এক
মড়ার মাথা
ঠাকুরদাদা মারা গেলে পর, তাঁর লোহার সিন্দুকে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে একটি ছোট বাক্স পাওয়া গেল। সে বাক্সের ভিতরে নিশ্চয়ই কোনো দামি জিনিস আছে মনে করে মা সেটি খুলে ফেললেন। কিন্তু তার মধ্যে পাওয়া গেল শুধু একখানা পুরনো পকেট-বুক, আর একখানা ময়লা-কাগজে-মোড়া কী-একটা জিনিস। মা কাগজটা খুলেই জিনিসটা ফেলে দিয়ে হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠলেন।
আমি ব্যস্ত হয়ে বললুম, “কী, কী হল মা?”
মা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মাটির দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, “কুমার, শিগ্গির ওটা ফেলে দে!”
আমি হেঁট হয়ে চেয়ে দেখলুম, একটা মড়ার মাথার খুলি মাটির উপরে পড়ে রয়েছে! আশ্চর্য হয়ে বললুম, “লোহার সিন্দুকে মড়ার মাথা! ঠাকুরদা কি বুড়ো-বয়সে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন?”
মা বললেন, “ওটা ফেলে দিয়ে গঙ্গাজল স্পর্শ করবি চল্।”
মড়ার মাথার খুলিটা জানলা গলিয়ে আমি বাড়ির পাশের একটা খানায় ফেলে দিলুম। পকেট-বুকখানা ঘরের একটা তাকের উপর তুলে রাখলুম। মা বাক্সটা আবার সিন্দুকে পুরে রাখলেন।
দিন-কয়েক পরে পাড়ার করালী মুখুয্যে হঠাৎ আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। করালী মুখুয্যেকে আমাদের বাড়িতে দেখে আমি ভারি অবাক হয়ে গেলুম। কারণ আমি জানতুম যে ঠাকুরদাদার সঙ্গে তার একটুও বনিবনা ছিল না, তিনি বেঁচে থাকতে করালীকে কখনো আমাদের বাড়িতে দেখিনি।
করালীবাবু বললেন, “কুমার, তোমার মাথার ওপরে এখন আর কোনো অভিভাবক নেই। তুমি নাবালক। হাজার হোক তুমি তো আমাদেরই পাড়ার ছেলে। এখন আমাদের সকলেরই উচিত, তোমাকে সাহায্য করা। তাই আমি এসেচি।”
করালীবাবুর কথা শুনে বুঝলুম, তাকে আমি যতটা খারাপ লোক বলে ভাবতুম, আসলে তিনি ততটা খারাপ লোক নন। তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে বললুম, “যদি কখনো দরকার হয়, আমি আপনার কাছে আগে যাব।”
করালীবাবু বসে বসে একথা সেকথা কইতে লাগলেন। কথা প্রসঙ্গে আমি তাঁকে বললুম, “ঠাকুরদাদার লোহার সিন্দুকে একটা ভারি মজার জিনিস পাওয়া গেছে।”
করালীবাবু বললেন, “কী জিনিস?”
মড়ার মাথার খুলি --”
করালীবাবুর চোখদুটো যেন দপ্ করে জ্বলে উঠল। তিনি তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, “মড়ার মাথার খুলি?”
“হ্যাঁ, আর একখানা পকেট-বই।”
“সে-বাক্সটা এখন কোথায়?”
“লোহার সিন্দুকেই আছে।”
করালীবাবু তখনই সেকথা চাপা দিয়ে অন্য কথা কইতে লাগলেন। কিন্তু আমি বেশ বুঝলুম, তিনি যেন অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠছেন। খানিক পরে তিনি চলে গেলেন।
সেদিন রাত্রে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। শুনলুম আমার কুকুর বাঘা ভয়ানক চিৎকার করছে। বিরক্ত হয়ে দু-চারবার ধমক দিলুম, কিন্তু আমার সাড়া পেয়ে বাঘার উৎসাহ আরো বেড়ে উঠল -- সে আরো জোরে চ্যাঁচাতে লাগল। তার পরেই, যেন কার পায়ের শব্দ পেলুম। কে যেন দুড়-দুড় করে ছাদের উপর দিয়ে চলে গেল। ব্যস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলুম। চারিদিকে খোঁজ করলুম, কারুকেই দেখতে পেলুম না। ভাবলুম, আমারি ভ্রম। বাঘার গলার শিকল খুলে দিয়ে, আবার ঘরে এসে শুয়ে পড়লুম!
সকালবেলায় ঘুম ভেঙেই শুনি মা ভারি চ্যাঁচামেচি লাগিয়েছেন! বাইরে এসে জিজ্ঞাসা করলুম “ব্যাপার কী মা?”
মা বললেন, “ওরে, কাল রাত্তিরে বাড়িতে চোর এসেছিল!”
তা হলে কাল রাত্রে যা শুনেছিলুম তা ভুল নয়!
মা বললেন, “দেখবি আয়, বড় ঘরে লোহার সিন্দুক খুলে রেখে গেছে!”
ঘরে গিয়ে দেখি, সত্যিই তাই! কিন্তু চোর বিশেষ-কিছু নিয়ে যেতে পারেনি-- কেবল সেই চন্দনকাঠের বাক্সটা ছাড়া।
কিন্তু মনে কেমন একটা ধোঁকা লেগে গেল! সিন্দুকে এত জিনিস থাকতে চোর খালি বাক্সটা নিয়ে গেল কেন? আরো মনে পড়ল, কাল সকালে এই বাক্সের কথা শুনেই করালীবাবু কীরকম উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন! তবে কি এই বাক্সের মধ্যে কোনো রহস্য আছে? সম্ভব। নইলে, একটা মড়ার মাথার খুলি কে আর এত যত্ন করে লোহার সিন্দুকের ভিতরে রেখে দেয়?
মাকে কিছু না বলেই তাড়াতাড়ি বাইরে ছুটলুম। বাড়ির পাশের খানাটার মুখে গিয়ে দেখলুম, মড়ার মাথার খুলিটা একরাশ জঞ্জালের উপরে কাত হয়ে পড়ে আছে! সেটাকে আর একবার পরখ করবার জন্য তুলে নিলুম। খুলির এক পিঠে গাঢ় কালো রং মাখানো ছিল, কিন্তু খানার জল লেগে মাঝে মাঝে রং উঠে গেছে! আর যেখানেই রং নেই, সেইখানেই অংকের মতন কী কতকগুলো খোদা রয়েছে। অত্যন্ত কৌতূহলী হয়ে খুলিটাকে লুকিয়ে আবার বাড়িতে আনলুম। সাবান-জলে সেটাকে বেশ করে ধুয়ে ফেলতেই কালো রং উঠে গেল। তখন আশ্চর্য হয়ে দেখলুম, খুলির এক পিঠের সবটায় কে অনেকগুলো অঙ্ক খুদে রেখেছে, অঙ্কগুলো এইরকম --

দুই
যকের ধন
এই অদ্ভুত অঙ্কগুলির মানে কী? অনেক ভাবলুম, কিন্তু মাথামুন্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারলুম না। হঠাৎ মনে পড়ল ঠাকুরদাদার পকেট-বইয়ের কথা। সেখানাও তো এই খুলির সঙ্গে ছিল, তার মধ্যে এই রহস্যের কোনো সদুত্তর নেই কি?
তখনি উপরে গিয়ে তাক থেকে পকেট-বইখানা পাড়লুম। খুলে দেখি, তার গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত লেখায় ভরতি। গোড়ার দিকের প্রায় ষোলো-সতেরো পাতা পড়লুম, কিন্তু সেসব বাজে কথা। তারপর হঠাৎ এক জায়গায় দেখলুম:
“১৩১০ সাল, আশ্বিন মাস। আসাম থেকে ফেরবার মুখে একদিন আমরা এক বনের ভিতর দিয়ে আসছি। সন্ধ্যা হয়-হয়, আমরা এক উচু পাহাড়ে-জমি থেকে নামছি। হঠাৎ দেখি খানিক তফাতে একটা মস্ত-বড় বাঘ! সে সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে যেন কার উপরে লাফিয়ে পড়বার জন্য তাগ করছে! আরও একটু তফাতে দেখলুম, একজন সন্ন্যাসী পথের পাশে, গাছের তলায় শুয়ে ঘুমাচ্ছেন। আমি তখনি চিৎকার করে উঠলুম৷ আমার সঙ্গের কুলিরাও সে-চিৎকারে যোগ দিল। সন্ন্যাসীর ঘুম ভেঙে গেল, বাঘটাও চমকে ফিরে আমাদের দেখে এক লাফে অদৃশ্য হল।
সন্ন্যাসী জেগে উঠেই ব্যাপারটা সব বুঝে নিলেন। আমার কাছে এসে কৃতজ্ঞতাভরে বললেন, “বাবা, তোমার জন্যে আজ আমি বাঘের মুখ থেকে বেঁচে গেলুম।”
আমি বললুম, “ঠাকুর, বনের ভেতরে এমনি করে কি ঘুমোতে আছে?”
সন্ন্যাসী বললেন, “বনই যে আমাদের ঘর-বাড়ি বাবা!”
আমি বললুম, “কিন্তু এখনি যে আপনার প্রাণ যেত!”
সন্ন্যাসী বললেন, “কৈ বাবা, গেল না তো। ভগবান ঠিক সময়েই তোমাকে পাঠিয়ে দিলেন।” শুনলুম, আমরা যেদিকে যাচ্ছি, সন্ন্যাসীও সেই দিকে যাবেন। তাই সন্ন্যাসীকেও আমরা সঙ্গে নিয়ে চললুম। সন্ন্যাসী দুদিন আমাদের সঙ্গে রইলেন। আমি যথাসাধ্য তার সেবা করতে ত্রুটি করলুম না। তিন দিনের দিন বিদায় নেবার আগে তিনি আমাকে বললেন, “দ্যাখো বাবা, তোমার সেবায় আমি বড় তুষ্ট হয়েছি। তুমি আমার প্রাণরক্ষাও করেচ। যাবার আগে আমি তোমাকে একটি সন্ধান দিয়ে যেতে চাই।”
আমি বললুম, “কিসের সন্ধান?”
সন্ন্যাসী বললেন, “যকের ধনের।”
আমি আগ্রহের সঙ্গে বললুম, “যকের ধন! সে কোথায় আছে ঠাকুর?”
সন্ন্যাসী বললেন “খাসিয়া পাহাড়ে।”
আমি হতাশভাবে বললুম, “কোনখানে আছে আমি তা জানব কেমন করে?”
সন্ন্যাসী বললেন, “আমি ঠিকানা বলে দিচ্চি। খাসিয়া পাহাড়ের রূপনাথের গুহার নাম শুনেচ?”
আমি বললুম, “শুনেচি। প্রবাদ আছে যে, এই গুহার ভেতর দিয়ে চীনদেশে যাওয়া যায়, আর অনেককাল আগে এক চীনসম্রাট এই গুহাপথে নাকি সসৈন্যে ভারতবর্ষ আক্রমণ করতে এসেছিলেন।”
সন্ন্যাসী বললেন, “হ্যাঁ। এই রূপনাথের গুহা থেকে পঁচিশ ক্রোশ পশ্চিমে গেলে, উপত্যকার মাঝখানে একটি সেকেলে মন্দির দেখতে পাবে। সে-মন্দির এখন ভেঙে পড়েছে, কিছুদিন পরে তার কোনো চিহ্নও হয়তো আর পাওয়া যাবে না। একসময়ে এখানে মস্ত এক মঠ ছিল, তাতে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা থাকতেন। সেকালের এক রাজা বিদেশী শক্রর সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করবার আগে এই মঠে নিজের সমস্ত ধনরত্ন গচ্ছিত রেখে যান। কিন্তু যুদ্ধে তাঁর হার হয়। পাছে নিজের ধনরত্ন শত্রুর হাতে পড়ে, সেই ভয়ে রাজা সে-সমস্ত এক জায়গায় লুকিয়ে এক যককে পাহারায় রেখে পালিয়ে যান। তারপর তিনি আর ফিরে আসেননি। সেই ধনরত্ন এখনো সেখানেই আছে।”
তারপর সন্ন্যাসী আমাকে বৌদ্ধমঠে যাবার পথের কথা ভালো করে বলে দিলেন।
আমি বললুম, “কিন্তু এতদিনে আর কেউ যদি সেই ধনরত্নের সন্ধান পেয়ে থাকে?”
সন্ন্যাসী বললেন, “কেউ পায়নি। সে বড় দুর্গম দেশ, সেখানে যে বৌদ্ধমঠ আছে, তা কেউ জানে না, আর কোনো মানুষও সেখানে যায় না! মঠে গেলেও, সারাজীবন ধরে ধনরত্ন খুঁজলেও কেউ পাবে না। কিন্তু তোমাকে সেখানে গিয়ে খুঁজতে হবে না; ধনরত্ন ঠিক কোনখানে পাওয়া যাবে, তা জানবার উপায় কেবল আমার কাছে আছে।” এই বলে সন্ন্যাসী তার ঝোলা থেকে একটি মড়ার মাথার খুলি বার করলেন।
আমি আশ্চর্য হয়ে বললেম, “ওতে কী হবে ঠাকুর?”
