মায়ের মুখ



লেখক : শৈবাল মিত্র



স্কুল থেকে ফিরে ইউনিফর্ম ছেড়ে চিঁড়ে-দই-কলার ফলার খেয়ে শিঞ্জিনী আজ সোজা পড়তে বসে গেল। ক্লাস ফাইভের ফাস্ট গার্ল হলেও এই বিকেল চারটের সময় শিঞ্জিনী কোনওদিন পড়তে বসে না। পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে বাঘবন্দী অথবা রুমালচোর খেলে ঠিক সন্ধে ছ’টার সময় পড়তে বসে। কিন্তু আজ সেটা করার উপায় নেই। আজ ঠিক সন্ধ্যে সাড়ে ছটার সময় মা-বাবার সঙ্গে শিঞ্জিনী যাবে যোধপুর পার্কে, মেজোজেঠুর বাড়ি। অফিস থেকে বাবা বাড়ি ফিরবেন সাড়ে পাঁচটায়। তারপর হাতমুখ ধুয়ে বাবা একটু বিশ্রাম করার পর, ছটা নাগাদ কসবার এই বাড়ি থেকে বেরোলে অনায়াসেই সাড়ে ছটার মধ্যে মেজোজেঠুর বাড়ি পৌঁছনো যাবে।

প্রায় ছ’ বছর বাদে ছোটকাকা আজ সকালে বিলেত থেকে কলকাতায় এসেছেন। দমদম বিমানবন্দর থেকে ছোটকাকা গিয়ে উঠেছেন যোধপুর পার্কে, মেজোজেঠুর বাড়িতে। কলকাতায় ছোটকাকা মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা থেকে কাল দুপুরের ফ্লাইটে ব্যাঙ্কক যাবেন। সেখান থেকে ফিরবেন লন্ডনে। ছ’ বছর আগে শিঞ্জিনী যখন ছোটকাকাকে দেখেছিল, তখন তার বছর চারেক বয়স। খুব আবছা হলেও ছোটকাকার ঝকঝকে চেহারা, হাসিখুশি -মুখ শিঞ্জিনীর আজও মনে আছে। মনে থাকার আরও একটা কারণ, সেবার ছোটকাকা অনেক চকোলেট আর লজেন্স দিয়েছিলেন শিঞ্জিনীকে। সেসব চকোলেট, লজেন্সের স্বাদ শিঞ্জিনী এখনও ভুলতে পারেনি। বারো-তেরো বছর আগে, শিঞ্জিনীর তখনও জন্ম হয়নি, ছোটকাকা বিলেতে গিয়েছিলেন। সেই যে গেলেন, আর ফেরা হয়নি, বিলেতে থেকে গেলেন। বিলেতের একটা নামী প্রতিষ্ঠানে ইঞ্জিনিয়ার ছোটকাকা এখন বিরাট চাকরি করেন। বছরে তিন-চার মাস প্লেনে চেপে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ান।

আজ সকালে, স্কুলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত শিঞ্জিনীর মনে ছোটকাকাকে দেখার জন্য যে উত্তেজনা টলটল করছিল, এখন আর সেটা নেই। স্কুল ছুটি হওয়ার আগেই, সেই থার্ড পিরিয়ড থেকে তার মন খুব খারাপ, বেজায় মুষড়ে পড়েছে সে। পড়তে বসেও তার মাথা থেকে স্কুলের দুশ্চিন্তা কাটেনি। টেবিলের ওপর খুলে রাখা ভূগোল বইয়ের পাতায় শূন্য দৃষ্টি মেলে মাঝে-মাঝে মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে তার বলতে ইচ্ছা করছিল, “মা আমাকে কেন ইংরেজি স্কুলে পড়ালে না? আমি কি দোষ করেছি? ভাল করে ইংরেজি না শিখে আমি আর স্কুলে যাব না”।

কথাগুলো মা’কে বলার জন্যে মনের মধ্যে জোর তাগিদ থাকলেও শিঞ্জিনী চেয়ার ছেড়ে উঠল না। ভূগোলের দুর্বোদ্ধ লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে তার বারবার শুধু কাবেরীদির ইংরেজির ক্লাসের কথা মনে পড়তে থাকল।

