লেখক: শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথমাংশের লিঙ্ক
ক্ৰমে চারিটা বাজিল। পুঁটিরামকে চা তৈয়ার করিবার হুকুম দিয়া, এবার কি করিব ভাবিতেছি, এমন সময় দ্বারে মৃদু টোকা পড়িল। উঠিয়া দ্বার খুলিয়া দেখিলাম, আমাদের পূর্বদিনের দগ্ধানন ব্যোমকেশবাবু। তাঁহার হাতে একটি সংবাদপত্র।
তিনি বলিলেন, ব্যোমকেশবাবু বেরিয়েছেন নাকি?
-- হাঁ। আসুন।
তাঁহার বিশেষ কোনও প্রয়োজন ছিল না, পূর্বদিনের আমন্ত্রণ স্মরণ করিয়া গল্পগুজব করিতে আসিয়াছিলেন। আমিও একলা বৈকালটা কি করিয়া কাটাইব ভাবিয়া পাইতেছিলাম না, বোসজা মহাশয়কে পাইয়া আনন্দিত হইলাম।
বোসজা আসন পরিগ্ৰহ করিয়া বলিলেন, আজ কাগজে একটা মজার বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে, সেইটে আপনাদের দেখাতে এনেছিলুম। হয়তো আপনাদের চোখে পড়েনি—কাগজটা খুলিয়া আমার দিকে বাড়াইয়া দিয়া বলিলেন, দেখেছেন কি?
সেই বিজ্ঞাপন। বড় দ্বিধায় পড়িলাম। মিথ্যা কথা বিশ্বাসযোগ্য করিয়া বলিতে পারি না, বলিতে গেলেই ধরা পড়িয়া যাই। অথচ ব্যোমকেশ চাণক্য-বাক্য উদ্ধৃত করিয়া মুখ বন্ধ রাখিতে উপদেশ দিয়া গিয়াছে। এইরূপ সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পড়িয়া কি বলিব ভাবিতেছি, এমন সময় বোসজা মৃদুকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন, পড়েছেন, অথচ ব্যোমকেশবাবু কোনও কথা প্রকাশ করতে মানা করে গেছেন—না?
আমি চুপ করিয়া রহিলাম।
তিনি বলিলেন, সম্প্রতি দেশলায়ের কাঠি নিয়ে একটা মহা গণ্ডগোল বেধে গেছে। এই সেদিন দেবকুমারবাবুর মোকদ্দমা শেষ হল, তাতেও দেশলাই; আবার দেখছি দেশলাইয়ের বাক্সের বিজ্ঞাপন—মূল্য এক লক্ষ টাকা। সাধারণ লোকের মধ্যে স্বভাবতই সন্দেহ হয়, দুটো মধ্যে কোনও যোগ আছে। বলিয়া সপ্রশ্ন চক্ষে আমার পানে চাহিলেন।
আমি এবারও নীরব হইয়া রহিলাম! কথা কহিতে সাহস হইল না, কি জানি আবার হয়তো বেফাঁস কিছু বলিয়া ফেলিব।
তিনি বলিলেন, যাক ও কথা, আপনি হয়তো মনে করবেন। আমি আপনাদের গোপনীয় কথা বার করবার চেষ্টা করছি। বলিয়া অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপন করিলেন। আমি হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম।
পুঁটিরাম চা দিয়া গেল। চায়ের সঙ্গে ক্রিকেট, রাজনীতি, সাহিত্য, নানাবিধ আলোচনা হইল। দেখিলাম লোকটি বেশ মিশুক ও সদালাপী—অনেক বিষয়ে খবর রাখেন।
এক সময় জিজ্ঞাসা করিলাম, আচ্ছা, আপনার কি করা হয়? কিছু মনে করবেন না, আমাদের দেশে প্রশ্নটা অশিষ্ট নয়।
তিনি একটু চুপ করিয়া বলিলেন, সরকারী চাকরি করি।
-- সরকারী চাকরি?
-- হাঁ। তবে সাধারণ চাকরের মত দশটা চারটে অফিস করতে হয় না। চাকরিটা একটু বিচিত্র রকমের ৷
-- ও—কি করতে হয়? প্রশ্নটা ভদ্ররীতিসম্মত নয় বুঝিতেছিলাম, তবে কৌতুহল দমন করিতে পারিলাম না।
তিনি ধীরে ধীরে বলিলেন, রাজ্য শাসন করবার জন্যে গভর্নমেন্টকে প্রকাশ্যে ছাড়াও অনেক কাজ করতে হয়, অনেক খবর রাখতে হয়; নিজের চাকরদের ওপর নজর রাখতে হয়। আমার কাজ অনেকটা ঐ ধরনের।
বিস্মিতকণ্ঠে বলিলাম, সি আই ডি পুলিস?
তিনি মৃদু হাসিলেন, পুলিসের ওপরও পুলিস থাকতে পারে তো। আপনাদের এই বাসাটি দিব্যি নিরিবিলি, মেসের মধ্যে থেকেও মেসের ঝামেলা ভোগ করতে হয় না। কতদিন এখানে আছেন?
কথা পাল্টাইয়া লইলেন দেখিয়া আমিও আর কিছু জিজ্ঞাসা করিতে পারিলাম না; বলিলাম, আমি আছি বছর আষ্টেক, ব্যোমকেশ তার আগে থেকে আছে ৷
তারপর আরো কিছুক্ষণ সাধারণভাবে কথাবার্তা হইল। তাঁহার মুখের এরূপ অবস্থা কি করিয়া হইল জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন, কয়েক বছর আগে ল্যাবরেটরিতে কাজ করিতে করিতে হঠাৎ অ্যাসিডের শিশি ভাঙিয়া মুখে পড়িয়া যায়। সেই অবধি মুখের অবস্থা এইরূপ হইয়া গিয়াছে।
অতঃপর তিনি উঠিলেন। দ্বারের দিকে যাইতে যাইতে হঠাৎ ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, দারোগা বীরেনবাবুর সঙ্গে আপনাদের জানাশোনা আছে। কেমন লোক বলতে পারেন?
-- কেমন লোক? তাঁর সঙ্গে আমাদের কাজের সূত্রে আলাপ। তাঁর চরিত্র সম্বন্ধে তো কিছু জানি না।
-- তাঁকে খুব লোভী বলে মনে হয় কি?
-- মাফ করবেন ব্যোমকেশবাবু, তাঁর সম্বন্ধে আমি কিছুই বলতে পারি না।
-- ও-আচ্ছা। আজ চললুম।
তিনি প্ৰস্থান করিলেন। কিন্তু তাঁহার কথাগুলো আমার মনে কাঁটার মত বিধিয়া রহিল। বীরেনবাবুর চরিত্র সম্বন্ধে ইনি অনুসন্ধিৎসু কেন? বীরেনবাবু কি লোভী? পুলিসের কর্মচারী সাধারণত অর্থগৃধ্নু হয় শুনিয়াছি। তবে বীরেনবাবু সম্বন্ধে কখনও কোনো কানাঘুষাও শুনি নাই। তবে এ প্রশ্নের তাৎপর্য কি? এবং গভর্নমেন্টের এই গোপন ভৃত্যটি কোন মতলবে আমাকে এই প্রশ্ন করিলেন?
পরদিন সকালে শয্যাত্যাগ করিয়াই খবরের কাগজ খুলিলাম। যাহা প্রত্যাশা করিয়াছিলাম তাহা বাহির হইয়াছে। বিজ্ঞাপন পৃষ্ঠার শুরুতেই রহিয়াছে—
গতকল্য বৈকালে সাড়ে পাঁচটার সময় শ্রীরামপুর স্টেশনের ওয়েটিং রুমে এক অজ্ঞাত ভদ্রলোক যুবকের লাস পাওয়া গিয়াছে। মৃতদেহে কোথাও ক্ষতচিহ্ন নাই। মৃত্যুর কারণ এখনও অজ্ঞাত। মৃতের বয়স আন্দাজ ত্রিশ বৎসর, সুশ্ৰী চেহারা, গোঁফ দাড়ি কামানো। পরিধানে বাদামী রংয়ের গরম পাঞ্জাবি ও সাদা শাল ছিল। যুবক কলিকাতা হইতে ৪-৫৩ মিঃ লোকাল ট্রেনে শ্রীরামপুরে আসিয়াছিল; পকেটে টিকিট পাওয়া গিয়াছে। যদি কেহ লাস সনাক্ত করিতে পারেন, শ্রীরামপুর হাসপাতালে অনুসন্ধান করুন।
তাড়াতাড়ি মুখ-হাত ধুইয়া কিছু জলযোগ করিয়া শ্রীরামপুরের উদ্দেশ্যে বাহির হইলাম। দ্বিতলে নামিয়া একতলার সিঁড়িতে পদার্পণ করিতে যাইব, পিছু ডাক পড়িল, অজিতবাবু, সক্কাল না হতে কোথায় চলেছেন?
দেখিলাম, ব্যোমকেশবাবু নিজের ঘরের দরজায় দাঁড়াইয়া আছেন। আজ আর মিথ্যা কথা বলিতে বাধিল না, বেশ সড়ৎ করিয়া বাহির হইয়া আসিল—যাচ্ছি ডায়মন্ড হারবারে-এক বন্ধুর বাড়ি। ব্যোমকেশ কবে ফিরবে কিছু তো ঠিক নেই, দুদিন ঘুরে আসি ৷
-- তা বেশ। আজকের খবরের কাগজ পড়েছেন?
কালকেতুখানা বগলে করিয়া লইয়াছিলাম, বলিলাম, না, গাড়িতে পড়তে পড়তে যাব। বলিয়া নামিয়া গেলাম।
রাস্তায় নামিয়া শিয়ালদহের দিকে কিছুদূর হাঁটিয়া গেলাম, তারপর সেখান হইতে ট্রাম ধরিয়া হাওড়া অভিমুখে রওনা হইলাম। নূতন মিথ্যা কথা বলিতে আরম্ভ করিলে একটু অসুবিধা এই হয় যে ধরা পড়িবার লজ্জাটা সর্বদা মনে জাগরুক থাকে। ক্রমশ পরিপক্ক হইয়া উঠিলে বোধকরি ও দুর্বলতা কাটিয়া যায়।
যা হোক, হাওড়ায় ট্রেনে চাপিয়া বেলা সাড়ে নটা আন্দাজ শ্রীরামপুর পৌছিলাম। হাসপাতালের সম্মুখে একটি ভদ্রলোক দাঁড়াইয়া ছিলেন, তাঁহাকে লাসের কথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া অদূরে একটি ছোট কুঠরী নির্দেশ করিয়া দিলেন। কুঠরীটি মূল হাসপাতাল হইতে পৃথক, সম্মুখে একজন পুলিস প্রহরী দাঁড়াইয়া আছে।
কাচ ও তার নির্মিত ক্ষুদ্র ঘরটির সম্মুখে গিয়া আমার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম; ভিতরে প্রবেশ করিতে বিশেষ বেগ পাইতে হইল না। দেখিলাম, ঘরের মাঝখানে শানের মত লম্বা বেদীর উপরে ব্যোমকেশ শুইয়া আছে—তাহার পা হইতে গলা পর্যন্ত একটা কাপড় দিয়া ঢাকা। মুখখানা মৃত্যুর কাঠিন্যে স্থির।
আমি তাহার পাশে দাঁড়াইয়া মৃদুস্বরে বলিলাম, আবুহোসেন জাগো।
ব্যোমকেশ চক্ষু খুলিল। কতক্ষণ। এইভাবে অবস্থান করছ?
-- প্রায় দুঘণ্টা। একটা সিগারেট পেলে বড় ভাল হত।
-- অসম্ভব। মৃত ব্যক্তি পিণ্ডি খেতে পারে শুনেছি, কিন্তু সিগারেট খাওয়া একেবারে নিষিদ্ধ।
-- ঠিক জানো? মনুসংহিতায় কোনও বিধান নেই?
-- না। তারপর, কজন লোক দেখতে এল?
মাত্র তিনজন। স্থানীয় লোক, নিতান্তই লোফার ক্লাশের ৷
-- তবে?
-- এখনও হতাশ হবার কোনও কারণ নেই। আজ সারাদিন আছে।—কালকেও অন্তত সকালবেলাটা পাওয়া যাবে ৷
-- দুদিন ধরে এইখানে পড়ে থাকবে? মনে কর যদি বিজ্ঞাপনটা তাঁর চোখে না পড়ে?
-- চোখে পড়তে বাধ্য। তিনি এখন অনবরত বিজ্ঞাপন অন্বেষণ করছেন।
-- তা বটে! যা হোক, এখন আমি কি করব বল দেখি।
-- তুমি এই ঘরের কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে বসে থাকে, যারা আসছে তাদের ওপরে লক্ষ্য রাখো। অবশ্য পুলিস নজর রেখেছে; যিনি এই হতভাগ্যকে পরিদর্শন করতে আসছেন তাঁরই পিছনে গুপ্তচর লাগছে। কিন্তু অধিকন্তু ন দোষায়। তুমি যদি কোনো চেনা লোক দেখতে পাও, তখনি এসে আমাকে খবর দেবে। আমার মুশকিল হয়েছে চোখ খুলতে পারছি না, কাজেই যাঁরা এখানে পায়ের ধুলো দিচ্ছেন তাঁদের শ্ৰীমুখ দর্শন করা হচ্ছে না। মড়া যদি মিটমিট করে তাকাতে আরম্ভ করে তাহলে বিষম হৈ চৈ পড়ে যাবে কিনা ৷
-- বেশ। আমি কাছাকাছি রইলুম। পুলিস আবার হাঙ্গামা করবে না তো?
দ্বারের প্রহরীকে চুপি চুপি নিজের পরিচয় দিয়ে যেও, তাহলে আর হাঙ্গামা হবে না। তিনি একটি বর্ণচোরা আম; দেখতে পুলিস কনস্টেবল বটে। কিন্তু আসলে একজন সি আই ডি দারোগা।
বাহিরে আসিয়া ছদ্মবেশী প্রহরীকে আত্মপরিচয় দিলাম; তিনি অদূরে একটা মেতির ঝাড় দেখাইয়া দিলেন। মেতির ঝাড়টি এমন জায়গায় অবস্থিত যে তাহার আড়ালে লুকাইয়া বসিলে ব্যোমকেশের কুঠরীর দ্বার পরিষ্কার দেখা যায়, অথচ বাহির হইতে ঝোপের ভিতরে কিছু আছে কিনা বোঝা যায় না।
ঝোপের মধ্যে গিয়া বসিলাম। চারিদিক ঘেরা থাকিলেও মাথার উপর খোলা; দিব্য আরামে রোদ পোহাইতে পোহাইতে সিগারেট ধরাইলাম।
ক্ৰমে বেলা যত বাড়িতে লাগিল, দৰ্শন-অভিলাষী লোকের সংখ্যাও একটি দুইটি করিয়া বাড়িয়া চলিল। উৎসুকভাবে তাঁহাদের পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিলাম। সকলেই অপরিচিত, চেহারা দেখিয়া বোধ হইল, অধিকাংশই বেকার লোক একটা নূতন ধরনের মজা পাইয়াছে।
ক্রমে এগারোটা বাজিল, মাথার উপর সূর্যদেব প্রখর হইয়া উঠিতে লাগিলেন। র্যাপারটা মাথায় চাপা দিয়া বসিয়া রহিলাম। একটা নৈরাশ্যের ভাব ধীরে ধীরে মনের মধ্যে প্রবল হইয়া উঠিতে লাগিল। যে-ব্যক্তি দেশলাই চুরি করিয়াছে, সে শ্রীরামপুরে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তির লাস দেখিতে আসিবে কেন? আর, যদি বা আসে, এতগুলো লোকের মধ্যে তাহাকে দেশলাই-চোর বলিয়া চিনিয়া লওয়া যাইবে কিরূপে? সত্য, সকলের পিছনেই পুলিস লাগিবে, কিন্তু তাঁহাতেই বা কি সুবিধা হইতে পারে? মনে হইল, ব্যোমকেশ বৃথা পণ্ডশ্ৰম করিয়া মরিতেছে।
ব্যোমকেশের ঘরের দিকে চাহিয়া এই সব কথা ভাবিতেছিলাম, হঠাৎ চমক ভাঙিয়া গেল। একটি লোক দ্রুতপদে আসিয়া কুঠরীতে প্রবেশ করিল; বোধহয় পাঁচ সেকেন্ড। পরেই আবার বাহির হইয়া আসিল-প্রহরীর প্রশ্নে একবার মাথা নাড়িয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেল।
লোকটি আমাদের মেসের নূতন ব্যোমকেশবাবু। তাঁহাকে দেখিয়া এতই স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিলাম যে তিনি চলিয়া যাইবার পরও কিয়ৎকাল বিস্ময়বিমূঢ়ভাবে বসিয়া রহিলাম তারপর ধড়মড় করিয়া উঠিয়া সেই ঘরের অভিমুখে ছুটিলাম।
ব্যোমকেশ বোধকরি আমার পদশব্দ শুনিয়া আবার মড়ার মত পড়িয়া ছিল, আমি তাহার কাছে গিয়া উত্তেজিত স্বরে বলিলাম, ওহে, কে এসেছিলেন জানো? তোমার মিতে-মেসের সেই নূতন ব্যোমকেশবাবু।
ব্যোমকেশ সটান উঠিয়া বসিয়া আমার পানে বিস্ফারিত নেত্ৰে তাকাইল। তারপর বেদী হইতে লাফাইয়া নীচে নামিয়া বলিল, ঠিক দেখেছ? কোনও ভুল নেই?
