ভূতুড়ে রাত

লেখক: হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

সভা শেষ হতে বেশ রাত হয়ে গেল। আমার যে বাড়িতে রাত্রে থাকা ঠিক হয়েছে সেটা শহরের বাইরে। ডাকবাংলোয়। কর্মকর্তাদের একজন মোটরে আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। কিন্তু পথে বিপত্তি।

শহর ছাড়িয়ে একটু গিয়েই মোটর বিকল হল। আধঘণ্টা ধরে অনেক চেষ্টা করেও মোটর চালু করা গেল না। ঘড়িতে রাত তখন এগারোটা দশ। কর্মকর্তা বললেন, মুস্কিল হল দেখছি, এক কাজ করা যাক। সামনেই রাজা-বাহাদুরের বাড়ি!

রাতটা সেখানেই কাটানো যাক। ফিকে জ্যোৎস্নায় বিরাট অট্টালিকার অস্পষ্ট কাঠামো দেখা গেল। মস্ত বড় লোহার ফটক। কর্মকর্তা ফটকের এপার থেকে চীৎকার শুরু করলেন, দারোয়ান, দারোয়ান?

অনেকক্ষণ ডাকার পর আধবুড়ো এক দারোয়ান এসে দাঁড়াল। কর্মকর্তাকে চিনতে পেরে সেলাম করল। নীচের দুটো ঘর খুলে দাও। মোটর খারাপ হয়ে গেছে। আমরা রাতটা এখানে কাটাব। দারোয়ান বিড় বিড় করে কি বলল, তারপর কোমরে বাঁধা চাবির গোছা থেকে চাবি বের করে দুটো ঘর খুলে দিল। একটা ঘরে আমি, আর একটায় কর্মকর্তা আর ড্রাইভার। ঘরের মধ্যে পা দিয়েই বুঝতে পারলাম ঘর রীতিমত ঝাড়পৌঁছ করা হয়। কোথাও একতিল ময়লা নেই। উঁচু খাট, তার উপর পরিষ্কার বিছানা! ঝালর দেওয়া দুটো বালিশ।

সারারাত বাতি জ্বেলে ঘুমানো অভ্যাস। অন্ধকারে একেবারেই ঘুম হয় না। কম পাওয়ারের নীলাভ বাতিটা জ্বেলে রাখলাম। শুয়ে শুয়ে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে চোখে পড়ে পায়ের দিকে একটা তেল রঙ-এর ছবি।

সিংহাসনের মতন কারুকার্য করা একটা চেয়ারে একজন প্রৌঢ় বসে! অঙ্গে জমকালো পোষাক, প্রকাণ্ড মুখ। বিরাট গোঁফ, রক্তাক্ত দুটি চোখ। যেন জ্বল জ্বল করছে। ইনিই সম্ভবত রাজাবাহাদুর, এই অট্টালিকার মালিক ছিলেন। বাইরে বৃষ্টির শব্দ। গাছের পাতায় পাতায় নূপুরের আওয়াজের মতন। এক সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘট্ ঘট্ ঘট্ --

ঘুমের মধ্যে শব্দ কানে এল। প্রথমে মনে হল ঝড়ের বেগে জানলার পাল্লা কাঁপছে। তারপর মনে হল, কে যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে।

এত রাত্রে কে দরজা ঠেলছে।

তবে কি কোন কারণে কর্মকর্তা কিংবা ড্রাইভার ডাকছে। দু-হাতে চোখ রগড়ে উঠে বসলাম। না। যেদিকে দরজা, শব্দটা সেদিক থেকে আসছে না। ফিরতেই সারা শরীর কেঁপে উঠল। আমি ভীরু এমন বদনাম কেউ দেবে না, কিন্তু চোখের সামনে এমন এক দৃশ্যকে অস্বীকারই বা করি কি করে!