সন্যাসী বললেন, “যে-যক ধনরত্নের পাহারায় আছে, এ তারই মাথার খুলি! এই খুলিতে আমি মন্ত্র পড়ে দিয়েছি, এ-খুলি যার কাছে থাকবে, যক তাকে আর কিছুই বলবে না। খুলিতে এই যে অঙ্কের মতো রেখা রয়েছে, এ হচ্চে সাঙ্কেতিক ভাষা। এই সঙ্কেত বুঝবার উপায়ও আমি তোমাকে বলে দিচ্চি, তা হলেই তুমি জানতে পারবে ঠিক কোনখানে ধনরত্ন আছে।” এই বলে সন্ন্যাসী আমাকে সঙ্কেত বুঝবার গুপ্ত উপায় বলে দিলেন।
তারপর এক বৎসর ধরে অনেক ভাবলুম। কিন্তু একলাটি সেই দুর্গম দেশে যেতে ভরসা হল না। শেষটা আমার প্রতিবেশী করালীকে বিশ্বাস করে সব কথা জানিয়ে বললুম, “করালী, তোমার জোয়ান বয়স, তুমি যদি আমার সঙ্গে যাও, তবে তোমাকেও ধনরত্নের অংশ দেব।”
কিন্তু করালী যে বেইমান, আমি তা জানতুম না। সে ফাঁকি দিয়ে মড়ার মাথার খুলিটা আমার কাছ থেকে আদায় করবার চেষ্টায় রইল। দু-একবার লোক লাগিয়ে চুরি করবার চেষ্টাও করেছিল, কিন্তু পারেনি। ভাগ্যে আমি তাকে যকের ধনের ঠিকানাটা বলে দিইনি। লোভে একলা সেই অজানা দেশে গিয়ে শেষটা কি বাঘ-ভালুক-ডাকাতের পাল্লায় প্রাণ খোয়াব? অন্য কারুকে সঙ্গে নিতেও ভরসা হয় না, কে জানে, টাকার লোভে বন্ধুই আমাকে খুন করবে কি না! তবে এই পকেট-বইয়ে আমি সব কথা লিখে রাখলুম। ভবিষ্যতে এই লেখা হয়তো আমার বংশের কারুর উপকারে আসতে পারে।
কিন্তু আমার বংশের কেউ যদি সত্যিই সেই বৌদ্ধমঠে যাত্রা করে, তবে যাবার আগে যেন বিপদের কথাটাও ভালো করে ভেবে দেখে। এ-কাজে পদে পদে প্রাণের ভয়।”
পকেট-বইখানা হাতে করে আমি অবাক হয়ে বসে রইলুম।
তিন
সঙ্কেতের অর্থ
উঃ! করালীবাবু কী ভয়ানক লোক! ঠাকুরদাদার সঙ্গে সে চালাকি করতে গিয়েছিল, কিন্তু পেরে ওঠেনি। তারপর এতদিনেও সে আশা ছাড়েনি। আমি বেশ বুঝলুম, এই মড়ার মাথাটা কোথায় আছে তা জানবার জন্যেই করালী কাল আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছিল! রাত্রে এইটে চুরি করবার ফিকিরেই যে আমাদের বাড়িতে চোর এসেছিল, তাতেও আর কোনো সন্দেহ নেই। ভাগ্যে মড়ার মাথাটা আমি বাড়ির পাশের খানায় ফেলে দিয়েছিলুম!
এখন কী করা উচিত? গুপ্তধনের চাবি তো এই খুলির মধ্যেই আছে, কিন্তু অনেকবার উল্টেপাল্টে দেখেও আমি সেই অঙ্কগুলোর ল্যাজ-মুড়ো কিছুই বুঝতে পারলুম না। পকেট-বইখানার প্রত্যেক পাতা উল্টে দেখলুম, তাতেও ঠাকুরদাদা এই সঙ্কেত বুঝবার কোনো উপায় লিখে রাখেননি। ঠাকুরদাদার উপরে ভারি রাগ হল। আসল ব্যাপারটিই জানবার উপায় নেই!
তারপর ভেবে দেখলুম, জেনেই-বা কী আর এমন হাতি-ঘোড়া লাভ হত! আমার বয়স সতেরো বৎসর। সেকেন্ড-ইয়ারে পড়চি। জীবনে কখনো কলকাতার বাইরে যাইনি। কোথায় কোন্ কোণে আসাম আর খাসিয়া পাহাড়, আবার তার ভেতরে কোথায় আছে “রূপনাথের গুহা” -- এসব খুঁজে বার করাই তো আমার পক্ষে অসম্ভব! তার উপরে সেই গভীর জঙ্গল, সেখানে দিন-রাত বাঘ-ভাল্লুক-হাতিরা হানা দিচ্ছে! সেকেলে এক বৌদ্ধমঠ, তার ভিতরে যকের ধন, সে-ও এক ভুতুড়ে কাণ্ড! শেষটা কি একলা সেখানে গিয়ে আলিবাবার ভাই কাসিমের মতন টাকার লোভে প্রাণটা খোয়াব? এসব ভেবেও বুকটা ধুকপুক করে উঠল!
হঠাৎ মনে হল বিমলের কথা। বিমল আমার প্রাণের বন্ধু, আমাদের পাড়ার ছেলে। আমার চেয়ে সে বয়সে বছর-তিনেকের বড়, এ-বৎসরে বি.এ. দেবে। বিমলের মতো চালাক ছেলে আমি আর দুটি দেখিনি। তার গায়েও অসুরের মতন জোর, রোজ সে কুস্তি লড়ে, দুশো ডন, তিনশো বৈঠক দেয়। তার উপরে এই বয়সে সে অনেক দেশ বেড়িয়ে এসেছে, এই গেল বছরেই তো আসামে বেড়াতে গিয়েছিল। তার কাছে আমি কোনো কথা লুকোতুম না! ঠিক করলুম, যাওয়া হোক্ আর না-ই হোক একবার বিমলকে এই মড়ার মাথাটা দেখিয়ে আসা যাক।
বৈকালে বিমলের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলুম, তখন সে বসে বসে বন্দুকের নল সাফ করছিল। আমাকে দেখে বললে, “কী হে, কুমার যে! কী মনে করে?”
আমি বললুম, “একটা ধাঁধা নিয়ে ভারি গোলমালে পড়েচি ভাই!”
বিমল বললে, “কী ধাঁধা?”
আমি মড়ার মাথার খুলিটা বার করে বললুম, “এই দ্যাখো!”
বিমল অবাক হয়ে খুলিটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বললে: এ আবার কী?”
আমি পকেট-বইখানা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললুম, “আমার ঠাকুরদার পকেট-বই। পড়লেই সব বুঝতে পারবে।”
বিমল বললে, “আচ্ছা রোসো, আগে তাড়াতাড়ি বন্দুকটা সাফ করে নিই। কাল পাখি-শিকারে গিয়েছিলুম। বন্দুকে ভারি ময়লা জমেছে।”
বন্দুক সাফ করে, হাত ধুয়ে বিমল বললে, “ব্যাপার কী বলো দেখি কুমার? তুমি কি কোনো তান্ত্রিক গুরুর কাছে মন্ত্র নিয়েছ? তোমার হাতে মড়ার মাথা কেন?”
আমি বললুম, “আগে পকেট-বইখানা পড়েই দ্যাখো না!”
“বেশ” বলে বিমল পকেট-বইখানা নিয়ে পড়তে লাগল। খানিক পরেই দেখলুম, বিমলের মুখ বিস্ময়ে আর কৌতূহলে ভরে উঠেছে!
পড়া শেষ করেই বিমল তাড়াতাড়ি মড়ার মাথাটা তুলে নিয়ে সেটাকে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলে। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বললে, “ভারি আশ্চর্য তো!”
আমি বললুম, “অঙ্কগুলো কিছু বুঝতে পারলে?”
বিমল বললে, “উঁহু!”
আমিও পারিনি।”
কিন্তু আমি এত সহজে ছাড়ব না। তুমি এখন বাড়ি যাও, কুমার! খুলিটা আমার কাছেই থাক। আমি এটার রহস্য জানবই! তুমি কাল সকালে এসো।”
আমি বললুম, “কিন্তু সাবধান।”
বিমল বললে, “কেন?”
আমি বললুম, “করালী মুখুয্যে এই খুলিটা চুরি করবার জন্যে কাল আমাদের বাড়িতে লোক পাঠিয়েছিল।”
বিমল বললে, “করালী? তার কোনো লোকের এত সাহস হবে না যে, আমার বাড়িতে মাথা গলাবে।”
“তা আমি জানি। তবু সাবধানের মার নাই।” এই বলে আমি চলে এলুম।
পরের দিন ভোর না হতেই বিমলের কাছে ছুটলুম। তার বাড়িতে আমার অবারিত দ্বার। একেবারে তার পড়বার ঘরে গিয়ে দেখি, বিমল টেবিলের উপর হেঁট হয়ে এক মনে কী লিখছে, আর সামনেই মড়ার মাথাটা পড়ে রয়েছে। আমার পায়ের শব্দে চমকে তাড়াতাড়ি সে খুলিটাকে তুলে নিয়ে লুকিয়ে ফেলতে গেল, তারপর আমাকে দেখে আশ্বস্ত হয়ে হেসে বললে, “ওঃ, তুমি! আমি ভেবেছিলুম অন্য কেউ!”
“কাল তো অত সাহস দেখালে, আজ এত ভয় পাচ্ছ কেন?”
“কাল? কাল সবটা ভালো করে তলিয়ে বুঝিনি। আজ বুঝচি, আমাদের এখন সাবধান হয়ে কাজ করতে হবে, কাকপক্ষী যেন টের না পায়।”
“অঙ্কগুলো দেখে কিছু বুঝলে?”
“যা বোঝা উচিত সব বুঝেচি।”
আনন্দে আমি লাফিয়ে উঠলুম! চেঁচিয়ে বললুম, “সব বুঝতে পেরেচ! সত্যি?”
বিমল বললে, “চুপ! টেঁচিয়ো না! কে কোথায় শুনতে পাবে বলা যায় না। ঠাণ্ডা হয়ে এখানে বোসো।”
আমি একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বললুম, “খুলিতে কী লেখা আছে,
আমাকে বলো।”
বিমল আস্তে আস্তে বললে, “প্রথমটা আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। প্রায় চার ঘণ্টা চেষ্টা করে যখন আমি একেবারে হতাশ হয়ে পড়েচি, তখন হঠাৎ আমার একটা কথা মনে পড়ে গেল। অনেকদিন আগে একখানা ইংরিজি বই পড়েছিলুম। তাতে নানারকম সাঙ্কেতিক লিপির গুপ্তরহস্য বোঝানো ছিল। তাতেই পড়েছিলুম যে ইউরোপের চোর-ডাকাতরা প্রায়ই একরকম সঙ্কেত ব্যবহার করে। তারা Alphabet অর্থাৎ বর্ণমালাকে যথাক্রমে সংখ্যা অর্থাৎ ১, ২, ৩ হিসাবে ধরে। অর্থাৎ one হবে A, two হবে B, three হবে C ইত্যাদি। আমি ভাবলুম হয়তো এই খুলিটাতেও সেই নিয়মে সঙ্কেত সাজানো হয়েচে। তারপর দেখলুম, আমার অনুমান মিথ্যা নয়। তখন এই সঙ্কেতগুলো খুব সহজেই পড়ে ফেললুম।”
আমি আগ্রহের সঙ্গে বলে উঠলুম, “পড়ে কী বুঝলে বলো?”
বিমল আমার হাতে একখানা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললে, “খুলির সঙ্কেতগুলো ছাব্বিশটা ঘরে ভাগ করা। আমিও লেখাগুলো সেইভাবেই সাজিয়েচি।”
কাগজের উপরে এই কথাগুলো লেখা ছিল :
“ভাঙা দেউলের পিছনে সরলগাছ
মূলদেশ থেকে পুবদিকে দশগজ
এগিয়ে থামবে ডাইনে আটগজ
এগিয়ে বুদ্ধদেব বামে ছয়গজ
এগিয়ে তিনখানা পাথর
তার তলায় সাতহাত জমি খুঁড়লে পথ পাবে”
আমি চিঠিখানা পড়ে মনে মনে বিমলের বুদ্ধির তারিফ করতে লাগলুম।
বিমল বললে, “সাঙ্কেতিক লিপিটা তোমাকে ভালো করে বুঝিয়ে দি, শোনো।
আমাদের বাংলা ভাষায় “অ” থেকে শুরু করে “৺” পর্যন্ত বাহান্নটি বর্ণ। সেই বর্ণগুলিকে ১, ২, ৩ হিসাবে যথাক্রমে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ ১ হচ্চে অ, ২ হচ্চে আ, ১৩ হচ্চে ক, ৫২ হচ্ছে ৺ প্রভৃতি। যেখানে “আ”-কার বা “এ”-কার প্রভৃতি আছে, সেখানে বর্ণের যে-পাশে দরকার, সেইপাশে ব্রাকেটের ভেতর সংখ্যা লেখা হয়েচে। উদাহরণ দ্যাখো: “ভ” বর্ণের সংখ্যা ৩৬, আর “আ”-কারের সংখ্যা হচ্ছে ২। অতএব, ৩৬ (২) সঙ্কেতে বুঝতে হবে “ভা”। “দ” বর্ণের সংখ্যা ৩০, “এ”-কারের সংখ্যা হচ্চে ৯। অতএব “দে” বোঝাতে লিখতে হবে (৯) ৩০। “উ”-কার বর্ণের তলায় বসে। সুতরাং ৩৫/৫ থাকলে বুঝতে হবে “বু”। “উ” র মতো “উ”-কারের সংখ্যা হচ্চে ৫। চন্দ্রবিন্দুর সংখ্যা বাহান্ন, চন্দ্রবিন্দু উপরে বসে, কাজেই “খুঁ”র সঙ্কেত ৫২/১৪। যুক্ত-অক্ষরকে আলাদা করে ধরা হয়েছে, যেমন “বুদধদেব”। যিনি এই সংখ্যাগুলি লিখেছেন, তার বানান-জ্ঞান ততটা টনটনে নয়। কেননা “মূল” ও “পূব” তার হাতে পড়ে হয়েচে, “মুল” ও “পুব”। ঊ’ র মতো উ-কারের সংখ্যা হচ্চে ৬। কিন্তু তিনি উ-কারের সংখ্যা ঊ-কারের ৬-এর স্থানে বসিয়েচেন -- বর্ণের তলাকার ব্রাকেটে।”
আমি মড়ার মাথার খুলিটা আর একবার পরখ করবার জন্যে তুলে নিলুম -- কিন্তু দৈবগতিকে হঠাৎ সেখানা ফসকে মার্বেল বাঁধানো মেঝের উপরে সশব্দে পড়ে গেল। তাড়াতাড়ি সেটা উঠিয়ে নিয়ে, তার উপর একবার চোখ বুলিয়ে আমি বলে উঠলুম, “ঐ যাঃ! খুলিটার খানিকটা চটে গিয়েছে।”
বিমল বললে, “কোন্ খানটা?”
