সুরের মায়া

লেখক: হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

এই আমার এক অদ্ভুত সখ। নেশাও বলা যায়। শহরের মধ্যে যখন যেখানে নীলাম হয়, আমি ঠিক গিয়ে হাজির হই। যারা নীলাম হাঁকে, তাদের অনেকের সঙ্গে আমার মুখ চেনা হয়ে গেছে। আমার যেতে দেরী হলে তারা অপেক্ষা করে, নীলাম শুরু করে না।

বিশেষতঃ ল্যাজারাসের দোকানে প্রতি সেলে আমি গিয়ে হাজির হই। টুকিটাকি জিনিস কিনি। এর মধ্যে অনেকগুলোই দরকারে লাগে না। আমার কম করে আটটা সৌখীন ছড়ি হয়েছে, ফুলকাটা আখরোট কাঠের বাক্স গোটা ছয়েক, চারখানা পুরোনো আমলের চেয়ার, একটা নাকি রবার্ট ক্লাইভ ব্যবহার করতেন।

অনেক সময় ঠকেছি। রাজা রামমোহনের লেখার টেবিল বলে চড়া দামে আমাকে যেটা গছানো হয়েছিল, পরে জানতে পারলাম সেটা নিতান্ত সাধারণ টেবিল। রামমোহনের আমলে তার জন্মই হয়নি।

ঠকেও আমার চেতনা হয়নি। নীলামের বিজ্ঞাপন দেখে দেখে ঠিক গিয়ে হাজির হতাম। এই রকম এক নীলামে, বোধ হয় ল্যাজারাসেরই, একটা ভাল জিনিস হাতে এল। ছোট্ট কটেজ পিয়ানো। বার্ণিশ ম্লান হয়ে গেছে, কিন্তু তাতে আভিজাত্যের হানি হয়নি।

নীলামওয়ালা বলল, এ পিয়ানো এ দেশের নয়। সমুদ্রের ওপার থেকে এসেছে। রাজপরিবারের কে একজন এর মালিক ছিল, তারপর অবস্থা খারাপ হওয়াতে বিক্রি করে দিয়েছে। তারপর হাত বদলাতে বদলাতে কলকাতা শহরে এসে পিয়ানো হাজির হয়েছে।

মাত্র সাতশ টাকায় এ জিনিস কিনতে পেরেছি শুনে বাদ্যরসিক বন্ধুবান্ধবেরা অবাক।

পরিচিত একজনকে দেখালাম। সে বলল, অনেকদিন ব্যবহার করা হয়নি। ভাল জিনিস। একটু টিউনিং করে নিতে হবে।

বসবার আর শোবার ঘরে জায়গা ছিল না। পিয়ানোটা পাশের ছোট একটা ঘরে রেখে দিলাম। ঠিক করলাম, একজন মাস্টার রেখে সপ্তাহে দুদিন পিয়ানো বাজানো শিখব।

ঈশ্বরের অসীম করুণায় গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য কোন চিন্তা ছিল না। বাবা যখন মারা গেলেন, তখন বালিগঞ্জের এই বসতবাটি ছাড়া কলকাতায় তাঁর আরো তিনখানা বাড়ি ছিল। যা থেকে মাসিক আয় সাড়ে তিন হাজার। ব্যাঙ্কে ছ' লাখ টাকা, এ ছাড়া কোম্পানীর কাগজ, শেয়ারে প্রায় চার লাখ। কাজেই আমার কোন চিন্তাই ছিল না।

মা মারা গেছে অনেক আগে। ভাইবোনের ঝামেলা নেই। আমি মা-বাপের একমাত্র সম্তান। অবসর সময়ে সাহিত্য করি। সাহিত্য অর্থে গল্প উপন্যাস রচনা নয়। ভারি ভারি প্রবন্ধ লিখি। বেশির ভাগ প্রত্নতত্বকে কেন্দ্র করে।

ভারতবর্ষের কোথাও মাটি খুঁড়ে পুরাকালের কোন নিদর্শন পাওয়া গেছে শুনলেই ছুটে সেখানে চলে যাই।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হতাশ হই। দুটো সরা কিংবা হাঁড়ির ভাঙা টুকরো, তাই নিয়েই পণ্ডিতদের মধ্যে প্রায় হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। পালবংশের না সেনবংশের, তাই নিয়ে চুলোচুলি।