ছবির ফ্রেমটুকু রয়েছে, রাজাবাহাদুর নেই।

ছবির ঠিক নিচে রাজাবাহাদুর বসে।

এক পোশাক, এক ভঙ্গী। নিশ্চল, নিথর, তবু হাতের মোষের সিং-এর ছড়িটা মেঝের উপর ঠুকছেন খট্‌ খট্‌ খট্‌। আমার মনে হল শরীরের সমস্ত রক্ত জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। চীৎকার করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছি। চুপ চাপ রইলাম।

বাইরে ঝড়ের গতি আরও উদ্দাম। হঠাৎ এক সময় শব্দ করে দরজা খুলে গেল। হাওয়ার ঝলকের সঙ্গে দীর্ঘকৃশ চেহারার একজন ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল। এগিয়ে আসতে দেখতে পেলাম লোকটার খালি গা, আর ময়লা ধুতি হাঁটুর ওপর তোলা। মাথায় মোটা টিকি। এদেশের চাষা-ভুষো লোক বলেই মনে হয়।

লোকটা রাজাবাহাদুরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ভ্রূকুটি ফুটে উঠল।

কে?

আমি ঠাকুরপ্রসাদ।

ঠাকুরপ্রসাদ? এখানে এত রাত্রে কি দরকার।

আমার ছেলে শিউপ্রসাদ কই?

শিউপ্রসাদ, তা আমি কি করে জানব?

হ্যাঁ, তুমি জান! তোমার লোক তাকে ধরে এনেছে। আমার খাজনা বাকি ছিল, দু’সাল ধরে দিতে পারছি না, তাই তোমার লোক আমার ছেলেকে ধরে এনেছে। বল কোথায়?

মনে হল রাজাবাহাদুর যেন একটু অস্বস্তি বোধ করলেন। একবার খোলা দরজার দিকে দেখলেন, এই আশায় যদি তাঁর কোন পাইক, এ ঘরে এসে পড়ে। কিন্তু না, কেউ এল না। এই গভীর রাতে, ঝড়বৃষ্টির মধ্যে সবাই বোধহয় নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাচ্ছে! কেউ এল না দেখে রাজাবাহাদুর বললেন, আমি তোমার ছেলের কথা জানিনা। তুমি যেতে পার।

যাবার জন্য আমি আসিনি। ঠাকুরপ্রসাদের গলায় যেন সিংহ গর্জনের সুর।

তার মানে?

তার মানে?

আমি প্রথমে ভাবলাম, বুঝি বিদ্যুৎ চমকাল! না বিদ্যুৎ নয়, ঠাকুরপ্রসাদ কোমর থেকে ধুতির আড়ালে লুকানো প্রকাণ্ড একটা ভোজালি বের করল।

এ কি?

রাজাবাহাদুর আর্তকণ্ঠে চীৎকার করে উঠলেন। শিউপ্রসাদকে আমার চাই, নইলে তোমাকে প্রাণে বাঁচতে দেব না। বল শিউপ্রসাদ কোথায়?

চোরা কুঠুরিতে।

বলতে বলতে রাজাবাহাদুর উঠে দাঁড়ালেন। উঠে দাঁড়িয়েই দেয়ালে ফটোর পিছনে হাত দিয়ে কি একটা টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘড় ঘড় করে শব্দ।

রাজাবাহাদুর সেই দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন। ওই যে চোরা কুঠুরি। ওইখানে তোমার ছেলে আছে।

ঠাকুরপ্রসাদ যে ভাবে নেমে গেল, মনে হল যেন সিঁড়ি আছে। একটু পরেই একটা আর্তনাদ শোনা গেল।

ঠাকুরপ্রসাদ উপরে উঠে এল। তার কোলে মরা ছেলে। শিউপ্রসাদ, শিউপ্রসাদ বাপ আমার। তার কান্নার শব্দে আমার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। মরা ছেলেকে মেঝের ওপর নামিয়ে রেখে ঠাকুরপ্রসাদ সোজা হয়ে রাজাবাহাদুরের মুখোমুখি দাঁড়াল।

বজ্র গর্জনে বলল, আর নয়, তোমার অত্যাচার অনেক সহ্য করেছি। এবার প্রতিশোধ নেব। যে ভোজালিটা কোমরে গুঁজে রেখেছিল, সেটা সে আবার টেনে বের করল।

আমি ভয় পেলাম। এখনই আমার চোখের সামনে একটা খুনোখুনি হয়ে যাবে ভেবে চীৎকার করে উঠলাম।

কি আশ্চর্য, গলা দিয়ে একটু স্বর বের হ’ল না। রাজা বাহাদুর চেঁচালেন, রামলোচন, পিয়ারীলাল। ঠাকুরপ্রসাদ জোরে হেসে উঠল, হাঃ-হাঃ-হাঃ, কেউ আসবে না। সবাই যাত্রা শুনতে গেছে। সেই খবর পেয়েই আমি এসেছি। ভগবানের নাম স্মরণ কর। তারপর কি হয়ে গেল। আমার চারদিকে ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে গেল। সেই ধোঁয়ার মধ্যে রাজাবাহাদুর আর ঠাকুরপ্রসাদ হারিয়ে গেল।

ঘুম যখন ভাঙল তখন সবে ভোর হচ্ছে। কাঁচের জানলা দিয়ে সূর্যের প্রথম কিরণ এসে বিছানার ওপর পড়েছে। বিছানা থেকে উঠেই ফটোর দিকে দেখলাম রাজাবাহাদুরের প্রকাণ্ড মূর্তি। নেমে ফটোর পিছনে হাত দিয়ে দেখলাম। চোরাকুঠুরি খোলার কোন বোতাম দেখতে পেলাম না। মেঝে নিরীক্ষণ করে দেখলাম। কোথাও কোন ফাটল নেই।

তাহলে সবই আমার মনের ভুল কিংবা স্বপ্নে সব কিছু দেখেছি। দরজা খুলে বাইরে এলাম। গেটের কাছে দরোয়ান বসে। তার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সে উঠে সেলাম করল। তাকে সোজাসুজি প্রশ্ন করলাম। আচ্ছা এখানে চোরাকুঠুরিটা কোথায়? দরোয়ান চমকে উঠল, চোরাকুঠুরি!

হ্যাঁ। যেখানে রাজাবাহাদুর প্রজাদের ধরে এনে রাখতেন।

আপনাকে এ সব কে বলল বাবুজী।

যেই বলুক। কথাটা সত্যি কি না তুমি বলনা?

দরোয়ান চাপা গলায় বলল, আমি কিছু জানি না বাবুজী। বাবার কাছে শুনেছি, যে ঘরে আপনি শুয়েছিলেন সেখানে চোরাকুঠুরি ছিল। মেঝেটা ফাঁক হয়ে নেমে যাবার রাস্তাও ছিল। রাজাবাহাদুর মরে যাবার পর তার ছেলে বিলাত থেকে ফিরে এসে মেঝে গেঁথে চোরা-কুঠুরি বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

রাজাবাহাদুরের ছেলে কোথায় থাকেন?

কলকাতায়! মাঝে মাঝে দশ-বার দিনের জন্য এখানে আসেন।

আচ্ছা আর একটা কথা!

বলুন বাবুজী।

রাজাবাহাদুর কিভাবে মারা গেছেন?

দরোয়ান তখনই কোন উত্তর দিল না। একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে রইল। কি, বল? বল? আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম।

দরোয়ান প্রায় কেঁদে ফেলল। আমি কিছু জানি না বাবুজী। আমার বাবার কাছে শুনেছি, তিনি এক প্রজার হাতে খুন হয়েছিলেন। যে প্রজার নাম ঠাকুরপ্রসাদ।

দরোয়ান উত্তর দেবার আগেই কর্মকর্তার গলা কানে এল।

চলুন মুখ হাত ধুয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি। সকালে কলকাতা ফেরার একটা ট্রেন আছে।

তারপর অনেক বছর কেটে গেছে, কিন্তু সে রাত্রের সে দৃশ্যের কথা আমি ভুলতে পারিনি। এখনও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে চমকে জেগে উঠি। রাজবাহাদুরের চীৎকার কানে আসে। রামলোচন, পিয়ারীলাল? সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরপ্রসাদের উৎকট হাসি, কেউ নেই, কেউ আসবে না।

ঠাকুরপ্রসাদের পায়ের কাছে মরা ছেলে, হাতে উদ্যত ভোজালি। সে রাতে নিছক স্বপ্ন দেখেছি একথা মন মানতে চায় না। অতীতের একটা ঘটনা চোখের সামনে ঘটেছিল, এ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কি করে এটা সম্ভব হল?

এর উত্তর আমার জানা নেই।

No comments:

Post a Comment