লেখক: অশোককুমার ঘোষ
মানুষ হিসাবে আমি যে কেবল শান্তিপ্রিয় তাই নয়, কিছুটা ভীতু প্রকৃতিরও বটে। তাই গাড়ি-ঘোড়ায় বিশেষ করে ট্রেনে কোথাও যেতে হলেই আমার মনটা সাংঘাতিক খিঁচড়ে থাকে। সব সময় মনে হয় চোর-ছ্যাঁচোড়, পকেটমার, গুন্ডা আর ট্রেন-ডাকাতরা আমার চারপাশেই ঘোরাঘুরি করছে। তাই পারতপক্ষে আমি ঘরের কোণ ছেড়ে কোথাও বেরই না, এড়িয়ে যাই। তবুও সেবার, মানে এই গত ২৫ ডিসেম্বর- বোম্বে এক্সপ্রেসে আমায় হাওড়া যেতে হল এবং তখনই ঘটনাটা ঘটল।
চক্রধরপুরেই দেখা হয়ে গেল এক পরিচিত টি. টি. ই -র সঙ্গে। উনি যাবেন বোম্বে এক্সপ্রেস নিয়ে। তাই তাঁর কৃপায় একটা থ্রি টায়ার কামরায় বসার জায়গা পেলাম। জায়গা দখল করেই মনটা খুশি হয়ে উঠল, কিন্তু কি ক্ষণস্থায়ী সেই সুখ। ট্রেন যখন ছাড়ব ছাড়ব সেই সময় স্থানীয় কলেজের বেশ কিছু ছাত্র এই কম্পার্টমেন্টেই উঠল। সঙ্গে একগাদা জিনিসপত্র। আড়চোখে তাকিয়েই বুঝলাম পিকনিক করতে যাচ্ছে এবং অচিরেই জানতে পারলাম যে তাদের গন্তব্যস্থল ঘাটশিলা। যাক উৎপাতটা ঘণ্টা দেড়েকের বেশি সহ্য করতে হবে না।
ওরা ঘাটশিলায় কলরব করতে করতে নেমে গেল। আমি আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখে নিলাম আমার অ্যাটাচিটা যথাস্থানেই আছে। গাড়ি আবার যথা নিয়মেই চলতে শুরু করল। আমিও একটা ম্যাগাজিন খুলে চোখ মেলে দিলাম। গাড়ি আবার গন্তব্যাভিমুখে রওনা হল।
আসল ঘটনা ঘটল কিন্তু খড়্গপুর পেরোনর পর। আমার পাশেই বসেছিলেন এক মাড়োয়াড়ী ভদ্রলোক। বিশাল বপু এই ভদ্রলোক কাত হয়ে এক ‘মনোহর কহানিয়া’ জাতীয় রোমাঞ্চকর পত্রিকা পড়ছিলেন খুব মনোযোগ দিয়ে। হঠাৎ ‘ই ক্যারে বাপ’ বলে ভদ্রলোক তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন।
সেই চিৎকারে কামরার সবাই সচকিত হয়ে উঠল। আমারও চোখ সেদিকে পড়তেই দেখি ভদ্রলোকের বাম বাহুতে একটা বড়সড় রক্তের ফোঁটা জ্বলজ্বল করছে। হঠাৎ রক্ত দেখে বিচলিত হয়ে উৎস সন্ধানে ওপরের দিকে চোখ তুলতেই দেখি আমার আট্যাচিটা যেখানে ছিল তার পাশেই একটা বড়সড় গামছার পুঁটলি আর রক্তটা সেই গামছা থেকেই চুঁইয়ে পড়েছে। মনটা বিরক্তিতে ভরে উঠল। হাত বাড়িয়ে নিজের অ্যাটাচি কেসটা টেনে নিতে গিয়েই বাধা পেলাম। লম্বা-চওড়া এক ভদ্রলোক হাঁ হাঁ বলে উঠলেন, করছেন কী মশাই? এখন কোন কিছুতেই হাত দেবেন না। কোনওমতে ঢোক গিলে বলতে গেলাম যে আ্যাটাচিটা আমার। কিন্তু ওই পুঁটলিটার মালিক আমি নই। আমার কথা মাঝপথে চাপা পড়ে গেল ভদ্রলোকের কথায়, তিনি সগর্জনে বলে উঠলেন, দেখুন মশায় আ্যাটাচিটা যে আপনার তাও আমরা জানি না, আবার পুঁটলিটা যে আপনার নয় তাও আমরা জানি না। প্রমাণ কী? তাছাড়া আজকাল আকছার খুন করে এভাবে মুন্ডু, ধড় লোকে পাচার করে দিচ্ছে। সুতরাং চুপচাপ বসে থাকুন। হাওড়া এলে পুলিশ ডেকে যা ব্যবস্থা করা যায় করা যাবে।
এই কথা শুনে আমার তো শিরদাঁড়া বেয়ে বরফের স্রোত নামতে লাগল। একি গেরো রে বাবা। চিন্তায় মাথা ঘুরে গেল। চোখের ওপর এক এক করে ভেসে উঠতে লাগল গল্পে পড়া বিভিন্ন ঘটনা। যে সব ঘটনায় আমরা পড়ি খুনী খুন করে মৃতদেহ খণ্ড খণ্ড করে পাচার করে। বুকের মধ্যে গুড়গুড় আওয়াজ হতে লাগল, মনে কেবল একটাই চিন্তা-- কিভাবে প্রমাণ করব অ্যাটাচিটা আমার কিন্তু পুঁটলিটা আমার নয়?