আর এক সখ এই নীলামে জিনিস কেনা। এর মধ্যেও অবশ্য প্রত্নতত্বের পাগলামি আছে।

পিয়ানোটা যে রাত্রে দিয়ে গেল, সে রাত্রে শরীরটা একটু খারাপ ছিল। অল্প জ্বর হয়েছিল। সেই সঙ্গে সর্বাঙ্গে ব্যথা। তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। একটু তন্দ্রার ভাব এসেছিল। সেই তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থাতেই শুনলাম, পাশের ঘরে পিয়ানো বেজে চলেছে, টুং টুং টুং। কোন শিক্ষিত হাতের ছোঁয়া, কে যেন এলোপাতাড়ি একটার পর একটা পর্দা ছুঁয়ে চলেছে।

এরকম ধৃষ্টতা একজনের দ্বারাই সম্ভব। আর কেউ সাহস করবে না। আমার ভৃত্য নটবর। নিবাস কাঁথি। খুব ছেলেবেলায় তার বাপের সঙ্গে আসত। বাবা কাজ ছাড়বার সময় নটবরকে দিয়ে গেছে।

নটবর আমার খাস চাকর । আমার সব কিছু দেখাশোনা করে। তিনতলায় অন্য কোন চাকরের ওঠবার হুকুম নেই। নটবর বিশ্বাসী। নিঃসন্দেহে কাজের লোক। কিন্তু তার ধারণা, সে বাড়ির লোক। আমার যে কোন জিনিসে সে নির্বিচারে হাত দেয়। ধমক দিলে দিন কয়েক কিছু করে না, তারপর যে কে সেই। এ নিশ্চয় নটবরের কাজ। নতুন আনা পিয়ানোর ওপর শিক্ষানবিশী করছে।

কিছুক্ষণের পর অসহ্য লাগল। বিছানা ছেড়ে চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে নিলাম। একটু এগোতেই শব্দ থেমে গেল। আমার ওঠার আওয়াজ পেয়ে নটবর পালিয়েছে। ভোর রাতের দিকেও একবার যেন পিয়ানোর বাজনা শুনলাম। ঘুমের ঘোরে ঠিক বুঝতে পারলাম না। একটু শব্দ হয়েই থেমে গেল।

দিনের বেলা একেবারে চুপচাপ। রাত্রে মাঝে মাঝে টুং টুং করে বেজে ওঠে। নটবর নয়। মাঝরাতে ঘুম ছেড়ে উঠে পিয়ানো বাজাবে, নটবরের এমন শখ আর সাহস কোনটাই নেই। পরে একটু ভেবে বুঝতে পারলাম, এ নিশ্চয়ই ইঁদুরের কারসাজি। পাশের ঘরটায় নানা ধরণের জিনিসপত্রে ঠাস বোঝাই থাকাতে ইঁদুর আর আরশোলার দৌরাত্ম হয়েছে। বেশ বড় সাইজের ইঁদুর। তারই দু একটা রীডের ওপর দৌড়াদৌড়ি করলে, এ ধরনের বাজনা হওয়া সম্ভব।

কোন আমল দিলাম না।

কিন্তু একদিন আমল দিতে হল। বাইরে গিয়েছিলাম দরজায় তালা দিয়ে। দরজা খুলতে গিয়েই থেমে গেলাম। ভেতরে পিয়ানো বাজছে। আগের মতো এলেমেলো বাজনা নয়, রীতিমত শিক্ষিত হাত। কোন গৎ বাজাচ্ছে।

আমার কোন বন্ধু হয়তো বাজাচ্ছে। কিন্তু বন্ধু ঘরে ঢুকবে কি করে? দরজা খুলতেই বাজনা থেমে গেল।

প্রথমেই পিয়ানোর ঘরে এসে দাঁড়ালাম। কোথাও কেউ নেই। শুধু পিয়ানোর ডালা খোলা। ঠিক যেন কে বাজাচ্ছিল, আমার ঘরে ঢোকার শব্দ পেয়ে উঠে গেছে। তাড়াতাড়িতে ডালাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছে।

এই প্রথম অনুভব করলাম মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের একটা শীতল শিহরণ নেমে গেল। অপ্রাকৃতিক কিছু একটার অস্তিত্ব প্রথম বুঝতে পারলাম।

এতদিন মনকে বুঝিয়েছিলাম ইঁদুরের উৎপাত, কিন্তু আজকের ঘটনা কি বলে বোঝাব?

