নীলদৈত্য

লেখক: হীরালাল চক্রবর্তী

অনেকক্ষণ থেকে বাপ ডাকছে। উঠোনের উত্তর কোনে নিম গাছটার নিচে বসে তখন থেকে তন্ময় হয়ে কি যেন করছে ছেলেটা। অনেকক্ষণ ডাকাডাকিতেও ছেলে সাড়া দিচ্ছে না দেখে পূরণ পাল নিজে বাইরে বেরিয়ে এল মাত্র তিন হাত দূরে বসে আছে ছেলেটা। পূরণের আর ধৈর্য রইল না। ছুটে এসে ঠাস করে একটা চড় কসিয়ে দিল কাদামাখা হাতে।

-- লক্ষ্মীছাড়া! দিনকে দিন লায়েক হচ্ছ! এত ডাকেও সাড়া মেলে না?

নব চড় খেয়ে বাবার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল কতকক্ষণ। পুরণ বললে; কি, ওগুলো কি শুনি? দিন-রাত তুমি তার ব্যাটারী ছুরি কাঁচ নিয়ে কোন্‌ বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড বানাচ্ছ শুনি? যা কাদা ছেনে দিয়ে আয়। এক হাতে কতদিক সামলাব? পুজোর আর কতদিন বাকী আছে?

পুরণ আবার গিয়ে কারখানায় ঢুকল। নব তখনো গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ডান গালে কাদামাখা পাঁচটি আঙুলের স্পষ্ট ছাপ পড়ে গেছে। টিন কাঠের অসমাপ্ত উড়ো জাহাজটার দিকে সে তাকাল। রাজ্যের টুকরো তার ছড়িয়ে আছে। টর্চের দু-তিনটি বাল্ব, সরু লাল ফিতে, একখানা ব্লেড কাঁচ আর কাঠের টুকরো। টিনের পাতে ব্যাটারী দা। এতসব সরঞ্জামের মধ্যে হঠাৎ যেন তার মন দুলে উঠল। সে স্বপ্ন দেখতে লাগল একটা উড়োজাহাজ উড়ছে। গুরগুর শব্দ হচ্ছে। লাল নীল আলো জ্বলছে। শিশুসুলভ খুশিতে সে হেসে ফেললে মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললে, তোর কি লঙ্জা নেই রে? এত মার খাস তাতেও হয় না?

নব বললে, জানো মা উড়োজাহাজ হু-স্‌ করে উড়ে যাবে। লাল নীল আলো জ্বলবে। ওঃ কি মজা।

মা গালে হাত দিয়ে সবিষ্ময়ে বললে, ওমা! এমন অনাসৃষ্টি কাণ্ড তো কোথাও দেখিনি। কুমোরের ছেলে, যার চোদ্দ পুরুষ কাদা ছেনে পুতুল গড়েছে তাদের ছেলে জাহাজ বানাচ্ছে।

পুরণের ফের ডাক কানে যেতেই নব দৌড়ে চলে গেল। এর পর না গেলে বাবা এসে হয়ত এত পরিশ্রমে বানানো উড়োজাহাজটাকে আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেলবে।

পুরণ পাল, মফঃস্বলের একজন নাম করা মৃৎশিল্পী। তার বাবা ছিল বিখ্যাত প্রতিমা শিল্পী। বাবা নেই। কিন্তু পুরণ পাল বাবার ক্ষেত্রটিকে প্রশস্ত করেছে বহুগুণ। দ্বার পুরণকে বিদেশ পাড়ি দিতে হয়েছে প্রতিমা গড়ার জন্য। আজও তার দুর্গাপ্রতিমা সপরিবারে পাড়ি দেয় বিদেশে। কোলকাতায় পুরণ পালের দুখানা প্রতিমা যায় ওখানকার বিখ্যাত দুটি ক্লাবে। অথচ পুরণ একা মানুষ! দুচারজন কারিগর থাকে সবসময়। কিন্তু হাতে কলমে নিজের মনের মত করে কাজ করতে না পারলে তার মন ওঠে না।

