ভোম্বলমামার কালোয়াতি


 ভোম্বলমামার কালোয়াতি -
লেখক: চিত্তরঞ্জন সেনগুপ্ত

 

আগেই বলেছি, ছোটনাগপুর উপত্যকার সংলগ্ন পাহাড় ও অরণ্যে ঘেরা আমাদের ছোট্ট আধা-শহরটি ছিল লাক্ষা শিল্পের একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র। ব্যবসার সূত্রে বাঙালি, বিহারি, মারোয়াড়ি, মির্জাপুরি, মাদ্রাজি, পঞ্জাবি, সকল অঞ্চলের মানুষই বসতি করেছিলেন। এবং সবার মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতিও বেশ নিবিড় ছিল।সকল সম্প্রদায়ের মানুষই মিলেমিশে নিজেদের সামাজিক বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলি উদযাপন করতেন, এমনি একটি মিনি-ভারতবর্ষের মিশ্র সংস্কৃতির আবহাওয়ায় আমাদের ছেলেবেলাটা কেটেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতায় বোমা পড়ার আতঙ্কে যে ক’টি পরিবার আমাদের আধা-শহরে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই পরিবারের একজন মেজদা এবং আরেকজন ভোম্বলমামা। এদের দু’জনারই কীর্তিকাণ্ডের কিছু-কিছু কথা আনন্দমেলার মারফত তোমরা জানো। এসব পড়ে ভোম্বলমামা, যিনি এখন তাঁর ছেলের কাছে তৈলসাম্রাজ্য আরব দেশে বাস করেন, সেখান থেকে তাঁর নিজস্ব ইংরেজিতে আমায় চিঠি লিখে জানিয়েছেন, 'মি ভেরি প্লিজড টু রিড দি স্টোরিজ অব মাই ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফ্যাক্টরিজ’ অর্থাৎ ‘আমার কান্ড-কারখানার গল্প পড়ে খুব খুশি হয়েছি’। সেই ভোম্বলমামা আমাদের শহরে এসে কীভাবে, কালোয়াতি গানে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন, এটা তারই গল্প।

নিতাইজেঠু, অর্থাৎ মেজদার বাবা ছিলেন সম্পর্কে ভোম্বলমামার ভগ্নিপতি। দু’জনেই ছিলেন সঙ্গীতরসিক। দু'জনেই ভাল কালোয়াতি গান গাইতে পারতেন। উপরন্তু, ভোম্বলমামা ওস্তাদ তবলচি ছিলেন। নিতাইজেঠুর বাড়িতে একটা গানবাজনার আড্ডা গড়ে উঠেছিল। ভোম্বলমামা আসার পর তা আরও জমে উঠল। মাঝেমাঝে শ্রোতা হিসেবে আমরাও সেই আড্ডায় শামিল হতাম, তবে সেটা দিন-বিশেষে, মানে যে-দিনগুলোতে শ্রোতাদের জিবেগজা, কড়াইশুঁটির কচুরি অথবা মাংসের চপ সহযোগে আপ্যায়ন করা হত। তার খবর মেজদা আগেভাগেই আমাদের দিয়ে রাখত। নিতাইজেঠু আর ভোম্বলমামার মধ্যে গানের সুর, তাল, লয় নিয়ে প্রায়ই তর্ক-বিতর্ক হত। আমরা কচুরি বা চপ খেতে-খেতে ওঁদের ঝগড়া উপভোগ করতাম, কারণ ওঁদের গানের আমরা কিছুই বুঝতাম না। অধিকাংশই হিন্দি ক্ল্যাসিক্যাল। বিল্টু সমঝদারের মতো মাথা দোলাত আর পরে আমাদের গানের অর্থ বোঝাবার চেষ্টা করত। আমরা কিন্তু কচুরি-সিঙাড়ার মাধুর্যেই বুঁদ হয়ে থাকতাম। মেজদাও। তবে মাঝেমধ্যে ভোম্বলমামার প্রতি আনুগত্যের খাতিরে মেজদাকেও মাথা দোলাতে হত, প্রায়শই বেতালা।

