মূর্তির কবলে

লেখক: হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

একেবারে আচমকা। তাও অন্য কোন বড় শহর হলে এক কথা। আপসোস করার বিশেষ কিছু থাকত না। কিন্তু বদলি করল কলকাতা থেকে এলোর। অন্ধ্রদেশে, ইংরাজ আমলে ওই নাম ছিল, এখন স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে নাম হয়েছে এলুরু।

একটা আশার কথা বিয়ে থা করিনি। বৌ-ছেলেপুলের বালাই নেই। ঝাড়া হাত-পা। কাজেই তল্পি-তল্পা বেঁধে ট্রেনে উঠলাম।

স্টেশনে রামকৃষ্ণ রাও ছিলেন। এঁর জায়গাতেই আমি যাচ্ছি । ইনি বদলি হচ্ছেন কোয়েন্বাটুর। এঁকে বলেছিলাম থাকবার জন্য একটা আস্তানার সন্ধান করতে । বিদেশ বিভূঁই, কিছুই জানা নেই। অন্তত মাথা গোঁজবার একটা জায়গা থাকা দরকার।

তিনি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, চিন্তার কোন কারণ নেই। আমি যেখানে ছিলাম যেখানেই আপনি থাকতে পারবেন। বাড়িওয়ালা খুব সদাশয়, বাড়িটাও যথেষ্ট খোলামেলা।

যেতে যেতে রামকৃষ্ণ বললেন, আমি এখানে একলাই থাকতাম। বদলির চাকরির জন্য স্ত্রী, পুত্রকে মামার বাড়ি মাদ্রাজে রেখে দিয়েছি।

তারপর হঠাৎ থেমে রামকৃষ্ণ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার নিজের রান্না করার অভ্যাস আছে?

বিশেষ নেই, তবে কলকাতায় ঝি না এলে মাঝে মাঝে নিজেকেই চালিয়ে নিতে হত।

ওই এক মুস্কিল। এখানকার রান্না খেতে আপনাদের মানে বাঙালীদের হয়তো অসুবিধা হবে। সবই নারকেল তেলে রান্না কি না?

আর কিছু বললাম না। অদৃষ্টে দুর্ভোগ আছে জানি।

বাড়িটা বেশ পছন্দসই। চারপাশে একটু বাগান আছে। নারকেল আর কিছু আমগাছ।

রান্না করার লোক একটা হয়ে গেল। শঙ্করণ। সে শুধু ভাত রেঁধে দিয়ে যাবে। মাছ, মাংস ডিম ছোঁবে না। ওগুলো আমাকেই করে নিতে হ’ত।

রামকৃষ্ণ যাবার সময় একটি জিনিস দিয়ে গেলেন। টেরাকোটার মূর্তি। লাল রঙের। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম নটরাজের মূর্তি। কিন্তু ভাল করে দেখলাম, না। নটরাজ নয়। সেই ধরনের ভঙ্গী। মুখ-চোখের চেহারা বীভৎস। চারিদিকে আগুনের লেলিহান শিখা।

রামকৃষ্ণ বললেন, কি মূর্তি জানি না। হরিদ্বারে এক সাধুর কাছ থেকে পেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন কালভৈরবীর মূর্তি। রোজ শুতে যাবার আগে এ মূর্তিতে প্রণাম করে শুলে মঙ্গল হবে, অবহেলা করলে অশুভ।

এসব ব্যাপারে আমার ভক্তি-শ্রদ্ধা একটু কম। বরং বলা যায়, আমি কিছুটা নাস্তিক। নিজের পুরস্কার ছাড়া আর কিছু মানি না।

তবু রামকৃষ্ণের মুখের ওপর আমি কিছু বলিনি। বলতে পারিনি। মূর্তিটা নিয়ে আলনার ওপর রেখে দিলাম। এলুরুর চারিপাশে আমাদের তামাকের ক্ষেত। আমার কাজ এই সব তামাক পরিদর্শন করা। একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। তামাকে যাতে পোকা না লাগে, লাগলে তার প্রতিষেধক কি, তারপর কিভাবে তাকে গুদাম জাত করে রপ্তানির উপযোগী করা যায়, সে বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া, এই সমস্ত কাজ। অনেক দিন আমাকে গ্রাম অঞ্চলেই কাটাতে হ’ত।

