Showing posts with label অপ্রাকৃত / ভৌতিক. Show all posts
Showing posts with label অপ্রাকৃত / ভৌতিক. Show all posts

ম্যাজিশিয়ান

লেখক: বিমল কর

বছর পঁচিশ পরে দেখা। চিনতেও পারিনি। অশ্বিনীই আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, - কী রে, চিনতে পারছিস? আমি অশ্বিনী।

মানুষ যে কত বদলে যায়, অশ্বিনীকে না দেখলে বোঝা মুশকিল। ছেলেবেলার চেহারা বয়েসে পালটে যায়। তবু একটা আদল ধরা পড়ে। অশ্বিনীর সবই পালটে গিয়েছে। অনেকক্ষণ নজর করে দেখলে হয়তো তার সামনের দাঁত আর কখনও-কখনও চোখের দৃষ্টিতে পুরনো অশ্বিনীকে একটু-আধটু ধরা যায়।

অশ্বিনী আমার হাত ধরে টানল। বলল, - আয়, দোকানে আয়। আমি ধুলুর মুখে শুনেছিলাম, তুই আসছিস।

ধুলু আমার ভাই। নিজের নয়, দূর সম্পর্কের। বয়েসে অনেক ছোট। শ্রাদ্ধশান্তির ব্যাপারে ধুলুদের বাড়িতেই এসেছি। দিন-দুই থাকার কথা।

দরজির দোকান দিয়েছে অশ্বিনী। বাজারের মধ্যেই। দোকানের নাম রেখেছে “মনোরমা”। ছোট দোকান। সাধারণ ভাবে সাজানো-গোছানো। দোকানের পেছনের দেওয়ালে কাঠের তক্তা দিয়ে বাঙ্ক মতন করে নিয়েছে, সেখানে তার দরজি বসে সেলাই-মেশিন নিয়ে।

অশ্বিনী আমাকে তার চেয়ারে বসাল। নিজে বসল একটা টুলের ওপর। বলল, - কত কাল পরে তোকে দেখলাম, বিজন। কেমন আছিস বল?

বলার আর কীই বা ছিল। চাকরি-বাকরি, ঘরসংসার, ছোটখাটো অসুখ-বিসুখ নিয়ে সাধারণ মানুষ যেমন করে বেঁচে থাকে সেইভাবেই দিন কাটছে। বললাম অশ্বিনীকে। শেষে বললাম, - তুই কেমন আছিস তাই বল?

অশ্বিনী বলল, - আমার অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছিস। এই দোকান নিয়ে আছি। চলে যাচ্ছে কোনও রকমে। বলে অশ্বিনী উঠল। - দাঁড়া, একটু চায়ের কথা বলে আসি। পকৌড়া খাবি? সেই মতিয়ার দোকানের পকৌড়া। মতিয়া অবশ্য নেই, তার ভাইপো দোকান চালায়।

অশ্বিনীকে খুশি করতেই আমি মাথা নাড়লাম। অশ্বিনী চলে গেল।

দোকান ফাঁকা। রাত হয়ে আসছে। যদিও মাসটা ফাল্গুন, তবু কলকাতার মতন গরম পড়ে যায়নি। একটু শীতের ভাব রয়েছে।

আমার বারবার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ছিল। অশ্বিনী আমার ছেলেবেলার বন্ধু। একসঙ্গে প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে হাই স্কুল পর্যন্ত পড়েছি। খেলাধুলো করেছি একসঙ্গে। থাকতামও এক পাড়ায়। স্কুল ছাড়বার পর থেকে আর তেমন দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। আমার বাবা চাকরি থেকে রিটায়ার করে ধানবাদ ছাড়লেন। আমিও ছাড়লাম। মাঝে এক-আধবার দু’এক দিনের জন্যে এসেছি হয়তো ধুলুদের বাড়ি, অশ্বিনীকেও দেখেছি, কিন্তু এবার যেমন দেখলাম সে-রকম নয়।

ছেলেবেলায় অশ্বিনী ছিল যেমন হুজুগে তেমনি বেপরোয়া। তার বাবা, আমাদের কামাখ্যাকাকা, ছিলেন রেলের ছোট ডাক্তার। দেখতে বড় সুন্দর ছিলেন। বড়দের সঙ্গে থিয়েটারও করতেন। অশ্বিনী অত সুন্দর ছিল না দেখতে, কিন্তু সুশ্রী ছিল। তার চোখ-নাক ছিল চমৎকার। চেহারাটা অবশ্য গণেশ-গণেশ ছিল। অশ্বিনী বেশ শৌখিন ছিল। ফিটফাট প্যান্ট-শার্ট পরে স্কুলে যেত। তার পকেটে পাট করা রুমাল থাকত। আমরা তখন বাচ্চাদের পকেটে রুমাল থাকার কথা ভাবতেই পারতাম না।

অশ্বিনীর ছেলেবেলা থেকেই শখ ছিল ম্যাজিশিয়ান হবে। ধানবাদের রেলবাবুরা পেল্লায় করে যে একজিবিশান করতেন সেখানে গণপতির ম্যাজিক দেখার পর থেকেই তার মাথায় এই শখ চাপে। অশ্বিনী বটতলার ম্যাজিকশিক্ষার বই আনিয়ে ম্যাজিক শিখত, আর আমাদের দেখাত।

ম্যাজিক দেখাতে গিয়ে অশ্বিনী অনেকবার মরতে মরতে বেঁচে গেছে। একবার সে কলা খেয়ে মুখ থেকে ছুঁচ বার করতে গিয়ে মরো-মরো হয়েছিল। আর-একবার যা করেছিল, আরও মারাত্মক। কাঁচের টুকরো চিবিয়ে খেতে গিয়েছিল। বইয়ে পড়েছিল আদার রসে কাঁচের টুকরো ভিজিয়ে উনুনের পাশে রেখে গরম করে নিলে কাঁচ হজম করা যায়। সেই কায়দাটা দেখাতে গিয়ে গাল জিভ কেটে যায়-যায় অবস্থা হয়েছিল অশ্বিনীর। ছেলেবেলার এইসব বোকামি সে অবশ্য শুধরে নিয়েছিল, কিন্তু ম্যাজিকের নেশা তার মাথা থেকে যায়নি। আমরা যখন স্কুল ছেড়ে চলে আসি, তখন সে অনেক পাকা ম্যাজিশিয়ান; সরস্বতী-পুজোর দিন স্কুলে সে ম্যাজিক দেখাত।

ম্যাজিশিয়ান অশ্বিনী আজ সাদামাটা একটা দরজির দোকান দিয়ে বসে আছে -- এ যেন ভাবাই যায় না। তা ছাড়া তার চেহারা? সেই সুশ্রী, শৌখিন অশ্বিনীর আজ কী বিশ্রী চেহারা হয়ে গিয়েছে! রোগা, হাড়-হাড় চেহারা, মুখ শুকিয়ে বুড়োদের মতন চিমসে হয়ে গিয়েছে, মুখের কথা জড়ানো, মাথার চুল পাতলা, পোশাক-আশাকও একেবারে মামুলি। ওকে দেখলে দুঃখই হয়।

অশ্বিনীর কথাই ভাবছিলাম, এমন সময় অশ্বিনী ফিরে এল। হাতে শালপাতার ঠোঙায় পকৌড়া। বলল, - আমি খাব না, তুই খা। গরম ভাজিয়ে আনলাম। চা আসছে।

পকৌড়া খেতে-খেতে আমি বললাম, - তোর এই দরজির দোকান কত দিনের?

- তা বছর ছয়েক হবে।

- “মনোরমা” নাম দিয়েছিস কেন?

- আমার মায়ের নাম মনোরমা।

আমার খেয়াল ছিল না কাকিমা’র নাম। অপ্রস্তুত হলাম। তারপরই বললাম, - তুই আর-কিছু করতে পারলি না? চাকরি-বাকরি? অন্য কোনও ভাল ব্যবসা?

- চাকরি করেছি। ভাল লাগত না। ঝগড়াঝাঁটি হত। ছেড়ে দিয়েছি।

- কিন্তু এই দরজির দোকানে তোর চলে?

- চলে যাচ্ছে। আমার আর আছেটা কী! মা নেই, বাবা নেই। দিদি ছিল। সেও নেই। আমি একলা থাকি। নিজেই রান্নাবান্না করি, খাই।

এমন সময় চা এল। দেখলাম, অশ্বিনীর জন্যে চা আসেনি। বললাম, - তুই চা খাবি না?

- না। তুই খা।

চা খেতে খেতে আমি হেসে বললাম, - তোর সেই ম্যাজিক? ম্যাজিক ছেড়ে দিয়েছিস?

অশ্বিনী আমার দিকে তাকাল। পাতা পড়ল না চোখের। একবার যেন দৃষ্টিটা কঠিন ও রুক্ষ হল, তারপর ধীরে ধীরে সেই রুক্ষভাব মোলায়েম হয়ে এসে কেমন যেন মলিন হল।

অশ্বিনী বলল, - লোক-দেখানো ম্যাজিক ছেড়ে দিয়েছি।

কথাটা কানে লাগল। বললাম, - তার মানে? ম্যাজিক তো লোকেই দেখে।

- ও ম্যাজিক আর আমি দেখাই না।

- অন্য ম্যাজিক দেখাস নাকি? আমি ঠাট্টা করে হাসলাম, - সেটা আবার কী?

অশ্বিনী ম্লান করে হাসল; কোনও জবাব দিল না কথার।

চা খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এল। অশ্বিনী চুপচাপ। আমার কেমন ভাল লাগছিল না। অস্বস্তি হচ্ছিল। অশ্বিনীর হঠাৎ এমন বোবা হয়ে যাওয়া কেন? সে মাঝে মাঝেই আমায় কেমন করে যেন দেখছে। তা ছাড়া এসে পর্যন্ত লক্ষ করছি, অশ্বিনী কথা বলার সময় মুখের সামনে রুমাল ধরে রাখছে। কী খারাপ অভ্যেস!

অসহিষ্ণু হয়ে আমি বললাম, - তুই যেন কী ভাবছিস! আমায় অমন করে দেখছিস কেন? রুমালটাই বা মুখের সামনে ধরে রেখেছিস কেন?

অশ্বিনী রুমাল সরাল না। আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল; তারপর বলল, - তোকে একটা কথা বলতে পারি। বিশ্বাস করবি?

- কী কথা?

- শুনলে হাসবি। ভাববি, আমার মাথা খারাপ হয়েছে।

আমি হেসে ফেলে বললাম, - তোর তো প্রথম থেকেই মাথার গোলমাল। ছেলেবেলায় কাঁচ চিবিয়ে খেতে গিয়ে মরতে বসেছিলি, মনে নেই!

অশ্বিনী হাসির মুখ করল।

আমি বললাম, - তোকে কত বছর পরে দেখছি, অশ্বিনী। আমার ভাল লাগছে না। এই দরজির দোকান, তোর চেহারা, চোখমুখ সব যেন কেমন লাগছে। সত্যি করে বল তো, তোর কী হয়েছে? আমি হাসব না।

অশ্বিনী বেশ অন্যমনস্ক হয়ে গেল। নিশ্বাস ফেলল বড় করে। তারপর বলল, - তোকে যা বলছি সত্যি করেই বলছি। এক বর্ণও বাড়িয়ে বলছি না। মিথ্যে বলছি না।

বলে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অশ্বিনী বলল, - বছর আষ্টেক আগের কথা। মা বেঁচে আছে। বাবা নেই। তখন আমি একটা চাকরি করতাম। তবে চাকরিতে আমার মন ছিল না। মন ছিল ম্যাজিকে। ম্যাজিকই ছিল আমার ধ্যান-জ্ঞান। কত টাকা-পয়সাই না খরচ করেছি ম্যাজিকের জিনিসপত্র তৈরি করতে, সাজপোশাক বানাতে। ছোটখাটো একটা দলই তৈরি করে ফেলেছিলাম আমি। এসব দিকে, -- মানে তোর কোলিয়ারিতে, মেলায়, রেলের ক্লাবে, চ্যারিটি শোয়ে আমার ডাক পড়ত। দলবল নিয়ে যেতাম। খেলা দেখাতাম। টাকা-পয়সাও পেতাম। একবার কাতরাসগড়ে আমাদের ডাক পড়ল। কালীপুজোর সময়। খেলা দেখাতে গেলাম দলবল নিয়ে। সঙ্গে একটা বাচ্চা মেয়ে ছিল, তুই চিনবি না, ভজনদার মেয়ে। তার নাম টুনি। দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনই স্মার্ট। টুনিকে নিয়ে আমরা দু’তিনটে খেলা দেখাতাম। তার মধ্যে একটা ছিল হাসি-হুল্লোড়ের, বড় বেতের টুকরির মধ্যে টুনিকে ঢুকিয়ে দেওয়া হত -- আর চোখের পলকে ভ্যানিশ হয়ে যেত টুনি, তার বদলে টুকরি থেকে এক জোড়া খরগোশ বেরিয়ে আসত।

অশ্বিনী কথা বলতে বলতে থামল একবার। বাইরের দিকে তাকাল। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, - অন্য দুটো খেলার মধ্যে একটা ছিল, টুনি ছুরি দিয়ে আমার জিব কেটে দেবে, রক্ত পড়বে গলগল করে, আবার কাটা জিব জোড়া হয়ে যাবে। সোজা খেলা। তুইও ছেলেবেলায় খুলে যাবার সময় রাস্তার ধারে এই খেলা দেখেছিস -- মাদারিরা দেখাত। খেলাটাকে চটকদার করার জন্য আমি টুনির মতন বাচ্চা মেয়েকে দিয়ে খেলাটা দেখাতাম। তাকে খুব ভাল করে খেলাটা শিখিয়েছিলাম।

সেদিন কিন্তু কী যে হল কে জানে। সহজ খেলা। অজস্রবার দেখিয়েছি। অথচ ওই দিনটাতে সব গোলমাল হয়ে গেল, ভুল হয়ে গেল আমাদের। টুনি আমার আসল জিবে ছুরি চালিয়ে দিল।

আমি চমকে উঠলাম। বলে কী অশ্বিনী। ওর জিব নেই নাকি? তা হলে কথা বলছে কেমন করে?

আমার অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে অশ্বিনী বলল, - তুই ভাবছিস, আমার জিব কি কেটে ফেলেছিল টুনি? না। সবটা কাটেনি। জিবের একটা পাশ কেটে গিয়েছিল। তাতেই যা রক্ত পড়েছিল তুই কল্পনাও করতে পারবি না। হাসপাতালেও ছিলাম বেশ কিছুদিন।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললাম, - সেই থেকে ম্যাজিক ছেড়ে দিয়েছিস?

মাথা হেলিয়ে অশ্বিনী বলল, - হ্যাঁ, ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু আসল ব্যাপারটা তো তোকে বলিনি এখনও। আমার জিব ধীরে ধীরে আবার আগের মতন হয়ে এল খানিকটা, ভাবলাম বেঁচে গেলাম। পরে দেখলাম, জিবটা আর আগের মতন হচ্ছে না। রংটা দিন দিন কালো হয়ে যাচ্ছে, আর ধারগুলো কেমন গুটিয়ে থাকে। কথা বলতে আগে বেশ কষ্ট হত। এখন অনেকটা সামলে নিয়েছি।

কৌতূহল বোধ করে বললাম, - দেখি তোর জিব?

অশ্বিনী মাথা নাড়ল।

আমি বললাম, - দেখা না, কী হয়েছে?

অশ্বিনী আমার চোখে চোখে তাকিয়ে বলল, - না রে, দেখিস না।

- কেন?

- আমার জিব আমি কাউকেই দেখাই না। মা আমার জিব দেখত, মারা গেল। বাজারের দাস ডাক্তার আমার জিব দেখেছিল -- সেও মারা গেল। আমার জিব দেখলে খারাপ হয়। আমি কারুর সামনে জিব দেখাই না।

আমার বিশ্বাস হল না।

তারপরই মনে পড়ল, অশ্বিনী আমার সঙ্গে কথা বলার সময় আগাগোড়া মুখের সামনে রুমাল আড়াল করে রেখেছিল। সে কোনও কিছুই খায়নি।

অশ্বিনীর কথা আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছিল না, আবার কেমন ভয়ও করছিল। অশ্বিনী কার জিব নিয়ে বেঁচে আছে কে জানে! তার, না অভিশপ্ত কোনও জীবের, কে জানে!

শেষ

ভূতুড়ে রাত

লেখক: হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

সভা শেষ হতে বেশ রাত হয়ে গেল। আমার যে বাড়িতে রাত্রে থাকা ঠিক হয়েছে সেটা শহরের বাইরে। ডাকবাংলোয়। কর্মকর্তাদের একজন মোটরে আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। কিন্তু পথে বিপত্তি।

শহর ছাড়িয়ে একটু গিয়েই মোটর বিকল হল। আধঘণ্টা ধরে অনেক চেষ্টা করেও মোটর চালু করা গেল না। ঘড়িতে রাত তখন এগারোটা দশ। কর্মকর্তা বললেন, মুস্কিল হল দেখছি, এক কাজ করা যাক। সামনেই রাজা-বাহাদুরের বাড়ি!

রাতটা সেখানেই কাটানো যাক। ফিকে জ্যোৎস্নায় বিরাট অট্টালিকার অস্পষ্ট কাঠামো দেখা গেল। মস্ত বড় লোহার ফটক। কর্মকর্তা ফটকের এপার থেকে চীৎকার শুরু করলেন, দারোয়ান, দারোয়ান?

অনেকক্ষণ ডাকার পর আধবুড়ো এক দারোয়ান এসে দাঁড়াল। কর্মকর্তাকে চিনতে পেরে সেলাম করল। নীচের দুটো ঘর খুলে দাও। মোটর খারাপ হয়ে গেছে। আমরা রাতটা এখানে কাটাব। দারোয়ান বিড় বিড় করে কি বলল, তারপর কোমরে বাঁধা চাবির গোছা থেকে চাবি বের করে দুটো ঘর খুলে দিল। একটা ঘরে আমি, আর একটায় কর্মকর্তা আর ড্রাইভার। ঘরের মধ্যে পা দিয়েই বুঝতে পারলাম ঘর রীতিমত ঝাড়পৌঁছ করা হয়। কোথাও একতিল ময়লা নেই। উঁচু খাট, তার উপর পরিষ্কার বিছানা! ঝালর দেওয়া দুটো বালিশ।

সারারাত বাতি জ্বেলে ঘুমানো অভ্যাস। অন্ধকারে একেবারেই ঘুম হয় না। কম পাওয়ারের নীলাভ বাতিটা জ্বেলে রাখলাম। শুয়ে শুয়ে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে চোখে পড়ে পায়ের দিকে একটা তেল রঙ-এর ছবি।

সিংহাসনের মতন কারুকার্য করা একটা চেয়ারে একজন প্রৌঢ় বসে! অঙ্গে জমকালো পোষাক, প্রকাণ্ড মুখ। বিরাট গোঁফ, রক্তাক্ত দুটি চোখ। যেন জ্বল জ্বল করছে। ইনিই সম্ভবত রাজাবাহাদুর, এই অট্টালিকার মালিক ছিলেন। বাইরে বৃষ্টির শব্দ। গাছের পাতায় পাতায় নূপুরের আওয়াজের মতন। এক সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘট্ ঘট্ ঘট্ --

ঘুমের মধ্যে শব্দ কানে এল। প্রথমে মনে হল ঝড়ের বেগে জানলার পাল্লা কাঁপছে। তারপর মনে হল, কে যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে।

এত রাত্রে কে দরজা ঠেলছে।

তবে কি কোন কারণে কর্মকর্তা কিংবা ড্রাইভার ডাকছে। দু-হাতে চোখ রগড়ে উঠে বসলাম। না। যেদিকে দরজা, শব্দটা সেদিক থেকে আসছে না। ফিরতেই সারা শরীর কেঁপে উঠল। আমি ভীরু এমন বদনাম কেউ দেবে না, কিন্তু চোখের সামনে এমন এক দৃশ্যকে অস্বীকারই বা করি কি করে!

ছবির ফ্রেমটুকু রয়েছে, রাজাবাহাদুর নেই।

ছবির ঠিক নিচে রাজাবাহাদুর বসে।

এক পোশাক, এক ভঙ্গী। নিশ্চল, নিথর, তবু হাতের মোষের সিং-এর ছড়িটা মেঝের উপর ঠুকছেন খট্‌ খট্‌ খট্‌। আমার মনে হল শরীরের সমস্ত রক্ত জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। চীৎকার করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছি। চুপ চাপ রইলাম।

বাইরে ঝড়ের গতি আরও উদ্দাম। হঠাৎ এক সময় শব্দ করে দরজা খুলে গেল। হাওয়ার ঝলকের সঙ্গে দীর্ঘকৃশ চেহারার একজন ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল। এগিয়ে আসতে দেখতে পেলাম লোকটার খালি গা, আর ময়লা ধুতি হাঁটুর ওপর তোলা। মাথায় মোটা টিকি। এদেশের চাষা-ভুষো লোক বলেই মনে হয়।

লোকটা রাজাবাহাদুরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ভ্রূকুটি ফুটে উঠল।

কে?

