যকের ধন (শেষাংশ)
লেখক: হেমেন্দ্রকুমার রায়
প্রথমাংশের লিঙ্ক
পনেরো
দুটো জ্বলন্ত চোখ
বিমলের গল্প শুনে আমার আঁতটা কেমন ছাঁৎ-ছাঁৎ করতে লাগল, গুহার বাইরে আর চাইতেই ভরসা হল না, কে জানে, সেখানে ঝোপঝাপের মধ্যে হয়তো কোনো বিদঘুটে চেহারা ওত পেতে বসে আছে!
আমার মুখের ভাব দেখে বিমল হেসে বললে, “ওহে কুমার, তোমার ভয় করচে নাকি?”
“তা একটু একটু করচে বৈকি!”
“এই না বললে, তুমি ভূত মান না?”
“হুঁ, আগে মানতুম না, কিন্তু এখন আর মানি না বলে মনে হচ্ছে না!”
“ভয় কী কুমার, আমার বিশ্বাস এ-গল্পটার একবর্ণ সত্যি নয়, আগাগোড়া গাঁজাখুরি! ভূতের গল্পমাত্রই রূপকথা, পাছে লোকে বিশ্বাস না করে, তাই তাকে সত্যি বলা হয়।”
কিন্তু তবু আমার মন মানল না, বিমলকে কিছুতেই আমার কাছছাড়া হতে দিলুম না। ভয়ের চোটে রামহরির রান্না রামপাখির মিষ্টি মাংস পর্যন্ত তেমন তারিয়ে খেতে পারলুম না!
গুহার বাইরের দিকে বিমল অনেকগুলো সরল কাঠ ছড়িয়ে আগুন জ্বেলে বললে, “কোনো জীবজন্তু আর আগুন পেরিয়ে এদিকে আসতে পারবে না। তোমরা দুজনে এখন ঘুমোও, আমি জেগে পাহারা দি। আমার পর কুমারের পালা, তারপর রামহরির।”
ছাতকের ডাকবাংলোর সেই ব্যাপারের পর থেকে রোজ রাত্রেই আমরা এমনি করে পাহারা দি।
আমি আর রামহরি গায়ের কাপড় মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লুম।
মাঝরাত্রে বিমল আমাকে ঠেলে তুলে বললে, “কুমার, এইবার তোমার পালা!”
শীতের রাত্রে লেপ ছাড়তে কি সাধ যায়, বিশেষ এই বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ে-পর্বতে! কিন্তু তবু উঠতে হল, কী করি, উপায় তো আর নেই!
গুহার সামনের আগুন নিবে আসছিল, আরো খানকতক কাঠ তাতে ফেলে দিয়ে, বন্দুকটা কোলের উপর নিয়ে দেয়াল ঘেঁষে বসলুম।
চাঁদ সেদিন মাঝরাত্রের আগেই অস্ত গিয়েছিল, বাইরে ঘুটঘুট করছে অন্ধকার! পাহাড়, বন, ঝোপঝাপ সমস্ত মুছে দিয়ে জেগে আছে খালি অন্ধকারের এক সীমাহীন দৃশ্য, আর তারই ভিতর থেকে শোনা যাচ্ছে ঝরনার অশান্ত ঝর্ঝর, শত শত গাছের একটানা শরশর, লক্ষ লক্ষ ঝিঁঝিঁর একঘেয়ে ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁ!
হঠাৎ আর-এক রকম শব্দ শুনলুম! ঠিক যেন অনেকগুলো আঁতুড়ের শিশু কাঁদছে, ‘টেয়্যা, টেয়্যা, টেয়্যা!
আমার বুকটা ধড়ফড় করে উঠল, এতগুলো মানুষের শিশু এল কোত্থেকে? একে আজ বিশ্রী একটা ভূতের গল্প শুনেছি, তার উপরে গহন বনের এক থমথমে অন্ধকার রাত্রি, তার উপরে এই বেয়াড়া চিৎকার! মনের ভিতরে যতসব অসম্ভব কথা জেগে উঠল!
আবার সেই অদ্ভুত কাঁদুনি!
আমার মনে হল, এ-অঞ্চলের যত ভূত-পেতনি বাসা ছেড়ে চরতে বেরিয়ে গেছে, আর বাপ-মায়ের দেখা না পেয়ে ভূতুড়ে খোকারা একসঙ্গে কান্নার কনসার্ট জুড়ে দিয়েছে!
ভয়ে সিঁটিয়ে ভাবছি, আর-একটু কোণ-ঘেঁষে বসা যাক, এমন সময়ে, ও কী ও!
গুহার বাইরে, অন্ধকারের ভিতরে দু-দুটো জলন্ত কয়লার মতন চোখ, একদৃষ্টিতে আমার পানে তাকিয়ে আছে!
বুক আমার উড়ে গেল, এ-চোখদুটো যে ঠিক সেই শ্মশানের পিশাচের মতো! এখানেও পিশাচ নাকি?
ধীরে ধীরে চোখদুটো আরো কাছে এগিয়ে এসে আবার স্থির, হয়ে রইল! আমার মনে হল, আঁধার সমুদ্রে যেন দুটো আগুন-ভাঁটা ভাসছে।
আমি আর চুপ করে বসে থাকতে পারলুম না, ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে কাঁপতে বন্দুকটা কোনোরকমে তুলে ধরে দিলুম তার ঘোড়া টিপে, গুডুম করে ভীষণ এক আওয়াজ হল, সঙ্গে সঙ্গে জলন্ত চোখদুটো গেল নিবে!
বন্দুকের শব্দে বিমল, রামহরি আর বাঘা একসঙ্গে জেগে উঠল, বিমল ব্যস্ত হয়ে বললে, “কুমার, কুমার, ব্যাপার কী?”
আমি বললুম, “পিশাচ, পিশাচ!”
“পিশাচ কী হে?”
“হ্যাঁ, ভয়ানক একটা পিশাচ এসে দুটো জ্বলন্ত চোখ মেলে আমার পানে তাকিয়ে ছিল, আমি তাই বন্দুক ছুড়েচি!”
বিমল তখনি আমার হাত থেকে বন্দুকটা টেনে নিলে। তারপর এক হাতে লন্ঠন, আর এক হাতে বন্দুক নিয়ে আগুন টপকে গুহার বাইরে গিয়ে চারিদিকে তন্ন তন্ন করে দেখে এসে বললে, “কোথাও কিছু নেই। ভূতের গল্প শুনে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে কুমার, তুমি ভুল দেখেচ!”
এমন সময় আবার সেই ভূতুড়ে খোকারা কোত্থেকে কেঁদে উঠল!
আমি মুখ শুকিয়ে বললুম, “ঐ শোনো!”
“কী?”
“ভূতদের খোকারা কাঁদচে; রামহরি, তুমিও শুনেচ তো?”
বিমল আর রামহরি দুজনেই একসঙ্গে হো হো করে হাসি শুরু করে দিল!
আমি রেগে বললুম, “তোমরা হাসচ বড় যে? এ কি হাসির কথা?”
বিমল হাসতে হাসতে বললে, “শহরের বাইরে কুমার তো কখনো পা দাওনি, শহর ছাড়া দুনিয়ার কিছুই জানো না, এখনো একটি আস্ত বুড়ো খোকা হয়ে আছে। যা শুনছ, তা ভূতদের খোকার কান্না নয়, বকের ছানার ডাক!”
“বকের ছানার ডাক?”
“হ্যাঁ গো হ্যাঁ! কাছেই কোনো গাছে বকের বাসা আছে। বকের ছানার ডাক অনেকটা কচি ছেলের কান্নার মতো।”
বেজায় অপ্রস্তুত হয়ে গেলুম। কিন্তু সেই জ্বলন্ত চোখদুটো তো মিথ্যে নয়! বিমল যতই উড়িয়ে দিক, আমি স্বচক্ষে দেখেছি, আর ভুল যে দেখিনি, তা আমি দিব্যি গেলে বলতে পারি! কিন্তু আজ যে-রকম বোকা বনে গেছি, তাতে এদের কাছে সে- ব্যাপার নিয়ে আপাতত কোনো উচ্চবাচ্য না করাই ভালো!
ষোলো
পিশাচ-রহস্য
পরের দিন সকালে উঠে দেখি আর-এক মুশকিল! রামহরির কম্প দিয়ে জ্বর এসেছে! কাজেই সেদিন আমাদের সেখানেই থেকে যেতে হল, জ্বর-গায়ে রামহরি তো আর পথ চলতে পারে না! ক্রমাগত পথ চলে চলে আমাদের শরীর বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিল, কাজেই এই হঠাৎ-পাওয়া ছুটিটা নেহাত মন্দ লাগল না!
সেদিনও বিমল দুটো পাখি মেরে আনল, নিজের হাতেই আমরা রান্নার কাজটা সেরে নিলুম!
সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কালকের রাতের সেই ভূতুড়ে ব্যাপারটার কথা আবার আমার মনে পড়ে গেল! বিমলের কাছে সেকথা তুলতে-না-তুলতেই সে হেসেই সব উড়িয়ে দিল। আমি কিন্তু অত সহজেই মনটাকে হালকা করে ফেলতে পারলুম না, আমি যে স্বচক্ষে দেখেছি! ভাবলে এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, বাপরে!
সেদিনও সরল কাঠের আগুন জেলে গুহার মুখটা আমরা বন্ধ করে দিলুম। আজ রামহরির অসুখ, কাজেই আমাদের দুজনকেই পালা করে পাহারা দিতে হবে। আজও প্রথম রাতে পাহারার ভার নিলে বিমল নিজে!
যখন আমার পালা এল, তখন গভীর রাত্রি। আজও চাঁদ ডুবে গেছে আর সেই গাছের পাতার মরমরানি, ঝরনার ঝরঝরানি আর বকের ছানাদের কাতরানি শোনা যাচ্ছে।
গুহার মুখের আগুনটা কমে আসছে দেখে আমি কতকগুলো চ্যালা কাঠ তার ভিতরে ফেলে দিলুম ৷ তার পরেই শুনলুম কেমন একটা শব্দ, গুহার বাইরে কে যেন খড়মড় করে শুকনো পাতা মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে।
কিন্তু প্রাণপণে তাকিয়েও সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে বিন্দু-বিসর্গ কিছুই দেখতে পেলুম না। শব্দটাও একটু পরে থেমে গেল।
কিন্তু আমার বুক টিপটিপ করতে লাগল!
বাঘা মনের সুখে কুন্ডলী পাকিয়ে, পেটের ভিতরে মুখ গুঁজে ঘুমোচ্ছিল, আমি তাকে জাগিয়ে দিলুম। বাঘা উঠে একটা হাই তুলে আর মাটির উপরে একটা ডন দিয়ে নিয়ে, আমার পাশে এসে দুই থাবা পেতে বসল। এক হাতে তার গলাটা জড়িয়ে ধরে আমি অনেকটা আশ্বস্ত হলুম।
আবার সেই শব্দ। বাঘার দিকে চেয়ে দেখলুম, সেও দুই কান খাড়া করে ঘাড় বাঁকিয়ে শব্দটা শুনছে। তার পরেই সে এক লাফে গুহার মুখে গিয়ে পড়ল, কিন্তু আগুনের জন্য বাইরে যেতে না পেরে, সেইখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গরগর গরগর করতে লাগল।
তার গজরানিতে বিমলের ঘুম ভেঙে গেল, উঠে বসে সে বললে, “আজ আবার কী ব্যাপার। বাঘা অমন করচে কেন?”
আমি বললুম, “বাইরে কিসের একটা শব্দ হচ্ছে, কে যেন চলে বেড়াচ্চে।”
“সে কী কথা!”, বলেই বিমল এগিয়ে এসে আমার হাত থেকে বন্দুকটা নিয়ে বাগিয়ে ধরলে।
শব্দটা তখন থেমে গেছে, কিন্তু ও কী ও ! আবার যে সেই দুটো জলন্ত চোখ অন্ধকারের ভিতর থেকে কটকট করে আমাদের পানে তাকিয়ে আছে!
বাঘা ঘেউঘেউ করে টেঁচিয়ে উঠল, আমিও বলে উঠলুম, “দ্যাখো, বিমল দ্যাখো!”
কিন্তু আমি বলবার আগেই বিমল দেখেছিল, সে মুখে কিছু বললে না, চোখদুটোর দিকে বন্দুকটা ফিরিয়ে একমনে টিপ করতে লাগল।
চোখদুটো আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছিল- হঠাৎ বিমল বন্দুকের ঘোড়া টিপে দিলে, সঙ্গে সঙ্গে ধুম করে শব্দ, আর একটা ভীষণ গর্জন। তার পরেই সব চুপ, চোখদুটোও আর নাই।
বিমল আমার দিকে ফিরে বললে, “এই চোখদুটোই কাল তুমি দেখেছিলে?”
“হ্যাঁ। এইবার তোমার বিশ্বাস হল তো?”
“তা হয়েছে বটে, কিন্তু এ পিশাচের নয়, বাঘের চোখ!”
“বাঘ?”
“হ্যাঁ। বোধ হয় এতক্ষণে লীলাখেলা সাঙ্গ করেচে, তবু বলা যায় না, আজ রাত্রে আর বাইরে গিয়ে দেখে কাজ নেই, কী জানি একেবারে যদি না মরে থাকে, আহত বাঘ ভয়ানক জীব!”
পরদিন সকালে উঠে দেখলুম, বিমল যা বলেচে তাই! গুহার মুখ থেকে খানিক তফাতে, পাহাড়ের উপরে একটা মরা বাঘ পড়ে রয়েচে, আমরা মেপে দেখলুম, পাকা ছয় হাত লম্বা! বিমলের টিপ আশ্চর্য, বন্দুকের গুলি বাঘটার ঠিক কপালে গিয়ে লেগেছে!
সতেরো
মরণের মুখে
দিন-তিনেক পরে রামহরির অসুখ সেরে গেল, আমাদেরও যাত্রা আবার শুরু হল। আবার আমরা পাহাড়ের পথ ধরে অজানা রহস্যের দিকে এগিয়ে চললুম।
বিমল বললে, “আমি একটু এগিয়ে যাই, আজকের খোরাক জোগাড় করতে হবে তো, পাখি-টাখি কিছু মেলে কি না দেখা যাক”, এই বলে সে বন্দুকটা কাঁধে নিয়ে হনহন করে এগিয়ে চলল, খানিক পরেই আঁকাবাঁকা পথের উপরে আর তাকে দেখা গেল না, কেবল শুনতে পেলাম গলা ছেড়ে সে গান ধরেছে:
“আগে চল্, আগে চল্ ভাই।
পড়ে থাকা পিছে মরে থাকা মিছে
বেঁচে মরে কিবা ফল ভাই।”
ক্রমে সে গানের আওয়াজও আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল।
রামহরির শরীর তখনো বেশ কাহিল হয়ে ছিল, সে তাড়াতাড়ি চলতে পারছিল না, কাজেই আমাকে বাধ্য হয়ে তার সঙ্গে থাকতে হল।
সেদিন সকালের রোদটি আমার ভারি ভালো লাগছিল, মনে হচ্ছিল যেন সারা পাহাড়ের বুকের উপরে কে কাঁচা সোনার মতো মিঠে হাসি ছড়িয়ে দিয়েছে। হরেক রকম পাখির গানে চারিদিক মাৎ হয়ে আছে, গাছপালার উপরে সবুজের ঢেউ তুলে বাতাস বয়ে যাচ্ছে, আর এখানে-ওখানে আশেপাশে গোছা-গোছা রঙিন বনফুল ফুটে, সোহাগে দুলে দুলে মাথা নেড়ে যেন বলছে, “আমাদের নিয়ে মালা গাঁথো, আমাদের আদর করো, আমাদের মনে রেখো, ভুলো না।”
কচি কচি ফুলগুলিকে দেখে মনে হল, এরা যেন বনদেবীর খোকা-খুকি। আমি বেছে বেছে অনেক ফুল তুললুম, কিন্তু কত আর তুলব, এত ফুল দুনিয়ার কোনো ধনীর বাগানেও যে ধরবে না।
এমনি নানা জাতের ফুল এদেশের সব জায়গাতেই আছে। কিন্তু আমাদের স্বদেশ যে কতবড় ফুলের দেশ, আমরা নিজেরাই সে-খবর রাখি না। আমরা বোকার মতো হাত গুটিয়ে বসে থাকি আর সেইসব ফুলের ভাণ্ডার দু-হাতে লুট করে নিয়ে যায় বিদেশী সাহেবেরা ৷ তারপর বড় শহরের বাজারে সেইসব ফুল চড়া দামে বিকিয়ে যায়, কেনে অবশ্য সাহেবরাই বেশি। এ থেকেই বেশ বুঝতে পারি, আমাদের ব্যবসা-বুদ্ধি তো নেই-ই, তারপরে সবচেয়ে যা লজ্জার কথা, স্বদেশের জিনিসকেও আমরা আদর করতে শিখিনি।
এই ভাবতে ভাবতে পথ চলছি, হঠাৎ রামহরি বলে উঠল, “ছোটবাবু, দেখুন দেখুন।”
আমি ফিরে বললুম, “কী?”