তখন শঙ্করণ থাকত বাড়ির তদারকিতে। একেবারে নিস্তরঙ্গ জীবন। সংস্কৃতির ছিটেফোঁটা কোথাও নেই।

কি আর করা যাবে। কটা লোক আর জীবন আর জীবিকা মেলাতে পারে।

মাস খানেক পর মুস্কিলে পড়লাম। শঙ্করণ এল না। এই সময় বর্ষার খুব প্রকোপ। চারিদিকে ম্যালেরিয়া। দিন পনের শয্যাপাত করে রাখে। নিরুপায়, নিজে সেই হাত পুড়িয়ে রান্নাবান্না করতে হয়। কাজ বিশেষ নেই। রাত আটটার মধ্যে শুয়ে পড়ি।

বাইরে বৃষ্টির নূপুর আর ব্যাঙের আলাপ জলসার আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছে। শোওয়া মাত্র --চোখে ঘুম এল। রাত কত খেয়াল নেই। হঠাৎ ধড়মড় করে বিছানার ওপর উঠে বসলাম।

মশারিতে আগুন ধরে দাউ দাউ করে জলছে। কি আশ্চর্য, কি করে এটা হল। বেড সুইচ নেই। ঘরের আলো বন্ধ করে তবে আমি শুয়েছি। কারণ আলো থাকলে আমি ঘুমোতে পারি না। ভীষণ বিপদে পড়ে গেলাম। মশারির চারিদিক জ্বলে উঠেছে। নাইলনের মশারি। নামবার কোন পথ নেই। আগুনের তাপ আমার শরীর ঝলসে দিচ্ছে।

চেঁচাবার শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছি। আর চেঁচিয়েও কোন লাভ নেই। সব চেয়ে কাছে যে বাড়ি সেটাও আধ মাইল দূর।

বিদেশে এভাবে কি পুড়ে মরতে হবে। মরিয়া হয়ে নামবার চেষ্টা করলাম। এ ছাড়া উপায় নেই।

একটু এগিয়ে থেমে গেলাম। সেই অগ্নিশিখার পিছনে বিরাট এক মূর্তি । শুধু বিরাট নয়, বিকটও। কালভৈরবীর মুর্তি । দুটি চোখে অগ্নিপিন্ড। ঠোঁটের দুপাশে আগুনের ঝলক। ভাবলাম ভুল দেখছি। চোখদুটো ভাল করে রগড়ে নিলাম। কিন্তু না, এক দৃশ্য।

কালভৈরবীর মূর্তি যেন জীবন্ত হয়েছে। এদিকে আগুনের উত্তাপ বাড়ছে। বিছানার ওপর বসে থাকা আর সম্ভব নয়। লাফিয়ে মেঝের ওপর পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে আগুন যেন মিলিয়ে গেল। কালভৈরবীর মূর্তিও উধাও।

কিন্তু আর একটা আশ্চর্য কান্ড। একটা অদৃশ্য টানে কে যেন আমাকে আলনার দিকে নিয়ে গেল। আলনার কাছে গিয়েই অবাক হলাম। কালভৈরবীর মূর্তিটা নেই।

শঙ্করণ মূর্তিটা আলনার ওপর একটা তাকের মধ্যে রাখত। মাঝে মাঝে লক্ষ্য করেছি, সে মূর্তির সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়ছে। আমি নিজে এসব না মানলেও, কারও ধর্মবিশ্বাসে বাধা দিতে চাইনি।

পিছন ফিরে দেখলাম, মশারির অবস্থা স্বাভাবিক।

আগুনের সামান্য চিহ্নও কোথাও নেই।

নিজের ওপর রাগ হল। নিশ্চয় বিশ্রী একটি স্বপ্ন দেখেছিলাম। স্বপ্ন দেখে এতটা ভয় পাওয়া নিঃসন্দেহে ছেলেমানুষি। কিছুক্ষণ পায়চারি করে শুতে গেলাম।

