লেখক: নীরদ হাজরা
প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
সাত
আলম বাড়ি ফিরে আসতে গোটা বাড়ি জুড়ে উৎসব শুরু হয়ে গেল।
মা ছুটে এলেন, বাবা এলেন, এলেন প্রতিবেশীরা। সংবাদ পওয়া মাত্র ছুটে এলেন মধুমালতীদিদি। হাসি-আনন্দ-কান্না, অথচ সব মিলিয়ে উৎসব। সবাই খুশি।
শুধু সে উৎসবে প্রাণ খুলে যোগ দিতে পারল না আলম নিজে। অবশ্য সাত-আট বছরে যে ছেলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছে, প্রায় ন বছর পরে যোল-সতের বছরে সেই ছেলে ফিরে এলে বাড়িকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। এটাই স্বাভাবিক। এজন্যে আলমের গম্ভীর হয়ে থাকায় কেউ কিছু মনে করলেন না।
থাকুক আলম গম্ভীর, না মিশুক সে সকলের সঙ্গে, তবু সকলে খুশি। খুশির মন্ত্রটা আরো বেশি এই কারণে যে, তারা অলমের যে পরিবর্তন আশঙ্কা করেছিলেন, তার কিছুই নেই আলমের মধ্যে। সেই গোবেচারা, সেই বোকা-বোকা ছেলেটই মাথায় কিছু লম্বা হয়ে ফিরে এসেছে। অথচ তারা কত দুশ্চিন্তাই না করেছিলেন!
অবশ্য দুশ্চিন্তা করাটা তাদের পক্ষে অন্যায় নয় কারণ সেকালে লোকে কলকাতা সম্পর্কে ভাল ধারণা পোষণ করতেন না। কলকাতা এক কুহকের দেশ। সেখানে আকাশ-ছোঁয়া বাড়ি, সান-বাঁধানো পথ, কল টিপলে জল। সেখানে মেয়েরা পুরুষের সামনে পথে বের হয়, বাজার করে, ঘোড়ায় চড়ে। সেখনে যে ছেলে যায়, সে কি আর ভাল থাকে? তার ওপরে যিনি আলমের কলকাতায় থাকার সংবাদ এনেছিলেন, তিনি প্রচার করেছিলেন যে, আলমকে তিনি কোন ভদ্র জায়গায় দেখেন নি। যেখানে মেয়েরা রঙ মেখে নাচে গায়, পুরুষের সঙ্গে মিশে থ্যাটার করে, সেই নরকের দ্বারে তিনি দেখে এসেছেন আলমকে।
এই সংবাদ শুনেই আরো কন্নাকাটি শুরু করেছিলেন আলমের মা। নইলে ন বছরে শোক তাঁর কমে এসেছিল। হারিয়ে-যাওয়া ছেলের জন্যে তাঁর চোখের জল যে কখনই ঝরত না, মন কখনই ভার হয়ে উঠত না, তা নয়, তবে মৃত্যুশোকের মত এ হারানোর শোকও তিনি মেনেই নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ছেলে বেঁচে আছে অথচ আছে অতি নোংরা জায়গায়, একথা শুনে তিনি আর স্থির থাকতে পারেন নি। আফতার মাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, তুমি শান্ত হও মা, আমি নিজে যাচ্ছি, তাকে নিয়ে ফিরে আসব।
সত্যিই নিয়ে এলেন আফতার, কিন্তু এ কোন আলমকে নিয়ে আসা হল?
মধুমালতীদিদি বললেন, সদ্য কলকাতা ছেড়ে এসেছে। ওর মন খারাপ থাকতেই পারে। এখানে মন বসতে সময় লাগবে।
একটু থেমে বললেন, এক কাজ করলে হয় না?
মা বললেন, কী?
আলমের বিয়ে দাও।
কথাটা মন্দ লাগল না মার। নূতন বাঁধনে বাঁধতে পারলে নিশ্চয়ই মন বসবে ছেলের। সত্যি সত্যি তো আর বিগড়ে যায় নি ছেলেটা। তাহলে এ কদিনে কিছুই বোঝা যেত না?
আলমের বিয়ের কথা সদু খাঁকে বললেন আলমের মা।
সদু খাঁ বললেন, বেশ কথা। দাও বিয়ে। কনে তো ঠিকই আছে।
মধুমালতীর মনে পড়ল কথা একটা দেওয়া আছে বটে। বাবার বন্ধু বসির মিয়া, তিনিও গানের রাজ্যের মানুষ। বাজান বাঁশি। এই বাজানোর সূত্রেই দুজনে বন্ধু। এই-সূত্রেই অনেক কাল আগে বসির মিয়ার মেয়ে মদনমঞ্জরীর সঙ্গে আলমের বিয়ের কথা হয়েছিল দুই বন্ধুতে। কিন্তু আজ কি বসির মিয়া মানবেন সে কথা? তাঁর মেয়ে মদনমঞ্জরীর বয়স বছর আট-নয় হল। মেয়েটিকে দেখেছেন মধুমালতী। ভারী মিষ্টি মুখখানা। সুন্দর গড়ন। ও মেয়ের পাত্রের অভাব হবে না। মধুমালতী ভাবছেন, এদিকে আমাদের ছেলের আবার বদনাম রটেছে-ঘর-পালানো ছেলে, কলকাতায় থেকেছে, তাকে দেখা গেছে অতি খারাপ জায়গায়। যদি বসির মিয়া রাজি না হন!
সদু খাঁ বললেন, হুঁ, রাজি না হলেই হল!
বাদানুবাদে আর কালক্ষেপ না করে পরদিনই পুরনো প্রস্তাব নূতন করে তোলা হল। বসির মিয়া লাফিয়ে উঠলেন, রাজি হব না মানে? কথার খেলাপ করব না কি? ও মেয়ের দুমাস বয়সে আমি কথা দিয়েছি না!
অতএব সাজ-সাজ রব পড়ে গেল দুই বাড়িতে। যাদের বিয়ে, তাদের একজন লাফিয়ে এক্কা-দোক্কা খেলতে থাকল, অন্য জন বসে রইল গুম হয়ে। তাদের জিজ্ঞাসা করবার কথা কেউ মনেও আনল না।
ধুমধামের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল আলমের।
সবচেয়ে আনন্দ করলেন মধুমালতীদিদি। তাঁর সবচেয়ে আদরের ভাই আলমের বৌ এল ঘরে, দিদি বৌকে যে কত ভাবে সাজালেন তার ঠিক নেই। আহা! ঘর আলো করা বৌ! এমন বৌ না এলে মানায়।
অনেক রাত হয়ে গেল শুতে।
নব বর-বধূকে ঘরে রেখে সকলে চলে গেলেন। সারাদিনের ধকলে মেয়েটা তখন অবসন্ন। কথা বলা দুরে থাক, যৌতুক পাওয়া টাকাগুলোও ভালো করে গুছিয়ে রাখতে পারল না সে। কোন ক্রমে সেগুলো মাথার কাছে ছড়িয়ে রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।
আলম এই প্রথম ভালো করে দেখল মেয়েটিকে। আহামরি কিছু বলে বোধ হল না তার। তার মনে প্রশ্ন জাগল? এই মেয়েটিই কি এসেছে তাকে সুরের জগৎ থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে?