আমি ঠাকুরপ্রসাদ।

ঠাকুরপ্রসাদ? এখানে এত রাত্রে কি দরকার।

আমার ছেলে শিউপ্রসাদ কই?

শিউপ্রসাদ, তা আমি কি করে জানব?

হ্যাঁ, তুমি জান! তোমার লোক তাকে ধরে এনেছে। আমার খাজনা বাকি ছিল, দু’সাল ধরে দিতে পারছি না, তাই তোমার লোক আমার ছেলেকে ধরে এনেছে। বল কোথায়?

মনে হল রাজাবাহাদুর যেন একটু অস্বস্তি বোধ করলেন। একবার খোলা দরজার দিকে দেখলেন, এই আশায় যদি তাঁর কোন পাইক, এ ঘরে এসে পড়ে। কিন্তু না, কেউ এল না। এই গভীর রাতে, ঝড়বৃষ্টির মধ্যে সবাই বোধহয় নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাচ্ছে! কেউ এল না দেখে রাজাবাহাদুর বললেন, আমি তোমার ছেলের কথা জানিনা। তুমি যেতে পার।

যাবার জন্য আমি আসিনি। ঠাকুরপ্রসাদের গলায় যেন সিংহ গর্জনের সুর।

তার মানে?

তার মানে?

আমি প্রথমে ভাবলাম, বুঝি বিদ্যুৎ চমকাল! না বিদ্যুৎ নয়, ঠাকুরপ্রসাদ কোমর থেকে ধুতির আড়ালে লুকানো প্রকাণ্ড একটা ভোজালি বের করল।

এ কি?

রাজাবাহাদুর আর্তকণ্ঠে চীৎকার করে উঠলেন। শিউপ্রসাদকে আমার চাই, নইলে তোমাকে প্রাণে বাঁচতে দেব না। বল শিউপ্রসাদ কোথায়?

চোরা কুঠুরিতে।

বলতে বলতে রাজাবাহাদুর উঠে দাঁড়ালেন। উঠে দাঁড়িয়েই দেয়ালে ফটোর পিছনে হাত দিয়ে কি একটা টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘড় ঘড় করে শব্দ।

রাজাবাহাদুর সেই দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন। ওই যে চোরা কুঠুরি। ওইখানে তোমার ছেলে আছে।

ঠাকুরপ্রসাদ যে ভাবে নেমে গেল, মনে হল যেন সিঁড়ি আছে। একটু পরেই একটা আর্তনাদ শোনা গেল।

ঠাকুরপ্রসাদ উপরে উঠে এল। তার কোলে মরা ছেলে। শিউপ্রসাদ, শিউপ্রসাদ বাপ আমার। তার কান্নার শব্দে আমার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। মরা ছেলেকে মেঝের ওপর নামিয়ে রেখে ঠাকুরপ্রসাদ সোজা হয়ে রাজাবাহাদুরের মুখোমুখি দাঁড়াল।

বজ্র গর্জনে বলল, আর নয়, তোমার অত্যাচার অনেক সহ্য করেছি। এবার প্রতিশোধ নেব। যে ভোজালিটা কোমরে গুঁজে রেখেছিল, সেটা সে আবার টেনে বের করল।

আমি ভয় পেলাম। এখনই আমার চোখের সামনে একটা খুনোখুনি হয়ে যাবে ভেবে চীৎকার করে উঠলাম।

কি আশ্চর্য, গলা দিয়ে একটু স্বর বের হ’ল না। রাজা বাহাদুর চেঁচালেন, রামলোচন, পিয়ারীলাল। ঠাকুরপ্রসাদ জোরে হেসে উঠল, হাঃ-হাঃ-হাঃ, কেউ আসবে না। সবাই যাত্রা শুনতে গেছে। সেই খবর পেয়েই আমি এসেছি। ভগবানের নাম স্মরণ কর। তারপর কি হয়ে গেল। আমার চারদিকে ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে গেল। সেই ধোঁয়ার মধ্যে রাজাবাহাদুর আর ঠাকুরপ্রসাদ হারিয়ে গেল।

ঘুম যখন ভাঙল তখন সবে ভোর হচ্ছে। কাঁচের জানলা দিয়ে সূর্যের প্রথম কিরণ এসে বিছানার ওপর পড়েছে। বিছানা থেকে উঠেই ফটোর দিকে দেখলাম রাজাবাহাদুরের প্রকাণ্ড মূর্তি। নেমে ফটোর পিছনে হাত দিয়ে দেখলাম। চোরাকুঠুরি খোলার কোন বোতাম দেখতে পেলাম না। মেঝে নিরীক্ষণ করে দেখলাম। কোথাও কোন ফাটল নেই।

তাহলে সবই আমার মনের ভুল কিংবা স্বপ্নে সব কিছু দেখেছি। দরজা খুলে বাইরে এলাম। গেটের কাছে দরোয়ান বসে। তার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সে উঠে সেলাম করল। তাকে সোজাসুজি প্রশ্ন করলাম। আচ্ছা এখানে চোরাকুঠুরিটা কোথায়? দরোয়ান চমকে উঠল, চোরাকুঠুরি!

হ্যাঁ। যেখানে রাজাবাহাদুর প্রজাদের ধরে এনে রাখতেন।

আপনাকে এ সব কে বলল বাবুজী।

যেই বলুক। কথাটা সত্যি কি না তুমি বলনা?

দরোয়ান চাপা গলায় বলল, আমি কিছু জানি না বাবুজী। বাবার কাছে শুনেছি, যে ঘরে আপনি শুয়েছিলেন সেখানে চোরাকুঠুরি ছিল। মেঝেটা ফাঁক হয়ে নেমে যাবার রাস্তাও ছিল। রাজাবাহাদুর মরে যাবার পর তার ছেলে বিলাত থেকে ফিরে এসে মেঝে গেঁথে চোরা-কুঠুরি বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

রাজাবাহাদুরের ছেলে কোথায় থাকেন?

কলকাতায়! মাঝে মাঝে দশ-বার দিনের জন্য এখানে আসেন।

আচ্ছা আর একটা কথা!

বলুন বাবুজী।

রাজাবাহাদুর কিভাবে মারা গেছেন?

দরোয়ান তখনই কোন উত্তর দিল না। একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে রইল। কি, বল? বল? আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম।

দরোয়ান প্রায় কেঁদে ফেলল। আমি কিছু জানি না বাবুজী। আমার বাবার কাছে শুনেছি, তিনি এক প্রজার হাতে খুন হয়েছিলেন। যে প্রজার নাম ঠাকুরপ্রসাদ।

দরোয়ান উত্তর দেবার আগেই কর্মকর্তার গলা কানে এল।

চলুন মুখ হাত ধুয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি। সকালে কলকাতা ফেরার একটা ট্রেন আছে।

তারপর অনেক বছর কেটে গেছে, কিন্তু সে রাত্রের সে দৃশ্যের কথা আমি ভুলতে পারিনি। এখনও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে চমকে জেগে উঠি। রাজবাহাদুরের চীৎকার কানে আসে। রামলোচন, পিয়ারীলাল? সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরপ্রসাদের উৎকট হাসি, কেউ নেই, কেউ আসবে না।

ঠাকুরপ্রসাদের পায়ের কাছে মরা ছেলে, হাতে উদ্যত ভোজালি। সে রাতে নিছক স্বপ্ন দেখেছি একথা মন মানতে চায় না। অতীতের একটা ঘটনা চোখের সামনে ঘটেছিল, এ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কি করে এটা সম্ভব হল?

এর উত্তর আমার জানা নেই।

ভূত নেই?

লেখক: হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

আমি তোমাদের আগে বলেছি, এখনও বলছি, ভূত আর ভগবান নিয়ে তর্কের আজও শেষ হয়নি। যতদিন মানুষের মনে অনুসন্ধিৎসা থাকবে, ততদিন শেষও হবে না।

এ বিষয়ে পৃথিবীর বিদ্বান এবং সাধারণ লোক দুটো মত পোষণ করেন। কেউ বলেন, বিজ্ঞান ভূতের অস্তিত্ব মানে না, কিন্তু বিজ্ঞান কি শেষ কথা? আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারে? আবার কেউ বলেন, ভূত নিশ্চয় আছে।

এমন ঘটনা তোমাদের মধ্যে অনেকেই শুনেছ, কিংবা দেখেছ, খ্যাতনামা ডাক্তাররা যে মুমূর্য রোগীকে দিনের পর দিন চিকিৎসা করেও সারাতে পারে না, এক সামান্য ফকির রোগীর গায়ে হাত বুলিয়ে, কিংবা তার মাথায় একটা রুদ্রাক্ষ ছুঁইয়ে তাকে সম্পূর্ণ নিরাময় করে তুলেছে।

এতে বোঝা যায়, আমাদের লৌকিক জগতের বাইরে আর একটা জগৎ আছে, যেটা ঠিক বিজ্ঞানের নিয়মে চলে না।

তোমরা পরজন্ম সন্বন্ধে অনেক কথা শুনেছ।

সংবাদপত্রেও নিশ্চয় পড়েছ, জাতিস্মর নিয়ে কত আলোচনা হচ্ছে।

সুদূর রাজস্থানে মরুর মধ্য দিয়ে উটের পিঠে চেপে বাপের সঙ্গে ছোট সাত বছরেরর ছেলে চলেছে। হঠাৎ একটা গ্রামের কাছে একটা কুটিরের দিকে হাত দেখিয়ে ছেলে বাপকে বলল, ওই দেখ বাবা, ওই আমার বাড়ি। ওখানে আমার আত্মীয়স্বজন সবাই আছে।

বাপ প্রথমে কড়া ধমক দিল ছেলেকে, কিন্তু তাকে নিরস্ত করা গেল না। তার মুখে এক কথা। ওখানে আমার বুড়ো বাপ রয়েছে, বউ চন্দ্রা রয়েছে, ছোট ভাই এক ভোর বেলা পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে আমাকে কুয়ার মধ্যে ফেলে দেয়। তুমি চলই না ওখানে।

কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে বাপ সেই কুটিরের সামনে গেল।

দাওয়ার ওপর এক বৃদ্ধ বসে হাঁপাচ্ছে। একটি বউ জল তুলছে কুয়া থেকে। ছেলেটি উট থেকে নেমে হনহন্‌ করে বৃদ্ধের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

বাবা, আমি কেশোপ্রসাদ। তোমার বড় ছেলে। দু'চোখের ওপর কোঁচকানো মাংসের স্তর নেমেছে। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ।

বৃদ্ধ ঝুঁকে পড়ে দেখে বলল। দিল্লাগি করতে এসেছ! আমার ছেলে আজ আট বছর মারা গেছে। ভোর বেলা কুয়া থেকে জল তুলতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল কুয়ার মধ্যে।

ছেলেটি বলল, না, পা পিছলে পড়ে যায় নি। মাধোপ্রসাদ তাকে ঠেলে দিয়েছিল। তার মতলব ছিল আমি না থাকলে বাজরার খেত, বাড়িঘর সবই সে পাবে।

যে বউটি জল তুলছিল, সে ছেলেটির কথায় আকৃষ্ট হয়ে কাছে এসে দাঁড়াল।

তার দিকে চোখ পড়তেই ছেলেটি চেঁচিয়ে উঠল।

আরে চন্দ্রা, আমি কেশোপ্রসাদ, তোমার মরদ।

চন্দ্রার বয়স বছর ত্রিশের কম নয়। সে সাত বছরের স্বামীকে দেখে হেসে ফেলল। চোখের কোণে একটু জলও দেখা গেল। বলল, পাগল কোথাকার।

ছেলেটির বর্তমান বাপ একটু পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার সে এগিয়ে এসে বলল, কি ঝামেলা করছিস? দেরি হয়ে যাচ্ছে, চল।

ছেলেটি যাবার কোন লক্ষণই দেখাল না। দাওয়ার ওপর বসে পড়ে বলতে লাগল, কোন ঘরে সে শুত, সে ঘরে কি আসবাব আছে, বাজরার খেতের পরিমাপ কত, বাপের দু'বার সাংঘাতিক অসুখ করেছিল, বিকানীর থেকে সেই-ই হাকিম নিয়ে এসেছিল।

আরো অনেক কথা সে বলল।

সে কোন গাঁয়ে বিয়ে করেছিল। চন্দ্রার বাপের নাম কি। এমন কি বিয়ে করে বউকে নিয়ে যখন ফিরছিল, তখন মাঝপথে তুমুল বালির ঝড় উঠেছিল। সে আর চন্দ্রা সারা দেহ আবৃত করে উটের পেটের নীচে আশ্রয় নিয়ে নিজেদের বাঁচিয়েছিল।

চন্দ্রা আর চন্দ্রার শ্বশুর তো অবাক।

সাত বছরের ছেলে এত সব কথা জানল কি করে?

এবার ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল, মাধোপ্রসাদ তো আর নেই?

না, তাকে খেতের মধ্যে সাপে কামড়েছে। তুই যাবার এক বছরের মধ্যেই।

ছেলেটি যাবার মুখেই বাধা। চন্দ্রা তাকে জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে কান্না। সে তাকে ছেড়ে দেবে না।

ছেলেটি বলল, আমার নবজন্ম হয়েছে। নতুন আমির ওপর তোমাদের কোন দাবি নেই। আমার বাবা আছে, মা আছে, দাদারা আছে। সে সংসারে আমাকে ফিরে যেতেই হবে। এই নিয়ম।

ছেলেটি বাপের সঙ্গে আবার উটের পিঠে চাপল।

তবে মাঝে মাঝে সে পুরানো সংসারেও আসত।

এই ছেলেটি জাতিস্মর।

আগের জন্মের কথা তার সব মনে আছে।

বিজ্ঞান এর কি ব্যাখ্যা দেবে?

খবর পেয়ে বিখ্যাত এক গবেষক ছেলেটির কাছে গিয়েছিলেন। তাকে নানাভাবে পরীক্ষা করেছিলেন। শেষে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, এর মধ্যে কোন কারচুপি নেই। ছেলেটির সত্যিই আগের জন্মের সব কথা মনে আছে।

এই রকম জাতিস্মরের কাহিনী ইদানীং অনেক শোনা যায়। শুধু ভারতবর্ষে নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও । ঠিক এমনিভাবে ভূতের কাহিনীও সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে।

আজ তোমাদের এমনই এক ভূতের কাহিনী শোনাচ্ছি।

এ কাহিনীর সঙ্গে আমি কিছুটা জড়িত, কাজেই এটা যে নির্ভেজাল সত্যি কাহিনী এ বিষয়ে তোমাদের কাছে আমি হলফ করে বলতে পারি।

আমার একজন খুব নিকট আত্মীয়া, নাম আরতি বন্দ্যোপাধ্যায় এম, এ, বি, এড কিন্তু ওকালতি করে না। বেসরকারী অফিসের আইন বিভাগের উচ্চপদস্থ অফিসার, থাকত পাইকপাড়ায়। এক বান্ধবীর সঙ্গে একটি ফ্ল্যাট নিয়ে।

বান্ধবীটি এক স্কুলের শিক্ষিকা।

জীবন দু'জনের বেশ ভালই কাটছিল। ছুটির দিন সিনেমা, কিংবা আরো অনেক বান্ধবী মিলে বনভোজন, অথবা গড়ের মাঠে প্রদর্শনী দেখতে যাওয়া।

হঠাৎ আরতির বিয়ে ঠিক হলো।

পাত্রও উচ্চ শিক্ষিত। এক যন্ত্রপাতির কারখানার আধা মালিক।

আরতি আমার কাছে এসে দাঁড়াল।

আপনি তো অনেক কিছুর সন্ধান রাখেন। আমাকে একটা বাড়ি খুঁজে দিন।

জিজ্ঞাসা করলাম, কি, কিনবে?

না, না, ভাড়া নেব। খুব বড় দরকার নেই। দু'জনের থাকবার মতন। একটু যেন ভাল এলাকায় হয়, আর দক্ষিণ কলকাতায় দেখবেন, কারণ ওর কারখানাটা কালীঘাটে।

আমি নিজে থাকি বালীগঞ্জে। একেবারে লেকের কাছে।

পরদিন থেকেই বাড়ি খোঁজা শুরু করে দিলাম। শুধু নিজে নয়, গোটা দুয়েক দালালকেও লাগিয়ে দিলাম।

অনেক বাড়ির সন্ধান এল। কিছু নিজে, কিছু আরতিকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি দেখতে লাগলাম। আরতি ভারী খুঁতখুঁতে মেয়ে। কোন বাড়িই তার পছন্দ হলো না। কোন না কোন কারণে সব নাকচ করে দিল।

তিন মাস ঘোরাঘুরির পর কালীঘাট অঞ্চলে এক বাড়ির সন্ধান মিলল।

পার্কের সামনে প্রায় নতুন বাড়ি। সদ্য রং করা হয়েছে। খান তিনেক কামরা। বারান্দা, বাথরুম, আবার ওরই মধ্যে এক ফালি উঠানও আছে। সেই অনুপাতে. ভাড়াও খুব বেশী নয়। দুশো কুড়ি।

বাড়ির মালিক পাশের বাড়িতেই থাকেন।

এ বাড়ি আরতির পছন্দ হয়ে গেল।

শুধু আরতির নয়, আরতির স্বামী আশিসেরও।

আর দেরী না করে সেদিনই দু'মাসের ভাড়া আগাম দেওয়া হলো।

মাসখানেক পর আরতির বাসায় বেড়াতে গিয়ে খুব ভাল লাগল। নতুন আসবাবপত্র দিয়ে চমৎকার সাজিয়েছে। উঠানের পাশে সারি সারি টব। দেশী ফুল বেল, জুঁই যেমন আছে, তেমনি বিদেশী ফুল ডালিয়া, পাপি, হলিহকও রয়েছে।

এমন বাসা খুঁজে দেবার জন্য আরতি আশিস দু'জনেই আমাকে বারবার ধন্যবাদ দিল।

এরপর অনেকদিন আর আরতির সঙ্গে দেখা হয় নি।

অফিসের কাজে দিল্লী যেতে হয়েছিল, সেখানে মাস তিনেক কাটিয়ে কানপুর। সেখানেও এক মাসের ওপর লেগে গেল। কলকাতা ফিরলাম প্রায় পাঁচ মাস পর।

এক ছুটির দিনে বন্ধুবান্ধব নিয়ে গল্প করছি, আরতি এসে ঢুকল। প্রথম নজরেই মনে হলো, তার চেহারা একটু যেন ম্লান।

আরতি ভিতরে চলে গেল। বন্ধুরা বিদায় হতে আমিও ভিতরে গেলাম। দেখলাম, আরতি চুপচাপ সোফার ওপর বসে আছে। আমাকে দেখে বলল, আপনার সঙ্গে কথা আছে।

কি বল? শরীর খারাপ নাকি? চেহারাটা কেমন দেখাচ্ছে।

আরতি মুখ তুলে বলল।

রাত্রে একেবারে ঘুম হচ্ছে না।

সে কি? ডাক্তার দেখাও, নইলে শক্ত অসুখে পড়ে যাবে।

ডাক্তার কিছু করতে পারবে না।

তার মানে?

মানে, বাড়িটা ভাল নয়।

সে কি, স্যাঁতস্যাঁতে বা অন্ধকার এমন তো নয়। রোদ বাতাস প্রচুর।

সে সব কিছু নয়, অন্য ভয় আছে।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

আরতি কিছুক্ষণ কি ভাবল, তারপর আস্তে আস্তে বলল, ও বাড়িতে আমরা দু'জন ছাড়াও অন্য একজন আছে।

অন্য একজন আছে?