এ বছরে, এই ক্লাস ফাইভ থেকেই শিঞ্জিনীদের ইংরেজি পড়ানো শুরু হয়েছে। এ বি সি ডি শেষ করে, “সান মানে সূর্য, মুন মানে চাঁদ, স্কাই মানে আকাশ”, এসব পড়িয়ে মাসখানেক বা মাস দেড়েক হল কাবেরীদি ছোট ছোট ট্রান্সলেশন করাচ্ছিলেন। হঠাৎ কোনও একটা ইংরেজি স্কুল থেকে সেরা ব্যানার্জি এসে ফাইভে ভর্তি হবার পর, শিঞ্জিনীদের ক্লাসের আবহাওয়া বদলে গেল। সেরার মতো একজন ইংরেজি জানা ছাত্রী পেয়ে কাবেরীদি এতো খুশি হলেন যে, ক্লাসের বাকি ছাত্রীদের কথা তাঁর মন থেকে মুছে গেল। সেরার দিকে তাকিয়ে সেরার মতো করে তিনি ক্লাসে ইংরেজি পড়াতে শুরু করলেন। নার্সারি থেকে ক্লাস ফোর পর্যন্ত ইংরেজি স্কুলে পড়ায় ইংরেজি লেখায় আর বলায়, সেরা যে অনেক পাকা আর নির্ভুল হবে, এটা বুঝতে কাবেরীদির মতো একজন অভিজ্ঞ, সহৃদয় টিচারের অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কী আশ্চর্য, কাবেরীদি সেটা বুঝলেন না। এখন ইংরেজির ক্লাসে কাবেরীদি সবসময় ‘সেরা’, ‘সেরা’ করেন। এমনকী, যে শিঞ্জিনী এই স্কুলে ক্লাস ওয়ান থেকে ফোর পর্যন্ত ফি-বছর প্রথম হচ্ছে, তাকেও যখন-তখন যাচ্ছেতাই বলেন। যেসব ট্রান্সলেশন কিছুদিন ধরে কাবেরীদি ক্লাসে করাচ্ছেন, সেগুলো সেরা ছাড়া আর কেউ পারে না। মেয়েরা বুঝতে পারে যে, শুধু সেরার জন্যেই কাবেরীদি ইংরেজি পড়াচ্ছেন, কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস পায় না।

পরশুদিন ক্লাসে ঢুকেই শিঞ্জিনীকে কাবেরীদি প্রশ্ন করেছিলেন, “আকাশ মেঘে কালো হয়ে আছে, এর ইংরেজি কী আকাশ, মেঘ, কালো, এই তিন শব্দের ইংরেজি জেনেও পুরো বাক্যটা তৈরি করতে গিয়ে শিঞ্জিনী খুব বিপন্ন বোধ করছিল। তবুও ঢোক গিলে, আমতা-আমতা করে সে বলেছিল, “দি স্কাই ইজ ব্ল্যাক।”

বলেই শিঞ্জিনী বুঝেছিল, বাক্যের মধ্যে মেঘ শব্দটা নেই, মেঘ বাদ পড়ে গেছে। কিন্তু কীভাবে মেঘকে আনবে, ভেবে পায়নি।

অবজ্ঞার সঙ্গে একপলক শিঞ্জিনীকে দেখে কাবেরীদি সেরার দিকে তাকাতে সে লাফিয়ে উঠে বলেছিল, “দ্য স্কাই ইজ ডার্ক উইথ ক্লাউড।”

সেরার মুখের ওপর মুগ্ধ দৃষ্টি ছড়িয়ে কাবেরীদি বলেছিলেন, “সেরা সব বিষয়ে সেরা।”

কাবেরীদি বসতে না বলায় শিঞ্জিনী তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর সারা পিরিয়ড শিঞ্জিনী আর বসার অনুমতি পায়নি। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকার সময় তার দু’চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছিল। গতকালও এরকম একটা কঠিন ট্রানস্লেশন, ‘দুটো হাত মানুষের সম্পদ’ – এর ইংরেজি, কাবেরীদি জিজ্ঞেস করেছিলেন শিঞ্জিনীকে।

শিঞ্জিনীর কান দুটো লাল হয়ে উঠেছিল, মাথা ঘুরছিল ভনভন করে, ‘দুটো হাত’ আর ‘মানুষ’-এর ইংরেজি জানা থাকলেও ‘সম্পদ’ শব্দের ইংরেজি সে জানত না। শব্দহীন শিঞ্জিনীকে কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাবেরীদি ধমক দিয়ে বলেছিলেন, “অপদার্থ, এরা আবার ক্লাসে ফার্স্ট হয়!”