ছোট্ট শহর। কোনও খবরই কারও অজানা থাকে না। নিতাইজেঠুর কথা সবার আগে থেকেই জানা ছিল। ভোম্বলমামা আসার পরেই সবাই যেন কীভাবে জেনে গেল যে, শহর কলকাতা থেকে ওস্তাদ গাইয়ের আর্বিভাব হয়েছে৷ বিশেষত মির্জাপুরি মহল্লায়, কারণ ওখানেই গানের চর্চা ছিল বেশি। কুঠিয়াল লালচাঁদ জয়সোয়ালের গদিতেই গানের আসর বসত। ওখানে নিতাইজেঠুও আমন্ত্রিত হতেন। হোলির সময় বেশ বড় ধরনের আসর বসত। সেবার হোলির আগে খবর এল, এবার লালচাঁদবাবুর গদিতে যে গানের আসর বসবে, তাতে নিতাইবাবু আর কলকাত্তাইয়া ওস্তাদ ভোম্বলবাবুর আসা চাইই। আগ্রহী শ্রোতাদেরও সাদর নিমন্ত্রণ।

সেই হোলি উৎসবেরই আগের দিন। তখন দুপুর। নিতাইজেঠু গাইছেন। তবলা সঙ্গত করছেন ভোম্বলমামা। গিটকিরি চলছে। নিতাইজেঠুর গলায় যেন মেঘ গর্জন করছে। বেশ দ্রুত তালের গান। ভোম্বলমামার চার ফুট দশ ইঞ্চি হাইট। বসে থাকলে দু'ফুট কমে যায়। তার অর্ধেক তবলায় ঢাকা, কিন্তু আঙুলগুলো যেন মেশিনের মতো দ্রুত চলছে। একবার সমের মুখে এসে তবলা বন্ধ করে ভোম্বলমামা বললেন, “এটা কী হল জামাইবাবু? প্রতিবার একটা মাত্রা মিস করছেন, আমাকে সেটা মেক-আপ দিতে হচ্ছে”।

নিতাইজেঠু বোধহয় ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। বললেন, “দ্যাখো ভোম্বল, গায়ক হচ্ছে ইঞ্জিন, তবলচি হচ্ছে বগি। ইঞ্জিন যেমন যাবে, বগিকে তেমনি তার পিছন-পিছন যেতে হবে।”ভোম্বলমামা বললেন, “ভুল বললেন জামাইবাবু, গায়ক হচ্ছে ইঞ্জিন, আর তবলচি-হচ্ছে রেল-লাইন। ইঞ্জিনকে ঠিক পথে নিয়ে যাওয়াই যার কাজ। এতটুকু বে-লাইনে গেলেই অ্যাকসিডেন্ট !”

নিতাইজেঠু বললেন, “ঠিক আছে, নাও, অন্য গান ধরছি”।

তারপর অন্য একটা গানের আলাপ শুরু করতেই ভোম্বলমামা বললেন, “জামাইবাবু, এটা হচ্ছে কী? এই ভর-দুপুরে সন্ধ্যার গান ধরলেন ?” নিতাইজেঠু বললেন, “তোমার সব কিছুতেই খুঁত ধরা অভ্যেস, ভোম্বল। এটা দুপুর হলেও বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখেছ ? আকাশ জুড়ে মেঘ জমেছে। চারদিকে অন্ধকার। সন্ধ্যার লক্ষণাত্রান্ত এই দুপুরে এ-গান অনায়াসে গাওয়া যায়”।

ভোম্বলমামা বললেন, “আপনার পাঁঠা আপনি যেদিক দিয়ে খুশি কাটুন, কিন্তু আমি কাটারি ধরতে পারব না।”ভোম্বলমামা তবলা ছেড়ে উঠে গেলেন। “আরে শোন্‌, শোন্‌ ভোম্বল”। বলতে বলতে নিতাইজেঠুও ছুটলেন ভোম্বলমামার পিছু-পিছু।

মেজদা বলল, “ভোম্বলমামাকে বাবা বড্ড তোয়াজ করেন।” বিল্টু বলল, “সারে দুনিয়া একতরফ, অওর মামাজি এক তরফ। আমাদের বাড়িতেও যখন মামাজি আসেন, তখন পরব লেগে যায়। আচ্ছা খানা, আচ্ছা পহননা। আর দুষ্টুমি করলেও নো ধমক, নো গালাগালি, নট কিচ্ছু”।

মেজদা বলল, “একজাক্টলি। এই আমাকেই দ্যাখ্ না। রাতদিন মামার সঙ্গে থাকি। কারও কিছু বলার সাহস আছে ? ইভাদি, ডায়নাদি তখন একেবারে ভিজে বেড়ালটি, নইলে সারাদিন ধরে আমার পিছনে লাগা। দিনরাত মা’কে বলে, “মা, মেজো এটা করছে না। মা, মেজো ওটা করছে না।”

বাড়িতে মেজদাকে ইভাদি, ডায়নাদির শাসনের মধ্যে থাকতে হয়। এখন ভোম্বলমামার আসার পর রাশ খানিকটা টিলে হয়েছে, সেই সুখেই বুঁদ হয়ে আছে মেজদা।

বিল্টু বলল, “আমি বলি কি, এক কাম করো মেজদা, মামাজির থাকাটা পার্মানেন্ট করে নাও, তা হলে জীবনভর আরামে থাকবে।” মেজদা অন্যমনস্ক হয়ে বলল, “সেই চেষ্টাই তো করছি। কাল তা হলে তোরা আসছিস তো ?”

