পিছনের জানলা

লেখক: হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

আচমকা বদলির হুকুম এল কলকাতা থেকে গয়া। মোটঘাট বেঁধে গয়া পৌঁছে দেখি প্লাটফর্মে সুখলাল দাঁড়িয়ে।

সুখলাল অফিসের কাজে অনেকবার কলকাতা এসেছে। এক অফিসেরই লোক। সেই সূত্রেই আলাপ। সুখলাল বলল, আপনার জন্য একটা বাসার জোগাড় করে রেখেছি। শহরের একটু বাইরে। বেশ নিরিবিলি জায়গা, আপনার ভালোই লাগবে।

শহর থেকে মাইল দুয়েক দূর। বাড়িটা এক নজরে ভালই লাগল। একতলা। চারদিকে বাগান, মানে একসময় বাগান ছিল, এখন আগাছার জন্য কিছুটা জঙ্গলের চেহারা নিয়েছে। দুখানা ঘর, একটা বসবার, আর একটা শোবার, এছাড়া ছোট একটা রান্নাঘর।

সুখলাল বাড়ির মধ্যে ঢুকে দু-দিকের জানলাগুলো খুলে দিল। শীতের অল্প ঠাণ্ডা বাতাস ভালই লাগল। চারপাশে বাড়ি না থাকায় অনেকদূর পর্যন্ত দেখা গেল। উঁচু নিচু মাঠ গাছপালা ঝোপঝাড়। রান্নার ঘরে ঢুকে সুখলাল বলল, পিছনের এ জানলা খুলবেন না।

জিজ্ঞেস করলাম, কেন?

এ দিক দিয়ে তো আর বাতাস আসবে না। কী দরকার খুলে।

আর কিছু বললাম না। জিনিসপত্র গোছাতে আরম্ভ করলাম।

সুখলালই দুলারির মাকে জোগাড় করে দিল। রান্নাবান্না থেকে ঝাঁট দেওয়া, কাপড় কাচা, সব কিছুই করবে।

দিন তিনেক পর দুলারির মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সুখলালবাবু রান্নাঘরের জানলাটা খুলতে বারণ করেছে কেন বলো তো?

দুলারির মা অনেকক্ষণ ধরে আমার দিকে চেয়ে রইল। দৃষ্টিতে কৌতূহল আর বিস্ময়। তারপর বলল, ও জানলাটা নাই খুললেন বাবু?

কিন্তু কেন?

রান্নাঘরের জানলা তো। খাবার জিনিস থাকে। যদি ধুলোবালি পড়ে, কিংবা কুকুর বেড়াল ঢুকে পড়ে।

অবশ্য জানলার কোনো গরাদ নেই। ছোটখাট জন্তু-জানোয়ার ঢুকে পড়া মোটেই বিচিত্র নয়। তবু আমার মনে হল, আসল কথাটা যেন দুলারির মা চেপে যাচ্ছে।

কী হতে পারে রান্নাঘরের জানলাটা খুললে?

ছুটির দিন। অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমোলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখলাম, দুলারির মা টেবিলের ওপর চায়ের কাপ রেখে গেছে। রোজকার মতন।

চা খাওয়া হতেই দুলারির মা এসে দাঁড়াল। বাবু দরজাটা বন্ধ করে দিন। বাজারে যাব।”

দরজাটা বন্ধ করে মুখ-হাত ধুয়ে রান্নাঘরের চৌকাঠে গিয়ে দাঁড়ালাম। আর দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই চোখ পড়ল পিছনের জানলার ওপর।

বাইরে এলোমেলো শীতের হাওয়া বইছে। বন্ধ জানলাটা সেই হাওয়ায় থরথর করে কাঁপছে। ঠিক মনে হল যেন বলছে, আমাকে খুলে দাও, আমাকে খুলে দাও।

খুলতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লাম। সব্বাই যখন বারণ করছে, তখন কী দরকার জানলাটা খুলে। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে ছেলেমানুষি ভয়টা দূর করে সজোরে জানলায় ধাকা দিলাম। জানলা খুলল না। অনেকদিন না খোলার জন্য এঁটে গিয়েছে। আমারও জেদ চেপে গেল। প্রাণপণ শক্তিতে জানলাটা খোলবার চেষ্টা করতে লাগলাম। বার চারেক ধাক্কা দেবার পরে জানলাটা খুব শব্দ করে খুলে গেল। খোলার সঙ্গেই আশ্চর্য এক কাণ্ড। বাইরে থেকে গরম একটা হাওয়ার ঝলক ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল।