ভোরের দিকে একই কাণ্ড। এবারে কালভৈরবীর মূর্তির দুটির নাসারন্ধ্র দিয়ে আগুনের হল্কা। মশারি পুড়ছে।

আগের বারের মতন লাফ দিয়ে নীচে নামতে সব স্বাভাবিক। আর বিছানায় যাইনি। আলো ফোটা পর্যন্ত বেতের চেয়ারে চুপচাপ বসে রইলাম। শেষ রাত্রের দিকে বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। আকাশ প্রায় পরিষ্কার। ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে ফাঁকে নীল আকাশের আভাস।

শঙ্করণ এসে হাজির। জ্বর নেই, তবে চেহারা বেশ কাহিল।

একবার ভাবলাম শঙ্করণকে কিছু বলব না। আমার সম্বন্ধে তার ধারণা খারাপ হবে। ভাববে, আমি অহেতুক ভয় পেয়েছি।

কিন্তু তাকে অন্যভাবে জিজ্ঞাসা করলাম। আচ্ছা শঙ্করণ, সেই কালভৈরবীর মূর্তিটা কোথায় জান? কালভৈরবীর মূর্তি! কেন, তাকের ওপর নেই?

শঙ্করণ ছুটে এল ঘরের মধ্যে। তাক খালি। মূর্তি নেই।

লক্ষ্য করলাম, শঙ্করণের মুখ পাংশু, নীরক্ত হয়ে গেল। এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগল।

তাইতো, কোথায় গেল? আপনি ফেলে দেননি তো?

আমার ঈশ্বর-বিশ্বাসের ওপর শঙ্করণের মোটেই শ্রদ্ধা ছিল না। সে আমার হাল-চাল দেখে হয়তো কিছুটা মালুম করেছে।

আমি বললাম, মূর্তি সম্বন্ধে আমি কোনই খোঁজ রাখি না। তুমিই তো দেখাশোনা করতে। শঙ্করণের আমার কথার উত্তর দেবার অবকাশ নেই।

সে তন্ন তন্ন করে মূর্তিটা খুঁজছে। আলনাটা সরিয়েই সে চেঁচিয়ে উঠল। এই তো এখানে পড়ে রয়েছে। দেখলাম দুজোড়া জুতার ফাঁকে মূর্তিটা পড়ে আছে।

শঙ্করণ সন্তর্পণে মূর্তিটা তুলে নিল। রুক্ষকন্ঠে বলল, এটা এখানে কে ফেলল?

উত্তর দেওয়া প্রয়োজন মনে করলাম না। চুপ করে রইলাম।

শঙ্করণ মূর্তিটা কাপড় দিয়ে ভাল করে মুছে তাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করল। নতজানু হয়ে মূর্তির সামনে বসে বিড় বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ করল।

মাস খানেক একভাবে গেল। কোন উপদ্রব নেই।

কলকাতা থেকে একটা চিঠি এল। বন্ধু অসিতের লেখা। অসিত শুধু আমার মামুলি বন্ধুই নয়, কলেজে আমরা অভিন্ন হৃদয় ছিলাম। অসিত বম্বেতে এক কাপড়ের কলের টেক্সটাইল ইঞ্জিনীয়ার। সে লিখেছে, দু মাসের ছুটিতে কলকাতা এসেছে। এসে ভাল লাগছে না, কারণ আমি কলকাতায় নেই। তার খুব ইচ্ছা আমার কাছে মাস খানেক কাটিয়ে যাবে।

প্রস্তাবটা খুব ভাল লাগল। পাগুববর্জিত দেশে অসিতের মতন বন্ধু পাশে থাকলে সময়টা ভালই কাটবে। পত্রপাঠ তাকে আসতে লিখে দিলাম। চিঠি লেখার সাত দিনের মধ্যে অসিত এসে হাজির। এলুরু স্টেশন থেকে তাকে ট্যাক্সি করে নিয়ে এলাম। বাড়ি দেখে অসিত বেজায় খুশি।

সব কিছুতেই তার দারুণ উৎসাহ। বিন্দুতে সিন্ধুর স্পর্শ পেল!