আমি বললাম, “কোথায়?”

মেজদা বলল, “লালচাঁদজির গদীতে কাল গানের আসর বসবে। জমজমাট ব্যাপার। বাবা আর ভোম্বলমামাও যাবেন। ছোটদের জন্যও কচুরি আর জিলিপির ঢালাও ব্যবস্থা।”

গানের জন্য আমরা তেমন আগ্রহবোধ না করলেও কচুরি আর জিলিপির নাম শুনে উৎসাহিত হলাম। বিল্টু বলল, “যব নিতাইজেঠু আর মামাজির যুগলবন্দী গানের প্রোগ্রাম, তব তো জানাই পড়েগা।” যেন নিতান্তই গানের জন্য যাওয়া।

আমি বললাম, “আর কচুরি-জিলিপি কা ভি প্রোগ্রাম হ্যায়।”বিল্টু বলল, “হম গানামে জায়দা ইন্টারেস্টেড। ও-সব কচোরি-জিলেবি সেকেন্ডারি।”

সকাল থেকে শুরু হলেও হোলির মাতামাতি শেষ হতে দুপুর গড়িয়ে গেল। আমাদের শহরে হোলি ছিল সকলের কাছেই বিশেষ প্রিয় অনুষ্ঠান। দোলপূর্ণিমার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই অবাঙালি মহল্লায় ঢোল বাজিয়ে গান শুরু হয়ে যেত। প্রতি রাতেই। আমরাও শুনতে যেতাম। তারপর দোলপূর্ণিমার আগের রাতে হৈহৈ করে হোলি জ্বালানো হত। সে-রাতে কাঠের তৈরি কোনও জিনিস কেউ বাইরে রাখত না। কারণ সারারাত ধরে হোলি জ্বালাবার তাগিদে গেরস্থ-বাড়ির বাইরে পড়ে থাকা জ্বালানি কাঠ, অথবা খাটিয়া অথবা টেবিল, চেয়ার বা পুরনো দরজা-জানলার ফ্রেম, কিছুই আস্ত থাকত না। গেরস্থরা সেদিন সবাই খুব সজাগ থাকতেন। সকাল থেকে শুরু হত হোলির উৎসব। দুপুর বারোটা নাগাদ লরিতে করে দল বেঁধে বেরোতেন বাঙালি, বিহারি, মির্জাপুরি, পঞ্জাবি ও মাদ্রাজি বাবুরা। উৎসব শেষ হতে দুপুর গড়িয়ে যেত। তারপর একপ্রস্থ আবির খেলা শুরু হত সন্ধেবেলায়। তখন সবাই ধোপদুরস্ত আদ্দি অথবা মলমলের গিলে করা পাঞ্জাবি আর পাজামা বা ধুতি পরে, খুশবুদার আতর লাগিয়ে বেরোতেন। সঙ্গে সুগন্ধি আবির। কপালে আবির দিয়ে কোলাকুলি করতেন, মিষ্টি খেতেন আর খাওয়াতেন।

দুপুরের পর থেকেই আমরা ছটপট করছিলাম কখন সন্ধে হয়। কারণ, -- জলসা। সেদিন যেন সন্ধে বেশ একটু দেরি করেই নামল। আমি, বিল্টু আর মেজদা যখন লালচাঁদবাবুর গদিঘরে পৌছলাম, তখন শহরের বিশিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সেখানে পৌঁছে গেছেন। ঘর জুড়ে ফরাস বিছানো ছিল। তার ওপর বিশাল সাইজের কোলবালিশ, যাকে ওরা বলে গিদ্দা, ছড়ানো ছিল। একটা গিদ্দাকে কক্জা করে আমরা কোণের দিকে পরিপাটি করে বসলাম।