কেন এমন হল? অন্য জানলা দিয়ে বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। শীতের স্বাভাবিক হাওয়া। তবে কি অনেকদিন বন্ধ থাকার জন্য হাওয়াটা এরকম গরম? ঠিক বুঝতে পারলাম না। এগিয়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। কী আছে বাইরে, যার জন্যে এ জানলাটা খোলা নিষেধ ছিল। এদিক ওদিক দেখতে দেখতেই নজরে পড়ল।

কাছেই একটা ঝাঁকড়া গাছের নীচে একটা কবর। কবরের-সাইজ দেখে মনে হল ছোট বয়সের কেউ শুয়ে আছে। কবরের মাথার কাছে একটা সাদা রঙের ক্রস।

এই ব্যাপার! এরই জন্য এত কান্ড! সুখলাল আর দুলারির মা কি মনে করেছিল, কবর দেখে আমি ভয় পাব, তাই জানলাটা খুলতে মানা করেছিল?

তা ছাড়া আর কি হতে পারে। আর তো কিছু চোখে পড়ছে না।

সদর দরজায় খুট-খুট শব্দ হতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজা খুলে দিলাম। দুলারির মা বাজার নিয়ে ফিরেছে।

আমাকে দেখে বলল, বাবু বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন? অনেকক্ষণ দরজা ঠেলছি।

আমি কোনো উত্তর না দিয়ে শোবার ঘরে চলে এলাম।

একটু পরেই রান্নাঘর থেকে দুলারির মায়ের চিৎকার কানে এল। এ কী, এ জানলা কে খুলল? সর্বনাশ, কে এমন কাজ করলে?

রান্নাঘরে গিয়েই অবাক হয়ে গেলাম। বাজারের জিনিষ চারদিকে ছড়ানো। দুলারির মায়ের এলোমেলো বেশ। খোলা চুল। লাল দুটি চোখ। চিৎকার করে চলেছে।

কী হল? সরো আমি জানলা বন্ধ করে দিচ্ছি।

এগিয়ে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করার চেষ্টা করলাম। প্রথমে এক হাত দিয়ে, তারপর দু হাতে, কিন্তু কিছুতেই বন্ধ করতে পারলাম না। মনে হল জানলার পাল্লাটা যেন কাঠের নয়, নিরেট পাথরের তৈরি। একচুল সরানো গেল না। ও আর বন্ধ হবে না। আমি ঠিক জানি বাবু, সর্বনাশ একটা হবে।

দুলারির মা হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল।

সজোরে তাকে একটা ধমক দিলাম, আঃ, কী হচ্ছে কী? চুপ করো। জানলার কব্জাটা শক্ত হয়ে গিয়েছে। কাল মিস্ত্রি ডেকে ঠিক করে নিলেই হবে।

সেই রাত্রেই।

আমার খাবার ঢাকা দিয়ে দুলারির মা রোজকার মতন চলে গিয়েছে। আমি বাইরের ঘরে বসে অফিসের কাজ করছিলাম, ঘড়ির দিকে নজর পড়তেই উঠে পড়লাম। খাবার সময় হয়েছে।

রান্নাঘরের কাছে গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

খাবারের ঢাকা খোলা। থালার কাছে বছর ছয়েকের এক শিশু। ধবধবে গায়ের রঙ। এক মাথা কোঁকড়ানো সোনালী চুল। নীল দুটি চোখ। শিশুটি দাঁড়িয়ে নেই। অনবরত থালাটার চারপাশে ঘুরছে।

হাত দিয়ে চোখ দুটো রগড়ে নিলাম। ভুল দেখছি না তো? ঘরের মধ্যে শিশু আসবে কী করে? না, সেই এক দৃশ্য। শিশুটি ঘুরপাক খাচ্ছে। খুব ধীর পায়ে।

একটু পরেই শিশুটি থেমে গেল। মুখ তুলে দেখল আমার দিকে। নীল দুটি চোখের অদ্ভুত দৃষ্টি। আমার সারা দেহ যেন হিমের স্পর্শে অসাড় হয়ে গেল।