তখনই সেরা উঠে দাঁড়িয়ে নির্ভুল ইংরেজি, নিখুঁত উচ্চারণে ট্রানস্লেশন করেছিল।

গত পনেরো দিন, ক্লাসে এই কাণ্ড, শিঞ্জিনী অসহায়, দিশেহারা, কী করবে ভেবে পায় না। মাত্র পাঁচ মাস আগে তাদের ইংরেজির অক্ষর পরিচয় হয়েছে ; ট্রানস্লেশন শুরু হয়েছে, এখনও দেড়-দু মাস হয়নি। এতদিন যে ট্রানস্লেশন কাবেরীদি করাতেন, সেগুলোও ছিল খুব সহজ, সরল। যেমন, “মানুষের দুটো হাত আছে”, “আকাশের রঙ লাল”, “সকালে সূর্য ওঠে”, এমন সাদামাঠা সহজ ট্রানস্লেশনের পর হঠাৎ যদি জটিল বাক্যের কঠিন ট্রানস্লেশন দেওয়া হয়, মেয়েরা পারবে কী করে?

শিঞ্জিনী ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল, যা সে পারে না, কোনও মেয়েই পারে না, শুধু সেরা পারে। শিঞ্জিনীর মনে হয়, তাকে অপদস্থ অপমানিত করার জন্যেই যেন কাবেরীদি ক্লাসে আসেন। তাই ইংরেজির ক্লাসে আতঙ্কে শিঞ্জিনী সিঁটিয়ে থাকে। কিন্তু কাবেরীদি যে কেন তাকে এত হেনস্থা করেন, শিঞ্জিনী ভেবে পায় না। সে কোনওদিন কাবেরীদির সঙ্গে উদ্ধত, খারাপ ব্যবহার করেনি ৷ কোনও দিদির সঙ্গেই শিঞ্জিনী তা করে না। স্কুলের দিদিরা শিঞ্জিনীকে বিনয়ী, বাধ্য, নম্র, মেধাবী মেয়ে বলে জানেন। শুধু লেখাপড়ায় নয়, নাচ, গান, আবৃত্তি, বিতর্ক, ছবি আঁকাতেও স্কুলে শিঞ্জিনী অপ্রতিদ্বন্দী, তার জুড়ি নেই। স্কুলের বাইরে নানা প্রতিযোগিতাতেও শিঞ্জিনী অনেক পুরস্কার পেয়েছে। এখনও পায়। চৌকস, মেধাবী ছাত্রী হিসেবে গত পাঁচ বছর স্কুলে দিদিদের উচ্ছুসিত প্রশংসা শিঞ্জিনী পেয়েছে। কাবেরীদিও খুব স্নেহ করতেন শিঞ্জিনীকে, স্নিগ্ধ, নরম গলায় কথা বলতেন শিঞ্জিনীর সঙ্গে। সেই কাবেরীদি গত তিন মাসে একদম পালটে গেছেন। ইংরেজি না জানার জন্যে কথায়-কথায় শিঞ্জিনীকে লাঞ্ছনা করেন। কিন্তু স্কুলে যতটুকু ইংরেজি শেখানো হয়েছে, সেটুকু শিঞ্জিনী শিখেছে; সে শেখায় কোনও ভুল, ত্রুটি, অবহেলা নেই, একথা কাবেরীদি ভাবেন না। কারেরীদিকে এখন তাই শিঞ্জিনীর ভারী নিষ্টুর, হৃদয়হীন মনে হয়।