কী করবে আলম? সে কি তার সুরের জগৎকে বিদায় জানাবে? এখানে এই গ্রামে বসে জমি চাষ করবে? মাছ ধরবে? মুরগী পুষবে? ছাগল পুষবে? গরুর দুধ দুইবে আর জাবনা মাখবে? মাথাটা গরম হয়ে উঠল আলমের। ঘুম এল না চোখে।
একসময় উঠে বসল আলম। মেয়েটার দিকে আবার তাকাল। তারপর ওর মাথার কাছে ছড়িয়ে থাকা যৌতুকের টাকাগুলো তুলে নিয়ে দরজা খুলে নেমে এল উঠোনে। বেশ সাবধানে পার হল বাড়ির উঠোন। আড়ালে আড়ালে পার হল গ্রাম। তারপর দে দৌড়!
একেবারে মানিকগঞ্জের স্টীমারঘাটে এসে থামল আলম।
* * * *
কলকাতায় এসে এবারও প্রথম গঙ্গার ঘাটে এল আলম। স্নান করতে নামতে সাহস পেল না। খানিক বসে থেকে হাঁটা শুরু করল পূবমুখো। টাকাগুলোর একটা গতি করা দরকার। এ টাকা যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণই হারাবার ভয়। তার থেকে যে জন্যে বৌয়ের টাকা চুরি করে এনেছে আলম সেটা সেরে নেওয়া যাক।
চিৎপুর রোডের ওপরে একটা বাদ্যযন্ত্রের দোকান আলমের পরিচিত। মিনার্ভার তবলা ছইতে বা অন্যান্য যন্ত্র সারাতে এ- দোকানে এসেছে আলম। অনেক সময় মালিক সুর বাঁধতে বাঁধতে বলেছেন, শোন তো প্রসন্ন, সুরটা ঠিক উঠছে কি না! আশ্চর্য কান লোকটার, প্রসন্নের কানকেও তারিফ করেন তিনি। সেই দোকানের সামনে গিয়ে বসে রইল আলম।
দোকান খুলতে এসে আলমকে দেখে দোকানী বললেন, কী গো প্রসন্ন বিশ্বেস, পালিয়েছিলে কোথায়? আজ হঠাৎ কী মনে করে?
আলম বলল, একখান বেহালা কিনুম।
বেহালা কিনবে? দোকান খুলতেই এমন খদ্দের! মনে মনে খুবই খুশি হলেন দোকানী। প্রসন্ন তাঁর স্নেহেরও পাত্র। অপাত্রে কত যন্ত্রই তো বিক্রি করেন, তাতে লাভও হয়, কিন্তু মন ভরে না। যোগ্য হাতে একটা নিজের তৈরি যন্ত্র তুলে দেওয়ার আনন্দ কম নয়।
দোকানী অনেক বেছে একটি যন্ত্র তুলে দিলেন প্রসন্নের হাতে। যন্ত্র হাতে নিয়েও যেন বিশ্বাস হয় না আলমের ষে, এ যন্ত্র তার। ভাগ্যিস দাদা নিয়ে গিয়েছিলেন আর দিদি বিয়ে ঠিক করেছিলেন। এই মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়া মেয়েটিকে মনে পড়ল আলমের। দুঃখ হল। তবু ভাবল, দুঃখ কর। তুমিও দুঃখ কর, আমিও। এই দুঃখ দিয়েই আমরা একদিন সুরকে জয় করব, তোমাকেও সুরের স্বর্গে নিয়ে যাব দেবী।
দোকানীর সামনে সব টাকা নামিয়ে দিল আলম।
দোকানী গুনে বললেন, এত টাকা কী হবে প্রসন্ন? আলম বলল, বেশী হইছে? তবে, একখান ক্ল্যারিওনেটও দিয়ে দেন। হিসাব কষলেন দোকানী, কয়েক টাকা কম হয়। তাহোক, তিনি সেরা ক্লারিওনেটখানা এনে দিলেন আলমকে। যন্ত্রদুটো হাতে পেয়ে কি ভেবে দোকানীকে একটা প্রণাম করে ফেলল আলম। দোকানী তাকে বুকে জড়িয়ে বললেন, তুমি মস্ত মানুষ হবে প্রসন্ন, হবেই!
দোকান থেকে নেমে আলম যেন শূন্য দিয়ে হেঁটে চলল। দুহাতে দুই যন্ত্র। বুকভরা আনন্দ। কিন্তু মগজে কোন চিন্তা-ভাবনাই আসছে না। অভ্যাসবশে একেবারে পাথুরেঘাটা ঠাকুরবাড়ি গিয়ে উঠল আলম। গেটের সেপাইদের দেখে হঠাৎ তার মনে হল, এখানে কার কাছে এসেছে সে? গুরু তো নেই তার, অনেক আগে স্বর্গে গেছেন। তবে?