শিশুটি পিছন ফিরে রান্নাঘরের দিকে চলতে শুরু করল।

আমি সাহস করে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। কিছুটা গিয়ে আর যেতে পারলাম না। ঠিক জানলার কাছে যেতেই অসহ্য গরম হাওয়া। বাড়িতে আগুন লাগলে যেমন গরম তাপ লাগে, অবিকল সেই রকম।

একটা ধোঁয়ার কুন্ডলী। তারপর শিশুটিকে দেখতে পেলাম না।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সন্দেহ হল। সবই হয়তো আমার মনের ভ্রম। ছোট একটা কবর দেখে শিশুটিকে কল্পনা করেছি। সেই কল্পনার রূপই দেখেছি চোখের সামনে।

খেতে বসতে গিয়েই থেমে গেলাম।

থালার চারপাশ ঘিরে ছোট ছোট পায়ের চিহ্ন। দুপুরের দিকে বৃষ্টি হয়েছিল। বাইরে মাঠে জল জমেছে। শিশুটি বুঝি সেই জল পার হয়ে এসেছে।

খাবারে হাত দিতে পারলাম না। উঠে এলাম। তাহলে এ তো আমার মনের ভূল নয়। শিশুটি সত্যিই এসেছিল।

এই প্রথম মনে হল, পিছনের জানলাটা না খুললেই ভাল করতাম। কাল মিন্ত্রী ডেকে জানলাটা আগে বন্ধ করতে হবে।

অনেকক্ষণ শোবার ঘরে পায়চারি করলাম। মাথাটা গরম হয়ে রয়েছে। এখন শুলেও ঘুম আসবে না। বেশ কিছুক্ষণ পরে আবার রান্নাঘরে গেলাম। ভাল করে দেখলাম কোথাও কোনো পায়ের চিহ নেই। অবশ্য জলের দাগ এতক্ষণ থাকবার কথা নয়।

তবু খাবার কোনো ইচ্ছা করল না। এক সময়ে বাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়লাম। সহজে ঘুম এল না। এ-পাশ ও-পাশ করতে লাগলাম।

রাত তখন কটা জানি না। গলায় খুব ঠাণ্ডা একটা স্পর্শ পেয়ে চমকে জেগে উঠলাম।

জানলার কাঁচের মধ্য দিয়ে চাঁদের আলো এসে বিছানার ওপর পড়েছে। কোথাও কোনো অস্পষ্টতা নেই। সেই শিশুটি এক হাত দিয়ে আমার গলা আঁকড়ে ধরে পাশে শুয়ে রয়েছে।

সবলে শিশুকে সরিয়ে দিতে চাইলাম, পারলাম না। এইটুকু শিশুর কী অসীম শক্তি। হঠাৎ দেখতে দেখতে আশ্চর্য রূপান্তর ঘটল।

শিশুর দেহের মাংস আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। পরিবর্তে একটা কঙ্কাল বিছানায় শুয়ে। একইভাবে হাত দিয়ে আমার গলা বেষ্টন করে রয়েছে। হাড়ের দৃঢ় বাঁধন।

চিৎকার করে উঠলাম। প্রাণপণ শক্তিতে হাতটা সরাবার চেষ্টা করলাম। পারলাম না।

আবার সেই আগুনের হলকা। মনে হল, সেই তাতে আমার মাংসও বুঝি গলে-গলে পড়বে। আমিও কঙ্কালে পরিণত হব।

তারপর কী হল আমার জানা নেই। অনেকগুলো লোকের ক্ষীণকণ্ঠ, তাদের পায়ের আওয়াজ।

জ্ঞান হতে দেখলাম, বিছানায় শুয়ে আছি।

পাশে সুখলাল, আর একজন ডাক্তার। একটু দূরে দুলারির মা দাঁড়িয়ে।

শুনলাম পরের দিন সকালে বাড়ির মধ্যে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে দুলারির মা আমায় পিছনের মাঠে পেয়েছে। সেই ছোট কবরটার পাশে শুয়ে ছিলাম।

কখন, কীভাবে সেখানে গিয়েছি, জানি না।

No comments:

Post a Comment