কাবেরীদির দেখাদেখি ক্লাসের কিছু মেয়েও আজকাল একটু ঘুরিয়ে, পরোক্ষে শিঞ্জিনীকে অপমান, অবহেলা করছে। তারা এখন সব সময়ে সেরার সঙ্গে মেশে, খেলে, থাকে, সেরার প্রশংসায় তারা পঞ্চমুখ। আড়ালে তারা বলে, ‘ক্লাসে সেরা এসেছে, শিঞ্জিনীকে আর ফাঁকতালে ফার্স্ট হতে হবে না’।

এরকম মেয়ের সংখ্যা ক্লাসে কম হলেও, এদের কথায়, ব্যবহারে শিঞ্জিনী খুব দুঃখ পায়। ইংরেজি ছাড়া বাকি সব বিষয়ে সে যে এখনও ক্লাসে অদ্বিতীয়, ফার্স্ট, এটা জেনেও শিঞ্জিনীর মনের মধ্যে কেমন এক বিষণ্ণতা, হেরে যাওয়ার গ্লানি জমতে থাকে। প্রায়ই তার মনে হয়, বাবাকে বলে এই স্কুল ছেড়ে দিয়ে নতুন একটা স্কুলে ভর্তি হবে। সেখানে কেউ তাকে অপমান, অবহেলা করবে না, লজ্জা দেবে না। সবচেয়ে বড় অসুবিধে হল যে, শিঞ্জিনী এমন মুখচোরা মেয়ে যে, এসব কথা সে বাড়িতে মা-বাবাকে বলতে পারে না। তা ছাড়া স্কুলের কোনও দিদির নামে বাড়িতে নালিশ করতে শিঞ্জিনীর ভারী সঙ্কোচ হয়, লজ্জা করে; মনে হয়, সে যেন নিজের বিরুদ্ধে নালিশ করছে। তা সত্ত্বেও শিঞ্জিনীর মুখ দেখে কিছু একটা আঁচ করে, দু-একদিন মা প্রশ্ন করেছেন, “তোর মুখটা শুকনো! কেন? স্কুলে কারও সঙ্গে ঝগড়া করেছিস? দিদিরা বকেছেন?”

মায়ের প্রশ্নে থতমত শিঞ্জিনী জবাব দিয়েছে, “নাহ্‌, কিছু হয়নি তো!”

মা আর কোনও প্রশ্ন করেননি। মাঝে কয়েক দিন শিঞ্জিনীকে পড়াতে বসে তার ইংরেজির খাতা দেখে অবাক হয়ে মা প্রশ্ন করেছেন, “এত কঠিন ট্রানস্লেশন, তুই পারিস?”

ম্লান হেসে একটা জড়ানো উত্তর দিয়ে মায়ের হাত থেকে শিঞ্জিনী রেহাই পেতে চেয়েছে। তারপর মায়ের সাহায্য নিয়েই শিঞ্জিনী ইংরেজির হোমটাস্ক করেছে। কিন্তু আজ থার্ড পিরিয়ডে ইংরেজি ক্লাসের পর শিঞ্জিনীর মনটা এমন খারাপ হয়ে গেল, যা আগে কখনও হয়নি। তার ধারণা হল, সে ইংরেজি জানে না, সে হতভাগ্য, ভারী দুঃখী, তার বেঁচে থাকার কোনও মানে নেই। থার্ড পিরিয়ডে ঘটনাটা হয়েছিল এরকম : ক্লাসে ঢুকে কাবেরীদি ইংরেজিতে বলেছিলেন, “তোমরা কে কী হতে চাও, ইংরেজিতে বলো।”

কথাটা শেষ করে অজন্তার দিকে আঙুল তুলে কাবেরীদি বললেন, “ইউ…”।

কাবেরীদির তীরের মতো উঁচিয়ে থাকা আঙুল দেখে অজন্তা ভয়ে-ভয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। বেচারি অজন্তা! কাবেরীদির ইংরেজি কথার একটা বর্ণও সে বুঝতে পারেনি। বুঝলেও ইংরেজিতে কিছু বলা তার ক্ষমতার বাইরে।

অজন্তার বোবা মুখের দিকে কয়েক সেকেণ্ড রাগী চোখে তাকিয়ে থেকে কাবেরীদি বলেছিলেন, “নাট!”