সেখান থেকে ঘুরে একবার ডাক্তার কেদার বোসের বাড়ির সামনে থামল আলম। ওঁর দয়াতেই আলমের শিক্ষার শুরু। গুরুর গুরু তিনি। কিন্তু সেখানেও এখন ওঠা যায় না। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, ঘরের টানাটানি। দেখলে অবশ্যই ডাক্তার-গিন্নি ওকে টেনে নেবেন। সাক্ষাৎ জননী। কিন্তু অন্যকে বিব্রত করবে না আলম। দুঃখ যা বইবার, নিজেই বইবে। অবশ্য এখন দুঃখের ভাগ নেবার আরো একজন হয়েছে। নিচ্ছেও। ভাগীদার পাওয়ার গর্বে আলম পথেই হাঁটতে থাকে। একসময় মিনার্ভা থিয়েটারের সামনে এল আলম। এবার ক্ষিদে লেগেছে। এখন আর সে কলকাতার দোকানকে ভয় করে না, যে কোন খাবারের দোকানে ঢুকে খাবার কিনে খাওয়ার সাহস তার আছে। কিন্তু পকেট যে শূণ্য, সব উজাড় করেই তো হাতে এসেছে বেহালা আর ক্ল্যারিওনেট। যন্ত্রদুটো বুকে চেপে ধরে ক্ষিদে ভুলতে চেষ্টা করল আলম।
অবশেষে সেই লঙ্গরখানাতেই খাবার মিলল আলমের। খেয়েদেয়ে সে ছুটল লেবো সহেবের বাড়ি। সেখানেও হতাশ হল আলম। সাহেব-মেমসাহেবে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, মেমসাহেব চলে গেছেন কোথায়। আর সেই থেকে লেবো সাহেব দিন-রাত অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় থাকেন।
লেবো সাহেবের বাড়ি থেকে বের হল যখন আলম তখন গভীর রাত। অকল্যাণ্ড প্যালেসের বারান্দায় শুয়ে রাত কাটিয়ে দিল সে। যন্ত্র দুটোর জন্য ঘুম গাঢ় হল না। চোর-ছ্যাঁচড়ও জেগে ওঠবার আগে উঠল আলম।
গঙ্গার পাড়ে যন্ত্র রেখে যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়েই কটা ডুব মারল। তারপর গা মুছে শুদ্ধ হয়ে বসে নদীর পাড়েই বেহালা খুলে বসল।
অনেকক্ষণ বাজাল আলম। কিন্তু তন্ময় হতে পারল না। মন তার অস্থির। গুরু চাই, শিক্ষার যে অনেক বাকি, জীবন যে খুবই ছোট! একটা দিন ব্যর্থ হওয়া মনে যে অনেক পিছিয়ে যাওয়া। আলম কোথায় যাবে? কার সঙ্গে পরামর্শ করবে? হঠাৎই হাবু দত্তের কথা মনে হল আলমের। ছুটল।
কিন্তু এই কটা দিনের ব্যবধানে তার পৃথিবীর যে কত পরিবর্তন ঘটেছে, তা জানে না আলম। হাবু দত্তের স্বাস্থ্য কোন দিনই ভালো নয় তেমন। নিয়মরীতিও কিছুই মানেন না তিনি, হাঁপানির টানে প্রায়ই কষ্ট পান। এখন না কি বুকের দোষ ধরা পড়েছে।
হাবু দত্তের অবস্থা দেখে বুকের ভিতর কেমন করে উঠল আলমের। নিজের জীবনের ভাগ দিয়ে যদি গুরুর বেদনা দূর করা যায়, করবে আলম। ওকে দেখে টেনে টেনে থেমে থেমে কথা বললেন হাবু দত্ত। তারপর বিছানায় শুয়ে হাঁপাতে থাকলেন। গভীর মমতায় আলম হাবু দত্তের পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে থাকল।
অনেকক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়লেন হাবু দত্ত। আলম আস্তে আস্তে উঠল। শেষ, আলমের সুর শেখা শেষ! আর গুরু কই?
হঠাৎই একদিন আলমের মনে ভেসে উঠল একটা নাম। কোনদিন তাঁকে দেখে নি সে। মিয়া তানসেনের বংশধর তিনি। একসময় নিজেই আগ্রহভরে শিখিয়েছিলেন আলমের বাবাকে৷ তার বাবার বাজানো সে সুর আজও তার বুকের মধ্যে বেঁচে আছে। সে সুর সে কারো কাছে শেখে নি, অথচ রয়েছে তার রক্তে, তার চেতনায়।
আর এমনই মূর্খ সে যে, তাঁর কাছে না গিয়ে কলকাতার পথে পথে ঘুরে মরছে!
কিন্তু কোথায় কাশেম খাঁ? তিনি কি তখনও আছেন রাজা জগৎকিশোরের বাড়ি? সেসব কিছুই ভাবল না আলম। যন্ত্রদুটো নিয়ে সোজা ছুটে চলল।
আট
রেলগাড়িতে, স্টীমারে এবং তারপর পায়ে হেঁটে প্রায় দুশো মাইল পথ অতিক্রম করে এল আলম। এসে পৌঁছল মুক্তগাছায় রাজা জগৎকিশোরের বাড়িতে।
কিন্তু কেমন করে রাজার সামনে, উপস্থি৩ হবে আলম? সিংহদরজার দুটি সিংহ, হাঁ করে লাফিয়ে পড়ে বুঝি! না, ওগুলো মাটির। আলমের মনে হল, গোটা বাড়িটাই বুঝি হাঁ করে আছে ওর দিকে। ও কি পালাবে? নাঃ। শেষ না দেখে ও ফিরবে না।
যন্ত্রদুটো আবার বুকের ওপর চেপে ধরল আলম। যেন মস্ত আশ্বাস পেলে। তারপর রাজবাড়ির চারিদিকে ঘুরতে থাকল।
দেখার জিনিস তো কম নেই! দুচোখ ভরে দেখতে থাকল আলম। হাঁ করেই দেখতে থাকল। সহসা এক চিৎকারে চমকে ওঠে সে। কে একজন তার পিঠে খোঁচা দিয়ে বলছে, এই, কী চাস?
এক সিপাই। আলম ভাবলঃ রাজবাড়িতে তো ঢুকিনি বাপু? তবে এত হাঁক-ডাক কেন? আলম জানত না ষে রাজবাড়ির বাইরেও রাজার বাড়ির অংশ থাকে। সেখানে ঢোকাও নিষেধ।
আলম আসলে তখন রাজার উদ্যানে ঘুরছে। পাশেই পুকুর। রাজা জগৎকিশোর তখন বন্ধুদের সঙ্গে মাছ ধরছেন। সিপাই তাকে ঐ যন্ত্রদুটির চোর ভেবেই ধরেছিল।
ব্যাপারটা অন্যরকম হতে পারত। কিন্তু আলমের ভাগ্য ভালো, ঘটনাটা জগৎকিশোরের চোখে পড়ে গেল। তিনি সিপাইকে ডাকলেন, লোকটাকে তাঁর কাছে আনতে বললেন।
আলম তখন কি ছাই জানে, যে লোকটির সামনে তাকে উপস্থিত করা হচ্ছে, তিনিই স্বয়ং রাজা? হালকা মাজা গায়ের রঙ, মুখে পাতলা দাড়ি, ফতুয়া গায়ে, ছিপ-হাতে লোকটাই যে রাজা, একথা স্বপ্নেও ভাবে নি আলম। এমন একটা লোকের সামনে যখন তাকে উপস্থিত করা হল, সঙ্গী লোকগুলো যখন তাকে ছিঁচকে চোর বলে বিদ্রুপ করল, তখন কোথা থেকে একটা তেজি মন ফুঁসে উঠল আলমের মধ্যে। সে বলল, আমি উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। আমার পিতা উস্তাদ সদু খাঁ। বাড়ি শিবপুর। কলকাতায় আমার ন্যায় উস্তাদ নাই।
হালকা দাড়ি-মুখে লোকটি গভীর মনোযোগে শুনলেন আলমের কথা। সস্নেহে বললেন, তুমি কলকাতা থেকে এসেছ? ওস্তাদ?