হ্যাঁ, তাকে মাঝে মাঝে গভীর রাতে দেখা যায়।

অন্য লোক হলে কথাটা হেসে উড়িয়ে দিত। শুনতেই চাইত না। কিন্তু আমি মৃত্যুর পরে আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী। আমার স্থির ধারণা, যারা অতৃপ্ত কামনা বাসনা নিয়ে এ পৃথিবী ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়, তারা আবার ফিরে আসে। কখনও বায়বীয় মূর্তি, কখনও মানুষের রূপ ধরে ফেলে যাওয়া সংসারের মাঝখানে ঘুরে বেড়ায়।

কি ব্যাপার খুলে বল তো।

বলছি।

আরতি কোলের উপর রাখা ভ্যানিটি ব্যাগটা পাশে নামিয়ে রাখল। সহজ হয়ে বসে বলতে লাগল। মাস দুয়েক আগে হঠাৎ খুটখাট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মনে হলো বাইরের ঘরে যেন কার পায়ের আওয়াজ। আশিস পাশেই শুয়েছিল। তার ঘুমের বহর তো জানেনই। বুকের ওপর দিয়ে এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য চলে গেলেও তার -ঘুম ভাঙবে না। কাজেই তাকে ডাকার চেষ্টা না করে নিজেই উঠে পড়লাম। ভীতু এ বদনাম কেউ দিতে পারবে না। বরং সবাই জানে আমি রীতিমত সাহসী। প্রথমে জানলা দিয়ে দেখলাম। কিছু দেখা গেল না।

কিন্তু খুটখাট শব্দ ঠিক চলতে লাগল।

মনে হলো, খড়ম পায়ে দিয়ে কে যেন পায়চারি করছে।

অথচ কোন লোককে দেখা গেল না।

রাতে মাংস রান্না হয়েছিল। হাড়ের টুকরো রান্নাঘরে প্লেটের ওপর পড়েছিল। খুব সম্ভবতঃ ইঁদুর সেই হাড়ের টুকরো বাইরের ঘরে নিয়ে এসেছে।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। তখনই ঘুম এল না। একবার ঘুম ভেঙে গেলে চট করে ঘুম আমার আসে না। এপাশ ওপাশ করতে লাগলাম। পাশের লোকটি অকাতরে নিদ্রা যাচ্ছে। নাক দিয়ে বিচিত্র ধ্বনি বের হচ্ছে।

ঘরে হালকা সবুজ রঙের একটা বাতি জ্বলছিল। অন্ধকারে আমি ঘুমাতে পারি না। এ আমার ছেলেবেলার অভ্যাস। হঠাৎ দেখলাম দীর্ঘ একটা ছায়া আলোকে আড়াল করে এ ঘর থেকে অন্য ঘরে চলে গেল। চমকে উঠে বসলাম।

আশিসকে ডেকে বললাম। এই ওঠ, ওঠ, ঘরের মধ্যে কে ঢুকেছে।

আশ্চর্য মানুষ! চোখ খুলল না। পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, ফ্রিট দিয়ে দাও।

ছায়াটা সরে সরে বাইরের দেয়ালের সঙ্গে মিশে গেল। আর দেখা গেল না।

আমি তখন বিছানার ওপর উঠে বসেছি।

মনকে বোঝালাম, এ শুধু চোখের ভুল।

তা না হলে, ছায়া দেখা গেল, অথচ মানুষটাকে দেখা গেল না, তা কি হতে পারে? ভূতের কথা ভাবতেও পারি নি, কারণ ভূত আছে এমন অদ্ভুত কথা আমি কোনদিনই বিশ্বাস করি না।

আমি খুব মনোযোগ দিয়ে আরতির কথা শুনছিলাম। এবার বললাম, তারপর?

তারপর দিন কুড়ি সব স্বাভাবিক। কোন গোলমাল নেই। সে রাতে ভয় পেয়েছিলাম ভেবেই হাসি পেত। একেবারে ছেলেমানুষি কাণ্ড।

আশিস কারখানার কাজে দিন চারেকের জন্য জামসেদপুর গিয়েছিল। বাড়িতে আমি একলা। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। এবারে একেবারে স্পষ্ট দেখলাম।

দীর্ঘ একহারা চেহারা। খালি গা। কাঁধের ওপর ধবধবে সাদা উপবীত। কোঁচাটা ভাঁজ করে সামনে গোঁজা। মাথায় পাকা চুল। দুটি চোখ জবাফুলের মতন লাল। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ির মধ্যে দিয়ে উঁচু চোয়াল দেখা যাচ্ছে।

লোকটির উর্দ্ধ দৃষ্টি। হাতে শক্ত একটা দড়ি। ওপর দিকে কি যেন খুঁজছে।

সেই মুহূর্তে শরীরের সব রক্ত জমে হিম শীতল হয়ে গেল। দু'হাতে বুকটা চেপে ধরেও দ্রুত স্পন্দন কমাতে পারলাম না। মনে হলো, তখনই হার্টফেল করবে। বিকৃতকণ্ঠে বললাম, কে, কে ওখানে?

লোকটি ওপর থেকে দৃষ্টি নামিয়ে আমার দিকে দেখল। জ্বলন্ত দৃষ্টি। পলকহীন। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। তখনই মনে হলো লোকটা এ জগতের কেউ নয়। অশরীরী আত্মা।

আস্তে আস্তে লোকটা পাশের ঘরে ঢুকে গেল। আমি খাট থেকে নামলাম, কিন্তু তার পিছনে যাবার সাহস হল না।

এই কথাগুলো বলবার সময়ে দেখলাম আরতির মুখ-চোখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।

আমি বললাম।

এরকম যখন ব্যাপার, তখন না হয় ঐ বাড়ি ছেড়ে দাও। অন্য কোথাও বাড়ি খুঁজি। আরতি উত্তর দিল। তাতেও তো মুশকিল। আপনি বোধহয় লক্ষ্য করেন নি, বাড়ির দেয়াল ভেঙে চুরে আমি দুটো ঘর বাড়িয়েছি। বাইরেটা চুনকাম করেছি, ভিতরে রং দিয়েছি, গ্যাস বসাবার জন্য রান্নাঘরেরও অনেক অদলবদল করেছি। অবশ্য এসব বাড়িওয়ালার মত নিয়েই করেছি। ভাড়া থেকে মাসে মাসে কিছু করে টাকা কেটে রাখছি। সে টাকা শোধ হতে বছর দুয়েক লাগবে তার আগে বাড়ি ছেড়ে দিলে আমার অনেক টাকা লোকসান হয়ে যাবে।

একটু ভেবে আমি বললাম।

ঠিক আছে, আমি একবার তোমার বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা করব। তিনি কি বলেন, শুনি।

দিন দুয়েকের মধ্যেই বাড়িওয়ালার কাছে গিয়ে হাজির হলাম। ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ, বিপুলকায়। কলকাতায় কিছু বাড়ি আছে, কাঠের ব্যবসা।

একটা ইজিচেয়ারে বসেছিল। আমাকে দেখে ওঠবার চেষ্টা করল, পারল না।

কি খবর? আমার কাছে হঠাৎ?

আরতির কাছে শোনা সব কিছু বললাম। শেষকালে জিজ্ঞাসা করলাম, ঠিক করে বলুন তো? ও বাড়িটার কোন দোষ আছে?

দোষ মানে?

মানে, কেউ ওবাড়িতে অপঘাতে মারা গিয়েছিল? আগের কোন ভাড়াটে?

বাড়িওয়ালা মাথা নাড়ল।

না মশাই, এর আগে মাত্র দুঘর ভাড়াটে ছিল। অপঘাত তো দূরের কথা, এমনই মৃত্যু কারো হয় নি। তাছাড়া এই বিজ্ঞানের যুগে, মানুষ যখন পায়চারি করার জন্য চাঁদে যাচ্ছে, তখন কি সব ভূত-প্রেতের কাহিনী আমদানি করছেন।

তর্ক করলাম না। অনেক বিষয় আছে তর্ক করে বোঝানো যায় না। স্থুল উদাহরণ দেওয়া যেখানে সম্ভব নয়।

চলে এলাম।

তারপর মাস দুয়েক আরতির কোন খবর নেই।

আমিও নিশ্চিন্ত। যাক, অপদেবতার উপদ্রব আর নেই। সব শান্ত।

কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে একদিন সকালে আশিস এল। কোটরগত চোখ, বিবর্ণ মুখ, ঘোলাটে দৃষ্টি। বললাম, কি হে শরীর খারাপ নাকি? আরতি কেমন আছে?

আমার কথার উত্তর না দিয়ে আশিস অস্পষ্ট গলায় বলল।

একটু জল দিন। জল শুধু খেল না, মুখে চোখেও দিল। তারপর বলল।

আরতিকে টালিগঞ্জে তার দিদির বাড়ি দিয়ে এসেছি। কালীঘাটের বাড়িতে আর আমাদের থাকা চলবে না।

কেন, কি হলো?

আরতির কাছে তো আপনি কিছু কিছু শুনেছেন। আমি কিন্তু এ পর্যন্ত কিছু দেখি নি। কোন শব্দও শুনি নি। সেইজন্য এতদিন আমি আরতিকে ঠাট্টা করতাম। তা ছাড়া ভূত, আত্মা এ সবে আমার কোনদিনই কোন বিশ্বাস নেই।

কাল একটা কাজে হাওড়ায় আটকে পড়েছিলাম। বাস বন্ধ। ট্যাক্সিও পাই না। কিছুটা হেঁটে তারপর ট্রামে বাড়ি পৌঁছতে প্রায় বারোটা হয়ে গিয়েছিল।

আরতি খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। যাক, আরতিকে খাবার সাজাতে বলে আমি হাত মুখ ধোবার জন্য বাথরুমে ঢুকে পড়লাম। নীচু হয়ে বেসিনে মুখ ধুয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই মাথায় ঠক করে কি একটা লাগল। বাথরুমে আবার কে কি রাখল।

একটু কমজোর বাতি। কিন্তু সেই বাতিতেই দেখতে কোন অসুবিধা হলো না।

ঠাণ্ডা একটা বরফের শ্রোত আমার মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল।

বাথরুমটা অ্যাসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া। আগে টালির ছাদ ছিল, আমরাই খরচ করে অ্যাসবেসটস দিয়ে নিয়েছিলাম। ওপরে দুটো কাঠের কড়ি।

একটা কড়িতে দেহটা ঝুলছে।

গলায় দড়ির ফাঁস। মাথাটা একদিকে কাত হয়ে পড়েছে। দুটো চোখ আধবোজা। জিভটা অনেকখানি বের হয়ে গেছে। বোধ হয় জিভের ওপর দাঁতের চাপ পড়েছিল, তাই জিভ কেটে রক্তের ফোঁটা ঝরে পড়েছে। কিছুটা দেহের ওপর, কিছুটা মেঝেতে, পরনে আধময়লা ধুতি, কাঁধে পৈতে।

মাথা উঁচু করার সময় ঝুলন্ত দেহের একটা পা আমার মাথায় ঠেকে গিয়েছিল।

আমি সব কিছু ভুলে আরতি বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম।

আরতি আমার অপেক্ষায় খাবার টেবিলে বসেছিল।

আমার চিৎকারে ছুটে এসে বাথরুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল।

প্রথমে সে সঠিক কিছু বুঝতে পারে নি।

তারপর ওপর দিকে চোখ যেতেই ও মাগো বলে মেঝের ওপর ছিটকে পড়ে অজ্ঞান। আরতির মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে কোনরকমে জ্ঞান ফিরিয়ে আনলাম। তারপর বাকী রাতটা দু'জনে বাইরের ঘরে বসে কাটালাম।

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম ট্রামে উঠে আরতিকে নিয়ে যখন তার দিদির বাড়ি এলাম, তখন জ্বরে আরতির গা পুড়ে যাচ্ছে। দুটো চোখ করমচার মতন লাল।

আমি চুপ করে সব শুনলাম।

আশিসের কথা শেষ হতে জিজ্ঞাসা করলাম।

আরতি এখন কেমন আছে?

খুব ভাল নয়। বিকারের ঘোরে মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে উঠছে, ওই লোকটা, ওই লোকটাই তো ঘুরে বেড়াচ্ছিল দড়ি হাতে। আমি এখানে থাকব না। আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে চল।

অবশ্য আরতির জন্য খুব চিন্তা নেই। ভয়টা কেটে গেলেই ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু সব কিছু নিজের চোখে দেখবার দারুণ ইচ্ছা হলো। এমন তো নয়, এক সময় দরজা খোলা পেয়ে বাইরের কোন লোক বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে আত্মহত্যা করেছে? সে হয়তো আত্মহত্যা করবার নির্জন একটা জায়গা খুঁজছিল।

তাই আশিসকে বললাম।

চল একবার নিজের চোখে দেখে আসি। তাছাড়া, তোমরা ব্যাপারটাকে ভৌতিক ভাবছ, তাতো নাও হতে পরে! পুলিসে খবর দেওয়াও তোমাদের একটা কর্তব্য। তারা এসে মৃতদেহের ভার নেবে।

আশিস আমার সঙ্গে চলল।

তালা খুলে ভিতরে ঢুকলাম।

বাথরুমের মধ্যে গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। কোথাও কিছু নেই, সব পরিষ্কার।

আশিসকে জিজ্ঞেস করলাম। .

কই হে? কোথায় তোমার ঝুলন্ত দেহ? রক্তের একটি ফোঁটাও তো কোথাও দেখছি না। আশিস রীতিমত অপ্রস্তত।

সব চোখের ভুল, বুঝলে?

আশিস মাথা নাড়ল।

কিন্তু দু'জনেই ভুল দেখলাম? ও রকম হয়। একজনের ভয়, আর একজনের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে তাকেও এক ধরনের কাল্পনিক দৃশ্য দেখায়।

তুমিই দেখ না, কাল রাতে তুমি যদি সত্যিই ও রকম একটা দৃশ্য দেখে থাক, তাহলে আজ কোথাও কিছু নেই, তা কি হতে পারে? এইখানটাই তো দেখেছিলে?

মুখ তুলে ওপরের দিকে দেখেই আমি থেমে গেলাম।

কি আশ্চর্য, এটা তো আগে দেখি নি।

কড়ির সঙ্গে একটা মোটা দড়ি বাঁধা। দড়িটা ফাঁসের আকারে ঝুলছে।

অস্বীকার করব না, আমার হাত পা বেশ ঠাণ্ডা হয়ে গেল। বুকের দাপাদাপি তে জোরে যে ভয় হলো, স্পন্দন থেমে না যায়।

ঐ দড়ির ফাঁস তো প্রথমবার দেখি নি। আরও অবাক কাণ্ড, দড়ির ফাঁসটা অল্প অল্প দুলছে, অথচ কোথাও বাতাস নেই। বাইরে বাতাস থাকলেও বাথরুমে বাতাস ঢোকবার কোন সুযোগই নেই। আশিসের সঙ্গে বেরিয়ে এলাম।

এটা যে ভৌতিক ব্যাপার নয়, কোন মানুষের কারসাজী তা হওয়াও অসম্ভব নয়। কোন যুক্তিতর্ক বিস্তার করেও সমাধান করতে পারলাম না।

আরতিরা আর ও বাড়িতে ফিরে যায় নি। ভবানীপুরে একটা বাড়ি ঠিক করে উঠে গিয়েছিল। আর্থিক লোকসান সত্ত্বেও।

এ ঘটনার প্রায় মাস তিনেক পর এক বিকেলে কালীঘাট পার্ক দিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ আরতির বাড়িওয়ালার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। একটা বেঞ্চে বসে আছে।

আমি তার পাশে বসে পড়ে জিজ্ঞাসা করলাম।

মশাই, সত্যি কথা বলুন তো। বাড়িটার কি রহস্য? আমার আত্মীয়াটি তো থাকতে পারল না, পালাল।

প্রথমে কিছুতেই বলবে না। অবশেষে আমার পীড়াপীড়িতে বলল --

এক বুড়ো ভদ্রলোক ওই বাড়িতে আত্মহত্যা করেছিল। তা প্রায় বছর দশেক আগে। পেটে শূলবেদনা ছিল। বাড়ির সবাই নিমন্ত্রণ খেতে বাইরে গিয়েছিল, তখন বাথরুমে বুড়ো গলায় দড়ি দেয়। তারপর থেকে যে ভাড়াটে আসে, তারাই ভয় পায়। বেশীদিন থাকতে পারে না।

আমি বললাম গয়ায় পিগুদানের ব্যবস্থা করেন নি কেন?

করার চেষ্টা করেছি মশাই, অনেকবার করেছি। প্রত্যেকবার এক-একটা বিপদ! বুড়োর আত্মীয়রা গয়া গিয়েছিল পিগু দিতে, তিন দিন ধরে দারুণ ঝড়বৃষ্টি। ধর্মশালা থেকে বের হতেই পারল না।

আমি নিজে একবার গিয়েছিলাম। ট্রেন থেকে স্টেশনে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে একমাস হাসপাতালে শয্যাগত। পুরোহিত দিয়ে শাস্তি স্বস্ত্যয়নের আয়োজন করার চেষ্টা করেছিলাম। সেখানেও বিপত্তি। পুরোহিত আসনে বসবার সঙ্গে সঙ্গে ছাদ ভেঙে একটা চাঙড় তার মাথায় পড়ল। পুরোহিত জ্ঞান হারিয়ে মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়ল।

ব্যস, তারপর থেকে আর কোন পুরোহিতই আসতে রাজী হলো না। কি করি বলুন তো?

এর উত্তর আমার জানা ছিল না। কাজেই সেদিন বাড়িওয়ালার প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারি নি।

একটা কথা শুধু মনে হয়েছে, পৃথিবীর সব অবিশ্বাসী মানুষদের জড় করে চিৎকার করে বলি, যারা মনে করেন, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সবকিছু শেষ হয়ে যায়, প্রেতযোনি বলে কিছু নেই, তারা কালীঘাট অঞ্চলের এই বাড়িটায় রাত কাটিয়ে যান। বাড়িটা এখনও খালি।

ঠিকানা আমার কাছ থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে যাবেন। অবশ্য আমি, ভাল-মন্দ হয়ে গেলে কোনকিছুর জন্য দায়ী থাকব না, এই মর্মে আমাকে একটা লিখিত চুক্তিপত্র দিতে হবে।

টান

লেখক: হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

ভূত আছে কি নেই এ তর্ক বহুদিনের। ভগবানের অস্তিত্ব নিয়েও এ ধরণের তর্ক আদিম যুগ থেকে চলে আসছে, দুটো তর্কেরই আজও কোনও রকম নিষ্পত্তি হয়নি। আর হবে কিনা তাও বলা যায় না।

বিজ্ঞানের যুগে তোমরা হয়তো এ সব মানতে চাইবে না এবং এটাই স্বাভাবিক। অনুবীক্ষণ আর দূরবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে যা দেখা যায় না, তার অস্তিত্বই নেই এই তোমাদের হচ্ছে মত।

ভূতের কথা তোমাদের মতো এতদিন আমিও বিশ্বাস করতাম না। অনেক জায়গায় ভূত দেখার আমন্ত্রণও পেয়েছি। পোড়ো বাড়ীতে রাত কাটিয়েছি, ঘোর অমাবস্যায় শ্মশানে ঘোরাফেরা করেছি, কিছু কিছু চামচিকে আর শেয়াল ছাড়া আর কিছু নজরে পাইনি।

ভূত সম্বন্ধে ঘোরতর অবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলাম, এমন সময় এই ব্যাপারটা ঘটলো, যা আজকে তোমাদের কাছে বলতে বসেছি।

ঠিক আমাদের পাশের বস্তিতে থাকে সমর রায়, ছেলেটি দেখতে যেমন সুন্দর, লেখাপড়াতেও তেমনই উৎসাহী।

বি. এ. পরীক্ষা দেবার আগে মাঝে মাঝে আমার কাছে পড়তে আসতো। সেই সময়ে তার বিদ্যাবুদ্ধির পরখ করার সুযোগ মিলেছিলো। তাছাড়া একেবারে পাশের বস্তিতে থাকতো, কাজেই খুব ছোট্টোবেলা থেকেই তাকে দেখেছি।

ইদানীং অনেকদিন সমরের সঙ্গে দেখা আর হয়নি, আমরা শুনেছিলাম পরীক্ষার পর বাইরে কোথায় বেড়াতে গেছে।

এক সন্ধ্যায় ঘরে বসে একটা বই পড়ছি। বাইরে ঝড়ের আভাস। জানলা, দরজার পর্দাগুলো দমকা বাতাসে উড়ছে দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি যেন গায়ে এসে পড়লো, কিন্তু বইটা এত ভালো লাগছিলো যে, উঠে জানলাগুলো বন্ধ করতেও ইচ্ছে করছিলো না।

এমন সময় হঠাৎ সশব্দে দরজাটা খুলে গেলো। ভাবলাম ঝড়। চোখ ফিরিয়েই কিন্তু অবাক হলাম। সমর এসে দাঁড়িয়েছে উস্কখুস্ক চুল, পাংশু মুখ।

কি সমর কবে ফিরলে? বইটা মুড়ে প্রশ্ন করলাম।

সমর কৌচে আমার পাশে বসে বললো এই একটু আগে। জামা-কাপড় ছেড়েই আপনার কাছে চলে এসেছি। আপনাদের খবর ভালো তো?

বললাম হ্যাঁ, ভালো, কিন্তু কি ব্যাপার? জরুরী কোন কথা আছে নাকি?

ওর হাবভাব দেখে আমার মনে হলো সমরের বোধ হয় জরুরী কোনো কথা বলার আছে।

আপনার সময় হবে এখন? আপনার সঙ্গে আমার কথা ছিলো একটু। হাসলাম। বললাম অফুরন্ত সময়। বলো কি তোমার কথা আছে বলার?

এ প্রশ্ন হাজারবার হাজার জায়গায় শুনেছি। সোজাসুজি উত্তর না দিয়ে বললাম, কি বলতে চাইছো সেটাই তুমি সহজ করে বলো।

মৃত্যুর পরে মানুষ শেষ হয়ে যায় না, মাষ্টার মশাই। ভূত বলুন, আত্মা বলুন, তারা আছে। মাঝে মাঝে তারা দেখাও দেয় শুনেছি। আচ্ছা, এটা কি ঠিক?