-- কোনও ভুল নেই ৷
-- যাঃ, এতক্ষণে হয়তো পালাল ৷
ব্যোমকেশের গায়ে জামা কাপড় ছিল বটে। কিন্তু জুতা পায়ে ছিল না, সেই অবস্থাতেই সে বাহিরের দিকে ছুটিল। হাসপাতালের সম্মুখে যে ভদ্রলোকটিকে আমি দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়াছিলাম, তিনিও তখনও সেখানে ছিলেন; ব্যোমকেশ তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, কোথায় গেল? এখনি যে-লোকটা এসেছিল?
ভদ্রলোক অত্যন্ত বিচলিত হইয়া বলিলেন, সেই নাকি?
-- হ্যাঁ-তাকেই গ্রেপ্তার করতে হবে।
ভদ্রলোক মাথায় হাত দিয়া বলিলেন, সে পালিয়েছে।
-- পালিয়েছে?
সে কলকাতা থেকে ট্যাক্সিতে এসেছিল, আবার ট্যাক্সিতে চড়ে পালিয়েছে। আমাদের মোটর-বাইকের বন্দোবস্ত করা হয়নি, তাই—
দাঁতে দাঁত ঘষিয়া ব্যোমকেশ বলিল, এর জবাবদিহি। আপনি করবেন। —এস অজিত, যদি একটা ট্যাক্সি পাওয়া যায়-হয়তো এখনও—
কিন্তু ট্যাক্সি পাওয়া গেল না। অগত্যা বাসে চড়িয়াই কলিকাতা যাত্ৰা করিলাম।
পথে জিজ্ঞাসা করিলাম, উনিই তাহলে?
ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িল, হুঁ।
-- কিন্তু বুঝলে কি করে?
-- সে অনেক কথা-পরে বলব!
-- আচ্ছা, উনি অত তাড়াতাড়ি পালালেন কেন? তুমি যদি মরে গিয়েই থাকো—
উনি শিকারী বেরাল, ঘরের মধ্যে পা দিয়েই বুঝেছিলেন যে ফাঁদে পা দিয়েছেন। তাই চটপট সরে পড়লেন।”
সাড়ে বারোটার সময় মেসে পৌঁছিয়া দ্বিতলে উঠিয়া দেখিলাম সিঁড়ির মুখে মেসের ম্যানেজার দাঁড়াইয়া আছেন। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ব্যোমকেশবাবু এসেছিলেন?
ম্যানেজার সবিস্ময়ে নগ্নপদে ব্যোমকেশকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন, দু নম্বর ব্যোমকেশবাবু? তিনি তো এই খানিকক্ষণ হল চলে গেলেন। বাড়ি থেকে জরুরী খবর পেয়েছেন, তাই তাড়াতাড়ি চলে যেতে হল। তিনিও আপনার খোঁজ করছিলেন। আপনাকে নমস্কার জানিয়ে গেছেন। বলে গেছেন, আপনি যেন দুঃখ না করেন, শীগগির আবার দেখা হবে ৷
শিষ্টতার এই প্ৰবল ধাক্কা সামলাইয়া লইয়া ব্যোমকেশ বলিল, তাঁর ঘর কোনটা?
-- ঐ যে পাঁচ নম্বর ঘর।
পাঁচ নম্বর ঘরের দ্বারে তালা লাগানো ছিল, ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, এর চাবি কোথায়?
ম্যানেজার বলিলেন, আমার কাছে একটা চাবি আছে, কিন্তু—
-- খুলুন।
চাবির থোলো পকেট হইতে বাহির করিতে করিতে ম্যানেজার উৎকণ্ঠিত স্বরে বলিলেন, কি-কি হয়েছে ব্যোমকেশবাবু?
-- বিশেষ কিছু নয়; যে ভদ্রলোকটি এই ঘরে ছিলেন তিনি একজন দাগী আসামী।
ম্যানেজার তাড়াতাড়ি দ্বার খুলিয়া দিলেন। ঘরে প্রবেশ করিয়া ব্যোমকেশ একবার চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, তিনি তো কিছুই নিয়ে যাননি দেখছি। বাক্স বিছানা সবই রয়েছে ৷
ম্যানেজার বলিলেন, তিনি কেবল ছোট হ্যান্ডব্যাগ আর জলের কুঁজো নিয়ে গেছেন— আর সবই রেখে গেছেন। বললেন, দুচার দিনের মধ্যে ফিরবেন, আমিও ভাবলুম—
ব্যোমকেশ বলিল, ঠিক কথা। আপনি এবার থানার দারোগা বীরেনবাবুর কাছে খবর পাঠান—তাঁকে জানান যে চোরের সন্ধান পাওয়া গেছে, তিনি যেন শীগগির আসেন। —আমরা ততক্ষণে এই ঘরটা একবার দেখে নিই।
ম্যানেজার প্রস্থান করিলে ব্যোমকেশ ঘরের আসবাবপত্রের মধ্যে অনুসন্ধান আরম্ভ করিল। এই মেসের প্রায় সব ঘরগুলিই বড় বড়, প্রত্যেকটিতে দুই বা তিনজন করিয়া ভদ্রলোক থাকিতেন। কেবল এই পাঁচ নম্বর ঘরটি ছিল ছোট, একজনের বেশি থাকা চলিত না। ভাড়াও কিছু বেশি পড়িত, তাই ঘরটা অধিকাংশ সময় খালি পড়িয়া থাকিত। যিনি মেসে থাকিয়াও স্বাতন্ত্র্য ও নিভৃততা রক্ষা করিতে ইচ্ছুক তাঁহার পক্ষে ঘরটি চমৎকার।
ঘরে গোটা দুই ট্রাঙ্ক ও বিছানা ছাড়া আর বিশেষ কিছু ছিল না। ব্যোমকেশ বিছানাটা পর্যবেক্ষণ করিয়া বলিল, শীতের সময়, অথচ লেপ তোষক বালিশ কিছুই নিয়ে যাননি। অর্থাৎ-বুঝেছ?
-- না। কি?
-- অন্যত্র আর একসেট বন্দোবস্ত আছে ৷
ব্যোমকেশ বিছানা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিল, কিন্তু কিছু পাওয়া গেল না। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, তুমি কি আশা করছি দেশলায়ের বাক্সটা তিনি এই ঘরে রেখে গেছেন?
-- না।—তাহলে তিনি ফিরে এলেন কেন? আমি খুঁজছি তাঁর বর্তমান ঠিকানা; যদি কোথাও কিছু পাই যা-থেকে তাঁর প্রকৃত নামধামের কিছু ইশারা পাওয়া যায়। তাঁর সত্যিকারের নাম যে ব্যোমকেশ বসু নয় এটা বোধ হয় তুমিও এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে।
-- মানে—কি বলে—হাঁ, পেরেছি বৈকি। কিন্তু ব্যোমকেশ ছদ্মনাম গ্রহণ করবার উদ্দেশ্য কি?
বিছানার উপর বসিয়া ব্যোমকেশ ঘরের এদিক-ওদিক চাহিতে চাহিতে বলিল, উদ্দেশ্য প্রতিহিংসা সাধন। অজিত, প্রতিহিংসার মনস্তত্ত্বটা বড় আশ্চর্য। তুমি গল্প-লেখক, সুতরাং মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে সবই জানো। তোমাকে বলাই বাহুল্য যে নেপথ্য থেকে প্ৰতিহিংসা সাধন করে মানুষ সুখ পায় না; প্রত্যেকটি আঘাতের সঙ্গে সে জানিয়ে দিতে চায় যে সে প্রতিহিংসা নিচ্ছে। শত্ৰু যদি জানতে না পারে কোথা থেকে আঘাত আসছে, তাহলে প্রতিহিংসার অর্ধেক আনন্দই ব্যর্থ হয়ে যায়। ইনি তাই একেবারে আমার বুকের ওপর এসে চেপে বসেছিলেন। এটা যদি সুসভ্য বিংশ শতাব্দী না হয়ে প্রস্তর-যুগ হত, তাহলে এত ছল চতুরীর দরকার হত না, উনি একেবারে পাথরের মুগুর নিয়ে আমার মাথায় বসিয়ে দিতেন। কিন্তু এখন সেটা চলে না, ফাঁসি যাবার ভয় রয়েছে। মোট কথা, প্ৰতিহিংসার পদ্ধতিটা বদলেছে বটে। কিন্তু মনস্তত্ত্বটা বদলায়নি। আজ যে উনি আমার মৃত মুখখানা দেখবার জন্যে শ্রীরামপুরে ছুটেছিলেন, সেও ওই একই মনোভাবের দ্বারা পরিচালিত হয়ে ৷ ব্যোমকেশ খামখেয়ালী গোছের হাসিল—চিঠিখানার কথা মনে আছে তো, সেটা আমারই উদ্দেশ্যে লেখা এবং উনি নিজেই লিখেছিলেন। তার বাহ্য কৃতজ্ঞতার আড়ালে লুকিয়ে ছিল অতি ক্রুর ইঙ্গিত। তিনি যতদূর সম্ভব পরিষ্কার ভাবেই লিখে জানিয়েছিলেন যে তিনি ভোলেননি—ঋণ পরিশোধ করবার জন্য ব্যগ্র হয়ে আছেন। আমরা অবশ্য তখন চিঠির মানে ভুল বুঝেছিলাম, তবু-আমার মনে একটা খটকা লেগেছিল। তোমার বোধহয় মনে আছে।
সেই চিঠিতে লিখিত কথাগুলো যেন এখন নূতন চক্ষে দেখিতে পাইলাম। বলিলাম, মনে আছে। কিন্তু তখন কে জানত—; আচ্ছা, লোকটা তোমার কোনও পুরনো শত্ৰু-না?
-- তাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই।
-- লোকটা কে তা কিছু বুঝতে পারছি না?
-- বোধহয় একটু একটু পারছি। কিন্তু এখন ও কথা যাক, আগে তাঁর বাক্সগুলো দেখি।
একটা বাক্সের চাবি খোলাই ছিল, তাহাতে দৈনিক ব্যবহার্য কাপড়-চোপড় ছাড়া আর কিছু ছিল না। অন্যটার তালা লইয়া ব্যোমকেশ দুএকবার নাড়াচাড়া করিয়া একটু চাপ দিতেই সেটাও খুলিয়া গেল। ভিতরে কয়েকটা গরম কোট পাঞ্জাবি ইত্যাদি রহিয়াছে। সেগুলা বাহির করিয়া তলায় অনুসন্ধান করিতে এক শিশি স্পিরিট-গাম ও কিছু বিনুনি করা ক্রেপ চুল বাহির হইয়া পড়িল। সেগুলি তুলিয়া ধরিয়া ব্যোমকেশ বলিল, হুঁ, মুখে যার অ্যাসিড ছাপ মেরে দিয়েছে তাকে মাঝে মাঝে গোঁফ দাড়ি পরে ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয় বৈকি। এই সব পরে সম্ভবত ইনি ট্রামে আমার দেশলাই বদলে নিয়েছিলেন।
ক্ৰেপ ইত্যাদি সরাইয়া রাখিয়া ব্যোমকেশ আবার কয়েকটা জিনিস দুই হাতে বাক্সের ভিতর হইতে বাহির করিল, বলিল, কিন্তু এগুলো কি?
মোমজামার মত খানিকটা কাপড়ে কি কতকগুলা জড়ানো রহিয়াছে। ব্যোমকেশ সাবধানে সেগুলা মেঝের উপর রাখিয়া মোড়ক খুলিল। একটি আধা আউন্সের খালি শিশি, কয়েকখণ্ড সীলমোহর করিবার লাল রংয়ের গালা ও অর্ধ-দগ্ধ একটি মোমবাতি রহিয়াছে।
ব্যোমকেশ শিশির ছিপি খুলিয়া আঘ্রাণ গ্ৰহণ করিল, মোমবাতি ও গালা খুব মনোযোগের সহিত দেখিল, শেষে, মোমজামাটা তুলিয়া লইয়া পরীক্ষা করিল। দেখিলাম সাধারণ মোমজামা নয়, খুব ভাল জাতীয় ওয়াটারপ্রুফ কাপড়—ঈষৎ নীলাভ এবং স্বচ্ছ-আয়তনে একটা রুমালের মত। বর্তমানে তাহার একটা কোণের প্রায় সিকি ভাগ কাপড় নাই-মনে হয় কোনও কারণে ছিঁড়িয়া লওয়া হইয়াছে।
ব্যোমকেশ ধীরে ধীরে বলিল, শিশি, গালা, মোমবাতি এবং ওয়াটারপ্রুফের একত্র সমাবেশ। মানে বুঝতে পারলে?
-- না-কি মানে?
-- ওয়াটারপ্রুফ থেকেও কিছু আন্দাজ করতে পারলে না?
-- হতাশভাবে বলিলাম, কিছু না। তুমি কি বুঝলে?
-- সবই বুঝেছি, শুধু ভদ্রলোকের বর্তমান ঠিকানা ছাড়া। —চল, এখানকার কাজ আমাদের শেষ হয়েছে ৷
এই সময় ম্যানেজারবাবু ফিরিয়া আসিলেন, বলিলেন, দারোগাবাবুকে খবর দিয়েছি, তিনি এলেন বলে।
-- বেশ। —আচ্ছা ম্যানেজারবাবু, আমার এই মিতেটি যখন চলে গেলেন তখন আপনি নিশ্চয় তাঁর সঙ্গে সদর পর্যন্ত গিয়েছিলেন।
-- আজ্ঞে হ্যাঁ, গিয়েছিলুম।
-- ট্যাক্সির নম্বরটা আপনার চোখে পড়েনি?
মাথা নাড়িয়া ম্যানেজার বলিলেন, আজ্ঞে না। নীল রঙের পুরনো ট্যাক্সি—ড্রাইভার একজন শিখ—এইটুকুই লক্ষ্য করেছিলুম।
একটু চুপ করিয়া থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল, সে সময় দোরের কাছে আর কেউ ছিল?
ম্যানেজার ভাবিয়া বলিলেন, ভদ্রলোক কেউ ছিলেন বলে তো মনে পড়ছে না, তবে আপনাদের চাকর পুঁটিরাম দাওয়ায় বসেছিল। আপনারা বাসায় ছিলেন না, তাই সে বোধ হয় একটু—
নিশ্বাস ফেলিয়া ব্যোমকেশ বলিল, পুঁটিরাম থাকা না-থাকা সমান। সে তো আর ইংরিজি জানে না, কাজেই ট্যাক্সির নম্বর চোখে দেখলেও পড়তে পারবে না। —চল অজিত, দেড়টা বাজল, পেটও বাপান্ত করছে। ম্যানেজারবাবু, এবেলা দুটি ভাত আমাদের দিতে হবে। অবশ্য যদি অসুবিধা না হয়।
ম্যানেজার সানন্দে বলিলেন, বিলক্ষণ! অসুবিধে কিসের! ব্যোমকেশবাবুর—মানে, দুনম্বর ব্যোমকেশবাবুর-ভাত হাঁড়িতেই আছে, তিনি তো খাননি। আপনারা স্নান করুনগে, আমি ভাত পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, মন্দ ব্যবস্থা নয়। দুনম্বর ব্যোমকেশবাবুর বাড়া ভাত এক নম্বর ব্যোমকেশবাবু খাবেন। দুনিয়াতে এই ব্যাপার তো হরদম চলছে—কি বল অজিত? এখন দুনম্বর ব্যোমকেশবাবু কোথায় বসে কার ভাত খাচ্ছেন সেইটে জানতে পারলে বড় খুশি হতুম।
আহার তখনো শেষ হয় নাই, বীরেনবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কোনও রকমে অন্ন গলাধঃকরণ করিয়া বাহিরের ঘরে প্রবেশ করিতেই বীরেনবাবু উঠিয়া প্রশ্ন-ব্যাকুল নেত্ৰে ব্যোমকেশের পানে তাকাইলেন। তাঁহার সমস্ত দেহ একটা জীবন্ত জিজ্ঞাসার চিহ্নের আকার ধারণ করিল।
ব্যোমকেশ বলিল, আপনার এখনো খাওয়া হয়নি দেখছি।
-- না। খাবার জন্যে বাড়ি যাচ্ছিলুম। এমন সময় আপনার ডাক পেলুম। —কি হল ব্যোমকেশবাবু? ধরেছেন তাকে?
-- বলছি। কিন্তু তার আগে আপনাকে কিছু খাবার আনিয়ে দিই।
-- খাবার দরকার নেই। তবে যদি এক পেয়াল চা—?
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, বেশ। এবং সেই সঙ্গে দুটো নিষিদ্ধ ডিম। —পুঁটিরাম।
পুঁটিরাম হুকুম লইয়া প্রস্থান করিলে পর, ব্যোমকেশ বীরেনবাবুকে সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করিয়া বলিল। তাঁহাকে না বলিয়া এত কাজ করা হইয়াছে, ইহাতে বীরেনবাবু একটু আহত হইলেন। ব্যোমকেশ তাঁহাকে যথা সম্ভব মিষ্ট করিয়া সান্ত্বনা দিল, তথাপি তিনি ক্ষুব্ধ স্বরে বলিলেন, আমি যদি জানতুম তাহলে সে এমন হাত-ফসকে পালাতে পারত না। এখন তাকে ধরা কঠিন হবে।
-- এতক্ষণে সে হয়তো কলকাতা থেকে বহু দূরে চলে গেছে।
ব্যোমকেশ মেঝের দিকে তাকাইয়া থাকিয়া বলিল, আমার কিন্তু মনে হয় সে কলকাতাতেই আছে। কারণ সে মার্কা-মারা লোক, ওরকম মুখ নিয়ে মানুষ বেশি দূর পালাতে পারে না। কলকাতা শহরই তার পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ ৷
বীরেনবাবু বলিলেন, তাহলে এখন কর্তব্য কি? তার চেহারার বর্ণনা দিয়ে ইস্তাহার জারি করা ছাড়া আর তো কোনো পথ দেখছি না।
ব্যোমকেশ ভাবিতে ভাবিতে বলিল, ওটা তো হাতেই আছে। কিন্তু তার আগে-যদি ট্যাক্সির নম্বরটা পাওয়া যেত—
ইতিমধ্যে পুঁটিরাম চা ইত্যাদি আনিয়া বীরেনবাবুর সম্মুখে রাখিতেছিল, ব্যোমকেশ তাহার দিকে ফিরিয়া বলিল, পুঁটিরাম, তোমার ইংরেজী শেখা দরকার, আজই একখানা প্যারী সরকারের ফাস্টবুক কিনে আনবে। অজিত আজ থেকে তোমাকে ইংরেজি শেখাবে।
অবান্তর কথায় বীরেনবাবু বিস্মিতভাবে ব্যোমকেশের দিকে চাহিলেন, ব্যোমকেশ বলিল, ও যদি ইংরিজি জানত তাহলে আজ কোনও হাঙ্গামাই হত না। পুঁটিরামের দ্বারের কাছে অবস্থিতি ও ট্যাক্সি দর্শনের কথা বলিয়া ব্যোমকেশ বিমৰ্ষভাবে মাথা নাড়িল।
পুঁটিরাম মুখের সম্মুখে মুষ্টি তুলিয়া সসম্ভ্রমে একটু কাশিল—
-- আজ্ঞে—
-- কি?
-- আজ্ঞে, টেক্সির নম্বর আমি দেখেছি।
-- তা দেখেছ-কিন্তু পড়তে তো পারেনি।
-- আজ্ঞে, পড়তে পেরেছি। চারের পিঠে দুটো শূন্য, তারপর আবার একটা চার।
আমরা তিনজনে অবাক হইয়া তাহার মুখের পানে তাকাইয়া রহিলাম। শেষে ব্যোমকেশ বলিল, তুই ইংরিজি পড়তে জনিস?
-- আজ্ঞে না।
-- তবে?
-- বাংলাতে লেখা ছিল বাবু, সেই জন্যেই তো চোখে পড়ল ৷
আমরা চক্ষু গোলাকৃতি করিয়া রহিলাম। তারপর ব্যোমকেশ হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল—বুঝেছি। পুঁটিরামের পিঠ চাপড়াইয়া দিয়া বলিল, বহুত আচ্ছা! পুঁটিরাম, আজ থেকে - তোমার মাইনে এক টাকা বাড়িয়ে দিলুম।
পুটিরাম সহৰ্ষে এবং সলজ্জে বলিল, আজ্ঞে, বাইরের দাওয়ায় বসেছিলুম, টেক্সিতে বাংলা লম্বর দেখে একেবারে অবাক হয়ে গেলুম। তাইতো লম্বরটা মনে আছে হুজুর।
বীরেনবাবু বলিয়া উঠিলেন, কিন্তু ব্যাপারটা কি? ট্যাক্সিতে বাংলা নম্বর এল কোত্থেকে?
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, বাংলা নয়-ইংরিজি নম্বরই ছিল। কিন্তু আমাদের ভাগ্যক্রমে সেটা বাংলা হয়ে পড়েছিল। বুঝলেন না? আসলে নম্বরটা ৮০০৮, পুঁটিরাম তাকে পড়েছে। ৪০০৪।
-- ওঃ— বীরেনবাবুর চক্ষুদ্বয় ও অধরোষ্ঠ কিছুক্ষণ বর্তুলাকার হইয়া রহিল।
অবশেষে ব্যোমকেশ বলিল, তাহলে আর দেরি করে লাভ কি? বীরেনবাবু, এ তো আপনার কাজ। নীল রংয়ের গাড়ি, চালক শিখ, নম্বর ৮০০৮-খুঁজে বার করতে বেশি কষ্ট হবে না। আপনি তাহলে বেরিয়ে পড়ুন, খবরটা যত শীঘ্ৰ পাওয়া যায় ততই ভাল।
আমি এখনি যাচ্ছি— বীরেনবাবু উঠিয়া এক চুমুকে চা নিঃশেষ করিয়া বলিলেন, সন্ধ্যের আগেই আশা করি খবর নিয়ে আসতে পারব।
-- শুধু খবর নয়, একেবারে গাড়ি ড্রাইভার সব নিয়ে হাজির হবেন। ইতিমধ্যে আমি কমিশনার সাহেবকে টেলিফোন যোগে খবরটা জানিয়ে দিই। তিনি নিশ্চয় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
গমনোদ্যত বীরেনবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, আসামীর নাম বা পূর্ব পরিচয় সম্বন্ধে আপনি কোনও খবর দিতে পারেন না?
নির্ভুল খবর এখন দিতে পারি। কিনা জানি না, তবু— এক টুকরা কাগজে একটা নম্বর লিখিয়া তাঁহার হাতে দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, আলিপুর জেলে এই কয়েদীর ইতিহাস খুলে হয়তো কিছু পরিচয় পাবেন।
বীরেনবাবু বলিলেন, লোকটা তাহলে দাগী?
আমার তো তাই মনে হয়। কাল সকালে তার খোঁজ করে নম্বরটা বার করেছিলুম, কিন্তু তার জেলের ইতিহাস পড়বার ফুরসত হয়নি। আপনি সরকারী লোক, এ কাজটা সহজেই পারবেন-অফিসের মারফত। কেমন?