আমি বললুম, গোড়ার চারটে ঘর-- ভাঙা দেউলের পিছনে সরলগাছ--পর্যন্ত।”
বিমল বললে, “এই কান্ডটি যদি আগে ঘটত তা হলে সমস্তই মাটি হয়ে যেত। যাক, তোমার কোনো ভয় নেই, সঙ্কেতগুলো আমি কাগজে টুকে নিয়েচি। কিন্তু আমাদের সাবধান হতে হবে, অঙ্কগুলো রেখে কথাগুলো এখনি নষ্ট করে ফেলাই উচিত।” এই বলে সে সঙ্কেতের অর্থ-লেখা কাগজখানা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললে।
যখন দরকার হবে, পাঁচ মিনিটের চেষ্টাতেই সঙ্কেতের অর্থ আমরা ঠিক বুঝতে পারব, কিন্তু বাইরের কোনো লোক খুলির সঙ্কেত দেখে কিছুই ধরতে পারবে না।
চার
সর্বনাশ
আমি বললুম, “বিমল, সঙ্কেতের মানে তো বোঝা গেল, এখন আমরা কী করব?”
বিমল বাধা দিয়ে বললে, “এতে আর কিন্তু-টিন্তু কিছু নেই কুমার, আমাদের যেতেই হবে। এত-বড় একটা অদ্ভুত ব্যাপার, এর শেষ পর্যন্ত না দেখলে আমার তৃপ্তি হচ্ছে না।”
আমি বললুম, “আমাদের সঙ্গে কে কে যাবে?”
“কেউ না। খালি তুমি আর আমি।”
“কিন্তু সে বড় দুর্গম জায়গা। লোকজন না নিয়ে কি যাওয়া উচিত?”
বিমল বললে, “কিছুই দুর্গম নয়, পথঘাট আমি সব চিনি, “রূপনাথের গুহা” পর্যন্ত ঠিক যাব। তার পরের পথ কীরকম জানি না বটে, কিন্তু চিনে নিতে বেশি দেরি লাগবে না। তুমি বুঝি বিপদের ভয় করচ? ও-ভয় কোরো না। বিপদকে ভয় করলে মানুষ আজ এত বড় হতে পারত না। সোজা পথ দিয়ে তো শিশুও যেতে পারে, তাতে আর বাহাদুরি কী? বিপদের অগ্নিপরীক্ষায় হাসিমুখে যে সফল হয়, পৃথিবীতে তাকেই বলি মানুষের মতো মানুষ।”
আমি বললুম, “কিন্তু গোয়ার্তুমি করে প্রাণ দিলে মানুষের মর্যাদা কি বাড়বে? আমি অবশ্য কাপুরুষ নই, তুমি যেখানে বল যেতে রাজি আছি! তবে অন্ধের মতো কিছু করা ঠিক নয়, জানো তো, প্রবাদেই আছে, লাফ মারবার আগে চেয়ে দ্যাখো।”
বিমল বললে, “যা ভাববার আমি সব ভেবে দেখেচি, এখন আর ভাবনা নয়।”
“কবে যাবে?”
“আমি তো প্রস্তুত। কাল বল, কাল, পরশু বল, পরশু--”
“এত তাড়াতাড়ি। যাবার আগে বন্দোবস্ত করতে হবে তো!”
বন্দোবস্ত করব আর ছাই। আমরা তো সেখানে ঘর-সংসার পাততে যাচ্ছি না, এসব কাজে যতটা ঝাড়া-হাত-পায়ে যাওয়া যায়, ততই ভালো। গোটা-দুই ব্যাগ, আর আমরা দুটি প্রাণী --ব্যস।”
“কোন্ পথে যাবে?”
বিমল বললে, “আমাদের কামরূপ পার হয়ে এই খাসিয়া পাহাড়ে উঠতে হবে। খাসিয়া পাহাড়ের ঠিক পাশেই যমজ ভাইয়ের মতো আর একটি পাহাড় আছে, তার নাম জয়ন্তী। এদের উত্তরে আছে কামরূপ আর নবগ্রাম। পূর্বে আছে উত্তর-কাছাড়, নাগা পর্বত আর কপিলী নদী। দক্ষিণে আছে শ্রীহট্ট, আর পশ্চিমে গারো পাহাড়।”
“খাসিয়া পাহাড় কি খুব উঁচু?”
“হুঁ, উঁচু বৈকি। কোথাও চার হাজার, কোথাও পাঁচ হাজার, আবার কোথাও বা সাড়ে ছয় হাজার ফুট উঁচু। পাহাড়ের ভেতর অনেক জলপ্রপাত আছে, তাদের মধ্যে চেরাপুঞ্জি নামে জায়গার কাছে “মুসমাই” আর শিলং শহরের কাছে “বীডনস” প্রপাত দুইটিই বড়। প্রথমটির উচ্চতা এক হাজার আটশো ফুট, দ্বিতীয়টি ছয়শো ফুট। উচ্চতায় প্রথম প্রপাতটি পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয়। পাহাড়ের মধ্যে উষ্ণ প্রস্রবণও আছে, তার জল গরম। খাসিয়া পাহাড়ে শীত আর বর্ষা ছাড়া আর কোনো ঋতুর প্রভাব বোঝা যায় না, বৃষ্টি আর ঝড় তো লেগেই আছে। বৈশাখ আর জ্যৈষ্ঠমাসে বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত একটু বসন্তের আমেজ পাওয়া যায়। খাসিয়া পাহাড়ের চেরাপুঞ্জি তো বৃষ্টির জন্যে বিখ্যাত।”
আমি বললুম, “সেখানে বাঘ-ভাল্লুকের ভয় আছে?”
বিমল হেসে বললে, “খালি বাঘ-ভাল্লুক কেন, সেখানকার জঙ্গলে হাতি, গন্ডার, বুনো মোষ আর বরাহ সবই পাওয়া যায়, কিন্তু সাপ খুব কম।”
আমি মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললুম, “তবেই তো।”
বিমল আমার পিঠ চাপড়ে বললে, “কুমার, তুমি কলকাতার বাইরে কখনো যাওনি বলে বন-জঙ্গলকে যতটা ভয়ানক মনে করচ, আসলে তা তত ভয়ানক নয়। আর আমি সঙ্গে থাকব, তোমার ভয় কী? জানো তো, আমি এই বয়েসেই ঢের বড় জন্তু শিকার করেচি। আমার দুটো বন্দুকের পাশ আছে, একটা তোমাকে দেব। তুমি আজও কিছু শিকার করনি বটে, কিন্তু আমি তো তোমাকে অনেক দিন আগেই বন্দুক ছুঁড়তে শিখিয়ে দিয়েছি, এইবার সে-শিক্ষার পরীক্ষা হবে।”
সেদিন আর কিছু না বলে বাড়িমুখো হলুম। মনে ভয় হচ্ছিল বটে, আনন্দও হচ্ছিল খুব। নতুন নতুন দেশ দেখবার সাধ আমার চিরকাল। কেতাবে নানা দেশের ছবি দেখে আর গল্প পড়ে সেসব দেশে যাবার জন্যে আমার মন যেন উড়ুউড়ু করত। কখনো ইচ্ছে হ’ত রবিন ক্রুশোর মতন এক নির্জন দ্বীপে গিয়ে, নিজের হাতে কুঁড়েঘর বেঁধে মনের সুখে দিনের পর দিন কাটাই। কখনো ইচ্ছে হ’ত সিন্দবাদ নাবিকের মতো ‘রক’ পাখির সঙ্গে আকাশে উঠি, তিমিমাছের পিঠে রান্না চড়াই, আর দ্বীপবাসী বৃদ্ধকে আছাড় মেরে জব্দ করে দিই। কখনো ইচ্ছে হ’ত ডুবো-জাহাজে সমুদ্রের ভেতরে যাই আর পাতাল-রাজের ধনভান্ডার লুট করে নিয়ে আসি! এমনি কত ইচ্ছাই যে আমার হ’ত তা আর বলা যায় না, বললে তোমরা সবাই শুনে নিশ্চয়ই খুব ঠাট্টার হাসি হাসবে।
আসল কথা কী, যকের ধন পাওয়ার সঙ্গে নতুন দেশ দেখবার আনন্দ ক্রমেই আমাকে চাঙ্গা করে তুললে। মনে যা-কিছু ভয়-ভাবনা ছিল, যেন কোথায় ভেসে গেল।
বাড়ির কাছে আসতেই আমার আদরের কুকুর বাঘা আধহাত জিভ বার করে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে আমাকে আগ বাড়িয়ে নিতে এল।
আমি বললুম, “কী রে বাঘা, আমার সঙ্গে খাসিয়া পাহাড়ে বেড়াতে যাবি?”
বাঘা যেন আমার কথা বুঝতে পারলে। পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, সামনের দুই পায়ে সে আমার কোমর জড়িয়ে ধরলে, তারপর আদর করে আমার মুখ চেটে দিতে এল। আমি তাড়াতাড়ি মুখ সরিয়ে নিয়ে তাকে নামিয়ে দিলুম!
আমার এই বাঘা বিলিতি নয়, দিশী কুকুর। কিন্তু তাকে দেখলে সেকথা বোঝবার যো নেই। ভালোরকম যত্ন করলে দিশী কুকুরও যে কেমন চমৎকার দেখতে হয়, বাঘাই তার প্রমাণ। তার আকার মস্ত-বড়, গায়ের রং হলদে, তার উপর কালো কালো ছিট, অনেকটা চিতাবাঘের মতো, তাই তার নাম রেখেছি বাঘা। ভয় কাকে বলে বাঘা তা জানে না, আর তার গায়েও বিষম জোর। একবার হাউন্ড জাতের প্রকাণ্ড একটা বিলিতি কুকুর তাকে তেড়ে এসেছিল, কিন্তু বাঘার এক কামড় খেয়েই সে একেবারে মরো-মরো হয়ে পড়েছিল। আমি ঠিক করলুম, বাঘাকেও আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাব।
পরের দিন সকালে তখনো আমার ঘুম ভাঙেনি, হঠাৎ কে এসে ডাকাডাকি করে আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলে! চেয়ে দেখি বিমল আমার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আশ্চর্য হয়ে উঠে বসে বললুম, “কীহে, সক্কালবেলায় হঠাৎ তুমি যে?”
বিমল হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, “সর্বনাশ হয়েছে!”
আমি তাড়াতাড়ি বললুম, “সর্বনাশ হয়েছে! সে আবার কী?”
বিমল বললে, “কাল রাত্রে মড়ার মাথাটা আমার বাড়ি থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে!”
“আ্যাঃ, বল কী?” আমি একেবারে হতভন্বের মতো আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলুম!
পাঁচ
পরামর্শ
আমি বললুম, “মড়ার মাথা কী করে চুরি গেল, বিমল!”
বিমল বললে, “জানি না। সকালে উঠে দেখলুম, আমার পড়বার ঘরের দরজাটা খোলা, রাত্রে তালা-চাবি ভেঙে কেউ ঘরের ভেতরে ঢুকেচে! বুকটা অমনি ধড়াস করে উঠল! মড়ার মাথাটা আমি টেবিলের টানার ভেতরে চাবি বন্ধ করে রেখেছিলুম। ছুটে গিয়ে দেখি, টানাটাও খোলা রয়েচে, আর তার ভেতর মড়ার মাথা নেই!”
আমি বলে উঠলুম, “এ নিশ্চয়ই করালী মুখুয্যেরর কীর্তি। সে-ই লোক পাঠিয়ে মড়ার মাথা চুরি করেছে। কিন্তু এই ভেবে আমি আশ্চর্য হচ্ছি, করালী কী করে জানলে যে, মড়ার মাথাটা তোমার বাড়িতে আছে?”
বিমল বললে, “করালী নিশ্চয়ই চারিদিকে চর রেখেচে! আমরা কী করচি না- করচি, সব সে জানে!”
আমি বললুম, “কিন্তু খালি মড়ার মাথাটা নিয়ে সে কী করবে? সঙ্কেতের মানে তো সে জানে না!”
বিমল বললে, “কুমার, শত্রকে কখনো বোকা মনে কোরো না! আমরা যখন সঙ্কেত বুঝতে পেরেচি, তখন চেষ্টা করলে করালীই-বা তা বুঝতে পারবে না কেন?”
আমি বললুম, “কিন্তু সঙ্কেতের সবটাও যে আর মড়ার মাথার ওপরে নেই! মনে নেই, আমার হাত থেকে পড়ে কাল মড়ার মাথাটা চটে গিয়েচে!”
বিমল কী যেন ভাবতে ভাবতে বললে, “তবু বিশ্বাস নেই!”
হঠাৎ আমার আর একটা কথা মনে পড়ল। আমি তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করলুম, “আচ্ছা ঠাকুরদার পকেট-বইখানাও কি চুরি গেছে?”
বিমল বললে, “না, এইটুকুই যা আশার কথা। পকেট-বইখানা কাল রাত্রে আমি আর একবার ভালো করে পড়বার জন্যে উপরে নিয়ে গিয়েছিলুম। ঘুমোবার আগে সেখানা আমার মাথার তলায় বালিশের নিচে রেখে শুয়েছিলুম, চোর তা নিতে পারেনি।”
আমি কতকটা নিশ্চিন্ত হয়ে বললাম, “যাক, তবু রক্ষে ভাই। যকর ধনের আছে সেই পকেট-বইয়ের মধ্যে। ঠিকানা না জানলে করালী সঙ্কেত জেনেও কিছু করতে পারবে না! কিন্তু খুব সাবধান বিমল! পকেট-বইখানা যেন আবার চুরি না যায়।”
বিমল বললে, “সে-বন্দোবস্ত আজকেই করব। পকেট-বইয়ের যেখানে পথের কথা আর ঠিকানা আছে, সেসব জায়গা আমি কালি দিয়ে এমন করে কেটে দেব যে, কেউ তা পড়তে পারবে না!”