রামহরি আঙুল দিয়ে মাটির দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে।
পথের উপরে একটা বন্দুক পড়ে রয়েছে। দেখেই চিনতে পারলুম, সে বিমলের বন্দুক।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলুম, পথের মাঝখানে বন্দুক ফেলে বিমল গেল কোথায়? সে তো বন্দুক ফেলে যাবার পাত্র নয়।
ব্যাপারটা সুবিধের নয়, একটা-কিছু হয়েছেই। তারপর মুখ তুলেই দেখি, বাঘা একমনে একটা জায়গা শুঁকছে আর কেমন একটা কাতর কুঁই-কুঁই করছে।
এগিয়ে গিয়ে ভালো করে দেখি, সেখানে খানিকটা রক্ত চাপ বেঁধে রয়েছে।
রামহরি প্রায় কেঁদে ফেলে বললে, “খোকাবাবু নিশ্চয় কোনো বিপদে পড়েচেন।” আমি বললুম, “হ্যাঁ রামহরি, আমারও তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু কী বিপদ?”
রামহরি বললে, “কী করে বলব ছোটবাবু, এখনে যে বাঘ-ভাল্লুক সবই আছে!”
আমি বললুম, “বাঘে মানুষ খায় বটে কিন্তু ব্যাগ নিয়ে তো যায় না। বিমল বাঘের মুখে পড়েনি, তা হলে বন্দুকের সঙ্গে তার ব্যাগটাও এখানে পড়ে থাকত।”
“তবে খোকাবাবু কোথায় গেলেন?” এই বলেই রামহরি চেঁচিয়ে বিমলকে ডাকবার উপক্রম করলে।
আমি তাড়াতাড়ি তাকে বাধা দিয়ে বললুম, “চুপ, চুপ, চেঁচিও না, আমার বিশ্বাস বিমল শত্রুর হাতে পড়েছে, আর শক্ররা কাছেই আছে। চ্যাঁচালে আমরাও এখনি বিপদে পড়ব।”
“তা হলে উপায়?”
“তুমি এইখানে একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে বসে থাকো। বাঘাকেও ধরে রাখো, নইলে বাঘাও হয়তো চেঁচিয়ে আমাদের বিপদে ফেলবে। আমি আগে এদিক-ওদিক একবার দেখে আসি।”
বাঘার গলায় শিকলি বেঁধে রামহরি পথের পাশেই একটা ঝোপের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে বসল।
প্রথমে কোন্ দিক দিয়ে যাব আমি তা বুঝতে পারলুম না। কিন্তু একটু পরেই দেখলুম খানিক তফাতে আরো রক্তের দাগ রয়েছে, আরো খানিক এগিয়ে দেখলুম রক্তের দাগ। তৃতীয় দাগের পরেই একটা ঝোপের পাশে খুব সরু পথ, সেই পথের উপরে একটা লম্বা দাগ, যেন কারা একটা মস্ত বড় মোট ধুলোর উপর দিয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছে।
আমি সেই সরু পথ ধরলুম, সে-পথেও মাঝে মাঝে রক্তের দাগ দেখে বুঝতে দেরি লাগল না যে, এই দিকে গেলেই বিমলের দেখা পাওয়া যাবে।
কিন্তু বিমল বেঁচে আছে কি? এ-রক্ত কার? তাকে ধরে নিয়ে গেলই-বা কারা? সে কি ডাকাতের হাতে পড়েচে?, কিন্তু এসব কথার কোনো উত্তর মিলল না।
আচম্বিতে আমার পা থেমে গেল, খুব কাছেই যেন কাদের গলা শোনা যাচ্ছে।
আমার হাতের বন্দুকটা একবার পরখ করে দেখলুষ, তার দুটো ঘরেই টোটা ভরা আছে। তারপর ঝোপের পাশে পাশে গুঁড়ি মেরে খুব সন্তর্পণে সামনের দিকে অগ্রসর হলুম।
আর বেশি এগুতে হল না, সরু পথটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে অল্প খানিকটা খালি জমি, তার পরেই পাহাড়ের খাদ-- যে-দৃশ্য দেখলুম জীবনে তা ভুলব না। সেই খোলা জমির উপরে জনছয়েক লোক দাঁড়িয়ে আছে, তাদের একজনকে দেখেই চিনলুম, সে করালী।
আর একদিকে পাহাড়ের খাদের ধারেই একটা বড় গাছ হেলে পড়েছে এবং তারই তলায় পড়ে রয়েছে বিমলের দেহ। তার মাথা ও মুখ রক্তমাখা আর হাত ও কোমরে দড়ি বাঁধা। বিমলের উপরে হুমড়ি খেয়ে বসে আছে করালীর দলের আর একটা লোক।
শুনলুম করালী চেঁচিয়ে বলছে, “বিমল, এখনো কথার জবাব দাও। তোমার ব্যাগের ভেতরে পকেট-বই নেই, সেখানা কোথায় আছে বলো।”
কিন্তু বিমল কোনো উত্তর দিলে না।
বিমল চুপ।
করালী বললে, “শম্ভু।”
যে-লোকটা দড়ি ধরে ছিল, সে মুখ ফিরিয়ে বললে, “আজ্ঞে।”
লোকটাকে চিনলুম, ছাতকের ডাকবাংলোয় দেখেছিলুম।
করালী বললে, “দ্যাখো শঙ্গু, আর এক মিনিটের মধ্যে বিমল যদি আমার কথার উত্তর না দেয়, তবে তুমি ওকে তুলে খাদের ভেতর ছুড়ে ফেলে দিও।”
কয়েক সেকেন্ড কেটে গেল, আমার বুকটা ধুকপুক করতে লাগল, কী যে করব কিছুই স্থির করতে পারলুম না।
করালী বললে, “বিমল, এই শেষ-বার তোমাকে বলচি। যদি সাড়া না দাও, তবে তোমার কী হবে বুঝতে পারচ তো? একেবারে হাজার ফুট নিচে পড়ে তোমার দেহ গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে যাবে, একটু চিহ্ন পর্যন্তও থাকবে না।”
বিমল তেমনি বোবার মতন রইল।
আর এ-দৃশ্য সহ্য করা অসম্ভব ঠিক করলুম করালী যা জানতে চায় আমিই তার সন্ধান দেব। কাজ নেই আর যকের ধনে, টাকার চেয়ে প্রাণ ঢের বড় জিনিস। মন স্থির করে আমি উঠে দাঁড়ালুম।
করালী বললে, “বিমল, এখনো তুমি চুপ করে আছ?”
এতক্ষণ পরে বিমল বললে, “পকেট-বই পেলেই তো তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে?”
করালী বললে, “নিশ্চয়।”
বিমল বললে, “ব্যাগের মধ্যে আমার একটা জামার ভেতরদিককার পকেট খুঁজলেই তুমি পকেট-বই পাবে।”
ব্যাগটা করালীর সামনেই পড়ে ছিল, সে তখনই তার ভিতরে হাত পুরে দিল। একটু চেষ্টার পরেই পকেট-বই বেরিয়ে পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে করালীর মুখে একটা পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠল।
কিন্তু এ-হাসি দেখে এত বিপদেও আমার হাসি পেল। কারণ আমি জানি, পকেট-বই থেকে পথের ঠিকানার কথা বিমল আগেই মুছে দিয়েছে। এত বিপদেও বিমল ভয় পেয়ে বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেনি, -ধন্যি ছেলে যা-হোক!
বিমল বললে, “তোমাদের মনের আশা তো পূর্ণ হল, এইবার আমাকে ছেড়ে দাও।”
করালী কর্কশ স্বরে বললে, “হ্যাঁ, ছেড়ে দেব বৈকি, শক্রুর শেষ রাখব না। শম্ভু, আর কেন, ছোঁড়াকে নিশ্চিন্তপুর পাঠিয়ে দাও।”
বিমল চেঁচিয়ে বলে উঠল, “করালী। শয়তান! তুমি, “
কিন্তু তার কথা শেষ হতে-না-হতেই শম্ভু বিমলকে ধরে হিড়হিড় করে টেনে খাদের ধারে নিয়ে গিয়ে একেবারে ঠেলে ফেলে দিলে এবং চোখের পলক না যেতেই বিমলের দেহ ঝুপ করে নিচের দিকে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখের উপরে একটা অন্ধকারের পর্দা নেমে এল এবং মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে যেতে যেতে আবার শুনলুম, করালীর সেই ভীষণ অষ্টহাসি। তার পরেই আমি একেবারে অজ্ঞান হয়ে গেলুম।
আঠারো
অবাক কান্ড
কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে ছিলুম জানি না! যখন জ্ঞান হল, চোখ চেয়ে দেখলুম, রামহরি আমার মুখের উপরে হুমড়ি খেয়ে আছে। আমাকে চাইতে দেখে সে হাঁপ ছেড়ে বললে, “কী ছোটবাবু, অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন কেন?”
কেন যে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলুম, প্রথমটা আমার তা মনে পড়ল না, আমি আস্তে আস্তে উঠে বসলুম, বোকা বনে বোবার মতো।
রামহরি বললে, “তোমার ফিরতে দেরি হচ্চে দেখে আমার ভারি ভয় হল। বাঘাকে সেইখানেই বেঁধে রেখে তোমাকে খুঁজতে আমিই এই দিকে এলুম,”
এতক্ষণে আমার সব কথা মনে পড়ল, রামহরিকে বাধা দিয়ে পাগলের মতো লাফিয়ে উঠে আমি বললুম, “রামহরি, রামহরি, আমিও ওদের খুন করব।”
রামহরি আশ্চর্য হয়ে বললে, “কাদের খুন করবে ছোটবাবু, তুমি কী বলচ?” ফেলে দিয়েচে।”
আমার বন্দুকটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে আমি বললুম, “যারা বিমলকে খাদে ফেলে দিয়েচে।”
“খোকাবাবুকে খাদে ফেলে দিয়েচে! অ্যাঁ, অ্যাঁ,” রামহরি চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল!
আমি বললুম, “এখন তোমার কান্না রাখো রামহরি! এখন আগে চাই প্রতিশোধ। নাও, ওঠো, বিমলের বন্দুকটা নিয়ে এই দিকে এসো।”
আমি ঝোপ থেকে বেরিয়ে দাঁড়ালুম, ঠিক করলুম সামনে যাকে দেখব তাকেই গুলি করে মেরে ফেলব!
কিন্তু কেউ তো কোথাও নেই! খাদের পাশে খোলা জমি ধুধু করছে, সেখানে জনপ্রাণী দেখতে পেলুম না।
রামহরি পিছন থেকে বললে, “তুমি কাকে মারতে চাও ছোটবাবু?”
দাঁতে দাঁত ঘষে আমি বললুম, “করালীকে! কিন্তু এর মধ্যেই দলবল নিয়ে সে কোথায় গেল?”
“করালী!”- স্তম্ভিত রামহরির মুখ দিয়ে আর কথা বেরুল না।
“হ্যা রামহরি, করালী। তারই হুকুমে বিমলকে ফেলে দিয়েচে।”
আমারও গলা কান্নায় বন্ধ হয়ে এল। কোনোরকমে সামলে নিয়ে হতাশভাবে আমি বললুম, “রামহরি, বিমলের খোঁজ নেওয়া আর মিছে। এখান থেকে হাত-পা বেঁধে তাকে খাদের ভেতরে ফেলে দিয়েচে। অত উঁচু থেকে ফেলে দিলে লোহাই গুঁড়ো হয়ে যায়, মানুষের দেহ তো সামান্য ব্যাপার। বিমলকে আর আমরা দেখতে পাব না!”
রামহরি মাথায় করাঘাত করে বললে, “খোকাবাবু সঙ্গে না থাকলে কোন্ মুখে আবার মা-ঠাকরুনের কাছে গিয়ে দাঁড়াব? না, এ প্রাণ আমিও রাখব না। আমিও পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে মরব।” এই বলে সে খাদের ধারে ছুটে গেল।
অনেক কষ্টে আমি তাকে থামিয়ে রাখলুম ৷ তখন সে মাটির উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।
যেখান থেকে বিমলকে নিচে ফেলে দিয়েচে, আমি সেখানে গিয়ে দাঁড়ালুম। তারপর ধারের দিকে ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগলুম, বিমলের দেহটা নজরে পড়ে কি না।
নীচের দিকে তাকাতেই আমার মাথা ঘুরে গেল। উঃ, এমন গভীর খাদ জীবনে আমি কখনো দেখিনি, পাহাড়ের পিঠ খাড়াভাবে নিচের দিকে কোথায় যে তলিয়ে গেছে, তা নজরেই ঠেকে না। তলার দিকটা একেবারে ধোঁয়া-ধোঁয়া অস্পষ্ট।
হঠাৎ একটা অদ্ভুত জিনিস আমার চোখে পড়ল। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে থেকে হাত-পনেরো নিচেই পাহাড়ের খাড়া গায়ে একটা বুনোগাছের পুরু ঝোপ দেখা যাচ্ছে”, আর, আর সেই ঝোপের উপরে কী ও-টা?, ও যে মানুষের দেহের মতো দেখতে।
প্রাণপণে চেঁচিয়ে আমি বললুম, “রামহরি, দেখবে এসো।”
রামহরি তাড়াতাড়ি ছুটে এল, সঙ্গে সঙ্গে ঝোপের উপরে দেহটাও নড়ে উঠল।
আমি ডাকলুম, “বিমল, বিমল।”
নিচ থেকে সাড়া এল, “কুমার, এখনো আমি বেঁচে আছি ভাই।”
আবার আমি অজ্ঞানের মতো হয়ে গেলুম, আনন্দের প্রচণ্ড আবেগে। রামহরি তো আমোদে আটখানা হয়ে নাচতে শুরু করলে।
অনেক কষ্টে আত্মসংবরণ করে আমি বললুম, “রামহরি, অমন করে নাচলে তো চলবে না, আগে বিমলকে ওখান থেকে তুলে আনতে হবে যে।”
রামহরি তখনি নাচ বন্ধ করে, চোখ কপালে তুলে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললে, “তাই তো ছোটবাবু, ওখানে আমরা কী করে যাব, নামবার যে কোনো উপায় নেই!”