অবশ্য আমি খুব দুর্বলচিত্ত নই। এ পৃথিবীতে জীবজগতের পাশাপাশি অশরীরী আত্মারাও বাস করে, এমন অর্বাচীন চিন্তা আমি করিনা। এরকম মূঢ় বিশ্বাসও আমার নেই। বরং বন্ধুবান্ধবদের ভৌতিক তত্ত্ব আমি অবহেলায় উড়িয়ে দি।

পিয়ানোর ব্যাপারটা ভৌতিক কিংবা অপ্রাকৃত ঘটনা ছাড়া আর কি? দিন দুয়েক কিছু হল না।

তারপর আমি ভাবলাম, পিয়ানোটা যখন কিনলাম, তখন বাজনাটা একটু শিখি।

খুঁজে খুঁজে এক মাস্টার জোগাড় হল। পেয়ে গেলাম। অ্যালবার্ট পেরেরা। গ্রীন ভ্যালি হোটেলে পিয়ানো বাজায়। ঠিক হল দুশো টাকা নেবে, সপ্তাহে দুদিন শেখাবে। বুধ আর শনি। বিকেলবেলা। তার আগে পিয়ানোটা টিউন করিয়ে নিলাম। যে লোকটা টিউন করতে এসেছিল, সে বলল, খুব ভাল পিয়ানো সায়েব। এ জিনিস আর পাওয়া যায় না।

রীতিমত উৎসাহের সঙ্গে শিখতে শুরু করলাম।

যতক্ষণ পেরেরা থাকে, কোন অসুবিধা হয় না। কিন্তু পেরেরা চলে যাবার পর অমনি পিয়ানো বাজাতে গেলেই অসুবিধা আরম্ভ হয়।

পিয়ানোর সামনে টুলে বসতে গিয়েই চমকে উঠি। মনে হয় কে যেন আগে থেকে টুলে বসেছিল। আমি বসতে যেতেই সরে যাবার চেষ্টা করল। আমি বেশ একটা নরম দেহের আভাস পেলাম। ঠিক মনে হল, যেন কার কোলের ওপর বসে পড়েছি। তারপর রীডের ওপর আঙুল চালাতে গিয়েও এক বিপত্তি। আরেকটা নরম আঙুলের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে যাচ্ছে।

নিজেকে বোঝালাম এ শুধু মনের ভুল। পিয়ানো সম্বন্ধে অলৌকিক একটা ভয় মনকে অধিকার করে আছে। এসব তারই প্রতিক্রিয়া।

কিছুদিন পর এ অস্বস্তিও কেটে গেল। সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। কিন্তু ওই দিন পনেরো। তারপর পেরেরা আসা বন্ধ করল।

প্রথমে ভেবেছিলাম অসুস্থ ; খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, না, পেরেরা ঠিক হোটেলে পিয়ানো বাজাচ্ছে। তবে কি তার দক্ষিণা মনঃপুত নয়? কিন্তু পেরেরাই দুশো টাকা চেয়েছিল। আমি তাতে রাজী হয়েছি।

ঠিক করলাম, পেরেরার বাড়িতে গিয়েই দেখা করব। পেরেরা পার্ক সার্কাস অঞ্চলে থাকে। তার বাড়িতে আমি আগেও গিয়েছি। পেরেরা বাড়িতেই ছিল। আমাকে দেখে সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।

কি ব্যাপার, আপনি ক'দিন যাচ্ছেন না? অথচ শরীর নিশ্চয় অসুস্থ নয়, কারণ হোটেলে ঠিক বাজাচ্ছেন।

পেরেরা বলল, আসুন, ভেতরে আসুন। আপনার সঙ্গে কথা আছে। তার বাইরের ঘরে গিয়ে বসলাম। পেরেরা কফি আনল। কফিতে চুমুক দিতে দিতে তার কাহিনী শুনলাম।

আপনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা । এই বিজ্ঞানের যুগে এমন একটা কাহিনী কাউকে বিশ্বাস করানোও মুশকিল।

পেরেরা একটু দম নিল; তারপর আবার বলতে আরন্ত করল, আপনাকে পিয়ানো শেখানোর পর বাড়ি ফিরে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়। স্বপ্ন মনে হয় বটে; কিন্তু আমি জানি, সপ্তাহে দু'দিন ঠিক একরকম স্বপ্ন কেউ দেখে না। আপনি জানেন আমি নেশা-ভাং করি। রোজই ডিনারের আগে মদ আমার চাই, কিন্ত মদ তো আমি নতুন খাচ্ছি না। আমার দশবারো বছরের অভ্যাস। এর আগে তো আমি কোনদিন এসব দেখিনি।

পেরেরার গৌরচন্দ্রিকার ধরন দেখে মনে হল, আসল বক্তব্যে সে আসতে দ্বিধা করছে। পাছে তার বক্তব্য আমার বিশ্বাসযোগ্য না হয়।

তাই আমি বললাম, আমার সময় কম। আসল ব্যাপারটা কি বলে ফেলুন।

পেরেরা শুরু করল ; আপনি বোধ হয় জানেন না, আমি বহু ঘাটের জল খাওয়া লোক। গায়ে জোরও যেমন আছে, মনে সাহসও তেমনই। কিন্তু আপনাকে পিয়ানো শেখানোর ব্যাপারে আমি একটু গোলমালে পড়েছি। পাছে আপনি ভয় পান তাই আমি কিছু বলিনি। যখনই পিয়ানোর রীডে হাত চালাতাম, আর একটা অদৃশ্য হাতের সঙ্গে যেন হাত ঠেকে যেত। নরম হাত, কোন স্ত্রীলোকের বলেই মনে হত। আপনাকে যখন পিয়ানো শেখাতে যেতাম, যীশুর দিব্যি, পেটে. একফোঁটা এ্যালকোহল থাকত না। কাজেই এমন হবার কথা নয়। কিন্তু এই স্বপ্ন আমাকে বিচলিত করেছে।

হঠাৎ খাটটা দুলে উঠল। আমি প্রথমে ভাবলাম ভূমিকম্প। না, শোবার ঘরের আর তো কিছু দুলছে না। রাস্তার আলোর কিছুটা ঘরে এসে পড়েছে। সেই আলোকে দেখলাম, বাতিটা তারে ঠিক ঝুলছে। একটুও দুলছে না।

পায়ের দিকে চোখ পড়তেই শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল। পরিষ্কার দেখলাম, একটা কবন্ধ। মানে মাথা নেই। অঙ্গে দামী মখমলের পোশাক। অনেক দূর থেকে ফোনের তারের মধ্যে দিয়ে যেমন স্বর ভেসে আসে, তেমনই স্বরে কে বলল, যদি প্রাণের মায়া থাকে, ও পিয়ানোতে হাত দিবি না। ও আমার পিয়ানো। তাতে আর কারো স্পর্শ আমি সহ্য করব না।

তবু সাহস করে বললাম, কোন পিয়ানো?

খাটটা আবার নড়ে উঠল। তীক্ষ্ণ হল কণ্ঠস্বর, কোন পিয়ানো জানিস না? বাজাবার সময় আমি অনেকবার বাধা দিয়েছি। ভাল চাস তো ও পিয়ানোয় একদম হাত দিবি না।

পরের দিন সকালে উঠে রাতের স্বপ্নটাকে বিশেষ আমল দিইনি। অবশ্য এখন বুঝতে পারছি, ওটা আদৌ স্বপ্ন নয়। ভাবলাম, নির্ঘাৎ সুরার প্রভাব।

তারপরের দিন আপনার ওখানে যাবার কথা। সেজেগুজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি বাসের আশায়। হঠাৎ কালো একটা মোটর সামনে দিয়ে নক্ষত্রবেগে যাবার সময় আমার সারা পোশাকে কাদা ছিটিয়ে গেল। একেবারে আপাদমস্তক। মেজাজ খিঁচড়ে গেল। বাড়ি ফিরে এলাম। স্নান সেরে আর যাবার ইচ্ছা হল না। ভাবলাম, ফোনে পরের দিন আপনাকে জানিয়ে বিকালে যাব।

রাত্রে সেই এক ব্যাপার। খাট কেঁপে উঠল। বাতি জ্বালিয়ে রেখেছিলাম। আচমকা বাতি নিভে গেল। পায়ের কাছে সেই কৰন্ধ মুর্তি! এবারে রাগে যেন একেবারে ফেটে পড়ল; কি, আমার কথা কানে গেল না। আবার তুই পিয়ানোয় হাত দিতে দিয়েছিলি? বলেছি, ও পিয়ানোতে আর কারও স্পর্শ আমি সহ্য করব না। মুখে রক্ত উঠে মরবি। কথার সঙ্গে সঙ্গে কবন্ধমূ্র্তিটা বিরাট হয়ে ছাদ স্পর্শ করল।

আমি বেশ বুঝতে পারলাম, স্বপ্ন নয়, সব কিছু আমি জেগে জেগে দেখছি। বুকের মধ্যে তীব্র একটা যন্ত্রণা অনুভব করলাম। বুকে ঝোলানো ক্রস ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম, আর নয়, আর এই সর্বনেশে পিয়ানোর ধারে-কাছে যাব না। আপনি আমাকে মাপ করুন আপনি অন্য কোন শিক্ষক খুঁজে নিন।

পেরেরার বাড়ি থেকে যখন বের হলাম, তখন মনের অবস্থা অবর্ণনীয়। অতিন্দ্রিয় জগৎ সম্বন্ধে আমার কোনই ধারণা ছিল না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু ভয়ের একটা কালো ছায়া মনকে আচ্ছন্ন করে রইল।

পিয়ানোটা যে স্বাভাবিক নয়, তা তো আমি বুঝতে পেরেছি। আমার কথা পেরেরাকে আর বলিনি। কিন্তু পেরেরার কাহিনী শোনবার পর আমার আর পিয়ানোর কাছে যেতে সাহস হল না। মনে মনে ঠিক করলাম, পিয়ানোটা আবার ল্যাজারাসের দোকানে ফেরৎ দিয়ে আসব। এখানে দিয়ে কাউকে বিক্রি করে দিক।

এর মধ্যে আবার এক কাণ্ড ঘটল।

দুপুর থেকে কালো মেঘ সারা আকাশ ছেয়ে গিয়েছিল। ঘন অন্ধকার দু'হাত দূরের লোক দেখার উপায় নেই। বিকেল হবার সঙ্গে সঙ্গে তুমুল বর্ষণ আরন্ত হল। বাজের শব্দে কান পাতা দুষ্কর। বিদ্যুতের তীব্র ঝিলিক।

একটু বাইরে বের হবার দরকার ছিল। হল না। চুপচাপ বন্ধ জানলার কাছে চেয়ার পেতে প্রকৃতির তান্ডব নাচ দেখতে লাগলাম। হঠাৎ বৃষ্টি আর বাজের শব্দ ছাপিয়ে পিয়ানোর শব্দ।

বেশ শিক্ষিত হাতের বাজনা । বিদেশী কোন গান বাজাচ্ছে। পা টিপে টিপে উঠে পড়লাম। কি করে বাজাচ্ছে একবার দেখতে হবে। এ ঘরে বাতি জ্বালানো ছিল। এ ঘরের আলো পিয়ানোর ঘরে পড়ে। কাজেই দেখবার অসুবিধা নেই।

জানলার কাছে গিয়েই থেমে গেলাম। সমস্ত শরীর শিউরে উঠল। মাথার চুল খাড়া হবে উঠল সজারুর কাঁটার মতন। মনে হল, বুকের ধুকধুক্‌ শব্দটা এখনই বুঝি থেমে যাবে।

কোন মানুষ নেই। শুধু পিয়ানোর রীডের ওপর ধবধবে সাদা দুটি হাত এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছে। সরু চাঁপার কলির মতন আঙ্গুলের ছোঁয়ায় চমৎকার সুরের ঝঙ্কার উঠছে। মনিবন্ধ পর্যন্ত দুটি হাত। নিঃসন্দেহে সে দুটি হাত স্ত্রীলোকের। মনিবন্ধ থেকে টপটপ করে রক্তের ফোঁটা মেঝের ওপর ঝরে পড়ছে।

যখন জ্ঞান হল, দেখলাম বিছানায় শুয়ে আছি। এক পাশে ডাক্তার, অন্য পাশে ভৃত্য নটবর। ডাক্তার বলল, কাছেই বাজ পড়েছিল; সেই শব্দে আপনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। দিন সাতেক সম্পূর্ণ বিশ্রাম। বিছানা ছেড়ে উঠবেন না।

চুপ করে সব শুনে গেলাম। জানি আসল কথা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না।

সেরে উঠেই ল্যাজারাসের ওখানে চলে গেলাম।

ম্যানেজার পিন্টোর সঙ্গে আমার অনেকদিনের জানাশোনা। তাকে বললাম, আচ্ছা, যে পিয়ানোটা নীলামে আমি কিনেছিলাম, সেটা কার কাছ থেকে আপনারা পেয়েছিলেন?

কেন বলুন তো?

এমনিই জিজ্ঞাসা করছি।

দাঁড়ান দেখে বলছি।

পিন্টো বিরাট খাতা খুলে কিছুক্ষণ দেখল; তারপর বলল, আমাদের এখানে নীলামের জন্য দিয়েছেন মিসেস ক্রিস্টোফার। সার্কাস রেঞ্জে বাসা।

ঠিকানা লিখে নিলাম।

কি ব্যাপার বলুন তো? পিয়ানোর মধ্যে কিছু পেয়েছেন?

কি পাব?

টাকাকড়ি কিছু। আমি ভাবলাম বুঝি মালিককে ফেরৎ দেবেন।

না, না, সেসব কিছু নয়। পিয়ানো সম্বন্ধে দু-একটা কথা জিজ্ঞাসা করবার আছে। আচ্ছা ধন্যবাদ।

খুঁজে খুঁজে ঠিক গিয়ে হাজির হলাম মিসেস ক্রিস্টোফারের বাড়ি। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, এ রহস্যভেদ করবই।

মিসেস ক্রিস্টোফার প্রথমে কিছুতেই বলতে চায় না। অনেক অনুরোধ উপরোধের পর বলল, পিয়ানোটা আমার বোনের। বোন বিলেতে থাকত। পিয়ানোতে অদ্ভুত দখল ছিল। বোন মারা গেলে পিয়ানোটা আমি এখানে নিয়ে আসি।

আপনি বিক্রি করে দিলেন কেন?

কিছুক্ষণ নীরব মিসেস ক্রিস্টোফার।

আমাদের মধ্যে লুকোচুরি করে লাভ নেই। আপনি পিয়ানোটা কেন নিজের কাছে রাখতে চাননি আমি জানি। খুবই স্বাভাবিক; বোনের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে পিয়ানোটার দাম আপনার কাছে অনেক। কিন্তু ওই পিয়ানোতে আপনার বোনের আত্মা ভর করে আছে। তিনি কাউকে পিয়ানো ছুঁতে দেন না। তাইতো?

আবিষ্টের মত মিসেস ক্রিস্টোফার আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ।

আপনার বোন কিভাবে মারা গিয়েছিলেন?

মিসেস ক্রিস্টোফার উঠে গিয়ে সোরাই থেকে জল গড়িয়ে খেলো পুরো এক গ্লাস। তারপর বাইরের দিকে চোখ ফিরিয়ে আস্তে আস্তে বলল, আমার বোন লিজা বেঁচে নেই। বিলেতে বোমায় মারা গেছে। গত যুদ্ধের সময়। যখন বোমা পড়ছিল, লিজা তখন পিয়ানোতে তন্ময়। আমিও সেই সময় ওখানে ছিলাম। সাইরেন বাজার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেন্টারে যাই। লিজার খেয়ালই ছিল না।

কিছুক্ষণ পরে অল ক্লিয়ার হতে বাড়িতে ফিরে দেখি, লিজার শরীর বোমার আঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন। শুধু কাটা দুটো হাত পিয়ানোর ওপর ছিল।

লড়াই থামতে আমি চাকরি নিয়ে এদেশে ফিরি। চাকরি আমার ছিলই, আমি শিক্ষকতার একটা কোর্স শেষ করার জন্য বিলেত গিয়েছিলাম। পিয়ানোটা সঙ্গে নিয়ে আসি।

তারপর প্রতি রাত্রে পিয়ানোর টুং টাং কানে আসে। উঠে গিয়ে দেখি কোথাও কিছু নেই। এক ঝড়ের রাতে পিয়ানোর জোর আওয়াজ হতে দেখলাম, লিজার দুটো হাত রীডের ওপর চঞ্চল। মনে হল, বোমার আওয়াজের সঙ্গে রাগের শব্দের মিল আছে বলেই বোধহয় দুর্যোগের রাতে লিজার ছিন্ন হাত দেখা যায়। তারপর পিয়ানোটা নিলামে দিয়ে দিই।

চলে এলাম। আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। অতীন্দ্রিয় জগতের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সব দ্বিধার অবসান।

No comments:

Post a Comment