বাজাও আমারে বাজাও (শেষাংশ)

লেখক: নীরদ হাজরা

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

তৃতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

দশ

নবাবের ইচ্ছায় পরদিনই নাড়া-বাঁধা উৎসব অনুষ্ঠিত হল। সে উৎসবে উপস্থিত থাকলেন যতেক দরবার-শিল্পীরা। বিতরণ করা হল প্রচুর মিঠাই। মুখে সকলেই হাসি আর উল্লাস প্রকাশ করলেও এক পুঁচকে ছোকরার এই আধিপত্যে ঈর্ষানল জ্বলল প্রায় সকলের বুকেই। স্বভাবত দরবার-শিল্পীদের মধ্যে আলমের বন্ধুত্বের সুযোগ কমে গেল।

অবশ্য বন্ধুত্ব করবার অবসরই বা কোথায় আলমের! ভোরবেলা কোনক্রমে দুটি মুখে দিয়ে সে দ্রুত ছোটে গুরুর বাড়িতে। গুরুর পায়খানা পরিষ্কার করে, জল ভরে রেখে তার গুরু-সেবা শুরু হয়। তারপর গুরুর আদেশের জন্যে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। কিন্তু দুর্ভাগ্য,দিনের পর দিন যায়, গুরুর খিদমতগারি ছাড়া আর কিছুই হয় না আলমের দ্বারা! গুরু বোধহয় আলমকে শিক্ষা দেওয়ার কথা ভুলেই গেছেন।

এমান করে কেটে গেল দু বছর তিন মাস।

অবশ্য এই সাতাশ মাসের মধ্যে আরো কতকগুলি ঘটনা ঘটেছে আলমের জীবনে। প্রথমত, ওয়াজির খাঁর শিষ্যত্ব লাভের পরেই ঠিকানা জানিয়ে আলম চিঠি দেয় বাবাকে, তার দীক্ষার কথাও জানায়। দ্বিতীয় ঘটনা -ব্যাণ্ডমাস্টার হুসেন খাঁর বন্ধুত্ব লাভ। হুসেন খাঁ আলমের কাছ থেকে যেমন গ্রহণ করেন, শেখানও তেমনি।

অনেক ধ্রুপদ আর হোরি এসে জমে আলমের ভান্ডারে। কিন্তু ওয়াজির খাঁর কাছে শিক্ষা?

বিচিত্রভাবেই ঘটনাটা ঘটল আলমের জীবনে। এজন্য নিজের স্ত্রীর প্রতি আলমের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ওর টাকাতেই আলম প্রথম যন্ত্র কিনতে পেরেছিল। ওর জন্যই অবশেষে ওয়াজির খাঁর করুণা লাভ করেহিল আলম। ও যত দূরেই থাকুক, আলমের চারদিকে মঙ্গলের আবরণ দিয়ে রক্ষা করেছে চিরকাল। স্ত্রীর এত প্রীতির প্রতিদান কী দেবে কাঙাল আলম। অবশেষে নিজের জীবন-সাধনার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান, তার আবিচ্কৃত নূতন রাগের নাম দিয়েছিল ‘মদনমঞ্জরী’; এ নামেই অক্ষয় হয়ে থাকবে স্ত্রীর প্রতি আলমের কৃতজ্ঞতা।

সেদিন দ্বিপ্রহরে গুরুর দরজা থেকে বাড়ি ফিরছে আলম। এমন সময় গুরুর মেজোছেলে নজির খাঁ এসে ডাকলেন তাকে, বাবুজি, শীঘ্র আসুন। পিতাজি আপনাকে ডাকছেন।

ছুটল আলম।

গুরুজি গম্ভীর। আলম বুঝল, অজ্ঞাতে কোন অপরাধ ঘটে গেছে। আলম মাথা নীচু করে বলল, গোস্তকি মাপ কিজিয়ে। কৈ গাফিলতি হো গিয়া!

গুরু মাথা ঝাঁকালেন। মরমে মরে গেল আলম। মাথা ঝুঁকে পড়ল ওর। গুরু বললেন, তুমি বিয়ে করেছ?

আলম বলল, জি, হাঁ। বাবা কথা দিয়েছিলেন আমার স্ত্রীর বাবাকে। পিতৃ-সত্য পালন করেছি।

--বুরবাক! কিন্তু মেয়েটির প্রতি কী ব্যবহার করেছ?

আলম আবার মাথা নীচু করল। .

গুরু বললেন, এই দেখ, তোমার বাবা তার করেছেন, তোমার স্ত্রী আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। ছিঃ! যার দিল এত কঠোর, সে শিখবে সঙ্গীত?

স্তব্ধ হয়ে রইল আলম।

গুরু বললেন, আজই বাড়ি ফিরে যাও।

হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল আলম।কি নিয়ে আমি বাড়ি ফিরব? আমি যে বড় গর্ব করে জানয়েছি, ওয়াজির খাঁ আমার হাতে শিষ্যের নাড়া বেঁধেছেন! অথচ আমি যে কিছুই শিখি নি!

গুরু ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, কিছুই শেখ নি? মানে? এই তিন বছর --

-- আপনি তো আমাকে শেখান নি!

-- আমি না শেখাই, আমার ছেলেরা? পর্যায়ক্রমে ছেলেদের দিকে তাকালেন ওয়াজির খাঁ।

ছেলেরা বলল, আমাদের তো সে আদেশ দেন নি।

স্তব্ধ হয়ে গেলেন ওয়াজির খাঁ। ইস্‌, কিছুই পায় নি ছেলেটা, অথচ গোলামের গোলামের মতো সেবা করে গেছে! ছিঃ ছিঃ, কী ভুল করেছেন তিনি! ছেলেদেরও শিক্ষা দেওয়ার কথা বলতে ভুলে গেছেন। ওয়াজির খাঁ ছেলেদের বললেন, আজ থেকে আলম তোমাদের ভাই হল। ওকে শেখাবার দায়িত্ব তোমাদের। আমিও শেখাব।

পরদিন থেকে শুরু হল আলমের শিক্ষা। আলম বুঝি পারলে চব্বিশ ঘণ্টাই পড়ে থাকে তরা সাধনা নিয়ে, কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। এদিকে অত্যচারে-অত্যাচারে শরীরও ভেঙে পড়েছে। তবু ক্লান্তি নেই আলমের।

গুরু ওয়াজির খাঁ বলেন, মাংস খা আলম। স্বাস্থ্য ভালো হবে, বুকে বল হবে, বেশি দম পাবি।

আলম হাসে। যে গোস্ত সে জীবনে খায় নি, তা আর খাবে না।

একদিন দরবারেও এই গোস্ত খাওয়া নিয়ে কথা উঠল। কথা চলতে চলতে ‘মছলিখোর’ আলমকে নিয়ে, কথা উঠল, কথা উঠল বাঙালীকে নিয়ে। মুহূর্তে চটে গেল আলম। তাকে নিয়ে বিদ্রুপ সইতে পারে আলম, কিন্তু তার জাতকে নিয়ে নয়। বাঙালী আলম সগর্বে বলে উঠল, গোস্ত খেয়ে তোরা যা ডান হাতে পারিস, মছলি খেয়ে বাঙালি তা বাঁ হাতে পারে। দেখবি?