উঁকি মেরে দেখলুম বিমলের কাছে যাওয়া অসম্ভব, পাহাড়ের গা বেয়ে মানুষ তো আর টিকটিকির মতো নিচে নামতে পারে না! ওদিকে বিমল যেরকম বেকায়দায় হাজার হাজার ফুট নিচু খাদের তুচ্ছ একটা ঝোপের উপরে আটকে আছে,
এমন সময়ে নিচে থেকে বিমলের চিৎকার আমার ভাবনায় বাধা দিলে! শুনলুম, বিমল চেঁচিয়ে বলছে, “কুমার, শিগ্গির আমাকে তুলে নাও, আমি ক্রমেই নিচের দিকে সরে যাচ্ছি।”
তাড়াতাড়ি মুখ বাড়িয়ে আমি বললুম, “কিন্তু কী করে তোমার কাছে যাব, বিমল?”
বিমল বললে, “ আমার ব্যাগের ভিতর দড়ি আছে, সেই দড়ি আমার কাছে নামিয়ে দাও।”
“কিন্তু তোমার হাত-পা যে বাঁধা, দড়ি ধরবে কেমন করে?”
“কুমার, কেন মিছে সময় নষ্ট করচ, শিগগির দড়ি ঝুলিয়ে দাও!”
বিমলের ব্যাগটা সেইখানেই পড়ে ছিল, ভাগ্যে করালীরা সেটাও নিয়ে যায়নি। রামহরি তখনই তার ভিতর থেকে খানিকটা মোটা দড়ি বার করে আনলে।
জোর বাতাস বইছে, আর প্রতি দমকাতেই ঝোপটা দুলে দুলে উঠছে এবং সঙ্গে সঙ্গে বিমলের দেহ নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। কী ভয়ানক অবস্থা তার! আমার বুকটা ভয়ে টিপটিপ করতে লাগল।
বিমল বললে, “দড়িটা ঠিক আমার মুখের কাছে ঝুলিয়ে দাও। আমি দাঁত দিয়ে দড়িটা ভালো করে কামড়ে ধরার পর তোমরা দুজনে আমাকে ওপরে টেনে তুলো!”
আমি একবার সার্কাসে একজন সাহেবকে দাঁত দিয়ে আড়াই মণ ভারী মাল টেনে তুলতে দেখেছিলুম! জানি বিমলের গায়ে খুব জোর আছে, কিন্তু তার দাঁত কি এমন শক্ত হবে?
হঠাৎ বিষম একটা ঝোড়ো বাতাস এসে ঝোপের উপরে ধাক্কা মেরে বিমলের দেহকে আরো খানিকটা নিচের দিকে নামিয়ে দিল, কোনোরকমে দেহটাকে বাঁকিয়ে-চুরিয়ে বিমল একরকম আলগোছেই শূন্যে ঝুলতে লাগল। তার প্রাণের ভিতরটা তখন যে কীরকম করছিল, সেটা তার মড়ার মতো সাদা মুখ দেখেই বেশ বুঝতে পারলুম। হাওয়ার আর-একটা দমকা এলেই বিমলকে কেউ আর বাঁচাতে পারবে না।
তাড়াতাড়ি দড়ি ঝুলিয়ে দিলুম, একেবারে বিমলের মুখের উপরে। বিমল প্রাণপণে দড়িটা কামড়ে ধরলে।
আমি আর রামহরি দুজনে মিলে দড়ি ধরে টানতে লাগলুম, দেখতে দেখতে বিমলের দেহ পাহাড়ের ধারের কাছে উঠে এল; বিমলের মুখ তখন রক্তের মতোন রাঙা হয়ে উঠেছে, সামান্য দাঁতের জোরের উপরেই আজ তার বাচন-মরণ নির্ভর করছে।
রামহরি বললে, “ছোটবাবূ, তুমি একবার একলা দড়িটা ধরে থাকতে পারবে? আমি তা হলে খোকাবাবুকে হাতে করে ওপরে তুলে নি।”
আমি বললুম, “পারব।”
রামহরি দৌড়ে গিয়ে বিমলকে একেবারে পাহাড়ের উপরে নিরাপদ স্থানে তুলে ফেললে। তারপর তাকে নিজের বুকের ভিতরে টেনে নিয়ে আনন্দের আবেগে কাঁদতে লাগল আমি গিয়ে তার বাঁধন খুলে দিলুম।
আমি বল্লুম, “বিমল, কী করে তুমি ওদের হাতে গিয়ে পড়লে।”
বিমল বললে, “নিজের মনে গান গাইতে গাইতে আমি এগিয়ে যাচ্ছিলুম, ওরা বোধহয় পথের পাশে লুকিয়ে ছিল, হঠাৎ পিছন থেকে আমার মাথায় লাঠি মারে, আর আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।”
আমি বললুম, “তারপর যা হয়েছে, আমি সব দেখেচি। তোমাকে যে আবার ফিরে পাব, আমরা তা একবারও ভাবতে পারিনি।”
বিমল হেসে বললে, “হ্যাঁ, এতক্ষণে নিশ্চয় আমি পরলোকে ভ্রমণ করতুম- কিন্তু ভাগ্যে ঠিক আমার পায়ের তলাতেই ঝোপটা ছিল! রাখে কৃষ্ণ মারে কে?”
আমি মিনতি স্বরে বললুম, “বিমল, আর আমাদের যকের ধনে কাজ নেই- প্রাণ নিয়ে ভালোয় ভালোয় দেশে ফিরে যাই চলো।”
বিমল বললে, “তেমন কাপুরুষ আমি নই। তোমার ভয় হয়, তুমি যাও। আমি কিন্তু শেষ পর্যন্ত না দেখে এখান থেকে কিছুতেই নড়ব না।”
উনিশ
গাছের ফাঁকে ফাঁড়া
আবার আমাদের চলা শুরু হয়েছে। এবারে আমরা প্রাণপণে এগিয়ে চলেছি। পিছনে যখন শত্রু লেগেছে তখন যত তাড়াতাড়ি গন্তব্যস্থানে গিয়ে পৌঁছানো যায়, ততই মঙ্গল। কত বন-জঙ্গল, কত ঝরনা, খাদ, কত পাহাড়ের চড়াই-উতরাই পার হয়েই যে আমরা চলেছি, আর চলেছি, তার আর কোনো ঠিকানা নাই। মাঝে মাঝে আমার মনে হতে লাগল, আমরা যেন চলবার জন্যেই জন্মেছি, আমরা যেন মৃত্যুর দিন পর্যন্ত খালি চলবই আর চলবই। দুপুরবেলায় পাহাড় যখন উনুনে-পোড়ানো চাটুর মতো বিষম তেতে ওঠে, কেবল সেই সময়টাতেই আমরা চলা থেকে রেহাই পেয়ে রেঁধে খেয়ে কিছুক্ষণ গড়িয়ে নি! রাত্রে জ্যোৎস্না না থাকলেও দায়ে পড়ে আমাদের বিশ্রাম করতে হয়। নইলে চলতে চলতে রোজ আমরা দেখি, আকাশে উষার রঙিন আভাস মস্ত এক ফাগের থালার মতন প্রথম সূর্যের উদয়, বনের পাখির ডাকে সারা পৃথিবীর জাগরণ, সন্ধ্যার আভাসে মেঘে-মেঘে রামধনুকের সাতরঙা মেঘের তীরে সূর্যের বিদায়, তারপর পরীলোক-থেকে-উড়িয়ে-দেওয়া ফানুশের মতো চাঁদের প্রকাশ। আবার, সেই চাঁদই কতদিন আমাদের চোখের সামনেই ক্রমে ম্লান হয়ে প্রভাতের সাড়া পেয়ে মিলিয়ে যায়, ঠিক যেন স্বপ্নের মায়ার মতন।
কিন্তু করালীর আর দেখা নেই কেন? এতদিনে আবার তার সঙ্গে আমাদের দেখা হওয়া উচিত ছিল, কারণ এখন সে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে যে, পকেট-বইয়ে পথের কোনো ঠিকানাই আর নেই! সে কি হতাশ হয়ে আমাদের পিছন ছেড়ে সরে পড়েছে, না আবার কোনদিন হঠাৎ আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবে?
এমনিভাবে দিন চলতে চলতে শেষে একদিন আমরা রূপনাথের গুহার সুমুখে এসে দাঁড়ালুম! এই রূপনাথের গুহা! শুনেছি, এই গুহার ভিতর দিয়ে অগ্রসর হলে সুদূর চীনদেশে গিয়ে হাজির হওয়া যায়। একবার এক চীন-সম্রাট নাকি এই পথ দিয়ে ভারতবর্ষ আক্রমণ করতে এসেছিলেন। অবশ্য, এটা ইতিহাসের কথা নয়, প্রবাদেই একথা বলে। রূপনাথের গুহা বড় হোক আর ছোট হোক তাতে এসে যায় না, আর তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাবার দরকারও নেই। কিন্তু এখানে এসে আমরা অস্বস্তির হাঁপ ছেড়ে বাচলুম, কেননা এতদিন আমরা এই গুহার উদ্দেশেই আসছিলুম এবং এখানে পৌঁছে অন্তত এইটুকু বুঝতে পারলুম যে, এইবারে আমরা পথের শেষ দেখতে পাব। কারণ যে-জায়গায় যকের ধন আছে, এখান থেকে সে জায়গাটা খুবই কাছে, মাত্র দিন-তিনেকের পথ।
বিমল হাসিমুখে একটা গাছতলায় বসে গুনগুন করে গান গাইতে লাগল।
আমি তার পাশে গিয়ে বললুম, “বিমল, এখনি অতটা স্ফুর্তি ভালো নয়।”
বিমল ভুরু কুঁচকে বললে, “কেন?”
“মনে করো, বৌদ্ধমঠে গিয়ে যদি আমরা দেখি যে, যকের ধন সেখানে নেই, তা হলে!”
“কেনই-বা থাকবে না!”
“যে-সন্ন্যাসী আমার ঠাকুরদাদাকে মড়ার মাথা দিয়েছিল, সে যে বাজে কথা বলেনি তার প্রমাণ?”
“না, আমার দৃঢ় বিশ্বাস সন্ন্যাসী সত্য কথাই বলেচে। অকারণে মিছে কথা বলে তার কোনো লাভ ছিল না তো!”
আমি আর কিছু বললুম না।
বিমল বললে, “ওসব বাজে ভাবনা ভেবে মাথা খারাপ কোরো না। আপাতত আজকের মতো এখানে বসেই বিশ্রাম নেব। তারপর কাল আবার আমরা বৌদ্ধমঠের দিকে চলতে শুরু করব।”
সূর্য অস্ত গিয়েছে, তখনো সন্ধ্যা হতে দেরি আছে। পশ্চিমের আকাশে রঙের খেলা তখনো মিলিয়ে যায়নি, দেখলে মনে হয়, কারা যেন মেঘের গায়ে নানা রঙের জলছবি মেরে দিয়ে গেছে! সেদিন বাতাসটি আমার ভারি মিষ্টি লাগছিল! বিমল নিজের মনে গান গাইছে, আর আমি চুপ করে বসে শুনছি, তার গান বাস্তবিকই শোনবার মতো! এইভাবে খানিকক্ষণ কেটে গেল।
হঠাৎ সামনের জঙ্গলের দিকে আমার চোখ পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আমার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠল! আমি বেশ দেখলুম, একটা গাছের আড়াল থেকে করালীর কুৎসিত মুখখানা উঁকি মারছে, কুতকুতে চোখদুটো তার গোখরো সাপের মতো তীব্র হিংসায় ভরা। আমাদের সঙ্গে চোখাচোখি হবামাত্র মুখখানা বিদ্যুতের মতো সাঁৎ করে সরে গেল।
আমি তাড়াতাড়ি বিমলের গা টিপলুম, বিমল চমকে গান থামিয়ে ফেললে।
চুপিচুপি আমি বললুম, “করালী!”
বিমল একলাফে দীড়িয়ে উঠে চললে, “কৈ?”
আমি সামনের জঙ্গলের গাছটার দিকে দেখিয়ে বললুম, “এখানে।”
বিমল তখনি সেইদিকে যাবার উপক্রম করলে। কিন্তু আমি বাধা দিয়ে বললুম, “না যেও না। হয়তো করালীর লোকেরাও ওখানে লুকিয়ে আছে। আচমকা বিপদে পড়তে পারো।”
বিমল বললে, “ঠিক বলেচ! কিন্তু আমি যে আর থাকতে পারচি না, কুমার। আমার ইচ্ছে হচ্ছে, এখুনি ছুটে গিয়ে শয়তানের টুঁটি টিপে ধরি।”
আমি বললুম, “না, না, চলো, আমরা এখান থেকে সরে পড়ি। করালী ভাবুক, আমরা ওদের দেখতে পাইনি। তারপরে ভেবে দেখা যাবে আমাদের কী করা উচিত।”
চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে আমরা সেখান থেকে চলে এলুম! বেশ বুঝলুম, করালী যখন আমাদের এত কাছে-কাছে, তখন কোনো-না-কোনো দিক দিয়ে একটা নূতন বিপদ আসতে আর বড় দেরি নেই! যকের ধনের কাছে এসেছি বলে আমাদের মনে যে আনন্দের উদয় হয়েছিল, করালীর আবির্ভাবে সেটা আবার কর্পুরের মতন উবে গেল। কী মুশকিল, এই রাহুগ্রাস থেকে কি কিছুতেই আমরা ছাড়ান পাব না?
বিশ
পথের বাধা
কী দুর্গম পথ! কখনো প্রায় খাড়া উপরে উঠে গেছে, কখনো পাতালের দিকে নেমে গেছে, কখনো পাহাড়ের শিখরের চারিদিকে পাক খেয়ে, আবার কখনো-বা ঘুটঘুটে অন্ধকার গুহার ভিতর দিয়ে পথটা সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। এ-পথে নিশ্চয় লোক চলে না, কারণ পথের মাঝে মাঝে এমন সব কাঁটা-জঙ্গল গজিয়ে উঠেছে যে কুডুল দিয়ে কেটে না পরিষ্কার করে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব। ঠাকুরদাদার পকেট-বইয়ে যদি পথের ঠিকানা ভালো করে না লেখা থাকত, তা হলে নিশ্চয় আমরা এদিকে আসতে পারতুম না। পকেট-বইখানা এখন আমাদের কাছে নেই বটে, কিন্তু পথের বর্ণনা আমরা আলাদা কাগজে টুকে নিজেদের সঙ্গেই রেখেছিলুম। পথটা খারাপ বলে আমরা তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতেও পারছিলুম না। বিশ মাইল পথ আমরা অনায়াসে একদিনেই পেরিয়ে যেতুম, কিন্তু এই পথটা পার হতে আমাদের ঠিক পাঁচদিন লাগল।
কাল থেকে মনে হচ্ছে, আমরা ছাড়া পৃথিবীতে যেন আর কোনো মানুষ নেই। চারিদিক এত নির্জন আর এত নিস্তব্ধ যে নিজেদের পায়ের শব্দে আমরা নিজেরাই থেকে-থেকে চমকে উঠছি। মাঝে মাঝে বাঘা যেই ঘেউঘেউ করে ডাকছে আর অমনি চারিধারে পাহাড়ে-পাহাড়ে এমন বিষম প্রতিধ্বনি জেগে উঠছে যে আমার মনে হতে লাগল, পাহাড়ের শিখরগুলো যেন হঠাৎ আমাদের পদশব্দে জ্যান্ত হয়ে ধমকের পর ধমক দিচ্ছে। পাখিগুলো পর্যন্ত আমাদের সাড়া পেয়ে কিচির-মিচির করে ডেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে উড়ে পালাচ্ছে, যেন এ-পথে আর কখনো তারা মানুষকে হাঁটতে দেখেনি। উপরে আচম্বিতে এক অপূর্ব দৃশ্য ভেসে উঠল। সারি সারি মন্দিরের মতন কতকগুলো বাড়ি, সমস্ত যেন মিশকালো রঙে তুলি ডুবিয়ে, আগুনের মতো রাঙা আকাশের পটে এঁকে রেখেছে। একটা উঁচু পাহাড়ের শিখরের উপরে মন্দিরগুলো গড়া হয়েছে।
এই নিস্তব্ধতার রাজ্যের শিখরের উপরে মুকুটের মতো সেই মন্দিরগুলোর দৃশ্য এমন আশ্চর্যরকম গম্ভীর যে, বিস্ময়ে আর সম্ভ্রমে খানিকক্ষণ আমরা আর কথাই কইতে পারলুম না।
সকলের আগে কথা কইল বিমল। মহাআনন্দে সে চেঁচিয়ে উঠল, “বৌদ্ধ মঠ।”
আমিও বলে উঠলুম, “যকের ধন।”
রামহরি বললে, “আমাদের এতদিনের কষ্ট সার্থক হল।”
বাঘা আমাদের কথা বুঝতে পারলে না বটে, কিন্তু, এটা সে অনায়াসে বুঝে নিলে যে, আমরা সকলেই খুব খুশি হয়েছি। সে-ও তখন আমাদের মুখের পানে চেয়ে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে ঘেউঘেউ করতে লাগল। আনন্দের প্রথম আবেগ কোনোরকমে সামলে নিয়ে আবার তাড়াতাড়ি অগ্রসর হলুম। মঠ তখনো আমাদের কাছ থেকে প্রায় মাইলখানেক তফাতে ছিল, আমরা প্রতিজ্ঞা করলুম, আজকেই ওখানে না গিয়ে কিছুতেই আর বিশ্রাম করব না।
সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমেই ঘন হয়ে উঠল। বিমল আমাদের আগে আগে যাচ্ছিল। আচমকা সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলে, “সর্বনাশ।”
আমি বললুম, “কী হল বিমল?”