আলম সেলাম জানাল। বলল, জি হাঁ।
লোকটি তাকালেন প্রহরীর দিকে। বললেন, ওর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও। কাল ওকে রাজদরবারে উপস্থিত করবে।
সিপাহীটি এবার সমীহের সঙ্গে নিয়ে গেল আলমকে। লোকটির সঙ্গীরাও আর উপহাস করল না। আলম বুঝল, এ জয় প্রকৃত জয় নয়, তার প্রকৃত পরীক্ষা হবে আগামীকাল সকালে।
রাজার অতিথিশালায় ষোড়শোপচারে খেয়ে কোমল শয্যায় শুয়ে ঘুম এল না আলমের। তার গোটা সঙ্গীতশিক্ষার জীবনটা যেন ছায়াছবির মতো ভেসে গেল চোখের সামনে। কাল কি সে পরবে রাজার চিত্ত জয় করতে? খানিকটা আশ্বাসও পেল। সে তো কম শেখে নি। গোপালকৃষ্ণের কাছে সাত-সাতটা বছরের তালিম, হাবু দত্তের শিক্ষণ, লেবো সাহেবের দান, হাজারী ওস্তাদের আশীর্বাদ, এসবের পরেও থিয়েটারের চুটকি গান। মাঠে-ঘাটে ছড়িয়ে থাকা ভাটিয়ালি, বাউল, রামপ্রসাদী-কী না সংগ্রহ করেছে সে? তাল-বাদ্য, তার-বাদ্য ফুঁ-বাদ্য-কী না শিখেছে? এত শেখে কজন?
এমন সব কথা ভাবতে ভাবতে একটা ভরসায় বুক ভরে গেল আলমের, শান্তিতে চোখ বুজে এল। কখন এক সময় ঘুমিয়েও পড়ল সে।
গাঢ় ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল আলম। সে যেন এক বিচিত্র পরিবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নানা রঙের আলোর ফোয়ারা যেন এক অবিরল ধারায় এসে মিলে-মিশে জলের মতো বিন্দু বিন্দু ঝরে পড়ছে। সেই আলোর জালের নেপথ্যে বুঝি বা এক রহস্য অপেক্ষা করছে।
কিসের রহস্য? কান পেতে শুনল আলম, একটা সুর। একটা মিঠে সুর। সুরটা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যেন। আশ্চর্য সুরটা দৃশ্যমান রূপ ধরে আলমের চোখের সামনে ছায়া-ছায়া ভেসে বেড়াতে থাকল। অর্ধেক ঘুমে, অর্ধেক জাগরণে আলম উপলব্ধি করতে পারল কোমল রে’-র ছায়াটা রূপ নিতে নিতে যেন সা’-র স্পর্শে ভিন্ন রূপের আভাসে থরথর করে কাঁপতে থাকল। সঙ্গীতের এ-কী রূপ? এ রাজ্যে কোথা থেকে এল আলম? এসব সুর কি তার বুকের ভিতর থেকে জন্মাচ্ছে? যেখান থেকেই জন্মাক, এ সুরের কাছে তার সব শিক্ষা তুচ্ছ বোধ হল, তার এতদিনের সাধনা, এতদিনের শিক্ষা, একলহমায় অর্থহীন প্রমাণিত হয়ে গেল। .
সঙ্গীতের যদি এত রূপ থেকে থাকে, তবে সঙ্গীতের রাজ্যে প্রবেশ তো দূরের কথা, তার সিংহদ্বারেও উপস্থিত হতে পারে নি আলম। গতকাল পুকুরপাড়ের লোকগুলোর উপহাস শুনতে শুনতে আলমের মনে যে আত্মগৌরব-বোধ জেগে উঠেছিল, এই মুহূর্তে তার সবটুকু নির্মূল হয়ে গেল। একটা হাহাকার-ভরা মন নিয়ে জেগে উঠল আলম।
কিন্তু এ কী! জাগরণেও সে সুর কেন? তবে তো এ সুর স্বপ্নের নয়! এ তো তার বুকের ভিতর থেকে ওঠে নি, দৃশ্যমান এই জগতেরই সরোদের ওপর কারো ছড়ের টানে জেগে উঠছে এ সুর। যিনি বাজাচ্ছেন, তিনি মহাগুণী। ইনিই কি তবে মিয়া তানসেনের বংশধর, তার বাবার গুরু সেই কাশেম আলি? ভাবতেই সমস্ত দেহে শিহরণ খেলে গেল আলমের।
একটু বেলা হতেই আলমকে ডেকে আনা হল দরবারে। দরবারে ঢুকে প্রথমেই অবাক হল আলম। কালকের সেই অল্পদাড়িওয়ালা মানুষটি বসে আছেন সবচেয়ে দামী আসনে। ইনিই তবে রাজা জগৎকিশোর!
হায়রে, ভোরবেলা যে সুর শুনে নিজেকে নিঃস্ব বলে বোধ হয়েছে, সেই সুর যিনি অবিরত শুনছেন, তাঁরই সামনে কিনা সে নিজের পরিচয় দিয়েছে ওস্তাদ বলে! নিজেকে ঠক, প্রবঞ্চক, মিথ্যাবাদী বলে বোধ হল আলমের। ওস্তাদ হতে গিয়ে আলম হল কিনা প্রতারক?
আলম ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বলল, মহারাজ, আমি মিথ্যা কইছি। ভোরবেলা যে সুর শুনছি, তাতে বুঝছি, আমি সঙ্গীতের স-ও জানি না। আমারে শাস্তি দেন মহারাজা, শাস্তি দেন!
দরবারের সব নিয়ম লঙ্ঘন করে মহারাজের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল আলম।
জগৎকিশোর কি যেন ভাবলেন। তারপর তিনি তাকালেন তাঁর সভার ওস্তাদ আহম্মদ আলির দিকে। ইনিও তানসেনের আত্মীয়ের বংশের লোক। ইনি এমন কিছু রাগ জানেন, যা শুনলে মনে হয়, অন্য সব সঙ্গীতশিক্ষা, অর্থহীন। ওস্তাদ কি তেমন কিছু বাজিয়োছলেন ভোরে? তাই কি শুনেছে ছেলেটি?তা যদি হয়, তবে এ ছেলেটিও কম দরদী নয়। আহম্মদ খাঁর তারিফ করাও কম শিক্ষার কাজ নয়। জগৎকিশোর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন ওস্তাদের দিকে।
ওস্তাদ বললেন, জি হাঁ, আজ ভোরে আম টোরী রাগে আলাপ করেছি। এ বাচ্চা তা শুনে থাকতে পারে। আলম আবার পাগলের মতো বলে উঠল, মহারাজ! উনি বাজাইছিলেন ঐ বাজনা! হেই খোদা! আমারে ওনার গোলাম কইরা দেন মহারাজ!