বাঃ, এ যে একেবারে বাগানবাড়ি রে? শহর অথচ শহরের গোলমাল নেই। বেশ আছিস।

চা খেতে খেতে হঠাৎ তার দৃষ্টি মূর্তির দিকে গেল। জিজ্ঞাসা করল, ওটা কিসের মূর্তি রে?

কালভৈরবীর।

সেটা আবার কি?

চা শেষ করে অসিত মূর্তির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে দেখে বলল, বাড়ির মধ্যে এই কিম্ভূতকিমাকার মূর্তিটা রেখেছিস কেন? ফেলে দে।

শঙ্করণ ওই মূর্তিটা রোজ পূজা করে, তাই আর সরাইনি। নাহলে ও মোটেই আমার পছন্দসই নয়। শঙ্করণ পছন্দ করে তো এটা সে তার বাড়িতে নিয়ে যাক, কিংবা রান্নাঘরে, তার কাজের জায়গায় রাখুক। তোকে তো নাস্তিক বলেই জানতাম, অন্তত মূর্তিপূজার বিরোধী।

কিছু বললাম না। কিই বা বলব। অসিত আমার মনের কথাই বলেছে।

আমার ঠিক পাশের ঘরটা তার শোবার জন্য নির্দিষ্ট হয়েছিল। দুটো দরজার মাঝখানে একটা দরজা ছিল। বেশ কিছুটা গল্পগুজব করার পর অসিত শুতে গিয়েছিল।

আমার ঘুম আসেনি। টেবল-ল্যাম্প জেলে টোবাকো কিওরিং সম্বন্ধে একটা বই পড়লাম, তারপর শুতে গেলাম। বোধহয় মাঝরাত, ঠিক খেয়াল নেই। পাশের ঘরে দুপদাপ শব্দ। অনেকগুলো লোক যেন দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে।

একবার মনে হল ডাকাত পড়েছে। তারপর ভাবলাম ডাকাতদের তো এই ঘরের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে। পাশের ঘরে ঢোকবার আলাদা কোন রাস্তা নেই।

সারা ঘর জুড়ে তান্ডব নৃত্য চলেছে, অথচ অসিতের কোন শব্দ নেই। তবে কি তার কোন বিপদ ঘটল। উঠে পড়লাম।

দরজার পাশে গিয়ে দেখলাম, অসিত পাশের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়েছে। হাত রাখতেই দরজাটা খুলে গেল। শব্দ চলছে, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না।

শুধু অসিতের মশারিটা প্রবল বাতাসে উড়ছে।

অথচ আজ গুমোট। বাতাস একেবারেই নেই।

অসিত, অসিত। বার কয়েক চেঁচালাম। কোন উত্তর নেই। বাইরে ম্লান চাঁদের আলো। জানলা দিয়ে সেই আলো অসিতের বিছানার ওপর এসে পড়েছে। অস্পষ্ট অসিতের কাঠামো দেখা গেল। সে শুয়ে রয়েছে।

সন্দেহ হ’ল, ভূতুড়ে বাড়ি নয় তো? শব্দ আসছে কোথা থেকে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিজের বিছানায় ফিরে এলাম। তারপর এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়েছি।

অসিতের সঙ্গে দেখা হল, পরের দিন চায়ের টেবিলে।

আমি কিছু বলবার আগেই অসিত বলল, না ভাই, দু’বেলা মাংস আমার সহ্য হচ্ছে না। পেট গরম হয়। রাত্রে যা সব স্বপ্ন দেখি।

কি স্বপ্ন দেখলি?