বিমল বললে, “উঃ, মরতে মরতে ভয়ানক বেঁচে গেছি।”
“কেন, কেন?”
“খবরদার! আর এগিয়ো না, দাঁড়াও! এখানে পাহাড় ধসে গেছে! আর পথ নেই।”
মাথায় যেন বজ্র ভেঙে পড়ল, পথ নেই। বিমল বলে কী? সাবধানে দু-চার পা এগিয়ে যা দেখলুম, তাতে মন একেবারে দমে গেল। পথের মাঝখানকার একটা জায়গা ধসে গিয়ে প্রায় পঞ্চাশ-যাট ফুট গভীর এক ফাঁকের সৃষ্টি করেছে, ফাঁকের মুখটাও প্রায় সতেরো-আঠারো ফুট চওড়া! সেই ফাঁকের মধ্যেও নেমে যে পথের এদিক থেকে ওদিক গিয়ে উঠব, এমন কোনো উপায়ও দেখলুম না। পথের দুপাশে যে খাড়া খাদ রয়েচে, তা এত গভীর যে দেখলেও মাথা ঘুরে যায়। এ কী বিড়ম্বনা, এতদিনের পরে, এত বিপদ এড়িয়ে যকের ধনের সামনে এসে, শেষটা কি এইখান থেকেই বিফল হয়ে ফিরে যেতে হবে?
আমার সর্বাঙ্গ এলিয়ে এল, সেইখানেই আমি ধুপ করে বসে পড়লুম।
খানিকক্ষণ পরে মুখ তুলে দেখলুম, ঠিক সেই ভাঙা জায়গাটার ধারে একটা মস্ত উঁচু সরল গাছের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বিমল কী ভাবছে।
আমি বললুম, “আর কী দেখচ ভাই, এখানে বসবে এসো, আজ এখানেই রাতটা কোনোরকমে কাটিয়ে কাল আবার বাড়ির দিকে ফিরব।”
বিমল রাগ করে বললে, “এত সহজেই যদি হাল ছেড়ে দেব, তবে মানুষ হয়ে জন্মেচি কেন?”
আমি বললুম, “হাল ছাড়ব না তো কী করব বলো? লাফিয়ে তো আর ফাঁকটা পার হতে পারব না, ডানাও নেই যে, উড়ে যাব।”
বিমল বললে, “তোমাকে লাফাতেও হবে না, উড়তেও বলচি না। আমরা হেঁটেই যাব।”
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, “হেঁটে! শূন্য দিয়ে হেঁটে যাব কীরকম?”
বিমল বললে, “শোনো বলচি। এই ফাঁকটার মাপ সতেরো-আঠারো ফুটের বেশি হবে না কেমন?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা, ভাঙা পথের ঠিক ধারেই যে সরল গাছটা রয়েছে, ওটা আন্দাজ কত ফুট উঁচু হবে বলো দেখি?”
“সতেরো-আঠারো ফুটের চেয়ে ঢের বেশি।”
“বেশ, তা হলে আর ভাবনা কী? আমরা কুডুল দিয়ে কুপিয়ে গাছের গোড়াটা এমনভাবে কাটব, যাতে করে পড়বার সময়ে গাছটা পথের ঐ ভাঙা অংশের উপরেই গিয়ে পড়ে। তা হলে কী হবে বুঝতে পারচ তো?”
আমি আহ্লাদে এক লাফ মেরে বললুম, “ওহো বুঝেচি। গাছটা ভাঙা জায়গার উপর পড়লেই একটা পোলের মতো হবে। তা হলেই আমরা তার উপর দিয়ে ওপারে যেতে পারব। বিমল তুমি হচ্ছ বুদ্ধির বৃহস্পতি। তোমার কাছে আমরা এক-একটি গোরু বিশেষ।”
বিমল বললে, “বুদ্ধি সকলেরই আছে, কিন্তু কাজের সময়ে মাথা ঠাণ্ডা রেখে সকলেই সমানভাবে বুদ্ধিকে ব্যবহার করতে পারে না বলেই তো মুশকিলে পড়তে হয়, যাক, আজ আমাদের এইখানে বিশ্রাম। কাল সকালে উঠেই আগে গাছটা কাটবার ব্যবস্থা হবে।”
একুশ
বাধার উপরে বাধা
গভীর রাত্রি। একটা ঝুঁকে-পড়া পাহাড়ের তলায় আমরা আশ্রয় নিয়েছি। আমাদের দুদিকে পাহাড় আর দুদিকে আগুন! বিমল আর রামহরি ঘুমোচ্ছে, আমিও কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি, কিন্তু ঘুমোইনি, কারণ এখন আমার পাহারা দেবার পালা। চাঁদের আলোয় কাজ আর তেমন জোর নেই; চারিদিকে আলো আর অন্ধকার যেন একসঙ্গে লুকোচুরি খেলছে! হঠাৎ বৌদ্ধমঠে যাবার পথের উপর দিয়ে শেয়ালের মতো কী-একটা জানোয়ার বারবার পিছনে তাকাতে তাকাতে তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেল, দেখলেই মনে হয় সে যেন কোনো কারণে ভয় পেয়েছে।
মনে কেমন সন্দেহ হল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলুম বটে, কিন্তু চোখের কাছে একটু ফাঁক রাখলুম, আর বন্দুকটাও কাপড়ের ভিতরেই বেশ করে বাগিয়ে ধরলুম। এক, দুই, তিন মিনিট। তার পরেই দেখলুম, পাহাড়ের আড়াল থেকে পথের উপরে একটা মানুষ বেরিয়ে এল... তারপর আর-একজন...তারপর আরো একজন...তারপর একসঙ্গে দুইজন। সবসুদ্ধ পাঁচজন লোক।
আস্তে আস্তে চোরের মতন আমাদের দিকে তারা এগয়ে আসছে! যদিও রাতের আবছায়ায় তফাত থেকে তাদের চিনতে পারলুম না, তবুও আন্দাজেই বুঝে নিলুম, তারা কারা! সব-আগের লোকটা আমাদের অনেকটা কাছে এগিয়ে এল! আমাদের সামনেকার আগুনের আভা তার মুখের উপরে গিয়ে পড়তেই চিনলুম, সে করালী! একটা নিষ্ঠুর আনন্দে বুকটা আমার নেচে উঠল! এই করালী! এরই জন্যে আমাদের কত বিপদে পড়তে হয়েছে, কতবার প্রাণ যেতে যেতে বেঁচে গেছে, এখনো এ আমাদের যমের বাড়ি পাঠাবার জন্যে তৈরি হয়ে আছে; ধরি ধরি করেও কোনোবারেও একে আমরা ধরতে পারিনি, কিন্তু এবারে আর কিছুতেই এর ছাড়ান নেই।
বন্দুকটা তৈরি রেখে একেবারে মরার মতো আড়ষ্ট হয়ে পড়ে রইলুম। করালী আরো কাছে এগিয়ে আসুক না, তার পরেই তার সুখের স্বপ্ন জন্মের মতো ভেঙে দেব! পা টিপে-টিপে করালী ক্রমে আমাদের কাছ থেকে হাত-পনেরো-ষোলো তফাতে এসে পড়ল, তার পিছনে পিছনে আর চারজন লোক।
আগুনের আভায় দেখ্লুম, করালীর সেই কুৎসিত মুখখানা আজ রাক্ষসের মতোই ভয়ানক হয়ে উঠেছে। তার ডানহাতে একখানা মস্তবড় চকচকে ছোরা, এখানা নিশ্চয়ই সে আমাদের বুকের উপরে বসাতে চায়, তার পিছনের লোকগুলোরও প্রত্যেকের হাতে ছোরা, বর্শা বা তরোয়াল রয়েছে। এটা আমাদের খুব সৌভাগ্যের কথা যে, করালীরা কেউ বন্দুক জোগাড় করে আনতে পারেনি। তাদের সঙ্গে বন্দুক থাকলে এতদিন নিশ্চয় আমরা বেঁচে থাকতে পারতুম না।
করালী আমাদের আগুনের বেড়াটা পেরিয়ে আসবার উদ্যোগ করলে।
বুঝলুম, এই সময়। বিদ্যুতের মতন আমি লাফিয়ে উঠলুম, তারপর চোখের পলক ফেলবার আগেই বন্দুকটা তুলে দিলুম একেবারে ঘোড়াটি টিপে। গুড়ুম। বিকট এক চিৎকার করে করালী মাথার উপর দুহাত তুলে মাটির উপরে পড়ে গেল।
তার পিছনের লোকগুলো হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, তাদের দিকেও আর-একবার বন্দুক ছুঁড়তেই তারা প্রাণের ভয়ে পাগলের মতো দৌড়ে পালাল।
কিন্তু বন্দুকের গুলি বোধ হয় করালীর গায়ে ঠিক জায়গায় লাগেনি, কারণ মাটির উপরে পড়েই সে চোখের নিমেষে উঠে দাঁড়াল, তারপর প্রাণপণে ছুটে অন্ধকারে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। আমার দোনলা বন্দুকে আর টোটা ছিল না, কাজেই তাকে আর বাধা দিতেও পারলুম না। কয়েক সেকেন্ড পরেই ভীষণ এক আর্তনাদে নিস্তব্ধ রাত্রের আকাশ যেন কেঁপে কেঁপে উঠল, তেমন আর্তনাদ আমি জীবনে আর কখনো শুনিনি। তার পরেই আবার সব চুপচাপ।, ও আবার কী ব্যাপার?