এমন সরল এবং আবেগময় আকৃতি অনেককাল শোনেন নি জগৎকিশোর। তাঁর মন গলে গেল। তিনি তাকালেন ওস্তাদের দিকে। ওস্তাদ বললেন, আপনি যদি চান, আমি ওকে তালিম দেব রাজা।
আলম আবার কেঁদে উঠল।
রাজা আদেশ ঘোষণা করলেনঃ এই ছেলেটিকে এখন থেকে বরাদ্দমতো খাবার, পোশাক সব দেবে। ও ওস্তাদজির কাছে শিখবে।
আলমকে রাজার লোকেরা পৌঁছে দিল ওস্তাদজির বাড়িতে।
আর এক নূতন সাধনা শুরু হল আলমের।
* * * *
ক্রমে আলমের ভুল ভাঙ্গল। তার বাবার গুরু কাশেম খাঁ ইনি নন, তাঁরই এক আত্মীয় আহম্মদ আলি। তা হোক, গুরু তবু স্বর্গের দেবতা। আলম যেন তার ভৃত্যের ভৃত্য। গুরু দরজায় গেলে তাড়াতাড়ি চপ্পল এগিয়ে দেয় আলম, মুখে পানের পিক জমলে এগিয়ে ধরে পিকদানি। একটু গরম বাতাস বইলে আলম পাখা নিয়ে হাজির। ঘুমের আগে চলে পদসেবা। গুরুর কখন কী দরকার যেন আগে থেকে বোঝে আলম। নিত্য এমন সেবায় আহম্মদ আলি এমন হয়ে পড়লেন যে, আলম নইলে তাঁর এক মুহূর্ত চলে না।
কিন্তু শিক্ষা?
আহম্মদ আলি ভুলেও সে কথা মুখে আনেন না।
না আনুন। আলম তাতে পরোয়া করে না, নিজের ভিতর আর এক শক্তির সন্ধান পেয়েছে সে। গভীর মন দিয়ে সুর শুনলে ওর মনের ভিতরে যেন শিলালিপিতে তৈরী হয়ে যায় তার স্বরলিপি। আর কিছু চায় না আলম, আহম্মদ আলি যেন তাকে অবিরত তাঁর সঙ্গে থাকতে দেন।
এদিকে রামপুর ছেড়ে, বাড়ি-ঘর ছেড়ে অনেককাল এদেশে কাটিয়ে দিয়েছেন আহম্মদ আলি। এবার তাঁর মনে ঘরে ফেরার বাসনা জাগল। অর্থও জমেছে কম নয়। এবার বাঁধ গাঁটরি, চল মুসাফির।
কিন্তু না, অত সহজে তাঁকে ছাড়লেন না জগৎকিশোর। আহম্মদ আলি যদি চলেই যাবেন তো যাবার আগে আর একটা শিকার-যাত্রা হয়ে যাক। বিখ্যাত শিকারী রাজাসাহেব, ভারতজোড়া তাঁর নাম। মাঝে মাঝেই শিকারে যান তিনি। মস্ত তার আয়োজন। সঙ্গে যান রাজ গায়কের দল। দিনে শিকার, রাত্রে জলসা। দিন দশ-পনের পর ফেরেন রাজা। সঙ্গে চিতাবাঘ বা হাতীর মাথা। লোকে লোকারণ্য হয়ে ষায় রাজবাড়ি। ধন্য-ধন্য করে সবই।
আহম্মদ আলিকে নিয়ে আবার শিকারে গেলেন রাজা জগৎকিশোর। আলম রইল আহম্মদ আলির সকল কিছুর তত্ত্বাবধানে।
রাজবাড়িতে একটা হাল ছাড়া নৌকার ভাব এখন। কে কার খোঁজ রাখে। রাজা ফিরলে আবার শুরু হবে তৎপরতা। এখন অবসর।
কিন্তু বেশীদিন অবসর মিলল না এবার। তাড়াতাড়ি ফিরলেন রাজা। অপ্রত্যশিতভাবে সহজেই শিকার মিলেছে। খুব খুশি রাজা। কিন্তু রজবাড়িতে ফিরে উৎকর্ণ হয়ে উঠলেন ওস্তাদজি। ও কিসের সুর ভেসে আসে? এ যে তাঁরই নিজের সুর। কে বাজায়? প্রায় ছুটে চললেন ওস্তাদজি। তাঁরই ঘরের বন্ধ দরজা ভেদ করে আসছে আওয়াজ। জিন না কি? কিন্তু পাশের জানালা দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন আহন্মদ আলি। তার আসনের পায়ের কাছে বসে তণ্ময় হয়ে তাঁরই সুর বাজিয়ে চলেছে আলম। তাজ্জব কি বাত। ওকে শেখাল কে? হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন ওস্তাদ, দরওয়াজা খুল্ বেত্তমিজ।
দরজা খুলে মাথা নীচু করে দাঁড়াল আলম। তাড়াতাড়ি চপ্পল এগিয়ে দিয়ে বলল, দের হো গিয়া। গুস্তাকি মাপ কিজিয়ে ওস্তাদ।
আলমের সেবায় গোস্তাকি ভুললেন ওস্তাদ। কিন্তু তাঁর মনে একটা কাঁটা বিঁধে রইল। না শেখালেও নির্ভুল সুর তুলে নেয়, এ কে তার সঙ্গী? সুরের ডাকাত!
আহম্মদ আলি তবু আলমকে সঙ্গে নিয়েই বাড়ির দিকে-যাত্রা করলেন।
ওস্তাদ সোজা বাড়ি ফিরলেন না, রয়ে-বসে, এখানে থেমে, ওখানে দাঁড়িয়ে সর্বত্র দু পয়সা কামিয়ে তহবিল্ ভারী করতে করতে চললেন। এসব উপার্জনের ছিটেফোঁটাই আলমের ভাগ্যে জুটতে থাকল। না পেলেও আপত্তি নেই আলমের। সে চায় শুধু ওস্তাদের সঙ্গে থাকতে, শুনতে চায় তাঁর সুর।
অবশেষে পৌঁছল তারা রামপুরে। পাহাড়ী দেশ। নূতন আবহাওয়া, অতিরিক্ত শ্রম। দেহ যেন আর বইছে না আলমের, তবু সব জড়তা ঝেড়ে ফেলে আলম। শ্রম আর সেবার মূল্যেই যে তাকে কিনতে হবে সুর।
বাড়ি পৌঁছে আলমকে একেবরেই চাকর সাজালেন ওস্তাদ। বাড়ির সব কাজ বর্তাল আলমের ওপর, এমনকি গরু চরানোও। পরিবর্তে তার ভাগ্যে জেটে ঝড়তি-পড়তি খাবার, আর তার শোবার জায়গাটি মনোরম-- গোয়ালে গরুর বাচ্চার পাশে। ঝাঁঝে নাক জ্বলে যায়। আর কোথায়ই বা তাকে শুতে দেবেন গুরু, ঘরের সংখ্যা যে খুবই কম!