আসরের মাঝখানে হার্মোনিয়াম আর তানপুরা। নিমকাঠের তৈরি তবলা আর তামার তৈরি বাঁয়া। আর একটি সারেঙ্গী। পরে জেনেছিলাম, সারেঙ্গীটা পঞ্চকোটরাজের সভাগায়ক বাঁকে মিশিরের। উনি সারেঙ্গি ছাড়া গান না। ধীরে-ধীরে মজলিশ বেশ জমে উঠল। আবির মাখানোর অনুষ্ঠানটা শেষ হওয়ার পরেই গানের অনুষ্ঠান আরম্ভ হল। ইতিমধ্যে কচুরি-জিলিপি বিতরণও শুরু হয়েছিল।

প্রথম গান ধরলেন বাঁকে মিশিরজি। তাঁর সঙ্গে তবলা সঙ্গত করলেন ভোলা ওস্তাদ। ঝাড়া একঘন্টা। গান শেষ হতেই মেজদা ফিসফিস করে বলল, “কী অসাধারণ মীড়, গমক, গিটকিরি”।

গোলমালের মধ্যে ঠিকমতো শুনতে না পেয়ে বিল্টু জিজ্ঞেস করল, “গিরগিটি? উও ক্যা?”

মেজদা বিরক্ত হয়ে বলল, “তোমার মাথা। কক্সকম্ব কোথাকার!”

তারপর গান ধরলেন আমাদের শহরেরই কেশর ওস্তাদ। উনি অবশ্য বেশি সময় নিলেন না। আধঘণ্টার মধ্যেই শেষ করলেন। তারপর নিতাইজেঠু। তবলা সঙ্গতে ভোম্বলমামা। সে একটা দেখার মতো দৃশ্য। বিশালবপু নিতাইজেঠু, তাঁর পাশে ভোম্বলমামা- যাঁর হাইট চারফুট দশইঞ্চি, এবং ওজন সর্বসাকুল্যে উনচল্লিশ কেজি। বিশাল তবলাটা ওঁর শরীরের প্রায় অর্ধেকটা ঢেকে রেখেছিল। নিতাইজেঠু ধীরেসুস্থে তখনকার সেই বিখ্যাত গান ধরলেন, ‘এলো ফাগুন, এল হোলি’। আলাপ এবং তাল-লয়-বিস্তার নিয়ে পুরো একটি ঘণ্টা। দ্রুত লয়ে গাইবার সময় ভোম্বলমামার আঙুলগুলো যেন হরিণের মতো দৌড়চ্ছিল। মাথাটাও সবেগে এ-পাশে ও-পাশে নড়ছিল, চৈত্রের ঝোড়ো হাওয়ায় তালগাছের মাথা যেমন নড়ে।

গানের মধ্যেই নানা প্রশংসার ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। “বহোত আচ্ছা”, “লা-জবাব”, “ক্যা খুব, ক্যা খুব” ইত্যাদি। মেজদা বলল, “এটাই রেওয়াজ। গান যেমনই হোক, প্রশংসা করতেই হবে। না হলে গুণিজনের অসম্মান করা হয়”। আমাদের তখন সেকেণ্ড রাউণ্ড কচুরি-জিলিপি সবে শেষ হয়েছে। সেই সময় দরাজ গলায় গান ধরলেন গৃহকর্তা লালচাঁদ জয়সোয়ালজি। তৈরি গলা। একসময় লখনউয়ের ভাতখণ্ডে মিউজিক কলেজে সঙ্গীত শিক্ষা করেছিলেন। তবলায় ভোম্বলমামা। একে গৃহকর্তা তায় আজকের ভূরিভোজনের আয়োজন, এজন্য প্রশংসা বেশ ভালই জুটল। আমরাও কচুরি-জিলিপির প্রেরণায় একটু বেশিক্ষণ ধরেই হাততালি দিলাম।

এবার লালচাঁদজি বললেন, “ইয়ে সোব বাংলা আউর হিন্দি গানা তো বহোত শুনলাম, ভোম্বলদাসজি শুনেছি দেশ-বিদেশ ঘুরে এসেছেন, একটা বিলাইতি ক্ল্যাসিক্যাল যদি শুনান, তা হলে বহোত আনন্দ পাই”।

মেজদা আঁতকে উঠল। ফিসফিসিয়ে বলল, “বিলিতি ক্ল্যাসিক্যাল ? সে আবার কী জিনিস?” ভোম্বলমামা, তখন তাঁর ইংরেজি ছেড়ে বিশুদ্ধ বাংলায় বললেন, ভারতবর্ষটা ঘুরেছি, কিন্তু দেশের বাইরে কখনও যাইনি লালচাঁদজি”। লালচাঁদজি বললেন, “তো ঠিক আছে, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত তো ঘুরিয়েসেন”।

ভোম্বলমামা বললেন, “তা ঘুরেছি। তবে এত করে যখন বলছেন, তখন একটা, বিদেশী গানই আপনাদের শোনাব। কাবুলি খাম্বাজ”। লালচাঁদজি বললেন, “ইয়া কি কাবুল দেশের গান?”