মিনিট-খানেকের মধ্যেই এই ব্যাপারগুলো হয়ে গেল। ততক্ষণে গোলমালে বিমল, রামহরি আর বাঘাও জেগে উঠেছে।
বিমলকে তাড়াতাড়ি দু’কথায় সমস্ত বুঝিয়ে দিয়ে বললুম, “কিন্তু এ আর্তনাদ যে কেন হল বুঝতে পারচি না। আমার মনে হল একসঙ্গে যেন জনতিনেক লোক চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল।”
বিমল সভয়ে বললে, “কী ভয়ানক! নিশ্চয়ই অন্ধকারে দেখতে না পেয়ে তারা ভাঙা পথের সেই ফাঁকের মধ্যে পড়ে গেছে। তারা কেউ আর বেঁচে নেই।”
আমি বললুম, “কিন্তু করালী ওদিকে যায়নি, সে এখনো বেঁচে আছে।”
রামহরি বললে, “আহা, হতভাগাদের জন্যে আমার ভারি দুঃখ হচ্ছে, শেষটা অপঘাতে মরল।”
বিমল বললে, “যেমন কর্ম, তেমনি ফল, দুঃখ করে লাভ নেই! করালীর যদি শিক্ষা না হয়ে থাকে তবে তার কপালেও অপঘাত মৃত্যু লেখা আছে।”
আমি বললুম, “অন্তত কিছুদিনের জন্যে আমরা নিশ্চয় করালীর দেখা পাব না। সে মরেনি বটে, কিন্তু রীতিমতো জখম যে হয়েচে, তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই।”
বিমল বললে, “আর তিন দিন যদি বাধা না পাই, তা হলে যকের ধন আমাদের মুঠোর ভিতরে এসে পড়বেই, এ আমি তোমাকে বলে দিলুম।”
আমি হেসে বললুম, “তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।”
বাইশ
অলৌকিক কান্ড
সেই সকাল থেকে আমরা ভাঙা জায়গাটার ধারে গিয়ে, সরল গাছের গোড়ার উপরে ক্রমাগত কুড়ুলের ঘা মারছি আর মারছি। এমনভাবে আমরা গাছ কাটছি, যাতে করে পড়বার সময়ে সেটা ঠিক ভাঙা জায়গার উপরে গিয়ে পড়বে। দুপুরের সময় গাছটা পড়ো-পড়ো হল। আমরা খুব সাবধানে কাজ করতে লাগলুম, কারণ আমাদের সমস্ত আশা-ভরসা এখন গাছটার উপরেই নির্ভর করছে, একটু এদিক-ওদিক হলেই সকলকে ধুলো-পায়েই বাড়ির দিকে ফিরতে হবে।
গাছটা পড়তে আর দেরি নেই, তার গোড়া মড়মড় করে উঠল।
বিমল বললে, “আর গোটাকয়েক কোপ। ব্যস, তা হলেই কেল্লা ফতে।”
টিপ করে ঠিক গোড়া-ঘেঁষে মারলুম আরো বার-কয়েক কুডুলের ঘা।
বিমল বলে উঠল, “হুঁশিয়ার। সরে দাঁড়াও, গাছটা পড়চে।”
আমি আর রামহরি একলাফে পাশে সরে দাঁড়ালুম।
মড় মড় মড়, মড়াৎ। গাছটা হুমমুড় করে ভাঙা জায়গাটার দিকে ঢলে পড়ল।
বিমল বললে “ব্যস। দ্যাখো কুমার আমাদের পোল তৈরি।”
গাছটা ঠিক মাঝখানকার ফাঁকটার উপর দিয়ে পাহাড়ের ওধারে গিয়ে পড়েছে, তার গোড়া রইল এদিকে, আগা রইল ওদিকে। যা চেয়েছিলুম তাই।
আহার আর বিশ্রাম সেরে আমরা আবার বৌদ্ধমঠের দিকে অগ্রসর হলুম৷ রোদ্দুরে পাহাড়ে-পথ তেতে আগুন হয়ে উঠেছিল, কিন্তু সেসব কষ্ট আমরা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলুম না, মনে-মনে দৃঢ়পণ করলুম যে আজ মঠে না গিয়ে কিছুতেই আর জিরেন নাই। সূর্য অস্ত যায়-যায়। মঠও আর দূরে নেই। তার মেঘ-ছোঁয়া মন্দিরটার ভাঙা চূড়া আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে জেগে আছে। এদিকে-ওদিকে আরো কতকগুলো ছোট ছোট ভগ্নস্তূপও দূর থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি।
আরো খানিক এগিয়ে দেখলুম আমাদের দু’পাশে কারুকার্য অনেক গুহা রয়েছে। এইসব গুহায় আগে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা বাস করতেন, এখন কিন্তু তাদের ভিতর জনপ্রাণীর সাড়া নেই। গুহাগুলোর মাঝখান দিয়ে পথটা হঠাৎ একদিকে বেঁকে গেছে। সেই বাঁকের মুখে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলুম আমার সামনেই মঠের সিংদরজা।
আমরা সকলেই একসঙ্গে প্রচণ্ড উৎসাহে জয়ধ্বনি করে উঠলুম। বাঘা আসল কারণ না বুঝেও আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে চ্যাঁচাতে লাগল, ঘেউ ঘেউ ঘেউ। অনেকদিন পরে আবার সেই পোড়ো মন্দিরটার চারিদিকে সরগরম হয়ে উঠল।
বিমল দু’হাত তুলে উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠল, “যকের ধন। যকের ধন আজ আমাদের।”
আমি বললুম “চলো, চলো। আগে সেই জায়গাটা খুঁজে বার করি।”
সিংদরজার ভিতর দিয়ে আমরা মন্দিরের আঙিনায় গিয়ে পড়লুম। প্রকাণ্ড আঙিনা, চারিদিকে চকবন্দি ঘর, কিন্তু এখন আর তাদের কোনো শ্রী-ছাঁদ নেই। বুনো চারাগাছে আর জঙ্গলে পা ফেলে চলা দায়, এখানে-ওখানে ভাঙা পাথর ও নানারকম মূর্তি পড়ে রয়েছে, স্থানে-স্থানে জীবজন্তুর রাশি রাশি হাড়ও দেখলুম। বোধ হয় হিংস্র পশুরা এখন সন্ন্যাসীদের ঘরের ভিতরে আস্তানা গেড়ে বসেছে, বাইরে থেকে শিকার ধরে এখানে বসে বসে নিশ্চিন্তভাবে পেটের ক্ষুধা মিটিয়ে নেয়।
আমি বললুম, “বিমল, মড়ার মাথাটা এইবার বার করো, সঙ্কেত দেখে পথ ঠিক করতে হবে।”
বিমল বললে, “তার জন্যে ভাবনা কী, সঙ্কেতের কথাগুলো আমার মুখস্থই আছে।” এই বলে সে আউড়ে গেল: “ভাঙা দেউলের পিছনে সরল গাছ। মূলদেশ থেকে পূর্বদিকে দশগজ এগিয়ে থামবে। ডাইনে আটগজ এগিয়ে বুদ্ধদেব। বামে ছয়গজ এগিয়ে তিনখানা পাথর। তার তলায় সাতহাত জমি খুঁড়লে পথ পাবে।”
আমি বললুম, “তা হলে আগে আমাদের ভাঙা দেউল খুঁজে বার করতে হবে।”
বিমল বললে “খুঁজতে হবে কেন? দেউল বলতে এখানে নিশ্চয়ই বোঝাচ্ছে এ প্রধান মন্দিরকে। ও মন্দির তো ভাঙা। আচ্ছা, দেখাই যাক না।”
আমরা বড় মন্দিরের পিছনের দিকে গিয়ে উপস্থিত হলুম।
রামহরি বললে, “বাহবা, ঠিক কথাই যে! মন্দিরের পিছনে এ যে সরল গাছ।”
তাই বটে। মন্দিরের পিছনে অনেকটা খোলা জায়গা, আর তার মধ্যে সরল গাছ আছে মাত্র একটি,, কিছু ভুল হবার সম্ভাবনা নেই। চারিদিকে মাঝে মাঝে ছোট বড় অনেকগুলো বুদ্ধদেবের মুর্তি রয়েছে কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। ভাঙা, অভাঙা পাথরও পড়ে আছে অগুন্তি।
বিমল বললে, “এরি মধ্যে কোনো-একটি মূর্তির কাছে আমাদের যকের ধন আছে। আচ্ছা, সরল গাছ থেকে পূর্বদিকে এই দশগজ এগিয়ে থামলুম। তারপর ডাইনে আটগজ, হুঁ এই যে বুদ্ধদেব। বাঁয়ে ছয় গজ, কুমার, দ্যাখো দ্যাখো, ঠিক তিনখানাই পাথর পরে পরে সাজানো রয়েচে। মড়ার মাথার সঙ্কেত তা হলে মিথ্যে নয়।”
আহ্লাদে বুক আমার দশখানা হয়ে উঠল, মনের আবেগ আর সহ্য করতে না পেরে আমি সেই পাথরগুলোর উপরে ধুপ করে বসে পড়লুম।
বিমল বললে, “ওঠো, ওঠো। এখন দেখতে হবে, পাথরের তলায় সত্যিসত্যিই কিছু আছে কি না।”
আমরা তিনজনে মিলে তখনি কোমর বেঁধে পাথর সরিয়ে মাটি খুঁড়তে লেগে গেলুম। প্রায় হাত সাতেক খোঁড়ার পরেই কুডুলের মুখে কী-একটা শক্ত জিনিস ঠক্ ঠক্ করে লাগতে লাগল। মাটি সরিয়ে দেখা গেল, আর-একখানা বড় পাথর। অল্প চেষ্টাতেই পাথরখানা তুলে ফেলা গেল, সঙ্গে সঙ্গে দেখলুম গর্তের মধ্যে সত্যসত্যই একটি বাঁধানো সুড়ঙ্গ-পথ রয়েছে।
আমাদের তখনকার মনের ভাব লেখায় খুলে বলা যাবে না। আমরা তিনজনেই আনন্দ বিহ্বল হয়ে পরস্পরের মুখের পানে তাকিয়ে বসে রইলুম।
কিন্তু হঠাৎ একটা ব্যাপারে বুকটা আমার চমকে উঠল। গর্তের ভিতর থেকে হু হু করে ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে।
“বিমল, দ্যাখো- দ্যাখো।”
বিমল সবিষ্ময়ে গর্তের দিকে তাকিয়ে থেকে বললে, “তাই তো, এ কী কাণ্ড! এতদিনের বন্ধ গর্তের ভেতর থেকে ধোঁয়া আসছে কেমন করে?”
তখন সন্ধ্যা হতে আর বিলম্ব নেই, পাহাড়ের অলিগলি ঝোপঝাপের ধারে ধারে অন্ধকার জমতে শুরু হয়েছে, চারিদিকে এত স্তব্ধ যে পাখিদের সাড়া পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না।
গর্ত থেকে ধোঁয়া তখনো বেরুচ্ছে, আর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুরে ঘরে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে!
বিমল আস্তে আস্তে বললে, “সামনেই রাত্রি, আজ আর হাঙ্গামে কাজ নেই। কাল সকালে সব ব্যাপার বোঝা যাবে। এসো, গর্তের মুখে আবার পাথর চাপিয়ে রাখা যাক।”
তেইশ
মরণের হাসি
মনটা কেমন দমে গেল। অতগুলো পাথর-চাপানো বন্ধ গর্তের মধ্যে ধোঁয়া এল কেমন করে? আগুন না থাকলে ধোঁয়া হয় না, কিন্তু গর্তের ভিতরে আগুনই-বা কোত্থেকে আসবে? অনেক ভেবেও কিছু ঠিক করতে পারলুম না।
সে-রাত্রে মঠের একটা ঘরের ভিতরে আমরা আশ্রয় নিলুম। খাওয়াদাওয়ার পর শোবার আগে বিমলকে আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “হ্যাঁ হে, তুমি যকের কথায় বিশ্বাস কর?”
বিমল বললে, “হ্যাঁ, শুনেছি যক একরকম প্রেতযোনি। তারা গুপ্তধন রক্ষা করে। কিন্তু যক আমি কখনো দেখিনি, কাজেই তার কথা আমি বিশ্বাসও করি না।”
আমি বললুম, “তুমি ভগবানকে কখনো চোখে দেখনি, তবু ভগবানকে যখন বিশ্বাস কর, তখন যকের কথাতেও বিশ্বাস কর না কেন?”
বিমল বললে, “হঠাৎ যকের কথা তোলবার কারণ কী, কুমার?”
“কারণ আমার বিশ্বাস এ গুপ্তধনের গর্তের ভেতরে ভুতুড়ে কিছু আছে। নইলে, “
“নইলে-টইলের কথা যেতে দাও। ভূত দানব যাই-ই থাক, কাল আমি গর্তের মধ্যে ঢুকবই”, দৃঢ়স্বরে এই কথাগুলো বলেই বিমল শুয়ে পড়ে কম্বল মুড়ি দিলে।
আমার বুকের ছমছমানি কিন্তু গেল না! রামহরির কাছ-ঘেঁষে বসে বললুম, “আচ্ছা রামহরি, তুমি যক বিশ্বাস কর?”
“করি ছোটবাবু।”
“তোমার কি মনে হয় না রামহরি, যে এ গর্তের ভেতরে যক আছে?”
“যকই থাকুক আর রাক্ষসই থাকুক, খোকাবাবু যেখানে যাবে, আমিও সেখানে যাব”, এই বলে রামহরিও লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।
যেমন মনিব, তেমনি চাকর। দুটিতে সমান গোঁয়ার। আমি নাচার হয়ে বসে বসে পাহারা দিতে লাগলুম।
ভোরবেলায় উঠেই আমরা আবার যথাস্থানে গিয়ে হাজির। গর্তের মুখ থেকে পাথরগুলো আবার সরিয়ে ফেলা হল। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করেও আজ কিন্তু ধোঁয়া দেখতে পাওয়া গেল না।
বিমল আশ্বস্ত হয়ে বললে, “বোধ হয় অনেক কাল বন্ধ থাকার দরুন গর্তের ভেতর বাষ্প-টাষ্প কিছু জমেছিল, তাকেই আমরা ধোঁয়া বলে ভ্রম করেছিলুম।
বিমলের এই অনুমানে আমারও মন সায় দিল। নিশ্চিন্ত হয়ে বললুম, “এখন আমাদের কী করা উচিত?”
“কুমার, রামহরি, তোমরা প্রত্যেকে এক-একটা ইলেকট্রিকের টর্চ নাও, কারণ সুড়ঙ্গের ভেতরটা নিশ্চয়ই অমাবস্যার রাতের মতো অন্ধকার”,-- এই বলে সে প্রথমে বাঘাকে গর্তের মধ্যে নামিয়ে দিলে, তারপর নিজেও নেমে পড়ল। আমরাও দুজনে তার অনুসরণ করলুম।
উঃ, সুড়ঙ্গের ভিতরে সত্যিই কী বিষম অন্ধকার। দু-চার পা এগিয়ে আমরা ভুলে গেলুম যে, বাইরে এখন সূর্যদেবের রাজ্য। ভাগ্যে এই ‘বিজলি-মশাল’ বা ইলেকট্রিক টর্চগুলো আমাদের সঙ্গে ছিল, নইলে একপা-ও অগ্রসর হ’তে পারতুম না।
আমরা হেঁট হয়ে ক্রমেই ভিতরে প্রবেশ করছি, কারণ সুড়ঙ্গের ছাদ এত নিচু যে, মাথা তুলবার কোনো উপায় নেই।
আচম্বিতে পিছনে কিসের একটা শব্দ হল, সঙ্গে সঙ্গে আমরা সকলেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লুম।
পিছনে ফিরে দেখলুম, সুড়ঙ্গের মুখের গর্ত দিয়ে বাইরের যে আলোটুকু আসছিল, তা আর দেখা যাচ্ছে না।
আবার সেইরকম একটা শব্দ। তারপর, আবার, আবার।
আমি তাড়াতাড়ি ফের সুড়ঙ্গের মুখে ছুটে এলুম। যা দেখলুম, তাতে প্রাণ আমার উড়ে গেল।
সুড়ঙ্গের মুখ একেবারে বন্ধ।
বিমলও এসে ব্যাপারটা দেখে স্তন্তিত হয়ে গেল।
অনেকক্ষণ সবাই চুপচাপ, সকলের আগে কথা কইলে রামহরি।
সে বললে, “কে এ কাজ করলে?”
বিমল পাগলের মতন গর্তের মুখে ঠেলা মারতে লাগল, কিন্তু তার অসাধারণ শক্তিও আজ হার মানলে, গর্তের মুখ একটুও খুলল না।
আমি হতাশভাবে বললুম, “বিমল, আর প্রাণের আশা ছেড়ে দাও, এখানেই জ্যান্ত আমাদের কবর হবে!”
আমার কথা শেষ হতে-না-হতেই কাশির মতো খনখনে গলায় হঠাৎ খিলখিল করে কে হেসে উঠল! সে কী ভীষণ বিশ্রী হাসি, আমার বুকের ভিতরটা যেন মড়ার মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেল!
হাসির আওয়াজ এল সুড়ঙ্গের ভিতর থেকেই! তিনজনেই বিজলি-মশাল তুলে ধরলুম, কিন্তু কারুকেই দেখতে পেলুম না!
বিমল বললে, “কে হাসলে কুমার?”
আমি ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে কাঁপতে বললুম, “যক, যক!”
সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই খিলখিল করে খনখনে হাসি!
মানুষে কখনো তেমন হাসি হাসতে পারে না। বাঘা পর্যন্ত অবাক হয়ে কান খাড়া করে সুড়ঙ্গের ভিতর দিকে চেয়ে রইল।
পাছে আবার সেই হাসি শুনতে হয়, তাই আমি দু’হাতে সজোরে দু-কান বন্ধ করে মাটির উপরে বসে পড়লুম।
চব্বিশ
ধনাগার
জীবনে এমন বুক-দমানো হাসি শুনিনি, সে হাসি শুনলে কবরের ভেতরে মড়াও যেন চমকে জেগে শিউরে ওঠে। সেই হাসির তরঙ্গে সমস্ত সুড়ঙ্গ যেন কাঁপতে লাগল। আমার মনে হল বহুকাল পরে সুড়ঙ্গের মধ্যে মানুষের গন্ধ পেয়ে যক আজ প্রাণের আনন্দে হাসতে শুরু করেছে, কতকাল অনাহারের পর আজ তার হাতের কাছে খোরাক গিয়ে আপনি উপস্থিত! উপরে গর্তের মুখ বন্ধ, ভিতরে এই কাণ্ড! এ-জীবনে আর যে কখনো চন্দ্র-সূর্যের মুখ দেখতে পাব না, তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই!
হাসির আওয়াজ ক্রমে দূরে গিয়ে ক্ষীণ হয়ে মিলিয়ে গেল, কেবল তার প্রতিধ্বনিটা সুড়ঙ্গের মধ্যে গমগম করতে লাগল! আর কোনো বাঙালির ছেলে নিশ্চয়ই আমাদের মতন অবস্থায় কখনো পড়েনি! আমরা যে এখনো পাগল হয়ে যাইনি এইটেই আশ্চর্য!
তিনজনে স্তম্ভিতের মতো বসে বসে পরস্পরের মুখ-চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলুম, কারুর মুখে আর বাক্য সরছে না। বিমলের মুখে আজ প্রথম এই দুর্ভাবনার ছাপ দেখলুম। সে ভয় পেয়েছে কি না বুঝতে পারলুম না, কিন্তু আমার মনে হল, আজ সে বিলক্ষণ দমে গিয়েছে! আর না দমে করে কী, এতেও যে দমবে না, নিশ্চয়ই সে মানুষ নয়!
প্রথম কথা কইলে রামহরি! আমাকে হাতে ধরে টেনে তুলে বললে, “বাবু, আর এরকম করে বসে থাকলে কী হবে, একটা ব্যবস্থা করতে হবে তো?”
আমি বললুম, “ব্যবস্থা আর করব ছাই! যতক্ষণ গ্রাণটা আছে, নাচার হয়ে নিশ্বাস ফেলি এসো!”