চিন্তায় দিশেহারা হয়ে উঠলাম। বাড়ির সবার মুখ মনের মধ্যে ভেসে উঠতে লাগল। জীবনে হয়ত আর কারো মুখই দেখতে পাবনা। নিজেকে মনে হতে লাগল যেন সত্য সত্যই অপরাধী। ঘাড় গুঁজে মুখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে আছি।
ইতিমধ্যে গোটা ট্রেনে খবর ছাড়িয়ে গেছিল যে, একটা গামছার পুঁটলিতে মানুষের কাটা মাথা পাওয়া গেছে। গাড়ি থামলেই অন্য কামরা থেকে লোক এসে অকু্স্থল পরিদর্শন করে যাচ্ছে আর আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে, যেন সবাই নিশ্চিত আমিই অপরাধী।
হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ি দাঁড়াতেই দেখি, গাড়ি হাওড়া স্টেশনে ঢুকে পড়েছে। গাড়ি দাঁড়াতেই একজন মাতব্বর গোছের লোক নেমে গেল পুলিশে খবর দিতে। কামরার মধ্যে ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। সবার মুখচোখে উৎসুক উৎকন্ঠা। মৃদু গুঞ্জন হঠাৎ বেড়ে গেল, পুলিশ পুলিশ রবে।
ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন একজন ইন্সপেক্টর, সঙ্গে দুজন কনস্টেবল উপস্থিত হয়েই প্রথমে পুঁটলিটা হাতের বেটন দিয়ে নেড়েচেড়ে কঠোর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন পু্ঁটলিটা আপনার?
প্রায় কেঁদে ফেলে আমার উত্তর, না স্যার ওটার মালিক আমি নই -- ওটার সম্বন্ধে আমি কিছু জানি না।
কিন্তু মুখ দেখে মনে হল না যে, উনি আমার কথার এক অক্ষরও বিশ্বাস করেছেন। মুখ ঘুরিয়ে একজন কনস্টেবলকে ডেকে বললেন, রামভরসা-উস পুঁটলি কো খোলো।
এই কথা শুনে সেই উদ্দিষ্ট কনস্টেবলটি একহাত জিভ কেটে দশহাত পিছিয়ে জবাব দিল, আরে রাম রাম ই কি বাত, বোলতেসেন স্যার - আমি বাউন আছি। ই কাম হাম করবে না স্যার।
নিরুপায় ইন্সপেক্টর অন্য কনস্টেবলটিকে তখন পুঁটলিটি খুলতে আদেশ দিলেন। এই লোকটি অবশ্য বিনা আপত্তিতে এগিয়ে এসে পুঁটলিটা খুলতে শুরু করল।
প্রচণ্ড উত্তেজনায় ও উৎকন্ঠায় সবার চোখ প্রায় ঠিকরে পড়ছে। সবাই ঝুঁকে পড়ে দেখতে চায় কী বের হয়, পুরুষ মানুষের মাথা না মেয়ে মানুষের মাথা।
ইতিমধ্যে কনস্টেবলটি আস্তে আস্তে পুঁটলিটা খুলতেই সবাই হতবাক -না, কাটা মুন্ডু না - বরঞ্চ বলা যায় ‘মুন্ডুকাটা’। মুন্ডুকাটা কটি নধর মুরগী বা মোরগ। সেই পিকনিক পার্টির সম্পত্তি।
শেষ
No comments:
Post a Comment