অজন্তার পরেই শিঞ্জিনীকে দাঁড়াতে হল। প্রশ্নটা বুঝেও ইংরেজিতে নিজের জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে গড়গড় করে বলে যাওয়া যাওয়া শিঞ্জিনীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। ঢোক গিলে, টিমে তালে দু-একটা ইংরেজি বাক্য শিঞ্জিনী বলার চেষ্টা করেছিল। ঠিকমতো প্রকাশ করতে না পারলেও অনেক কিছু বলার তীব্র আকুলতা তার বুকের মধ্যে ফুঁসে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, দিদি বাংলায় বলার অনুমতি দিলে অনেক কথা সে গুছিয়ে বলতে পারত।

শিঞ্জিনীর ইংরেজি বলার আপ্রাণ চেষ্টার মাঝখানেই কাবেরীদি বললেন, “রাবিশ, অনেক হয়েছে, এবার থামো!”

অপমানে কালো হয়ে গিয়েছিল শিঞ্জিনীর মুখ। শিঞ্জিনীর দিকে না তাকিয়ে কাবেরীদি চোখের ইঙ্গিতে সেরাকে বলতে বললেন। সেরা উঠে দাঁড়িয়ে ইংরেজিতে গড়গড় করে নিজের জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে দু-তিন মিনিট বলে গেল। সেরার কথা সবটা না বুঝলেও সে যে ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়, এটুকু শিঞ্জিনী ধরতে পেরেছিল।

ভূগোল পড়া শেষ করে ইতিহাস পড়তে পড়তে শিঞ্জিনীর মনে হল, ভূগোলটা ঠিকমতো তৈরি হয়নি, ইতিহাসও হবে না। মনের মধ্যে কেমন এক ছটফটানি, অশান্তি। মাথায় কিছু ঢুকছে না! যোধপুর পার্কে মেজোজেঠুর বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছেটাও মরে গেছে। পিসতুতো যেসব ভাইবোনদের সঙ্গে দেখা হওয়ার, খেলা করার কল্পনায় শিঞ্জিনী মশগুল হয়ে ছিল,এখন তাদের মুখগুলো ভেবেও শিঞ্জিনীর আতঙ্ক হচ্ছে। ভাইবোনেদের প্রায় সকলেই ইংরেজি স্কুলে, কলেজে পড়ে, ফটাফট ইংরেজিতে কথা বলে। যোধপুর পার্কে মেজোজেঠুর বাড়িতে পুরোপুরি সাহেবি কায়দা, বাড়ির লোকেরা কাঁটাচামচেয় ব্রেকফাস্ট, ডিনার-লাঞ্চ খায়। মেজোজেঠুর ছেলে মান্তুদাদা, মেয়ে মিলিদি বাড়িতেও ইংরেজিতে কথা বলে। মিলিদি একদিন শিঞ্জিনীকে বলেছিল, “বাংলা বলতে আমার খুব কষ্ট হয়!”

বড়জেঠুর দুই মেয়ে বুন্তিদি আর বেবিদি পড়ে সাহেবি কলেজে, তারা হাফ মেমসাহেব, বাড়িতে বাংলা বললেও রাস্তায়, বাসে, ট্রামে ইংরেজি ছাড়া বলে না। বড়পিসির ছেলেমেয়েরা শিঞ্জিনীর চেয়ে বয়সে অনেক বড়, তারা বাংলা স্কুলে লেখাপড়া শিখেছে। কথায়, চালচলনে তারা পুরো বাঙালি। শিঞ্জিনীকে তারা খুব ভালবাসে। শিঞ্জিনীর মতো তারাও ইংরেজি বোলচাল শুনলে বেশ ঘাবড়ে যায়। মেজোপিসি আর ফুলকাকার ছেলেমেয়েরা ইংরেজি স্কুলে গেলেও তাদের বয়স কম, অতশত তারা বোঝে না, শিঞ্জিনীর সঙ্গে তাদের খুব ভাব। তাদের টানেই শিঞ্জিনী আজ মশগুল হয়ে ছিল। কিন্তু এখন তার সব আগ্রহ নিভে গেছে। ইতিহাস-বই খুলে সে গুম হয়ে বসে আছে। সুট-কোট পরা ছোটকাকার সামনেও যে কাবেরীদির ক্লাসের মতো তাকে অপমানিত হতে হবে, এমন এক আশঙ্কা শিঞ্জিনীকে ক্রমশ চেপে ধরছে।