বিমল বলে, “কিন্তু গর্তের মুখ বন্ধ করল কে?”
আমি বললুম, “যক!”
বিমল মুখ ভেঙিয়ে বললে, “যকের নিকুচি করেচে! আমি ওসব মানি না।”
“না মেনে উপায় কী? ভেবে দ্যাখো বিমল, যে-গর্তের কথা কাক-পক্ষী জানে না, সেই গর্তেরই মুখ হঠাৎ এমন বন্ধ হয়ে গেল কী করে?”
বিমল চিন্তিতের মতন বললে, “হ্যাঁ, সে-ও একটা কথা বটে!”
“মনে আছে তো, কাল এই গর্তের ভিতর থেকে হু-হু করে ধোঁয়া বেরুচ্ছিল।”
“মনে আছে।”
“আর এই বিশ্রী হাসি!”
বিমল একেবারে চুপ!
হঠাৎ রামহরি চেঁচিয়ে উঠল, “খোকাবাবু, দ্যাখো, দ্যাখো!”
ও কী ব্যাপার! আমরা সকলেই স্পষ্ট দেখলুষ, খানিক তফাতে সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে শোঁ করে একটা আগুন চলে গেল।
আমি সরে এসে পাথর-চাপা গর্তের মুখে পাগলের মতন ধাক্কা মারতে লাগলুম, কিন্তু গর্তের মুখ একটুও খুলল না।
বিমল বললে, “কুমার! টর্চটা জ্বেলে আমার সঙ্গে এসো। রামহরি, তুমি সকলের পিছনে থাকো! আমি দেখতে চাই, ও-আগুনটা কিসের!”
আগুনটা তখন আর দেখা যাচ্ছিল না। বিমল বন্দুক বাগিয়ে ধরে এগিয়ে গেল, আমরাও তার পিছনে পিছনে চললুম। ভয়ে আমার বুকটা টিপটিপ করতে লাগল!
খানিক দূরে গিয়েই সুড়ঙ্গটা আর-একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে গিয়ে পড়েছে, সেইখানেই আগুনটা জুলে উঠেছিল!
সেইখানে দাঁড়িয়ে আমরা সতর্কভাবে চারিদিকে চেয়ে দেখলুম।
হাত-কয়েক দূরে, মাটির উপরে কী যেন একটা পড়ে রয়েছে বলে মনে হল, বাঘা ছুটে সেইখানে চলে গেল!
বিজলি-মশালের আলোটা ভালো করে তার উপরে গিয়ে পড়তেই, বিমল বলে উঠল, “ও যে দেখচি একটা মানুষের দেহের মতো!”
রামহরি বললে, “কিন্তু একটুও নড়চে না কেন?”
হঠাৎ আবার কে হেসে উঠল- হি-হি-হি-হি! কোথা থেকে কে যে সেই ভয়ানক হাসি হাসলে, আমরা কেউ তা দেখতে পেলুম না! সকলেই আড়ষ্ট হয়ে দাড়িয়ে রইলুম, হাসির চোটে সমস্ত সুড়ঙ্গটা আবার তেমনি যেন থরথর কাঁপতে লাগল!
আমি আঁতকে চেঁচিয়ে বললুম, “পালিয়ে এসো বিমল, পালিয়ে এসো, চলো আমরা গর্তের মুখে ফিরে যাই।
কিন্তু বিমল আমার কথায় কান পাতলে না, সে সামনের দিকে ছুটে এগিয়ে গেল।
সুড়ঙ্গ আবার স্তব্ধ।
বিমল একেবারে সেই মানুষের দেহটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, তারপর হেট হয়ে তার গায়ে হাত দিয়ে বলে উঠল, “কুমার, এ যে একটা মড়া!”
সুড়ঙ্গের মধ্যে মানুষের মৃতদেহ! আশ্চর্য!
বিমল আবার বললে, “কুমার, এদিকে এসে এর মুখের ওপর ভালো করে আলোটা ধরো তো!”
আর এগুতে আমার মন চাইছিল না, কিন্তু বাধ্য হয়ে বিমলের কাছে যেতে হল।
আলোটা ভালো করে ধরতেই বিমল উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠল, “কুমার, কুমার! এ যে শম্ভু!”
তাই তো, শম্ভুই তো বটে! চিৎ হয়ে তার দেহটা পড়ে রয়েছে, চোখদুটো ভিতর থেকে যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে আর তার গলার কাছটায় প্রকাণ্ড একটা ক্ষত!
বিমল হেঁট হয়ে শম্ভুর গায়ে হাত দিয়ে বললে, “কোনো আশা নেই, অনেকক্ষণ মরে গেছে!”
আমি সেই ভয়ানক দৃশ্যের উপর থেকে আলোটা সরিয়ে নিয়ে বললুম, “কিন্তু শম্ভু এখানে এল কী করে?”
বিমল চমকে উঠে বললে, “তাই তো, ও-কথাটা তো এতক্ষণ আমার মাথায় ঢোকেনি, শম্ভু এই সুড়ঙ্গের সন্ধান পেলে কোত্থেকে?”
আমি বললুম, “শম্ভু যখন এসেছে, তখন করালীও নিশ্চয় সুড়ঙ্গের কথা জানে।”
বিমল এক লাফ মেরে বলে উঠল, “কুমার, কুমার! আলোটা ভালো করে ধরো, যকের ধন! যকের ধন কোথায় আছে, আগে তাই খুঁজে বার করতে হবে।”
চারিদিকে আলোটা বারকতক ঘোরাতে-ফেরাতেই দেখা গেল, সুড়ঙ্গের এককোণে একটা দরজা রয়েছে।
বিমল ছুটে গিয়ে দরজাটা ঠেলে বললে, “এই যে একটা ঘর! যকের ধন নিশ্চয়ই এর ভেতরে আছে।”
পঁচিশ
অদৃশ্য বিপদ
ঘরের ভিতরে ঢুকে আমরা সাগ্রহে চারিদিকে চেয়ে দেখলুম।
ঘরটা ছোট, ধুলো আর দুর্গন্ধে ভরা।
আসবাবের মধ্যে রয়েছে খালি এককোণে একটা পাথরের সিন্ধুক, এরকম সিন্ধুক কলকাতায় জাদুঘরে আমি একবার দেখেছিলুম।
বিমল এগিয়ে গিয়ে সিন্ধুকের ডালাটা তখনই খুলে ফেললে, আমরা সকলেই একসঙ্গে তার ভিতরে তাড়াতাড়ি হুমড়ি খেয়ে উঁকি মেরে দেখলুম, কিন্তু হা ভগবান, সিন্ধুক একেবারে খালি।
আমাদের এত কষ্ট, এত পরিশ্রম, এত আয়োজন, সমস্তই ব্যর্থ হল! কেউ আর কোনো কথা কইতে পারলুম না, আমার তো ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছিল।
অনেকক্ষণ পরে বিমল একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, “আমাদের একুল ওকুল দুকুল গেল! যকের ধনও পেলুম না, প্রাণেও বোধ হয় বাঁচব না!”
আমি বললুম, “বিমল আগে যদি আমার মানা শুনতে। কতবার তোমাকে বলেচি ফিরে চলো, যকের ধনে আর কাজ নেই।”
রামহরি বললে, “আগে থাকতেই মুষড়ে পড়চ কেন? খুঁজে দ্যাখো, হয়তো আর কোথাও যকের ধন লুকানো আছে!”
বিমল বললে, “আর খোঁজাখুঁজি মিছে। দেখছ না আমাদের আগেই এখানে অন্য লোক এসেচে, সে কি আর শুধু-হাতে ফিরে গেছে?”
আমি বললুম, “এ-কাজ করালীর ছাড়া আর কারুর নয়!”
“হুঁ।”
“কিন্তু সে কী করে খোঁজ পেলে?”
“খুব সহজেই। কুমার, আমরা বোকা, গাধার চেয়েও বোকা! করালী পালিয়েছে ভেবে আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে পথ চলছিলুম, সে কিন্তু নিশ্চয়ই লুকিয়ে লুকিয়ে পিছু নিয়েছিল। তারপর কাল যখন আমরা সুড়ঙ্গের মুখ খুলেছিলুম, সে তখন কাছেই কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে বসে ছিল। কাল রাতেই সে কাজ হাসিল করেচে, আমরা যে কোনোরকমে পিছু নিয়ে তাকে আবার ধরব, সে-উপায়ও আর রেখে
যায়নি। বুঝেছ কুমার, করালী গর্তের মুখ বন্ধ করে দিয়ে গেছে!”
কিন্তু শম্ভুকে খুন করলে কে?”
“করালী নিজেই!”
“কেন সে তা করবে?”
“পাছে যকের ধনে শম্ভু ভাগ বসাতে চায়!”
হঠাৎ আমাদের কানের উপরে আবার সেই ভীষণ অট্টহাসি বেজে উঠল, “হা-হা, হা-হা-হা!”
আমি আর্তনাদ করে’বলে উঠলুম, “বিমল, শম্ভুকে খুন করেচে এই যক!”
আবার, আবার সেই হাসি!
আমার হাত থেকে বিজলি-মশালটা কেড়ে নিয়ে বিমল, যেদিক থেকে হাসি আসছিল সেই দিকে ঝড়ের মতন ছুটে গেল, তার পিছনে ছুটল রামহরি!
ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে একলা বসে আমি ভয়ে কাপতে লাগলুম, বিমল এত তাড়াতাড়ি চলে গেল যে আমিও তার পিছু নিতে পারলুম না।
উঃ, পৃথিবীর বুকের মধ্যকার সে-অন্ধকার যে কী জমাট, লেখায় তা প্রকাশ করা যায় না, অন্ধকারের চাপে আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল।
হঠাৎ আমার পিঠের উপরে ফোঁস করে কে নিশ্বাস ফেললে! চেঁচিয়ে বিমলকে ডাকতে গেলুম, কিন্তু গলা দিয়ে আমার আওয়াজই বেরুল না! সামনের দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু ঘরের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে মাটির উপর পড়ে গেলুম।
উঠে বসতে-না-বসতেই আমার পিঠের উপরে কে লাফিয়ে পড়ল এবং লোহার মতন শক্ত দুখানা হাত আমাকে জড়িয়ে ধরলে!
আমি তার হাত ছাড়াবার চেষ্টা করলুম, সে কিন্তু অনায়াসে আমাকে শিশুর মতো ধরে ঘরের মেঝের উপর চিৎ করে ফেললে- প্রাণপণে আমি চেঁচিয়ে উঠলুম, “বিমল, বিমল বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও!”
আমার বুকের উপরে বসে সে হা-হা করে হাসতে লাগল!, কিন্তু তার পর মুহূর্তেই সে-হাসি আচম্বিতে বিকট এক আর্তনাদের মতন বেজে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকের উপর থেকে সেই ভূত না মানুষটা, ভগবান জানেন কী, মাটির উপর ছিটকে পড়ল।
তাড়াতাড়ি আমি উঠে বসলুম, অন্ধকারে কিছুই দেখতে পেলুম না বটে, কিন্তু শব্দ শুনে বেশ বুঝলুম, ঘরের ভিতরে বিষম এক ঝটাপটি চলেছে।
ছাব্বিশ
ভূত, না জন্তু, না মানুষ
কী যে করব, কিছুই বুঝতে না পেরে দেয়ালে পিঠ রেখে আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলুম, ওদিকে ঘরের ভিতরে ঝটাপটি সমানে চলতে লাগল!
তার পরেই কে গোঁ গোঁ করে গুঙিয়ে উঠল, ওঃ সে যে কী যন্ত্রণার চিৎকার!
তার পরেই সব চুপচাপ!
আলো নিয়ে বিমল তখনো ফিরল না, অন্ধকারে আমিও আর উঠতে ভরসা করলুম না! ঘরের ভিতরে যে খুব একটা ভয়ানক কাণ্ড ঘটেছে তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু সে-কাণ্ডটা যে কী, অনেক ভেবেও আমি তা ঠাউরে উঠতে পারলুম না!
হঠাৎ আমার গায়ের উপরে কে আবার ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললে। আঁতকে উঠে একলাফে আমি পাঁচ হাত পিছনে গিয়ে দাঁড়ালুম। প্রাণপণে সামনের দিকে চেয়ে দেখলুম, অন্ধকারের মধ্যে দুটো জ্বলন্ত চোখ আমার পানে তাকিয়ে আছে! খানিক পরেই চোখদুটো ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল!
এবারে প্রাণের আশা একেবারেই ছেড়ে দিলুম। পায়ে-পায়ে আমি পিছন হটতে লাগলুম, সেই জ্বলন্ত চোখদুটোর উপরে স্থির দৃষ্টি রেখে! হঠাৎ কী-একটা জিনিসে পা লেগে আমি দড়াম করে পড়ে গেলুম এবং প্রাণের ভয়ে যত-জোরে-পারি চেঁচিয়ে উঠলুম.... তার পরেই কিন্তু বেশ বুঝতে পারলুম, আমি একটা মানুষের দেহের উপর কাত হয়ে পড়ে আছি।
সে-দেহ কার, তা জীবিত না মৃত, এসব ভাববার কোনো সময় নেই, কারণ গেল-বারের মতন এবারেও হয়তো আবার কোনো শয়তান আমার পিঠে লাফিয়ে পড়বে, সেই ভয়েই কাতর হয়ে তাড়াতাড়ি চোখ তুলতেই দেখি, সুড়ঙ্গের মধ্যে বিজলি-মশালের আলো দেখা যাচ্ছে! আঃ, এতক্ষণ পরে!
আলো দেখে আমার ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এল, তাড়াতাড়ি চেঁচিয়ে উঠলুম, “বিমল, বিমল, শিগগির এসো!”
“কী হয়েচে কুমার, ব্যাপার কী?” বলতে বলতে বিমল ঝড়ের মতো ছুটে এল, তার পিছনে রামহরি!
বিজলি-মশালের আলো ঘরের ভিতর পড়তেই দেখলুম, ঠিক আমার সামনে, মাটির উপরে দুই থাবা পেতে বসে বাঘা জিভ বার করে অত্যন্ত হাঁপাচ্ছে! তার মুখে ও সর্বাঙ্গে টাটকা রক্তের দাগ।
বুঝলুম, এই বাঘার চোখদুটো দেখেই এবারে আমি মিছে ভয় পেয়েছি! কিন্তু তার মুখে আর গায়ে অত রক্ত কেন?
হঠাৎ বিমল বিস্মিত-স্বরে বললে, “কুমার, কুমার, তুমি কিসের উপরে বসে আছ?”
তখন আমার হুঁশ হল- আমার তলায় যে একটা মানুষের দেহ।
এক লাফে দাঁড়িয়ে উঠে যা দেখলুম, তা আর জীবনে কখনো ভুলব না!
ঘরের মেঝের উপরে মস্ত লম্বা একটা কালো কুচকুচে মানুষের প্রায় উলঙ্গ দেহ চিৎ হয়ে সটান পড়ে আছে। লম্বা লম্বা জটপাকানো চুল আর গোঁফদাড়িতে তার মুখখানা প্রায় ঢাকা পড়েছে, তার চোখদুটো ড্যাবডেবে, দেখলেই বুক চমকে ওঠে, হাঁ-করা মুখের ভিতর থেকে বড় বড় দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছে, কে এ সেই অদ্ভুত মূর্তি দেখে সহজে বোঝা শক্ত যে, সে ভূত, না জন্তু, না মানুষ!
বিমল হেঁট হয়ে বললে, “এর গলা দিয়ে যে হুহু করে রক্ত বেরুচ্চে!”
আমি শুষ্কস্বরে বললুম, “বিমল, একটু আগে এই লোকটা আমাকে খুন করবার চেষ্টা করেছিল।”
“বল কী, তারপর তারপর!”