আর বলিস কেন? কাল মাঝরাতে দুপদাপ শব্দ। একপাল লোক হাতে ত্রিশূল আমার বিছানা ঘিরে প্রলয় নাচ নেচে চলেছে, যেখানে পা ফেলছে সেখানেই আগুন জ্বলে উঠছে। আর এমন মজা, সেই আগুনের আঁচ লাগছে আমার সারা দেহে। ওঠবার চেষ্টা করলাম, পারলাম না।

অসিতের দিকে দেখলাম, তার চেহারা খুব ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত মনে হল। কালভৈরবীর মূর্তির কথাটা বলতে গিয়েও বললাম না।

চা পান শেষ করে আমি আমার শোবার ঘরের তাকের কাছে গিয়েই চমকে উঠলাম। তাক খালি। মূর্তি নেই। সর্বনাশ, মূ্তিটা আবার গেল কোথায়।

আলনা, সুটকেশ, জিনিসপত্র সরিয়ে খুঁজতে আরম্ভ করলাম। মূর্তি কোথাও নেই। এই সময় শঙ্করণ ঘরে ঢুকল। উস্কোখুস্কো চুল, মলিন মুখ, উদভ্রান্ত দৃষ্টি। হাতে কালভৈরবীর মূর্তি ।

স্যার, আপনার এখানে কাজ করে আমার পোষাবে না। আমাকে ছুটি দিয়ে দিন।

কি হল?

শঙ্করণ কালভৈরবীর মূর্তিটা তুলে ধরে দেখিয়ে বলল, এই মূর্তিটাকে রান্নাঘরের কোণে ময়লা ফেলার ঝুড়ির মধ্যে রেখে দিয়েছিলেন। আপনারা আমিষভোজী বিধর্মী, ঠাকুরদেবতা হয়তো মানেন না, কিন্তু কালভৈরবী একেবারে কাঁচাখেকো দেবতা । কাউকে রেহাই দেবেন না।

শঙ্করণ চলে গেলে, আমি খুবই মুস্কিলে পড়ব। তাই বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করলামঃ এ মূর্তি এখান থেকে সরাল কে?

কে সরাল শঙ্করণ ভাল করেই জানত। যে সরিয়েছে সে কোন লুকোচুরি করেনি। তাই অসিতের ঘরের দিকে চোখের ইঙ্গিত করে শঙ্করণ বলল।

আর কে সরাবে, আপনার বন্ধু। ঠাকুরদেবতা নিয়ে খেলা করতে বারণ করে দেবেন। সর্বনাশ হয়ে যাবে।

ঠিক আছে, তুমি কাজ করগে যাও। অসিতকে আমি বলে দেব।

শঙ্করণ চলে গেল।

সেদিন বিকালে অসিতের সঙ্গে বেড়াতে বেড়াতে কথাটা বললাম। চিন্তাধারার দিক দিয়ে আমার সঙ্গে অসিতের কোন অমিল ছিল না। দুজনের একই ধরনের বিশ্বাস। সেই কলেজের-দিন থেকে। একটা রাতের অভিজ্ঞতাকে আমি মোটেই আমল দিই না। সে রাতের স্বপ্নের সঙ্গে ওই কালভৈরবী মূর্তির কোন যোগাযোগ আছে, আমি মনে করি না।

কিন্তু শঙ্করণের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত হানলে সে হয়তো এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। এ বিদেশ, বিভুঁয়ে আমি বিপদে পড়ব। তাই অসিতকে বললাম, অসিত আমার একটা কথা শুনবি?

বল।

তুই তো আর দিন দুয়েক আছিস, এর মধ্যে কালভৈরবী মূর্তি নিয়ে আর গোলমাল করিস না।

অসিত কোন উত্তর না দিয়ে অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে আমার আপাদমস্তক জরিপ করল।

এদেশের. লোকরা খুবই ধর্মভীরু হয়। অনেকটা আমাদের দেশের লোকদের মতন। পাথর নুড়ি গাছপালা সব কিছুতে ঈশ্বরত্ব আরোপ করে আনন্দ পায়। ওই কালভৈরবীর মূর্তিটাকে তুই অবহেলা আর তাচ্ছিল্য করলে শঙ্করণ আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। তারপর কোন লোক আর আমার কাছে কাজ করতে আসবে না। আমার কি অসুবিধা হবে বুঝতে পারছিস?