বুঝলাম কোনো কারণে সমর খুব উত্তেজিত হয়েছে। অনেকেরই রজ্জুতে সর্প ভ্রম হয়। অন্ধকারে গাছপালা দেখে ভূত-প্রেত কল্পনা করে, কিংবা বদমাশ লোকের প্রতারণায় ভুলে মনে করে অশরীরী কিছু একটা দেখেছে।

সমর কোঁচার খুঁট দিয়ে মুখ আর কপাল মুছে নিলো। তারপর একটু দম নিয়ে আবার বলতে আরম্ভ করলো।

লক্ষ্ণৌতে আমার এক পিসী আছে জানেন বোধ হয়?

হ্যাঁ, তোমার কাছেই শুনেছি। তিনি কোন এক স্কুলের শিক্ষিকা তাই না?

সমর ঘাড় নাড়লো, পিসী বৈদ্যনাথ শিক্ষাসদনে পড়ান। তিনি অনেকদিন ধরে তাঁর কাছে আমাকে যেতে লিখেছেন, কিন্তু একটার পর একটা ঝঞ্ঝাটের পর ভাবলাম, এখন তো প্রচুর অবসর, এইবার ঘুরে আসা যাক কিছুদিন। তাই মাসখানেক আগে দেরাদুন এক্সপ্রেসে রওনা হয়ে গেলাম লক্ষ্ণৌ।

তোমার বাবার কাছে শুনেছি। আমি কৌচের ওপর পা দুটো তুলে ভালো করে বসলাম।

আপনি শুনলে হাসবেন, এই জীবনে আমার প্রথম রেলযাত্রা। কাজেই কৌতুহলের অন্ত ছিল না। প্রত্যেক স্টেশনে ট্রেন থামলেই আমিও নেমে প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করতে আরম্ভ করি। গার্ডের হুইসেলের সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে কামরায় উঠি। কিন্তু একটা স্টেশনে বিপদ ঘটল।

আমি সোজা হয়ে বসলাম। বললাম, কি? ট্রেন ছেড়ে দিলে তো? তুমি আর সেই ট্রেনে উঠতে পারোনি নিশ্চয়ই।

সমর আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে বলতে লাগল, এক স্টেশনে নেমে এদিক ওদিক বেড়াচ্ছি, হঠাৎ দেখলাম, একটি বছর আট নয়েকের মেয়ে, বেশ ফুটফুটে চেহারা, কোঁকড়ানো চুল, পরনে নীলচে রঙের একটা ফ্রক। আমাকে হাত নেড়ে ডাকছে।

প্রথমে ভাবলাম, আমারই ভুল হয়েছে। মেয়েটি বোধ হয় অন্য কাউকে ডাকছে। এদিক ওদিক চেয়ে দেখলাম, না অন্য কেউ তো ধারে কাছে নেই। মেয়েটিকে বাঙালী বলেই মনে হলো আমার প্ল্যাটফর্মের ওপর বেশীর ভাগই অন্য জাতের মানুষজনের জটলা। মেয়েটির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আমায় সে হাতছানি দিয়ে ডাকলো।

ভাবলাম বিদেশে মেয়েটি নিশ্চয় কোনো বিপদে পড়েছে। আমাকে স্বজাতি দেখে সাহায্য চাইছে।

মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলাম। মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল, আমি এগোতেই সে চলতে শুরু করলো স্টেশনের বিশ্রাম কামরার দিকে। বুঝতে পারলাম, সম্ভবতঃ এই বিশ্রাম কামরায় ওদের কোনো আত্মীয় বা আত্মীয়া বিপদে পড়েছেন কিংবা হঠাৎ অসুস্থ হয়েছেন। কিন্তু না, বিশ্রামকক্ষের সামনে একটু দাঁড়িয়েই ঘাড় ফিরিয়ে আমাকে দেখে আবার হাত নেড়ে ডেকেই আবার এগিয়ে গেল।

ওধারে বকুল গাছ। অজস্র বকুল ঝড়ে পড়েছে পথের ওপর। পাশে স্টেশনের সীমানায় রেলিং, মেয়েটি সেখানে দাঁড়ালো।

আমি জোরে জোরে হেঁটে মেয়েটির কাছে এগিয়ে গেলাম। আর ঠিক সেই সময় --,

আমি আর উৎকন্ঠা চেপে রাখতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, কি হলো?

হুইসিল দিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিলো, এদিকে চেয়ে দেখি মেয়েটি উধাও। এক নিমেষে যেন মুছে গেলো। আমি ট্রেনের দিকে ছুটলাম, কিন্তু ধরতে পারলাম না। দুরন্ত গতিতে ট্রেন যেন আমার চেষ্টাকে উপহাস করতে করতে বেরিয়ে গেলো।

এতক্ষণ পর আমি হাসলাম। এই তোমার ভৌতিক গল্প। মেয়েটি তোমায় বোকা বানিয়ে সরে পড়েছে। বয়স কম হলে হবে কি, মেয়েটি বেশ ওস্তাদ মনে হচ্ছে।

সমর আমার হাসিতে যোগ দিল না, গম্ভীর গলায় বললো আমার কাহিনী এখানে শেষ হয়নি মাষ্টারমশাই।

আমি একটু অপ্রস্তুত হলাম, বললাম, বেশ বলে যাও।

আমি স্টেশন-মাস্টারের সঙ্গে দেখা করে ট্রেন ফেল করার কথা বললাম, তিনি পরের স্টেশনে ফোন করে বলে দিলেন, যাতে তারা আমার বিছানা আর সুটকেশটা নামিয়ে রাখতে পারে। এর পরের ট্রেন রাত সাড়ে নটায়।

হাতে অঢেল সময়। সমস্ত বিশ্রাম কক্ষগুলো তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। কয়েকজন দেহাতী যাত্রী বসে আছে। মেয়েটি কোথাও নেই। স্টেশনের বাইরে এসে কয়েকটা টাঙ্গাওয়ালাকে মেয়েটির কথা জিজ্ঞেস করলাম। তারা কেউ কিছু বলতে পারলো না।

আশ্চর্য লাগলো চোখের সামনে থেকে মেয়েটি কি করে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো, এমন সুন্দর দিনের আলোয় কোথায় সে সরে যেতে পারে।

আশ্চর্য হবার আমার আরো বাকী ছিলো, রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ সারা স্টেশনে হৈ চৈ। সবাই খুব ব্যস্ত। গিয়ে খবর নিয়েই চমকে উঠলাম। দেরাদুন এক্সপ্রেসের সঙ্গে এক মালগাড়ির ভীষণ ধাক্কা লেগেছে। অনেক লোক আহত হয়েছে, মারা গেছে বেশ কয়েকজন।

আপাততঃ সব গাড়ি বন্ধ। দু-একটি রিলিফ ট্রেন সাহায্য নিয়ে ছোটাছুটি করছে। স্টেশন মাস্টারের কামরায় খুব ভিড়। অনেকেই আত্মীয় স্বজনের খবর নেবার জন্য ব্যাকুল। ভিড় কমতে খবর পেলাম, দেরাদুন এক্সপ্রেসের সামনের চারখানা বগি একেবারে চূর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে গেছে। সামনের তিন নম্বর বগিতে আমার থাকার কথা। সেই মুহূর্তে নতুন করে আবার মেয়েটির কথা মনে এলো। মেয়েটি যদি হাতছানি দিয়ে আমাকে ডেকে না নিয়ে যেতো তাহলে আমার কি অবস্থা হতো ভেবেই শিউরে উঠলাম।

সেই রাতেই দুটো টেলিগ্রাম করলাম। একটা কলকাতার বাড়িতে, আর একটা লক্ষ্ণৌতে, পিসির কাছে। লিখে দিলাম যে ভাগ্যক্রমে দুর্ঘটনার হাত থেকে আমি বেঁচে গেছি। পথে এক ষ্টেশনে আমি নেমে পড়েছিলাম।

লাইন ঠিক হতে দিন কয়েক লাগলো। আবার একদিন লক্ষ্ণৌ রওনা হলাম, পিসীকে খবর দিয়ে।

সারারাত সেই মেয়েটির কথা ভাবলাম। বিধাতার আশীর্বাদের মতো সেই মেয়েটি যেন আমার প্রাণরক্ষা করতেই এসেছিল। কাজ শেষ করে বোধ হয় মিলিয়ে গেল।

পরের দিন এগারোটা নাগাদ লক্ষৌ পৌঁছলাম। স্টেশনে পিসী এসেছিলেন। খুব ছেলেবেলায় তাঁকে দেখেছিলাম, তবু চিনতে অসুবিধে হলো না। পিসীর চেহারা প্রায় একই রকম রয়েছে। প্রণাম করতেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন খবরের কাগজে ট্রেন দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আমার যা অবস্থা হয়েছিলো। কেবল মনে হচ্ছিল এর জন্যে যেন আমিই দায়ী। আমি বারবার তোকে আসতে লিখেছিলাম। তারপর তোর টেলিগ্রামটা পেয়ে ধরে প্রাণ এলো। কি ব্যাপার বল তো?

সব ব্যাপারটা বললে পিসী হয়তো বিশ্বাস করতেন না। বিশেষ করে তিনি যখন বিজ্ঞান পড়ান। কাজেই মেয়েটির ব্যাপারটা বেমালুম চেপে গিয়ে বললাম, চা খেতে একটা স্টেশনে নেমেছিলাম, ট্রেন ছেড়ে দিলো। ছুটে গিয়েও ট্রেন ধরতে পারলাম না।

পিসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ভগবান বাঁচিয়েছেন তোকে, জন্ম জন্ম যেন তোর চা খাওয়ার নেশাটি থাকে।

দু'জনে টাঙ্গায় উঠলাম। প্রায় আধঘণ্টার ওপর চলার পর একটি বাড়ির সামনে টাঙ্গা থামলো। পিসীর নির্দেশে।

পিসী নেমে চীৎকার করলেন, সুন্দর, সুন্দর।

একটি ছোকরা নেমে এলো, আমার সুটকেশ আর বিছানা নিয়ে আবার ওপরে উঠে গেলো। পিসীর পিছন পিছন আমিও ওপরে উঠলাম।

মাঝারি সাইজের একটা ঘরের দিকে আঙুল দেখিয়ে পিসী বললেন, এই ঘরটা তোর। যা, জামা কাপড় ছেড়ে নে। আমি জলখাবারের বন্দোবস্ত করি।

শরীর খুবই ক্লান্ত ছিল। ঘরের মধ্যে ঢুকে একটা চেয়ারের ওপর নিজেকে ছেড়ে দিলাম। এক কোণে একটা টেবিল, তার ওপর বাতিদান। একটা আলনা, ছোট একটা খাট। দেয়ালে গোটা তিনেক ছবি। সামনের ছবিটার দিকে চাইতেই সমস্ত শরীর বিদ্যুৎ স্পৃষ্টের মতো কেঁপে উঠলো। উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মনে হলো ভয়ের কোন কালো ছায়া আমাকে আবৃত করার চেষ্টা করছে।

তাড়াতাড়ি বাইরে এসে ডাকলাম - পিসী, পিসী...

পিসী বোধহয় নিচের রান্নাঘরে ছিলেন। কোনো সাড়া পেলাম না, কিন্ত পিসীকে আমার একান্ত দরকার। আমি তাড়াতাড়ি সিঁড়ির মাঝবরাবর নেমে আবার ডাকলাম পিসী ও পিসী।

ততক্ষণে আমার ডাক পিসীর কানে পৌঁছালো।

হন্তদন্ত হয়ে পিসী সিঁড়ির কাছে এসে বললেন, কিরে, কি হয়েচে তোর?

একটু এঘরে এসো তো?

আমি ছুটে ওপরের ঘরে এসে দাঁড়ালাম। হাঁপাতে হাঁপাতে পিসীও এলেন একটু পরে।

কি হলো রে তোর? শরীর খারাপ হয়নি তো? এতো ঘামছিস কেন?

জামার আস্তিন দিয়ে কপালের ঘামের বিন্দু মুছে বললাম, না, শরীর আমার ঠিক আছে। কিন্তু ঐ ছবিটা কার?

হাত দিয়ে সামনের ফটোটা দেখালাম।

পিসী বললেন, ওটা টুনুর ফটো। আমার মেয়ে টুনু।

আপনার মেয়ে? , .

হ্যাঁ, তাকে তুই দেখিস নি। তোর জন্মাবার আগে টুনু মারা গেছে টাইফয়েডে। বোধ হয় বছর আটেক হয়েছিল বয়স।

শেষদিকে পিসীর কণ্ঠস্বর একটু গাঢ় হয়ে এলো।

কিন্তু, ঠোঁটটা কামড়ে থেমে গেলাম। কিন্তু কিরে, কি বলবি বল? পিসী বললেন।

তুমি কি বিশ্বাস করবে পিসী? বিশ্বাস করবার কথা নয়।

কথাটা বল তবে তো বুঝবো, বিশ্বাস করবার কথা কিনা, পিসী আমার ভাবভঙ্গী দেখে রীতিমতো বিস্মিত হলেন।

টুনুদির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে পিসী।

আমার কথা শেষ হবার আগেই পিসী ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেন। ভাবলেন, নির্ঘাৎ ছেলেটির মাথা খারাপ হয়েছে।

একটু একটু করে সব বললাম। যখন শেষ করলাম, পিসীর চোখ দিয়ে টপ্‌টপ্‌ করে জল পড়ছে। পিসী বিজ্ঞান পড়ান, কিন্তু একটি কথারও প্রতিবাদ করলেন না, কিছু অবিশ্বাস করলেন না, শুধু বললেন, টুনুই তোর প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়েছে।

এবার সমর আমার দিকে ঘুরে বসলো।

বলুন মাষ্টারমশাই, কি করে এটা সম্ভব? মারা যাবার পরও কি আত্মার স্নেহ, দয়া, মায়ার টান থাকে। নিজের আত্মীয়দের বাঁচাবার জন্যে তারা কি মানুষের দেহ ধরে আবার ফিরে আসতে পারে মর্তলোকে?

বাইরে ঝড়ের সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমগাছের একটা ডাল জানালার পাল্লায় মাথা ঠেকছে অনবরত। জলের ঝাপটায় ঘরের অনেকখানি ভিজে গিয়েছে।

সেইদিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইলাম! কি উত্তর দেবো সমরের প্রশ্নের?

চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যাওয়া মানুষ নিজের লোককে বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্যে মায়া মমতার টানে আবার কি পৃথিবীতে ফিরে আসে? তাও কি সম্ভব?...

সুরের মায়া

লেখক: হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

এই আমার এক অদ্ভুত সখ। নেশাও বলা যায়। শহরের মধ্যে যখন যেখানে নীলাম হয়, আমি ঠিক গিয়ে হাজির হই। যারা নীলাম হাঁকে, তাদের অনেকের সঙ্গে আমার মুখ চেনা হয়ে গেছে। আমার যেতে দেরী হলে তারা অপেক্ষা করে, নীলাম শুরু করে না।

বিশেষতঃ ল্যাজারাসের দোকানে প্রতি সেলে আমি গিয়ে হাজির হই। টুকিটাকি জিনিস কিনি। এর মধ্যে অনেকগুলোই দরকারে লাগে না। আমার কম করে আটটা সৌখীন ছড়ি হয়েছে, ফুলকাটা আখরোট কাঠের বাক্স গোটা ছয়েক, চারখানা পুরোনো আমলের চেয়ার, একটা নাকি রবার্ট ক্লাইভ ব্যবহার করতেন।

অনেক সময় ঠকেছি। রাজা রামমোহনের লেখার টেবিল বলে চড়া দামে আমাকে যেটা গছানো হয়েছিল, পরে জানতে পারলাম সেটা নিতান্ত সাধারণ টেবিল। রামমোহনের আমলে তার জন্মই হয়নি।

ঠকেও আমার চেতনা হয়নি। নীলামের বিজ্ঞাপন দেখে দেখে ঠিক গিয়ে হাজির হতাম। এই রকম এক নীলামে, বোধ হয় ল্যাজারাসেরই, একটা ভাল জিনিস হাতে এল। ছোট্ট কটেজ পিয়ানো। বার্ণিশ ম্লান হয়ে গেছে, কিন্তু তাতে আভিজাত্যের হানি হয়নি।

নীলামওয়ালা বলল, এ পিয়ানো এ দেশের নয়। সমুদ্রের ওপার থেকে এসেছে। রাজপরিবারের কে একজন এর মালিক ছিল, তারপর অবস্থা খারাপ হওয়াতে বিক্রি করে দিয়েছে। তারপর হাত বদলাতে বদলাতে কলকাতা শহরে এসে পিয়ানো হাজির হয়েছে।

মাত্র সাতশ টাকায় এ জিনিস কিনতে পেরেছি শুনে বাদ্যরসিক বন্ধুবান্ধবেরা অবাক।

পরিচিত একজনকে দেখালাম। সে বলল, অনেকদিন ব্যবহার করা হয়নি। ভাল জিনিস। একটু টিউনিং করে নিতে হবে।

বসবার আর শোবার ঘরে জায়গা ছিল না। পিয়ানোটা পাশের ছোট একটা ঘরে রেখে দিলাম। ঠিক করলাম, একজন মাস্টার রেখে সপ্তাহে দুদিন পিয়ানো বাজানো শিখব।

ঈশ্বরের অসীম করুণায় গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য কোন চিন্তা ছিল না। বাবা যখন মারা গেলেন, তখন বালিগঞ্জের এই বসতবাটি ছাড়া কলকাতায় তাঁর আরো তিনখানা বাড়ি ছিল। যা থেকে মাসিক আয় সাড়ে তিন হাজার। ব্যাঙ্কে ছ' লাখ টাকা, এ ছাড়া কোম্পানীর কাগজ, শেয়ারে প্রায় চার লাখ। কাজেই আমার কোন চিন্তাই ছিল না।

মা মারা গেছে অনেক আগে। ভাইবোনের ঝামেলা নেই। আমি মা-বাপের একমাত্র সম্তান। অবসর সময়ে সাহিত্য করি। সাহিত্য অর্থে গল্প উপন্যাস রচনা নয়। ভারি ভারি প্রবন্ধ লিখি। বেশির ভাগ প্রত্নতত্বকে কেন্দ্র করে।

ভারতবর্ষের কোথাও মাটি খুঁড়ে পুরাকালের কোন নিদর্শন পাওয়া গেছে শুনলেই ছুটে সেখানে চলে যাই।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হতাশ হই। দুটো সরা কিংবা হাঁড়ির ভাঙা টুকরো, তাই নিয়েই পণ্ডিতদের মধ্যে প্রায় হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। পালবংশের না সেনবংশের, তাই নিয়ে চুলোচুলি।

আর এক সখ এই নীলামে জিনিস কেনা। এর মধ্যেও অবশ্য প্রত্নতত্বের পাগলামি আছে।

পিয়ানোটা যে রাত্রে দিয়ে গেল, সে রাত্রে শরীরটা একটু খারাপ ছিল। অল্প জ্বর হয়েছিল। সেই সঙ্গে সর্বাঙ্গে ব্যথা। তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। একটু তন্দ্রার ভাব এসেছিল। সেই তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থাতেই শুনলাম, পাশের ঘরে পিয়ানো বেজে চলেছে, টুং টুং টুং। কোন শিক্ষিত হাতের ছোঁয়া, কে যেন এলোপাতাড়ি একটার পর একটা পর্দা ছুঁয়ে চলেছে।

এরকম ধৃষ্টতা একজনের দ্বারাই সম্ভব। আর কেউ সাহস করবে না। আমার ভৃত্য নটবর। নিবাস কাঁথি। খুব ছেলেবেলায় তার বাপের সঙ্গে আসত। বাবা কাজ ছাড়বার সময় নটবরকে দিয়ে গেছে।

নটবর আমার খাস চাকর । আমার সব কিছু দেখাশোনা করে। তিনতলায় অন্য কোন চাকরের ওঠবার হুকুম নেই। নটবর বিশ্বাসী। নিঃসন্দেহে কাজের লোক। কিন্তু তার ধারণা, সে বাড়ির লোক। আমার যে কোন জিনিসে সে নির্বিচারে হাত দেয়। ধমক দিলে দিন কয়েক কিছু করে না, তারপর যে কে সেই। এ নিশ্চয় নটবরের কাজ। নতুন আনা পিয়ানোর ওপর শিক্ষানবিশী করছে।

কিছুক্ষণের পর অসহ্য লাগল। বিছানা ছেড়ে চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে নিলাম। একটু এগোতেই শব্দ থেমে গেল। আমার ওঠার আওয়াজ পেয়ে নটবর পালিয়েছে। ভোর রাতের দিকেও একবার যেন পিয়ানোর বাজনা শুনলাম। ঘুমের ঘোরে ঠিক বুঝতে পারলাম না। একটু শব্দ হয়েই থেমে গেল।

দিনের বেলা একেবারে চুপচাপ। রাত্রে মাঝে মাঝে টুং টুং করে বেজে ওঠে। নটবর নয়। মাঝরাতে ঘুম ছেড়ে উঠে পিয়ানো বাজাবে, নটবরের এমন শখ আর সাহস কোনটাই নেই। পরে একটু ভেবে বুঝতে পারলাম, এ নিশ্চয়ই ইঁদুরের কারসাজি। পাশের ঘরটায় নানা ধরণের জিনিসপত্রে ঠাস বোঝাই থাকাতে ইঁদুর আর আরশোলার দৌরাত্ম হয়েছে। বেশ বড় সাইজের ইঁদুর। তারই দু একটা রীডের ওপর দৌড়াদৌড়ি করলে, এ ধরনের বাজনা হওয়া সম্ভব।

কোন আমল দিলাম না।

কিন্তু একদিন আমল দিতে হল। বাইরে গিয়েছিলাম দরজায় তালা দিয়ে। দরজা খুলতে গিয়েই থেমে গেলাম। ভেতরে পিয়ানো বাজছে। আগের মতো এলেমেলো বাজনা নয়, রীতিমত শিক্ষিত হাত। কোন গৎ বাজাচ্ছে।

আমার কোন বন্ধু হয়তো বাজাচ্ছে। কিন্তু বন্ধু ঘরে ঢুকবে কি করে? দরজা খুলতেই বাজনা থেমে গেল।

প্রথমেই পিয়ানোর ঘরে এসে দাঁড়ালাম। কোথাও কেউ নেই। শুধু পিয়ানোর ডালা খোলা। ঠিক যেন কে বাজাচ্ছিল, আমার ঘরে ঢোকার শব্দ পেয়ে উঠে গেছে। তাড়াতাড়িতে ডালাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছে।

এই প্রথম অনুভব করলাম মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের একটা শীতল শিহরণ নেমে গেল। অপ্রাকৃতিক কিছু একটার অস্তিত্ব প্রথম বুঝতে পারলাম।

এতদিন মনকে বুঝিয়েছিলাম ইঁদুরের উৎপাত, কিন্তু আজকের ঘটনা কি বলে বোঝাব?