“তারপর ঠিক কী যে হল অন্ধকারে আমি তা বুঝতে পারিনি বটে, কিন্তু বোধ হয় বাঘার জন্যেই এ-যাত্রা আমি বেঁচে গেছি।”
“বাঘার জন্যে?”
“হ্যাঁ, সেই-ই টুঁটি কামড়ে ধরে একে আমার বুকের উপর থেকে টেনে নামায়, বাঘার কামড়েই যে ওর এই দশা হয়েচে, এখন আমি বেশ বুঝতে পারচি! দ্যাখো দেখি, ও বেঁচে আছে কি না?”
বিমল পরীক্ষা করে দেখে বললে, “না, একেবারে মরে গেছে।”
রামহরি বাঘার পিঠ চাপড়ে বললে, “শাবাশ বাঘা, শাবাশ।”
বাঘা আহ্লাদে ল্যাজ নাড়তে লাগল; আমি আদর করে তাকে বুকে টেনে নিলুম।
বিমল বললে, “কিন্তু এ-লোকটা কে?”
রামহরি বললে, “উঃ, কী ভয়ানক চেহারা! দেখলেই ভয় হয়!”
আমি বললুম, “আমার তো ওকে পাগল বলে মনে হচ্ছে।”
বিমল বললে, “হতে পারে। নইলে অকারণে তোমাকে মারবার চেষ্টা করবে কেন?”
আমি বললুম, “এতক্ষণে একটা ব্যাপার বুঝতে পারচি। শম্ভু বোধ হয় এর হাতেই মারা পড়েচে।”
রামহরি বললে, “কিন্তু এ সুড়ঙ্গের মধ্যে এল কী করে?”
বিমল চুপ করে ভাবতে লাগল। অনেকক্ষণ পরে সে বললে, “দ্যাখো কুমার, হাসি শুনে কে হাসচে খুঁজতে গিয়ে আমরা সুড়ঙ্গের এক জায়গায় কতকগুলো জুলন্ত কাঠ আর পোড়া মাংস দেখে এসেছি। এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এ-লোকটাই এ-সুড়ঙ্গের মধ্যে বাস করত। আমাদের দেখে এই-ই এতক্ষণ হাসছিল, এ যে পাগল তাতে আর কোনো সন্দেহ নাই!”
আমি বললুম, “কিন্তু সুড়ঙ্গের চারিদিক যে বন্ধ!”
বিমল লাফ মেরে দাঁড়িয়ে আনন্দ ভরে বলে উঠল, “কুমার, আমরা বেঁচে গেছি। এই অন্ধকূপের মধ্যে আমাদের আর অনাহারে মরতে হবে না!”
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, “হঠাৎ তোমার এতটা আহ্লাদের কারণ কী?”
বিমল বললে, “কুমার, তুমি একটি নিরেট বোকা। এ-ও বুঝচ না যে এই পাগলটা যখন সুড়ঙ্গের মধ্যে বাসা বেঁধেছে তখন কোথাও-না-কোথাও বাইরে যাবার একটা পথও আছে। সুড়ঙ্গের যে-মুখ দিয়ে ঢুকেছি, সে-মুখ তো বরাবরই বন্ধ ছিল, সুতরাং সেখান দিয়ে নিশ্চয়ই এই পাগলটা আনাগোনা করত না! যদি বল সে বাইরে যেত না, তা হলে সুড়ঙ্গের মধ্যে জ্বালানি কাঠ আর মাংস এল কোথেকে?”
আমি বললুম, “কিন্তু অন্য পথ থাকলেও আমরা তো তার সন্ধান জানি না। আমরা দেখিনি।”
আমি বললুম, “তবে চলো, আগে পথ খুঁজে বার করতে হবে, যকের ধন তো পেলুম না, এখন কোনো-গতিকে বাইরে বেরুতে পারলেই বাঁচি।”
বিমল বললে, “যকের ধন এখনো আমাদের হাতছাড়া হয়নি। পথ যদি খুঁজে পাই, তা হলে এখনো করালীকে ধরতে পারব। এখানে আর দেরি করা নয়, চলে এসো!”
বিমল আরো এগিয়ে গেল, আমরা তার পিছনে পিছনে চললুম।
সুড়ঙ্গটা যে কত বড়, তার মধ্যে যে এত অলিগলি আছে, আগে আমরা সেটা বুঝতে পারিনি। প্রায় দু-ঘণ্টা ধরে আমরা চারিদিকে আতিপাতি করে খুঁজে বেড়ালুম, কিন্তু পথ তবু পাওয়া গেল না। সেই চির-অন্ধকারের রাজ্যে আলো আর বাতাসের অভাবে প্রাণ আমাদের থেকে-থেকে হাঁপিয়ে উঠছিল, কিন্তু উপায় নেই, কোনো উপায় নেই!
শেষটা হাল ছেড়ে দিয়ে আমি বললুম, “বিমল, আর আমি ভাই পারছি না, পথ যখন পাওয়াই যাবে না, তখন এখানেই শুয়ে শুয়ে আমি শান্তিতে মরতে চাই!” এই বলে আমি বসে পড়লুম।
বিমল আমার হাত ধরে নরম গলায় বললে, “ভাই কুমার, এত সহজে কাবু হয়ে পড়লে চলবে না! পথ আছেই, আমরা খুঁজে বার করবই!”
আমি সুড়ঙ্গের গায়ে হেলান দিয়ে বললুম, “তোমার শক্তি থাকে তো পথ খুঁজে বার করো আমার শরীর আর বইচে না।”
হঠাৎ বাঘা দাঁড়িয়ে উঠে কান খাড়া করে একদিকে চেয়ে রইল, বিমলও আলোটা তাড়াতাড়ি সেইদিকে ফেরালে। দেখলুম, খানিক তফাতে একটা শেয়াল থতমত বাঘা তাকে রেগে ধমক দিয়ে তেড়ে গেল, শেয়ালটাও ভয় পেয়ে ছুট দিলে, ব্যাপার কী হয় দেখবার জন্যে বিমল বিজলি-মশালের আলোটা সেইদিকে ঘুরিয়ে ধরল।
অল্পদূরে গিয়েই শেয়ালটা সুড়ঙ্গের উপর দিকে একটা লাফ মেরে একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল। বাঘা হতভম্বের মতো সেইখানে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
শেয়াল কী করে পালাল দেখবার জন্যে বিমল কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেল। তারপর আলোটা মাথার উপর তুলে ধরে সেখানটা দেখেই মহাআহ্লাদে চেঁচিয়ে উঠল, “পথ পেয়েচি কুমার, পথ পেয়েচি!”
বিমলের কথায় আমার দেহে যেন নূতন জীবন ফিরে এল, তাড়াতাড়ি উঠে সেইখানে ছুটে গিয়ে বললুম, “কৈ, কৈ?”
“এই যো”
সত্যই তো! দেওয়ালের একেবারে উপরদিকে ছোট একটা গর্তের মতো, তার ভিতর দিয়ে বাইরের আলো রুপোর আভার মতো দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণ পরে পৃথিবীর আলো দেখে আমার চোখ আর মন যেন জুড়িয়ে গেল।
বিমল বললে, “নিশ্চয় পাহাড় ধসে এই পথের সৃষ্টি হয়েছে। কুমার, তুমি সকলের আগে বেরিয়ে যাও। রামহরি, তুমি আলোটা নাও আমি, কুমারকে গর্তের মুখে তুলে ধরি!”
বিমল আমাকে কোলে করে তুলে ধরলে, গর্ত দিয়ে মুখ বাড়াতেই নীলাকাশের সূর্য, স্নিগ্ধ-শীতল বাতাস আর ফলে-ফুলে-ভরা সবুজ বন যেন আমাকে চিরজন্মের বন্ধুর মতন সাদরে অভ্যর্থনা করলে!
সাতাশ
করালীর আর এক কীর্তি
বাইরের আলো-হাওয়া যে কত মিষ্টি, পাতালের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে সেদিন তা ভালো করে প্রথম বুঝতে পারলুম।
কারুর মুখে কোনো কথা নেই। সকলে মিলে নীরবে বসে খানিকক্ষণ ধরে সেই আলো-হাওয়াকে প্রাণভরে ভোগ করে নিতে লাগলুম।
হঠাৎ বিমল একলাফে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, “আলো-হাওয়া আজও আছে, কালও থাকবে! কিন্তু করালীকে আজ না ধরতে পারলে এ-জীবনে আর কখনো ধরতে পারব না! ওঠো কুমার, ওঠো.রামহরি!”
আমি কাতরভাবে বললুম, “কোথায় যাব আবার?”
“যে-পথে এসেছি, সে-পথে! করালীকে ধরব, যকের ধন কেড়ে নেব।”
“কিন্তু এখনো যে আমাদের খাওয়াদাওয়া হয়নি!”
বিমল হাত ধরে একটানে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললে, “খাওয়াদাওয়ার নিকুচি করেচে! আগে তো বেরিয়ে পড়ো, তারপর ব্যাগের ভেতরে বিস্কুটের টিন আছে, পথ চলতে চলতে তাই খেয়েই পেট ভরাতে পারবে!, -এসো, এসো, আর দেরি নয়!”
বন্দুকটা ঘাড়ে করে বিমল অগ্রসর হল, আমরাও তার পিছনে. পিছনে চললুম।
বিমল বললে, “সুড়ঙ্গের মুখে পাথর চাপা দিয়ে করালী নিশ্চয় ভাবচে, আর কেউ তার যকের ধনে ভাগ বসাতে আসবে না। নিশ্চিন্ত মনে দেশের দিকে ফিরে চলেচে, আমরা একটু তাড়াতাড়ি হাঁটলে আজকেই হয়তো আবার তাকে ধরতে পারব, এরি মধ্যে সে বেশিদূর এগুতে পারেনি।”
আমি বললুম, “কিন্তু করালী তো সহজে যকের ধন ছেড়ে দেবে না!”
“তা তো দেবেই না!”
“তা হলে আবার একটা মারামারি হবে বলো?”
“হবে বৈকি! কিন্তু এবারে আমরাই তাকে আগে আক্রমণ করব।”
এমনি কথা কইতে কইতে, বৌদ্ধমঠ পিছনে ফেলে আমরা অনেক দূর এগিয়ে পড়লুম। ক্রমে সূর্য ডুবে গেল, চারিধারে অন্ধকারের আবছায়া ঘনিয়ে এল, বাসামুখো পাখিরা কলরব করতে করতে জানিয়ে দিয়ে গেল যে, পৃথিবীতে এবার ঘুমপাড়ানি মাসির রাজত্ব শুরু হবে!
আমরা পাহাড়ের সেই মস্ত ফাটলের কাছে এসে পড়নুম,, সরল গাছ কেটে সাঁকোর মতো করে যেখানটা আমাদের পার হতে হয়েছিল। সাঁকোর কাছে এসে বিমল বললে, “দ্যাখো কুমার, আমি যদি করালী হতুম, তা হলে কী করতুম জানো?”
“কী করতে?”
“এই গাছটাকে যে-কোনো রকমে ফাটলের মধ্যে ফেলে দিয়ে যেতুম। তা হলে আর কেউ আমার পিছু নিতে পারত না।”
“কিন্তু করালী যে জানে তার শক্ররা এখন কবরের অন্ধকারে হাঁপিয়ে মরচে, তারা আর তার কিছুই করতে পারবে না!”
“এত-বেশি নিশ্চিন্ত হওয়াই ভুল, সাবধানের মার নাই! দ্যাখো না, এই এক ভুলেই করালীকে যকের ধন হারাতে হবে!... কিন্তু কে ও , কে ও?”
আমরা সকলেই স্পষ্ট শুনলুম, স্তব্ধ সন্ধ্যার বুকের মধ্য থেকে ক্ষীণ আর্তনাদ জেগে উঠছে, “জল, একটু জল!”
“কুমার, কুমার, ও কার আর্তনাদ?”
“একটু জল, একটু জল!”
সকলে মিলে এদিকে-ওদিকে খুঁজতে খুঁজতে শেষটা দেখলুম, পাহাড়ের একপাশ একটা খোঁদলের মধ্যে যেন মানুষের দেহের মতো কী পড়ে রয়েছে! জঙ্গলে সেখানটা অন্ধকার দেখে আমি বললুম, “রামহরি, শিগ্গির লন্ঠনটা জ্বালো তো!”
রামহরি আলো জ্বেলে খোঁদলের উপরে ধরতেই লোকটা আবার কান্নার স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, “ওরে বাবা রে, প্রাণ যে যায়, একটু জল দাও, একটু জল দাও!”
বিমল তাকে টেনে উপরে তুলে, তার মুখ দেখেই বলে উঠল, “একে যে আমি করালীর সঙ্গে দেখেচি!”
লোকটাও বিমলকে দেখে সভয়ে বললে, “আমাকে আর মেরো না, আমি মরতেই বসেচি, আমাকে মেরে আর কোনো লাভ নেই!”
এতক্ষণে দেখলুম, তার মুখে বুকে হাতে পিঠে বড় বড় রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেউ তাকে বারবার আঘাত করেছে!
বিমল বললে, “কে তোমার এ-দশা করলে?”
“করালী!”
“করালী?”
“হ্যাঁ মশাই, সেই শয়তান করালী।”
“কেন সে তোমাকে মারলে?”
“সব বলচি, কিন্তু বাবু, তোমার পায়ে পড়ি, আগে একটু জল দাও, তেষ্টায় আমার ছাতি ফেটে যাচ্ছে!”
রামহরি তাড়াতাড়ি তার মুখে জল ঢেলে দিলে। জলপান করে ‘আঃ’ বলে লোকটা চোখ মুদে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল।
বিমল বললে, “এইবার বলো, করালী কেন তোমাকে মারলে?”
“বলচি বাবু, বলচি, আমি তো আর বাঁচব না, কিন্তু মরবার আগে সব কথাই তোমাদের কাছে বলে যাব!” আরো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সে বলতে লাগল, “বাবু, তোমাদের পাথর চাপা দিয়ে, করালীবাবু আর আমি তো সেখান থেকে চলে এলুম ৷ যকের ধনের বাক্স ছিল করালীবাবুর হাতেই। তারপর এখানে এসে করালীবাবু বললে, “তুই কিছু খাবার রান্না কর্, কাল সারারাত খাওয়া হয়নি, বড্ড খিদে পেয়েছে।” আমাদের সঙ্গে চাল-চাল আর আলু ছিল, বন থেকে কাঠ-কুটো জোগাড় করে এনে আমি খিচুড়ি চড়িয়ে দিলুম। করালীবাবু আগে খেয়ে নিলে, পরে আমি খেতে বসলুম। তারপর কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ আমার পিঠের ওপরে ভয়ানক একটা চোট লাগল, তখনি আমি চোখে অন্ধকার দেখে চিৎ হয়ে পড়ে গেলুম। তারপর আমার বুকে আর মুখেও ছোরার মতন কী এসে বিঁধল, আমি একেবারে অজ্ঞান হয়ে পড়লুম। কে যে মারলে তা আমি দেখতে পাইনি বটে, কিন্তু করালীবাবু ছাড়া তো এখানে আর জনমনিষ্যি ছিল না, সে ছাড়া আর কেউ আমাকে মারেনি। বোধ হয় পাছে আমি তার যকের ধনের ভাগীদার হতে চাই, তাই সে একাজ করেচে”, এই পর্যন্ত বলেই লোকটা হাঁপাতে লাগল।
বিমল ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসা করল, “এ-ব্যাপারটা কতক্ষণ আগে হয়েছে?”
“তখন বোধ হয় বিকেলবেলা।”
“করালীর সঙ্গে আর কে আছে?”