ছেলেটাকে চায় সে মনের মত গড়ে তুলতে। শুধু বংশের মর্যাদা নয়, এমন এমন পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে ছেলেকে সে তুলে আনতে চায় যে, একজন শিল্পী হিসেবে তার ছেলে শুধু চর্বিত চর্বণ করবে না।

এর জন্য অনুশীলন চাই। সাধনা চাই। পুরণ পাল নিজের অবর্তমানে তার অসমাপ্ত কাজ ছেলের হাতে তুলে দিতে চায়। তার প্রতিমা দেখে মানুষ যেন ভাবিত হয়।

শিল্পের সুক্ষ্মতা, শিল্পীর অনুভব, যদি মানুষের হৃদয় স্পর্শ না করে তবে সে সৃষ্টির মূল্য কি।

তাই পুরণ চায় নবকে এখন থেকেই হাতে কলমে শেখাতে। কিন্তু ছেলেটা যেন উদাসী। যত বয়স বাড়ছে তত যেন ঔদাসিন্য বাড়ছে তার। বয়স হচ্ছে পুরণের।

আজকাল বেশি প্রতিমাও গড়ে না। একটা কঠিন রোগে পুরণ আরো দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু চাহিদার শেষ নেই। সব পূরণ হয় না। অনেকে ক্ষু্ন্ন হয়। কেউ কেউ শাসিয়েও যায়। নব যদিও হাল ধরে, কিন্তু পুরণ ভরসা পায় নি। সে ক্ষেত্রকে ডেকে এনেছিল। ঐ বছরটা তাতে মুখ রক্ষা হয়োছল কিঞ্চিৎ।

কিন্তু পুরণ চিন্তায় পড়ে গেল মফঃস্বলের একটি প্রতিমা নিয়ে। না করারও উপায় নেই। গোস্বামীরা অত্যন্ত প্রভাবশালী। শুধু প্রভাবই নয় এই মফঃস্বলের ক্ষুদ্র শহরটিতে গোস্বামীদের ভয় পায় না এমন কেউ নেই। রাজনীতির হত্যায় অন্ধকারের জান্তব ক্রিয়াকাণ্ডে গোস্বামীরা এই শহরে সন্ত্রাস হয়ে আছে। তাদেরই প্রভাবিত ক্লাব স্টার ক্লাব। কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে প্রতি বছর ঐ ক্লাবে ধুমধাম দুর্গা পূজা হত। বরাবর রমেশ পালের ঠাকুর হত ক্লাবে। পূরণ পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে যেত শিল্পীর সুক্ষ্ম শিল্প চাতুর্যে। এ বছরের গোড়ার দিকে একটা ভয়ংকর দাঙ্গা দিয়ে ক্লাবটা দুভাগ হয়ে যায়। গোপাল গোস্বামী স্টার ক্লাবেই প্রায় চ্যালেঞ্জ নিয়ে নেমে পড়েছে। অন্য ক্লাবটিও ইয়ং ক্লাব নাম নিয়ে নেমে পড়েছে। তারাই আনছে রমেশ পালের ঠাকুর।

কিন্তু পুরণ পড়ল মহা ফ্যাসাদে। ইতিমধ্যে তিন-চারখানা বড় কাজ হাতে নিয়ে ফেলেছে। কোলকাতারই তিনখানা। আর একখানা আছে বিদেশের। এমনিতেও তার শরীর ভাল নেই। হাঁপের টান বেড়েছে।

গোপাল গোস্বামী স্বয়ং এসেছে জীপে করে। প্রাক্তন জমিদার বংশের ছেলে । গম্ভীর স্পষ্ট স্বরে বললে, আমি নিজে দৌড়ে এসেছি, বোঝই তো। এমন প্রতিমা গড়িয়ে দিতে হবে রমেশ পাল কেন, তাবৎ পশ্চিমবাংলার মানুষ নাম করে।

পুরণ একটু ইতঃস্তত করে বললে, হাত যে আমার খালি নেই বাবু!