আমি বললুম, “তা হলে আমরাও মুশকিলে পড়ব যে!”
বিমল হেসে বললে, “কোনো ভয় নেই। ঠিকানা আর পথের কথা আর-একখানা আলাদা কাগজে নতুন একরকম সাঙ্কেতিক কথাতে আমি টুকে রাখব, সে-সঙ্কেত আমি ছাড়া আর কেউ জানে না।”
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকবার পর আমি বললুম, “এখন আমরা কী করব?”
বিমল বললে, “আগে মড়ার মাথাটা উদ্ধার করতে হবে!”
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম “কী করে?”
বিমল বললে, “যেমন করে তারা মড়ার মাথা আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেছে!”
আমি বললুম, “চোরের উপর বাটপাড়ি?”
বিমল বললে “তা ছাড়া আর উপায় কী? আজ রাত্রেই আমি করালীর বাড়িতে যেমন-করে-পারি ঢুকব। আমার সঙ্গে থাকবে তুমি।”
আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললুম, “কিন্তু করালী যদি জানতে পারে, আমাদের চোর বলে ধরিয়ে দেবে যে! সে-ই যে মড়ার মাথাটা চুরি করেচে, তারও তো কোনো প্রমাণ নেই!”
বিমল মরিয়ার মতো বললে, “কপালে যা আছে তা হবে। তবে এটা ঠিক, আমি বেঁচে থাকতে করালী আমাদের কারুকে ধরতে পারবে না।”
মনকে তবু বুঝ মানাতে না পেরে আমি বললুম, “না ভাই, দরকার নেই। শেষটা কি পাড়ায় একটা কেলেঙ্কারি হবে?”
বিমল বেজায় চটে গিয়ে বললে, “দূর ভীতু কোথাকার! এই সাহস নিয়ে তুমি যাবে রূপনাথের গুহায় যকের ধন আনতে? তার চেয়ে মায়ের কোলের আদুরে খোকাটি হয়ে বাড়িতে বসে থাকো, তোমার পকেট-বই এখনি আমি ফিরিয়ে দিয়ে যাচ্ছি।” এই বলেই বিমল হনহন করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল!
আমি তাড়াতাড়ি আবার বিমলকে ফিরিয়ে এনে বললুম, “বিমল, তুমি ভুল বুঝচ, আমি একটুও ভয় পাইনি। আমি বলছিলুম কি--”
বিমল আমাকে বাধা দিয়ে বললে, “তুমি কী বলচ, আমি তা শুনতে চাই না। স্পষ্ট করে বলো, আজ রাত্রে আমার সঙ্গে তুমি করালীর বাড়িতে যেতে রাজি আছ কি না?”
আমি জবাব দিলুম, “আছি।”
বিমল খুশি হয়ে আমার হাতদুটো আচ্ছা করে নেড়ে দিয়ে বললে, “এই তো গুড বয়ের মতো কথা। যদি মানুষ হতে চাও, ডানপিটে হও।”
আমি হেসে বললুম, “কিন্তু ডানপিটের মরণ যে গাছের আগায়!”
বিমল বললে, “বিছানায় শুয়ে থাকলেও মানুষ তো যমকে কলা দেখাতে পারে না! মরতেই যখন হবে, তখন বিছানায় শুয়ে মরার চেয়ে বীরের মতো মরাই ভালো! তোমরা যাদের ভালো ছেলে বলো, সেই গোবর-গণেশ মিনমিনে ননীর পুতুলগুলোকে আমি দু-চোখে দেখতে পারি না! সায়েবের জুতো খেয়ে তাদেরই পিলে ফাটে, বিপদে পড়লে তারাই আর বাঁচে না, মরে বটে, তা-ও কাপুরুষের মতো। এরাই বাঙালির কলঙ্ক। জগতে যেসব জাতি আজ মাথা তুলে বড় হয়ে আছে, বিপদের ভেতর দিয়ে, মরণের কুছ-পরোয়া না রেখে তারা সবাই শ্রেষ্ঠ হতে পেরেচে। বুঝলে কুমার? বিপদ দেখলে আমার আনন্দ হয়!”
ছয়
চোরের উপর বাটপাড়ি
সেদিন অমাবস্যা! চারদিকে অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে আছে। কেবল জোনাকিগুলো মাঝে মাঝে পিটপিট করে জ্বলছে ঠিক যেন আঁধার-রাক্ষসের রাশি রাশি আগুন-চোখের মতন।
আমাদের বাড়ি কলকাতার প্রায় বাইরে, সেখানটা এখনো শহরের মতন ঘিঞ্জি হয়ে পড়েনি। বাড়ি-ঘর খুব তফাতে তফাতে, গাছপালাই বেশি, বাসিন্দা খুব কম। অর্থাৎ আমরা নামেই কলকাতায় থাকি, এখানটাকে আসল কলকাতা বলা যায় না।
আমাদের বাড়ির পরে একটা মাঠ, সেই মাঠের একপাশের একটা কচুঝোপের ভিতর বিমল আর আমি সুযোগের অপেক্ষায় লুকিয়ে বসে আছি। মাঠের ওপারে করালীর বাড়ি।
মশারা আমাদের সাড়া পেয়ে আজ ভারি খুশি হয়ে ক্রমাগত ব্যান্ড বাজাচ্ছে, বিনি পয়সার ভোজের লোভে! সে-তল্লাটে যত মশা ছিল, ব্যান্ডের আওয়াজ শুনে সবাই সেখানে এসে হাজির হল এবং আমাদের সর্বাঙ্গে আদর করে শুঁড় বুলিয়ে দিতে লাগল। সেই সাংঘাতিক আদর আর হজম করতে না পেরে আমি চুপিচুপি বিমলকে বল্লুম “ওহে, আর যে সহ্য হচ্ছে না।”
বিমল খালি বললে, “চুপ!”
“আর চুপ করে থাকা যে কত শক্ত, তা কি বুঝচ না?”
“বুঝচি সব! আমি চুপ করে আছি কী করে?”
একথার উপরে আর কথা চলে না। অগত্যা চুপ করেই রইলুম!
ক্রমে মুখ-হাত-পা যখন ফুলে প্রায় ঢোল হয়ে উঠল তখন নিশুত রাতের বুক কাপিয়ে গির্জের ঘড়িতে টং করে একটা বাজল!
বিমল উঠে দাঁড়িয়ে বললে, “এইবার সময় হয়েচে!”
আমি তৈরি হয়েই ছিলুম, এক লাফে ঝোপের বাইরে এসে দাঁড়ালুম!
বিমল বললে, “আগে এই মুখোশটা পরে নাও!”
বিমল আজ দুপুরবেলায় রাধাবাজার থেকে দুটো দামি বিলাতি মুখোশ কিনে এনেছে। দুটোই কাফ্রির মুখ, দেখতে এমন ভয়ানক যে রাত্রে আচমকা দেখলে বুড়ো-মিন্সেদেরও পেটের পিলে চমকে যাবে! পরার উদ্দেশ্য, কেউ আমাদের দেখলেও চিনতে পারবে না।
মুখোশ পরে দুজনে আস্তে আস্তে করালীর বাড়ির দিকে এগুতে লাগলুম। তার বাড়ির পিছন দিকে গিয়ে বিমল চুপিচুপি বললে, “মালকোঁচা মেরে কাপড় পরে-নাও!”
আমি বললুম, “কিন্তু এদিকে তো বাড়ির ভেতরে ঢোকবার দরজা নেই!”
বিমল বললে, “দরজা দিয়ে ঢুকবে কে? আমরা কি নেমন্তন্ন খেতে যাচ্ছি? এদিকে একটা বড় বটগাছ আছে, সেই গাছের ডাল করালীর বাড়ির দোতলার ছাদের উপরে গিয়ে পড়েচে। আমরা ডাল দিয়ে বাড়ির ভেতরে যাব!” বিমল তার হাতের চোরা-লন্ঠনটা উঁচু করে ধরলে, একটা আলোর রেখা ঠিক আমাদের সামনের বটগাছের উপরে গিয়ে পড়ল!
বাড়িতে ঢুকবার এই উপায়ের কথা শুনে আমার মনটা অবশ্য খুশি হল না, কিন্তু মুখে আর কিছু না বলে, বিমলের সঙ্গে সঙ্গে গাছের উপর উঠতে লাগলুম।
অনেকটা উঁচুতে উঠে বিমল বললে, “এইবার খুব সাবধানে এসো! এই দ্যাখো ডাল! এই ডাল বেয়ে গিয়ে ছাদের উপর লাফিয়ে পড়তে হবে।”
আবছায়ার মতন ডালটা দেখতে পেলুম। বিমল আগে ডাল ধরে এগিয়ে গেল, একটা অস্পষ্ট শব্দে বুঝলুম, সে ছাদের উপরে লাফিয়ে পড়ল।
আমি দু-ধারে দু-পা রেখে আর দু-হাতে প্রাণপণে ডালটা ধরে ধীরে ধীরে এগুতে লাগলুম, প্রতি মুহূর্তেই মনে হয়, এই বুঝি পড়ে যাই! সেখান থেকে পড়ে গেলে স্বয়ং ধন্বন্তরীও আমাকে বাঁচাতে পারবেন না।
হঠাৎ বিমলের অস্পষ্ট গলা পেলুম, “ব্যস! ডাল ধরে ঝুলে পড়ো।”
আমি ভয়ে ভয়ে ডাল ধরে ঝুলে পড়লুম!
“এইবার ডাল ছেড়ে দাও।”
ডাল ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি ধুপ্ করে ছাদের উপরে গিয়ে পড়লুম। বিমল আমার পিঠ চাপড়ে বললে, “শাবাশ!”
আমি কিন্তু মনের মধ্যে কিছুমাত্র ভরসা পেলুম না! এসেছি চোরের মতো পরের বাড়িতে, ধরা পড়লেই হাতে পরতে হবে হাতকড়া! তারপর আর-এক ভাবনা, পালাব কোন্ পথ দিয়ে? লাফিয়ে তো ছাদে নামলুম, কিন্তু লাফিয়ে তো আর এ উঁচু ডালটা ফের ধরা যাবে না! বিমলকেও আমার ভাবনার কথা বললুম।
বিমল বললে, “সদর দরজা ভিতর থেকে বন্ধ বলেই আমাদের গাছে চড়তে হল। পালাবার সময় দরজা খুলেই পালাব।”
“কিছু বাড়িতে দরোয়ান আছে যে!”
“তার ব্যবস্থা পরে করা যাবে। এখন চলো, দেখি নিচে নামবার সিঁড়ি কোন্ দিকে! পা টিপে টিপে এসো।”
ছাদের পশ্চিম কোণে সিঁড়ি পাওয়া গেল। বিমল আগে আগে নামতে লাগল, আমি রইলুম পিছনে। সিঁড়ি দিয়ে নেমেই একটা ঘর। বিমল দরজার উপরে কান পেতে চুপিচুপি আমাকে বললে, “এ-ঘরে কে ঘুমোচ্ছে, তার নাক ডাকচে।”
চোরা-লন্ঠনের আলোয় পথ দেখে আমরা দালানের ভিতরে গিয়ে ঢুকলুম।
একপাশে তিনটে ঘর, সব ঘরই ভিতর থেকে বন্ধ। বিমল চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল। আমি তো একেবারে হতাশ হয়ে পড়লুম। এত বড় বাড়ি, ভিতরকার খবর আমরা কিছুই জানি না, এতটুকু একটা মড়ার মাথা কোথায় লুকানো আছে, কী করে আমরা সে-খোঁজ পাব? বিমলও যেমন পাগল! আমাদের খালি কাদা ঘেঁটে মরাই সার হল!
হঠাৎ বিমল বললে, “ওধারকার দালানের একটা ঘরের দরজা দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে! চলো ঐদিকে!”
বিমল আস্তে আস্তে সেই দিকে গিয়ে ঘরের সামনে দাঁড়াল। দরজাটা ঠেলতেই একটু খুলে গেল! ফাঁক দিয়ে উকি মেরে বিমল খানিকক্ষণ কী দেখলে, তারপর ফিরে আমার কানে-কানে বললে, “দ্যাখো!”
দরজার ফাঁক দিয়ে যা দেখলুম, তাতে আনন্দে আমার বুকটা নেচে উঠল! টেবিলের উপর মাথা রেখে করালী নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে, আর তার মাথার কাছেই পড়ে রয়েছে, আমরা যা চাচ্ছি তাই, সেই মড়ার মাথাটা! করালী নিশ্চয় সঙ্কেতগুলোর অর্থ বুঝবার চেষ্টা করছিল, তারপর কখন হতাশ ও শ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে! করালী তা হলে সত্যিই চোর।
বিমল খুব সাবধানে দরজাটা আর-একটু খুলে, পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে ঘরের ভিতরে গেল। তারপর ঘুমন্ত করালীর পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে মড়ার মাথাটা টেবিলের উপর থেকে তুলে নিল। তারপর হাসতে হাসতে ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। এত সহজে যে কেল্লা ফতে হবে, এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি!
এইবার পালাতে হবে। একবার বাইরে যেতে পারলেই আমরা নিশ্চিন্ত, আর আমাদের পায় কে!
দুজনেই একতলায় গিয়ে নামলুম। উঠান পার হয়েই সদর দরজা। কিন্তু কী মুশকিল, বিমলের চোরা-লন্ঠনের আলোতে দেখা গেল, একটা খুব লম্বা-চওড়া জোয়ান দরোয়ান দরজা জুড়ে চিৎপাত হয়ে শুয়ে, দিব্য আরামে নিদ্রা দিচ্ছে!