“কেউ নেই। আমরা পাঁচজন লোক ছিলুম। আসবার মুখেই দুজন তো তোমাদের তাড়া খেয়ে অন্ধকার রাতে এ ফাটলে পড়ে মরেচে। শম্ভুকে সুড়ঙ্গের মধ্যে ভূত না দানো কার মুখে ফেলে ভয়ে আমরা পালিয়ে এসেচি। এইবার আমার পালা, জল, আর-একটু জল!”
রামহরি আবার তার মুখে জল দিলে, কিন্তু এবারে জল খেয়েই তার চোখ কপালে উঠে গেল।
বিমল তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করলে, “যকের ধনের বাক্সে কী ছিল?”
কিন্তু লোকটা আর কোনো জবাব দিতে পারলে না, তার মুখ দিয়ে গাঁজলা উঠতে লাগল ও জোরে নিশ্বাস পড়তে লাগল। তার পরেই গোটা-কতক হেঁচকি তুলে সে একেবারে স্থির হয়ে রইল।
বিমল বললে, “যাক, এ আর জন্মের মতো কথা কইবে না! এখন চলো, করালীকে ধরে তবে অন্য কাজ!”
চোখের সামনে একটা লোককে এভাবে মরতে দেখে আমার মনটা অত্যন্ত দমে গেল, আমি আর কোনো কথা না বলে বিমলের সঙ্গে সঙ্গে চললুম এই ভাবতে ভাবতে যে, পৃথিবীতে করালীর মতন মহাপাষণ্ড আর কেউ আছে কি?
আঠাশ
ভীষণ গহ্বর
অল্প-অল্প চাঁদের আলো ফুটেছে, সে-আলোতে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না, অন্ধকার ছাড়া! প্রেতলোকের মতন নির্জন পথ। আমাদের পায়ের শব্দে যেন চারিদিকের স্তব্ধতা চমকে উঠছে! আশপাশের কালি-দিয়ে-আঁকা গাছপালাগুলো মাঝে মাঝে বাতাস লেগে দুলছে আর আমাদের মনে হচ্ছে, থেকে-থেকে অন্ধকার যেন তার ডানা নাড়া দিচ্ছে।
আমি বললুম, “দ্যাখো বিমল, আমাদের আর এগুনো ঠিক নয়।”
“কেন?”
“এই অন্ধকারে একলা পথ চলতে করালী নিশ্চয় ভয় পাবে। খুব সম্ভব, সে এখন কোনো গুহায় শুয়ে ঘুমুচ্চে আর আমরা হয়তো তাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাব। তারচেয়ে আপাতত আমরা কোথাও মাথা গুঁজে কিছু বিশ্রাম করে নি এসো, তারপর ভোর হলেই আবার চলতে শুরু করা যাবে।”
বিমল বললে, “কুমার, তুমি ঠিক বলেচ! করালীকে ধরবার আগ্রহে এসব কথা আমার মনেই ছিল না।”
রক্ত-জবার রঙে-ছোবানো উষার প্রথম আলো সবে যখন পূর্ব-আকাশের ধারে পাড় বুনে দিচ্ছে, আমরা তখন আবার উঠে পথ চলতে শুরু করলুম। চারিদিকে নানা জাতের পাখিরা মিলে গানের আসর জমিয়ে তুলেছে, গাছের সবুজ পাতারাও যেন মনের সুখে কাঁপতে কাঁপতে মর্মর-সুরে সেই গানে যোগ যাচ্ছে! আকাশে বাতাসে পৃথিবীতে কেমন একটি শান্তিভরা আনন্দের আভাস! এরি মধ্যে আমরা কিন্তু আজ হিংসাপূর্ণ আগ্রহে ছুটে চলেছি, এটা ভেবেও আমার মন বারবার কেমন সঙ্কুচিত হয়ে পড়তে লাগল!
পাহাড়ের পর পাহাড়ের মাথার উপরে সূর্যের মুখ যখন জ্বলন্ত মটুকের মতন জেগে উঠল, আমরা তখন পথের একটা বাঁকের মুখে এসে পড়েছি।
বাঘা এগিয়ে এগিয়ে চলছিল, বাঁকের মুখে গিয়েই হঠাৎ সে ঘেউঘেউ করে চেঁচিয়ে উঠল।
আমরা সবাই সতর্ক ছিলুম, সে চ্যাঁচাল কেন, দেখবার জন্যে তখনি সকলে ছুটে বাঁকের মুখে গিয়ে দাঁড়ালুম ৷
দেখলুম, খানিক তফাতে একটা লোক দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখামাত্র চিনলুম, সে করালী! তার হাতে একটা বড় বাক্স, যকের ধন!
আমাদের দেখেই করালী বেগে এক দৌড় মারলে, সঙ্গে সঙ্গে বিমলও তীরের মতন তার দিকে ছুটে গেল। আমরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম!
ছুটতে ছুটতে বিমল একেবারে করালীর কাছে গিয়ে পড়ল; তারপর সে চেঁচিয়ে বললে, “করালী, যদি প্রাণে বাঁচতে চাও তবে থামো! নইলে আমি গুলি করে তোমাকে মেরে ফেলব!”
কিন্তু করালী থামলে না, হঠাৎ পথের বাঁ-দিকে একটা উঁচু জায়গায় লাফিয়ে উঠেই অদৃশ্য হয়ে গেল, বিমল সেখানে থমকে দাঁড়াল, এক মুহূর্তের জন্যে। তার পরেই সে-ও লাফিয়ে উপরে উঠল, আমরা তাকেও আর দেখতে পেলুম না।
ততক্ষণে আমাদের হুঁশ হল, “রামহরি, শিগ্গির এসো” বলেই আমিও প্রাণপণে দৌড়ে অগ্রসর হলুম।
সেই উঁচু জায়গাটার কাছে গিয়ে দেখলুম, সেখানে পাহাড়ের গায়ে রয়েছে একটা গুহার মুখ। আমি একলাফে উপরে উঠতেই একটা বিকট চিৎকার এসে আমার কানের ভিতরে ঢুকল- সঙ্গে সঙ্গে শুনলুম বিমলের কণ্ঠস্বরে উচ্চ আর্তনাদ। তার পরেই সব স্তব্ধ।
আমার বুকের ভিতরটা যেন কেমন-করে উঠল, বেগে ছুটে গিয়ে গুহার মধ্যে ঢুকে পড়লুম। ভিতরে গিয়ে দেখি কেউ তো সেখানে নেই। অত্যন্ত আশ্চর্য ও স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম।
পর-মুহূর্তে রামহরিও এসে গুহার মধ্যে ঢুকে বললে, “কে অমন চেঁচিয়ে উঠল? কৈ, খোকাবাবু কোথায়?”
“জানি না রামহরি, আমি শুনলুম গুহার ভেতর থেকে বিমল আর্তনাদ করে উঠল। কিন্তু ভেতরে এসে কারুকেই তো দেখতে পাচ্ছি না।”
গুহার একদিকটা আঁধারে ঝাপসা। সেইদিকে গিয়েই রামহরি বলে উঠল, “এই যে, ভেতরে আর-একটা পথ রয়েছে।”
দৌড়ে গিয়ে দেখি, সত্যিই তো! একটা গলির মতো পথ ভিতরদিকে চলে গেছে, কিন্তু অন্ধকার সেখানে, একটুও নজর চলে না।
আমি বললুম, “রামহরি, শিগগির বিজলি-মশাল বের করো, বন্দুকটা আমাকে দাও!”
বন্দুকটা আমার হাতে দিয়ে রামহরি বিজলি-মশাল বার করলে, তারপর সাবধানে ভিতরে গিয়ে ঢুকল। আমিও বন্দুকটা বাগিয়ে ধরে সতর্কচোখে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে তার সঙ্গে সঙ্গে চললুম।
উপরে, নিচে, এ-পাশে, ও-পাশে গুহার নিরেট পাথর, তারই ভিতর দিয়ে যেতে আবার আমার মনে পড়ল সেই যকের ধনের সুড়ঙ্গের কথা!
আচম্বিতে রামহরি দঁড়িয়ে পড়ে আঁতকে উঠে বললে, “সর্বনাশ!”
আমি বললুম, “ব্যাপার কী?”
রামহরি বললে, “সামনেই প্রকাণ্ড একটা গর্ত!”
বিজলি-মশালের তীব্র আলোতে দেখলুম, ঠিক রামহরির পায়ের তলাতেই গুহার পথ শেষ হয়ে গেছে, তার পরেই মস্তবড় একটা অন্ধকার-ভরা ফাঁক যেন হা হা করে আমাদের গিলতে আসছে! বিমল কি ওরই মধ্যে পড়ে গেছে?
পৃথিবীর গর্ভ থেকে করুণ স্বরে কে যেন সাড়া দিলে, “কুমার, কুমার! বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও!”
গহ্বরের ধারে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে রামহরির হাত থেকে বিজলি-মশালটা নিয়ে দেখলুম, গর্তের মুখটা প্রায় পঞ্চাশ-ষাট হাত চওড়া! তলার দিকে চেয়ে দেখলুম, প্রায় ত্রিশ হাত নিচে কী-যেন চকচক করছে! ভালো করে চেয়ে দেখি, জল!
অনেক নিচে থেকে বিমল বললে, “এই যে জলের ভেতরে। শিগ্গির আমাকে তোলবার ব্যবস্থা করো ভাই, আমার হাতে-পায়ে খিল ধরেচে, এখনি ডুবে যাব।”
“রামহরি, রামহরি! ব্যাগের ভেতর থেকে দড়ির বান্ডিল বের করো, জলদি!”
রামহরি তখনি পিঠ থেকে বড় ব্যাগটা নামিয়ে খুলতে বসে গেল। আমি বিজলি-মশালটা নিচু-মুখো করে দেখলুম, কালো জলের ভিতরে ঢেউ তুলে বিমল সাঁতার দিচ্ছে।
তাড়াতাড়ি দড়ি নামিয়ে দিলুম, বিমল সাঁতরে এসে দড়িটা দু’হাতে চেপে ধরলে।
আমি আবার চেঁচিয়ে বললুম, “বিমল, দেওয়ালে পা দিয়ে দড়ি ধরে তুমি উপরে উঠতে পারবে, না, আমরা তোমায় টেনে তুলব?”
বিমলও চেঁচিয়ে বললে, “বোধ হয় আমি নিজেই উঠতে পারব।”
আমি আর রামহরি সজোরে দড়ি ধরে রইলুম, খানিক পরে বিমল নিজেই এসে উঠল, তারপর আমার কোলের ভিতরে পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে অজ্ঞান হয়ে গেল।
আমরা দুজনে তাকে ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে এলুম।
উনত্রিশ
পরিণাম
বিমলের জ্ঞান হলে পর আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “কী করে তুমি গর্তের মধ্যে গিয়ে পড়লে?”
বিমল বললে, “করালীর পিছনে পিছনে যেই আমি গুহার মধ্যে গিয়ে ঢুকলুম, সে অমনি ঐ অন্ধকার গলির মধ্যে সেঁধিয়ে পড়ল। আমিও ছাড়লুম না, গলির ভেতরে ঢুকে সেই অন্ধকারেই আমি তাকে জড়িয়ে ধরলুম, তারপরে দুজনের ধ্বস্তাধস্তি শুরু হল। কিন্তু আমরা কেউ জানতুম না যে ওখানে আবার একটা গহ্বর আছে, ঠেলা-ঠেলি জড়াজড়ি করতে করতে দুজনে হঠাৎ তার ভেতরে পড়ে গেলুম।”
আমি শিউরে বলে উঠলুম “আ্যাঁ, করালী তা হলে এখনো গহ্বরের মধ্যে আছে?”
“হ্যাঁ, কিন্তু বেঁচে নেই।”
“সেকী!”
“যদিও অন্ধকারে সেখানে চোখ চলে না, তবু আমি নিশ্চয়ই বলতে পারি, সে ডুবে মরেচে। কারণ আমরা জলে পড়বার পর ঠিক আমার পাশেই দু-চারবার ঝপাঝপ শব্দ হয়েই সব চুপ হয়ে গেল। নিশ্চয়ই সাঁতার জানত না, জানলে জলের ভেতরে শব্দ হত।”
আমি রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞাসা করলুম, “ আর যকের ধনের বাক্সটা?”
বিমল একটা বিষাদ-ভরা হাসি হেসে মাথা নাড়তে নাড়তে বললে, “আমি যখন করালীকে জড়িয়ে ধরি, তখনও সে বাক্সটা ছাড়েনি। আমার বিশ্বাস, বাক্সটা নিয়েই সে জল-পথে পরলোক যাত্রা করেচে।”
“কিন্তু বাক্সটা যদি গলির ভেতরে পড়ে থাকে?” বলেই আমি বিজলি-মশালটা নিয়ে আবার গুহার ভিতরকার গলির মধ্যে গিয়ে ঢুকলুম! কিন্তু মিছে আশা, সেখানে বাক্সের চিহ্নমাত্রও নেই! আর একবার সেই বিরাট গহ্বরের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে দেখলুম, অনেক নিচে অন্ধকার-মাখা জলরাশি মৃত্যুর মতন স্থির ও স্তব্ধ হয়ে আছে, এই একটু আগেই সে যে একটা মানুষের প্রাণ ও সাত-রাজার ধনকে নিষ্ঠুরভাবে গ্রাস করে ফেলেছে, তাকে দেখে এখন আর সে সন্দেহ করবারও উপায় নেই।
হতাশভাবে বাইরে এসে অবসন্নের মতন বসে পড়লুম!
বিমল শুধোলে, “কেমন, পেলে না তো!”
মাথা নেড়ে নীরবে জানালুম, “না।”
“তা আমি আগেই জানি। করালী প্রাণে মরেচে বটে, কিন্তু যকের ধন ছাড়েনি। শেষ জিত তারই!”
স্তব্ধ হয়ে বসে রইলুম। দুঃখে, ক্ষোভে, বিরক্তিতে মনটা আমার ভরে উঠল। এত বিপদ, এত কষ্টভোগের পর এতবড় নিরাশা! আমার ডাক ছেড়ে কাঁদবার ইচ্ছা হতে লাগল!
বিমল হতাশভাবে মাটির দিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইল। অনেকক্ষণ পরে রামহরি বললে, “তোমরা দুজনে অমন মনমরা হয়ে থাকলে তো চলবে না! যকের ধন ভাগ্যে নেই, তাতে হয়েছে কী? প্রাণে বেঁচেছ এই ঢের! যা হাতে না আসতেই অত বিপদ, এত ঝঞ্জাট, যার জন্যে এতগুলো লোকের প্রাণ গেল, তা পেলে না-জানি আরো কত মুশকিলই হ’ত! এখন ঘরের ছেলে ভালোয় ভালোয় ঘরে ফিরে চলো!”
বিমল মাথা তুলে হেসে বললে, “ঠিক বলেচ, রামহরি। আঙুর যখন নাগালের বাইরে, তখন তাকে তেতো বলেই মনকে প্রবোধ দেওয়া যাক। যকের ধন কি মানুষের ভোগে লাগে? করালী ভূত হয়ে চিরকাল তা ভোগ করুক, দরকার নেই আর তার জন্যে মাথা ঘামিয়ে! আপাতত বড়ই ক্ষুধার উদ্রেক হয়েছে, কুমার! তুমি একবার চেষ্টা করে দ্যাখো, পাখিটাখি কিছু মারতে পারো কি না। ততক্ষণে রামহরি ভাত চড়িয়ে দিক, আর আমি ওষুধ মালিশ করে গায়ের ব্যথা দূর করি।”
আমি বললুম, “কাজেই।”
বিমল বললে, “আহারের পর নিদ্রা, তারপর দুর্গা বলে দেশের দিকে যাত্রা, কী বল?”
আমি বললুম, “অগত্যা।”
আমার কথা ফুরুলো।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment