বাজাও আমারে বাজাও (দ্বিতীয়াংশ)

লেখক: নীরদ হাজরা

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

চার

দিনটা আলমের জীবনে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মায়ের মার বা বকাঝকা কিছুই তেমন করে গায়ে লাগে নি আলমের। কারণ, আলম তার আগেই বুঝে নিয়োছল কি চায় তার মন। গান আর বাজনা ছাড়া কিছুতেই বাঁচবে না আলম। আকাশের মাঝে, বাতাসের শব্দে, নদীর জলে কিসের যেন সুর শুনতে পায় সে। ঠিক না বুঝলেও তার মনে যেন কিসের ইশারা। কিন্তু কী করে সে সাড়া দেবে সেই ডাকে? বাবার স্নেহ, মায়ের ভালবাসা, দিদির আদর তাকে সব ভুলিয়ে রাখে। আলম বোঝে, এখানে থাকলে মায়ের শাসন এড়িয়ে সুরের রাজ্যে যাওয়া হবে না তার। কিন্তু এতজনের স্নেহের বন্ধনই বা সে কাটাবে কি করে? সেদিন মারের নির্যাতন এসেছিল আশীর্বাদ বহন করে। গোয়ালঘরে থাকতে থাকতেই সে স্থির করে ফেলেছে, এ বাড়িতে আর নয়, এ বাড়িতে কেউ সত্যিকারের ভালবাসে না তাকে। যদি ভালবাসত, তবে বুঝত তার মনের কথা। সেটাই যখন কেউ বুঝল না, তখন থাক পড়ে সবাই। আলম এ বাড়ি ত্যাগ করবে। এই মধুমালতীদিদি বের করে এনেছে তাকে, আদর করে খাইয়েছে, ঘুম পাড়িয়েছে। একটিও কথা বলে নি আলম, ঘুমের ভান করে পড়ে ছিল। একসময় মধুমালতীদিদি চলে গেছে, সকলের খাওয়া-দাওয়া সাঙ্গ হয়েছে, শুয়ে পড়েছে সবাই। তখনও অপেক্ষা করে থেকেছে আলম। রান্নাঘরে রয়েছেন মা। উঁকি দিয়ে দেখে বিছানা থেকে সন্তর্পণে নেমেছে সে। মা কোন হাঁড়িতে টাকা-পয়সা রাখেন তা জানা ছিল আলমের। আস্তে আস্তে গিয়ে সেই হাঁড়ি থেকে একখাবলায় যা উঠেছে তুলে নিয়েছে। তারপর আলনা থেকে নিজের একটা জামা নিয়ে টাকা কটা পুঁটলি করে রেখে দিয়েছে বালিশের নীচে।

তারপর একসময় মা এসে ঘরের দরজা বন্ধ করেছেন, রোজকার মতো শোবার আগে এসে দাঁড়িয়েছেন আলমের সামনে। গুটি মেরে ঝিম ধরে পড়ে থেকেছে আলম। মা একটা চাদর টেনে দিয়েছেন আলমের গায়ের উপর, ঘুমন্ত ছেলের মাথায় হাত বুলিয়েছেন। কিন্তু তাতে আলমের অভিমান বেড়েছে বই কমে নি, ওপাশ ফিরে শুয়েছে সে। একটু পরে মা চলে গেছেন।

তারপর নিঃশব্দে অপেক্ষা করেছে আলম। একসময় নিশ্চিন্ত হয়েছে মায়ের ঘুম সম্পর্কে। তখন ধীরে ধীরে উঠে তুলে নিয়েছে টাকা আর জামার পুঁটলিটা। তারপর দরজা খুলে দে-দৌড়। বন-বাদাড় ভেঙে পথ বিপথ মাড়িয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত না বেদম হয়েছে, ততক্ষণ ছুটেই চলেছে সে। ছেলেটা যেন এক দৌড়ে তার মা, বাবার স্পর্শকাতর এই পৃথিবীটা ছাড়িয়ে সুরের অন্য এক পৃথিবীতে গিয়ে পৌঁছাতে চায়।

খানিক থামল আলম। ঠিক পথেই এগুচ্ছে সে। এ তো মানিকনগরের আগের সেই হাওর। হাওরটার এদিক ওদিক দেখা যায় না, এত বড়। এই হাওর পেরিয়ে মানিকনগর। তারপর নদীর তীরে শ্যামগঞ্জের লঞ্চের ঘাট। এসব পথে কোনদিন যায় নি আলম। কিন্তু সাধুদের মুখে পথের বর্ণনা শুনে শুনে সব তার মুখস্থ।

এই হাওর সম্পর্ক আরো একটা কথা শুনেছে আলম। এখানে না কি অনেক জলার ভূত বাস করে। রাত হলে আগুন জ্বালে তারা। এখানে ওখানে দপদপিয়ে বেড়ায়। ইংরেজি পাঠশালায় পড়া বাবুদের বাড়ির ছেলেরা যদিও বলে ওগুলো ভূত নয়, আসলে একরকম গ্যাস, কিন্তু তা বিশ্বাস করে না আলম। গ্যাস যদি তবে অনবরত জ্বলে না কেন? বার বার জ্বলে নেভে কেন? কে বার বার জ্বালায়-নেভায়? হুঁ হুঁ বাবা, অত বোকা পাও নি আলমকে যে, যা-তা বলবে আর সে বিশ্বাস করবে! অনেক কিছু অবিশ্বাস করতে পারে আলম, কিন্তু ভূতকে নয়। শেষে অবিশ্বাসীকে বিশ্বাস করতে ঘাড়ে ধরুক আর কি!

এসব চিন্তা করে কিন্তু হাঁটা থামায় না আলম, তাকে যে সব পরিচিতের গণ্ডি ছাড়াতেই হবে! ভূতের কথা ভাবলে কী হবে, সত্যিকারের ভয়ডর বলে বোধ হয় কিছু নেই ছেলেটার। না হলে এই রাতে মাত্র আট বছরের ছেলে এমন করে পথ পাড়ি দিতে পারে?

কিন্তু ও কী! এই দুর্জয় সাহসী ছেলেটাও থমকে দাঁড়াল একবার। ঐ দূরে কটা আলো যেন জ্বলছে-নিভছে! কিসের একটা শোরগোল যেন। ভূতেদের মজলিস বসেছে বোধ হয়। তাই অত রোশনাই। কিন্তু রোশনাই করে আসর বসাবে কেন ভূতেরা? তারা তো অন্ধকারকেই ভালবাসে। দুহাতে ভালো করে চোখ মুছল আলম। আরো ক পা এগিয়ে এল। নাঃ, আলোগুলো তো জ্বলছেই শুধু, নিভছে না। নড়াচড়া করছে মাত্র। তবে কিসের আলো? ছুটতে থাকল আলম। আরো, কিছু পথ এসে বুঝল, সে হাওর ছাড়িয়ে, মানিকনগর ছাড়িয়ে শ্যামগঞ্জের লঞ্চঘাটে এসে গেছে। ঐ তো লঞ্চ!

সব দ্বিধা কাটিয়ে একদৌড়ে লঞ্চে গিয়ে উঠল আলম। খুবই ক্লান্ত শরীর। একটা কোণ দেখে যুত করে শুয়ে পড়ল আলম। যখন লঞ্চ ছাড়ে, ছাড়ুক।

আলমের যখন ঘুম ভাঙল, তখন বেশ বেলা হয়েছে। কিন্তু তখনও লঞ্চখানা দাঁড়িয়ে। ধক করে উঠল আলমের বুক, তবে কি সারারাত চলে নি লঞ্চখানা!

বাইরে এল আলম। না, এ তো ভিন্ন নদী, ভিন্ন শহর। তার সামনে যেন এক মস্ত মেলা। কত রকমের দোকান, কত রঙ, কত লোক!

ধীরে ধীরে লঞ্চ থেকে নামল আলম। তীরের দোকানগুলোর সামনে দিয়ে ঘুরল বারকয়েক। নানারকম দোকান থাকলেও বেশীর ভাগই খাবারের দোকান। আহার্যের বিচিত্র সুগন্ধে আলমের পেটের ভিতর থেকে ক্ষিধে যেন পাকিয়ে উঠতে লাগল। একটু নিরিবিলি জায়গা দেখে জামার পুঁটলি খুলল আলম। গুনল, গতরাতে অন্ধকারে একখাবলা যা এনেছে, তা নেহাত কম নয় -- বারো টাকা, তবু ভয় পেল আলম। সাহস করে কোন দোকানে ঢুকতে পারল না, পাছে তাকে ছোট বলে বের করে দেয়? কিংবা কেড়ে নেয় টাকা! থাক্‌ খাওয়া।

আপনমনে ঘুরতে লাগল আলম।

হঠাৎ এক জায়গায় যেন পরম প্রার্থিত বস্তু দেখে থমকে দাঁড়াল আলম। মুড়ি! একটা লোক মুড়ি বিক্রি করছে। আলমের মনে হল, লোকটা যেন তার কত দিনের চেনা। দোকানীর কাছে এসে এককোঁচড় মুড়ি নিল সে। দোকানী একটা টাকা ভাঙিয়ে তিন পয়সা নিয়ে বাকীটা ফেরত দিয়ে দিল।

কিন্তু ধীরেসুস্থে মুড়ি খাওয়া হল না আলমের। দৈত্যের মতো ভোঁ করে আওয়াজ করে জল তোলপাড় করতে করতে একখানা মস্ত বড় লঞ্চ এসে লাগল স্টেশনে। লোকজন স্টীমার এসেছে, স্টীমার এসেছে বলে তুমুল শোরগোল তুলল। আলম জানল, ঐ বড় লঞ্চগুলোকে স্টীমার বলে। একটা লোককে সে শুধাল, এটা কোথাকার স্টীমার?

লোকটা বলল, গোয়ালন্দের।

ভিড় ঠেলে পায়ে পায়ে আলম গিয়ে উঠল ঐ স্টীমারে। হৈ চৈ-চেঁচামেচি কাটিয়ে, প্রচুর লোক ও মাল নামিয়ে উঠিয়ে অবশেষে স্টীমারটা চলতে শুরু করল একসময়। একটা অদ্ভুত উল্লাসে ভরে উঠল আলমের মন। যেন সরস্বতীদেবীর হাঁস নিজে এসে ডানা মেলে তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সুরের রাজ্যে। আঃ কী তৃপ্তি! কী আনন্দ!

অবশ্য আলমের পক্ষে আরো আনন্দের এইজন্যে যে, গোটা স্টীমারটা ও তার জলযাত্রা দু-ই তার কাছে নতুন।

তাই বেশ কৌতূহলের বস্তু। ছেলেটা ভুলে গেল সব কিছু। গুটি গুটি পায়ে কৌতূহলী চোখ মেলে ঘুরে বেড়াতে লাগল একতলা-দোতলা, দেখল ইঞ্জিনঘর, ডেকের যাত্রীদের, দেখল কেবিন, মুরগীর খাঁচা, খালাসীদের থাকবার জায়গা। উপরে সারেংয়ের ঘরে উঠতে গিয়ে একবার ধমকও খেল সে। অবশেষে এসে দাঁড়িয়ে রইল রেলিংয়ের ধারে।

দুরে দূরে গ্রামগুলো কেমন করে মিলিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও পারে ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে, ফেনার রাজ্য তৈরি করে কত দূর পিছন পর্যন্ত চিহ্ন রেখে এগিয়ে যাচ্ছে স্টীমারটা!

আলমের সবচেয়ে মজা লাগছে, স্টীমার যখন কোথাও থামছে। স্টীমারের চাকা ঘোরায় নদীর জল তখন উথাল-পাথাল করছে। কী বড় বড় ঢেউ! যেন অত বড় স্টীমারটাকে গিলে ফেলবে। তারই মধ্যে মোচার খোলার মতো নৌকোগুলো নিয়ে এল ব্যাপারীরা। ঢেউয়ের মাথায় লাফিয়ে উঠছে নৌকোগুলো পাঁচ-সাত হাত, আবার নেমে যাচ্ছে দুই ঢেউয়ের মাঝে। এই বুঝি গেল ডুবে! না, ঐ তো ভেসে উঠেছে! আশ্চর্য, এই ওঠানামার ছন্দেই ওরা স্টীমারের যাত্রীদের হাতে তুলে দিচ্ছে দৈয়ের ভাঁড়, রসগোল্লা বা এরকম সব সওগাত। নিচ্ছে টাকা, দিচ্ছে খুচরো পয়সা। তন্ময় হয়ে লোকগুলোর অদ্ভুত কৌশল দেখতে থাকে আলম।

কিন্তু এ থামা কতক্ষণেরই বা! চলতেই থাকল স্টীমার। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। স্টীমারের মধ্যেও খাবারের দোকানের সন্ধান পেল আলম। কিন্তু কিনতে সাহস পেল না, যদি ছোট বলে তাকে না দেয়, যদি ধরে ফেলে যে, সে বাড়ি থেকে পালিয়েছে, যদি তাকে ধরে আবার বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। অতএব না খেয়েই দিনটা কাটিয়ে দিল আলম।

সন্ধ্যার গভীরে স্টীমার এসে থামল এক ঘাটে। লোকের কথা থেকে আলম বুঝল, এটাই গোয়ালন্দ ঘাট। সব যাত্রীই নেমে যাচ্ছে। অতএব জনস্রোতের সঙ্গেই নামল আলম। টিকিট-ফিকিট কেউ চাইল না তার কাছে। লক্ষ্যই করল না হয়ত।

কিন্তু এখানে কোথায় যাবে আলম! ভাবনা-চিন্তা না করে বেশীর ভাগ লোক যেদিকে যাচ্ছে, সেদিকেই চলল সে। ওমা, এ কী! এ কিসে উঠছে সকলে? বাড়ির মতো মস্ত বড় বড় বাক্স। তাতে আবার চাকা লাগানো। লোকের কথা থেকে সে বুঝল, একে না কি রেলগাড়ি বলে। এও না কি গাড়ি! কলে চলে। হেই আল্লা! পৃথিবীতে কতই না জাদু! তাদের গাঁয়ের লোক এসবের কিস্যু জানে না। এদিক-ওদিক ঘুরে একটা গাড়িতে উঠে পড়ল আলম। তারপর প্রতীক্ষা করতে করতে কখন, যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে, তা নিজেও খেয়াল করে নি।

ভোরে ঘুম ভাঙল আলমের। গাড়িতে তখন তল্পি বাঁধবার তোড়জোড়-শিয়ালদহ আসছে। সেখানে গাড়ি একবারে থেমে যাবে। কেউ যাবেন হাওড়া, কেউ ঠনঠনিয়া, কেউ শ্যামবাজার। ধর্মতলারও নাম শুনল আলম। কেমন বিচিত্র সব নাম, দেশগুলিও বিচিত্র। তাহলে এখানে নামতে হবে আলমকেও। কিন্তু এই কি সেই দেশ? এই দেশেই কি পাবে আলম সেই সুরের সন্ধান? এখানেই কি আছেন তার সুরের গুরু? কে জানে! আলম তার ছোট্ট পুঁটলিতে এগারো টাকা একষট্টি পয়সা বেঁধে নিয়ে নেমে পড়ল শিয়ালদহে।

বাইরে এসে স্তম্ভিত হয়ে গেল আলম। এত বড় বাড়ি সে কল্পনাও করতে পারে না। ভেঙে পড়বে না তো মাথায়! থমকে দাঁড়াল আলম। নাঃ, পড়বে না। ঐ তো নদীর স্রোতের মতো লোক ছুটে চলেছে। কত রকমের গাড়ি! ঘোড়ায় টানা গাড়িগুলোরই বা বাহার কত!

কতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে দেখা যায়, অতএব সামনের রাস্তা বরাবর হাঁটতে থাকল আলম।

খানিকদূর এসে আলম একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যদিও পোশাক-আশাক ভিন্নরকম, তবু একদল ছেলেকে দেখতে পেল সে। বইপত্র নিয়ে চলেছে তারা। এই পরিচিত দৃশ্য দেখে বুঝি বা একটু খুশি হয়েই তাদের দিকে এগিয়ে গেল আলম। হিতে বিপরীত হল- এই মাথামোটা গাঁইয়া ছেলেটি তাদের খেলার উপাদান হয়ে উঠল। তারা কেউ আলমের জামা ধরে টান দেয়, কেউ দেয় মাথায় টোকা, কেউ বা ওর কান ধরেই নেড়ে দেয়। কটা ছেলে তো ওর টাকার পুঁটলি ধরেই টানাটানি শুরু করে দিল।

এ কি বিপদ। প্রাণপণে দুহাতে বুকের মধ্যে পুঁটলি জড়িয়ে ধরে দ্রুত হাঁটতে থাকল আলম। ছেলেগুলিও ছুটতে থাকল তার পিছনে। অবশ্য কয়েক মিনিট মাত্র, ওদের পাঠশালার পথ ছাড়িয়ে বেশী দূরে এল না তারা। আলম সেযাত্রা অব্যাহতি পেল। একবার পিছন ফিরে ওদের দেখল আলম। এই না কি শহরের ছেলে! বাবাঃ, দরকার নেই ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। হাঁটতে থাকল সে।

এবার বেশ ক্ষিদে পেয়েছে আলমের। তেষ্টাও। আশপাশে কোথাও খানা-ডোবা বা পুকুর দেখতে পেল না আলম। কী দেশ রে বাবা! এরা কি জল খায় না! জল না পেলে বাঁচবে কী করে আলম! হায় খোদা! এ কোথায় নিয়ে এলে তাকে?

ভাবতে না ভাবতেই আলমের চোখের সামনে ভেসে উঠল বিশাল এক নদীর ঘোলাটে জলের প্রবাহ। নদ নালার দেশের মানুষ আলম, নদী দেখেই ছুটে গেল সে। এই তো তার চেনা পৃথিবী। নদীতে নদীতে ভেদ নেই, সেই একই জল, একই গতি। খুশিতে আঁজলা ভরে জল তুলে মুখে দিল আলম।

হায় খোদা! এ কী জল! দেড় দিন আগে খাওয়া মুড়িগুলো পর্যন্ত পেট থেকে উঠে এল আলমের। নুনগোলা জল। থুথু করে উঠে পড়ল আলম। এদেশের ছেলেগুলোই শুধু বিচিত্র নয়, জলও। নিরুপায় ক্ষোভে কেঁদেই ফেলল আলম। এ কোন্‌ কুহকের দেশে এল সে!



পাঁচ

ক্ষুধা ও তৃষ্ণা-এ দুটি জৈবিক তাড়না একসময় আলমের কান্নাও থামিয়ে দিল। দুপুর গড়িয়ে হল বিকেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। হঠাৎই তার নজরে পড়ল নদীর ধারে --নদীটা যে গঙ্গা তখনও জানে নি সে -- একদল লোক কী যেন ভাজছে। খাচ্ছেও অনেক লোক। তাদের পোশাক-পারচ্ছদ খুব যে পরিষ্কার তা নয়।

অনেক সাহস সঞ্চয় করে দোকানের কাছে গেল আলম। খানিক দাঁড়িয়ে থেকে জানল, যা ভাজা হচ্ছে, তাকে বলে ডালপুরী। সেও গিয়ে হাত পেতে বসল। দুপয়সার ডালপুরী আর জল খেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেল আলম। কলকাতায় এই প্রথম স্বস্তিলাভ করল সে।

এবার ঘুম। খুব বেশি চিন্তা করল না আলম। কাছেই এক গাছতলায় জামার পুঁটলিটা মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়ল সে। ঘুম আসতে একটুও দেরি হল না।

সারারাত বেঘোরে ঘুমোল সে। চোখে সূর্যের আলো লাগতে ঘুম ভেঙে গেল তার। উঠে বসে চোখ রগড়ে ভালো করে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেল আলম -- মাথার তলার জামার পুঁটলিটা নেই! এদিক-ওদিক তন্নতন্ন করে খুঁজলে সে। কিন্তু নাঃ, কলকাতার জাদুতে টাকাসহ জামাটা হাওয়া হয়ে গেছে! নিঃসম্বল ছেলেটা হু-হু করে কাঁদতে থাকল।

খানিক বাদে আলমের কান্না থামল পিঠে এক খোঁচা খেয়ে। তাকিয়ে দেখল, ডাণ্ডা হাতে এক পুলিশ। পুলিশটা তার পিঠে খোঁচা দিয়ে বলল, এই ছোকরা, কাঁদছিস কেন?

-- আমার বোঁচকা চুরি গেছে সিপাইজি!

-- চুরি! কেইসে?

সব বলল আলম। কেঁদে কেঁদেই বলল। শুনে সিপাইটি দার্শনিকের মতো হাসল। বলল, কলকাতা আজব জায়গা বাবা। এখানে টাকাওয়ালা পুঁটলি যাবেই। যা, ভাগ্‌!

বলে এক গর্জন করে সিপাইজি নিজেই চলে গেলেন।

সেদিকে তাকিয়ে চোখ মুছল আলম। কেঁদে ফল নেই। এখানে বাবা নেই, মধুমালতীদিদিও নেই। এই অচেনা রাজ্যে তাকে একা লড়াই করতে হবে, বাঁচতে হবে। পূরণ করতে হবে নিজের আকাঙ্ক্ষা। আবার উঠে দাঁড়াল আলম। হাঁটতে থাকল নদীর ধার বরাবর।

হাঁটতে হাঁটতে আলম এসে পৌঁছল এক শ্মশানঘাটে। লোকের মুখে নাম শুনল নিমতলা শ্মশানঘাট।

শ্মশান এড়িয়ে চলল আলম। শ্মশান তো জীবনের শেষ, সে তো সুরহীনের রাজ্য। অতএব সেখানে গিয়ে আলমের লাভ? তবু চোখ ফেরাতে গিয়েও ফেরানো হল না। ওখানে তিন সাধু না? হ্যাঁ, সাধুই বটে।

গ্রামের শিব মন্দিরে সাধু-সংসর্গে এসেছে আলম, পেয়েছে সুরের ছোঁয়া। তাই সাধু দেখে এগিয়ে গেল আলম। কিন্তু কলকাতার সাধুরাও কি ভিন্ন রকমের? কণ্ঠে তাদের গান কোথায়? আলম দেখল, তাদের গলায় জবার মালা, হাতে রুদ্রাক্ষ, সামনে কাঠের স্তুপে আগুন। কেউ বা সিদ্ধি ঘুঁটছে। হতাশায় আলমের চোখে জল এল। হঠাৎ এক সাধু হাতের ইশারায় ডাকল তাকে।

আলম এাগিয়ে যেতে সাধু বলল, কাঁদছিস কেন রে ব্যাটা? কাকে খোয়ালি?

আলম আরো কাঁদে। বলে, সব সাধুবাবা সব। আমার যা কিছু টাকা-পয়সা, আমার জামা।

সাধু ব্যাপারটা আন্দাজ করে নেন। বলেন খেয়েছিস?

আলম ঘাড় নাড়ে।

সাধু বলেন, হাত পাত।

হাত পাততেই কী যেন দিলেন সাধু। বললেন, নে, খেয়ে ফেল্‌। খেয়ে ফেলল আলম। সাধু বললেন, যা ব্যাটা, হাঁটতে থাক্‌ পুবমুখো। খাবার মিলে যাবে। যা।

সাধুর কথামতো পুবমুখো তাই হাঁটতে থাকে আলম। দুপুর শেষ, হয়ে তখন বিকেল ছুঁই-ছুঁই। হাঁটতে হাঁটতে ডান হাতে এক মস্ত মাঠ পেরোতেই বহু লোককে রাস্তায় বসে খেতে দেখল আলম। একদল লোক বড় বড় পাত্র থেকে লোকগুলিকে খাবার দিচ্ছে। কে একজন ঠেলা দিল আলমকে। বলল, ব্যাটা আবার সঙের মতো দাঁড়িয়ে রইলি কেন! একখানা পাতা নিয়ে বসে পড় ওখানে।

ছুটে গিয়ে পাতার স্তুপ থেকে একখানা পাতা টেনে বসে পড়ল আলম। খেতে খেতে শুনতে পেল, এক ব্যবসায়ী না কি রোজ এমনি করে কাঙালী ভোজন করান। আলম মনে মনে বলল, বেঁচে থাকুন তিনি।

বারকয়েক চেয়ে নিয়ে পেটটা বেশ করে বোঝাই করে নিল আলম। সাধু বোধ হয় এখানে খাবার বিলির কথা জানতেন। তাই সোজা পুবমুখো হাঁটতে বলেছিলেন।

খাওয়া শেষ করেই জলের কথা মনে হল তার। অন্যরা কি করে লক্ষ্য করল আলম। দেখল, রাস্তার পাশে কী একটা টিপতেই জল ঝরছে। দিব্যি খাচ্ছে লোকে। সেও খেল। খুব মজা লাগল তার। নদীর জল খাওয়া যায় না, লবণগোলা, অথচ এখানে টুপ করে টিপলেই জল! যত ইচ্ছে খাও। সত্যিই আজব শহর কলকাতা!

খাওয়া-দাওয়া শেষ হতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। কি আর করবে আলম, পাশেই এক ভদ্রলোকের বাড়ির বাইরের রকে গা এলিয়ে দিল।

কয়েকটা দিন-রাত ঐ একই বারান্দায় কাটিয়ে দিল আলম। সারাদিনে আশপাশে একটু একটু ঘুরল সে। জানল, ঐ রাস্তাটার নাম বিডন স্ট্রীট। আসবার পথে ডানদিকে যে বাগান পড়েছিল, তার নাম কোম্পানির বাগান। সোজা পশ্চিমে গেলে নিমতলা শ্মশান আর তার পাশেই মা গঙ্গা। নোনা অপেয় জল হলেও গঙ্গাকে এখন ভক্তি করে আলম। ভোর না হতেই যারা গঙ্গা স্তোত্র পাঠ করতে করতে স্নান করতে ছোটে, আলমের বড় ভালো লাগে তাদের। ভালো লাগে স্তোত্রের সুরটাও। মন কাড়া সুর। আলম আরো একটা খবর সংগ্রহ করল।

যে ভদ্রলোকের বাড়ির বারান্দায় সে ঘুমোয়, তাঁকে লোকে বলে কেদারনাথ ডাক্তার। দূর থেকে উঁকি মেরে দেখেছে আলম, ডাক্তারবাবুর কী গম্ভীর মুখ! দেখলেই ভয় করে।

সারাদিন ঘোরে-ফেরে আলম আর ভাবে, এমনি করে আলস্যে দিন কাটাতেই কি বাড়ি থেকে পালাল সে? কোথায় সেই সুরের রাজ্য?

সেদিন বিকেলে আশ্চর্যভাবে এক বিচিত্র সুর কানে এল আলমের।

কোথায় বাজছে সেই সুর? ডাক্তারবাবুর বাড়িতেই কি? এ কোন্‌ বাজনা? ঠিক ধরতে পারল না আলম। ধরা সম্ভবও নয় তার পক্ষে, তার শোনার দৌড় তো খোল-করতাল, বাঁশি, একতারা আর তবলা-সেতার অবধি! পিয়ানোর মতো বিদেশী যন্ত্র আলম দেখেও নি, নামও শোনে নি। ডাক্তারবাবুর বাড়িতে পিয়ানো আছে। ডাক্তারবাবু নিজেই উদ্যোগী হয়ে কিনেছিলেন। সময় পেলে বাজান। ছেলেমেয়েরাও বাজায়। তেমনই কোন বাজনা এসেছে আলমের কানে।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো ডাক্তারবাবুর দরজার পাশে গিয়ে, কান পেতে রইল আলম। শুনতে শুনতে সে এত তন্ময় হয়ে গেল যে, কখন দরজা খুলে ডাক্তারবাবুর স্ত্রী বেরিয়ে এসেছেন তা সে খেয়ালই করে নি। ছেলেটাকে এভাবে থাকতে দেখে তিনি জিজ্ঞসা করলেন, কী চাস রে?

ছেলেটা যেন শুনতেই পেল না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁ রে, কী চাস্‌ তুই?

এবার চোখ তুলে তাকাল আলম। বক্তার কণ্ঠস্বরে কোন বিরক্তি নেই৷ খানিক ভরসা পেল আলম। খাঁটি ত্রিপুরী ভাষায় বলল, আমি বাজনা শুনতাম আইছি।

-- বাজনা শুনবি? তুই থাকিস কোথায়?

এইটুকু স্নেহের স্পর্শও বুঝি সইতে পারল না আলম, ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ডাক্তারবাবুর স্ত্রী আদর করে তার চোখ মুছিয়ে দিলেন। তারপর প্রশ্ন করে জেনে নিলেন, ছেলেটি শুধু গান শিখবে বলে পালিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে। খায় নি ক’দিন, হারিয়েছে তার শেষ সম্বল। এখন সারাদিনে একবার খায়। তবু ভিক্ষে করে না।

ছেলেটার কথার সারল্যে, তার আকাঙ্খার বিশিষ্টতায় কী যেন একটা খুঁজে পেলেন ডাক্তারবাবুর স্ত্রী। আলমকে ডেকে ঘরে আনলেন তিনি। চাকরকে ডেকে কচুরি আনিয়ে পেট ভরে খাওয়ালেন ওকে। ওর নিজের কণ্ঠের গান শুনলেন। তারপর বললেন, তুই থাক্‌ আমার বাড়িতে। দেখি তোর কি ব্যবস্থা করা যায়।

ভেতরে ভেতরে তারপর কি কথাবার্তা হল জানে না আলম, তবে সেই রাত থেকে ডাক্তারবাবুর চিলেকোঠায় থাকা ব্যবস্থা হল তার। বাড়ির ছেলেদের পুরোনো কটা জামা-কাপড় ওর জুটল। চিলেকোঠায় শুয়ে আলমের আবার মনে হল, আজব কলকাতা! কোথা থেকে কী হয় কে বলবে!

পরদিন সকালে ডাক্তারবাবু স্বয়ং তাকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে চললেন। কোথায় চলেছেন জিজ্ঞেস করতে সাহস হল না তার। এপথ-ওপথ করে একটা মস্ত বড় বাড়ির সামনে এলেন ডাক্তারবাবু। আলম স্বপ্নেও এত বড়, এত সুন্দর বাড়ির কল্পনা করতে পারে না। যেদিকে তাকায়, তাতেই বিস্ময় আলমের। কত ফুল, কী বিরাট বিরাট থাম! ঘোড়াগুলো কেমন তেজস্বী। কী সুন্দর ঐ গাড়িটা। হেইরে! ওগুলো জ্যান্ত নয়, পাথরের মানুষ!

কিল্তু তার থেকেও বেশি বিস্ময় বোধ করল আলম, এত বড় পাথুরে বাড়িটার ভেতর থেকে সুর আসছে। সুর! যে সুরের জন্যে এমন করে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে আলম, এত কষ্ট সয়েছে, সেই সুর। ভেতর থেকে কি এক বেগ ঠেলে নিয়ে চলল আলমকে। ডাক্তারবাবু ছেলেটার সঙ্গে তাল রাখতে একটু জোরে পা চালাতে থাকলেন।

একটা ঘরের সামনে গিয়ে থমকে গেল আলম। ঘরের মধ্যে দরজার দিকে পিছন ফিরে বসে আছেন যিনি, কেমন করে আলমের মনে হল, তিনিই রাজা। আর তার উলটো দিকে ঐ তো চোখ বুজে গাইছেন গায়ক। পাশে তানপুরা বাজছে, সঙ্গত হচ্ছে মৃদঙ্গ। আলমের বুকের ভেতরটা সেই সুরে সুরে যেন নাচতে থাকল। কী করবে আলম? সে কি আনন্দে বিবশ হয়ে পড়ে যাবে? পাশের চৌকাঠ চেপে ধরল আলম।

একটু পরে সে ধাতস্থ হয়ে দেখে, ডাক্তারবাবু গিয়ে বসেছেন রাজার পাশে। এবার গায়কের হাতদুটির দিকে নজর গেল আলমের। কেমন যেন সরু সরু, সুরের সঙ্গে সঙ্গে কেমন থরথরিয়ে কাঁপছে। কে লোকটা?

একসময় গান শেষ হল। ডাক্তারবাবু রাজার সঙ্গে কী সব কথাবার্তা বললেন। রাজামশাই ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন আলমকে। ডাকলেন। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল আলম। বিশাল ঘরটার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল।

এপাশ থেকে রাজামশাই আর ওপাশ থেকে সেই গায়ক ভদ্রলোক দেখছেন আলমকে। আলম প্রথমে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। কিন্তু অচিরেই সে তন্ময় হয়ে গেল ঘরের অসংখ্য বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে। এত রকমের বাদ্যযন্ত্র আছে! আলম সব শিখবে, সব! এমন সময় গায়ক বললেন, হ্যাঁরে, তুই গান শিখবি বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিস?

আলম ঘাড় নাড়ল।

গান শিখতে গেলে যে কষ্ট সইতে হয়, তা সহ্য করতে পারবি?

আলম বলল, যে কোন কষ্ট আমি সইতাম পারুম। রাজা হাসলেন। বললেন, ওর মধ্যে নিষ্ঠা আছে গোপালবাবু। আপনি ওকে শেখান।

গোপালবাবু বললেন, রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের যখন ইচ্ছে, তখন নুলো গোপাল নিশ্চয়ই তার মূল্য দেবে।

বলে আলমের দিকে তাকিয়ে বললেন, কাল থেকে ভোরবেলা আমার বাড়িতে যাবি। আমি তোকে শেখাব। মনে রাখবি বারো বছর শুধু গলা সাধতে হবে। পারবি তো?

আবার ঘাড় নাড়ল আলম।



ছয়

পরদিন থেকে শুরু হয়ে গেল আলমের সঙ্গীতশিক্ষা।

ক্রমে সকলের পরিচয় জানল আলম। তাকে যিনি গান শেখাবার দায়িত্ব নিয়েছেন, তাঁর নাম গোপালকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। পক্ষাঘাতে তাঁর হাতদুটো শুকিয়ে গিয়েছিল বলে লোকে তাঁকে বলে নুলো গোপাল। তিনি নিজেও বলেন। কলকাতায় তো বটেই, কলকাতার বাইরেও ছড়িয়েছে গোপালের নাম।

গোপালকৃষ্ণ থাকেন রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়িতে। প্রথম দিন ঠিকই ভেবেছিল আলম। সেদিন যিনি ঘরের মধ্যে বসে গান শুনছিলেন, তিনি রাজা-ই। রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর। দ্বারকানাথ - দেবেন্দ্রনাথ - রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারেরই এক শাখা এই ঠাকুর পরিবার। এঁরাও সমপরিমাণে বিদ্যানুরাগী ও ধনী। সেকালের গান-বাজনায় ও নানারকম সাংস্কৃতিক উন্নতিতে এই ঠাকুরবাড়ির অবদানও কম নয়। সৌরীন্দ্রমোহনের আমল থেকে পাথুরেঘাটা ঠাকুরবাড়িতে বাংলাদেশের প্রায় সকল জ্ঞানী-গুণীজনেরই পদধূলি পড়েছে। সেই বাড়িতেই আলমের সঙ্গীত-সাধনা শুরু হল।

প্রতিদিন ভোরে নিমতলায় গিয়ে গঙ্গাস্নান করে আলম। তারপর সোজা চলে আসে পাথুরেঘাটায়। রাজার বাড়ি গুরু গোপালকৃষ্ণের ঘর তার চেনা, সোজা সেই ঘরে চলে যায় আলম। গুরুর নির্দেশমতো কাজ করে চলে। একবার মাত্র দুপুরের শেষে সেই ধনী বাড়ির কাঙালী-বিদায়ের খাওয়া খেতে যায়, রাত্রে আসে ডাক্তারবাবুর চিলেকোঠায়। এছাড়া একমুহূর্তও সময় নষ্ট করে না আলম, স্থির অবিচলভাবে মেতে থাকে তার সাধনায়।

গোপালকৃষ্ণ তাঁর এই ক্ষুদে শিষ্যের নিষ্ঠায় খুব খুশি, এই তো চাই। উপযুক্ত উপাদান পাওয়া গেছে, এখন একটু-একটু করে পালিশ দিতে হবে এর উপর, খাঁটি হীরে করে তুলতে হবে। এতে ধৈর্যহারা হলে হবে কেন?

ধৈর্যের এতটুকু কমতি নেই আলমের। চার বৎসর শুধু গুরুর গান আর তানপুরা-বাদন শুনেই কাটিয়ে দিল আলম। ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত হতে থাকল তার কান আর মন। একদিন স্বরগ্রামের সঙ্গে গলা মেলাতে দিলেন গুরু। সাতটি স্বরকে কত বিচিত্র সজ্জায় কত বিচিত্র ক্রমেই না সাজিয়ে দিলেন তিনি! আলম গুনে দেখল, একে একে তিনশ ষাট রকম পদ্ধতিতে গলা সাধার অভ্যাস করিয়েছেন গুরু।

আলমের স্বর-সাধনা কান পেতে শুনলেন গোপালকৃষ্ণ। যা চেয়েছিলেন, তা-ই হচ্ছে। সহজাত মিঠে গলা আলমের, এখন তাতে প্রত্যেকটা স্বরের প্রত্যেক শ্রুতি স্পষ্ট এবং শুদ্ধভাবে ধরা পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে দমও বেড়েছে। এইবার এর সঙ্গে মৃদঙ্গের বোল শেখাতে শুরু করলেন গুরুজি।

মৃদঙ্গ অবশ্য নিজে শেখালেন না গোপালকৃষ্ণ। তাঁর গানের সঙ্গে মৃদঙ্গ বা তবলা বাজাতেন, নন্দ ভট্টাচার্য। গুরুজির নির্দেশে তাঁর কাছেই আলমের শিক্ষা শুরু হল।

বেশ চলছে আলমের দিনগুলো। অসীম ধৈর্যে সে নুলো গোপাল আর নন্দ ভট্টাচার্যের সব বিদ্যা তিল তিল করে আয়ত্ত করে নিচ্ছে। এমন সময় এক আকস্মিক দুর্বিপাক আলমকে আবার অসহায় করে দিল। বিমূঢ় হয়ে গেল আলম।

অকস্মাৎ কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ল এক আতঙ্ক -- প্লেগ। ইঁদুর মরা দেখলেই লোকে ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালাতে লাগল। লোক যেমন মরছে, তেমন চলেও যাচ্ছে দূরে দূরান্তরে। সেখানেও বিপদ। কেউ কলকাতা থেকে এসেছে শুনলে ঠাঁই মেলে না। তবু প্রাত্যহিক মৃত্যু আর পলায়নে কলকাতা ফাঁকা হয়ে এল।

এই সাত বছরে ভোরে নিত্য গঙ্গাস্নান আলমের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ইদানীং নিমতলায় এলে আলমের মনটা উদাস হয়ে যায়। অবিরত হরিধ্বনি দিয়ে লোক আসছেই, সার সার চিতা জ্বলছেই। মৃত্যুর এই অবাধ লীলা দেখতে দেখতে হঠাৎ নিজের প্রতি মমতা জন্মায় আলমের। যদি সেও মারা যায়! জানতেও পারবেন না তার বাবা-মা, মধুমালতীদিদি কিংবা বড়দা আফতার হোসেন। কিংবা যদি তাদের কেউই! অমঙ্গল আশঙ্কায় চিন্তাটা তাড়াতাড়ি ঝেড়ে ফেলে আলম। দ্রুত স্নান সেরে সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। গত রাতে গুরু বলেছেন অজ নূতন পাঠ দেবেন। অধীরতায় আলমের আর সবুর সইছে না।

কিন্তু কী হয়েছে আজ পাথুরেঘাটার এই বাড়িটায়? এত ভোরে এত জনসমাগম কেন? উৎসব? উৎসব হলে সবাই নীরব কেন; সকলের পাশ কাটিয়ে একতলার এক কোণে গানের ঘরের দিকে এগোতে থাকে আলম।

ঘরের দরজা খোলা। ভেতরে উঁকি দিল আলম। ডাকল গুরুজিকে। কিন্তু কোন সাড়া এল না। আলম ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকল। ঘর ফাঁকা। বিছানাটা পর্যন্ত নেই। শুধু যন্ত্রগুলো যেমন সাজানো থাকে, ঠিক তেমনি রয়েছে।

হঠাৎ একটা তীব্র কান্নার শব্দে চমকে উঠল আলম। লোকটির নাম ঠিক জানে না সে, তবে লোকটা আসত গোপালকৃষ্ণের বাজনা শুনতে। ঘরে ঢুকে বিছানাছাড়া খাটটার ওপরেই লুটিয়ে পড়েছেন। কী ব্যাপার!

একটু পরেই ব্যাপারটা শুনল আলম। গত রাতে সে বাড়ি যাওয়ার পর গোপালকৃষ্ণের শরীরে প্লেগ আক্রমণের চিহ্ন প্রকাশ পায়। ঐ রোগে চিকিৎসার অবসর মেলে না। রাজাসাহেব তবু ডাক্তার ডেকে আনেন। কিন্তু তার আগেই গোপালকৃষ্ণ ইহলোক ত্যাগ করেছেন।

রাজবাড়ির লোকেরা কাউকেই বেশীক্ষণ থাকতে দিল না ঐ ঘরে। ঘরের সব কিছু ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতে হবে। কে জানে, কোথায় কোথায় লুকিয়ে আছে প্লেগের জীবাণু!

শূন্য মনে রাজবাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল আলম। গত রাতেও সস্নেহে যে মানুষ নূতন পাঠ দেবার অঙ্গীকার করেছেন, মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তিনি চলে গেলেন সকলরকম স্নেহ-মমতার বাইরে। এবার কী করবে আলম? কোথায় যাবে?

ডাক্তারবাবুর চিলেকোঠায় পাথরের মতো পড়ে রইল আলম। খেতেও ভালো লাগছে না তার।

দিন সাতেক এমন শূন্যতার মধ্যে কেটে গেল আলমের। তারপর ধীরে ধীরে আবার সে লোকের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করল। ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না, তাকে যে নূতন গুরু খুঁজে নিতে হবে, তাকে যে - সঙ্গীতের রাজ্য জয় করতেই হবে।

হঠাৎই সেদিন নন্দ ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আলমের। হনহন করে চলেছেন ভট্টাচার্যমশাই। আলম ডাকল মৃদুস্বরে। পিছু ডাকার জন্য যদি ভট্টাচার্যমশাই রেগে যান! তার চেয়ে বরং পিছ পিছু যাওয়া যাক তাঁর। আলম নন্দবাবুর পিছু নিল।

নন্দ ভট্টাচার্য চলতে চলতে সিমুলিয়ার এক মস্ত বাড়িতে ঢুকলেন। আলম বাড়িটা চিনল। এটাকেই বলে সিমলের দত্তবাড়ি। ঐ বাড়ির ছেলে হাবু দত্তের নাম শুনেছে আলম গোপালকৃষ্ণের মুখে। বিলিতী বাজনায় হাবু দত্তের না কি জুড়ি নেই। রামপুরের নবাব খবর পেয়ে তাঁকে না কি অনেক সাধ্যসাধনা করে কিছুদিনের জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের দরবারে। সেখানে সমান আদরে রেখেছিলেন নিজ ওস্তাদ উজির খাঁর সঙ্গে।

দত্তবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রইল আলম।

এই দত্তবংশকে সিমুলিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন রামমোহন দত্ত। সুপ্রিম কোর্টের বিখ্যাত উকিল ছিলেন তিনি। বিপুল বিত্ত রেখে তিনি মারা যান। কিন্তু তাঁর পুত্র দূ্গার্চরণ মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে বিশ্বনাথ নামে এক শিশুপুত্র রেখে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে যান। এই বিশ্বনাথ দত্তের পুত্র নরেন্দ্রনাথই পরে বিবেকানন্দ নামে জগদবিখ্যাত হন।

হাবু দত্ত হলেন বিবেকানন্দের জ্ঞাতি ভাই। দত্তবাড়ি তখন শরিকী অনেক টুকরো হয়ে গেছে। তবু দত্তবাড়ি তখনকার কলকাতার এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র! গোটা বংশে তখন বিশ ত্রিশটি যুবক। এক-একজন এক-এক দিকে দিকপাল। জ্ঞান-বিজ্ঞানে, স্বাস্থ্যচর্চায়, নূতন নূতন সামাজিক আন্দোলনে দত্তবাড়ি পুরোধাদের অন্যতম।

গান-বাজনার চর্চাও কম নেই এ বাড়িতে। স্বয়ং নরেন্দ্রনাথ যে কী ভালো গান গাইতে পারেন, তা তখনকার বহু মানুষ ভালো করেই জানেন, বিশেষ করে জানেন রামকৃষ্ণ-শিষ্যেরা।

কিন্তু নরেন্দ্রনাথের ঐ জ্ঞাতি ভাইটি হলেন একেবারে দলছাড়া। বাপ-মা মারা গেছেন আগেই। না বিয়ে-থা, না লেখাপড়া। শুধু গান আর বাজনা। এ শুধু হাবু দত্ত নয়, তাঁর ভাই টম দত্তও। পোশাকী নাম তাঁদের অমৃতলাল আর সুরেন্দ্রনাথ। তাঁদের বাজনা এত জনপ্রিয় যে, পোশাকী নামের বদলে ডাকনামেই তাঁরা সর্বজনে পরিচিত ছিলেন।

কোন্‌ বাজনা বাজান হাবু দত্ত? ক্ল্যারিওনেট বাজনায় তাঁর জুড়ি ছিল না। শুধু কি ক্ল্যারিওনেট, বেহালা, বাঁশি, সেতার, ম্যাণ্ডোলিন, ব্যাঞ্জো ইত্যাদি যত দেশী-বিদেশী বাদ্যযন্ত্র সবেতেই তিনি সিদ্ধহস্ত।

হাবু দত্তই দেশী-বিদেশী বাদ্যযন্ত্র একত্রে মিশিয়ে কনসার্ট বাজানো চালু করেন। সেটা চালু হল আমাদের, যাত্রায়, থিয়েটারে। সেই ন্যাশনল থিয়েটারের আমল থেকে থিয়েটারের নাটকে কত যে গানের সুর দিয়েছেন হাবু দত্ত তার ঠিক-ঠিকানা নেই। এহেন হাবু দত্তের বাড়ির সামনে দুরুদুরু বক্ষে দাঁড়িয়ে রইল আলম।

কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেই আলম বুঝল, এ বাড়িতে পাথুরেঘাটার ঠাকুরবাড়ির মতো অত দারোয়ানও নেই, প্রবেশ প্রস্থানের অত কড়াকড়িও নেই।

তব ঢুকবে কিনা ভাবছে, এমন সময় ডানাদকের দালানগুলো থেকে ভেসে এল বিচিত্র বাজনার সুর। বুকের ভিতরটা যেন উদ্দাম হয়ে উঠল আলমের, কিছু ভাবনাচিন্তা না করেই সে ছুটে গেল সেই ঘরটার সামনে, যে ঘর থেকে আসছে বাজনার শব্দ।

ঘর-বোঝাই শৌখিন মানুষ। বসে, দাঁড়িয়ে নানা ধরনের বাজনা বাজচ্ছেন নানা জন। রোগা মতো একটা মানুষ সমস্ত বাদ্যযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করছেন ঘাড় দুলিয়ে, হাত নাড়িয়ে। আলম বুঝল, উনিই হাবু দত্ত। তার মনে হল, এ বাদনের বিদ্যা আয়ত্ব না করতে পারলে জীবন বৃথা।

বাজনা থামতেই পাগলের মতো ছুটে গিয়ে আলম লুটিয়ে পড়ল হাবু দত্তের পায়ে। হাবু দত্ত পা ছাড়াবার চেষ্টা করে বললেন, কী চাস? কী চাস তুই?

আলম বলল, শুধু আপনার পায়ের তলায় পড়ে থাকতে চাই। বলে চোখের জলে ভিজিয়ে দিল তাঁর পা।

আলমের কান্না থামিয়ে তার সব কথা শুনলেন হাবু দত্ত। শুধু তিনিই শুনলেন না, শুনলেন উপস্থিত সবাই। সব শুনে একজন রসিকতা করলেন - বহুৎ আচ্ছা। তুই তাহলে থাকিস রাস্তায়, খাস লঙ্গরখানায়, আর চাইছিস হাবু দত্তের কাছে বাজনা শিখতে। বুঝলে হে হাবু দত্ত, তোমার শিষ্য হবার উপযুক্ত পুরুষই বটে।

লোকটির বলার কায়দায় সকলে হো-হো করে হেসে উঠলেন।

আলম তাকাল সকলের দিকে। বুঝল, তার মতো পথের ভিখারির এখানে আসা ঠিক হয় নি, এখানে দয়া করবে না কেউ।

কিন্তু হাবু দত্তের দিকে তাকিয়ে যেন অন্যরকম লাগল আলমের। তাঁর চোখে তো উপহাস নেই। তিনি তো আগ্রহের চোখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। তবে কি আলমের ইচ্ছা পূরণ হবে? আলম তার দেশী ভাষায় বলল, এ বাজনা না শিখলে আমি বাঁচতাম না।

হাবু দত্ত তার পিঠে থাবড়া মেরে বললেন, সাবাস ব্যাটা। এই তো চাই। জীবনের সব কিছু না ছাড়লে সুরের রাজ্যে ঢোকা যায় না। তুই যখন সকলের স্নেহের মায়া কাটিয়ে এসেছিস, তোর হবে। আমি তোকে শেখাব।

* * * *

হাবু দত্তের সঙ্গে আলমের স্বভাবে খুব মিলে গেল। এতখানি নিষ্ঠা এর আগে আর কারো মধ্যে দেখেন নি হাবু দত্ত। ফলে ভাণ্ডার উজাড় করে শেখাতে লাগলেন তিনি আলমকে। গোপালকৃষ্ণ সাত বছরে আলমের কানটাকে এমন তৈরি করে দিয়েছেন যে, কোন কিছুই বার বার দেখাতে হয় না তাকে। অন্যে যা শিখতে এক বছর সময় নেয়, আলম তা তুলে নেয় এক মাসে। ষতরকম বাদ্যযন্ত্র ছিল হাবু দত্তের সংগ্রহে, সবরকম বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শিখছে আলম। শিখছে স্বরলিপি তৈরি করতে।

শিষ্যের আগ্রহ আর তৎপরতা দেখে হাবু দত্ত বিস্তর গৎ শেখালেন তাকে। একদিন বললেন, তুই কি ডাকাত না কি রে আলম? তুই যে আমাকে ফতুর করে দিলি!

কিছুদিন বাদে হাবু দত্ত বললেন, চল্‌ আলম, তোর একটা চাকরি ঠিক করেছি। তুই সেখানে চাকরি করবি।

আলমকে নিয়ে হাবু দত্ত গেলেন মিনার্ভা থিয়েটারে। সে থিয়েটারের ম্যানেজার তখন নটগুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষ। তাঁর একটার পর একটা নাটক অভিনয় হচ্ছে আর লোকে যেন পাগল হয়ে উঠছে, এমনি তাঁর লেখার গুণ, এমনই পরিচালনা ও অভিনয়ের ক্ষমতা। এসব নাটকে গান-নাচের আয়োজনও কম নেই। নৃপেন বসু বা নেপা বসুর নাচ বাজার মাত করেছে তখন। অন্য থিয়েটারেও চলছে নেপা বসুর নাচের নকল। মিনার্ভা থিয়েটারে তখন এসব নাচের সঙ্গে তবলা বাজান শশী সাহা। সাহামশাই বাজান ভালোই, তবে না তখন তিনি একে হয়েছেন বৃদ্ধ, তায় শুরু করেছেন আফিংয়ের নেশা। ফলে ঝিমুতে থাকেন অবিরাম। কয়েকদিন নাচের সময় ঠিকমতো বাজাতে ভুলেই গেলেন।

বিরক্ত হয়েই গিরিশচন্দ্র হাবু দত্তকে বলেছিলেন একজন তবলচি যোগাড় করে দিতে। সেখানেই আলমকে নিয়ে এলেন হাবু দত্ত।

গিরিশচন্দ্র চাকরকে ইঙ্গিত করলেন, সে একজোড়া বাঁয়া তবলা এনে দিল। গিরিশচন্দ্র বললেন, বাজাও।

আলম বাজাতে শুরু করল।

অতটুকু ছেলের অত নির্ভুল বাজনা শুনে নটগুরু হাবু দত্তকে বললেন, তোমার সংগ্রহটি তো খাসা। কিন্তু এখানে এসে আবার টেঁসে না যায়।

হাবু দত্ত বললেন, সম্ভবত তা হবে না। অনেক পোড় খাওয়া মেটে হাঁড়ি।

গিরিশচন্দ্র বললেন, তবে আজ থেকেই লেগে যাক।...ওরে, তোর নাম কী রে?

আলম তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বলল, আজ্ঞে আলাউদ্দিন খাঁ।

-- উঁহু। ওসব মুসলমান নাম এখানে চলবে না। তোর মুখটা বেশ খুশি-খুশি, প্রসন্ন। তোর নাম দিলুম প্রসন্ন বিশ্বাস। দেখিস বাবা, বিশ্বাসভঙ্গ করিস নি যেন।

বলেই হো-হো করে হেসে উঠলেন বঙ্গরঙ্গালয়ের জনক।

সেই দিন থেকেই আলম ‘প্রসন্ন বিশ্বাস’ হয়ে লেগে গেল থিয়েটারের দলে। এখানে কত জ্ঞানী-গুণী আসেন। সৎসঙ্গে অনেক কিছু জানতে পারবে, এ-ই তার আশা।

কাজ খুব বেশি নয়। কিন্তু যা ভেবেছিল আলম, তা হল না। থিয়েটারে একঘেয়ে জীবন, নূতন কিছুই সেখানে শিখতে পেল না আলম, ব্যথাভরা মন নিয়ে অবসরের দিনগুলো ঘুরে বেড়ায় সে।

এক সান্ধ্য অবকাশে ফোর্ট উইলিয়ামের পাশে গঙ্গার ধারে চুপ করে বসে আছে আলম। সহসা বেজে উঠল ফোর্টের ব্যান্ড। গোরাদের ব্যান্ড বাজনার নাম শুনেছে আলম, কিন্তু সেটা যে এমন তা জানত না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে সেই বাজনা শুনল আলম। তারপর মনে মনে ঠিক করল, এ বাজনা তাকে শিখতেই হবে। নইলে এ জীবন বৃথা।

দূর থেকে বাজনদারদের দেখে কে তাদের প্রধান বুঝে নিল আলম। সাহেবটি বের হতেই তার পিছন পিছন চলতে থাকে সে। এখন কলকাতা আলমের অচেনা নয়। ময়দান পার হয়ে সাহেব চলেছে ধর্মতলার পথ ধরে। খানিক এগিয়ে এক গলিতে ঢুকল সাহেব।

বাড়িটা দেখে নিল আলম।

সামনের একটা পান-সিগারেটের দোকান থেকে সাহেবের পরিচয় জেনে নিল আলম। লেবো সাহেব নামে পরিচিত তিনি। জাতে গোয়ানীজ, ভারী বদরাগী লোক। মেম সাহেবকে নিয়ে বাস করেন এ বাড়িতে। ছেলেমেয়ে নেই।

আলমের ভয় হল বদরাগী শুনে। কিন্তু ঐ বদরাগী মানুষটাকে রাজি না করাতে পারলে তো চলবে না। কি করবে আলম? হাল না ছেড়ে দিনের পর দিন লেবো সাহেবের পিছনে এবং তার বাড়ির চারিদিকে ঘোরাঘুরি করতে থাকল আলম।

লেবো সাহেবকে রাজি করাতে পারার আগেই আর এক জায়গায় বাঁধা পড়ল আলম। একদিন মেছোবাজারের কাছ দিয়ে যেতে যেতে সানাই-এর সুরে তন্ময় হয়ে গেল আলম। বাজাচ্ছেন হাজারী ওস্তাদ। তেলাপোকা যেমন কাঁচপোকাকে টানে, হাজারী ওস্তাদের সুরও তেমন আলমকে টেনে নিয়ে গেল, বাজনা শেষ হতেও আবিষ্ট ভাব কাটল না আলমের।

ছেলেটার ভাব দেখে খুশি হলেন হাজারী ওস্তাদ। বাজনা শুনে এমন আবেশ তো যার-তার ভিতর আসে না। ওস্তাদ শুধালেন, তোমার কী চাই বাপজান?

আলম বলল, ওস্তাদ। আমি আপনের পায়ের নখেরও যোগ্যও না। আমারে একটু সানাইয়ে তালিম দিবেন?

হাজারী ওস্তাদ জীবনে এমন আবেদন শোনেন নি। তিনি বললেন, যদি তুমি নিতে পার, আমার সব তোমাকে দেব।

সত্যই উজাড় করে দিলেন হাজারী ওস্তাদ। আলম নিলও৷ ক’মাসের মধ্যেই সানাই, টিকারা, নাকাড়া শেখা হল আলমের।

কিন্তু লেবো সাহেবের বেহালা? তাঁর ব্যান্ড? তখনও হাল ছাড়ে নি আলম। লেবো সাহেবের পিছনে তখনও ঘোরে, তখনও পাক খায় বাড়িটার চারদিকে। লুকিয়ে লুকিয়ে বাজনা শুনে মনে মনে সুর তুলে নেয়।

কিন্তু যন্ত্র কোথায়? কোথায় গুরুর শিক্ষা? এখনও যে সাহেবের সামনে দাঁড়াতেই সাহস হয় না। একদিন সাহেব দরজা খুলে-বের হতেই বেপরোয়ার মতো তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াল আলম। সাহেব থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, ক্যা মাংতা?

যেন সিংহ- গর্জন হল।

ভয়ে ভয়ে আলম বলল, বেহালা বাজনা শিখুম।

নাক-মুখ কুঁচকে সাহেব বললেন, ক্যা?

তারপরেই আলমের প্রার্থনাটার অর্থ বুঝে আঙুল নেড়ে হাত ছুঁড়ে চীৎকার করে উঠলেন -ভাগ হিঁয়াসে!

আলম ভয় পেলেও ভাগতে পারল কই? এমন করে কোথাও ব্যাহত হয় নি আলমের ইচ্ছা, কেউই তাকে তাড়িয়ে দেয় নি। এমন বিতাড়নের সামনে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়েই রইল আলম। একটা হুঙ্কার ছেড়ে পাশ কাটিয়ে নিজেই চলে গেলেন লেবো সাহেব।

এবার কি কান্নায় ভেঙে পড়বে আলম? কিন্তু তার আগেই তার জামার কলারে টান পড়ল। কে? ঘুরে আরো হতবাক হয়ে গেল আলম, তাকে ডাকছেন স্বয়ং মেমসাহেব! সাহেবের হাত থেকে যদি বা নিস্তার মিলেছে, মেমসাহেব এবার তাকে চপ-কাটলেট না বানিয়ে ফেলেন! আলম নির্বোধের মতো চোখ তুলে তাকাল মেম-সাহেবের দিকে।

মেমসাহেব বললেন, তুম বেহালা বাজনা শিখিতে চাও?

ঘাড় নাড়ল আলম।

মেমসাহেব তাকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন। বসালেন বৈঠকখানায়। তার হাতে বেহালা দিয়ে বললেন, বাজাও।

মাথা নীচু করল আলম। বলল, আমি বাজাতে জানি না মেমসাহেব। আমি শিখবার চাই।

মেমসহেব আর একটা বেহালা আনলেন। তিনি বাজালেন একবার। মুহূর্তে আলম নিজের বেহালায় তা তুলে বাজিয়ে দিল। মেমসাহেব অবাক। আর একরকম বাজালেন তিনি। আলম সেটাও তুলে বাজিয়ে দিল। মেমসাহেব আনন্দে বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ইউ নটি বয়! তুমি বাজাইতে জানে।

আলম বলল, না, জানি না মাইজি। শিখতাম।

মেমসাহেব খুশিতে হাসলেন!

সেই থেকে সাহেব ফোর্টে গেলে লুকিয়ে লুকিয়ে আলমকে বেহালা বাজানো শেখাতে লাগলেন মেমসাহেব, আর আলমও যত দ্রুত পারল মেমসাহেবের গোপন দান তুলে নিতে লাগল।

কিন্তু এ চুরি বেশিদিন চলল না। একদিন অসময়ে বাড়ি ফিরে এলেন লেবো সাহেব, হাতেনাতে ধরা পড়ে পড়ে গেল আলম আর মেমসাহেব। কিন্তু ও কি! সাহেব তো আগুনের মতো জ্বলে উঠলেন না! উলটে তাঁর চোখ-মুখ থেকে খুশির ঝলক ঝরে পড়ছে!

আলমের পিঠ চাপড়ে তিনি বললেন, তুমি এত ভালো বাজাইতে শিখিয়াছ? তবে আমিই শিখাইব। আলম যেন হতে স্বর্গ পেল। কিন্তু শুধু লেবো সাহেবের কাছে শিখলেই তো হবে না, নিজের রেওয়াজের জন্য যন্ত্রও তো কেনা চাই। অনেক যন্ত্র।

টাকা?

তারও একটা ব্যবস্থা হল। লেবো সাহেব আলমকে ফোর্টের ব্যাণ্ডে ভর্তি করে দিলেন। এদিকে মিনার্ভার চাকরিও চলছে। কোন আয় থেকে একটা পয়সাও খরচ করে না আলম, সব জমায়। এখনও খায় সেই লঙ্গরখানায়। তাতেই দিন চলে যায় আলমের। একদিকে লেবো সাহেব, অন্যদিকে হাজারী ওস্তাদ। টাকাও জমছে। যন্ত্রগুলো নিশ্চয়ই হবে। আঃ, স্বর্গ কত দূর?

কিন্তু সে স্বর্গে আর পৌঁছানো হল না আলমের।

একদিন মিনার্ভা থেকে বের হতেই ভূত দেখার মত চমকে উঠল আলম। সামনে কে দাঁড়িয়ে! তার দাদা আফতারউদ্দিন!

আফতার হাত চেপে ধরলেন আলমের। বললেন, সকলকে কাঁদিয়ে এ তুই কোথায় পড়ে আছিস? ফিরে চল্‌ বাড়িতে।

আফতারউদ্দিন আলমকে টেনে নিয়ে চললেন শিয়ালদহের দিকে। সেখান থেকে ট্রেনে করে গোয়ালন্দ, গোয়ালন্দ থেকে ক্রমে শ্যামগঞ্জের লঞ্চ হয়ে শিবপুরে।

আলম এসে দাঁড়াল তার অতিপুরাতন বন্দীশালায়।




পরবর্তী পর্ব পড়তে ক্লিক করুন


No comments:

Post a Comment