তার চেয়ে সে যোধপুর পার্কে যাবে না। বাড়িতে বাণীদিদির কাছে থাকবে। খুব একঘেয়ে লাগলে পাশের বাড়িতে রানুর কাছে যাবে। একটা বাংলা স্কুলে ক্লাস সিকসে রানু পড়ে। শিঞ্জিনীর সে খুব প্রিয় বন্ধু। রানু ছাড়াও শিঞ্জিনীর এ-পাড়ার বন্ধুরা সকলেই বাংলা স্কুলে পড়ে। শিঞ্জিনীর মাঝে-মাঝে মনে হয়, তাদের পাড়ার ছেলেমেয়েরা সকলেই বাংলা স্কুলে পড়ে। আর বড়লোকদের পাড়ার ছেলেমেয়েরা যায় ইংরেজি স্কুলে। তারা বুড়িবসন্ত, বাঘবন্দী, চোরপুলিশ আর রুমালচোর খেলে না। খেললেও অদ্ভুত সব ইংরেজি নাম দিয়ে খেলাগুলোর কথা বলে। তাদের সঙ্গে দু-একবার খেলে শিঞ্জিনী কোনও মজা পায়নি।

যোধপুর পার্কে শিঞ্জিনীর যাওয়ার অনিচ্ছের পেছনে আরও একটা কারণ আছে। তার ভয়, কেতাদুরস্ত ছোটকাকার সামনে ইংরেজি বলা আর ইংরেজি আদব কায়দার যে মহড়া চলবে, সেখানে সে পাত্তা পাবে না, একেবারে কোণঠাসা হয়ে যাবে। বোকার মতো চুপচাপ বসে থাকতে হবে তাকে।

এত দুর্ভাবনা নিয়েও শিঞ্জিনীকে শেষ পর্যন্ত মা-বাবার সঙ্গে যোধপুর পার্কে মেজোজেঠুর বাড়িতে যেতে হল। সাড়ে ছটার কিছু পরে মেজোজেঠুর বাড়িতে যখন তারা পৌঁছল, তখন বাড়ির সাজানো ড্রইংরুম লোকজনে বোঝাই, সকলে এসে গেছে। বাবা-মা’র সঙ্গে শিঞ্জিনীকে দেখে ছোটকাকা হইহই করে উঠে বললেন, “তুই কত বড় হয়ে গেছিস রে, রীতিমত গিন্নি”।

লজ্জা পেলেও ছোটকাকার দিকে তাকিয়ে শিঞ্জিনী অবাক হল। লম্বা, ছিপছিপে ছোটকাকার শরীরে কোট-প্যান্টের বদলে রয়েছে পাজামা আর হ্যান্ডলুমের গেরুয়া পাঞ্জাবি। কৌতুকে চিকমিক করছে ছোটকাকার দু’ চোখের কুচকুচে কালো দুটো মণি। এ যেন অন্য ছোটকাকা। শিঞ্জিনীকে ছোটকাকা বললেন, “আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। তুই বোস, তোকেও কিছু একটা করতে হবে।”

ছোটকাকার কথা শুনে ভয়ে ধক করে উঠল শিঞ্জিনীর বুক। সে যা আশঙ্কা করেছিল, তাই হতে চলেছে। সকলের সামনে দারুণ নাকাল হতে হবে তাকে। এখানে আসার, জন্যে নিঃশব্দে শিঞ্জিনী আফসোস করতে লাগল। সেজোকাকার মেয়ে সরোজা একটা নার্সারি রাইম বলা শেষ করতে মেজোপিসির ছেলে চিন্টুদা একটা ইংরেজি রসিকতা করল। ঘরের সকলে হোহো করে হেসে উঠল। ছোটকাকাও মুচকি হাসলেন। তারপর শিঞ্জিনীকে প্রশ্ন করলেন, “তুই কী বলবি?”