সেসব বুঝি না। প্রতিমা গড়বে। সেরা প্রতিমা। টাকার চিন্তা করনা। -- চলে যাচ্ছিল সদলবলে। আবার ঘুরে এসে বললে, ভাল কথা এখান থেকে প্রতিমা নেয়া যাবে না। মণ্ডপে বসে গড়তে হবে।

ধুলো উড়িয়ে চলে গেল জীপ। সেদিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ বসে রইল নব। বুকের মধ্যে যেন গুড়গুড় করে বাজতে লাগল মাদলের বাজনার মত। নব দেখতে পেল একটা নীলবর্ণ দৈত্য যেন সেই ছেলেটাকে হাঁটুর ওপর চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে দুহাতের দশটা নখ দিয়ে তার বুক ফেঁড়ে দিচ্ছে। ফিনকি রক্তে দৈত্যটার চোখমুখ ভিজে গেছে। পা ধরে পায়ের ওপর মাথা খুঁড়ছে একজন রমণী। আলুলায়িত কেশদাম।

ও! অসহ্য! নব ছটফট করে। বিভু--তার ছেলেবেলার বন্ধু-সহপাঠী। ঐ গোপাল গোস্বামীর হুকুমে তুলে নিয়ে গিয়েছিল তার ছেলেরা। সঙ্গে সঙ্গে ওর মা ছুটে গিয়েছিল। নব নিঃশব্দে জানলার ফাঁক দিয়ে দেখেছিল দৃশ্যটা।

গোপাল গোস্বামী বিভুর ঝুঁকে পড়া মাথাটাকে তুলে ছুরির ডগা দিয়ে মুখখানার ওপর, আঁকিবুঁকি কেটে দিল। যীশুর মত দুহাত দুদিকে টান করে বাঁধা। বুক দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে। ওর মা গোপালের পায়ের ওপর পড়ে আকুলস্বরে কাঁদছে। নবর সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছিল। একমাস সে স্তব্ধ হয়ে ছিল। থেকে থেকে শিউরে উঠত।

পুরণ বললে,--কি রে, কি করব? শুনলি তো, এখন উপায়?

নব বললে, -- উপায় আর কি? গোপাল গোস্বামীর হুকুম!

-- আমি তো মরে যাব।

-- আমি করব।

নব তাকাল বাপের দিকে। পঁচিশ বছরের যুবক ছেলেটার চোখে মুখে যেন কি পেল পুরণ। চোখে মুখে এক উজ্জ্বল দৃঢ়তা, প্রত্যয়। হ্যাঁ হ্যাঁ এই চোখই তো সে দেখতে চায়।

নব হঠাৎ বললে, -- মানুষ কেন এমন হয়?

-- কি?

লোকটা কত সুপুরুষ। দেখলেই শ্রদ্ধা হওয়ার কথা। অথচ দেখলে সমস্ত শরীর কাঁপে। মনটা কুঁকড়ে যায় ঘঁণায়। বিভুকে যেভাবে মেরেছে সেইভাবে কুপিয়ে কুপিয়ে –

-- চুপ কর্‌। ধমকে উঠল পুরণ। আজেবাজে চিন্তা ছাড়বি?

পরদিনই নব গিয়ে উঠল স্টার ক্লাবের মন্ডপে। সঙ্গে ক্ষেত্র কাকার ছেলে অজয়। গোপাল গোস্বামী বললে, তুমি কেন? বাবা কোথায়?