একটু চুপ করে থেকে অসিত উত্তর দিল, তোর এমন অধঃপতন হবে ভাবতে পারি না। দরকার হ’লে কলকাতা থেকে লোক নিয়ে আয়। নিজের চিন্তার স্বাতন্ত্র, ব্যক্তিত্ব এভাবে বিসর্জন দিস না।

তুই পাগল হয়েছিস অসিত। কলকাতা থেকে কে আসবে এই পান্ডববর্জিত জায়গায়? বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে নিয়ে এলেও কিছুদিন পরে পালাবে। তাছাড়া এদেশের লোক আমাকে বয়কট করবে। শঙ্করণের মারফত একথাই চারদিকে রাষ্ট্র হয়ে পড়বে।

ঠিক আছে, তোর কথাটা শুনে রাখলাম।

অসিত চাপা সুরে কথাগুলো বলল। কিন্তু তার মুখ, চোখের চেহারা আমার ভাল লাগল না।

কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নেবার সময় এইভাবে সে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে, তার কপালে অজস্র বাড়তি আঁচড় পড়ে।

আর কোন কথা হল না। দুজনে বাড়ি ফিরে এলাম।

মনে পড়ে গেল, কলেজ-জীবনে দুজনে চার্বাকের উদ্ধৃতি তুলে কিভাবে প্রতিপক্ষকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছি। ঈশ্বর নেই, যা আছে তা প্রকৃতি। এই প্রকৃতির স্বাক্ষরই আমরা চারদিকে দেখতে পাচ্ছি।

পরের দিন মাইল চারেক দূরের এক গ্রামের মধ্যে যেতে হয়েছিল। এখানে বেশ কিছু তামাকের গুদাম ছিল। কি ভাবে তামাক সেই গুদামগুলোতে রাখা আছে দেখে আমাকে রিপোর্ট দাখিল করতে হবে।

টিফিন ক্যারিয়রে করে ভাত-তরকারি নিয়ে গিয়েছিলাম। মধ্যাহ্ন ভোজের অসুবিধা হবে না। এর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের দেওয়া কলা আর ডাব তো ছিলই।

দুপুরের খাওয়া শেষ করে একটা বেতের চেয়ারে বসে রিপোর্টটা নোট করছি, হঠাৎ পিছনে কাতর কণ্ঠ, অটহয়া, অটহয়া।

চমকে মুখ ফিরিয়ে দেখলাম, সাইকেল হাতে শঙ্করণ দাঁড়িয়ে। কাগজের মতন মুখের রং। দুটি চোখ বিস্ফারিত। খুব জোরে সাইকেল ছুটিয়ে আসার জন্য রীতিমত হাঁপাচ্ছে। ছুটে তার কাছে গেলাম, কি হয়েছে?

তাড়াতাড়ি আসুন, আপনার বন্ধু খুব অসুস্থ।

অসুস্থ? কি, জ্বর?

জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে দেখলাম শঙ্করণ নেই। খবরটা দিয়েই সাইকেলে রওনা হয়ে গিয়েছে। অগত্যা লোকদের বলে আমিও সাইকেল ছুটিয়ে দিলাম। যেতে যেতে মনে হল, শঙ্করণের যে রকম ভীতিবিহ্বল চেহারা দেখলাম, তাতে মনে হয় অসিত খুব গুরুতর অসুস্থ। অসিতের কোন মারাত্মক ধরনের অসুখ আছে, জানা ছিল না। বরং তাকে স্বাস্থ্যবান বলেই জানতাম। এখানে এসে ম্যালেরিয়ার কবলে পড়ল নাকি। দূর থেকেই দেখতে পেলাম আমার বাড়ির উঠানে লোকের ভীড়।

অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠল। অসিতের খারাপ কিছু হল না তো!