বলে হাত বদলে বাঁ হাতে সরোদ ধরল আলম। বলল, আজ থেকে আমি আর তারবাদ্য ডান হাতে বাজাব না, বাজাব বাঁ হাতে।

আজীবন তাই বাজিয়ে গেছে আলম। এতখানি স্বজাতির প্রতি মর্যাদাবোধ আমাদের অনেক মহান নেতার মধ্যেও বিরল।

এমনিভাবে কেটে গেল আলমের শিক্ষার চার বছর। এক শরতের সকালে ওয়াজির খাঁ বললেন, এবার তোমার শিক্ষা সমাপ্ত। তুমি এবার দেশ-ভ্রমণে বেরিয়ে পড়। পরীক্ষা দাও। লোকের চিত্ত জয় কর। বিশ্বে নিজের স্থান খুঁজে নাও।

গুরর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে, নবাবের শুভেচ্ছা নিয়ে আলম ফিরে চলল কলকাতায়। শুরু হল তার বিশ্ব-পরিক্রমা। এই প্রসঙ্গেই সে উঠল পুঁটিয়ারাণীর বাড়িতে। সেখানেই পরিচয় ঘটল শ্যমলাল ক্ষেত্রীর সঙ্গে। তিনিই ভবানীপুর সঙ্গীত সম্মেলনে বাজাবার ব্যবস্থা করে দিলেন আলমের। সেখান থেকেই নাম ছড়িয়ে পড়ল আলমের।

* * * *

সঙ্গীত-সম্মেলনের শেষে শ্যমলাল ক্ষেত্রী আবার দেখা করলেন আলমের সঙ্গে। অবশ্য তখন কেউ আর তাঁকে আলম বলে না। বলে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ।

শ্যামলাল বললেন, ওস্তাদ, আপনি এখন কোথায় যাবেন?

আলাউদ্দিন গুরুর আদেশের কথা শুনিয়ে দিলেন শ্যামলাল ক্ষেত্রীকে।

শ্যামলাল বললেন, আমার কথা শুনুন ওস্তাদজি। আমার বন্ধু ব্রজনাথ সিংজি হচ্ছেন মাইহারের রাজা। রাজাজি একজন উপযু্ক্ত ওস্তাদ খুঁজছেন। আপনি তাঁর কছে যান। যে কোন কাজে এগুতে গেলে একজন যোগ্য পৃষ্ঠপোষক চাই তো!

আলাউদ্দিন খাঁ মানলেন ক্ষেত্রীমশাইয়ের যুক্তি। কিন্তু মাইহার যাবার অর্থ কোথায়? আজ তো আর তিনি অবুঝ নন যে, বিনা টিকিটে স্টীমারে বা রেলে চেপে বসবেন!

কিন্তু এই দারিদ্রের কথা বলাই বা যায় কী করে?

আলাউদ্দিনের নীরবতা এবং মুখের চেহারা দেখে শ্যামলাল নিজেই বুঝলেন অবস্থাটা। বললেন, দ্বিধা করবেন না, ওস্তাদজি। উঠুন, আজই রওনা হোন। আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

সব ব্যবস্থাই শ্যামলাল করে দিলেন-ট্যাক্সি করে স্টেশনে নেওয়া, টিকিট কাটা, গাড়িতে খাওয়ার ব্যবস্থা।

সম্ভবত মাইহারে রাজার কাছে তারও করেছিলেন শ্যামলাল। তাই স্টেশনে রাজার পাঠানো গাড়ি উপস্থিত ছিল। বিকেলের দিকে মাইহার রাজপ্রাসাদে রাজার কাছে উপস্থিত হলেন আলাউদ্দিন।

তরুণ বয়সী রাজা। মন্দ লাগল না যুবককে। আলাউদ্দিন খাঁ কে সাদরে বসিয়ে গান শুরু করতে বললেন দেওয়ানজি।

পরীক্ষা! খুব সতর্ক হয়ে সময় ও শাস্ত্রের নির্দেশ মিলিয়ে নিজের প্রিয়তম রাগে গান ধরলেন আলাউদ্দিন খাঁ। দিন আর রাত এসেছে সন্ধ্যার প্রান্তে। এই সন্ধিক্ষণের প্রকাশই তো শ্রী রাগে, আর শ্রীরাগ আলাউদ্দিন খাঁ-র হাতে খেলে ভাল৷

কিন্তু ক মিনিট যেতে না যেতেই রাজা উসখুস করতে থাকলেন। মনে মনে বিরক্ত হলেন আলাউদ্দিন। এই সময়ে এমন রাগের বিশুদ্ধ প্রকাশেও যে তন্ময় হতে পারে না সে তো বেরসিক! হা আল্লা! ওয়াজির খাঁর শিষ্য হয়ে তাঁকে এমন এক বেকুফের কাছে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে! নিজের ভাগ্যকে মনে মনে ধিক্কার দিতে থাকলেন তিনি। এমন সময় বেকুফ রাজা চরম বেকুফি করলেন, থামতে বললেন আলাউদ্দিন খাঁকে। --এখন বিশ্রাম করুন, বলে রাজা চলে গেলেন।

অপ্রসন্ন মনে তাঁর জন্যে নির্দিষ্ট ঘরে চলে গেলেন আলাউদ্দিন। বুঝলেন, মাইহারে তাঁর অধিষ্ঠান হচ্ছে না, চলে যেতে হবে এখন থেকে। কিন্তু কোথায় যাবেন? যতক্ষণ রাজা বিদায় না দিচ্ছেন, ততক্ষণ যাওয়া হচ্ছে না। সেটা বেয়াদবি। তা করতে চান না আলাউদ্দিন খাঁ। কিন্তু এমন বেরসিকের রাজ্যে আর থাকতেও ইচ্ছে করছে না। এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকলেন তিনি।

ঘণ্টা কয়েক পর আবার তলব হল আলাউদ্দিনের। মন অপ্রসন্ন হলেও মুখে হাসি টেনে দরবারী ভঙ্গীতে তিনি দেওয়ানের পিছনে পিছনে যে ঘরে এলেন, সেটা একটা মস্ত হলঘর। একদিকে রেওয়াজের স্থান, তার চারদিকে থরে থরে সাজানো রয়েছে নানা জাতের যন্ত্র।

দেওয়ানজনী তাঁকে রেওয়াজের আসনে বসতে বললেন। আলাউদ্দিন খাঁ বসতে তাঁর হতে এগিয়ে দেওয়া হল প্রথম যন্ত্র-একটি ক্ল্যারিওনেট।

কী বাজাবেন আলাউদ্দিন? শ্রীরগে যাঁর বিরাগ, তাঁকে কী সুর শোনাবেন? মিনার্ভা থিয়েটারের হালকা চটুল গানের সুর তুললেন আলাউদ্দিন খাঁ।

খানিক বাজাতেই থামবার ইঙ্গিত হল। ক্রুদ্ধ মনে থামলেন তিনি।

আবার আর একটি যন্ত্র তুলে দেওয়া হল তাঁর হাতে। বাজানো শুরু হতে না হতে থামতে হল। একে একে প্রত্যেকটি যন্ত্র বাজাতে হল তাঁকে। বাজালেন হালকা থেকে গভীর, করুণ থেকে আনন্দঘন নানান সুর। কিন্তু কোন কিছুতেই খুশি হলেন না রাজা। দু মিনিট না বাজাতেই থামতে হল তাঁকে। ঘণ্টাদুয়েকে ঘরের সব বাদ্য বাজিয়েও বেরসিককে বাগে আনতে পারলেন না তিনি।