বিমল কিন্তু একটু ইতস্তত করলে না, সে খুব আস্তে আস্তে দরোয়ানকে টপকে দরজার খিল খুলতে গেল। ভয়ে আমার বুক টিপটিপ্ করতে লাগল, একটু শব্দ হলেই সর্বনাশ!
কিন্তু বিমল কী বাহাদুর! সে এমন সাবধানে দরজা খুললে যে, একটুও আওয়াজ হল না।
হঠাৎ আমার নাকের ভিতরে কী-একটা পোকা ঢুকে গেল, সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁচ্চো করে খুব জোরে আমি হেঁচে ফেললুম।
দরোয়ানের ঘুম গেল ভেঙে! বাঁজখাই গলায় সে চেঁচিয়ে উঠল, “কোন্ হ্যায় রে!”
লগ্ঠনটা তখন ছিল আমার হাতে। তার আলোতে দেখলুম, বিমল বিদ্যুতের মতন ফিরে দাঁড়াল, তারপর বাঘের মতন দরোয়ানের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, দুই হাতে তার গলা টিপে ধরল। খানিকক্ষণ গোঁ গোঁ করেই চোখ কপালে তুলে দরোয়ানজি একেবারে অজ্ঞান।
তারপর আর কী, দে ছুট তো দে ছুট! ঘোড়দৌড়ের ঘোড়াও তখন ছুটে আমাদের ধরতে পারত না, এক দমে বাড়িতে এসে তবে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম।
সাত
জানলায় কালো মুখ
এক এক গেলাশ জল খেয়ে, ঠান্ডা হয়ে, বাইরের ঘরে গিয়ে বসলুম। রাত তখন আড়াইটে ৷
বিমল বললে, “আজ রাতে আর ঘুম নয়। কাল বৈকালের গাড়িতে আমরা আসাম যাব।”
আমি আশ্চর্য হয়ে বলনুম “সে কী! এত তাড়াতাড়ি!”
বিমল বললে, “হুঁ, তাড়াতাড়ি না করলে চলবে না। করালী রাষ্কেল আমাদের ওপরে চটে রইল, মড়ার মাথা যে আমরাই আবার তার হাত থেকে ছিনিয়ে এনেচি, এতক্ষণে নিশ্চয়ই সে তা টের পেয়েচে! কখন কী ফ্যাসাদ বাধিয়ে বসবে কে তা জানে? কালই দুর্গা বলে বেরিয়ে পড়তে হবে!”
আমি আপত্তি জানিয়ে বললুম, “মা গেছেন শান্তিপুরে, মামার বাড়িতে। তাঁকে না জানিয়ে আমি কী করে যাব?”
বিমল বললে, “তাঁকে চিঠি লিখে দাও, আমার সঙ্গে তুমি আসামে বেড়াতে যাচ্চ, বড় তাড়াতাড়ি বলে যাবার আগে দেখা করতে পারলে না!”
আমি চিন্তিত মুখে বললুম, “চিঠি যেন লিখে দিলুম, কিন্তু এত বড় একটা কাজে যাচ্চি, অনেক বন্দোবস্ত করতে হবে যে! কালকের মধ্যে সব গুছিয়ে উঠতে পারব কেন?”
বিমল বিরক্ত স্বরে বললে, “তোমাকে বিশেষ কিছুই করতে হবে না, বন্দোবস্ত যা করবার তা আমিই করব অখন। তুমি খালি কাপড়-চোপড় আর গোটাকতক কোট-প্যান্ট নিও, বুঝলে অকর্মার ধাড়ি।”
“কেন? কোট-প্যান্ট আবার কী হবে?”
“যেতে হবে পাহাড়ে আর জঙ্গলে। সেখানে ফুলবাবুর মতো কাছাকোঁচা সামলাতে গেলে চলে না, তা হলে পদে-পদে বিপদে পড়তে হবে।”
আমি চুপ করে ভাবতে লাগলুম।
বিমল বললে, “ভেবেছিলুম দুজনেই যাব। কিন্তু তুমি যেরকম নাবালক গোবেচারা দেখচি, সঙ্গে আর-একজনকে নিলে ভালো হয়।”
“কাকে নেবে?”
“আমার চাকর রামহরিকে। সে আমাদের পুরনো লোক; বিশ্বাসী, বুদ্ধিমান আর তার গায়েও খুব জোর। আমার জন্যে সে হাসতে হাসতে প্রাণ দিতে পারে।”
“আচ্ছা, সেকথা মন্দ নয়। আমিও বাঘাকে সঙ্গে নিয়ে যাব, তাতে তোমার আপত্তি--”
“চুপ!” বলেই বিমল একলাফে দাঁড়িয়ে উঠল! তারপর ছুটে গিয়ে হঠাৎ ঘরের একটা জানলা দু-হাট করে খুলে দিলে। স্পষ্ট দেখলুম জানলার বাহির থেকে একখানা বিশ্রী কালো-কুচকুচে মুখ বিদ্যুতের মতন একপাশে সরে গেল। জানলায় কান পেতে নিশ্চয় কেউ আমাদের কথাবার্তা শুনছিল। বিমলও দাঁড়াল না, ঘরের কোণ থেকে একগাছা মাথা-সমান উঁচু মোটা বাশের লাঠি নিয়ে একছুটে বেরিয়ে গেল। আমি ঘরের দরজায় খিল লাগিয়ে আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলুম!
খানিক পরে বিমল ফিরে এসে আমাকে ডাকলে। আমি আবার দরজা খুলে দিয়ে তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করলুম, “ব্যাপার কী? লোকটাকে ধরতে পারলে?”
লাঠিগাছা ঘরের কোণে রেখে দিয়ে বিমল হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, “না, পিছনে তাড়া করে অনেকদূর গিয়েছিলুম, কিন্তু ধরতে পারলুম না!”
“লোকটা কে বলো দেখি?”
“কে আবার, করালীর লোক, খুব সম্ভব ভাড়াটে গুন্ডা। কুমার, ব্যাপার কী-রকম গুরুতর, তা বুঝচ কি? লোকটা আমাদের কথা হয়তো সব শুনেচে!”
“বিমল, তুমি ঠিক বলেচ, আমাদের আর দেরি করা উচিত নয়, আমরা কালকেই বেরিয়ে পড়ব।”
“তা তো পড়ব, কিন্তু বিপদ হয়তো আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই যাবে।”
“তার মানে?”
“করালী বোধ হয় তার দলবল নিয়ে আমাদের সঙ্গে যাবে।”
আমি একেবারে দমে গেলুম। বিমল বসে বসে ভাবতে লাগল। অনেকক্ষণ পরে সে বললে, “যা-থাকে কপালে। তা বলে করালীর ভয়ে আমরা যে কেঁচোর মতন হাত গুটিয়ে ঘরের কোণে বসে থাকব, এ কিছুতেই হতে পারে না। কালকেই আমাদের যাওয়া ঠিক।”
আমি কাতরভাবে বললুম, “বিমল, গোঁয়ার্তুমি কোরো না।”
বিমল চৌকির উপরে একটা ঘুসি মেরে বললে, “আমি যাবই যাব। তোমার ভয় হয় বাড়িতে বসে থাকো। আমি নিজে যকের ধন এনে তোমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যাব, দেখি করালী হারে কি আমি হারি।”
আমি তার হাত ধরে বললুম, “বিমল, আমি ভয় পাইনি। তুমি যাও তো আমিও নিশ্চয়ই তোমার সঙ্গে যাব। কিন্তু ভেবে দ্যাখো, শেষটা বন-জঙ্গলের ভেতরে একটা খুনোখুনি হতে পারে। করালীরা দলে ভারী, আমরা তার কিছু করতে পারব না।”
বিমল অবহেলার হাসি হেসে বললে, “করালীর নিকুচি করেচে। কুমার, আমার গায়েই খালি জোর নেই, বুদ্ধির জোরও আমার কিছু-কিছু আছে। তুমি কিছু ভেবো না, আমার সঙ্গে চলো, করালীকে কীরকম নাকানি-চোবানি খাওয়াই একবার দেখে নিও।”
আমি বিমলকে ভালোরকম চিনি। সে মিছে জাঁক কাকে বলে জানে না। সে যখন আমাকে অভয় দিচ্ছে, তখন মনে-মনে নিশ্চয় কোনো-একটা নূতন উপায় ঠিক করেছে। কাজেই আমিও নিশ্চিন্তভাবে বললুম, “আচ্ছা ভাই, তুমি যা বল আমি তাতেই রাজি।”
আট
শাপে বর
সারারাত জিনিসপত্র গুছিয়ে, ভোরের মুখে ঘণ্টাখানেক গড়িয়ে, যথাসময়ে আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লুম। আমাদের দলে রইল বিমলের পুরনো চাকর রামহরি ও আমার কুকুর বাঘা। দুটো বড় বড় ব্যাগ, একটা ‘সুটকেস’ ও একটা ‘ইকমিক্ কুকার’ ছাড়া বিমল আর কিছু সঙ্গে নিতে দিলে না।
ব্যাগদুটোর ভিতরে কিন্তু ছিল না, এমন জিনিস নেই। ছুরি, ছোরা, কাঁচি, নানা-রকম ওষুধ-ভরা ছোট একটি বাক্স, ফোটো তুলবার ক্যামেরা, ইলেকট্রিকের টর্চ, ফ্লাস্ক (যার সাহায্যে দুধ, জল বা চা ভরে রাখলে চব্বিশ ঘণ্টা সমান ঠাণ্ডা বা গরম থাকে), গোটাকতক বিস্কুট, ফল ও মাছ-মাংসের টিন (অনেক দিনে যা নষ্ট হবে না), আসাম সম্বন্ধে খানকয়েক ইংরাজি বই, খাতা, ছোট ছোট দুটো বালিশ আর শতরঞ্চি ও কাফ্রির সেই দুটো মুখোশ (বিমলের মতে পরে ও-দুটোও কাজে লাগতে পারে) প্রভৃতি কতরকমের জিনিসই যে এই ব্যাগদুটোর ভিতরে ভরা হয়েছে, তা আর নাম করা যায় না। ‘সুটকেসের’ ভিতরে আমাদের জামা-কাপড় রইল। আমরা প্রত্যেকেই এক-এক গাছা মোটা দেখে লাঠি নিলুম, দরকার হলে এ-লাঠি দিয়ে মানুষের মাথা খুব সহজেই ভাঙা যেতে পারবে। অবশ্য, বিমল বন্দুক-দুটোও সঙ্গে নিতে ভুললে না।
বাড়ি ছেড়ে বেরুবার সময় মনটা যেন কেমন-কেমন করতে লাগল। দেশ ছেড়ে কোথায় কোন্ বিদেশে, পাহাড়ে-জঙ্গলে বাঘ ভাল্লুক আর শক্রর মুখে পড়তে চললুম, যাবার সময়ে মায়ের পায়ে প্রণাম পর্যন্ত করে যেতে পারলুম না, কে জানে এ-জীবনে আর কখনো ফিরে এসে মাকে দেখতে পাব কি না! একবার মনে হল বিমলকে বলি যে, “আমি যাব না!” কিন্তু পাছে সে আমাকে ভীরু ভেবে বসে, সেই ভয়ে মনকে শক্ত করে রইলুম।
বিমলও আমার মুখের পানে তাকিয়ে মনের কথা বোধ হয় বুঝতে পারলে। কারণ হঠাৎ সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলে, “কুমার, তোমার মন কেমন করচে?”
আমি সত্য কথাই বললুম, “একটু একটু করচে বৈ কি!”
“মায়ের জন্যে?”
“হুঁ।”
“ভেবো না। খুব সম্ভব আজকেই হয়তো তোমার মাকে তুমি দেখতে পাবে!”
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, “কী করে? আমরা তো যাচ্চি আসামে!”
“তা যাচ্চি বটে!” বলেই বিমল একবার সন্দেহের সঙ্গে পিছন দিকে চেয়ে দেখলে, তার চোখ-মুখের ভাব উদ্বিগ্ন। সে নিশ্চয় দেখছিল শত্রুরা আমাদের পিছু নিয়েছে কি না! কিন্তু কারুকেই দেখতে পাওয়া গেল না।
বিমলের বাড়ির গাড়ি আমাদের স্টেশনে নিয়ে যাবার জন্য অপেক্ষা করছিল।
আমরা গাড়িতে গিয়ে চড়ে বসলুম। গাড়ি ছেড়ে দিলে। বিমল সারা-পথ অন্যমনস্ক হয়ে রইল। মাঝে মাঝে তেমনি উদ্বেগের সঙ্গে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে পিছন-পানে চেয়ে দেখতে লাগল।
শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছে আমরা গাড়ি থেকে নামলুম। একবার চারিদিকে সতর্কচোখে চেয়ে দেখে আমি বললুম, “বিমল, আপাতত আমাদের কোনো ভয় নেই।”
বিমল সেকথার কোনো জবাব না দিয়ে বললে, “তোমরা এইখানে দাঁড়িয়ে থাকো, আমি টিকিট কিনে আনি।”
টিকিট কিনে এনে, বিমল আমাদের নিয়ে স্টেশনের ভিতর গিয়ে ঢুকল। বাঘাকে জন্তুদের কামরায় তুলে দিয়ে এল। বাঘা বেচারি এত লোকজন দেখে ভড়কে গিয়েছিল। সে কিছুতেই আমার সঙ্গ ছাড়তে রাজি হল না। শেষটা বিমল শিকলি ধরে তাকে জোর করে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল!
গাড়ি ছাড়তে এখনো দেরি আছে। কামরার মধ্যে বেজায় গরম দেখে আমি গাড়ি থেকে নেমে পড়ে প্ল্যাটফর্মের উপর পায়চারি করতে লাগলুম। ঘুরতে ঘুরতে গাড়ির একেবারে শেষদিকে গেলুম। হঠাৎ একটা কামরার ভিতর আমার নজর পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে আমার সারা দেহে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি সভয়ে দেখলুম, কামরার ভিতরে করালী বসে আছে। দুজন মিশকালো গুন্ডার মতো লোকের সঙ্গে হাত-মুখ নেড়ে করালী কী কথাবার্তা কইছিল, আমাকে দেখতে পেলে না। আমি তাড়াতাড়ি ছুটে নিজেদের গাড়িতে এসে উঠে পড়লুম!