অবশ্য আমি খুব দুর্বলচিত্ত নই। এ পৃথিবীতে জীবজগতের পাশাপাশি অশরীরী আত্মারাও বাস করে, এমন অর্বাচীন চিন্তা আমি করিনা। এরকম মূঢ় বিশ্বাসও আমার নেই। বরং বন্ধুবান্ধবদের ভৌতিক তত্ত্ব আমি অবহেলায় উড়িয়ে দি।

পিয়ানোর ব্যাপারটা ভৌতিক কিংবা অপ্রাকৃত ঘটনা ছাড়া আর কি? দিন দুয়েক কিছু হল না।

তারপর আমি ভাবলাম, পিয়ানোটা যখন কিনলাম, তখন বাজনাটা একটু শিখি।

খুঁজে খুঁজে এক মাস্টার জোগাড় হল। পেয়ে গেলাম। অ্যালবার্ট পেরেরা। গ্রীন ভ্যালি হোটেলে পিয়ানো বাজায়। ঠিক হল দুশো টাকা নেবে, সপ্তাহে দুদিন শেখাবে। বুধ আর শনি। বিকেলবেলা। তার আগে পিয়ানোটা টিউন করিয়ে নিলাম। যে লোকটা টিউন করতে এসেছিল, সে বলল, খুব ভাল পিয়ানো সায়েব। এ জিনিস আর পাওয়া যায় না।

রীতিমত উৎসাহের সঙ্গে শিখতে শুরু করলাম।

যতক্ষণ পেরেরা থাকে, কোন অসুবিধা হয় না। কিন্তু পেরেরা চলে যাবার পর অমনি পিয়ানো বাজাতে গেলেই অসুবিধা আরম্ভ হয়।

পিয়ানোর সামনে টুলে বসতে গিয়েই চমকে উঠি। মনে হয় কে যেন আগে থেকে টুলে বসেছিল। আমি বসতে যেতেই সরে যাবার চেষ্টা করল। আমি বেশ একটা নরম দেহের আভাস পেলাম। ঠিক মনে হল, যেন কার কোলের ওপর বসে পড়েছি। তারপর রীডের ওপর আঙুল চালাতে গিয়েও এক বিপত্তি। আরেকটা নরম আঙুলের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে যাচ্ছে।

নিজেকে বোঝালাম এ শুধু মনের ভুল। পিয়ানো সম্বন্ধে অলৌকিক একটা ভয় মনকে অধিকার করে আছে। এসব তারই প্রতিক্রিয়া।

কিছুদিন পর এ অস্বস্তিও কেটে গেল। সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। কিন্তু ওই দিন পনেরো। তারপর পেরেরা আসা বন্ধ করল।

প্রথমে ভেবেছিলাম অসুস্থ ; খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, না, পেরেরা ঠিক হোটেলে পিয়ানো বাজাচ্ছে। তবে কি তার দক্ষিণা মনঃপুত নয়? কিন্তু পেরেরাই দুশো টাকা চেয়েছিল। আমি তাতে রাজী হয়েছি।

ঠিক করলাম, পেরেরার বাড়িতে গিয়েই দেখা করব। পেরেরা পার্ক সার্কাস অঞ্চলে থাকে। তার বাড়িতে আমি আগেও গিয়েছি। পেরেরা বাড়িতেই ছিল। আমাকে দেখে সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।

কি ব্যাপার, আপনি ক'দিন যাচ্ছেন না? অথচ শরীর নিশ্চয় অসুস্থ নয়, কারণ হোটেলে ঠিক বাজাচ্ছেন।

পেরেরা বলল, আসুন, ভেতরে আসুন। আপনার সঙ্গে কথা আছে। তার বাইরের ঘরে গিয়ে বসলাম। পেরেরা কফি আনল। কফিতে চুমুক দিতে দিতে তার কাহিনী শুনলাম।

আপনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা । এই বিজ্ঞানের যুগে এমন একটা কাহিনী কাউকে বিশ্বাস করানোও মুশকিল।

পেরেরা একটু দম নিল; তারপর আবার বলতে আরন্ত করল, আপনাকে পিয়ানো শেখানোর পর বাড়ি ফিরে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়। স্বপ্ন মনে হয় বটে; কিন্তু আমি জানি, সপ্তাহে দু'দিন ঠিক একরকম স্বপ্ন কেউ দেখে না। আপনি জানেন আমি নেশা-ভাং করি। রোজই ডিনারের আগে মদ আমার চাই, কিন্ত মদ তো আমি নতুন খাচ্ছি না। আমার দশবারো বছরের অভ্যাস। এর আগে তো আমি কোনদিন এসব দেখিনি।

পেরেরার গৌরচন্দ্রিকার ধরন দেখে মনে হল, আসল বক্তব্যে সে আসতে দ্বিধা করছে। পাছে তার বক্তব্য আমার বিশ্বাসযোগ্য না হয়।

তাই আমি বললাম, আমার সময় কম। আসল ব্যাপারটা কি বলে ফেলুন।

পেরেরা শুরু করল ; আপনি বোধ হয় জানেন না, আমি বহু ঘাটের জল খাওয়া লোক। গায়ে জোরও যেমন আছে, মনে সাহসও তেমনই। কিন্তু আপনাকে পিয়ানো শেখানোর ব্যাপারে আমি একটু গোলমালে পড়েছি। পাছে আপনি ভয় পান তাই আমি কিছু বলিনি। যখনই পিয়ানোর রীডে হাত চালাতাম, আর একটা অদৃশ্য হাতের সঙ্গে যেন হাত ঠেকে যেত। নরম হাত, কোন স্ত্রীলোকের বলেই মনে হত। আপনাকে যখন পিয়ানো শেখাতে যেতাম, যীশুর দিব্যি, পেটে. একফোঁটা এ্যালকোহল থাকত না। কাজেই এমন হবার কথা নয়। কিন্তু এই স্বপ্ন আমাকে বিচলিত করেছে।

হঠাৎ খাটটা দুলে উঠল। আমি প্রথমে ভাবলাম ভূমিকম্প। না, শোবার ঘরের আর তো কিছু দুলছে না। রাস্তার আলোর কিছুটা ঘরে এসে পড়েছে। সেই আলোকে দেখলাম, বাতিটা তারে ঠিক ঝুলছে। একটুও দুলছে না।

পায়ের দিকে চোখ পড়তেই শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল। পরিষ্কার দেখলাম, একটা কবন্ধ। মানে মাথা নেই। অঙ্গে দামী মখমলের পোশাক। অনেক দূর থেকে ফোনের তারের মধ্যে দিয়ে যেমন স্বর ভেসে আসে, তেমনই স্বরে কে বলল, যদি প্রাণের মায়া থাকে, ও পিয়ানোতে হাত দিবি না। ও আমার পিয়ানো। তাতে আর কারো স্পর্শ আমি সহ্য করব না।

তবু সাহস করে বললাম, কোন পিয়ানো?

খাটটা আবার নড়ে উঠল। তীক্ষ্ণ হল কণ্ঠস্বর, কোন পিয়ানো জানিস না? বাজাবার সময় আমি অনেকবার বাধা দিয়েছি। ভাল চাস তো ও পিয়ানোয় একদম হাত দিবি না।

পরের দিন সকালে উঠে রাতের স্বপ্নটাকে বিশেষ আমল দিইনি। অবশ্য এখন বুঝতে পারছি, ওটা আদৌ স্বপ্ন নয়। ভাবলাম, নির্ঘাৎ সুরার প্রভাব।

তারপরের দিন আপনার ওখানে যাবার কথা। সেজেগুজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি বাসের আশায়। হঠাৎ কালো একটা মোটর সামনে দিয়ে নক্ষত্রবেগে যাবার সময় আমার সারা পোশাকে কাদা ছিটিয়ে গেল। একেবারে আপাদমস্তক। মেজাজ খিঁচড়ে গেল। বাড়ি ফিরে এলাম। স্নান সেরে আর যাবার ইচ্ছা হল না। ভাবলাম, ফোনে পরের দিন আপনাকে জানিয়ে বিকালে যাব।

রাত্রে সেই এক ব্যাপার। খাট কেঁপে উঠল। বাতি জ্বালিয়ে রেখেছিলাম। আচমকা বাতি নিভে গেল। পায়ের কাছে সেই কৰন্ধ মুর্তি! এবারে রাগে যেন একেবারে ফেটে পড়ল; কি, আমার কথা কানে গেল না। আবার তুই পিয়ানোয় হাত দিতে দিয়েছিলি? বলেছি, ও পিয়ানোতে আর কারও স্পর্শ আমি সহ্য করব না। মুখে রক্ত উঠে মরবি। কথার সঙ্গে সঙ্গে কবন্ধমূ্র্তিটা বিরাট হয়ে ছাদ স্পর্শ করল।

আমি বেশ বুঝতে পারলাম, স্বপ্ন নয়, সব কিছু আমি জেগে জেগে দেখছি। বুকের মধ্যে তীব্র একটা যন্ত্রণা অনুভব করলাম। বুকে ঝোলানো ক্রস ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম, আর নয়, আর এই সর্বনেশে পিয়ানোর ধারে-কাছে যাব না। আপনি আমাকে মাপ করুন আপনি অন্য কোন শিক্ষক খুঁজে নিন।

পেরেরার বাড়ি থেকে যখন বের হলাম, তখন মনের অবস্থা অবর্ণনীয়। অতিন্দ্রিয় জগৎ সম্বন্ধে আমার কোনই ধারণা ছিল না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু ভয়ের একটা কালো ছায়া মনকে আচ্ছন্ন করে রইল।

পিয়ানোটা যে স্বাভাবিক নয়, তা তো আমি বুঝতে পেরেছি। আমার কথা পেরেরাকে আর বলিনি। কিন্তু পেরেরার কাহিনী শোনবার পর আমার আর পিয়ানোর কাছে যেতে সাহস হল না। মনে মনে ঠিক করলাম, পিয়ানোটা আবার ল্যাজারাসের দোকানে ফেরৎ দিয়ে আসব। এখানে দিয়ে কাউকে বিক্রি করে দিক।

এর মধ্যে আবার এক কাণ্ড ঘটল।

দুপুর থেকে কালো মেঘ সারা আকাশ ছেয়ে গিয়েছিল। ঘন অন্ধকার দু'হাত দূরের লোক দেখার উপায় নেই। বিকেল হবার সঙ্গে সঙ্গে তুমুল বর্ষণ আরন্ত হল। বাজের শব্দে কান পাতা দুষ্কর। বিদ্যুতের তীব্র ঝিলিক।

একটু বাইরে বের হবার দরকার ছিল। হল না। চুপচাপ বন্ধ জানলার কাছে চেয়ার পেতে প্রকৃতির তান্ডব নাচ দেখতে লাগলাম। হঠাৎ বৃষ্টি আর বাজের শব্দ ছাপিয়ে পিয়ানোর শব্দ।

বেশ শিক্ষিত হাতের বাজনা । বিদেশী কোন গান বাজাচ্ছে। পা টিপে টিপে উঠে পড়লাম। কি করে বাজাচ্ছে একবার দেখতে হবে। এ ঘরে বাতি জ্বালানো ছিল। এ ঘরের আলো পিয়ানোর ঘরে পড়ে। কাজেই দেখবার অসুবিধা নেই।

জানলার কাছে গিয়েই থেমে গেলাম। সমস্ত শরীর শিউরে উঠল। মাথার চুল খাড়া হবে উঠল সজারুর কাঁটার মতন। মনে হল, বুকের ধুকধুক্‌ শব্দটা এখনই বুঝি থেমে যাবে।

কোন মানুষ নেই। শুধু পিয়ানোর রীডের ওপর ধবধবে সাদা দুটি হাত এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছে। সরু চাঁপার কলির মতন আঙ্গুলের ছোঁয়ায় চমৎকার সুরের ঝঙ্কার উঠছে। মনিবন্ধ পর্যন্ত দুটি হাত। নিঃসন্দেহে সে দুটি হাত স্ত্রীলোকের। মনিবন্ধ থেকে টপটপ করে রক্তের ফোঁটা মেঝের ওপর ঝরে পড়ছে।

যখন জ্ঞান হল, দেখলাম বিছানায় শুয়ে আছি। এক পাশে ডাক্তার, অন্য পাশে ভৃত্য নটবর। ডাক্তার বলল, কাছেই বাজ পড়েছিল; সেই শব্দে আপনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। দিন সাতেক সম্পূর্ণ বিশ্রাম। বিছানা ছেড়ে উঠবেন না।

চুপ করে সব শুনে গেলাম। জানি আসল কথা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না।

সেরে উঠেই ল্যাজারাসের ওখানে চলে গেলাম।

ম্যানেজার পিন্টোর সঙ্গে আমার অনেকদিনের জানাশোনা। তাকে বললাম, আচ্ছা, যে পিয়ানোটা নীলামে আমি কিনেছিলাম, সেটা কার কাছ থেকে আপনারা পেয়েছিলেন?

কেন বলুন তো?

এমনিই জিজ্ঞাসা করছি।

দাঁড়ান দেখে বলছি।

পিন্টো বিরাট খাতা খুলে কিছুক্ষণ দেখল; তারপর বলল, আমাদের এখানে নীলামের জন্য দিয়েছেন মিসেস ক্রিস্টোফার। সার্কাস রেঞ্জে বাসা।

ঠিকানা লিখে নিলাম।

কি ব্যাপার বলুন তো? পিয়ানোর মধ্যে কিছু পেয়েছেন?

কি পাব?

টাকাকড়ি কিছু। আমি ভাবলাম বুঝি মালিককে ফেরৎ দেবেন।

না, না, সেসব কিছু নয়। পিয়ানো সম্বন্ধে দু-একটা কথা জিজ্ঞাসা করবার আছে। আচ্ছা ধন্যবাদ।

খুঁজে খুঁজে ঠিক গিয়ে হাজির হলাম মিসেস ক্রিস্টোফারের বাড়ি। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, এ রহস্যভেদ করবই।

মিসেস ক্রিস্টোফার প্রথমে কিছুতেই বলতে চায় না। অনেক অনুরোধ উপরোধের পর বলল, পিয়ানোটা আমার বোনের। বোন বিলেতে থাকত। পিয়ানোতে অদ্ভুত দখল ছিল। বোন মারা গেলে পিয়ানোটা আমি এখানে নিয়ে আসি।

আপনি বিক্রি করে দিলেন কেন?

কিছুক্ষণ নীরব মিসেস ক্রিস্টোফার।

আমাদের মধ্যে লুকোচুরি করে লাভ নেই। আপনি পিয়ানোটা কেন নিজের কাছে রাখতে চাননি আমি জানি। খুবই স্বাভাবিক; বোনের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে পিয়ানোটার দাম আপনার কাছে অনেক। কিন্তু ওই পিয়ানোতে আপনার বোনের আত্মা ভর করে আছে। তিনি কাউকে পিয়ানো ছুঁতে দেন না। তাইতো?

আবিষ্টের মত মিসেস ক্রিস্টোফার আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়ল, হ্যাঁ।

আপনার বোন কিভাবে মারা গিয়েছিলেন?

মিসেস ক্রিস্টোফার উঠে গিয়ে সোরাই থেকে জল গড়িয়ে খেলো পুরো এক গ্লাস। তারপর বাইরের দিকে চোখ ফিরিয়ে আস্তে আস্তে বলল, আমার বোন লিজা বেঁচে নেই। বিলেতে বোমায় মারা গেছে। গত যুদ্ধের সময়। যখন বোমা পড়ছিল, লিজা তখন পিয়ানোতে তন্ময়। আমিও সেই সময় ওখানে ছিলাম। সাইরেন বাজার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেন্টারে যাই। লিজার খেয়ালই ছিল না।

কিছুক্ষণ পরে অল ক্লিয়ার হতে বাড়িতে ফিরে দেখি, লিজার শরীর বোমার আঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন। শুধু কাটা দুটো হাত পিয়ানোর ওপর ছিল।

লড়াই থামতে আমি চাকরি নিয়ে এদেশে ফিরি। চাকরি আমার ছিলই, আমি শিক্ষকতার একটা কোর্স শেষ করার জন্য বিলেত গিয়েছিলাম। পিয়ানোটা সঙ্গে নিয়ে আসি।

তারপর প্রতি রাত্রে পিয়ানোর টুং টাং কানে আসে। উঠে গিয়ে দেখি কোথাও কিছু নেই। এক ঝড়ের রাতে পিয়ানোর জোর আওয়াজ হতে দেখলাম, লিজার দুটো হাত রীডের ওপর চঞ্চল। মনে হল, বোমার আওয়াজের সঙ্গে রাগের শব্দের মিল আছে বলেই বোধহয় দুর্যোগের রাতে লিজার ছিন্ন হাত দেখা যায়। তারপর পিয়ানোটা নিলামে দিয়ে দিই।

চলে এলাম। আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। অতীন্দ্রিয় জগতের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সব দ্বিধার অবসান।

সামন্ত বাড়ি

লেখক: হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

বাড়িটার দিকে চোখ পড়লেই গা ছম ছম করে। সমস্ত দরজা-জানলার কব্জাগুলো বোধহয় ভেঙে গেছে। একটু বাতাস হলেই বিচিত্র শব্দ হয়। ক্যাঁচ কোঁচ ক্যাঁচ।

বাড়িটার আদিকালে কি রং ছিল বলা মুশকিল। এখন বাইরের আস্তরণ খসে পাঁজর-প্রকট চেহারা। রন্ধ্রে রন্ধ্রে বট অশত্থের চারা। ছাদের একদিকের কার্নিস সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে।

সামনে অনেকখানি জায়গা। গায়ের বুড়ো লোকেরা বলে এক সময়ে খুব চমৎকার ফুলের বাগান ছিল। সামন্তরা দেশ থেকে নানা জাতের ফুলের গাছ এনে লাগিয়েছিল। এখন ফুলের গাছের একটিও অবশিষ্ট নেই। হতশ্রী চেহারা। ভেরান্ডা, ঘেঁটু আর আকন্দ গাছের রাজত্ব। দু-একটা ঘোড়া-নিমও আছে।

আগে এই বাড়ি জমজমাট ছিল।

সামন্তর দুই ছেলে, দুই বৌ, একঘর নাতিপুতি। এ ছাড়া কর্তা আর গিন্নী তো ছিলই। সাতদিনে প্রায় সবাই উজাড়।

সামন্তর ছোট ছেলে বৌ নিয়ে বিদেশে ছিল, তাই কেবল তারাই বাঁচল। বাকি সবাই কলেরায় খতম। সাতদিনে এগারো জন, চাকর-বাকর নিয়ে।