দেওয়ানজি এবার কণ্ঠ-সঙ্গীত শুরু করতে বললেন। কণ্ঠ-সঙ্গীত মিনিট কয় চলতে না চলতে রাজাজি অধৈর্যের মতো উঠে দাঁড়ালেন। গান থামিয়ে আলাউদ্দিন খাঁকেও উঠে দাঁড়াতে হল। রাজা ছুটে এলেন।

গালে চড় মারবেন না কি? না, আলাউদ্দিন খাঁ কে বিস্মিত করে রাজা তাঁর হাত জড়িয়ে ধরলেন।

বললেন, ওস্তাদজি, আপনি আমায় বিস্মিত করেছেন। আমার প্রতিজ্ঞা ছিল, আমার সংগ্রহের সব বাদ্য বাজাতে পারবেন যে ওস্তাদ, তাঁকে আমার সভাগায়কের পদে বরণ করব। আপনার আগে আর কেউ সব যন্ত্র বাজানো তো দূরের কথা, ধরতেও পারেন নি। এবার অনুগ্রহ করে আপনি মাইহার রাজ্যসভা অলঙ্কৃত করতে সম্মতি দিন।

ওঃ। বার বার থামতে বলা তাহলে বেরসিকপনা নয়, পরীক্ষায় পাসের ইঙ্গিত। আর এতক্ষণ কত ভেবে মরছিলেন তিনি। আলাউদ্দিন খাঁ অদ্ভুতভাবে হাসলেন। বললেন, আপনি যদি খুশি হয়ে থাকেন, তবে আমি সভা-গায়ক হতে সম্মত।

রাজাজি দেওয়ানের দিকে ফিরে বললেন, ওস্তাদজির থাকা খাওয়ার উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দিন। আর কাল দশহরা, পূণ্যদিন। যথাযোগ্য আয়োজন করুন, কালই ওস্তাদজির অভিষেক হবে।

ছোট রাজ্য হলেও যথেষ্ট জাঁক-জমকের সঙ্গে অভিষেক হল আলাউদ্দিন খাঁর। বিখ্যাত চন্দন চৌবে মহারাজের শিষ্য ঘোররে মহারাজ তখন রাজ-অতিথি হয়ে মাইহারে আছেন। ফৌজি কোট ছাড়িয়ে মহারাজের পাঠানো দরবারী পোশাক তিনিই পরিয়ে দিলেন আলাউদ্দিন খাঁর অঙ্গে, তাঁর মাথায় সুন্দর করে বেঁধে দিলেন জরির পাগড়ি। দরবারে উপস্থিত হয়ে এক বিচিত্র মানসিকতায় ভরে গেল আলাউদ্দিনের মন। আজীবন দারিদ্রে দিনপাতের বেদনা যেন দূর হয়ে গেল সম্মান ও সমারোহের প্রাচুর্যে। তবু যেন ভিতরে ভিতরে কী এক অব্যক্ত বেদনায় তাঁর মন কেঁদে চলল।

কিন্তু দরবারে তখন ভিন্ন পরিবেশ। সার দিয়ে খোলা তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় পঞ্চাশ জন সর্দার। অভ্যাগত জনে ভরপুর সকল আসন। স্বয়ং রাজা তাঁকে ফুল-চন্দন দিয়ে আপ্যায়ণ করলেন, দিলেন একথালা মোহর। তারপর হাত ধরে তাঁকে বসিয়ে দিলেন একটা শূন্য সিংহাসনে। চারদিক থেকে শঙ্খ বেজে উঠল। সকলে জয়ধ্বনি দিল তাঁর, রাজার, মাইহারের।

শঙ্খ আর জয়ধ্বনি থামতে রাজাজি বললেন, আজ এই পূণ্যদিনে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে আমি শুধু সভাগায়কের পদেই বরণ করলাম না, আমার সঙ্গীতগুরুর পদেও বরণ করলাম। মহামন্ত্রীর পরেই হল তাঁর স্থান। গুরুজিকে আপনারা সর্বতোভাবে সম্মান দান করবেন।

সমস্ত দরবার আবার ধ্বনি দিয়ে উঠল -- রাজার গুরু আমাদের গুরু। আমরা গুরুর সম্মান দিতে জানি, মহারাজ।

আলাউদ্দিন খাঁ আসন থেকে নেমে এসে বললেন, মহারাজা! আমি নিজে যে এখনও ছাত্র! আমার গুরু ওয়াজির খান আমাকে দেশ-ভ্রমণের আদেশ দিয়েছেন, শিষ্য করবার আদেশ তো দেন নি!

রাজাজি বললেন, বেশ তো, তিনি যদি আদেশ না দেন, তবে শিষ্য করবেন না। কিন্তু যদি আদেশ দেন, তবে করবেন তো? আমি চেয়ে পাঠালে ওয়াজির খাঁ নিশ্চয় সে আদেশ দেবেন।

তবে সে আদেশ চেয়ে পাঠান মহারাজ।

সঙ্গে সঙ্গে রাজার দূত ছুটল ওয়াজির খাঁর কাছে রামপুরে। সব শুনে উল্লসিত হলেন ওয়াজির খাঁ, আলাউদ্দিনের বিনয়ে আরো খুশি। যোগ্য শিষ্য। গুরুর সম্মান যে এমন করে রাখতে জানে, তাকে অদেয় কী থাকতে পারে? শিষ্য গ্রহণের আদেশই শুধু নয়, শিষ্যের হাতে বাঁধবার নাড়াটিও নিজে হাতে তৈরি করে পাঠালেন ওয়াজির খাঁ।

আর একটি উৎসব করে রাজা আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্য হলেন। এই দিনই রাজা শুধোলেন, গুরু হলে তাঁর দক্ষিণা স্থির করতে হয়। আপনার--

কথা সমাপ্ত করতে দিলেন না আলাউদ্দিন খাঁ, জিভ কাটলেন, কান মললেন। বললেন, গান শিখিয়ে আমি পয়সা নেব না। একটা পানও নেব না। যার মধ্যে সত্যিকারের দরদ দেখব, তাকে এমনি শেখাব।

আলাউদ্দিনের মহত্বে আর একবার চমকে গেলেন রাজা। কিন্তু মনে তাঁর অন্য চিন্তা! তবে গুরুজির চলবে কীভাবে? রাজা বললেন, বেশ। আজ থেকে আপনাকে আমি আমার সব দেবোত্তর সম্পত্তির ম্যানেজারও করে দিলাম। রাজ্যের নিয়ম অনুযায়ী আপনি মাসিক প্রণামী পাবেন দেড়শ টাকা অর একটি বাড়ি।

একট থামলেন রাজা। আগেই শুনেছেন আলাউদ্দিন খাঁর জীবন-কথা। সেই প্রসঙ্গ টেনে এবার বললেন, গুরুমাকে এখানে নিয়ে আসুন। স্থায়ী হয়ে বসুন। আমার রাজ্য সুরে সুরে ভরিয়ে দিন ওস্তাদজি।

সম্মতিসুচক মাথা নাড়লেন আলাউদ্দিন খাঁ, তাঁর জগৎটাই যে সুরময়!



এগারো

মাইহারের রাজা বললেন, শেখান গুরুজি।

চুপ করে রইলেন আলাউদ্দিন খাঁ।

রাজা বললেন, বলুন, কোথায় আপনার বাধা?

আলাউদ্দিন বললেন, বাধা আমার নয়, বাধা আপনার। সঙ্গীত-সাধনার জন্যে যে কষ্ট স্বীকার করতে হবে, তা কি আপনি সইতে পারবেন?