বিমল বললে, “কী হে কুমার, ব্যাপার কী? চোখ কপালে তুলে ছুটতে ছুটতে আসছ কেন?”
আমি বললুম, “বিমল! সর্বনাশ হয়েছে।”
বিমল হেসে বললে, “কিছুই সর্বনাশ হয়নি! তুমি করালীকে দেখেচ তো? তা আর হয়েচে কী? সে যে আমাদের সঙ্গ ছাড়বে না, আমি তা অনেকক্ষণই জানি! যাক, তুমি ভয় পেও না, চুপ করে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকো!”
বিমল যত সহজে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলে, আমি তা পারলুম না। আস্তে আস্তে এক কোণে গিয়ে বসে পড়লুম বটে, মন কিন্তু বিমর্ষ হয়ে রইল। বিমল আমার ভাব দেখে মুখ টিপে টিপে হাসতে লাগল। এদিকে গাড়ি ছেড়ে দিল।
জানি না, কপালে কী আছে! জঙ্গলের ভিতরে অপঘাতেই মরতে হবে দেখছি! করালীর সঙ্গে কত লোক আছে তা কে জানে? সে যখন আমাদের পিছু নিয়েচে, তখন সহজে কি আর ছেড়ে দেবে? আমি খালি এইসব কথা ভেবে ও নানারকমের বিপদের কল্পনা করে শিউরে শিউরে উঠতে লাগলুম।
বিমল কিন্তু দিব্যি আরামে সামনের বেঞ্চে পা তুলে দিয়ে বসে নিজের মনে কী একখানা বই পড়তে লাগল।
গাড়ি একটা স্টেশনে এসে থামল। বিমল মুখ বাড়িয়ে স্টেশনের নাম দেখে আমাকে বললে, “কুমার প্রস্তুত হও, পরের স্টেশন রাণাঘাট। এইখানেই আমরা নামব!”
এ আবার কী কথা! আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, “রাণাঘাটে নামব! কেন?”
“সেখান থেকে শান্তিপুরে, তোমার মামার বাড়িতে মায়ের কাছে যাব।”
“হঠাৎ তোমার মত বদলাল কেন?”
“মত কিছুই বদলায়নি, আজ কী করব, কাল থেকেই আমি তা জানি। কিন্তু তোমাকে কিছু বলিনি। এই দ্যাখো, আমি শান্তিপুরের টিকিট কিনেচি। এর কারণ কিছু বুঝলে কি?”
“না।”
“আমি বেশ জানতুম, করালী আমাদের পিছু নেবে! কালকেই তার চর শুনে গেছে, আমরা আসামে যাব! আজও সে জানে, আমরা আসাম ছাড়া আর কোথাও যাব না! সে তাই ভেবে নিশ্চিন্ত হয়ে গাড়ির ভিতরে বসে থাকুক, আর সেই ফাঁকে আমরা রাণাঘাটে নেমে পড়ি! দিন-কয়েক তোমার মামার বাড়িতে বসে বসে আমরা তো মজা করে পোলাও কালিয়া খেয়ে নি! আর ওদিকে করালী যখন জানতে পারবে আমরা আর গাড়ির ভিতরে নেই, তখন মাথায় হাত দিয়ে একেবারে বসে পড়বে!
নিশ্চয় ভাববে যে আমরা তাকে ভুলিয়ে অন্য কোনো ঠিকানায় যকের খোঁজে গেছি! সে হতাশ হয়ে কলকাতার দিকে ফিরবে, আর আমরা তোমার মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে আসামের দিকে যাত্রা করব। আর কেউ আমাদের পিছু নিতে পারবে না।
আমার পক্ষে এটা হল শাপে বর! ওদিকে করালীও জব্দ আর এদিকে আমারও মায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, একেই বলে লাঠি না ভেঙে সাপ মারা! বিমলের দুখানা হাত চেপে ধরে আমি বলে উঠলুম, “ভাই, তুমি এত বুদ্ধিমান! আমি যে অবাক হয়ে যাচ্ছি!”
গাড়ি রাণাঘাটে এসে থামতেই আমরা টপাটপ নেমে পড়লুম, কেউ আমাদের দেখতে পেলে না।
নয়
নতুন বিপদের ভয়
তিন দিন মামার বাড়িতে খুব আদরে কাটিয়ে মায়ের কাছ থেকে আমি বিদায় নিলুম৷ মা কি সহজে আমাকে ছেড়ে দিতে চান? তবু তাঁকে আমরা যকের ধন আর বিপদ-আপদের কথা কিছু বলিনি, তিনি শুধু জানতেন আমরা আসামে বেড়াতে যাচ্ছি।
যাবার সময়ে বিমলকে ডেকে মা বললেন, “দেখো বাবা, আমার শিবরাত্রির সলতেটুকুকে তোমার হাতে সঁপে দিলুম, ওকে সাবধানে রেখো।”
বিমল বললে, “ভয় কী মা, কুমার তো আর কচি খোকাটি নেই, ওর জন্যে তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না।”
মা বললেন, “না বাছা, কুমারকে তুমি কোথাও একলা ছেড়ে দিও না, ও ভারি গোঁয়ার-গোবিন্দ, কী করতে কী করে বসবে কিছুই ঠিক নেই। ও যদি তোমার মতো শান্তশিষ্টটি হত তা হলে আমাকে আর এত ভেবে মরতে হত না।”
বিমল একটু মুচকে হেসে বললে, “আচ্ছা মা, আমি তো সঙ্গে রইলুম, কুমার যাতে গোঁয়ার্তুমি করতে না পায়, সেদিকে আমি চোখ রাখব।”
আমি মনে-মনে হাসতে লাগলুম। মা ভাবছেন আমি গোঁয়ার-গোবিন্দ আর বিমল শান্তশিষ্ট। কিন্তু বিমল যে আমার চেয়ে কত বড় গোঁয়ার আর ডানপিটে, মা যদি তা ঘুণাক্ষরেও জানতেন।
মায়ের পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে আমি, বিমল আর রামহরি দুর্গা বলে বেরিয়ে পড়লুম, বাঘা আমাদের পিছনে পিছনে আসতে লাগল। কিন্তু শান্তিপুরে স্টেশনের ভিতরে এসে, রেলগাড়িকে দেখেই বাঘা পেটের তলায় ল্যাজ গুঁজে একেবারে যেন মুষড়ে পড়ল। সে বুঝলে, আবার তাকে জন্তুদের গাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়ে একলাটি বেঁধে রেখে আসা হবে।
রাণাঘাটে নেমে আবার আমরা আসল গাড়ি ধরলুম। বিমল খুশিমুখে বলল, “যাক, এবারে আর করালীর ভয় নেই। সে হয়তো আসামে বসে নিজের হাত কামড়াচ্ছে, আর আমাদের মুন্ডপাত করচে।”
আমি বললুম, “আসাম থেকে করালী এখন কলকাতায় ফিরে থাকতেও পারে।”
বিমল বললে, “কলকাতায় কেন, সে এখন যমালয়ে গেলেও আমার আপত্তি নেই। চলো, গাড়িতে উঠে বসা যাক।”
অনেক রাতে গাড়ি সরাঘাটে গিয়ে দাড়াল। আমি যে-সময়ের কথা বলছি, পদ্মার উপর তখনো সরার বিখ্যাত পুলটি তৈরি হয়নি। সরাঘাটে সকলকে তখন গাড়ি থেকে নেমে স্টিমারে করে পদ্মার ওপারে গিয়ে আবার রেলগাড়ি চড়তে হত। কাজেই সরায় এসে আমাদেরও মালপত্তর নিয়ে গাড়ি থেকে নামতে হল।
আগেই বলেছি, আমি কখনো কলকাতার বাইরে পা বাড়াইনি। স্টিমারে চড়ে চারিদিকের দৃশ্য দেখে আমার যেন তাক লেগে গেল। কলকাতার গঙ্গার চেয়েও চওড়া নদী যে আবার আছে এই পদ্মাকে দেখে প্রথম সেটা বুঝতে পারলুম। আকাশে চাঁদ উঠেছে আর গায়ে জ্যোৎস্না মেখে পদ্মা নেচে, দুলে বেগে ছুটে চলচে, রুপোর জল দিয়ে তার ঢেউগুলি তৈরি। মাঝে মাঝে সাদা ধবধবে বালির চর চোখের সামনে কখনো জেগে উঠছে, কখনো মিলিয়ে যাচ্ছে, স্বপ্নের ছবির মতন। আমার মনে হল এ নিরিবিলি বালির চরগুলির মধ্যে হয়তো এতক্ষণ পরীরা এসে হাসিখুশি, খেলাধুলা করছিল। স্টিমারের গর্জন শুনে দৈত্য বা দানব আসছে ভেবে এখন তারা ভয় পেয়ে হাওয়ার-সঙ্গে হাওয়া হয়ে মিশিয়ে গেছে।
বালির চর এড়িয়ে স্টিমার ক্রমেই অন্য তীরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, খালাসিরা জল মাপছে আর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কী বলছে। স্টিমারের একদিকে নানা জাতের মেয়ে-পুরুষ একসঙ্গে জড়াজড়ি করে বসে, শুয়ে, দাঁড়িয়ে গোলমাল করছে; আর একদিকে ডেকের উপরে উজ্জ্বল আলোতে চেয়ার-টেবিল পেতে বাহার দিয়ে বসে সাহেব-মেমরা খানা খাচ্ছে! খানিকক্ষণ পরে অন্যদিকে মুখ ফেরাতেই দেখি, একটা লোক আড়চোখে আমার পানে তাকিয়ে আছে। তার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হতেই সে হনহন করে এগিয়ে ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
স্টিমার ঘাটে এসে লাগল। আমরা সবাই একে একে নিচে নেমে স্টেশনের দিকে চললুম। আসাম মেল তখন আমাদের অপেক্ষায় দাড়িয়ে ভোঁস ভোঁস করে ধোঁয়া ছাড়ছিল, আমরাও তার পেটের ভিতর ঢুকে নিশ্চিন্ত হয়ে বসলুম।
কামরার জানলার কাছে আমি বসে ছিলুম। প্রাটফর্মের ওপাশে আর একখানা রেলগাড়ি, সেখানাতে দার্জিলিঙের যাত্রীদের ভিড়। ফার্স্ট ও সেকেন্ড ক্লাসের সাহেব-মেমরা কামরার ভিতরে বিছানা পাতছিল, এক ঘুমে রাত কাটিয়ে দেবার জন্যে। তাদের ঘুমের আয়োজন দেখতে দেখতে আমারও চোখ ঢুলে এল।
আমিও শুয়ে পড়বার চেষ্টা করছি, হঠাৎ আবার দেখলুম, স্টিমারের সেই অচেনা চেয়ে দেখছে। এবার আমার ভারি সন্দেহ হল। বিমলের দিকে ফিরে বললুম, “ওহে, দ্যাখো দ্যাখো।”
বিমল বেঞ্চির উপর কম্বল পাততে পাততে বললে, “আর দেখাশুনো কিছু নয়, এখন চোখ বুজে নাক ডাকিয়ে ঘুমোবার সময়।”
“ওহে, না দেখলে চলবে না। স্টিমার থেকে একটা লোক বরাবর আমাদের ওপর নজর রেখেছে, এখনো সে দাঁড়িয়ে আছে, যেন পাহারা দিচ্ছে।”
শুনেই বিমল একলাফে জানালার কাছে এসে বলল, “ কৈ কোথায়?”
“ঐ যে।”
কিন্তু লোকটাও তখন বুঝতে পেরেছিল যে আমরা তার উপর সন্দেহ করেছি। সে তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে সেখান থেকে সরে পড়ল।
বিমল চিন্তিতের মতো বললে, “তাই তো এ আবার কে!”
“করালীর চর নয় তো?”
“করালী? কিন্তু সে কী করে জানবে আজ আমরা এখানে আছি?”
“হয়তো করালী আমাদের চালাকি ধরে ফেলেচে! সে জানত আমরা দু-চার দিন পরেই আবার আসামে যাব। আসামে যেতে গেলে এ-পথে আসতেই হবে। তাই সে হয়তো এইখানেই এতদিন ঘাঁটি আগলে বসে ছিল।”
“অসন্তব নয়। আচ্ছা, একবার নেমে দেখা যাক, করালী এই গাড়ির কোনো কামরায় লুকিয়ে আছে কি না। এই বলেই সে প্লাটফর্মের উপর নেমে এগিয়ে গেল।”
গাড়ি যখন ছাড়ে-ছাড়ে, বিমল তখন ফিরে এল।
আমি বললুম, “কী দেখলে?”
“কিছু না। প্রত্যেক কামরায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেচি, করালী কোথাও নেই। বোধ হয় আমরা মিছে সন্দেহ করেচি।”
বিমলের কথায় অনেকটা নিশ্চিন্ত হলুম, যদিও মনের মধ্যে কেমন একটা খটকা লেগে রইল।
গাড়ি ছেড়ে দিলে। বিমল বললে, “ওহে কুমার, এই বেলা যতটা পারো ঘুমিয়ে নাও, আসামে একবার গিয়ে পড়লে হয়তো আমাদের আহার-নিদ্রা একরকম ত্যাগ করতেই হবে।”
বিমল বেঞ্চির উপরে “আঃ” বলে সটান লম্বা হল, আমিও শুয়ে পড়লুম। সুখের বিষয়, এ-কামরায় আর কেউ ছিল না, সুতরাং ঘুমে আর ব্যাঘাত পড়বার ভয় নেই।
দশ
এ চোর কে?
আমরা খাসিয়া পাহাড়ের মধ্যে দাড়িয়ে আছি, সামনে বুদ্ধদেবের এক পাথরের মূর্তি। গভীর রাত্রি, আকাশে চাঁদ নেই, সব দিকে খালি অন্ধকার আর অন্ধকার! মাথার অনেক উপরে তারাগুলো টিপ্ টিপ্ করে জুলছে, তাদের আলোতে আশে-পাশে অনেকগুলো পাহাড়ের মাথা ঝাপসা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে, আমার মনে হল সেগুলো যেন বড় বড় দানবের কালো কালো মায়ামুর্তি। তারা যেন প্রেতপুরীর পাহারাওয়ালার মতো ওঁত পেতে হুমড়ি খেয়ে রয়েছে, এখনি হুড়মুড় করে আমাদের ঘাড়ের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে! চারিদিক এত স্তব্ধ যে গায়ে কাঁটা দেয়, বুক ছাঁৎ ছাঁৎ করে! শুধু রাত করছে, ঝিম্ ঝিম্ ঝিমৃ, আর ভয়ে কেঁপে গাছপালা করছে, সর্ সর্ সর্!
বিমল চুপিচুপি আমাকে বললে, “এই বুদ্ধদেবের মূর্তি। এইখানেই যকের ধন আছে।”
হঠাৎ কে খল্ খল্ করে হেসে উঠল, সে বিকট হাসির প্রতিধ্বনি যেন পাহাড়ের মাথাগুলো টপকে লাফাতে লাফাতে কোথায় কতদূরে কোন্ চির অন্ধকারের দেশের দিকে চলে গেল!
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলুম, রামহরি আঁতকে উঠে দুহাতে মুখ ঢেকে ধুপ করে বসে পড়ল, বাঘা আকাশের দিকে মুখ তুলে ল্যাজ গুটিয়ে কেউ কেঁউ করে কাঁদতে লাগল।
বিমল সাহসে ভর করে বললে, “কে হাসলে?”
আবার সেই খল্ খল্ করে বিকট হাসি। কে যে হাসছে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, তবে সে-হাসি নিশ্চয়ই মানুষের নয়, মানুষ কখনো এমন ভয়ানক হাসি হাসতে পারে না!
বিমল আবার বললে, “কে তুমি হাসচ?”
“আমি!” উঃ, সে স্বর কী গম্ভীর।
“কে তুমি? সাহস থাকে আমার সামনে এসো।”
“আমি তোমার সামনেই আছি।”
“মিখ্যে কথা! আমার সামনে খালি বৃদ্ধদেবের মূর্তি আছে।”
“হাঃ, হাঃ, হাঃ! আমাকে বুদ্ধদেবের মূর্তি ভাবচ? চেয়ে দ্যাখো ছোকরা, আমি যক!”
বুদ্ধদেবের সেই মূর্তিটা একটু একটু নড়তে লাগল, তার চোখদুটো ধ্বকধ্বক করে জ্বলে উঠল।
বিমল বন্দুক তুললে মুর্তিটা আবার খল খল করে হেসে বললে, “তোমার বন্দুকের গুলিতে আমার কিছুই হবে না।”
বিমল বললে, “কিছু হয় কি না দেখাচ্চি।” সে বন্দুকের ঘোড়া টিপতে উদ্যত হল!
আকাশ-কাঁপানো স্বরে মূর্তি চেঁচিয়ে বললে, “খবরদার! তোমার গুলি লাগলে আমার গায়ের পাথর চটে যাবে। বন্দুক ছুড়লে তোমারি বিপদ হবে।”
“হোক গে বিপদ, বিপদকে আমি ডরাই না।”
“জানো, আমি আজ হাজার হাজার বছর ধরে এইখানে বসে আছি, আর তুমি কালকের ছোকরা হয়ে আমার শান্তিভঙ্গ করতে এসেছ? কী চাও তুমি?”
“গুপ্তধন!”
“হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। গুপ্তধন চাও, ভারি আশা যে! এই গুপ্তধন নিতে এসে এখানে তোমার মতো কত মানুষ মারা পড়চে তা জানো? ঐ দ্যাখো তাদের শুকনো হাড়!”
মূর্তির চোখের আলোতে দেখলুম, একদিকে মস্তবড় হাড়ের ঢিপি, হাজার হাজার মানুষের হাড়ে সেই ঢিপি অনেকখানি উঁচু হয়ে উঠেছে।
বিমল একটুও না দমে বললে, “ও দেখে আমি ভয় পাই না, আমি গুপ্তধন চাই।”
“আমি গুপ্তধন দেব না।”
“দিতেই হবে।”
“না, না, না!”
“তা হলে বন্দুকের গুলিতে তোমার আগুন-চোখ কানা করে দেব।”
গর্জন করে মূর্তি বললে, “তার আগেই তোমাকে আমি বধ করব!”
তুমি তো পাথর, এক পা এগুতে পার না, আমি তোমার নাগালের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, তুমি আমার কী করবে?”
“হাঃ হাঃ, চেয়ে দ্যাখো এখানে চারিদিকেই আমার প্রহরীরা দাঁড়িয়ে আছে! আমার হুকুমে এখনি ওরা তোমাদের টিপে মেরে ফেলবে!”
“কোথায় তোমার প্রহরী?”
“প্রত্যেক পাহাড় আমার প্রহরী!”
“ওরাও তো পাথর, তোমার মতো নড়তে পারে না। ও-সব বাজে কথা রেখে হয় আমাকে গুপ্তধন দাও নয় এই তোমাকে গুলি করলুম!”, বিমল আবার বন্দুক তুললে।
“তবে মরো। প্রহরী।” মূর্তির আগুন-চোখ নিবে গেল- সঙ্গে সঙ্গে পলক না যেতেই অন্ধকারের ভিতর অনেকগুলো পাহাড়ের মতো মস্ত বড় কী কতকগুলো লাফিয়ে উঠে আমাদের উপরে এসে পড়ল। বিষম এক ধাকায় মাটির উপর পড়ে অসহ্য যাতনায় চেঁচিয়ে আমি বললুম, “বিমল, বিমল---,”
আমার ঘুম ভেঙে গেল! চোখ মেলে দেখলুম, রেলগাড়ির বেঞ্চের উপর থেকে গড়িয়ে আমি নিচে পড়ে গেছি, আর বিমল আমার মুখের উপরে ঝুঁকে বলছে, “ভয় কী কুমার, সে-রাস্কেল পালিয়েচে!”
তখনো স্বপ্নের ঘোর আমার যায়নি, আমি ভয়ে ভয়ে বললুম, “যক আর নেই?”
বিমল আশ্চর্য ভাবে বললে, “যকের কথা কী বলচ, কুমার?”
আমি উঠে বসে চোখ কচলে অপ্রস্তুত হয়ে বললুম, “বিমল, আমি এতক্ষণ একটা বিদঘুটে স্বপ্ন দেখছিলুম। শুনলে তুমি অবাক হবে!”
বিমল বললে, “আর গাড়ির ভিতরে এখনি যে কান্ডটা হয়ে গেল, তা মোটেই স্বপ্ন নয়! শুনলে তুমিও অবাক হবে।”
আমি হতভম্বের মতো বললুম, “গাড়ির ভেতরে আবার কী কাণ্ড হল!”
বিমল বললে, “একটা চোর এসেছিল!”
“চোর? বল কী!”
“হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি, একটা লোক আমাদের ব্যাগ হাতড়াচ্ছে! আমি তখনি উঠে তার রগে এক ঘুসি বসিয়ে দিলুম, সে ঠিকরে তোমার গায়ের উপর গিয়ে পড়ল- সঙ্গে সঙ্গে তুমিও আঁতকে উঠে বেঞ্চির তলায় চিৎপাত হলে! লোকটা- পড়েই আবার দাঁড়িয়ে উঠল, তারপর চোখের নিমেষে জানালা দিয়ে বাইরে এক লাফ মেরে অদৃশ্য হয়ে গেল।”
“চলন্ত ট্রেন থেকে সে লাফ মারল? তা হলে নিশ্চয়ই মারা পড়েচে!”
“বোধ হয় না। ট্রেন তখন একটা স্টেশনের কাছে আস্তে আস্তে চলছিল!”
“আমাদের কিছু চুরি গিয়েচে নাকি?”
“হুঁ। মড়ার মাথাটা!” বলেই বিমল হাসতে লাগল।
“বিমল, মড়ার মাথাটা আবার চুরি গেল, আর তোমার মুখে তবু হাসি আসচে?”
“হাসব না কেন, চোর যে জাল মড়ার মাথা নিয়ে পালিয়েচে।”
“জাল মড়ার মাথা! সে আবার কী?”
“তোমাকে তবে বলি শোনো। এরকম বিপদ যে পথে ঘটতে পারে, আমি তা আগেই জানতুম। তাই কলকাতা থেকে আসবার আগেই, আমাদের পাড়ার এক ডাক্তারের কাছ থেকে আর-একটা নতুন মড়ার মাথা জোগাড় করেছিলুম। নতুন মাথাটার উপরেও আসল মাথায় যেমন আছে, তেমনি অঙ্ক ক্ষুদে দিয়েচি,, তবে এর মানে একেবারে উল্টো। এই নকল মাথাটাই ব্যাগের ভেতরে ছিল। আমি জানতুম মড়ার মাথা চুরি করতে আবার যদি চোর আসে, তবে নকলটাকে নিয়েই সে তুষ্ট হয়ে যাবে। হয়েচেও তাই!”
“বিমল, ধন্যি তোমার বুদ্ধি! তুমি যে এত ভেবে কাজ কর, আমি তা জানতুম না। আসল মড়ার মাথা কোথায় রেখেচ?”
“অনেকের বাড়িতে যেমন চোর-কুঠুরি থাকে, আমার ব্যাগের ভেতরেও তেমনি একটা লুকানো ঘর আছে। এ-ব্যাগ আমি অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়েছি। মড়ার মাথা তার ভেতরেই রেখেছি।”
“কিন্তু আমাদের পিছনে এ কোন্ নতুন শত্রু লাগল বলো দেখি।”
শত্রু আর কেউ নয়, এ করালীর কাজ! সে আমার চালাকিতে ভোলেনি, নিশ্চয় এই গাড়িতেই কোথাও ঘুপটি মেরে লুকিয়ে আছে।”
“তবেই তো!”
“কুমার, আবার তোমার ভয় হচ্ছে নাকি?”
“ভয় হচ্চে না, কিন্তু ভাবনা হচ্চে বটে! এই দ্যাখো না, করালীর চর যদি আজই ঘুমন্ত অবস্থায় তোমার বুকে ছুরি বসিয়ে দিয়ে যেত?”
“করালী আমাদের সঙ্গে নেই, এই ভেবে আমরা অসাবধান হয়েছিলুম বলেই আজ এমন কাণ্ড ঘটল। এখন থেকে আবার সাবধান হব, রামহরি আর বাঘাকে সর্বদাই কাছে কাছে রাখব, আর সকলে মিলে একসঙ্গে ঘুমোবও না।”
“করালী যখনি জানবে সে জাল মড়ার মাথা পেয়েছে, তখনি আবার আমাদের আক্রমণ করবে।”
“আমরাও প্রস্তুত! কিন্তু সে যদি সাঙ্কেতিক লেখা এখনো পড়তে না পেরে থাকে, তবে এ জাল ধরা তার কর্ম নয়।”
গাড়ি তখন উর্ধশ্বাসে ছুটছে আর আমাদের চোখের সুমুখ দিয়ে চাঁদের আলোয় উজ্জ্বল বন - জঙ্গল - মাঠের দৃশ্যের পর দৃশ্য ভেসে যাচ্ছে, ঠিক যেন বায়োস্কোপের ছবির পর ছবি! আমার আর ঘুমোবার ভরসা হল না, বাইরের দিকে চেয়ে, বসে বসে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলুম। প্রতি মিনিটেই গাড়ি আমাদের দেশ থেকে দূরে, আরও দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলছে, কত অজানা বিপদ আমাদের মাথার উপরে অদৃশ্যভাবে দুলছে! জানিনা, এই পথ দিয়ে এ-জীবনে আর কখনো দেশে ফিরতে পারব কিনা!
এগারো
ছাতকে
আজ আমরা শ্রীহট্টে এসে পৌঁচেছি।
বিমল বললে, “কুমার, এই সেই শ্রীহট্ট।”
আমি বললাম “হ্যাঁ, এই হচ্ছে সেই কমলালেবুর বিখ্যাত জন্মভূমি!”
বিমল বললে, “উহ, কমলালেবু ঠিক শ্রীহট্ট শহরে তো জন্মায় না, তবে এখানকার প্রধান নদী সুরমা দিয়েই নৌকায় চড়ে কমলালেবু কলকাতায় যাত্রা করে বটে! খালি কমলালেবু নয়, এখানকার কমলা - মধুও যেমন উপকারী, তেমনি উপাদেয়৷”
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “এ-অঞ্চলে আরো কী পাওয়া যায়?”
“পাওয়া যায় অনেক জিনিস, যেমন আলু, কুমড়ো, শসা, আনারস, তুলো, আখ, তেজপাতা, লঙ্কা, মরিচ, ডালচিনি ও চুন প্রভৃতি। এসব মাল এ অঞ্চল থেকেই রপ্তানি হয়। কিন্তু এখানকার পান-সুপারির কথা শুনলে তুমি অবাক হবে!”
“অবাক হব? কেন?”
“বাংলাদেশের মতো এখানে পানের চাষ হয় না, কিন্তু এদেশে পানের সঙ্গে সুপারির বড় ভাব। বনের ভেতরে প্রায়ই দেখবে, সুপারি-কুঞ্জেই পান জন্মেছে, সুপারি-গাছের দেহ জড়িয়ে পানের লতা উপরে উঠেচে! তা ছাড়া, এখানকার “সফলাং আর একটি বিখ্যাত জিনিস।”
“সফলাং! সে আবার কী?”