অবশেষে নিরূপায় আলম একদিন সঞ্চিত সব অর্থ তুলে দিল ওস্তাদের মায়ের হাতে। মিনার্ভার পাওনা টাকা, লেবো সাহেবের ব্যাণ্ডের মাইনে, ওস্তাদের সঙ্গে ঘোরার ভাগ--সব মিলিয়ে কয়েক হাজার। টাকা পেয়ে ওস্তাদের মা খুশি হলেন। আলমের থাকার স্থান বদল হল। খাবার মতো খাবার আসতে থাকল।
আলমের টাকায় ইঁট কাটানো হল, পোড়ানো হল, মজুরদের সঙ্গে আলমকেও বয়ে আনতে হল ইঁট। এখন শরীর আর বয় না আলমের। থেকে থেকে পেটে হয় অসহ্য যন্ত্রণা। আলম কি শেষে মুখ থুবড়ে পড়ে মরবে?
হয়ত আলমকে দেখে মনে মনে খুশি হলেন আহম্মদ আলি। তাঁর কাছে শিখতে চওয়ার যোগ্য পুরস্কার দিয়েছেন ছেলেটা কে। ব্যাটা দুফোঁটা চোখের জল ফেলেই কিনতে চেয়েছিল মিয়া তানসেনের সাধনার ধন! মনে মনে হয়ত আরো কঠোর কোন শাস্তির পরিকল্পনা ছিল তাঁর। কিন্তু তার আগেই ঘটনার মোড় ঘুরল অন্যদিকে।
গোয়ালিয়র থেকে তাঁর এক আত্মীয়ের আহ্বানে সেখানে গেছেন আহম্মদ আলি, বাড়ির সকলেও গেছে তাঁর সঙ্গে। আলমের মতো বিশ্বাসী লোক যখন রয়েছে, তখন ভাবনা কি? বাড়ির ভার অছে আলমের ওপর। নিশ্চিন্তে তাই গেছেন আহম্মদ আলি।
গোয়ালিয়র থেকে যথাকলে রামপুরে ফিরে বাড়ির কাছাকাছি এসেই চক্ষ চড়কগাছ তাঁর। আবার সেই সুর! উন্মত্তের মত ক্ষেপে গেলেন ওস্তাদ। সেবারের মত এবার আর ঘরের দরজা বন্ধ নেই। ওস্তাদ হিড়হিড় করে টেনে আনলেন আলমকে। বাড়ির বাইরে ঠেলে দিয়ে বললেন, নিকালো।
মাটিতে পড়ে গেল আলম। গুরু ফিরেও তাকালেন না। .
কিন্তু পড়ে যাওয়া ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মায়া হল আহম্মদ আলির মায়ের। তিনি তুললেন আলমকে। নিজের ছেলেকে চেনেন তিনি। ওখানে আলমের যে আর ভরসা নেই, তা তিনি বুঝেছেন। আহম্মদ আলির মা বললেন, বেটা! এ হেকিমে বেমার না সারলে দুসরা হেকিম দেখাতে হয়। দুনিয়ায় হেকিমের কি অভাব?
দুসরা হেকিম খোঁজার পালা শুরু হল আলমের।
নয়
সে রাতটা রামপুরেরর বড় মসজিদের দাওয়াতেই কাটিয়ে দিল আলম। ভোরবেলাতেও সেখানেই বসে রইল সে। এ ভোরেই এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল তার জীবনে। তখনকার ভারতের সবচেয়ে মানী গায়ক ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর দেখা পেল সে ঐ মসজিদের সামনেই এক জুড়িগাড়ির ভিতরে। তখনও তাঁর পরিচয় জানে না আলম। গাড়িটা যেতেই সকলে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল। আলম জিজ্ঞাসাকরল, উনি কে ভাই? জিজ্ঞাসিত লোকটি বললেন, ওঁকে চেন না! উনি ওয়াজির খাঁ। মিয়া তানসেনের কন্যার সাক্ষাৎ বংশধর।
গায়ে শিহরণ খেলে গেল আলমের। মনে হল, ওঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটাবার জন্যেই ভাগ্য তাকে এনে ফেলেছে এখানে। সে স্থির করল, যেমন করেই হোক, ওয়াজির খাঁর কাছে শিখতেই হবে।
এক উন্মাদনায় সারাদিন পাগলের মতো ঘুরে বেড়াল আলম, নাওয়া-খাওয়ার কথাও ভুলে গেল। সন্ধ্যায় এক সৈনিক-ক্লাবের কাছে আসতেই তার হাতে বেহালা আর ক্ল্যারিওনেট দেখে চেপে ধরল এক পাঠান সৈনিক।
চিৎকার করে উঠল- এতক্ষণে বুঝি শুধু তোকে পাঠিয়েছে? কে কাকে পাঠিয়েছে কিছুই বুঝল না আলম। পাঠানের হাত থেকে রেহাই পেল না। সৈনিকপ্রবর তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখল ব্যাণ্ডবাদকদের খাঁচায়।
ওদিকে সৈনিক-ক্লাবের গোটা হলটায় তখন উৎসবের আয়োজন চলছে। এখন উৎসব আলম না দেখেছে, এমন নয়। লেবো সাহেবের ব্যাণ্ডের দলে থাকাকালে এমন অনেক উৎসব দেখেছে সে। কিন্তু তাকে এনে আটকানো হল কেন?
সেই পাঠান সৈনিকটি আরো কয়েকবার ধমকে গেল আলমকে। ভয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করবার ভরসা পেল না আলম। ইতিমধ্যে সেখানে দলে দলে ক্যাপ্টেন, লেফটেন্যান্ট, মেজররা আসতে শুরু করেছেন। টেবিলে টেবিলে ডিকেন্টারে পানীয় সরবরাহ করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও তাস খেলা হচ্ছে। একসময় বিশেষ একজন অফিসার উপস্থিত হতেই সেই পাঠান এসে আলমকে বলল, বাজাও।
লেবো সাহেবকে স্মরণ করে আলম এক উত্তেজক বাজনা বাজাতে শুরু করল। উপস্থিত অফিসারদের রক্তে জাগল সুরের মাতন। কেউ কেউ উঠে নাচতে নাগলেন। একসময় আলম থামতেই চিৎকার উঠল-’দুসরা’। সেটা থামতেই আবার চিৎকার। একটার পর একটা বাজিয়েই চলল আলম। অফিসাররা লাফাচ্ছেন, নাচছেন, লুটিয়ে পড়ছেন। আলমের মনে হচ্ছে, ঐ পুতুলগুলোকে খেলাবার দড়ি তার হাতে। সে খুশিমতো হাসাতে পারে, কাঁদাতে পারে তাদের।
গভীর রাতে থামল আলম। উৎসব শেষ হল। সকলেই তারিফ করে গেল আলমের বাজনার। বিশেষ অফিসারটিও পিঠ চাপড়ে গেলেন তার। পাঠান সৈনিকটির পাথরের মতো মুখের অন্তরালেও যেন খুশির আবেশ। সকলে চলে যেতে পাঠান বলল, তোর জন্যে তোর বাবুকে ক্ষমা করলাম। যা।
কিন্তু কোথায় যাবে আলম? তার বাবুই বা কে?
আলমের কথায় পাঠান সৈনিকটি তো অবাক! তাহলে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত ষে ব্যান্ডমাস্টার সেদিন বাজাবার জন্যে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন, আলম তাঁর কেউ নয়! কে তবে? যেই হোক, সে না এলে যে পাঠান সৈনিকটিকে বেইজ্জত হতে হত! ছেলেটকে যেন ভগবান পাঠিয়েছিলেন ক্লাবের সামনে। আর ভাগ্যিস সে ভুল ভেবে টেনে এনেছিল আলমকে! আলমের প্রতি অতিরিক্ত প্রসন্ন হয়ে উঠল পাঠানটি। জিজ্ঞাসা করে করে সে জেনে নিল আলমের জীবন কথা। সব জেনে সৈনিকটি বলল, তাহলে এখন তোর থাকবার জায়গা নেই?
আলম ঘাড় নাড়ল।
সৈনিক কিছু বলবার আগেই তার পিছন থেকে রিনরিনে গলায় দুর্বোধ্য ভাষায় কে যেন কী বলে উঠল। আলম কিছু না বুঝলেও খুশি হয়ে উঠল সৈনিকটি। আলমের দিকে ফিরে বলল, আমার মেয়ে। তোর এখানে থাকবার ব্যবস্থা হল। আমি এখানকার কেয়ারটেকার। আমি যত দিন আছি, তত দিন তুইও থাকবি।
আলম তাকাল মেয়েটির দিকে। সালোয়ার-পাঞ্জাবী-পরা ফুটফুটে ফরসা মেয়েটা, একেবারে ডল পুতুলের মতো দেখতে। আলম বুঝল, এরই কথায় তার থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে। আলম মাথা নুইয়ে মেয়েটিকে সেলাম জানাল।
থাকবার ব্যবস্থা হল বটে আলমের, কিন্তু দেহ তার সেই রাতেই বিদ্রোহ ঘোষণা করল- শুরু হল অসহ্য পেটের যন্ত্রণা। দেড়দিন বেঘোরে তার জন্যে নির্দিষ্ট ঘরে পড়ে রইল আলম। দ্বিতীয় দিনের বিকেলে ক্লান্ত দেহে বাইরে এল সে। কিন্তু কেথায় সেই আশ্রয়দাতা পাঠান? অনুসন্ধান করে জানল, তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। পাঠানদের দেশে নাকি ইংরেজ পাঠানে যুদ্ধ হয়েছে। ঐ মেয়েটির স্বামী নাকি লড়েছে ইংরেজদের সঙ্গে। সেই সংবাদ পেয়ে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেছে পাঠানটিকে।
কিন্তু মেয়েটি? সে না কি কোথায় পালিয়েছে। পুলিশও তার সন্ধান পায় নি। মেয়েটির জন্যে স্বস্তি বোধ করল আলম। কিন্তু তার নিজের কি হবে? ভারপ্রাপ্ত আফসারটি জানাল, আলমকে কোথাও যেতে হবে না, সে নিজে থাকতে পারে এখানে। এখানকার ব্যাণ্ড দলে যোগও দিতে পারে। মাইনে হবে মাসে বারো টাকা।
উপস্থিত এ সুযোগ ছাড়ল না আলম। রামপুরে থাকতে গেলে এ সহায় তার চাই-ই। নইলে ওয়াজির খাঁর সঙ্গে সে মিলবে কী করে?
কিন্তু রামপুরে থেকেও ওয়াজির খাঁর সামনে যাওয়ার কোন সুযোগ করতে পারল না আলম। ওস্তাদের বাড়ির দারোয়ানেরা তাকে পাগলা কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিল। শহরের লোক তার কথা শুনে তাকে ভাবল পাগল। একজন বলল, স্বয়ং খোদাকে পাওয়া যেতে পারে, ওয়াজির খাঁকে নয়। তোমার দেহে কি তানসেনী রক্ত আছে? তবে?
হতাশা-চরম হতাশা ঘিরে ধরল আলমের মন। ওয়াজির খাঁর কাছে যদি তালিম না পাওয়া গেল তবে কিসের এ জীবন? তবে মরণই ভালো। মাসমাইনে হাতে পেতে দু তোলা আফিং কিনে ফেলল আলম। এখন হে মৃত্যু, তুমি এসে আমায় এ ব্যর্থ জীবন থেকে মুক্তি দাও।
সেই বড় মসজিদের দাওয়ায় এসে বসল আলম। তাকে দেখে ইমামের কেমন যেন সন্দেহ হল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার মনে কিসের মতলব, বাপধন?
আলম মিথ্যা বলে না। সত্যও গোপন করে না, বিশেষত মসজিদে দাঁড়িয়ে ইমামের সামনে। সত্যটাই বলল আলম।
ছেলেটার স্পষ্টবাদিতায় এবং সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহে খুবই খুশি হলেন ইমাম। এও তো একরকম সাধক, পূণ্যাত্মা। একে তো মরতে দেওয়া যায় না।
কিন্তু ওয়াজির খাঁও তো কম শক্ত ঠাঁই নন। ভারতীয় সঙ্গীত জগতে এক আভিজাত্য ও অহমিকার প্রতিমূর্তি তিনি। রামপুরে বাড়ি তাঁর। তাই রামপুরের রাজদরবারে যান মাত্র। স্বয়ং রাজা এবং রাজার বিশেষ অতিথি ছাড়া কাউকে গান শোনান না তিনি। একবার কাশ্মীরের মহারাজা নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ওয়াজির খাঁকে। তিনি যান নি। সেই ওয়াজির কি শেখাবেন এই চালচুলোহীন ছেলেটিকে?