নব মৃদু হাসল। মিষ্টি সুরে বললে, বাবার শরীর খুব খারাপ। চিন্তা করবেন না, আমি বাবারই ছেলে।

দুটি পাড়ার ব্যবধান খুব বেশি নয়। মাঝখানে একটি বাঁশ ঝাড়। তিনমাস আগে থেকেই দুটি ক্লাবের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। দোকানে দোকানে ঘরে ঘরে পথে ঘাটে মাঠে আলোচনার ঝড় বইছে। এবার কে কাকে টেক্কা দেয় দেখার জন্য ছোট শহরটা উন্মুখ হয়ে আছে।

আবার আশঙ্কায় বুকও কাঁপে শহরটার। কোন সূত্র ধরে দাঙ্গা শুরু হবে কে জানে। দুই প্রতিদ্বন্দীর দলেই আছে খুনে ঘাতকেরা। শহরটাকে যারা এক ঘণ্টায় শ্মশান করে দিতে পারে! নিজ নিজ ক্লাবের গুণকীর্তনে চায়ের দোকান, কালভার্টগুলো সব সময় কলকল করে। একদিন গোপাল গোস্বামীর এক চেলা এসে খবর দিলে ইয়ং ক্লাবের নাদু হাজরা বিজয়া সম্মিলনীতে নট্টকে বায়না করেছে। শুনেই গোপাল গোস্বামী হুকুম দিলে, সাতদিন ধরে বিজয়া সম্মিলনী উৎসব হবে স্টার ক্লাবে। ঐ সাতদিন যাত্রা নাটক কবিগান গম্ভীরা ইত্যাদি চলবে। বায়না কর।

ইয়ং ক্লাবের নাদু হাজরার চ্যালারা দুই পাড়ার মাঝখানে বুড়ো নিম গাছটার নিচে কুঞ্জ পাঁজার চায়ের দোকানে বসে গুলতানি করছে। পথে যেতে যেতে গোপাল গোস্বামীর এক ভক্ত হঠাৎ একটা কথা শুনে গতি কমিয়ে দিল। ওরা বলছে কি? পঞ্চাশটা পাঁঠা বলি দেবে ইয়ং ক্লাব! কথাটা শুনেই সে ছুটতে ছুটতে চলে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে খবরটা সে সবিস্তারে ও কিছু অতিরঞ্জিত করে বলল স্টার ক্লাবে। ম্যানেজার গৌর কুণ্ডু ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করে গোপাল গোস্বামীর মুড্‌ লক্ষ্য করল। গোপাল কিং সাইজের একটা সিগারেট মুঠি পাকিয়ে টানছিল। গম্ভীর গলায় বললে, পঞ্চাশ? ঠিক আছে। গৌর, একশোটা আমরা বলি দেব।

এগুলো আনুসঙ্গিক। মূল কথা হল প্রতিমা। যাকে ঘিরে শহরে কাড়ানাকাড়া বাজানো হচ্ছে সেই দেবী দুর্গা কার মণ্ডপে কি রূপে দেখা দেবেন সেটাই আসল কথা।

এদিকে রুপোলী মুদ্রার ঝংকার যত বাড়ছে ও তরফের কুমোরের ব্যস্ততাও তত বাড়ছে। নবই কিন্তু নিস্পৃহ! সারা শহুর যখন দুটি দুর্ধর্ষ ক্লাবের দাপটে থরথর করে কাঁপছে তখন অন্যমনস্ক নব মাঝেমাঝেই হাত দুটো গুটিয়ে চুপচাপ হয়ে বসে থাকে।

পুরণ রোজ একবার করে খোঁজ নেয় -- কতদূর হল রে?

হবে হবে। -- একটু থেমে কি ভেবে নব বলে, -- কাল বিভুর বাবার সঙ্গে দেখা হল। কি মানুষ কি হয়ে গেছে! মাসিমাও আর সেই মানুষ নেই।

ক্লাব থেকে বাড়ি আসছিল নব। বাগান পোরয়ে পথে নামতেই দেখল বিভুর মা দাঁড়িয়ে আাছেন। নবকে দেখতে পেয়েই দাঁড়িয়েছেন। ঠিক দুর্গা প্রতিমার মত সুন্দরী বিভুর মা। এখন চেহারা ভেঙ্গে গিয়েছে। প্রিয়তম সন্তানের শোক সামলে উঠতে পারেন নি। নবকে দেখলেই তিনি থমকে যান। কে জানে হয়ত নবর মধ্যেই তাঁর হারানো সন্তানকে খুঁজে বেড়ান কিনা! নব জানে উনি রোজ একবার করে সেই বধ্যভূমিতে যান।

নব কাছে আসতে তিনি মুখের দিকে তাকালেন। অশ্রু ভারাক্রান্ত চোখ দুটো স্থির হয়ে গেছে ওর মুখের ওপর। নব ডাকল, মাসিমা !

-- আয়, একবার আমার বাড়ি আয় বাবা।

নবর একদম হাতে সময় ছিল না। তবু সে বিভুর মা'র হাত ধরে ওঁদের বাড়ি গেল। নবকে বসিয়ে মিষ্টি খাওয়ালেন উনি। তারপর কপালে গভীর স্নেহে একটি চুম্বন এঁকে দিলেন। আবেগে থরথর করে কেঁপে উঠল নবর শরীর! সে ডাকলে, -- মা।

বিভুর মা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। নবর চিন্তার জগতে অদ্ভুত এক প্রলয় ঘটতে লাগল। মনে হল বিভুর মা যেন দুর্গার মত তার সমস্ত সত্তা ধরে নাড়া দিচ্ছে। এক অপরিসীম দেবজ্যোতিতে তিনি যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন। নব দিশেহারার মত ঘর ছেড়ে দৌড়ে চলে গেল।

বাড়ি খেতে গেল না। অশান্ত অস্থিরভাবে বাগানময় ঘুরে বেড়াতে লাগল। মনটা একটু স্থির হলে আবার সে স্টার ক্লাবের মণ্ডপে গিয়ে কাজে বসল।

পুজোর আর খুব দেরী নেই। গোপালের চ্যালারা প্রতিদিন মণ্ডপে এসে ভিড় জমাচ্ছে। ছেলেপুলেরা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে -এক মেটে - দো মেটে - তিন মেটে। পুরণও রোজ খবর নিচ্ছে। ছেলের ওপর বিশ্বাস আছে, তবে মনের কোণে একটুখানি উদ্বেগ যেন চিনচিন করে। বাঘের খাঁচায় বসেছে, একটু বেসামাল হলেই বিপদ!

তাই পুরণ মাঝেসাঝে এসে দাঁড়ায়। দু-একটা উপদেশ, দেয়। নব শুধু এক কথাই বলে, সবাইকে চমকে দেবো, দেখো।

এদিকে পাঁচজন পাঁচ রকমের কথা বলছে। কেউ বলে -- দুর্‌ দুর্‌ ঐ ছোঁড়া আবার কি বানাবে। কোথায় রমেশ পাল আর কোথায় নব পাল! হাতি আর মশা।

ইতিমধ্যে রটনা ঘটনা নিয়ে দুটি ক্লাবে মিনি সংঘর্ষ হয়ে গেছে। দুচারটে বোমাও ফেটেছে।

একদিন গৌর কুণ্ডু ডেকে বললে, -- ওহে নব তোমাকে ওরা টিটকিরি করছে? বলো--

-- না না কেউ আমাকে কিছু বলে নি।

আবার একদিন শোনা গেল নবর ওপর বোমা ছোঁড়া হয়েছিল। অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছে। নবর মা ভয়ে কেঁদেই ফেলল। বললে, না-না তুই যাস নে বাবা। প্রাণই যদি যায় তো কাজ করে হবেটা কি?

নব বললে -- কে বললে আমাকে বোমা মেরেছে? বাজে গুজব!

নব দুদিন জ্বরে পড়ে আসতে পারে নি। নাদুর লোকেরা রটিয়ে দিলে স্টার-এর কুমোর ভয়ে সট্‌কেছে।

গৌর কুণ্ডু সদলবলে পুরণের বাড়ি হাজির, -- নব কোথায়?

কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এল নব -- জ্বরে ফেলে দিয়েছে। ঠিক আছে চলুন।

কিন্তু ওখানে গিয়েই নব অজ্ঞান হয়ে গেল। আবার তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল।

তিনাদন কাজ পড়ে রইল। শহরে আবার চাঞ্চল্য? ফিসফাস। হাসাহাসি। উদ্বেগ দুশ্চিন্তা। নাদুর চ্যালারা ছড়া কাটল। গোপাল গোস্বামী রাগে গর্জে উঠল, পুরণ আমাকে ডোবাচ্ছে? যদি তাই হয় তার শিক্ষা ওকে পাইয়ে দেব।

বিভুর মা একদিন হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে দুম করে ঘরের দরজা বন্ধ করে শুকনো মুখে বললে, -- হ্যাঁরে ঐ দানবটা শেষ পর্যন্ত তোর বুকেও নখ বসিয়ে দেবে না তো?

-- কেন? বললে নব শান্ত গলায়।

-- শুনছি তোর ঠাকুর নাকি ওদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না?

বলতে বলতে চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে নামল মায়ের।

নব হেসে বললে -- অত ভয় করছ কেন? এমন প্রতিমা গড়ব যা দেখে শহরের মানুষ তাজ্জব হয়ে যাবে।

রাত গভীর। নবর মাথা ভার হয়ে উঠেছে। ক্লান্তিতে চোখ জড়িয়ে আসছে। কিন্তু ঘুমোলে চলবে না। নব রং তুলি নিয়ে চোখ ভ্রু আঁকতে বসল। নিখুঁত তুলির টান!

হ্যাঁ, এই চোখই তো সে দেখেছে! মমতা মাখানো ঘন পল্লবিত দুটি চোখ। নব তুলি হাতে স্তব্ধ বসে রইল। সেই চোখ সেই মুখ। উজ্জ্বল দুটি চোখ ষেন ওরই দিকে চেয়ে আছে। বুকের সব বেদনা যেন স্থির দুটো চোখের কোলে এসে থমকে গেছে। কিন্তু না, ও চোখে শুধু বেদনা, বিষণ্ণতা নয়, মমতায় অশ্রুসজল নয়, ও চোখে দিতে হবে দস্যুর প্রতি অপার ঘৃণা। শানিত ভ্রূকুটি। বিদ্যুৎ ঝলকের মত সীমাহীন জ্বালা।

নব আবার তুলির টান লাগাল। হ্যাঁ, এই তো! নব চুল পরাল। এক ঢাল চুল। এলোকেশীর মত ছড়িয়ে দিল সারা পিঠে। উড়িয়ে দল কিছু চুল। কপালে গুচ্ছ চুল দিল ছড়িয়ে।

তুলির শেষ টান এবার দিতে হবে। সঞ্জীবিত করে তুলতে হবে তার ধ্যান তার স্মৃতিকে। চোখ জলে ভরে এল নবর। আর পারছে না ও। শরীর ভেঙে পড়ছে! খড়ের গাদার মধ্যে শুয়ে মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়ল।

পাড়ার গুরুস্থানীয় দুচারজন আসেন মাঝে মাঝে অগ্রগতি দেখতে। ডাঃ মুখার্জি অভি সাহা, দীনেশ পুরকায়েত। এঁরা শুধু বয়সে নয় সঙ্গতি ও ক্ষমতায় অনেক উঁচু দরের লোক। কারো শালা মন্ত্রী, ভাই শিল্পপতি, দাদা ব্যবসায়ী। দু পক্ষেই এ রকম মান্যগণ্য লোক আছেন। এঁদের মধ্যে ডাঃ মুখার্জিই একটু বোশ ধূরন্ধর। দুপক্ষের কাছেই নিরপেক্ষতার ভাণ করে থাকেন। তিনি কালই খবর করছিলেন যে ইয়ং ক্লাবের প্রতিমা পাঁচদিন আগে হাজির হয়েছে। দুর্গার কথা বলতে গিয়ে ডাঃ মুখার্জি হাত জোড় করে "পাপ নিওনা মা” বলে প্রণাম করে বললেন, একেবারে ইয়ের মত হয়েছে আর কি! ছিঃ, ছিঃ! এই ওদের রুচি!

