যে কেমন করে তাঁর হাতে এল, কে জানে! কিন্তু ঐ সেতারের পেছনেই কাটিয়ে দিলেন সারা জীবন।
কেউ না জানলেও সদু খাঁ নিজে জানেন কেমন করে তাঁর হাতে সেতার এল। আসলে বাজনা-পাগল লোক ছিলেন তিনি। নিজে না বাজালেও শুনতে ভালো লাগত তাঁর। একবার ত্রিপুরায় গিয়ে রাজদরবারে রবাব শুনবার সৌভাগ্য ঘটে সদু মিয়ার। বাজিয়ে ছিলেন দরবারের গায়ক ওস্তাদ কাশেম আলি খাঁ, সে বাজনা যেন কানে লেগে রয়েছে। তিনি নাকি মিয়া তানসেনের মেয়ের দিকের কেমন এক আত্মীয়।
অতএব সদু মিয়া অবসর পেলেই ছুটতে থাকলেন ত্রিপুরায়। সঙ্গে যেত ক্ষেতের সবচেয়ে ভালো চাল, বাড়ির-তৈরী টাটকা ঘি, মরসুমী ফল, বড় মুরগী, তৈরী খাসি। গায়কের ভেট, উপঢৌকন এসব।
বার বার পেতে পেতে একবার কাশেম আলি বললেন, তুমি আস কোথা থেকে?
সদ মিয়া বললেন, শিবপুর থেকে।
--এত দূর থেকে তুমি এত সব আন কেন?
অকপটে বললেন সদু মিয়া, আপনার রবাব বাজানো আমার বড় ভালো লাগে। বাড়ির সেরা জিনিসটি তাই আপনাকে না দিলে তৃপ্তি পাই না।
খাঁসাহেব বুঝলেন, যথার্থ সঙ্গীত-পাগল লোক সদু খাঁ। বললেন, তোমার আগ্রহ আছে। তুমি নিজে বাজনা শেখ না কেন? যদি শেখ, আমি তোমায় শেখাব।
এ কি প্রস্তাব করছেন খাঁসাহেব! আজ এই বৃদ্ধ বয়সে, অশক্ত দেহে এ শিক্ষা কি সম্ভব? সদু খাঁ কথা না বলে শুধু জরাজীর্ণ হাতদুটি বাড়িয়ে দিলেন।
খাঁসাহেব অর্থ বুঝলেন, সস্নেহে হাসলেন। বললেন, শিক্ষার বয়স নেই। তন্ময়তা থাকলেই শিক্ষা হয়। তুমি সেতার শেখ, আমি শেখাব।
এই অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যে হাতে সেতার তুলে নিলেন সদু খাঁ। তন্ময়তা তাঁর আছে, তবু কি বয়স বাধা নয়? সদু খাঁ বাজান, বাজনা শেখেন আর ভাবেন, আহা, যদি বয়স থাকত! অনেক ভেবেচিন্তে তিনি মেজো ছেলে আফতারউদ্দিনের হাতে সেতার তুলে দিলেন। দুই ওস্তাদ তাকে শিক্ষা দিতে থাকলেন -- রামকানাই শীল শেখাতে থাকলেন তবলা আর রামধন শীল সেতার।
সদু খাঁর স্ত্রী কিন্তু মনে মনে চটে গেলেন স্বামীর এই ব্যবহারে। নিজে তো গেছেনই, আবার ছেলেগুলোকেও! সারা জীবনে সংসারের ঝক্কি সামলালেন না, পুত্রদেরও কি অমন সংসার-বিমুখ করে দেবেন? একদিন বলেই ফেললেন তিনি, খবরদার, আপনি কিন্তু আর তৃতীয় ছেলে আলমের দিকে হাত দেবেন না।
সদু খাঁর নজর আলমের দিকে না ছিল এমন নয়। ছেলেটার মাথা মোটা হলে কী হবে চাল-চলন ভাব ভঙ্গী ভালো। মায়ের কোলে শুয়ে দুধ খেতে খেতে বাজনা শুনে কেমন মাথা দোলায়! ব্যাটা বাজনার কান নিয়ে জন্মেছে। কিন্তু স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে সে ভাবনায় বিরত হলেন সদু খাঁ।
স্ত্রী ভুরু কুঁচকে বললেন, কী ভাবছেন? একেও নেবেন নাকি?
সদু খাঁ তাড়াতাড়ি বললেন, না না, তুমি আফতারকে দিয়েছ, তা-ই তো যথেষ্ট। আলম তোমারই থাক।
স্ত্রী বললেন, হ্যাঁ, আলমকে আমি লেখাপড়া শেখাব। বড় করব। ও হবে মস্ত পণ্ডিত, মস্ত কারবারী, মস্ত মহাজন।
সদু খাঁ হাসলেন। বললেন, বেশ তা তা-ই হবে। ছেলে বড় হলেই তো মা-বাবার গৌরব!
সেই গৌরব বাড়াতেই বয়স উপযুক্ত না হতেই আলমকে পাঠশালায় ভর্তি করে দেওয়া হল।
এই আলমই আলাউদ্দিন খাঁ। ১৮৬২ সালের কাছাকাছি কোন সময়ে তাঁর জন্ম হয় বলে অনুমান করা হয়।
পাঠশালা মোটেই ভালো লাগে না আলমের। বর্ণ পরিচয় হয়েছে তার। বাংলা বই মোটামুটি পড়তে পারে। হাতের লেখা সুশ্রী না হলেও লিখতেও শিখেছে আলম। তবু তার পড়াশুনা ভালো লাগে না। সে যে মাঠে মাঠে খেলে বেড়াতে চায়, তা নয়, সে যে খুব খেলে বেড়াতে ভালোবাসে, তাও নয়, বন্ধু-বান্ধব, দুষ্টুমি, বালক-সুলভ চপলতাও তার নেই, সে চায় দাদার মতো বাজনা শিখতে।
কিন্তু মায়ের কড়া শাসন। বাজনাটায় একদিন হাত দিয়েছে কি অমনি পিঠে পড়ল চ্যালাকাঠের বাড়ি। পড়তে পড়তে একটু থেমে দাদার বাজনা শুনতে কান পাতলেই ধমক। মায়ের কথার ওপরে এ সংসারে কথা বলবার অধিকার নেই কারো। তিনিই তো সংসারের হালটা ধরে রেখেছেন। তাঁর হিসেবী চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতেই জুটছে মুখের অন্ন, দেহের বস্ত্র আর মাথার উপরে আশ্রয়। অতএব তাঁর শাসনে আলম নামে ক্ষুদে ছেলেটার বুকের ভিতরে কিসের ছায়া জমছে তা জানবে কে?
এক জানতে পারেন দিদি-- মধুমালতীদিদি। পাশের গাঁয়ে বিয়ে হয়েছে তাঁর। স্বচ্ছল পরিবার। আহ্লাদী বৌ। অতএব খুশিমতো আসেন বাপের বাড়ি। এই মাথামোটা বোকা-বোকা ভাইটার প্রতি তাঁর অসীম দরদ। কিন্তু তিনিও বলেন, ভালো করে লেখাপড়া কর্ আলম। দাদার মতো সেতারে হাত দিস না। পাঠশালার পড়া শেষ করে নে, তোকে বড় ইস্কুলে ভর্তি করে দেব। শহরে থাকবি।
এ-ই যাঁর মুখের কথা, কে তাঁকে জানাবে মনের ইচ্ছে! অন্ততঃ আলমের সাহস হয় না। বুকের কথা বুকেই চেপে রেখে আলম বই-পত্তর বগলে যায় পাঠশালায়। গুরুমশাইয়ের বেতের সামনে তার অন্তরাত্মা আরো শুকিয়ে ওঠে মাত্র। পড়াশুনা তেমন এগোয় না।
একাঁদন পাঠশালায় যাবার পথে থমকে দাঁড়াল আলম। কী সুন্দর প্রাণকাড়া সুর ভেসে আসছে না! কোথা থেকে? সুরের সন্ধানে ছুটল আলম। সুরের উৎসে এসে থমকে গেল। তার এত পরিচিত, এত সহজ জায়গায় রয়েছে তার স্বর্গ আর সে কি না নরকে মুখ গুঁজে পড়ে আছে!
এর পর থেকে বাড়ি থেকে পাঠশালার নামে বেরিয়ে নিত্য তার স্বর্গে এসে উপস্থিত হতে শুরু করল আলম। তাদেরই গাঁয়ের শিবমন্দির। এই শিব থেকেই তো গ্রামের নাম শিবপুর। ভক্তের চাইতেও সাধু-সন্ন্যাসীর ভিড় বেশি সেখানে! তাঁদের সিদ্ধি ঘোঁটা, ধুনি জ্বালানো, ধ্যান, শাস্ত্র-আলোচনা আর সেইসঙ্গে চলে নানারকম গান আর গান। আলম একটা মূহূর্তও নষ্ট করতে চায় না। কিন্তু বিকেল হলেই অন্য পড়ুয়াদের সঙ্গে বাড়ি ফিরতে হয়। নইলে মায়ের শাসনে যে এটুকুও হারাবে!
কিন্তু আলম খেয়াল করে নি যে, সদু মিয়ার ছেলে দিনের পর দিন পাঠশালা কামাই করতে থাকলে গুরুমশাই খোঁজ করবেনই। আর হলও তা-ই। সেদিন সবেমাত্র আলম বই-পত্তর নিয়ে বেরিয়েছে, পাঠশালায় যাওয়ার পথে গুরুমশাই এলেন তাদের বাড়ি। তার মাকে ডাকলেন। গুরুমশাই জানেন, ছেলের পড়া নিয়ে সদু মিয়াকে বলে লাভ নেই। অতএব সোজা আলমের মাকে বললেন, হ্যাঁগো আলমের মা, তুমি কি এ ছেলেটারও পড়াশুনা বন্ধ করে দিলে?
-- কেন? কেন? ভ্রু কুঁচকে সন্দেহবিদ্ধ প্রশ্ন তুললেন আলমের মা, সে তো রোজই পাঠশালায় যায়। আজও গেছে। পড়াশুনা বন্ধের কথা উঠছে কেন?
অভিজ্ঞ গুরুমশাই হাসলেন। বললেন, এ রোগেই তো ঘোড়া মরে আলমের মা! গাঁয়ের অধিকাংশ বাপ-মা ছেলে পাঠিয়েই খালাস, ছেলে সত্যি সত্যি পাঠশালায় যায় কিনা খোঁজও রাখে না। সেইজন্যেই তো আমাকে আবার বাড়ি-বাড়ি আসতে হয়।
মা বললেন, তবে কি আলম পাঠশালায় যায় না?
-- তবে আর বলছিটা কী তোমায়? খোঁজ নাও। দেখ, ছেলে কোন বদসঙ্গে মিশেছে।
দায় সেরে চলে গেলেন গুরুমশাই। আলমের মায়ের মেজাজ ততক্ষণে সপ্তমে চড়ে গেছে। সংসারতরীকে কি তিনি কিছুতেই নিজের ইচ্ছেমতো চালনা করতে পারবেন না? তার পালে কি উলটো হাওয়া লাগবেই? তাঁর যত আক্রোশ গিয়ে পড়ল সদু খাঁর ওপর। মানুষটা যদি একটু সংসারী হত! তিনি গর্জে উঠলেন -- বড় মিয়া। একবার শুনুন তো?
অপরাধীর মতো এসে দাঁড়লেন সদু মিয়া, কী বলছ বড় বৌ?
--আপনি কি কোন খোঁজই রাখবেন না? আমাকে কি পাঠশালাতে গিয়েও খোঁজ নিতে হবে ছেলের পড়াশুনার?
তড়বড়িয়ে উঠলেন সদু খাঁ, সে কী কথা! তোমাকে যেতে হবে কেন? আমি এখুনি যাচ্ছি।
বলেই পাঠশালার দিকে যাত্রার উদ্যোগ করলেন সদু মিয়াঁ।
দাঁড়ান! ডাকলেন আলমের মা, পাঠশালায় গিয়ে লাভ নেই। ছেলে পাঠশালার নাম করে বের হয়, কিন্তু যায় না পাঠশালায়। গাঁয়ে খুঁজে দেখুন সে শয়তান কোন আড্ডায় মিশেছে। যেখানে পান, তার কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনুন। আজ তারই একদিন কি আমারই একদিন!
ছুটলেন সদু মিয়া। কোথায় থাকতে পারে ছেলে? তিনিই কি ছাই জানেন ছেলের মনের সন্ধান! কে তার বন্ধু কোথায় তার খেলার জায়গা? খানিক এলোমেলো দৌড়-ঝাঁপ করলেন সদু মিয়া, তারপর দূর ছাই, বলে সময় কাটাবার জন্যে চললেন শিবমন্দিরে। দেবতার স্থান, মহাত্মাদের আগমন ঘটে ওখানে। দুদণ্ড বসলেও মনটা শান্ত হয়, এইসব তুচ্ছতা থেকে অনেক উঁচুতে তোলা যায় মনটাকে। আর মনকে পার্থিব তুচ্ছতা থেকে না তুলতে পারলে রাগ-রাগিণীরা কি ধরা দিতে চান? সঙ্গীত-সাধনা কি সহজ কথা!
শিবমন্দিরের কাছাকাছি আসতেই মনটা খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠল সদু খাঁর। খাসা ভরাট গলায় গান ভেসে আসছে, সেইসঙ্গে বাজছে দেশী তারের বাজনা আর তবলা। তবলার হাতটাও বেশ ভালো লোকটার। একটু দ্রুত পা চালালেন সদু মিয়া।
ভিতরে ঢুকে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন সদু মিয়া। এক সন্ন্যাসীর পাশে বসে বড় বড় মাথা দুলিয়ে তবলা বাজাচ্ছে তাঁরই ছেলে আলম। কান খাড়া করে শুনলেন সদু খাঁ। না, তাল ঠিক, মিঠে বোল উঠছে। পাকা হাত। কিন্তু শিখল কবে? কে শেখাল? ওস্তাদের কাছে শিখেও আফতারের হাত তো এত শুদ্ধ, এত মিঠে হয় নি! তবে কি ছেলে তাঁর শ্রুতিধর? বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল তাঁর! এ কে এসে জন্মেছে তাঁর ঘরে? গর্বে ভরে উঠল মন। একবুক আনন্দ নিয়ে ছুটলেন তিনি বাড়ির দিকে।
বাড়িতে পৌঁছোবার আগে থাকতেই সদু মিয়া চীৎকার করে ডাকলেন, বড় বৌ! বড় বৌ! ছুটে এলেন আলমের মা। অন্য প্রতিবেশীরাও কৌতুহলী হয়ে কান পাতলেন। খুশিতে বিগলিত সদু খাঁ বললেন, আলমের কাণ্ড তুমি শুনলে আশ্চর্য হবে বড় বৌ। এক ক্ষণজন্মা ছেলে এসেছে তোমার কোলে। ওকে অনাদর কোরো না।
এসব কথা শুনে হয়ত খুশি হলেন আলমের মা, কিন্তু সদু খাঁ যখন সবিস্তারে আলমের প্রকৃত কৃতিত্বের ব্যাখ্যা করলেন, তখন গুম হয়ে গেলেন তিনি। মুখে কোন কথা বললেন না। তাঁর মুখের একটি পেশিও নড়ল না। কিন্তু মনে মনে তিনি এক দুর্জয় প্রতিজ্ঞা করে দিনের কাজে হাত লাগালেন। সদু খাঁ ভাবলেন, স্ত্রী বুঝি বা খুশিই হয়েছে।
বিকালে ভালোমানুষের মতোই বাড়ি ফিরল আলম।
উঠোনে পা দিতেই তার হাত চেপে ধরলেন মা, কোথায় গিয়েছিলি?
মায়ের চোখের দিকে তাকিয়েই আলম বুঝল, সে যে পাঠশালায় যায় নি, একথা প্রকাশ হয়ে গেছে। আর মিথ্যে বলতে সাহস হল না তার। সে মায়ের চোখ থেকে চোখ নামিয়ে বলল, শিবতলায়।
-- কেন?
-- গান শুনতে।
-- গান শুনতে? ছুটে গেলেন মা। তারপর উঠোনের এককোণে স্তুপীকৃত চ্যালা কাঠের পাহাড় থেকে একটা তুলে নিয়ে বেদম মারতে থাকলেন আলমকে, দেখি তোর মগজ থেকে গানের ভূত তাড়ানো যায় কিনা!
মারতে মারতে মা-ই ক্লান্ত হয়ে পড়লেন একসময়। আলমের মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের হল না। ছেলেটার নির্যাতন দেখতে দেখতে সদু খাঁর বুক ফেটে যেতে লাগল। ওর পিঠে পড়া প্রতিটি আঘাত যেন সদু খাঁর নিজের পিঠে পড়ছে। চোখ বুজলেন তিনি।
এদিকে আলমের মা তাকে টানতে টানতে গোয়ালঘরে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন। বললেন, থাক্ ওখানে, তোর খাওয়াও বন্ধ। দেখি না খেয়ে তোর গানের ভূত কত দিন থাকে?
দরজা বন্ধ করে দিলেন আলমের মা।
চোখ খুললেন সদু খাঁ। দেখলেন, ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ভাইয়ের নির্যাতন দেখে মুখখানা করুণ করে দাঁড়িয়ে আছে আফতার। ফুঁপিয়ে কাঁদছে আলমের ছোট দু-ভাই নায়েব আর আয়েত। সারাদিন খায়নি ছেলেটা। মার তো হলই, খাওয়াও বন্ধ! নিজের অক্ষমতার জ্বালায় নিজেকেই ছোবলাতে ইচ্ছে হচ্ছে সদু খাঁর। কিন্তু ছেলেটার কী হবে?
ঠিক সময়ে তাঁর মনে পড়ল মধুমালতীর কথা। ধীর পায়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়লেন তিনি। একমাত্র মধুমালতীই পারে ছেলেটাকে রক্ষা করতে।
* * * *
যেন নেহাৎই বেড়াতে এসেছেন এমনভাবে বাড়ি ঢুকলেন মধুমালতী। কুশল সংবাদ জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে মাকে বললেন, কী হয়েছে মা? তোমার মুখ এমন গম্ভীর কেন?
সহানুভূতির ছোঁয়াচ পেয়ে দুর্জয়প্রতাপ আলমের মা হু-হু করে কেঁদে উঠলেন। তাঁর মনের সব আশঙ্কার কথা জানিয়ে বললেন, মধুমালতী রে, আমার সংসারটা কি একেবারেই ভেসে যাবে!
সব শুনে গম্ভীর মুখেই উঠে গিয়ে ভাইকে বের করে আনলেন মধুমালতী। খাওয়ালেন। তারপর বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে রেখে বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরলেন।
চিন্তা কোরো না মা। আল্লার ওপর বিশ্বাস রেখো। তুমি তো কোন অন্যায় কর নি, আল্লা তোমার ভালো করবেনই। শুধু মনে রেখো, কোথায় কীভাবে মঙ্গল আসে তা কেউ বলতে পারে না।
সদু মিয়া সবিস্ময়ে তাকালেন মেয়ের দিকে। ঠিক কথা বলেছে মধু-মা। কিন্তু এত বড় কথাটা ওর মাথায় এল কী করে?
পরদিন ঘুম থেকেই উঠেই চমকে উঠলেন আলমের মা। আলমের বিছানা খালি। তবে কি বাইরে গেছে? যায় না তো কোন দিন! অপেক্ষা করলেন। ফেরার সময় অতিক্রান্ত হতে ব্যস্ত হলেন। ডাকলেন সকলকে। খোঁজাখুজি শুরু হল, গ্রামের পরিচিত গণ্ডি ছাড়িয়ে আশপাশের গ্রাম, মধুমালতীর বাড়ি, নাঃ, কোথাও নেই!
কেঁদে ফেললেন আলমের মা। ভয়কাতুরে হাবাগোবা মাথামোটা ছেলেটা কি রাতারাতি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল! তোমরা কেউ কি দিতে পারবে না তার সন্ধান? ঈশ্বর কি শেষে আমার এই মঙ্গল করলেন!
পরবর্তী পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
Subscribe to:
Comments (Atom)