লজ্জায়, ভয়ে, সঙ্কোচে শিঞ্জিনী মাটিতে মিশে যাচ্ছে। এখানে যে তার বলা বা করার কিছু নেই, এটা সে বুঝে গেছে।

হঠাৎ ছোটকাকা প্রশ্ন করলেন, “তোরা কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত জানিস না ? ডি এল রায়, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, নজরুলের গান জানিস না?”

ছোটকাকার প্রশ্ন শুনে ভাইবোনেরা যখন মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে, বুন্তিদি বলল, “ওগুলো ভারী একঘেয়ে, প্যানপেনে গান।”

বড়জেঠু আর মেজোপিসেমশাই বুন্তিদির কথায় সায় দিতে অল্প হেসে ছোটকাকা শিঞ্জিনীকে প্রশ্ন করলেন, “রবীন্দ্রসঙ্গীত জানিস?”

লজ্জা পেলেও শিঞ্জিনী বলল, “হ্যাঁ।”



“কর্‌ একটা।” ছোটকাকা বললেন।









শিঞ্জিনীর মাথার মধ্যে একঝাঁক রবীন্দ্রসঙ্গীত গুনগুন করতে থাকল। ছোটকাকার মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে শিঞ্জিনী শুরু করল, “কেন চেয়ে আছ, গো মা...”

স্কুলের রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রতিযোগিতায় এই গানটা গেয়ে শিঞ্জিনী প্রথম হয়েছিল। গানটা সত্যি সে ভাল গায়। আজ যেন তার গায়কীতে একটু বাড়তি দরদ আর আবেগ মিলে গিয়েছিল। চমৎকার গাইল সে। গান শেষ করে শিঞ্জিনী দেখল, ড্রইংরুমের সকলে মৌন, স্তব্ধ, কী যেন ভাবছে। গাঢ় গলায় ছোটকাকা বললেন, “বাহ”।

এক মুহূর্ত পরে ছোটকাকা বললেন, “কোন্-কোন্‌ বাঙালি কবির লেখা মুখস্থ আছে?”

ছোটকাকার তারিফ পেয়ে শিঞ্জিনীর আত্মবিশ্বাস আর সাহস বেড়ে গিয়েছিল। তাই ছোটকাকার প্রশ্ন শুনে সে বলল, “রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, আরও অনেকের কবিতা আমার মুখস্থ”।

কচি ভাইঝি’টির মুখে এত কবির নাম শুনে ছোটকাকার চোখ দুটো বড়-বড় হয়ে গেছে। বললেন, “একটা কবিতা শোনা।”

শিঞ্জিনী শুরু করল, “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি….”,

এই কবিতাটা বলতে গেলে শিঞ্জিনীর বুকের ভেতরটা কেমন আকুল, বিহ্বল হয়ে ওঠে, চোখের সামনে কেমন ভেসে ওঠে তার নিজের মায়ের মুখ, ভারী আচ্ছন্ন হয়ে যায় সে, মনে হয়, এক গভীর, গম্ভীর মন্ত্র তার বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। আজও তাই হল। আবৃত্তি শেষ করে শিঞ্জিনী দেখল, দু’চোখ বুজে ছোটকাকা বসে আছেন, ছোটকাকার দু’ চোখের কোণে দু’ ফোঁটা জল….।

একটু পরে চোখ খুলে রুমালে চোখ-মুখ মুছে ছোটকাকা বললেন, “তোর সামনে বসে থাকতে আমার লজ্জা করছে। আমি একটাও ভাল বাংলা গান বা কবিতা, পুরো জানি না। আগামী বছর এক মাসের ছুটি নিয়ে কলকাতায় আসব। তখন তোদের বাড়িতে থেকে তোর কাছে গান আর কবিতা শিখব।”

কথা শেষ করে এক মুহুর্ত শিঞ্জিনীর দেকে তাকিয়ে ছোটকাকা প্রশ্ন করলেন, “আমায় শেখাবি তো মা?” সসঙ্কোচে শিঞ্জিনী ঘাড় নাড়ল। সেই মুহূর্তে দমকা হাওয়ায় শিঞ্জিনীর মন থেকে উড়ে গেল ইংরেজি স্কুলে না-পড়ার ক্ষোভ, লজ্জা, অভিমান।

ছবি : কৃষ্ণেন্দু চাকী

শেষ

No comments:

Post a Comment