শুধু সামন্ত বাড়িরই নয়, গায়ের বহু বাড়িতেই এক অবস্থা। মড়া পোড়াবার লোক নেই। ঘরে ঘরে মড়া পচতে লাগল। গন্ধে টেঁকা দায়। দিন-দুপুরে শেয়াল আর কুকুর আধ-মরাদের নিয়ে টানাটানি শুরু করল।

তারপর অনেক দিন কেটে গেছে, সামন্তর ছোট ছেলে আর দেশে ফিরে আসে নি।

বাড়ি অযত্ন, সংস্কারের অভাবে একটু একটু করে আজকের অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। এদিক দিয়ে পারতপক্ষে কেউ হাঁটে না।

অবশ্য এটা ঠিক যাওয়া-আসার পথও নয়। কেবল শনি আর মঙ্গলবার যে দুদিন হাটবার, হাটে যারা কমলপুর থেকে জিনিস নিয়ে আসে তারা সামন্ত বাড়ির পাশ দিয়ে ফেরে। কমলপুরে ফেরবার তাদের আর একটা পথ আছে, কিন্তু সে অনেক ঘুরপথ। প্রায় অর্ধেক গ্রাম ঘুরে যেতে হয়। তাদের ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সামন্ত বাড়ির পাশ দিয়ে তারা কোনরকমে ছুটে পালায়। তবু কি নিস্তার আছে! সব কানে যায়।

হঠাৎ একতলার ঘরে আলো জ্বলে ওঠে। জোর আলো নয়, নীলচে দীপ্তির মৃদু আলো। হা হা করে হাসির আওয়াজ শোনা যায়। সেই হাসি শুনলে সাহসী জোয়ানেরও বুকের রক্ত শুকিয়ে যায়। অশরীরী হাসি। এ যেন কোন মানুষের নয়। লোকেরা দু কানে আঙুল দিয়ে প্রাণপণে জায়গাটা দৌড়ে পার হয়।

একবার বছর দুয়েক আগে সহদেব জেলে সাহস করে দাঁড়িয়ে পড়ে ব্যাপারটা দেখবার চেষ্টা করেছিল। ভাঙা পাঁচিল পার হয়ে একটু এগিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। গোঁ গোঁ শব্দ করে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। সঙ্গীরা কেউ এগিয়ে আসে নি। পরের দিন সকালে তার আত্মীয়স্বজন এসেছিল। সহদেবের ঠোঁটের দু পাশে ফেনার রাশ। দেহে এত তাপ যে হাত রাখা যায় না।

কোনরকমে ধরাধরি করে সহদেবকে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল।

তারপর সহদেব তিনদিন বেঁচে ছিল। এ তিনদিন চোখ খোলে নি। মাঝে মাঝে শুধু সারা দেহ কেঁপে উঠেছিল। মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বর বের হয়েছিল : ভূ-ভূত। ভূ-ভূ-ত।

তারপর বহুদিন কেউ আর ওপথ দিয়ে চলে নি। ঘুরে অন্য পথ দিয়ে যাওয়া-আসা করত। অনেকদিন পর আবার কিছু স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। কিন্তু লোকেরা সন্ধ্যার আগেই সামন্ত বাড়ি পার হবার চেষ্টা করত।

সহদেব যে কি দেখেছিল, কেউ জানে না। জানবার কোন উপায় ছিল না।

একবার কলকাতার এক ভদ্রলোক সামন্ত বাড়ি কেনবার জন্য এসেছিল। তাঁর ইচ্ছা ছিল আশপাশের জমিতে ছোটখাট এক কারখানার পত্তন করবে আর বাড়িতে অফিস। তাঁর সঙ্গে ম্যনেজার ছিল। দুজনে মিলে জমিজমা দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল।

তাঁদের প্রথম সমস্যা হয়েছিল, সামন্ত বাড়ি যদি কেনাই ঠিক করে, তাহলে টাকাটা দেবে কাকে। প্রকৃত মালিক কে? এক ভাগ্নে অবশ্য এসে খাড়া হয়েছে, কিন্তু সে প্রকৃত মালিক কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে।

কিন্তু কেনবার প্রশ্ন আর উঠল না।

বাগান পার হয়ে বাড়ির মধ্যে আসতে গিয়েই দুজনে থেমে গেল। একটা ঘোড়ানিম গাছের তলায় দাঁড়িয়ে একটা কঙ্কাল। তার একটা হাত ধীরে ধীরে আন্দোলিত হচ্ছে। কাছে ডাকছে এই রকম ভাব।

তারপর দুজনে আর দাঁড়াতে সাহস পায় নি। দ্রুতবেগে ভাঙা পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে রাস্তায় এসে পড়েছিল। কাঁটাগাছে দেহ ক্ষতবিক্ষত, পোশাক ছিন্নভিন্ন, বাড়ি কেনা তো দূরের কথা, তারা একেবারে স্টেশনে এসে থেমেছিল। তারপর থেকে বাড়িটাকে কেউ আর সামন্ত বাড়ি বলত না, বলত ভূতুড়ে বাড়ি।

সমস্ত গ্রাম নিস্তব্ধ হয়ে গেলে ভূতুড়ে বাড়ি থেকে আওয়াজ ভেসে আসত- খুট, খাট, খুট, খুট, খাট, খুট।

গ্রামের জনার্দন খুড়ো হাঁপানীর জন্য রাতে ঘুমাতে পারতেন না। প্রায় সারা রাত দাওয়ায় বসে তামাক খেতেন। সেই শব্দ কানে যেতে বলতেন, ওই ভূতের নাচ শুরু হল। ওদের গায়ে তো এক তিল মাংস নেই, কেবল হাড়সম্বল। তাই খুট খুট আওয়াজ হচ্ছে।

কথাগুলো তিনি বলতেন দিনের আলোয় চন্ডীমণ্ডপে বসে। গ্রামের আর পাঁচজন মুরুব্বির সামনে, আরে বাপু, এরকম যে হবে, এ তো জানা কথা। নকুল সামন্তর বাড়ির কোন মড়ার তো আর সদ্গতি হয়নি। করবে, কে? তখন গায়ের সব ঘরে এক অবস্থা। কে কাকে দেখে ঠিক আছে! মুখে জল দেবার যেমন লোক নেই, তেমনই মারা গেলে মুখে আগুন দেবার লোকেরও অভাব। সব মড়া ওই বাড়িতে পচেছে। কাজেই বাড়ির মায়াও ত্যাগ করতে পারছে না।

মুখুজ্জেদের ত্রিলোচনদা বললেন, এক কাজ করলে হয়।

কি?

পাড়ার চাঁদা তুলে গয়ায় পিন্ড দিয়ে এলে হয়।

চাঁদার কথা শুনে হারু মজুমদার হঠাৎ, কে রে? কে আমগাছে ঢিল ছোড়ে, বলে পালিয়ে গেলেন।

অন্য সবাই বললেন, উত্তম প্রস্তাব।

বিধুবাবু প্রশ্নের খোঁচা তুললেন, কিন্তু গয়া যাবে কে? তার খরচ?

জনার্দন খুড়ো সে সমস্যারও সমাধান করে দিলেন, কেন, পরাশর গার্ড রয়েছে। মাসে দুবার সে গয়া যায়। তার হাতে টাকাটা তুলে দিলেই হয়।

আর এক ঝামেলা। ওই বিধুবাবুই তুললেন, কিন্তু পিতৃপুরুষের নামধাম কিছু তো জানা নেই, পিন্ডদান হবে কি করে?

আরে পুরোহিতকে মূল্য ধরে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। অন্য কারো পিতৃপুরুষ প্রক্সি দিয়ে দেবে। পিন্ডদান নিয়ে কথা। প্রেতলোকে সবাই হাঁ করে আছে, একবার পিণ্ড পড়লেই দেখবেন ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে।

তাই ঠিক হল। চাঁদাই তোলা হবে। কিন্তু কিভাবে? এখনই লোকের দরজায় খাতা নিয়ে ঘুরলে কেউই উপুড় হস্তও করবে না। পূজাপার্বণেও দেখা গেছে বিশেষ চাঁদা ওঠে না। তবু সেখানে দেবদেবীর রোষের ব্যাপার আছে।

এক্ষেত্রে সে সব আশঙ্কা নেই। সামন্তদের প্রেতাত্মা সামন্ত বাড়ি ছেড়ে গ্রামে চড়াও হবে এমন সম্ভাবনা কম।

সকলে ভেবেচিন্তে স্থির করল, সংকীর্তনের দল বের করবে। গ্রামে এরকম একটা দল ছিলই। তারাই কাপড় পেতে গান গেয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরবে।

তাই করল।

মোট উঠল তিন টাকা বাইশ পয়সা। দুটো শশা, একটা কাঠাল, গোটা পাঁচেক আম। তাও সেই বাইশ পয়সার মধ্যে দুটো দশ পয়সা আবার অচল।

গ্রামের মাতব্বররা যখন এ ব্যাপারে চিন্তিত, সেই সময়ে ঢাকের শব্দ কানে এল।

এখন আবার ঢাকের আওয়াজ কেন? পালা পার্বণের সময় নয়। শীতলা, মনসা পূজা হলে মাতব্বররা আগেই জানতে পারতেন। সবাই উৎকর্ণ হয়ে রইলেন।

গোটা চারেক গরুর গাড়ি আলের পথ ধরে চলেছে। ঢাকের শব্দ আসছে প্রথম গরুর গাড়ি থেকে। মাতব্বররা এগিয়ে গেলেন।

গরুর গাড়ির ছই-এর ওপর কাগজ লটকানো। দি দিগ্বিজয় যাত্রা পার্টি। প্রোপ্রাইটর পশুপতি ধাড়া।

এক গ্রাম থেকে বায়না সেরে কালনা ফিরে যাচ্ছে। ঢাকের আওয়াজ হচ্ছে বিজ্ঞাপন। পথে যদি কেউ বায়না করে। জনার্দন খুড়োই বললেন, এদের বায়না করলে হয়। আমোদ-প্রমোদের ব্যাপারে তবু লোকে টাকা খরচ করে। আর এই অজ পাড়াগাঁয়ে কিই বা আছে!

বিধুবাবু হাত তুলে প্রথম গরুর গাড়িটা থামালেন। বললেন, প্রোপ্রাইটর কোথায়? দেখা করব।

গাড়ি থেকে একটি কয়লার বস্তা নামল। মাথায় চার ফিট, করমচা লাল দুটি চোখ, পরনে ফতুয়া, ধুতি হাঁটুর ওপর। হেঁড়ে গলা যথাসম্ভব মিহি করে বলল, অনুমতি করুন আজ্ঞে। আমিই পশুপতি ধাড়া। প্রোপ্রাইটর, দি দিগ্বিজয় যাত্রা পার্টি।

কোথা থেকে আসছেন?

আসছি বীজপুর থেকে। মরবার সময় নেই। কেবল বায়নার পর বায়না। আমাদের মহীরাবণ বধ, সুরথ উদ্ধার, কুরুক্ষেত্র, কমলে কামিনী একেবারে বাছা বাছা পালা। লোকে এক রাতের জন্য বায়না করে নিয়ে যায়, সাত রাতের আগে ছাড়ে না।

আপনাদের রেট কি রকম?

পশুপতি ধাড়া এদিক-ওদিক চোখ ফিরিয়ে বলল, এখানে কোথাও বসবার জায়গা নেই আজ্ঞে? এসব বৈষয়িক কথাবার্তা এভাবে দাঁড়িয়ে -

কাছেই একটা বটগাছ ছিল। তলায় লাল সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। বিধুবাবু বললেন, আসুন পশুপতিবাবু এখানে বসা যাক। সকলে বটগাছতলায় বসল।

আমাদের রেট আজ্ঞে দুশো টাকা। পশুপতি কাজের কথা পাড়ল।

ত্রিলোচনবাবু চোখ কপালে তুললেন, বলেন কি? এ টাকায় তো কলকাতার দল আনা যায়।

পশুপতি ধাড়া দু হাতে পেট চেপে ধরে হাসতে হাসতে বলল, কলকাতার দল আর আমার দলে তফাতটা কোথায়? আপনারা পালা দেখুন তারপর টাকা দেবেন।

অনেক দর কষাকষির পর একশো টাকায় রফা হল। একশ টাকা আর পালা ভাল লাগলে প্রোপ্রাইটরকে পান খেতে আরো দশ।

পশুপতি ধাড়া হাঁক দিল, বিজে, এই বিজে।

সারসের মতন লম্বা, শীর্ণকায় এক ছোকরা লাফ দিয়ে গরুর গাড়ি থেকে নামল, গজ গজ করতে করতে। বিজে, বিজে, কেন আমার কি একটা ভাল নাম নেই?

পশুপতি ধাড়া বলল, বাবুদের খান কয়েক প্রোগ্রাম দিয়ে দে। শীর্ণকায় পকেট থেকে প্রোগ্রামের বান্ডিল বের করে গোটা চারেক প্রোগ্রাম বিলি করল। পশুপতি ধাড়া সকলকে একবার দেখে নিয়ে বলল, ওতে আমাদের ঠিকানা আছে। একটা পোষ্টকার্ড ফেলে দিলেই পেয়ে যাব। যেদিন আপনাদের দরকার তার অন্ততঃ মাসখানেক আগে আমাকে জানাবেন, নইলে সম্ভব হবে না, বায়নার পর বায়না কিনা।

জনার্দন খুড়ো বললেন, আমরা এ মাসের শেষে, ধরুন সতেরোই রাত্রে চাই। শনিবার আছে। শহরে যে সব বাবুরা কাজ করে সবাই বিকালে চলে আসবে। আসর ভরে যাবে। কোন্‌ পালাটা আপনাদের ভাল?

বললাম যে আমাদের সব পালাই এসকেলেন্ট।

একসেলেন্ট। জনার্দন সংশোধন করে দিলেন।

ওই আজ্ঞে। আসরে বাবুরা বলেন কিনা। একটু থেমে পশুপতি ধাড়া আবার বলে, কুরুক্ষেত্রই দেখুন তা হলে। আমার দুর্যোধনের পার্ট যারা একবার দেখেছে, তারা জীবনে ভুলবে না। আসরে হৈ চৈ পড়ে যায়।

শীর্ণকায় বলল, আর আমার ছিকেস্ট? পার্ট দেখে কোতলপুরের বাবুরা একবার বাঁশ দিয়েছিলেন।

বাঁশ? বাঁশ কেন? ত্রিলোচনবাবু উর্দ্ধলোচন হয়ে শুধান।

বিজে ব্যাখ্যা করল, মানে বাঁশী তৈরি করার জন্য। সবাই বললে, এ একেবারে আসল ছিকেষ্ট। বাঁশী ছাড়া মানায় না।

আঃ বিজে, ভদ্রলোকদের কথার মধ্যে তোর নাক গলাতে আসা কেন? পশুপতি বিরক্ত।

আবার বিজে! আপনি কি আমাকে বিজিকেন্দ্র মোহন বলে ডাকতে পারেন না?

পশুপতি ধাড়া রুখে উঠল, হ্যাঁ, ডাকব ওই নামে! আমার একে বাঁধানো দাঁত!

ঠিক আছে আমাদের কি করতে হবে বলুন। জনার্দন খুড়ো মনে করিয়ে দিলেন।

পশুপতি বললে, এই, খাতাটা গাড়ি থেকে নিয়ে আয়।

শীর্ণকায় গাড়ির দিকে ছুটল।

ইতিমধ্যে গাড়ি থেকে অনেক লোক নেমে দাঁড়িয়েছি। কেউ আলের ওপর। কেউ গাছের ছায়ায়। খেরো বাধানো লাল খাতা এল। গ্রামের তরফ থেকে জনার্দন খুড়ো সই করলেন। তখন পশুপতি ধাড়া বলল, এবার কিছু অগ্রিম দিতে হবে আজ্ঞে।

অগ্রিম?

এই রেওয়াজ। .

গ্রামের মাতব্বররা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করলেন। বিধুবাবু বললেন, কার কাছে কত আছে?

কুড়িয়ে বাড়িয়ে পাঁচ টাকা হল। সেই পাঁচ টাকাই জনার্দন খুড়ো এগিয়ে দিলেন। বললেন, নিন, আগাম রাখুন।

হাত পেতে টাকাটা নিয়ে পশুপতি ধাড়া বলল, বড্ড কম হয়ে গেল আজ্ঞে। দলের বিড়ির খরচও হবে না।

ঠিক আছে। বাকিটা যাত্রা শেষ হলে ভোর রাতে দেব।

পশুপতি ধাড়া দু হাত জোড় করে সকলকে নমস্কার করে উঠে পড়ল।

চারটে গরুর গাড়ি আবার চলতে শুরু করল।

গ্রামের মাতব্বররা কোমর বেঁধে চাঁদা আদায় শুরু করল।

তারা ঠিক করেছিল, কোন রকমে দেড়শো টাকা যদি ওঠাতে পারে, তাহলে যাত্রা পার্টিকে একশো টাকা দিয়ে, পঞ্চাশ টাকা থাকবে পিন্ডদানের জন্য।

বরাত ভাল, প্রায় দুশো টাকা উঠে গেল।

প্রথমে অনেকেই ভেবেছিল, টাকা পয়সা দেবে না, ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে যাত্রা শুনবে। তারপর শুনল কড়াকড়ি ব্যবস্থা হবে, বিনামূল্যে দেখার সুবিধা নেই, তাছাড়া উদবৃত্ত অর্থ গয়ায় পিন্ড দানে খরচ হবে, তখন আর কেউই দ্বিরুক্তি করল না।

জনার্দন খুড়ো প্রোপ্রাইটরকে পোস্টকার্ড ছেড়ে দিলেন।

যেখানে হাট বসে, বিলের ধারের মাঠ, সেখানটাই পরিষ্কার করা হল যাত্রার আসরের জন্য। পাড়ার উৎসাহী ছেলেরা গাছে গাছে হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড আটকে দিল: আসিতেছে, আসিতেছে, আসিতেছে! বহুদিন পরে আনন্দ সংবাদ! দি দিগ্বিজয় যাত্রাপার্টির যুগান্তকারী সৃষ্টি ‘কুরুক্ষেত্র’ !!

আগামী সতেরই বৈশাখ, হাটতলার মাঠে।

সবই ঠিক হল, শুধু একটু ভয় ছিল। কালবৈশাখীর সময় ঝড়বৃষ্টি হলেই মুশকিল।

তবে একটা ভরসার কথা এই যে, এবার ঝড়বৃষ্টির জোর কম।

আসরের দিন তিনেক আগে পশুপতি ধাড়া একবার সরেজমিনে তদারকে এল।

পোস্টার দেখে একটু গম্ভীর। বলল, সবই করলেন, প্রোপ্রাইটরের নামটা দিলেন না? দি দিগ্বিজয় যাত্রা পার্টির পরিচয়ই তো এই পশুপতি ধাড়া।

তারপর যাত্রার আসর কোথায় হবে, কোথায় সাজঘর, সব দেখল। জনার্দন খুড়োকে বলল, খাবার ব্যবস্থা কি হবে? আমাদের লুচি মাংস ছাড়া গলা খোলে না।

জনার্দন খুড়ো পরিষ্কার বললেন, লুচি মাংস পারব না। ঢালাও খিচুড়ির বন্দোবস্ত করব। তার সঙ্গে মাছ ভাজা। আপনাদের লোক ক'জন?

তা সব নিয়ে সাতাশজন।

ঠিক আছে, অসুবিধা হবে না। আরম্ভ করবেন নটায়?