রাজা বললেন, আপনি আদেশ করুন।

আলাউদ্দিন বললেন, প্রথমেই আপনাকে সরাব ছাড়তে হবে।

-- ছাড়ব।

-- যতক্ষণ রেওয়াজ করতে বলব, ততক্ষণই রেওয়াজ করতে হবে।

-- করব।

-- বেশ, তবে শেখাব আমি।

পরদিন থেকে শুরু হল অন্নদাতার শিক্ষা। অনন্যমনা হয়েই রাজা শিখতে থাকলেন। ওস্তাদজিও শেখাতে লাগলেন প্রাণ ঢেলে। অনভ্যস্ত কণ্ঠ, অনভ্যস্ত দেহ ও মন। মাঝে মাঝে অবাধ্য হয়, অসংযত হয়ে ওঠে, তবু রাজা প্রাণপণে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে চলেন। তবে গুরু যা চান, তা যেন পেরে ওঠেন না তিনি। গুরুও হারিয়ে ফেলেন ধৈর্য্য। একদিন রেগে গিয়ে এক চড় কষিয়ে দিলেন রাজাকে, একদিন হাতই মুচড়ে দিলেন। কিন্তু আশ্চর্য! কতটুকু সময়ের মধ্যে রাজার রাসভনিন্দিত কণ্ঠস্বরেও সুরের আবেশ নামল, রাজা নিজেই অবাক হলেন নিজের কৃতিত্বে।

রাণীরাও সঙ্গীত শিখতে লাগলেন গুরুজির কাছে।

রাজা আবার একদিন গুরুকে বললেন, এবার গুরুমাকে এখানে নিয়ে আসুন। স্থায়ী হয়ে বসুন। মাইহার ধন্য হোক।

কথাটা মনে ধরল আলাউদ্দিনের। খাওয়া-দাওয়ার বড়ই অসুবিধা হচ্ছে, জীবনে যেন কোন হিসেব থাকছে না। অতএব চিঠি গেল ত্রিপুরা জেলার ব্রাহ্মণবেড়িয়ার শিবপুরে। দাদা আফতারউদ্দিন একদিন মদনমঞ্জরীকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন মাইহরে।

কিন্তু এ কে? কোথায় সেই নোলক-পরা সাত-আট বছরের মেয়ে? তার বদলে কে এই সুন্দরী রমণী? আলাউদ্দিন খাঁর মনে হল, তবে সত্যিই অনেক কাল মেয়েটিকে নির্বাসনে রেখেছেন তিনি, নিষ্ঠুরতা করেছেন। কিন্তু কত বছর? তা প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ বছর হল।

মনে মনে ক্ষমা চাইলেন আলাউদ্দিন খাঁ। মাইহারে নূতন জীবন শুরু হল। যুগপৎ গৃহস্থলি এবং শিক্ষাদান।

এমন সময় একদিন কালো রেখায় ঘেরা এক শোকের চিঠি এল আলাউদ্দিন খাঁর নামে। তিনি তখন বাড়ি নেই, গেছেন হাটে। মাইহারে গুরুজির কাজ সর্বাগ্রে করণীয়। অতএব পিয়ন ছুটলেন হাটে। হাটের মধ্যেই চিঠি নিলেন আলাউদ্দিন খাঁ। কম্পিত হতে চিঠি খুললেন।

গুরু ওয়াজির খাঁর চিঠি। তাঁর বড়ছেলে পিয়ারা সাহেব মারা গেছেন। আলাউদ্দিনের বুকে যেন শেল বাজল। পিয়ারা সাহেব যে গুরুজির বুকের পাঁজরা!

তাঁর মৃত্যুতে নিশ্চয়ই বুকখানা ভেঙ্গে গেছে গুরুজির। মূহূর্তেক দেরি করলেন না আলাউদ্দিন, পিয়নকে বাড়িতে সংবাদ দিতে বলে হাট থেকেই রওনা হয়ে গেলেন, রামপুর অভিমুখে।

আলাউদ্দিনকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন ওয়াজির খাঁ। আলাউদ্দিন তাঁকে স্বান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেই কেঁদে আকুল। গুরুশিষ্যর কান্না থামলে গুরু বললেন, আলাউদ্দিন, আমি পাপ করেছি,মহাপাপ! তাই ঈশ্বর আমাকে এই শাস্তি দিয়েছেন।

কী পাপ গুরুজি?

গুরু বললেন, তোর মতো শিষ্য পেয়েও তোকে কিছু শেখাই নি। তোর প্রতি আমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি আলম।

আলাউদ্দিন কান মললেন. নাক মললেন। বললেন, আমার পাপ আর বাড়াবেন না গুরুজি। আমাকে আপনি যে দয়া করেছেন তাতেই আমি ধন্য!

গুরু বললেন, না রে না। বীণা, রবাব, সুরশৃঙ্গার এসব তোকে কিছুই দিই নি। ধ্রুপদ-ধামারেরও কিছুই দিই নি তোকে। আসলে মিয়া তানসেনের যা কিছু সম্পদ, তা আমাদের পরিবারের। স্বয়ং তানসেনের লেখা পুঁথি আছে আমাদের বাড়িতে। তা আমরা সম্মান করে রেখে দিই, নিজেরও খুলি না, পাছে অন্যকে দেখিয়ে ফেলতে লোভ হয়। সেরা চিজ বংশের একজনকে শেখাই। এমনি করে রক্ষা হয় ঘরানা। এটাই ভারতীয় সঙ্গীতের গুপ্ত রহস্য। এমনি করে হঠাৎ এক-এক-জনের মৃত্যুতে লুপ্ত হয়ে গেছে কত ঘরানা! আমার ঘরানাও লুপ্ত হয়ে যাবে আলম!

আলাউদ্দিন বললেন, কেন গুরুজি? আপনার অন্য ছেলেদের শেখান না, নাতি-নাতনীদের শেখান।

মাথা হেট করলেন ওয়াজির খাঁ, বললেন, অন্য ছেলেদের ক্ষমতা নেই, নাতি-নাতনীরা ছোট।

-- তবে ঘরানা রক্ষা কী করে হবে গুরুজি?

ওয়াজির খাঁ বললেন, তুই, তুই রক্ষা করা আমার ঘরানা। শিষ্যই তো পুত্র। একদিন পিয়ারাকে বলেছিলাম, আলম তোমাদের ভাই, তাকে সব শেখাও। বলেছিলাম, কিন্তু শেখায় নি। আজ তুই আমার প্রকৃত ছেলের কাজ কর্‌, আমার ঘরানা রক্ষা কর্‌।

হাউহাউ করে কাঁদেন আলাউদ্দিন খাঁ। বলেন, আমার দাড়িতেও যে পাক ধরেছে গুরুজি, আমার দেহেও যে বল নেই। আমি কি পারব এখন শিখতে?

তবু শুরু হয় শিক্ষা--দুই বৃদ্ধের এক বিচিত্র সাধনা। ওয়াজির খাঁ বোঝেন, ঘনিয়ে আসছে দিন। আরো-আরো শিখে নাও আলম, আমার বুক উজার করে সব জেনে নাও। যদি না জেনে নাও, তাহলে আমার মৃত্যুর সঙ্গে শেষ হয়ে যাবে, লুপ্ত হয়ে যাবে প্রায় তিনশ বছরের এক সুপ্রাচীন শিল্পরীতি। না, তোমার কোন দায় রইল না, এবার তুমি বিলিয়ে দিতে পার সকলের মধ্যে। যে ঘরানা আমি গঙ্গোত্রী হিমবাহের মতো জমাট করে রেখেছিলাম, হে ভগীরথ, তোমার সাধনায় তুমি তাকে দ্রবীভূত করেছ। এবার তুমি তাকে বিলিয়ে দাও মহামানবের সমুদ্রনীরে। বংশপরম্পরায় যে পাপ করেছি রাজসভার মোহে সাধারণকে বঞ্চিত করে, তোমার প্রচারের মধ্য দিয়ে হোক তার অবক্ষয়। সুরের রাজ্যের ঘরানা-রীতির সামন্ততন্ত্রের অবলুপ্তি ঘটুক, উদয়, হোক গণতন্ত্রের।

কিন্তু দেহ যে আর সয় না গুরুজি. শক্তি যে আর অবশিষ্ট নেই! তবু, তবু হে অশক্ত দেহ, তোমাকে বইতে হবে। হে ক্লান্ত মন, তোমাকে গ্রহণ করতে হবে। যে সূর্যোদয়ের জন্যে প্রতীক্ষা করেছি সারাজীবন, মৃত্যুর মুখোমুখিই যদি তা এসে থাকে তবে হে দেহলীন দেবতা, ধৈর্য ধর তাকে গ্রহণ করতে।

তাই মরণপণ করে যেন শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকলেন আলাউদ্দিন। তাঁকে ওয়াজির খাঁর শিক্ষর শেষ বিন্দুও নিঃশেষে শুষে নিতে হবে। এ তো দেবী সারদা যেন প্রসন্ন মুখে আশীর্বাদ করছেন, দিচ্ছেন অভয়।

কিন্তু শিক্ষা কি শেষ হল?

তা হয়ত নয়, তবু, প্রসন্ন চিত্তে শিষ্যকে আশীর্বাদ করলেন ওয়াজির খাঁ। ভাগ্য তাঁর সুপ্রসন্ন। নইলে এমন শিষ্য লাখে মেলে এক। এ শিষ্য তিনি পেলেন কোন্‌ পূণ্যে?

পরিতৃপ্তি নিয়েই বড়ছেলের মৃত্যুর তিন বছর পর চোখ বুজলেন ওয়াজির খাঁ। আলাউদ্দিন বুকভরা বেদনা নিয়ে ফিরে এলেন মাইহারে। গুরুর শোক পালন করলেন পুত্রেরই মতো-এক বছর।

বিখ্যাত সেতারী ও সরোদ-বাদকেরা আসছেন মাইহারে আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্যত্ব নেবার জন্যে। অন্যান্যদের সঙ্গে ১৯২৫ সালে এলেন তিমিরবরণ।

ক্রমে ক্রমে তিন কন্যা আর এক পুত্র জন্মগ্রহণ করল আলাউদ্দিনের! আরো এক পুত্রের আকাঙ্খা ছিল, কিন্তু আর পুত্র হল না। শেষ বয়সে কন্যা অন্নপূর্ণার সঙ্গে রবিশঙ্করের বিয়ে দিয়ে বললেন, আল্লা আমার সাধ মেটালেন। পুত্র চেয়েছিলাম, জামাই পেলাম রবুকে।

১৯৩৫ সাল। উদয়শঙ্করর সঙ্গে বিশ্বভ্রমণে বের হলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ।

বোম্বাই থেকে জাহাজ ছাড়ল।

জাহাজের ডেক থেকে কূলের দিকে তাকিয়ে কি জানি কেন হঠাৎ দ্বিতীয় বার গৃহত্যাগের কথা মনে পড়ল আলাউদ্দিনের। তফাৎ কিছু আছে। সেবার ঘুমন্ত মদনমঞ্জরীর অজান্তে তার টাকা চুরি করে পালাতে হয়েছিল, এবার মদনমঞ্জরীর জ্ঞাতসারে তার শুভ কামনা নিয়ে হয়েছে যাত্রা। সেবারে ছিল কিছুই-না-জানা বালক, আজ পক্ককেশ প্রবীণ। তবে সেদিন ছিল অজানা কলকাতা সফর, আজ অজানা বিশ্ব।

কিন্তু সেদিনের কলকাতার চেয়ে আজকের বিশ্বে সমাদর মিলল বেশী। প্রথমেই পোর্ট সৈয়দে নেমে মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমির দেশগুলি। মিশর, আরব, জেরুজালেম ইত্যাদি সমস্ত প্রধান শহরগুলিতে অনুষ্ঠানের করলেন উদয়শঙ্করের ইহুদী ম্যানেজার গ্রাটা। বিপুল সম্মান পেল গোটা দল। অভিজ্ঞেরা বললেন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেউ এত বিপুল সংবর্ধনা পান নি এদেশে। পাবেনই বা কেন? কবিগুরুর পর এঁরা ছাড়া আর কোন্‌ সাংস্কৃতিক দল গেছে সংস্কৃতির আদান-প্রদান করতে?

প্রদান তো বটেই, আদানও। সর্বত্রই মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন আলাউদ্দিন খাঁ। সে দেশের মাটির সুর তুলে নিতে হবে। সুরের কাঙাল আমি, সুরর ভিক্ষা চাই সর্বত্র। তিলতিল করেই তো হবে তিলোত্তমা৷ এখানে এসে আবার আজানের সুর বিশ্লেষণ করলেন আলাউদ্দিন খাঁ। সেই দুর্গা! সেই সিন্ধুভৈরবী! কে বলে মুসলমান ধর্ম নৃত্যগীতবিরোধী? তাহলে আজানে এত সুর কেন? মুসলিম গ্রামের মানুষ গান গায় কেন? উদয়শঙ্করের হিন্দু দেব-দেবীর নাচ দেখে কেন? আলাউদ্দিন সে দেশের ভাষা বোঝেন না, কিন্তু সুরের স্পর্শে বোঝেন, সেই প্রাণ, সেই সুর সর্বত্র বেড়ে চলেছে। জগৎ জুড়ে একই সুরের মেলা।

কাছেই মক্কাশরিফ, মুসলমানদের শ্রেচ্ঠ তীর্থ। উদয়শঙ্কর বললেন, একদিন যান, ঘুরে আসুন মক্কা।

মন নড়ে উঠল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে পড়ল, তাঁকে একাই যেতে হবে মক্কা, উদয়শঙ্করেরা যেতে পরাবেন না! ওঁরা হিন্দু, কাজেই ধর্মের বাধ। ভারতেও কোন মন্দিরে ঢুকতে পান নি আলাউদ্দিন খাঁ। গিরিশচন্দ্রের নাট্য-মন্দিরে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু নাম বদলে। আলাউদ্দিন খাঁ ঢোকেন নি, ঢুকেছিল প্রসন্ন বিশ্বাস। সর্বত্র সেই ধর্মের ধ্বজাধারীদের শাসন। মনে মনে দেবী সরস্বতীকে স্মরণ করলেন আলাউদ্দিন খাঁ। না, থাক। সুরের বিশ্বজয়ে বেরিয়েছেন তিনি, এক আরাধ্যই তাঁর মাথায় থাকুক। মক্কা নয়। কাউকে রেখে একা তিনি মক্কায় যাবেন না। আকাশে বাতাসে আজানের ঘোষণায় মহম্মদের বাণী এসেছে তাঁর কানে। আল্লা যদি দয়া করেন, তবে বারান্তরে আসবেন তিনি।

মিশর থেকে তাঁরা এলেন গ্রীসে। আলেকজাণ্ডার গিয়েছিলেন সৈন্য নিয়ে, আলাউদ্দিন এলেন সুর নিয়ে। আলেকজাণ্ডার পিছন ফিরতেই তাঁর সাম্রাজ্য চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল, আলাউদ্দিন যা গড়ে এলেন, তা চিরস্থায়ী।

গ্রীস থেকে ক্রমে ক্রমে তাঁরা এলেন বুলগেরিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, রুমানিয়া, হাঙ্গেরী, অস্ট্রিয়া চেকোশ্লোভাকিয়া, পোলাণ্ড, সুইডেন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডে।

প্রত্যেক দেশের প্রধান-প্রধান শহরগুলিতে অনুষ্ঠানের আয়োজন হল। রাজা থেকে সাধারণ প্রজা, প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী থেকে গ্রামের চাষী, কে এলেন না সেই সম্মেলনে? কি ভিড়, কি ভিড়! খবরের কাগজ ভর্তি ছবি আর শবিবরণ। সাময়িক পত্রিকায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের বিবরণ, ভারতীয় সঙ্গীত-নৃত্য সম্পর্কে আলোচনা। অনুষ্ঠান-শেষে হোটেলে ফেরার পথে অপেক্ষমান জনতার অভিনন্দন।

এলেন তাঁরা ভিয়েনায়, প্রাগে বুদাপেস্টে, অবশেষে প্যারিসে। শিল্প আর শিল্পের দেশ প্যারিস। এদেশের আয়োজন দেখে একদিকে বিস্মিত, অন্যদিকে অভিভূত হলেন আলাউদ্দিন খাঁ। এদের গোটা সঙ্গীত-জগতেই বহুর প্রভাব। এরা যখন বাজায়, একসঙ্গে দু-তিনশ জন শিল্পী বসে যায় একত্রে অর্কেস্ট্রা বাজাতে। যখন শোনে, তখন দশ-বারো হাজার মানুষ একত্রে শোনে।

কত কোটি টাকা ব্যয়ে এক-একটা হল ঘর তৈরী!

আলাউদ্দিন যখন বাজাতে থাকেন, তখন ঐ কয়েক হাজার দর্শক নিশ্চুপ। পিন পড়লে বুঝি সে শব্দ শোনা যায়। মনে হয়, প্রেক্ষাগৃহে একটিও লোক নেই, এত তন্ময় হয়ে শোনে তারা। যখন সরোদের মীড় নাট্যমন্দিরে পরিব্যপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, বহুর মাঝে নিজেকে সম্প্রসারিত করবার বিপুল আনন্দে আলাউদ্দিনের বুকের ভিতর, এক অসীম উচ্ছ্বাস আকুলি বিকুলি করতে থাকে।

বাজনা শেষ হলে হাততালি যেন থামতে চায় না! শ্রোতারা বুকের আনন্দ প্রকাশ করতে শিল্পীর দিকে ছুঁড়ে দেয় ফুলের তোড়া। তোড়ায় তোড়ায় ছয়লাপ হয়ে যায় মঞ্চ। আলাউদ্দিন খাঁ আনন্দে ভাসতে থাকেন।

আলাউদ্দিন খাঁ স্বীকার করেন, বাজিয়ে এত আনন্দ তিনি আর কোথাও পান নি।

প্যারিসের অভিজ্ঞতা বিচিত্র। একদিন হোটেলের ঘরে হুড়হুড় করে ঢুকে পড়ল একদল মেয়ে। কী তাদের বেশ-বাস! কি তাদের ভাব-ভঙ্গী। তাদের আবদার, তাঁর বাজনা শুনবে। এমন হাল্কা মেজাজের মেয়েরা কী শুনবে? বুঝবেই বা কি? অপ্রসন্ন মনে বিকেলের পড়ন্ত আলোর দিকে তাকিয়ে ওস্তাদ ভীমপলশ্রীতে ধরলেন সুরের ঝঙ্কার। ও মা! মুহূর্তে ওদের বাইরের হালকা মুখোশ খুলে গেল, ওরা যেন বুঝে নিতে চাইছে. তলিয়ে যেতে চাইছে সুরে। আমোদ লাগল আলাউদ্দিনের, খুশি হল মন। তিনিও ডুব দিলেন।

তিন ঘণ্টা বাদে যখন তিনি থামলেন, তখন মেয়েগুলির মুখে বিস্ময়। ওরা আন্তরিক শ্রদ্ধা নামিয়ে দিয়ে গেল এই ইন্ডিয়ান ওল্ড আর্টিস্টের পায়ে। ওরা যেন তাঁর স্পর্শ পেয়ে ধন্য হয়েছে।

ধন্য আলাউদ্দিনও। তিনিও যে ওদের সত্য পরিচয় জেনেছেন। মনে মনে প্রণাম করলেন গুরুকে। ঠিকই তো, দেশভ্রমণেই শিক্ষার চূড়ান্ত। শিক্ষার কি শেষ আছে!

প্যরিসের ধনীর দুলালী এলিস বোনার উদয়শঙ্করের ভক্ত। ক্রমে তিনি ভক্ত হয়ে পড়লেন আলাউদ্দিনেরও। তাঁরই প্রস্তাবক্রমে ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের এক প্রদর্শনী হল প্যারিসে। ওঁদের দলে তখন প্রায় চল্লিশ রকম যন্ত্র। প্রদর্শনীতে সাধারণ মানুষের কৌতুহলী ভিড়। আলাউদ্দিন খাঁ এক-এক করে যন্ত্র বাজিয়ে দেখান, দেন তাদের কৌতুহলের জবাব। দোভাষী বুঝিয়ে দেন বিষয়টি। ভারতীয় সঙ্গীতের প্রতি শ্রদ্ধা ঝরে পড়ে সকলের চোখে।

বুদাপেস্টে ওঁরা যখন সফর করছেন, তখন সে দেশের নামজাদা শিল্পীরা এলেন আলাউদ্দিনের সঙ্গে ভারতীয় সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করতে। তাঁরা প্রশ্ন করছেন, উদয়শঙ্কর বলে দিচ্ছেন তার বাংলা। আলাউদ্দিন খাঁ বলছেন বাংলায়, উদয়শঙ্কর তার ইংরাজি করে দিচ্ছেন। যতই শুনছেন, ততই যেন বিমুগ্ধ হচ্ছেন শিল্পীরা।

প্রথমেই তাঁরা প্রশ্ন করলেন, কী কী সঙ্গীতের সুর তৈরী করেছেন?

আলাউদ্দিন খাঁ বললেন, আমরা সঙ্গীতের সুর দিয়ে শিল্পীকে বিচার করি না। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ঋষিরা পেয়েছেন সাধনায়, আমরা তারই চর্চা করি, প্রকাশ করি। সময়, মনোভাব ইত্যাদির বিচার করে তৈরী আমাদের রাগ-রাগিনী। ভৈরবী বাজিয়ে শোনালেন আলাউদ্দিন খাঁ। বললেন, কী অনুভব হল? সমঝদার শ্রোতা বললেন, যেন কার জন্যে প্রতীক্ষা করছি, তবু তিনি এলেন না। আলাউদ্দিন খাঁ ভীমপলশ্রী বাজিয়ে শোনালেন। কান্না, যেন কান্নার সিন্ধু উথলে উঠল।

-- কেন গো, তোমাদের সুর এত কান্না আনে কেন?

আলাউদ্দিন খাঁ সাত সুর বাইশ শ্রুতি, একুশ মূর্ছনার হিসাব বোঝালেন, বাজিয়ে বোঝাতে চাইলেন এ সবের পার্থক্য। তালই আছে তিনশ ষাট রকম।

এবার তবলা নিয়ে বসলেন আলাউদ্দিন। মুখে মুখে বোল বলে নানারকম তালের পার্থক্য দেখাতে থাকলেন। ইউরোপীয় সঙ্গীতজ্ঞেরা কিছু বুঝলেন, কিছু বুঝলেন না। শুধু অবাক হয়ে বললেন, আপনাদের কান এত সূক্ষ্ম পার্থক্য ধরতে পারে!

হাসলেন আলাউদ্দিন খাঁ। বললেন, আপনাদের সঙ্গীতে এক সুর অন্য সুরের ঘাড়ে চেপে বসতে চায়। আমাদের সুর থাকে পাশাপাশি, একজন অন্যজনের উপর চেপে বসে না। যেন একেরই ক্রমবিকাশ, এ যেন তেত্রিশ কোটি দেবতা, অথচ এক ঈশ্বর।

-- তবে, অকপটে স্বীকার করলেন আলাউদ্দিন খাঁ, আপনাদের বেহালা বাজনা বড় মধুর। এ বাজনা শুনে মনে হয়, ও বাদনে আমি শিশু। স্থির করেছি, আমি আর বেহালা বাজাব না।

সত্যিই সেই থেকে বেহালা বাজানো ছেড়ে দিলেন খাঁ সাহেব।

বিদায় চাইলেন শিল্পীরা। হাতজোড় করে হাউমাউ করে উঠলেন আলাউদ্দিন। বললেন, আমার আলোচনা শুনে, আমার বাজনা শুনে ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রের উপর কোন খারাপ ধারণা করবেন না। আমি অক্ষম মানুষ। আমার শিক্ষাও সমাপ্ত হয় নি। আমি কি-ই বা দেখাতে পেরেছি, কি-ই বা শোনাতে পেরেছি? ভারতীয় গুণীরা গান গেয়ে ফুল ফোটাতে পারতেন, দীপ জ্বালাতে পারতেন, বৃষ্টি নামাতে পারতেন। সত্যিকারের গুণীর সন্ধান পেলে ভারতীয় সঙ্গীতের যথার্থ সংবাদ পেতেন।

এঁরা বললেন, আপনার কাছেও তো কম পেলাম না!

নাক মললেন আলাউদ্দিন, কান মললেন। হাতজোড় করে বললেন, সত্যিই যদি পেয়ে থাকেন, তবে সে আমাদের শাস্ত্রেরই গুণ, আমার নয়।



বারো

এলম হার্স্ট বাঙালির কাছে পরিচিত নাম। রবীন্দ্রনাথের জীবনাদর্শকে জীবনে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। বিশ্বভারতী গড়ে তুলতে এই ইংলণ্ডবাসী ধনীর সাহায্য কম ছিল না। বিশ্বভারতীর অনুকরণে তিনিও গড়েছিলেন এক প্রতিষ্ঠান, নাম - ভারটিংটন হল। এখানে এলম হার্স্ট ও তাঁর কন্যার আমন্ত্রণে উদয়শঙ্কর ও আলাউদ্দিন খাঁ কাটিয়ে গেলেন কয়েক মাস।

আর মন টিকছে না, দেশ টানছে। পুরো এক বছর বিদেশে কাটিয়ে আলাউদ্দিন ফিরে এলেন মাইহারে। প্রাণের-আকুতিতে নিজের বাড়ির দরজায় নিজেই আঁকা-বাঁকা অক্ষরে লিখলেন মদিনা-ভবন।

এবার আহ্বান এল রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। এক বিশ্ববিজয়ী ডাকলেন আর এক বিশ্ববিজয়ীকে। এ আহ্বানে সাড়া না দেবে কে? পথের কাঙাল আলমকে ডেকেছেন স্বয়ং বিশ্বকবি! সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছুটলেন শান্তিনিকেতনে। নিমন্ত্রিত অধ্যাপক-পদে সেখানে কাটিয়ে দিলেন ছ মাস। রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে যেন সমস্ত জ্বালা জুড়িয়ে ফিরলেন আলাউদ্দিন। বলতেন, বৃথাই বিশ্ব ঘুরলাম। গণেশ যেমন জননীকে প্রদক্ষিণ করে বলেছিলেন, বিশ্ব ঘোরা হল, ওঁর কাছে থাকলেও তাই।

বিদায়-দিনের একটা মজার গল্প বলতেন আলাউদ্দিন খাঁ। বিদয়ের দিনে গম্ভীর মুখে রবীন্দ্রনাথ না কি নন্দলাল বসুর দিকে তাকিয়ে আলাউদ্দিনকে দেখিয়ে বলেন, ওর মাথাটা রেখে দাও।

মাথা রাখবে! সে কি রে বাবা! ঘাবড়ে গেলেন আলাউদ্দিন খাঁ। এঁরা আবার কুকীদের মতো মাথা রাখার পাগলামি শুরু করেছেন কবে! দৌড় দেবেন কিনা ভাবছেন, এমন সময় নন্দলাল সঙ্গে করে আনলেন আর একজন কালো জল্লাদের মতো দেখতে লোককে?

নন্দলাল বললেন, রাম, এরই মাথা।

আরো ঘাবড়ে গেলেন আলাউদ্দিন।

খানিক পরে বিষয়টা পরিষ্কার হল। ও হরি! মাথা রাখা মানে এই! নন্দলাল বসুর প্রিয়তম ছাত্র রামকিঙ্কর বেইজ তৈরি করে রাখলেন আলাউদ্দিনের আবক্ষ মূর্তি।

* * * *

মাইহারে ফিরে ইউরোপীয় স্টাইলে একটা ব্যান্ডপার্টি গড়লেন আলাউদ্দিন খাঁ। ঢেঁড়া পিটিয়ে অক্ষরজ্ঞানশূন্য সাধারণ মানুষ জড়ো করা হল। তাঁর বাড়িতেই সকলের থাকা-খাওয়া। এদের দিয়েই তিনি গড়ে তুললেন এক অসাধারণ ব্যাণ্ডপার্টি। একশজন বাজায় একসঙ্গে। ইউরোপের মতো নোটেশন দেখে বাজাতে হয় না তাদের, তাল আর সরের ইঙ্গিতে ধরন-ছাড়ন, উত্থান পতন!

ভারতময় ছড়িয়ে পড়ল তার খ্যাতি। দেশদেশান্তর থেকে আসতে থাকল সঙ্গীত বিষয়ে নানা প্রশ্ন। কেউ যেন বিমুখ না হয়। নিজে সঙ্গীতের জন্যে যে কষ্ট ভোগ করেছ, অন্যে তা যেন না করে। নাড়া না বেঁধেও সকলেই তাঁর শিষ্য। আলাউদ্দিন খাঁ আর ব্যক্তি নন, তিনি এখন এক প্রতিষ্ঠান।

প্রস্তাব এল যোধপুর থেকে। সভা-গায়ক করতে চান তাঁকে। মস্ত রাজ্য, অনেক সুযোগ।

মাইহারের রাজা বললেন, গুরুজি, আমার ছোট্ট রাজ্য, সামান্য আয়। আপনাকে যোগ্য সম্মান দিতে পারি না। আপনি যান। আমি খুশিই হব।

তবু গেলেন না আলাউদ্দিন খাঁ। স্ত্রীকে বললেন, মাইহার আমার প্রথম অন্নদাতা। এ স্থান আমি ছাড়ব না।

থেকে গেলেন মাইহারেই।

স্বাধীনতার পূর্বে হিন্দু-মুসলমান রায়ট শুরু হল ভারতবর্ষ জুড়ে। এই সঙ্গীত-সাধকের বুক জুড়ে ব্যথা। কোন প্রচার নেই, কিন্তু নিজের জীবনে এত বড় সর্ব-ধর্মসমন্বয় ক’জন করেছেন? আল্লা আর সারদা একত্রে তাঁর আরাধনার বস্তু। যীশুর গল্প শুনে কান্নায় বুক ভাসান। কলকাতায় ছিলেন, অথচ রামকৃষ্ণদেবের চরণধূলি নেন নি জেনে তাঁর কী অনুশোচনা! কলকাতার শিষ্যকে তিনি লিখে পাঠান, বাবা, আমার ঘরে শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ, শ্রীশ্রী বিবেকানন্দের ফটো আছে। কিন্তু শ্রী গৌরাঙ্গের কুন ফটো নাই। তুমি অবশ্য একখানা শ্রীশ্রী গৌরহরির ছবি পাঠাইবা। এই আমার শেষ নিবেদন।

সেই মানুষ এই হানাহানিতে যেন আত্মগ্লানিতে ভরে গেলেন। এ যেন তাঁর নিজেরই পাপ।

দেশ স্বাধীন হল।

স্বাধীন সরকার করদ সব মিত্ররাজ্য নিজহাতে নিয়ে নিলেন। মাইহারের রাজ্যও সেই দলে হারিয়ে ফেলল নিজেকে। আলাউদ্দিনকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হল মাইহার সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়। তার অধ্যক্ষ আলাউদ্দিন খাঁ। সরকার নিজে দেন বেতন।

শুরু হল সম্মানের পালা।

১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে তাঁকে দিনেন্দ্র অধ্যাপক করে আবার শান্তিনিকেতনের সঙ্গীত-ভবনে নিয়ে যাওয়া হল।

১৯৫৮ সালে ভারত সরকার দিলেন ভারত-রত্ন উপাধি। বিশ্বভারতী উপাধি দিল দেশিকোত্তম।

১৯৬৪ সালে আলাউদ্দিন শেষবারের মতো দেখতে গেলেন নিজের জন্মস্থান সেই ত্রিপুরার ব্রাহ্মণবেড়িয়ার শিবপুর। ছোট ভাই আয়েত সেখানেই থাকেন। উঠলেন তাঁর বাড়িতে।

জনস্রোত আসছে আলাউদ্দিন খাঁকে দেখতে। ভলেনটিয়ার বাঁশ বেঁধে ঘিরে দিল বাড়ি। গেটে পয়সা দিয়ে ঢুকতে হচ্ছে। তাও ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। যেন মেলা বসে গেছে। দোকান-পাট মায় হোটেল পর্যন্ত।

মাত্র দশদিন ছিলেন সেখানে আলাউদ্দিন খাঁ। তাতেই দর্শনী বাবদ আদায় হয়োছল কয়েক হাজার টাকা। ভলেন্টিয়াররা তোড়া বেঁধে টাকাটা তুলে দিলেন আলাউদ্দিন খাঁর হাতে। আলাউদ্দিন টাকাটা মাথায় ছোঁয়ালেন। বললেন, এ আপনাদের স্নেহের দান। এর মূল্য আমি কিছুই দিতে পারব না। এই জন্মভূমির জন্যেই বা আমি কী করতে পেরেছি? আমি অক্ষম সন্তান। আপনাদের স্নেহ আমি মাথায় তুলে নিলাম। কিন্তু এ টাকায় আপনারা এই গ্রামে একটা মসজিদ আর একটা পাবলিক পুকুর করিয়ে দিন।

দেহ যেন আর সয় না। মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়েন, আলাউদ্দিনের দেহের আর দোষ কি? অত্যাচার তো কম করেন নি দেহের উপর! সারাদিনে একবার খাওয়া বা একেবারেই অনাহার। একটানা দিনভোর রেওয়াজ। অবশ্য বয়সও কম হল না, একশ বছরও পার হয়ে গেছে। আর কত কাল এই হানাহানির জগতে বসিয়ে রাখবে ঈশ্বর! তোমার সদানন্দের রাজ্যের স্বর্গীয় সুর কি আমায় শুনতে দেবে না!

অসুস্থ দেহে মাইহারের গরমে বড় কষ্ট হয়। রবিশঙ্কর বলেন, বাবা, অনুমতি দিন, একটা এয়ারকণ্ডিশনার বসিয়ে দিই। হাসেন আলাউদ্দিন। বলেন, যিনি আসছেন, তাঁকে সহজভাবেই আসতে দাও। তোমাদের ওসব যন্ত্র দেখে তিনি যদি ভয় পান, আমাকে যদি চিনতে না পারেন!

দিন দিন কেমন যেন উদাস হয়ে যান আলাউদ্দিন, চোখ জলে ভরে আসে। চোখ মেলে যাকে কাছে পান, তারই হাত জড়িয়ে ধরে বলেন, আমি মা সারদার ডাক শুনেছি! আহা, কী মধুর তাঁর স্বর! কী অপরূপ তাঁর সুরের রাজ্য! আমি সে সুর শুনতে পাই, কিন্তু ধরি ধরি করেও ধরতে পারি না।

আবার তাঁর চোখ বুজে আসে খানিক আনন্দ, খানিক শ্রান্তিতে।

১৯৭২ সালের ১৪ই জুন থেকে রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়লেন আলাউদ্দিন খাঁ। একদিন এক প্রিয় শিষ্যকে ডেকে বললেন, মরণের পর আড়ম্বর করবা না। আমারই এই উঠানের এক কোণে আমারে কবর দিবা। আমি মাটির সঙ্গে মিশা যামু। এই মাটির উপরে আমার নাতি-নাতনীরা বাজাবে, আমি শুয়া শুয়া শুনুম।

যাবার জন্য প্রস্তুত মন। অন্যরাও যেন প্রস্তুত হয়ে গেলেন। এই তো খাঁটি ভারতীয়ের মৃত্যু! ইহলোকের সব কাজ মিটিয়ে এ যেন লোকান্তরে যাত্রা। অতএব চোখের জল ফেলো না, যাত্রার আয়োজন কর। দেখো, যেন যাত্রায় কোন বিঘ্ন না ঘটে।

তবু, তবু কেন কান্না আসে তোমাদের চোখে? ওগো, আমি তো এপারের সব কাজ শেষ করেছি। সঙ্গীতের বন্ধনদশা ঘুচিয়েছি। আমার সব উজাড় করে শিখিয়েছি তোমাদের। এখন বাজাও, দেশ জুড়ে বাজাও। শুধু মাইহার নয়, সমগ্র ভারত সেই সুরে কেঁপে উঠুক। সমগ্র বিশ্ব প্রণত হোক সেই সুরের ঝঙ্কারে।

ভারত জুড়ে সত্যিই বাজছে সেই সুর। আলাউদ্দিন খাঁর শত শত শিষ্য-প্রশিষ্য বাজিয়ে চলেছেন সেই একই সুরের রেশ। কিন্তু সেই সুরের ভগীরথ আর আমাদের মধ্যে নেই।

প্রায় একশ দশ বৎসর বয়সে ১৯৭২ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর রাত ১১টা ১০ মিনিটে চিরস্মরণীয় এই সঙ্গীতসাধক চলে গেছেন অন্যত্র কোনও মহান সুরলোকের অভিসারে।।

শেষ

No comments:

Post a Comment