ভোম্বলমামা শ্রোতাদের দিকে ভাল করে তাকিয়ে বললেন, “হ্যাঁ”। তারপর, শুরু করলেন। প্রথমে আলাপ প্রায় মিনিট কুড়ি। তারপর অস্থায়ীটা ধরতেই গানের ভাষা শুনে তবলচি ভোলা ওস্তাদের চোখ ছানাবড়া। হাত দুটো দিশেহারা হয়ে সম খুঁজছে। গানের প্রথম লাইনটা এই রকম। “কালে ঠিয়ামি নেনে লি”।

দু’বার গাওয়ার পর ভোম্বলমামা যখন বুঝলেন যে, ভোলা-ওস্তাদ সম খুঁজে পাচ্ছেন না, তখন গানের মাঝখানেই বললেন, “প্রথম নে’তে সম্‌।” সমের হদিস পেয়ে ভোলা ওস্তাদ তড়বড়িয়ে তবলা বাজানো শুরু করলেন। ভোম্বলমামা তখন অন্তরাতে পৌঁছেছেন। পুরো গানটা এই রকম :

কালে ঠিয়ামি নেনে লি

রাদিন মিন লয়ে লি

দেশ রেন হার রুজনে

মিন ইজ রিল নে।

একঘন্টা পনেরো মিনিট গাওয়ার পর শেষ করলেন ভোম্বলমামা। আসরে তখন ধন্য ধন্য রব। লালচাঁদজি বললেন, “য়্যাসা গানা কভি নেহি শুনা। ক্যা তান, ক্যা গমক”।

তারপর শেষ রাউণ্ড কচুরি-জিলিপি খাওয়ার পর আমরা যখন বিদায় নিলাম, রাত তখন বারোটা।

পথে আসতে আসতে আমি বললাম বিল্টুকে, “চমৎকার গেয়েছেন ভোম্বলমামা, না রে?” বিল্টু বলল, “সহি বাত। কিন্তু কাবুলি ভাষায় হরেক শব্দে একটা করে জেড্‌ থাকে। মামাজির গানের মধ্যে কোথাও কোনও এক্স, ওয়াই, জেড নেই”। বোঝা গেল, বিল্টু গানের ভাষা নিয়ে সন্ধিগ্ধ।

পরদিনই সে সন্দেহের নিরসন হল। মেজদাদের বাড়ি গেছি আমি আর বিল্টু দু’জনেই। তখন বৈঠকখানায়, বসে-বসে দাবা খেলছিলেন নিতাইজেঠু আর ভোম্বলমামা।

নিতাইজেঠু বললেন, “আচ্ছা ভোম্বল, তুমি ওই কাবুলি গান কোথায় শিখলে বলো তো?”

ভোম্বলমামা হোহো করে হেসে বললেন, “কে বলল ওটা কাবুলের গান? ওঁরা বিলাইতি ক্ল্যাসিক্যাল শুনতে চাইলেন, তা দেখলাম শ্রোতাদের মধ্যে কেউ কাবুলি নেই। তখন একটা বিশুদ্ধ বাংলা কবিতার প্রতিটি শব্দের প্রথম অক্ষরটা ড্রপ করে দিয়ে একটা গান বানিয়ে সেটাকে খাম্বাজের ছাঁচে ফেলে দিলাম”।

নিতাইজেঠুর চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। বললেন, “তা, বাংলা কবিতাটা কী?”

ভোম্বলমামা বললেন, “একটা কবিতাই আমার মনে ছিল, “সকালে উঠিয়া আমি মনে-মনে বলি” -- তাও চার লাইন, এই দিয়েই তৈরি কাবুলি খাম্বাজ”। নিন, এবার আপনার রাজা সামলান।”

নিতাইজেঠু বললেন, “আর রাজা, আমি এখন নিজেকে সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছি”। বিল্টু বলল, “আমি আগেই বলেছিলাম”।

কিন্তু গানের সুরটা আমাদের মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। বহুদিন ধরে বিপ্টুকে গুনগুনিয়ে গাইতে শোনা যেত, -- “কালে ঠিয়ামি নেনে লি”।

কাবুলি খাম্বাজের প্রথম লাইন।

[ছবি: দেবাশিষ দেব]

(শেষ)

No comments:

Post a Comment