উহু নটায় নয়, দশটা। দশটা থেকে ভোর চারটে। একেবারে জমজমাট ব্যাপার। দেখবেন এই সময়ের মধ্যে লোকে হাঁ করতে ভুলে যাবে। বিশেষ করে মহামানী দুর্যোধনের পার্ট দেখে।

দুর্যোধনের পার্ট কে করে? পশুপতি ধাড়া পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে হাসল। কোন উত্তর দিল না।

সতেরই বৈশাখ। রাত দশটায় যাত্রা আরম্ভ, সাতটা থেকে হ্যারিকেন হাতে লোক আসতে শুরু করল দলে দলে। ভিন গাঁয়ের লোকেরাও এসে ভিড় করল। তাদের আটকানো গেল না।

যাত্রার লোকেরা সাজতে শুরু করেছিল ছটা থেকে। নির্বিবাদে সাজবার যো আছে! গাঁয়ের ছেলের পাল সাজঘরে উঁকিঝুঁকি দিয়ে বিরক্ত করছিল। দুর্যোধনের গোঁফই পাওয়া গেল না। পাড়ার কোন ছেলে সরিয়ে ফেলেছিল। আবার গোঁফের ব্যবস্থা হল।

প্রায় সকলের সাজ হয়ে যেতে পশুপতি ধাড়ার খেয়াল হল, আরে বিজেটা গেল কোথায়? তার ছিকেষ্টর মেকআপ বেশ টাইম নেবে।

খোঁজ, খোঁজ, এদিক-সেদিক সবাই খুঁজতে লাগল।

বেশ কিছুক্ষণ পর পাওয়া গেল। গাঁয়ের এক ছেলেই আবিষ্কার করল। এক পাকুড় গাছতলায় সে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাচ্ছে।

পশুপতি ধাড়া প্যাকিং বাক্সের ওপর বসে বিড়ি খাচ্ছিল, খবর শুনে তেতে লাল। বললে, বালতি করে জল নিয়ে বিজেটার মাথায় ঢেলে দাও। নির্ঘাৎ গাঁজা টেনে মরেছে।

জল ঢালতে হল না। দুঃশাসন আর ভীম তার দুটো হাত ধরে হেঁচকাটান দিয়ে তুলল। বিজে জড়ানো গলায় বলল, একি বাবা, স্বর্গেও অশান্তি? বিষ্টুর সঙ্গে একটু প্রাইভেট কথা বলছিলাম, তাতেও বাধা? অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই বিজে ধাতস্থ হল। মেকআপ নিতে বসে গেল।

দশটায় যাত্রা আরম্ভ হবার কথা, শুরু হল সাড়ে দশটায়।

যাত্রা বেশ জমে উঠেছিল। দুর্যোধন বার দুয়েক হাততালি পেল। তা পশুপতি ধাড়াকে মানিয়েছেও চমৎকার। বাজখাঁই গলায় খুব চেঁচাচ্ছে।

গোলমাল শুরু হল শ্রীকৃষ্ণ আসরে ঢুকতে। ঢোকা ঠিক নয়, শ্রীকৃষ্ণ শুয়েই ছিল। পায়ের কাছে অর্জুন, শিয়রে দুর্যোধন।

পালায় আছে শ্রীকৃষ্ণ কপট নিদ্রা ত্যাগ করে উঠে প্রথমে অর্জুনকে দেখতে পাবে, যদিও দুর্যোধন আগে থেকে বসে আছে।

কনসার্ট চলছে।

বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। শ্রীকৃষ্ণের ওঠার কোন লক্ষণ নেই।

লোকেরা অধৈর্য হয়ে উঠছে।

দুর্যোধন সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে প্রমাদ গনল। কপট নয়, শ্রীকৃষ্ণের আসল নিদ্রা চলেছে! নাসিকা গর্জনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কনসার্টের জন্য সে আওয়াজ অবশ্য আসরে পৌঁছাচ্ছে না। কনসার্ট থামলেই শোনা যাবে।

ফিস ফিস করে দুর্যোধন বলল, এই বিজে, বিজে, উঠবে না কি? লোক কতক্ষণ বসে থাকবে?

শ্রীকৃষ্ণ গভীর নিদ্রামগ্ন।

দুর্যোধন আর পারল না। এভাবে চললে তো রাত কাবার হয়ে যাবে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধটা আর হবে কখন? হাতটা বাড়িয়ে শ্রীকৃষ্ণের ঘাড়ে মোক্ষম এক চিমটি কাটল সে। ওরে বাপ, কি ছারপোকা। ঘুমোবার উপায় আছে! শ্রীকৃষ্ণ লাফ দিয়ে উঠল।

সারা আসর হেসে খুন।

দুর্যোধনবেশী পশুপতি ধাড়া পাকা অভিনেতা। মানিয়ে নেবার চেষ্টা করে বলল, কেন পরিহাস করছেন যদুপতি, আমি আপনার দেহে অঙ্গ সঞ্চালন করছিলাম।

কিন্তু যদুপতি তখন নেশায় মশগুল। বললে, বাপস, ওর নাম অঙ্গ সঞ্চালন! আমার শরীরে কালসিটে পড়ে গেছে! আসর হেসে গড়িয়ে পড়ল।

এরপর সে দৃশ্য আর জমবার কথা নয়। কোন রকমে শেষ করা হল।

সাজঘরে গিয়ে পশুপতি ধাড়া বিজের গলা টিপে ধরল, তোকে আজ খুনই করে ফেলব। কতদিন বলেছি না গাঁজা টেনে আসরে নামবি না। দিগ্বিজয় যাত্রা পার্টির একটা প্রেসটিজ নেই?

সবাই মিলে বিজেকে ছাড়িয়ে নিল। টিপুনির চোটে বিজেরও কিছুটা জ্ঞান ফিরে এসেছিল। সে বলল,আর এমনটি হবে না। দেখ না, সব সিন কেমন জমিয়ে দিই!

তারপর গোটা দুয়েক সিন শ্রীকৃষ্ণ ভালই করল।

এক জায়গায় একটু গোলমাল করে ফেলেছিল, কিন্তু সামলে নিয়েছে। সেই যেখানে অর্জুন মূহ্যমান, সামনে আত্মীয়কুটুম্ব দেখে কিছুতেই লড়াই করতে চাইছে না, আর শ্রীকৃষ্ণ তাকে উত্তেজিত করছে, তাতেও সফল না হয়ে জ্ঞানের বাণী আওড়াবে, সেই দৃশ্যটায়।

অর্জুন তো যথারীতি একেবারে ঠাণ্ডা। গান্ডীব ফেলে দিয়ে হেঁটমুণ্ডে দণ্ডায়মান। তখন শ্রীকৃষ্ণ হাঁ করল। বিরাট এক হাঁ।

পালায় আছে, সেই হাঁ দেখে অর্জুন বিহ্বল। সৃষ্টি লয় সব কিছু সেই মুখের গহ্বরে। সব কিছুর কারণ শ্রীকৃষ্ণ। অর্জুন নিমিত্ত মাত্র। এইখানে অর্জুনের বেশ লম্বা বক্তৃতা ছিল।

শ্রীকৃষ্ণ কি দেখছ? বলার পর অর্জুন পোজ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল মুখের বিস্মিত ভঙ্গী করে। বিশ্বরূপ দর্শন করছে!

কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের নেশা বোধ হয় তখনো পুরো কাটেনি। তাই সে আবার বলল, কি দেখছ ধনঞ্জয়, টনসিল? বলেই তার চেতনা হল। সামলে নিয়ে নিজের পার্ট বলতে আরম্ভ করল। ভাগ্য ভাল, জোর বাজনা চলায় টনসিলটা আসরের কেউ শুনতে পেল না।

এ সিনটা উতরে গেল।

এরপর শ্রীকৃষ্ণের লম্বা বিরাম। দুর্যোধনের উরু-ভঙ্গের সিনে আবার তাকে আসরে নামতে হবে। ভীমকে ইঙ্গিত করবে দুর্যোধনের উরুতে অন্যায়ভাবে গদা দিয়ে আঘাত করতে।

গরম পড়েছে অসহ্য। গাছের একটি পাতা নড়ছে না। ময়ূরের পাখা লাগানো মুকুটটা খুলে রেখে বিজে একটা টুলের ওপর বসল। একটা হাতপাখা নিয়ে নিজেকে বাতাস করতে লাগল। ঠিক সেই সময়ে তার সামনে দ্রৌপদী এসে দাঁড়াল। তার আর বিশেষ পার্ট নেই। একেবারে শেষ সিনে শুধু দাঁড়ানো। দ্রৌপদীর হাতে কলকে। শ্রীকৃষ্ণের দিকে ফিরে বলল, হবে নাকি এক ছিলেম?

বিজের মনশ্চক্ষে পশুপতি ধাড়ার মূর্তি ভেসে উঠল। সে মাথা নেড়ে বলল, না ভাই, পার্ট গোলমাল হয়ে যাবে।

দ্রৌপদী হেসে উঠল, দূর চাষা কোথাকার, এতে পার্ট আরো খোলে। গলার আওয়াজ ভরাট হয়।

তাই নাকি, তবে দাও, একটান টানি। বলে শ্রীকৃষ্ণ হাত বাড়িয়ে কলকেটা নিল। এক টান নয়, বেশ কয়েক টান দিয়ে দ্রৌপদীকে যখন কলকে ফেরত দিল, তখন শ্রীকৃষ্ণের অবস্থা কাহিল। তার ধারণা হল, সে এ গায়ের জমিদার। দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তারই আনন্দের জন্য সখীরা নাচগান করছে।

বেশিক্ষণ চোখ খুলে থাকতেও পারল না। চোখ বুজে ফেলল।

হঠাৎ মনে হল কে যেন তাকে জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে। অস্পষ্ট কার কন্ঠস্বর। এই বিজে, তোর সিন এসেছে রে। উরুভঙ্গের সিন।

অ্যাঁ। বিজে চোখ খুলল।

নে ওঠ্‌ গদাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

ঠক, ঠকাস ঠক।

ভীম আর দুর্যোধন গদাযুদ্ধ চালিয়েছে। সেই সঙ্গে আস্ফালন।

এতক্ষণে বিজে উঠে দাঁড়াল। বিজেকে উঠে দাঁড়াতে দেখে যে ধাক্কা দিয়েছিল সে সরে গেল।

দাঁড়িয়ে উঠে বিজের মাথাটা বড় হালকা লাগল। মাথায় শিখিপুচ্ছসুদ্ধ মুকুট ছিল, সেটা খেয়াল হল। সামনে থেকে মুকুটটা তুলে নিয়ে মাথায় পরে শ্রীকৃষ্ণ দ্রুতপায়ে আসরে গিয়ে দঁড়াল।

সঙ্গে সঙ্গে হা, হা হো, হো, দর্শকদের মধ্যে যেন হাসির বন্যা বইতে লাগল। থামবার কোন লক্ষণ দেখা গেল না।

এই ঘোরতর গদাযুদ্ধে হাসির কি খোরাক থাকতে পারে সেটা ভীম আর দুর্যোধনের কেউ বুঝতে পারল না।

গদাযুদ্ধটা খুব জমেছিল। আসর একেবারে নির্বাক। সূচ পড়লেও বুঝি শব্দ শোনা যেত।

কায়দা করে দুর্যোধন গদাটা তুলে কয়েক পা পিছিয়ে গেল হাসির কারণ জানবার জন্য। শ্রীকৃষ্ণের দিকে দৃষ্টি পড়তেই দুর্যোধনের দুটো চোখ ছানাবড়ার সাইজ হয়ে গেল।

ছলনাময় শ্রীকৃষ্ণ দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে মৃদু মৃদু হাসছে। মাথায় প্লাস্টিকের বালতি।

যাত্রার শেষে মুখের রং তোলবার ব্যবস্থা। গোটা তিনেক বালতি বসানো ছিল। দরকারের সময় পুকুর থেকে জল নিয়ে আসতে হবে। নেশার ঘোরে শিখিপুচ্ছের মুকুট ভেবে বিজে নীল রঙের প্লাস্টিকের বালতিটা মাথায় পরেছে।

এই সিনে দুর্যোধনের দারুণ পার্ট। পশুপতি ধাড়া তিনবার যে মেডেল পেয়েছিল, এই সিনের জন্য। শ্রীকৃষ্ণের ইঙ্গিতে ভীম অন্যায়ভাবে তার উরুভঙ্গ করবে, সেই সময় শ্রীকৃষ্ণকে প্রতারক, মিথ্যাচারী, কপট, ঈশ্বর নামের কলঙ্ক প্রভৃতি বলে দুর্যোধন দীর্ঘ বক্তৃতা দেবে। সারা আসর হাততালিতে ফেটে পড়ে।

হতভাগা বিজের জন্য সব মাটি!

দুর্যোধন আর পারল না। গদা উঁচিয়ে বলল, তবে রে কুষ্মাণ্ড, আজ তোর একদিন কি আমার একদিন! তোকে খুন করে ফাঁসি যাব।

গদাটা তুলোর নয়। পশুপতি ধাড়া অনেক যত্ন করে কাঠের গদা তৈরি করিয়েছে। তার ওপর কালো রংয়ের প্রলেপ।

বিজে জানে, ওই গদার এক ঘা পিঠে পড়লে মেরুদণ্ড একেবারে ছাতু হয়ে যাবে।

বিজে ওরে বাবারে, মেরে ফেলরে রে! বলে ঝাঁপ দিয়ে আসরে পড়ল। জনার্দন খুড়ো আর বিধুবাবু বসেছিলেন মঞ্চের আসনের দিকে। দুজনের মাঝখানে গড়গড়া। নলটা জনার্দন খুড়োর কোলের ওপর। বিজে গিয়ে পড়ল গড়গড়ার ওপর। গড়গড়া কাত। কলকে ছিটকে পড়ল বিধুবাবুর ফতুয়ার ওপর। তুবড়ির মতন আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ল।

ওরে বাপস্। বলে বিধুবাবু লাফাতে আরম্ভ করলেন। বিজে ততক্ষণে পগার পার। পশুপতি ধাড়াও ছাড়বার পাত্র নয়। গদা ঘোরাতে ঘোরাতে সগর্জনে তার পিছনে ছুটল।

গাঁয়ের মাতঙ্গিনী দিদি তখন গোলমেলে ব্যাপার দেখে সরে পড়বার চেষ্টা করছিল। তার পক্ষে সরে পড়া একটু কষ্টকর। কারণ, ওজন প্রায় সাড়ে তিন মণ। রাস্তা দিয়ে গেলে দূর থেকে মনে হত যেন একটা জালা গড়াতে গড়াতে চলেছে। ছেলেরা একবার তাকে শহরে নিয়ে গিয়েছিল সিনেমা দেখানোর জন্য। কিন্তু টিকিট কেটে বিপদ। মাতঙ্গিনী একটা সীটে ধরে না। নানান রকম কসরত করা সত্ত্বেও। তারপর ম্যানেজারকে বলে একটা টুলের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই মাতঙ্গিনীর সঙ্গে পশুপতি ধাড়ার ধাক্কা লাগল।

দুজনে দুদিকে ছিটকে পড়ল।

ধুলো ঝেড়ে পশুপতি ধাড়া যখন উঠে বসল, তখন বিজে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে। মাতঙ্গিনীর মুখ দিয়ে গালাগালির ফোয়ারা ছুটল, মুখপোড়া, চোখের মাথা খেয়েছিস? ভীমের সঙ্গে লড়ছিলি, নেমে এসে মেয়েমানুষের সঙ্গে লড়াই করতে লজ্জা করে না? লড়বি তো আমাকেও একটা গদা দে, দেখি তোর কত হিম্মত।

এসব কথা পশুপতি ধাড়া কানে নিল না। এখানে দেরি হলে বিজেটা চোখের আড়ালে চলে যাবে। গদা ঘোরাতে ঘোরাতে পশুপতি ধাড়া ছুটল।

বিজে দাঁড়িয়ে একটু দম নিচ্ছিল, হঠাৎ পশুপতি ধাড়াকে আসতে দেখে সে আবার উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াল।

সামনেই সামন্ত বাড়ি।

ভিতর থেকে শব্দ আসছে খুট, খুট, খুট।

সামন্ত বাড়ির ভৌতিক ব্যাপার সম্বন্ধে বিজের কিছুই জানা ছিল না। সে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ভাঙা পাঁচিলের মধ্যে দিয়ে ভিতরে গিয়ে ঢুকল।

পিছনে গদা হাতে পশুপতি ধাড়া।

দরজাটা বোধ হয় ভেজানো ছিল। ঠেলতেই খুলে গেল।

এদিকে যাত্রার আসরে বিরজা মল্লিক বসেছিল। থানার অফিসার-ইন-চার্জ। অর্জুন, কুন্তী আর দ্রৌপদী তাকে এসে ধরল, স্যার, বিজেকে বাঁচান। প্রোপ্রাইটর খেপলে জ্ঞান থাকে না। একেবারে খতম করে দেবে। আপনি দয়া করে উঠুন, স্যার।

বিরজা মল্লিক উঠল। শুধু ওঠা নয়, ছুটতে আরম্ভ করল। বিরজা মল্লিক ছুটতে, যাত্রার আসরে পিছনে বসা দুজন পুলিসও ছুটল। স্যারের পিছনে ছোটা তাদের চিরকালের অভ্যাস।

সামন্ত বাড়ির সামনে এসে বিরজা মল্লিক একটু ইতস্ততঃ করল, তারপর বিজে আর পশুপতিকে ঢুকতে দেখে, ঢুকে পড়ল। অগত্যা পুলিস দুজনও | .

বিজে ঢুকতেই দেখল সামনে একটা কঙ্কাল। কঙ্কালের দুটো চোখে আগুনের শিখা। কঙ্কাল ঠেলে বিজে পিছনে চলে গেল।

এদিকে বিজেকে দেখেই পশুপতি ধাড়া যে গদা ছুঁড়ে মেরেছে, সেটা তীব্রবেগে কঙ্কালের ওপর এসে পড়ল। কঙ্কাল গুঁড়িয়ে চূর্ণ বিচুর্ণ।

এতক্ষণ ঘরের মধ্য থেকে যে খুটখাট শব্দ আসছিল, সেটা বন্ধ হয়ে গেল।

তুই কোথায় পালাবি দেখি। পাতালে ঢুকলেও তোকে আমি টেনে বের করব। তোর জন্য দি দিগ্বিজয় যাত্রাপার্টির ইজ্জত আজ ধূলোয় মিশেছে। তোকে শেষ করে তবে আমি অন্নজল স্পর্শ করব।

এ ঘরে হ্যাজাকের আলো জ্বলছিল, চেঁচামেচি হতেই কে আলো নিভিয়ে দিল। সব অন্ধকার। ভিতরে অনেকগুলো লোকের পায়ের শব্দ। মাঝে মাঝে পশুপতি ধাড়ার গদার আঘাত। সেই সঙ্গে আর্তনাদ, ওরে বাবারে, গেলুম রে!

বিরজা মল্লিক বিপদে পড়ল। বিজে হয়তো খুনই হয়ে গেল। পশুপতি ধাড়া যেভাবে গদা ঘোরাচ্ছে, কিছুই বিচিত্র নয়।

হঠাৎ তার নিজের কোমরে গোঁজা টর্চ আর রিভলভারের কথা মনে পড়ে গেল। এক হাতে টর্চ টিপল। অন্য হাতে রিভলভার বাগিয়ে ধরল। টর্চের আলোতে সব দেখে বিরজা মল্লিকের চক্ষুস্থির।

বিজে কোথাও নেই। গদার আঘাতে জনতিনেক লোক পড়ে আছে। তাদের পরনে কালো গেঞ্জি আর কালো পাজামা। পশুপতি ধাড়ার জ্ঞান নেই। সবেগে গদা ঘুরিয়ে চলেছে সে।

টর্চের আলো ঘুরিয়ে বিরজা মল্লিক এদিক-ওদিক দেখল।

এক কোণে কালো রঙের একটা মেশিন। পাশে ছোট সাইজের অনেক বাক্স। গোলমেলে ব্যাপার বুঝতে বিরজা মল্লিকের একটুও দেরি হল না। লোকগুলোর দিকে রিভলভার লক্ষ্য করে বলল, উঠে দাঁড়াও তিনজনে, যদি বাঁচতে চাও।

তিনজনে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। ততক্ষণে মোটা লাঠি হাতে পুলিস দুজনও এসে হাজির হয়েছে।

কিসের মেসিন ওটা?

একজন ভীত কণ্ঠে বলল, আজ্ঞে নোট ছাপাবার। ও, এখানে তাহলে নোট ছাপানো হয়। তাই লোককে ভূতের ভয় দেখিয়ে তাড়াবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কঙ্কালের চোখে লাল কাগজ আটকে ভয় দেখাবার চেষ্টা! জাল নোট ছাপাবার কারবার চলেছে।

আমরা কিছু জানি না হুজুর, মালিক জানে।

চোপরাও। এই, বাঁধো তিনজনকে পিছমোড়া করে।

পুলিসরা এগিয়ে গিয়ে তিনজনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল। পশুপতি ধাড়া তখনও গদা ঘুরিয়ে চলেছে।

আঃ, কি হচ্ছে মশাই, গদা থামান! বিরজা মল্লিক কড়া ধমক দিল। পশুপতি থতমত খেয়ে গেল।

বিরজা মল্লিক এগিয়ে গিয়ে ছোট বাক্সগুলো খুলল।

কোনটাতে পাঁচ টাকার নোট, কোনটাতে দশ। সবই অবশ্য জাল।

বিরজা বলল, পশুপতিবাবু, আপনি এ সবের সাক্ষী। জবর একটা কেস পাকড়াও করা গেছে। কিন্তু আর একজন সাক্ষী পেলে হত। বিজুবাবু কোথায়?

বিজেটাকে আমিও খুঁজে পাচ্ছি না। পশুপতির স্বীকারোক্তি।

বিরজা মল্লিক পশুপতি ধাড়ার কথায় চিন্তিত হয়ে পড়লঃ তাই তো, এ ঘরের একটাই তো দরজা। সে দরজা আগলে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। কোথায় যেতে পারেন বিজুবাবু?

টর্চের আলো ঘরের চারদিকে ফেলে বিরজা মল্লিক চেঁচাল, বিজুবাবু, কোথায় আপনি?

ক্ষীণকণ্ঠ ভেসে এল, এই যে আমি ওপরে।

বিরজা মল্লিক চমকে উঠে টর্চের আলো ওপর দিকে ফেলে দেখল, কড়িকাঠে বাঁধা একটা দড়ি ধরে বিজে বিপজ্জনকভাবে ঝুলছে।

নেমে আসুন মশাই।

কি করে নামব?

যে ভাবে উঠেছেন।

কিভাবে উঠেছি জানি না। গদার ভয়ে উঠে পড়েছি।

এদিক-ওদিক দেখে বিরজা মল্লিক দেখতে পেল, জানলার পাশে মোটা একটা পাইপ ছাদ পর্যন্ত উঠেছে। বোঝা গেল, ভয়ে জ্ঞানশূন্য হয়ে এই পাইপ বেয়ে বিজে উঠে পড়ে ওই দড়ি আশ্রয় করেছে। বিরজা মল্লিক পুলিসদের দিকে ফিরে বলল, এই, ওকে নামাবার ব্যবস্থা কর।

বিরজা মল্লিক তো বলে খালাস, কিন্তু কড়িকাঠ থেকে বিজেকে নামাবে কি করে?

বুদ্ধি করে একজন পুলিস মেশিনের ওপর উঠে পড়ল। আর একজন তাকে চেপে ধরল। মেশিনের ওপর দাঁড়ানো পুলিস দুটো হাত বাড়িয়ে বলল, নিন, ঝাঁপ দিন, কোন ভয় নেই।

বিজে চেঁচাল, রাম, দুই, তিন।

তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে একেবারে পুলিসের কোলে।

বিরজা মল্লিক বলল, এই যে বিজুবাবু, আপনিও একজন সাক্ষী। এখানে একটা সই করুন।

বিজে বলল, আমার নাম বিজিতেন্দ্র মোহন নায়ক। কোথায় সই করতে হবে বলুন।

পুলিস দুজনকে সামন্ত বাড়িতে রেখে বিরজা মল্লিক তিনজনকে বেঁধে নিয়ে গেল। পিছন পিছন পশুপতি ধাড়া আর বিজে।

কিছুটা এসে পশুপতির খেয়াল হল, আরে আমার গদাটা ফেলে যাচ্ছি যে। আমার এত সাধের গদা।

বিজে বলল, আর আমার শিখিপুচ্ছ, মানে প্লাস্টিকের বালতি।


প্রতিহিংসা

লেখক: হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়


এ কাহিনী এতদিন কাউকে বলিনি। জানতাম বড়দের বলে লাভ নেই, তারা একটি বর্ণও বিশ্বাস করবে না। সবকিছু তারা যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করতে চায়।

কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা আছে যেগুলো যুক্তি নির্ভর নয়। তাদের ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তাই আমরা বলি অলৌকিক ঘটনা । কারণ পৃথিবীতে সচরাচর যা ঘটে ঘটতে পারে, সেই মাপ-কাঠিতে এ কাহিনী বিচার চলে না।

এমন এক অলৌকিক ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছিল। কাজকর্মের অবকাশে সে কাহিনী মনে পড়লে এখনও চমকে উঠি। মাঝরাতে স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে দেখি মাঝে মাঝে তারই ছায়া। ঘুম ভেঙে বিছানার উপর উঠে বসি। রাতটুকু আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কাটাতে হয়।

আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগেকার কথা।

আমি তখন লোচনপুর হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র। এক ইতিহাস ছাড়া অন্য সব বিষয়গুলোয় মোটামুটি ভালই ছিলাম, অংকে বিশেষ ভাল, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ইতিহাসের সাল তারিখগুলো কিছুতেই কন্ঠস্থ করতে পারতাম না। মোঘল আর পাঠান বাদশাহের নামগুলো গোলমাল হয়ে যেত। সতীদাহ প্রথা রদ বোধহয় বেন্টিঙ্ক না ডালহৌসি কার অক্ষয় কীর্তি, সেটা মাথা চুলকে চুল উঠিয়ে ফেললেও মনে রাখতে পারতাম না। ফলে ইতিহাসের পরীক্ষার দিন আমার অবস্থা রীতিমত সঙ্গীন হয়ে দাঁড়াত। বাড়ি থেকে স্কুল যাওয়ার পথে যতগুলো মন্দির পড়ত, সবগুলোতে মাথা ঠেকাতাম। রাস্তার দু-পাশের বড় সাইজের পাথরের নুড়িও বাদ দিতাম না।

আমার সঙ্গে পড়ত পশুপতি সামন্ত। ইয়া জাঁদরেল চেহারা। অমাবস্যাকেও হার মানানো গায়ের রঙ। ছেলেবেলায় মা-বাবা দুজনেই মারা গিয়েছিল। থাকত দূর সম্পর্কের এক পিসির কাছে। সেখানে তার লাঞ্ছনা-গঞ্জনার অন্ত ছিল না।

এই পশুপতি অন্যসব বিষয়ে যুত করতে পারত না, কিন্তু ইতিহাসে একেবারে নামকরা ছাত্র। ইতিহাসের শিক্ষক নিবারণবাবু পর্যন্ত তার তারিফ না করে পারতেন না। আমরা যখন এক পানিপথের যুদ্ধেই আধমরা হবার উপক্রম হয়েছি, তখন পশুপতি সমস্ত প্রশ্নপত্রের উত্তর দিয়ে পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে যেত।

কিন্তু অঙ্কে পশুপতি সামন্তের অবস্থা কাহিল। সোজা সোজা অঙ্কগুলো কষতেও সে হিমসিম খেয়ে যেত। একটা বানর চর্বি মাখানো বাঁশে ঘণ্টায় দুফিট উঠছে আর নামছে এক ফিট, বাইশ ফিট বাঁশের আগায় উঠতে তার কত দেরী হবে। এমন একটা নিরীহ প্রশ্নে পশুপতি মুখটা এমন করে বসে থাকত, মনে হত তার অবস্থা ওই বানরবর্গের চেয়েও মারাত্মক। গরমের ছুটিতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পশুপতি অঙ্কের পর অঙ্ক কষে গেছে, গোটা-দুয়েক খাতা শেষ, কিন্তু তাতেও বিশেষ সুবিধা করতে পারত না। বেচারী নিজেই বলত, আমার দ্বারা হবে না ভাই। অঙ্কটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকবে না।

আমাদের আমলে প্রাইভেট টিউটর রাখার এত রেওয়াজ ছিল না। তবু আমরা পশুপতিকে বলেছিলাম, একটা ভাল দেখে অঙ্কের মাষ্টার বাড়িতে রেখে দে বরং।

পশুপতি কোন উত্তর দেয়নি। ছলছল চোখে আমাদের দিকে চেয়েছিল। তার মনের ব্যথাটা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয়নি। পিসি কোনরকমে বাড়িতে ঠাঁই দিয়েছে! দু'বেলা দু'মুঠো ভাত আর সাধারণ জামা কাপড়ের বদলে তাকে দিয়ে রাজ্যের কাজ করিয়ে নেয়। ছুটির দিন আমরা দেখেছি, পশুপতি বসে বসে বেড়া বাঁধছে। এর পর প্রাইভেট টিউটরের বাড়তি খরচের কথা বললে পিসি তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়েই দেবে।

মনে মনে আমি কিন্তু পশুপতিকে হিংসা করতাম। কারণ যে ইতিহাসের লবনাক্ত সমুদ্রে আমি হাবুডুবু খাই, কুল পাই না, সেই ইতিহাসের যে তারিখগুলো আমার কাছে হুলের খোঁচার সামিল সেই সব সন তারিখগুলো পশুপতি এমনভাবে আওড়ে যায় যেন অতি সাধারণ ব্যাপার।

আর একটা কারণও ছিল। আমি আশা করেছিলাম পশুপতি আমায় অনুরোধ করবে। আমি অঙ্কে ভাল, মাঝে মাঝে তাকে যাতে অঙ্কের ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি। কিন্তু পশুপতি এ বিষয়ে কোনদিন একটি কথাও বলেনি, অনুরোধ তো দূরের কথা।

আমরা ক্লাসে সবশুদ্ধ আটচল্লিশ জন ছেলে, তার মধ্যে টেস্টে পাশ করলাম চল্লিশ জন। পশুপতিও একজন।

অঙ্কে সে পাশ করেনি, কিন্তু হেডমাস্টারের হাতে পায়ে ধরে ফাইনালে বসার অনুমতি পেল। প্রতিশ্রুতি দিল, মাঝখানের সময়টা সব ছেড়ে শুধু অঙ্ক করবে।

আমার অবস্থা ঠিক বিপরীত। ইতিহাসে ফেল করলাম না বটে, তবে কোন রকমে কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেলাম। একেবারে টলমলে অবস্থা। আমিও ঠিক করলাম, ছুটির বেশী সময়টুকু ইতিহাসেই নিয়োজিত করব।

প্রবেশিকা পরীক্ষা হ'ত শহরে। বিবিগঞ্জে। আমাদের গ্রাম থেকে চার মাইল দূরে। বাবার এক আলাপী উকিল ছিল সেই শহরে, আমি পরীক্ষার আগের দিন সেখানে গিয়ে উঠলাম। ক্লাসের অন্য ছেলেরা কে কোথায় উঠেছিল খোঁজ রাখিনি। তখন খোঁজ রাখার মত মনের অবস্থাও নয়।

পরীক্ষার হলে সকলের সঙ্গে দেখা হল। ইংরাজী, বাংলা দুটো পরীক্ষা নির্বিবাদে শেষ হল, পশুপতির সীট পড়েছে ঠিক আমার সীটের পিছনে।

তৃতীয় দিন অঙ্ক। হলে ঢোকবার মুখেই পশুপতির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। একেবারে সামনাসামনি। কপালে আধুলি সাইজের টিপ। পকেট বোঝাই ফুল আর বেলপাতা। এতরকম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়েও পশুপতি মুখে নির্ভীক ভাব ফোটাতে পারে নি। দুটি চোখে আসন্ন বিপদের ছায়া।

পরীক্ষা আরম্ভ হল। চারটি অঙ্ক শেষ করে পাঁচ নম্বর অঙ্কটি শুরু করেছি, হঠাৎ চেয়ারটি নড়ে উঠল। পিছনে পশুপতি। ভাবলাম পা সরাতে গিয়ে চেয়ারে হয়তো লেগে গিয়েছে। আবার পরীক্ষার খাতায় মনোনিবেশ করলাম।

আবার নড়ে উঠল চেয়ার। আড়চোখে পিছনে দেখতেই কানে ফিসফিস করে শব্দ হল। অঙ্কগুলো দেখা না। আমি একটাও পারছি না। গোটা তিনেক গার্ড অবশ্য এধার ওধারে ছিলেন। তাঁরা খুব কড়া এমন মনে হল না। দু'জন তো হাতে খোলা বই নিয়ে পায়চারি করছেন। ছাত্রদের দিকে নয়, তাঁদের নজর বইয়ের পাতায়।

আর একজন একেবারে কোণের দিকে দাঁড়িয়ে আছেন।

আমি যদি একপাশে একটু সরে বসি আমার খাতা দেখে অঙ্কগুলো টুকে নিতে পশুপতির কোন অসুবিধা হবে না। সব টোকবার দরকার নেই। গোটা চার পাঁচ অঙ্ক টুকে নিলেই যথেষ্ট। পাশ নম্বর হয়ে যাবে। কিন্তু আমি নিজেই শরীরটা দিয়ে খাতাটা আরো ঢেকে বসলাম। যাতে কোন দিকে কোন ফাঁক না থাকে। পশুপতি আমার কষা একটা অঙ্কও দেখতে না পায়।

মনকে বোঝালাম দুর্নীতির প্রশ্রয় দেওয়া কিছুতেই উচিত নয়। ধরা পড়লে দুজনেরই সর্বনাশ।

অবশ্য এসব নীতিকথার অন্তরালে আমার মনের হিংসাটাই প্রকট হয়ে উঠেছিল, পশুপতি আমার পিছনে, কাজেই ইতিহাসের দিন তার কাছ থেকে বিশেষ সাহায্য পাব এমন ভরসা কম। তাছাড়া নিতান্ত বেখাপ্পা প্রশ্ন যদি না আসে, তাহলে ইতিহাসে হয়তো কোনরকমে আমি পাশ করে যেতে পারি। কিন্তু পশুপতির খেদোক্তি শুনে মনে হচ্ছে, একটা অঙ্কও সে পর্যন্ত ঠিক করতে পারেনি।

আরও কয়েকবার চেয়ারটা নড়ে উঠল, পশুপতির করুণ অনুনয়ের সুর কানে এল। আমি অনড় অটল। দেখলাম সময় শেষ হবার আধঘন্টা আগে পশুপতি অঙ্কের খাতা জমা দিয়ে টলতে টলতে বাইরে চলে এল।

পরের দিন ইতিহাস। আমার অগ্নিপরীক্ষার দিন। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে ইতিহাসের বইগুলো নিয়ে বসলাম। দরকার হলে অনেক রাত অবধি পড়ব। মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন। কিন্তু যখন পড়তে লাগলাম মনে হল বিশেষ সুবিধা করতে পারছি না। মোগল সম্রাটদের ছুঁচালো দাড়িগুলো যেন সর্বাঙ্গে ফুটতে লাগল। আগে বাবর না আকবর কিছুতেই মনে করে উঠতে পারলাম না! দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে গেল হর্ষবর্ধনের বাপের নাম গোবর্ধন।

ফরাসীদের পীঠস্থান ফরাসডাঙা পটলডাঙার কাছে কিনা সেটা নিয়েও চিন্তিত হয়ে পড়লাম।

আসল কথা, একে ইতিহাসের জ্ঞান খুব গভীর নয়, তার ওপর আসন্ন বিপদের উত্তেজনা, সব মিলে যেটুকু এত কষ্ট করে এতদিন ধরে কণ্ঠস্থ করেছিলাম সব বেমালুম ওলোট পালোট করে দিল। সর্বনাশ, একেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসলাম।

হঠাৎ খুট করে শব্দ। দরজার দিকে চেয়েই চমকে উঠলাম।

চৌকাঠের ওপর পশুপতি। সেই কপালে সিঁদুরের ফোঁটা, পকেট ভর্তি ফুল, বেলপাতা।

এ কিরে তুই?

চলে এলাম। একটা গোপনীয় খবর আছে।

গোপনীয় খবর? প্রশ্ন করতে গিয়ে মনে পড়ে গেল রাত নটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে উকিলবাবুদের গেট বন্ধ হয়ে যায়! বাইরে থেকে লোক ঢোকার কোন উপায় নেই।

তুই ঢুকলি কি করে?

গেটের কাছে চাকর দাঁড়িয়েছিল একটা, তাকে তোর কথা বলতে গেট খুলে দিল। কথা বলতে বলতে পশুপতি এগিয়ে এসে আমার তক্তপোশের ওপর বসল।

আমার তো এ শহরে চেনাজানা কেউ নেই। আমি এখানে এক চায়ের দোকানের পিছনে চারপাই পেতে আশ্রয় নিয়েছি। একটু আগে সেখানে দুজন শিক্ষক এসেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন সম্ভবতঃ আমাদের ইতিহাসের প্রশ্নপত্র করেছেন। চায়ের দোকানে বসে তারা সেই বিষয়ে আলোচনা করছিলেন। আমি পার্টিশনের আড়াল থেকে বসে বসে শুনেছি।

বলিস কি? আমি উত্তেজনায়, আনন্দে টান হয়ে বসলাম।

আমি প্রশ্নগুলো বলছি তুই লিখে নে। তোর কথাই আগে মনে পড়ল। তাছাড়া তোকে এবাড়িতে ঢুকতে দেখেছি! তোর আস্তানা চিনি, তাই ছুটে আগে তোর কাছেই এলাম।

পশুপতির এতকথা কানে গেল না। আমি কাগজ পেন্সিল নিয়ে একেবারে তৈরী। হাতে সময় কম। প্রশ্নগুলো জানতে পারলে সারারাত ধরে একবার চেষ্টা করব।

লেখ, অশোকের রাজ্য প্রণালী, আকবর ও আওরঙজেবের তুলনামূলক সমালোচনা, মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ, শিবাজীর সাম্রাজ্য বিস্তার কাহিনী, লর্ড কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।

এই কটাই আমি শুনতে পেয়েছি। পশুপতি বলল।

যথেষ্ট, যথেষ্ট, উৎসাহে আমি ঠেঁচিয়ে উঠলাম, এই কটা ঠিক মত লিখতে পারলেই হয়ে যাবে। পাশ করার ভাবনা গেল। হয়তো ভাল নম্বরও পেয়ে যেতে পারি।

এতক্ষণ পরে পশুপতির জন্য আমার মায়া হ'ল। বেচারীকে কয়েকটা অঙ্ক দেখালেই হ'ত। ইতিহাসের প্রশ্ন জানতে পেরে ছুটে আগে তো আমার কাছেই এসেছে।

জিজ্ঞাসা করলাম, অঙ্ক কেমন হ'ল?

স্পষ্ট দেখতে পেলাম পশুপতির মুখে বিষণ্ণ একটা ছায়া নামল। একটু যেন বিমর্ষভাব!

অন্য দিকে চেয়ে বলল, ওই একরকম। যা হয়ে গেছে তার কথা আর ভাবছি না। পিছন দিকে দেখলে নিজের বড় ক্ষতি হয়। আমি চলি। তুই পড়।

পশুপতি বেরিয়ে গেল। প্রায় সারা রাতই পড়লাম। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠতে দেরী হয়ে গেল।

কোনরকমে স্নান সেরে, দুটি মুখে দিয়ে ছুটতে ছুটতে হলে যখন গিয়ে পৌঁছলাম, তখন পরীক্ষা শুরু হতে আর মিনিট দুয়েক।

বেশ খুশি হয়েই প্রশ্নপত্রটা টেনে নিলাম। তারপর অনেকক্ষণ আর চোখের সামনে কিছু দেখতে পেলাম না। পুঞ্জীভূত ধোঁয়া কখনও গাঢ়, কখনও একটু তরল!

সারা প্রশ্নপত্রে অশোকের নাম নেই। বাবর আর আকবরের তুলনার বদলে সাজাহানের সৌন্দর্য-প্রিয়তার প্রশ্ন রয়েছে। মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ নয়, মারাঠা রাজ্যের পতনের কারণ নির্ণয় করতে দেওয়া হয়েছে। শিবাজীর জীবনী কোথাও নেই, তার পরিবর্তে হায়দার আলীর উত্থানের কাহিনী।

মোটকথা পশুপতির বলা একটি প্রশ্নও আসেনি।

কিছুক্ষণ পর গোটা প্রশ্নপত্রটাই চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম দু'চোখ জলে ভরে এসেছে।

এমন করেই বুঝি পশুপতি আমার উপর প্রতিশোধ নিল।

কিন্তু বিস্মিত হবার আমার আরও একটু বাকি ছিল।

ঘণ্টা বাজতে কোনরকমে খাতাটা জমা দিয়ে বাইরে চলে এলাম। একটু দাঁড়ালাম যদি পশুপতির সঙ্গে দেখা হয়!

পশুপতিকে দেখতে পেলাম না, রাজীব এসে সামনে দাঁড়াল। আমাদের হেডমাস্টারের ছেলে।

ব্যাপারটা শুনেছ?

কি ব্যাপার?

পশুপতি কাল পরীক্ষার হ'ল থেকে বেরিয়ে রেলের তলায় মাথা দিয়েছে।

সমস্ত শরীরটা কেঁপে উঠল। জড়ানো কণ্ঠে বললাম। কে বললে?

বাবাকে খবর পাঠানো হয়েছিল। বাবা পশুপতির পিসিকে নিয়ে আজ সকালে এসে পৌঁছেছেন। বাবার কাছেই শুনলাম কোমর থেকে একেবারে দু'খণ্ড হয়ে গেছে।

কটার সময় হয়েছে এটা?

আকন্দপুর এক্সপ্রেস এখান দিয়ে ছটা তিরিশে যায়, সেই সময়েই।

কিন্ত ও যে, কথাটা বলতে গিয়েই থেমে গেলাম! যে পশুপতি সাড়ে ছটায় শেষ-হয়ে গিয়েছে সে রাত সাড়ে নটায় বহাল তবিয়তে আমার ঘরে গিয়ে আমাকে ইতিহাসের একগাদা প্রশ্ন বলে এসেছে। এমন আজগুবি কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। বরং আমাকেই মাতাল সাব্যস্ত করবে।

মাথা নীচু করে আস্তে আস্তে সরে এলাম।

শেষ মুহূর্তে হলে ঢুকেছিলাম, সারাক্ষণ উত্তেজিত অবস্থা, কাজেই পিছনের সীটে পশুপতি এসেছে কিনা সেটা আদৌ লক্ষ্য করিনি!

কিন্তু একটা কথা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলাম না।

মৃত্যুর পরেও কি পরলোকগত আত্মার বিদ্বেষ, প্রতিহিংসার প্রবৃত্তি থাকে?

তা যদি নাই থাকবে, তবে পশুপতি ওভাবে প্রতিশোধ নিতে কেন আবার আমার কাছে এসে দাঁড়াবে!