সকলেই হেসে উঠলেন হো হো করে।

দীনেশ পুরকায়েত হাসলেন বটে কিন্তু পরক্ষণে গম্ভীর হয়ে বললেন, -- অত হেসো না হে। নিজেদেরটি কেমন হয় দেখ।

ডাঃ মুখার্জি নাদুকে গোপনে বলেও এসেছেন, -- এবার স্টার ক্লাব ডুবলো নাদু। গোপাল এক ছোকরাকে দিয়ে ঠাকুর গড়াচ্ছে। বেড়াল দিয়ে হাল চাষ। কথাটা শহরেও জানাজানি হয়ে গেছে। ইয়ং ক্লাবের অপু তাতে রং চড়িয়ে বন্ধু মহলে নিজের লেখা গান গায়ঃ

ও যে প্রতিমা নয় পুতনা
দেখলে চোখের যাতনা,
ও খুড়ো তোর পায়ে পড়ি
মানের কথা বোলো না!

শুনে গোপাল গোস্বামী রাগে, উত্তেজনায় তার দলবল নিয়ে উঠে দাঁড়াল -- চল্‌ তো দেখি, কেমন ঠাকুর গড়ল। আগুন জ্বালিয়ে দেব কুমোর পাড়ায়।

সেই আগুনে মেজাজ নিয়েই সকলে এসে হাজির হল স্টার ক্লাবের পূজা মণ্ডপে। নব তখন অস্ত্রশোভিত দুর্গার দিকে চেয়ে তন্ময় হয়ে বসেছিল। সকলে চমকে উঠলো। গোপাল গোস্বামী একটা অস্ফূট গর্জন করে ছিটকে এসে মাঠে নামল, -- একি! এ কার মূর্তি!

বাকী সবার চোখ বিস্ময়ে স্তব্ধ। কণ্ঠস্বরও যেন হারিয়ে গেছে।

বসনেভূষণে সজ্জিত রণরঙ্গিণী এ মূর্তি কার! এ ষে সাক্ষাৎ অক্ষয় পালের স্ত্রী! বিভুর মা! আরো ভয়ানক ব্যাপার অসুরের মুখখানা। যেন গোপাল গোস্বামীর মুন্ডুটা কেটে অসুরের ঘাড়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে!

সারা শহরে এ খবর ছড়িয়ে যেতে সময় লাগল না!

দলে দলে লোকে এসে দেখতে লাগল। তাই তো! শহরের মানুষ মনে মনে খুশিতে মাথা দোলাতে লাগল। বেড়ে মূর্তি গড়েছে পুরণ পালের ছেলেটা!

কিন্তু এখানেই শেষ হল না এই ঘটনার। ছোট শহর হঠাৎ যেন মাথা গরম ছেলের মত ক্ষেপে উঠল। নব পালকে গোপাল গোস্বামী ক্লাব ঘরে আটকে দিয়েছে। সেই কুখ্যাত ঘর, যেখানে শহরের অনেক মায়ের ছেলে, অনেক বোনের ভাই, অনেক স্ত্রীর স্বামীর আত্মার দীর্ঘশ্বাস জমে আছে।

শহরের লোক ভেঙ্গে পড়ল। দারোগা সভয়ে ছুটে এলেন। যষ্ঠীর রাত ভয়ংকর উত্তাল হয়ে উঠল। সামাল দিতে দারোগার ঘাম ঝরে গেল অনেক।

অনেকদিন পর শহরের মানুষ এবার ক্ষেপেছে!

শেষ

No comments:

Post a Comment