-- নিশ্চয়।
বীরেনবাবু কাগজটা সাবধানে ভাঁজ করিয়া পকেটে রাখিয়া প্রস্থান করিলেন।
সেদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে দুজনে বীরেনবাবুর প্রতীক্ষা করিতেছিলাম। ব্যোমকেশ তাহার রিভলবারটা তেল ও ন্যাকড়া দিয়া পরিষ্কার করিতেছিল।
আমি বলিলাম, বীরেনবাবু তো এখনো এলেন না।
-- এইবার আসবেন। ব্যোমকেশ একবার ঘড়ির দিকে চোখ তুলিল।
-- আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, আচ্ছ ব্যোমকেশ, লোকটার আসল নাম কি? তুমি নিশ্চয় জানো?
-- আমি তো বলেছি, এখনও ঠিক জানি না।
-- তবু আন্দাজ তো করেছ।
-- তা করেছি।
-- কে লোকটা? আমার চেনা নিশ্চয়—না?
-- শুধু চেনা নয়, তোমার একজন পুরনো বন্ধু।
-- কি রকম?
ব্যোমকেশ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, সেই চিঠিখানাতে কোকনদ গুপ্ত নাম ছিল মনে আছে বোধ হয়। তা থেকে কিছু অনুমান করতে পার না?
-- কি অনুমান করব। কোকনদ গুপ্ত তো ছদ্মনাম।
-- সেই জন্যই তো তাতে আরো বেশি করে ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। মানুষের সত্যিকার নামকরণ হয় সম্পূর্ণ খেয়ালের বশে, অধিকাংশ স্থলেই কানা ছেলের নাম হয় পদ্মলোচন। যেমন তোমার নাম অজিত, আমার নাম ব্যোমকেশ—আমাদের বর্ণনা হিসাবে নাম-দুটো কোনও সার্থকতা নেই। কিন্তু মানুষ যখন ভেবে চিন্তে ছদ্মনাম গ্ৰহণ করে তখন তার মধ্যে অনেকখানি ইঙ্গিত পুরে দেবার চেষ্টা করে। কোকনদ শব্দটা তোমাকে কিছু মনে করিয়ে দিচ্ছে না? কোনও একটা শব্দগত সাদৃশ্য?
আমি ভাবিয়া বলিলাম, কি জানি, আমি তো এক কোকেন ছাড়া আর কিছুর সঙ্গেই সাদৃশ্য পাচ্ছি না।
ব্যোমকেশ হাসিল, বলিল, কোকনদের সঙ্গে কোকেনের সাদৃশ্য মোটেই কাব্যনুমোদিত নয়, তাই তোমার মন উঠছে না-কেমন? কিন্তু-ঐ বীরেনবাবু আসছেন, সঙ্গে আর একজন। অজিত, আলোটা জ্বেলে দাও, অন্ধকার হয়ে গেছে।
বীরেনবাবু প্ৰবেশ করিলেন; তাঁহার সঙ্গে একটি দীর্ঘাকৃতি শিখ। শিখের মুখে প্রচুর গোঁফ-দাড়ি-গ্রন্থি বাঁধিয়া তাহাদের উচ্ছঙ্খলতা কিঞ্চিৎ সংযত করা হইয়াছে। মাথায় বেণী। ব্যোমকেশ উভয়কে আদর করিয়া বসাইল।
কালব্যয় না করিয়া ব্যোমকেশ শিখকে প্রশ্ন আরম্ভ করিল। শিখ বলিল, আজ সকালের আরোহীকে তাহার বেশ মনে আছে। তিনি বেলা আন্দাজ সাড়ে দশটার সময় তাহার ট্যাক্সি ভাড়া করিয়া শ্ৰীরামপুরে যান; সেখানে হাসপাতালের অনতিদূরে গাড়ি রাখিয়া তিনি হাসপাতালে প্রবেশ করেন। অল্পক্ষণ পরেই আবার লৌটিয়া আসিয়া দ্রুত কলিকাতায় ফিরিয়ে আসিতে আদেশ করেন। কলিকাতায় পহুঁছিয়া তিনি এই বাসায় নামেন, তারপর সামান্য কিছু সামান লইয়া আবার গাড়িতে আরোহণ করেন। এখান হইতে বউবাজারের কাছাকাছি একটা স্থানে গিয়া তিনি শেষবার নামিয়া যান। তিনি ভাড়া চুকাইয়া দিয়া উপরন্তু দুই টাকা বখশিশ দিয়াছেন; ইহা হইতে শিখের ধারণা জন্মিয়াছে সে লোকটি অতিশয় সাধু ব্যক্তি।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, তিনি শেষবার নেমে গিয়ে কি করলেন?
শিখ বলিল, তাহার যতদূর মনে পড়ে তিনি একজন ঝাঁকামুটের মাথায় তাঁহার বেগ ও জলের সোরাহি চড়াইয়া দিয়া প্ৰস্থান করিয়াছিলেন; কোনদিকে গিয়াছিলেন তাহা সে লক্ষ্য করে নাই।
ব্যোমকেশ বলিল, তুমি তোমার গাড়ি এনেছ। সেই বাবুটিকে যেখানে নামিয়ে দিয়েছিলে আমাদের ঠিক সেইখানে পৌঁছে দিতে পারবে?
শিখ জানাইল যে বে-শক পরিবে।
তখন আমরা দুইজনে তাড়াতাড়ি তৈয়ার হইয়া নীচে নামিলাম। নীল রংয়ের গাড়ি বাড়ির সম্মুখে দাঁড়াইয়া ছিল, ৮০০৮ নম্বর গাড়িই বটে। আমরা তিনজনে তাহাতে উঠিয়া বসিলাম। শিখ গাড়ি চালাইয়া লইয়া চলিল।
রাত্রি হইয়াছিল। গাড়ির অন্ধকারের মধ্যে বসিয়া বীরেনবাবু হঠাৎ বলিলেন, আপনার কয়েদীর খোঁজ নেওয়া হয়েছিল। ইনি তিনিই বটে। মাস ছয়েক হল জেল থেকে বেরিয়েছেন।
ব্যোমকেশ বলিল, যাক, তাহলে আর সন্দেহ নেই। মুখ পুড়েছিল কি করে?
ইনি শিক্ষিত ভদ্রলোক আর বিজ্ঞানবিৎ বলে এঁকে জেল-হাসপাতালের ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে দেওয়া হয়েছিল। বছর দুই আগে একটা নাইট্রিক অ্যাসিডের শিশি ভেঙে গিয়ে মুখের ওপর পড়ে। বাঁচবার আশা ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেঁচে গেলেন।
আর কোনও কথা হইল না। মিনিট পনেরো পরে আমাদের গাড়ি এমন একটা পাড়ায় গিয়া দাঁড়াইল যে আমি বিস্মিত হইয়া বলিয়া উঠিলাম, ব্যোমকেশ, এ কি! এ যে আমাদের—। বহুদিনের পুরাতন কথা মনে পড়িয়া গেল। এই পাড়ারই একটা মেসে ব্যোমকেশের সহিত আমার প্রথম পরিচয় হইয়াছিল। (সত্যাম্বেষীগল্প দ্রষ্টব্য)
ব্যোমকেশ বলিল, হ্যাঁ, আমার অনেক আগেই বোঝা উচিত ছিল। চালককে জিজ্ঞাসা করিল, এইখানেই তিনি গিয়েছিলেন?
চালক বলিল, হাঁ।
একটু চিন্তা করিয়া ব্যোমকেশ বলিল, আচ্ছা, এবার আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে চল।
বীরেনবাবু বলিয়া উঠিলেন, সে কি, নামবেন না?
-- দরকার নেই। আমাদের শিকার কোথায় আছে আমি জানি।
-- তাহলে তাকে এখনি গ্রেপ্তার করা দরকার ৷
বোমকেশ বীরেনবাবুর দিকে ফিরিয়া বলিল, শুধু গ্রেপ্তার করলেই হবে? দেশলায়ের বাক্সটা চাই না?
-- না না-ত চাই বৈ কি। তাহলে কি করতে চান?
-- আগে দেশলায়ের বাক্সটা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে তারপর তাকে ধরতে চাই। চলুন, কি করতে হবে বাসায় গিয়ে বলব। আমরা আবার ফিরিয়া চলিাম।
রাত্রি আটটার সময় আমি, ব্যোমকেশ ও বীরেনবাবু একটা অন্ধকার গলির মোড়ে এক ভাড়াটে গাড়ির মধ্যে লুকাইয়া বসিলাম। এইখানে একটা গাড়ির স্ট্যান্ড আছে—তাই, আমাদের গাড়িটা কাহারও দৃষ্টি আকর্ষণ করিল না।
সম্মুখে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে আমাদের সেই পুরাতন মেস। বাড়িখানা এ কয় বৎসরে কিছুমাত্র বদলায় নাই, যেমন ছিল তেমনই আছে। কেবল দ্বিতলের মেসটা উঠিয়া গিয়াছে; উপরের সারি সারি জানালাগুলিতে কোথাও আলো নাই।
মিনিট কুড়ি-পঁচিশ অপেক্ষা করিবার পর আমি বলিলাম, আমরা ধরনা দিচ্ছি, কিন্তু উনি যদি আজ রাত্রে না বেরোন?
ব্যোমকেশ বলিল, বেরুবেন বৈ কি। রাত্রে আহার করতে হবে তো।
আরো কুড়ি মিনিট কাটিয়া গেল। ব্যোমকেশ গাড়ির খড়খড়ির ভিতর চক্ষু নিবদ্ধ করিয়াছিল, সহসা চাপা গলায় বলিল, এইবার! বেরুচ্ছেন তিনি।
আমরাও খড়খড়িতে চোখ লাগাইয়া দেখিলাম, একজন লোক আপাদমস্তক র্যাপার মুড়ি দিয়া সেই বাড়ির দরজা হইতে বাহির হইয়া আসিল, তারপর একবার ক্ষিপ্র-দৃষ্টিতে রাস্তার দুইদিকে তাকাইয়া দ্রুতপদে দূরের অন্ধকারে মিলাইয়া গেল।
রাস্তায় লোক চলাচল ছিল না বলিলেই হয়। সে অদৃশ্য হইয়া গেলে আমরা গাড়ি হইতে নামিয়া বাড়ির সম্মুখীন হইলাম।
সম্মুখের দরজায় তালা বন্ধ। ব্যোমকেশ মৃদু স্বরে বলিল, এদিকে এস।
পাশের যে-দরজা দিয়া উপরে উঠিবার সিঁড়ি আরম্ভ হইয়াছে, সে দরজাটা খোলা ছিল; আমরা তাহার ভিতরে প্রবেশ করিলাম। এইখানে সরু একফালি বারান্দা, তাহাতে একটি দরজা নীচের ঘরগুলিকে উপরের সিঁড়ির সহিত সংযুক্ত করিয়াছে। ব্যোমকেশ পকেট হইতে একটা টর্চ বাহির করিয়া দরজাটা দেখিল; বহুকাল অব্যবহৃত থাকায় দরজা কীটদষ্ট ও কমজোর হইয়া পড়িয়াছে। ব্যোমকেশ জোরে চাপ দিতেই হুড়ক ভাঙিয়া দ্বার খুলিয়া গেল। আমরা ঘরে প্ৰবেশ করিলাম।
ভাঙা দরজা স্বাভাবিক রূপে ভেজাইয়া দিয়া ব্যোমকেশ টর্চের আলো চারিদিকে ফিরাইল। ঘরটা দীর্ঘকাল অব্যবহৃত, মেঝোয় পুরু হইয়া ধূলা পড়িয়ছে, কোণে বুলি ও মাকড়সার জাল। ব্যোমকেশ বলিল, এটা নয়, ওদিকে চল।
ঘরের একটা দ্বার ভিতরের দিকে গিয়াছিল, সেটা দিয়া আমরা অন্য একটা ঘরে উপস্থিত হইলাম। এ ঘরটা আমাদের পরিচিত, বহুবার এখানে বসিয়া আড্ডা দিয়াছি। টর্চের আলোয় দেখিলাম ঘরটি সম্প্রতি পরিষ্কৃত হইয়াছে, একপাশে একটি তক্তপোশের উপর বিছানা পাতা, মধ্যস্থলে একটি টেবিল ও চেয়ার। ব্যোমকেশ ঘরটার চারিপাশে আলো ফেলিয়া দেখিয়া লইয়া বলিল, হুঁ, এই ঘরটা। বীরেনবাবু, এবার আসুন অন্ধকারে বসে গৃহস্বামীর প্রতীক্ষা করা যাক ৷
বীরেনবাবু ফিসফিস করিয়া বলিলেন, দেশলায়ের বাক্সটা এই বেলা—
-- সেজন্যে ভাবনা নেই। রিভলবার আর হাতকড়া পকেটে আছে তো?
-- আছে।
-- বেশ। মনে রাখবেন, লোকটি খুব শান্ত-শিষ্ট নয়।
আমি এবং বীরেনবাবু তক্তপোশের উপর বসিলাম, ব্যোমকেশ চেয়ারটা দখল করিল। অন্ধকার ঘরের মধ্যে নিঃশব্দে প্ৰতীক্ষা আরম্ভ হইল।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইল না। আধঘণ্টা তখনও অতীত হয় নাই, বাহিরের দরজায় খুট্ করিয়া শব্দ হইল। আমরা খাড়া হইয়া বসিলাম; নিশ্বাস আপনা হইতে বন্ধ হইয়া গেল।
অতি মৃদু পদক্ষেপ অন্ধকারে অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। তারপর সহসা ঘরের আলো দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল।
ব্যোমকেশ সহজ স্বরে বলিল, আসতে আজ্ঞা হোক অনুকুলবাবু। আমরা আপনার পুরনো বন্ধু, তাই অনুমতি না নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছি। কিছু মনে করবেন না।
অনুকুল ডাক্তার-অর্থাৎ দুনম্বর ব্যোমকেশবাবু-সুইচে হাত দিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। কিছুক্ষণ তিনি কথা কহিলেন না। তাঁহার পক্ষ্মহীন চক্ষু দুটি একে একে আমাদের তিনজনকে পরিদর্শন করিল। তারপর তাঁহার বিবৰ্ণ বিকৃত মুখে একটা ভয়ঙ্কর হাসি দেখা দিল; তিনি দাঁতের ভিতর হইতে বলিলেন, ব্যেমকেশবাবু যে! সঙ্গে পুলিস দেখছি। কি চাই? কোকেন?
ব্যেমকেশ মাথা নাড়িয়া হাসিল—না না, অত দামী জিনিস চেয়ে আপনাকে বিপদগ্ৰস্ত করব না। আমরা অতি সামান্য জিনিস চাই-একটা দেশলায়ের বাক্স।
অনুকুলবাবুর অনাবৃত চক্ষু দুটা ব্যোমকেশের মুখের উপর স্থির হইয়া রহিল। তিনি ধীরে ধীরে বলিলেন, দেশলায়ের বাক্স। তার মানে?
-- মানে, যে—বাক্স থেকে একটি কাঠি সম্প্রতি ট্রামে যেতে যেতে আপনি আমায় উপহার দিয়েছিলেন, তার বাকি কাঠিগুলি আমার চাই। আপনি তাদের যে মূল্য ধাৰ্য করেছেন অত টাকা তো আমি দিতে পারব না, তবে আশা আছে বন্ধুজ্ঞানে সেগুলি আপনি বিনামূল্যেই আমায় দেবেন।
-- আপনি কি বলছেন আমি বুঝতে পারছি না।
-- পারছেন বৈকি। কিন্তু হাতটা আপনি সুইচ থেকে সরিয়ে নিন। ঘর হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেলে আমাদের চেয়ে আপনারই বিপদ হবে বেশি। আপনি বোধ হয় লক্ষ্য করেননি, দুটি রিভলবার আপনার বুকের দিকে স্থির লক্ষ্য করে আছে।
অনুকুলবাবু সুইচ ছাড়িয়া দিলেন। তাঁহার মুখে পাশবিক ক্ৰোধ এতক্ষণে উলঙ্গ মূর্তি ধরিয়া দেখা দিল। তিনি চীৎকার করিয়া উঠিলেন, (ছাপিবার যোগ্য নয়) আমার জীবনটা তুই নষ্ট করে দিয়েছিস! তো... অনুকুলবাবুর ঠোঁটের কোণে ফেনা গাঁজাইয়া উঠিল।
ব্যোমকেশ দুঃখিতভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল, ডাক্তার, জেলখানায় থেকে তোমার ভাষাটা বড় ইয়ে হয়ে গেছে দেখছি। দেবে না। তাহলে দেশলায়ের বাক্সটা?
-- না—দেব না। আমি জানি না কোথায় দেশলায়ের বাক্স আছে। তোর সাধ্য হয় খুঁজে নে,—কোথাকার।
নিশ্বাস ফেলিয়া ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল—খুঁজেই নিই। তাহলে। --বীরেনবাবু, আপনি সতর্ক থাকবেন।
ব্যোমকেশ তক্তপোশের শিয়রে গিয়া দাঁড়াইল। গেলাস-ঢাকা জলের কুঁজোটা সেখানে রাখা ছিল, সেটা দুহাতে তুলিয়া লইয়া সে মেঝের উপর আছাড় মারিল। কুঁজা সশব্দে ভাঙিয়া গিয়া চারিদিকে জলস্রোত প্ৰবাহিত হইয়া গেল।
কুঁজার ভগ্নাংশগুলি মধ্য হইতে নীল কাপড়ে মোড়া শিশির মত একটা জিনিস তুলিয়া লইয়া ব্যোমকেশ আলোর সম্মুখে আসিয়া পরীক্ষা করিল, বলিল, ওয়াটারপ্রুফ, শিশি, সীলমোহর, সব ঠিক আছে--শিশিটা ভাঙেনি দেখছি—বীরেনবাবু, দেশলাই পাওয়া গেছে—এবার চোরকে গ্রেপ্তার করতে পারেন।
ব্যোমকেশ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, এই কাহিনীর মরাল হচ্ছে-ভাগ্যং ফলতি সর্বত্ৰ ন বিদ্যা ন চ পৌরুষং। পুঁটিরাম যদি দাওয়ায় বসে না থাকত এবং ট্যাক্সির নম্বরটা ৮০০৮ না হত, তাহলে আমরা অনুকুলবাবুকে পেতুম কোথায়?
জিজ্ঞাসা করিলাম, তা তো বুঝলুম, কিন্তু দেশলাই-চোর যে অনুকুলবাবু এ সন্দেহ তোমার কি করে হল?
ব্যোমকেশ বলিল, আমার সত্যান্বেষী জীবনে যতগুলি ভয়ঙ্কর শত্ৰু তৈরি করেছি, তার মধ্যে কেবল তিনজন বেঁচে আছে। প্রথম-পেশোয়ারী আমীর খাঁ, যে মেয়ে-চুরির ব্যবসাকে সূক্ষ্ম ললিতকলায় পরিণত করেছিল। বিচারে পিনাল কোডের কয়েক ধারায় তার বারো বছর জেলা হয়। দ্বিতীয়-পলিটিক্যাল দালাল কুঞ্জলাল সরকার, যে সরকারী অর্থনৈতিক গুপ্ত সংবাদ চুরি করে শেয়ার মার্কেটে বিক্রি করত। বছর দুই আগে তার সাত বছর শ্ৰীঘরের ব্যবস্থা হয়েছে। তৃতীয়—আমাদের অনুকুল ডাক্তার। ইনি কোকেনের ব্যবসা এবং আমাকে খুন করবার চেষ্টার অপরাধে দশ বছর জেলে যান। হিসেব করে দেখছি, বর্তমানে কেবল অনুকুলবাবুরই জেল থেকে বেরুবার সময় হয়েছে। সুতরাং অনুকুলবাবু ছাড়া আর কে হতে পারে?
-- তা বটে। কিন্তু এই দগ্ধানন ভদ্রলোকটিই যে অনুকুলবাবু এ সন্দেহ তোমার হয়েছিল?
-- না। ওঁর হাঁটার ভঙ্গীটা পরিচিত মনে হয়েছিল বটে। কিন্তু ওঁকে সন্দেহ করিনি। তারপর সেই কোকনদ গুপ্তর চিঠিখানা—সেটাও মনে ধোঁকা ধরিয়ে দিয়েছিল। কোকনদ নামটা এতই অস্বাভাবিক যে ছদ্মনাম বলে সন্দেহ হয়, উপরন্তু আবার গুপ্ত। তুমি বোধহয় লক্ষ্য করেছ, আমাদের দেশের লোক ছদ্মনাম ব্যবহার করতে হলেই শেষে একটা গুপ্ত বসিয়ে দেয়। তাই, দুনম্বর ব্যোমকেশবাবু যখন চিঠিখানা নিজের বলে স্পষ্টভাবে দাবি করতে না পেরেও নিয়ে চলে গেলেন, তখন আমার মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল। কোকনদ শব্দটা কোকেনের কথাই মনে করিয়ে দেয়-তুমি ঠিক ধরেছিলে। কিন্তু তখন দুনম্বর ব্যোমকেশবাবুর ওপর কোনও সন্দেহ হয়নি, তাই মনের সংশয় জোর করে সরিয়ে দিয়েছিলুম। তারপর শ্রীরামপুর হাসপাতালে তুমি বললে, উনি আমাকে দেখতে এসেছেন তখন নিমেষের মধ্যে সংশয়ের সব অন্ধকার কেটে গেল। বুঝলুম উনিই অনুকুলবাবু এবং দেশলাই-চোর।
-- উনি ব্যোমকেশ নাম গ্ৰহণ করে এ বাসায় উঠেছিলেন কেন?
-- আগেই বলেছি। প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি বড় অদ্ভুত জিনিস। ঐ চিঠিখানা আমাকে দিয়ে আমি বুঝতে পারি কি না দেখবার জন্যে উনি এত কাণ্ড করেছিলেন; আর ঐ প্রবৃত্তির দ্বারা তাড়িত হয়েই শ্রীরামপুরে আমার মৃত মুখ দেখতে গিয়েছিলেন। উনি জানতেন, ওঁর মুখের চেহারা এমন বদলে গেছে যে আমরা ওঁকে চিনতে পারব না।
-- কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া প্রশ্ন করিলাম, আচ্ছা, জলের কুঁজোর মধ্যে দেশলায়ের কাঠি লুকিয়ে রেখেছেন, এটা ধরলে কি করে?
ব্যোমকেশ কহিল, ওইখানে অনুকুলবাবুর প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। দেশলায়ের কাঠি জলের মধ্যে লুকিয়ে রাখা হবে এ কেউ কল্পনাই করতে পারে না। কাজেই, যদি কোনও কারণে তাঁর ঘর খানাতল্লাস হয়, জলের কুঁজোর মধ্যে কেউ তা খুঁজতে যাবে না। আমার সন্দেহ হল যখন শুনলুম, তিনি একটি হ্যান্ডব্যাগ আর জলের কুঁজে নিয়ে চলে গেছেন। হ্যান্ডব্যাগ না হয় বুঝলুম, কিন্তু জলের কুঁজো নিয়ে গেলেন কেন? শীতকালে যে-লোক লেপ বিছানা নিয়ে গেল না, সে জলের কুঁজো নিয়ে যাবে কি জন্যে? জলের কুঁজো কি এতই দরকারী? তারপর তাঁর বাক্স থেকে যখন গালা ওয়াটারপ্রুফ ইত্যাদি বেরুল, তখন আর কিছুই বুঝতে বাকি রইল না। কাঠিগুলি তিনি শিশিতে পুরে ওয়াটারপ্রুফ কাপড়ে জড়িয়ে সীলমোহর করে তাকে জলের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন, যাতে জলের মধ্যে থেকেও নষ্ট না হয়। অনুকুলবাবুর বুদ্ধি ছিল অসামান্য, কিন্তু বিপথগামী হয়ে সব নষ্ট হয়ে গেল!
পুঁটিরাম চায়ের শূন্য বাটিগুলা সংগ্ৰহ করিতে আসিয়াছিল, তাহার দিকে চাহিয়া ব্যোমকেশ বলিল, পুঁটিরাম, ফাস্টবুক এনেছ?
লজ্জিতভাবে পুঁটিরাম বলিল, আজ্ঞে হ্যাঁ।
-- বেশ। অজিত, আজ থেকেই তাহলে পুঁটিরামের হায়ার এডুকেশন আরম্ভ হোক। কারণ প্রত্যেক বারই যে ৮০০৮ নম্বর ট্যাক্সিতে আসামী পালাবে এমন তো কোনো কথাই নেই ৷
//সমাপ্ত//
No comments:
Post a Comment