আমি যেতেই একটা সম্মিলিত চাপা কলরব উঠল। একজন এসে আমার সাইকেলটা ধরল। উঠানের একপাশে একটা ঘর পড়েছিল। ইঁটের দেয়াল টালির ছাদ।

শুনেছিলাম, অনেক আগে বাড়িওয়ালা যখন এ বাড়িতে থাকত, তখন ভদ্রলোকের গোটা দুয়েক গরু ছিল। ওটা গোয়ালঘর হিসাবেই ব্যবহৃত হত। তারপর থেকে খালিই পড়ে আছে। সেই গোয়ালঘরের সামনে জমাট ভীড় । আমাকে দেখে লোকেরা সরে যাবার রাস্তা করে দিল। একটু এগিয়ে উঁকি দিয়ে দেখেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমার সমস্ত শরীর ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। কোনরকমে পাশে দাঁড়ানো লোকটির ওপর ভর দিয়ে টাল সামলালাম।

চোখের সামনে নারকীয় দৃশ্য।

মেঝের পর অসিত চিত হয়ে শুয়ে। অস্বাভাবিক যন্ত্রণায় তার দুটি চোখ আতঙ্কগ্রস্ত, সারা শরীর কুঞ্চিত। ঠিক বুকের মাঝখানে সেই কালভৈরবী মূর্তি । মূর্তির চারপাশের অগ্নিশিখা কাঁকড়ার দাঁড়ার রূপ নিয়ে বুকের মাংস কুরে কুরে ফেলছে। লোকদের নিষেধ সত্ত্বেও আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম । সবলে কালভৈরবীর মূর্তি টেনে তোলার চেষ্টা করলাম। সফল হলাম না। নিবিড় আকর্ষণে মূর্তিটা অসিতের দেহের ওপর চেপে বসেছে।

আমি আবার টেনে ফেলে দেবার চেষ্টা করতেই প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে পড়লাম চৌকাঠের কাছে। মূর্তি যেন পথ করে করে অসিতের দেহের মধ্যে প্রবিষ্ট হল।

সম্ভবত অচেতন হয়ে পড়েছিলাম। যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম, দেখলাম সব শেষ। অসিতের দেহ নিস্পন্দ। দুটি চোখ বীভৎস ভাবে খোলা । দু’পাশ দিয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ছে। কালভৈরবীর মূর্তিটা কোথাও নেই। অসিতের বুকের ওপর সেখানে রক্ত কালো হয়ে জমাট বেঁধে রয়েছে।

সমবেত লোকের হাততালি দিয়ে নাচগান শুরু করেছে।

শঙ্করণের সাহায্যে নিজের বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম।

অসিতের বাড়িতে টেলিগ্রাম পাঠালাম। দুর্ঘটনায় মৃত্যু। এ ছাড়া আর কি বলব।

শঙ্করণ দারোগাকে এজাহার দেবার সময় ব্যাপারটা জানতে পারলাম।

শঙ্করণ অসিতকে বোঝাতে গিয়েছিল কালভৈরবী জাগ্রত দেবতা। এঁর অবমাননা করলে অসিতের সর্বনাশ হবে। কথায় কথায় অসিত উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। ছুটে গিয়ে কালভৈরবীর মূর্তিটা তুলে নিয়ে উঠানের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। তাতেও বিরত না হয়ে লাথি মেরেছিল মূর্তিটাকে। সেটা ছিটকে গোয়ালঘরে মধ্যে গিয়ে পড়েছিল। অসিতও গোয়ালঘরে ঢুকেছিল। বোধহয় তার উদ্দেশ্য ছিল, মূর্তিটা ভেঙে চুরমার করে দেবে।

তারপরই হতভম্ব শঙ্করণ অসিতের আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিল। চোখের সামনে বীভৎস দৃশ্য দেখেছিল। কি আশ্চর্য, দারোগা সব কথাই বিশ্বাস করেছিল। লিখে নিতে কোন দ্বিধা করেনি। দেবতার বিদ্বেষে এমন ঘটনা যেন খুব স্বাভাবিক।

অসিতের শেষ কাজ করে বাড়ি ফিরতে ভোর হয়ে গেল।

ক্লান্ত দেহ, বিষণ্ণ মন, চিন্তা করার ক্ষমতাও যেন লোপ পেয়েছে। তালা খুলে ঘরের মধ্যে পা দিয়েই চমকে উঠলাম।

তাকের ওপর সেই কালভৈরবীর মূর্তি।

বন্ধ ঘরে কি করে এল মূর্তিটা! কে রাখল! অসিতের দেহের অভ্যন্তর থেকে এ মূর্তি বাইরে এল কি করে!

No comments:

Post a Comment