অনেক ভেবে আলমকে এক আরজি লিখে দিলেন ইমাম। বললেন, তুমি এক কাজ কর। নবাবের সঙ্গে দেখা কর এই আরজি নিয়ে।
সহজ পথে যখন নবাবের সঙ্গে দেখা হল না তখন এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল আলম। সন্ধ্যায় নবাব যখন চলেছেন তাঁর আটঘোড়ায় টানা গাড়িতে চড়ে, বেহালা আর ক্ল্যারিওনেট নিয়ে আলম লাফিয়ে পড়ল গাড়ির সামনে। হৈহৈ করে উঠল সকলে। কোচোয়ান সবেগে রাশ টেনে সংযত করল ঘোড়াগুলোকে। নবাবের দেহরক্ষীরা হিঁচড়ে টেনে সরিয়ে আনল আলমকে। তারা হয়ত তাকে মেরেই ফেলত, কিন্তু নবাব দেখলেন, একখানা কাগজ তুলে কী যেন বলতে চাইছে ছেলেটা। নবাবের কৌতুহল হল। তিনি ওকে তাঁর সামনে আনতে বললেন। আলম এবার তার আরজিটা পেশ করার সুযোগ পেল।
নবাবের পি. এ. সেই আরজি পড়ে শোনালেন নবাবকে। ভ্রু কুঁচকে আলমের দিকে তাকালেন নবাব। লোকটা বাঙালী, বোমা-মারা বাঙালী! সারাদেশে বাঙালী মাত্রই আতঙ্ক। নবাব ভালো করে সার্চ করতে বললেন আলমকে। উঁহু, মতলব বোঝা যাচ্ছে না ওর।
কিন্তু সার্চ করে কিছুই বের হল না। শুধুই বেহালা আর ক্ল্যারিওনেট, আর পকেট থেকে বের হল কালো মতো একদলা কি যেন। গন্ধেই সেটা মালুম হল, আফিং।
বটে! নবাব আবার তাকালেন ছেলেটার দিকে। তাহলে আরজিতে যা লিখেছে, তা মিথ্যে না হতেও পারে। পাগল! পৃথিবীতে যে কত রকম পাগলই আছে! কী যেন ভাবলেন নবাব, একে বললেন, ওকে হামিদ মঞ্জিলে উপস্থিত কোরো।
অবাক হয়ে গেলেন নবাবের পি.এ.। হামিদ মঞ্জিল! নবাবের সঙ্গীতালয় হামিদ মঞ্জিল! সেখানে কয়েকশ সঙ্গীতশিল্পী থাকেন। তাঁদের সব ব্যয় নবাবের। সেখানে নবাব এবং তাঁর অনুমতি পাওয়া লোক ছাড়া আর কেউ ঢুকতে পারে না, সেখানে ঐ ভিখিরিটাকে?
নবাব বললেন, ব্যান্ড-মাস্টার মহম্মদ হুসেন খাঁ কে বলে দাও, ওর পরীক্ষা নিক। যদি পারে, আমার ব্যান্ড-দলে ওকে ভর্তি করে নাও। উচিতমতো বেতন মহম্মদ খাঁকেই সুপারিশ করতে বলো।
আলম সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করল -- না, আমি চাকরি করব না। হয় ওয়াজির খাঁর কাছে শিখব, নয় মরব। নবাব যদি ওয়াজির খাঁর কাছে আমার শিখবার ব্যবস্থা না করতে পারেন, তবে আমাকে মরতেও বাধা দিতে পারবেন না।
মনে মনে ক্ষেপে গেলেন নবাব। গোটা রামপুরে তাঁর সামনে এভাবে কেউ কথা বলতে পারে না। আশ্চর্য ঐ ছোকরার সাহস! অবশ্য ওর সাহসে এক নবীনতার স্পর্শে আনন্দও বোধ করলেন নবাব। রাগে এবং অনুরাগে গাড়ি ঘোরালেন নবাব। সোজা চললেন হামিদমঞ্জিলে। আলমকে টেনে নিয়ে গেলেন তাঁর নিজের সঙ্গীতসাধনার ঘরে। বললেন, পারবে আমার সঙ্গে সঙ্গত করতে?
বাঙ্গালের গোঁ ধরে আলম বলল, জি, পারুম।
নবাব বেহাগের হোরিতে এক গান ধরলেন। আলম অবলীলাক্রমে বাজিয়ে গেল তাঁর সঙ্গে। ছেলেটার তাল, মাত্রা, লয়ের জ্ঞান দেখে খুশি হলেন নবাব, গান থামল।
থামতেই আবেগে উছলে উঠল আলম--আহা হা! কি গান! হুজুর, মেহেরবান, আর একটা।
হাত জোড় করল আলম। .
নবাবকে এভাবে বলা. আদবের বিরুদ্ধ। কিন্তু আলমের কথার মধ্যে এমন অকৃত্রিম আবেদন ছিল যে, নবাব খুশিই হলেন। প্রশ্রয় দিলেন আলমকে, শুরু করলেন এক বিচিত্র গিটকিরি ভরা টপ্পা। আলম বেহালায় সুর হারিয়ে ফেলল। বলল, এ আমি জানি না নবাব, শিখবার চাই।
খুব খুশি নবাব। ছেলেটার শিক্ষা আছে, শিক্ষার আগ্রহও আছে। সত্যকার সঙ্গীত-পাগল। ওয়াজির খাঁকে তলব করলেন নবাব।
ওয়াজির খাঁ এলে নবাব তাঁকে নিভৃতে ছেলেটার সব কথা বললেন। বললেন আফিং এবং মৃত্যুর প্রতিজ্ঞার কথাও। তাঁর কথায় ওয়াজির খাঁর অটল গাম্ভীর্যে চিড় না ধরলেও কৌতূহলের ঝিলিক দেখা গেল তাঁর চোখে-মুখে।
আলমের ডাক পড়ল আবার। আবার তার হাতে তুলে দেওয়া হল বেহালা। আবার বাজাতে বলা হল।
এবার আলম বাজাতে শুরু করল সেই সুর যা শৈশবে তার কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশে ছিল, ষে সুর আলম মাঝে মাঝে শুনতে পায় রক্তের দোলায়। তা থেকেই সে নিজের চেষ্টায় তুলেছিল বেহালায়। সেই সুরই বাজিয়ে দিল আলম।
চমকে উঠলেন ওয়াজির খাঁ। বললেন, থাম! এ সুর তুমি কোথায় পেলে বালক?
আলম বলল, এ সুর বাবা বাজাতেন।
খাঁ সাহেব বললেন, কে তোমার বাবা? এ সুর কোথায় পেলেন তিনি।
আলম বলল, আমার বাবার নাম সফদর হুসেন খাঁ। গাঁয়ের লোক বলে সদু খাঁ। তিনি এ সুর শিখেছিলেন ত্রিপুরার রাজদরবারের ওস্তাদ কাশেম খাঁর কাছ থেকে।
কাশেম খাঁ! নামটা শুনে ওয়াজির খাঁ চমকে উঠলেন। নবাবের দিকে ফিরে বললেন, তাই বলি, সুদূর বাংলা মূলুকের এই ছোঁড়ার তারে তানসেনি সুর আসে কোথা থেকে? হুজুর! এই কাশেম আলি ছিলেন আমার মামা।
নবাব যেন আলো পেলেন। বললেন, ওস্তাদ, আপনার মামা যদি এর বাবাকে শিখিয়ে থাকেন, তবে আপনিও ওকে শেখাতে পারেন।
নবাবের দিকে তাকালেন ওয়াজির খাঁ। বললেন, আপনার ইচ্ছা, আমি ওকে শেখাই। বেশ, আপনার ইচ্ছাপূরণ হবে। আমি ওকে শিষ্য করে নেব।
শেষ পর্ব পড়তে ক্লিক করুন
No comments:
Post a Comment