“কেশরের মতো একরকম মূল। খাসিয়ারা খেতে বড় ভালোবাসে।”
সারাদিন আমরা শ্রীহট্টেই রইলুম। এখান থেকে আমাদের গন্তব্যস্থান খাসিয়া পাহাড়কে দেখতে পেলুম। মনে হল এর বিশাল বুকের ভিতরে না-জানি কত রহস্যই লুকানো আছে, সে-রহস্যের মধ্যে ডুব দিয়ে আর থই পাব কি না, তাই-বা কে বলতে পারে! এ তো আর কলকাতার রাস্তার কোনো নম্বর-জানা বাড়ির খোঁজে যাচ্ছি না, এই অশেষ পাহাড়-বন-জঙ্গলের মধ্যে কোথায় আছে যকের ধন, কী করে আমরা তা টের পাব? এখন পর্যন্ত করালী বা তার কোনো চরের টিকিটি পর্যন্ত দেখতে না পেয়ে আমরা তবু অনেকটা আশ্বস্ত হলুম। বুঝলুম, জাল মড়ার মাথা পেয়ে করালী এতটা খুশি হয়েছে যে, আমাদের উপরে আর পাহারা দেওয়া দরকার মনে করছে না! বাঁচা গেছে। এখন করালীর এই ভ্রমটা কিছুদিন স্থায়ী হলেই মঙ্গল। কারণ তার মধ্যেই আমরা কেল্লা ফতে করে দেশে ফিরে যেতে পারব।
মাঝরাত্রে স্টিমারে চড়ে, সুরমা নদী দিয়ে পরদিন সকালে ছাতকে গিয়ে পৌঁছলুম।
সুরমা হচ্ছে শ্রীহট্টের প্রধান নদী। ছাতকও এই নদীর তীরে অবস্থিত। কলকাতায় ছাতকের চুনের নাম আমরা আগেই শুনেছিলুম। তবে এ-চুনের উৎপত্তি ছাতকে নয়, চেরাপু্ঞ্জি অঞ্চলে খাসিয়া পাহাড়ে এই চুন জন্মে, সেখান থেকে রেলে করে ও নৌকা বোঝাই হয়ে ছাতকে আসে এবং ছাতক থেকে আরো নানা জায়গায় রপ্তানি হয়। চেরাপুঞ্জিতে খালি চুন নয়, আগে সেখানে লোহার খনি থেকে অনেক লোহা পাওয়া যেত, সেইসব লোহায় প্রায় আড়াইশো বছর আগে বড় বড় কামান তৈরি হ’ত। কিন্তু বিলাতি লোহার উপদ্রবে খাসিয়া পাহাড়ের লোহার কথা এখন আর কেউ ভুলেও ভাবে না। চুন ও লোহা ছাড়া কয়লার জন্যেও খাসিয়া পাহাড় নামজাদা। কিন্তু পাঠাবার ভালো বন্দোবস্ত না থাকার দরুন, এখানকার কয়লা দেশ-দেশান্তরে যায় না।
ছাতক জায়গাটি মন্দ নয়। এখানে থানা, ডাক্তারখানা, পোস্ট-আপিস, বাজার ও মাইনর ইস্কুল কিছুরই অভাব নেই। একটি ডাকবাংলোও আছে, আমরা সেইখানে গিয়েই আশ্রয় নিলুম। বিমলের মুখে শুনলুম, এখানে পিয়াইন নামে একটি নদী আছে, সেই নদী দিয়েই আমাদের নৌকায় চড়ে ভোলাগঞ্জ পর্যন্ত যেতে হবে, এ- সময়ে নদীর জল কম বলে নৌকো তার বেশি আর চলবে না। কাজেই ভোলাগঞ্জ থেকে মাইল-দেড়েক হেঁটে আমরা থারিয়াঘাটে যাব, তারপর পাথর-বাঁধানো রাস্তা ধরে খাসিয়া পাহাড়ে উঠব। আজ ডাকবাংলোয় বিশ্রাম করে কাল থেকে আমাদের যাত্রা আরম্ভ।
ছাতক থেকে খাসিয়া পাহাড়ের কী চমত্কার! নীলরঙের প্রকাণ্ড মেঘের মতো, দৃষ্টি-সীমা জুড়ে আকাশের ঢেকে খাসিয়া পাহাড় ছড়িয়ে আছে, যতদূর নজর চলে, পাহাড়ের যেন আর শেষ নেই! পাহাড়ের কথা আমি কেতাবে পড়েছিলুম, কিন্তু চোখে কখনো দেখিনি, পাহাড় যে এত সুন্দর তা আমি জানতুম না; আমার মনে হতে লাগল, খাসিয়া পাহাড় যেন ইশারা করে কাছে ডাকছে, ইচ্ছা হল তখনি এক ছুটে তার কোলে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি!
সন্ধ্যার সময় খানিক গল্পগুজব করে আমরা শুয়ে পড়লুম। বেশ-একটু শীতের আমেজ দিয়েছিল, লেপের ভিতরে ঢুকে কী আরামই পেলুম!
বিমলও তার লেপের ভিতরে ঢুকে বললে, “ঘুমিয়ে নাও ভাই, নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে নাও, কাল এমন সময়ে আমরা খাসিয়া পাহাড়ে, এত আরামের ঘুম আর হয়তো হবে না।”
আমি বললুম, “কিন্তু আমরা তো ঘুমোব, পাহারা দেবে কে?”
বিমল বললে, “সে-ব্যবস্থা আমি করেচি। দরজার বাইরে বারান্দায় রামহরি আর বাঘা শুয়ে আছে। তার ওপরে দরজা-জানলাগুলোও ভেতর থেকে আমি বন্ধ করে দিয়েছি।”
আমার উদ্বেগ দূর হল। যদিও শত্রুর দেখা নেই, তবু সাবধানে থাকাই ভালো।
বারো
বিনি-মেঘে বাজ
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলুম তা জানি না, হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল! উঠতে গিয়ে উঠতে পারলুম না, আমার বুকের উপরে কে যেন চেপে বসে আছে। ভয়ে আমি চেঁচিয়ে উঠলুম, ‘বিমল, বিমল।”
অন্ধকারের ভিতরে কে আমার গলা চেপে ধরে হুমকি দিয়ে বললে, “খবরদার, চ্যাঁচালেই টিপে মেরে ফেলব!”
আমি একেবারে আড়ষ্ট হয়ে গেলুম, অনেক কষ্টে বললুম, “গলা ছাড়ো, আমারদম বন্ধ হয়ে আসচে!”
আমার গলা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে সে বললে, “আচ্ছা, ফের চ্যাঁচালেই কিন্তু মরবে!”
সেই ভীষণ ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না, আমার বুকের উপরে কে এ, ভূত না মানুষ? ঘরের অন্য কোণেও একটা ঝটাপট শব্দ শুনলুম তার পরেই একটা গোঙানি আওয়াজ, কে যেন কী দিয়ে কাকে মারলে, তারপর আবার সব চুপচাপ।
অন্ধকারেই হেঁড়ে গলায় কে বললে, “শম্ভু, ব্যাপার কী।”
আর-একজন বললে, “বাবু, এ-ছোঁড়ার গায়ে দস্যির জোর, আর একটু হলেই আমাকে বুক থেকে ফেলে দিয়েছিল আমি লাঠি দিয়ে একে ঠাণ্ডা করেচি।”
“একেবারে শেষ হয়ে গেল নাকি?”
না, অজ্ঞান হয়ে গেছে বোধ হয়।”
“আচ্ছা, তা হলে আমি আলো জ্বালি।” বলেই সে ফস্ করে একটা দেশলাই জ্বেলে বাতি ধরালে। দেখলুম এ সেই লোকটা ইস্টিমারে আর ইস্টিশানে যে গোয়েন্দার মতো পিছু নিয়ে আমার পানে তাকিয়েছিল।
আমাকে তার পানে চেয়ে থাকতে দেখে সে হেসে বললে, “কীহে স্যাঙাত, ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে আছ যে! আমাকে চিনতে পেরেচ নাকি?”
আমি কোনো জবাব দিলুম না। আমার বুকের উপরে তখনো একটা লোক চেপে বসে ছিল। ঘরে আর-এক কোণে বিমলের দেহ স্থির হয়ে পড়ে আছে, সে-দেহে প্রাণের কোনো লক্ষণ নেই! দরজা-জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলুম, সব বন্ধ। তবে এরা ঘরের ভিতর এল কেমন করে?”
বাতি-হাতে লোকটা আমার কাছে এগিয়ে এসে বললে, “ছোকরা, ভারি চালাক হয়েচ, না? যকের ধন আনতে যাবে? এখন কী হয় বলো দেখি?”
আমি ভয়ে ভয়ে বললুম, “কে তোমরা?”
“অত পরিচয়ে তোমার দরকার কী হে বাপু?”
“তোমরা কী চাও?”
“পকেট-বই চাই, পকেট-বই। তোমার ঠাকুরদাদার পকেট-বইখানা আমাদের দরকার। মড়ার মাথা আমরা পেয়েচি, এখন পকেট-বইখানা কোথায় রেখেচ বলো।”
এত বিপদেও মনে-মনে আমি না হেসে থাকতে পারলুম না। এরা ভেবেছে সেই জাল মড়ার মাথা নিয়ে যকের ধন আনতে যাবে! পকেট-বইয়ের কথা এরা জানে! নিশ্চয় এরা করালীর লোক।
লোকটা হঠাৎ আমাকে ধমক দিয়ে বললে, “এই ছোকরা, চুপ করে আছ যে? শিগ্গির বলো পকেট-বই কোথায়, নইলে, আমার হাতে কী, দেখচ?” সে কোমর থেকে ফস্ করে একখানা ছোরা বার করলে, বাতির আলোয় ছোরাখানা বিদ্যুতের মতো জ্বলজ্বল করে উঠল।
আমি তাড়াতাড়ি বললুম, “এই ব্যাগের ভেতরে পকেট-বই আছে।”
লোকটা বললে, “হুঁ, পথে এসো বাবা, পথে এসো! শম্ভু, ব্যাগটা খুলে দ্যাখ তো!”
শম্ভু বিমলের দেহের পাশে বসে ছিল, লোকটার কথায় তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ঘরের অন্য কোণে গিয়ে আমাদের বড় ব্যাগটা নেড়েচেড়ে বললে, “ব্যাগের চাবি বন্ধ।”
বাতি-হাতে লোকটা আমাকে জিজ্ঞাসা করলে, “ব্যাগের চাবি কোথায়?”
আমি কিছু বলবার আগেই বিমল হঠাৎ একলাফে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, “এই যে, চাবি আমার কাছে”, বলেই সে হাত তুললে, তার হাতে বন্দুক!
লোকগুলো যেন হতভম্ব হয়ে গেল! আমিও অবাক!
বিমল বন্দুকটি বাগিয়ে ধরে বললে, “যে আর এক-পা নড়বে তাকেই আমি গুলি করে কুকুরের মতো মেরে ফেলব।”
যার হাতে বাতি ছিল, হঠাৎ বাতিটা মাটির উপর ফেলে দিলে, সমস্ত ঘর আবার অন্ধকার। সঙ্গে সঙ্গে আগুনের ঝলক তুলে দুম করে বিমলের বন্দুকের আওয়াজ হল, একজন লোক “বাবারে গেছিরে” বলে চিৎকার করে উঠল, আমার বুকের উপরে যে চেপে বসেছিল, সে-ও আমাকে ছেড়ে দিলে, তার পরেই ঘরের দরজা খোলার শব্দ, বাঘার ঘেউ ঘেউ, রামহরির গলা। কী যে হল কিছুই বুঝতে পারলুম না, বিছানার উপরে উঠে আচ্ছন্নের মতন আমি বসে পড়লুম।
বিমল বললে, “কুমার, আলো জ্বালো, শিগগিরি!”
আমি আমতা আমতা করে বললুম, “কিন্তু, কিন্তু,”
“ভয় নেই, আলো জ্বালো, তারা পালিয়েচে।”
কিন্তু আমাকে আর আলো জ্বালতে হল না, রামহরি একটা লন্ঠন হাতে করে তাড়াতাড়ি ঘরের ভিতরে এসে ঢুকল!
ঘরের ভিতরে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই!
বিমল মেঝের দিকে হেঁট হয়ে পড়ে বললে, “এই যে রক্তের দাগ। গুলি খেয়েও লোকটা পালাল। বোধ হয় ঠিক জায়গায় লাগেনি, হাত-টাত জখম হয়েছে।”
রামহরি উদ্বিগ্ন মুখে বললে, “ব্যাপার কী বাবু?”
বিমল সেকথায় কান না দিয়ে বললে, “কিন্তু জানলা-দরজা সব বন্ধ, অথচ ঘরের ভেতর শত্রু। ভারি আশ্চর্য তো!” তার পরে একটু থেমে, আবার বললে, “ও বুঝেচি। নিশ্চয় আমরা যখন ও-ঘরে খেতে গিয়েছিলুম রাস্কেলরা তখনি ফাঁক পেয়ে এ-ঘরে ঢুকে খাটের তলায় চুপটি মেরে লুকিয়েছিল!”
কথাটা আমারও মনে লাগল। আমি. বললুম, “ঠিক বলেচ। কিন্তু বিমল, তুমি তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে, হঠাৎ কী করে দাঁড়িয়ে উঠলে?”
বিমল বললে, “আমি মোটেই অজ্ঞান হইনি, অজ্ঞান হওয়ার ভান করে চুপচাপ পড়ে ছিলুম৷ ভাগ্যে বন্দুকটা আমার বিছানাতেই ছিল!”
পা চেটে দিতে লাগল। আমি দেখলুম বাঘার মুখে যেন কিসের দাগ। এ যে রক্তের মতো! তবে কি বাঘা জখম হয়েছে? তাড়াতাড়ি তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ভালো করে দেখে বুঝলুম, না, অন্য কারুর রক্ত! বাঘা নিশ্চয় সেই লোকগুলোর কারুকে-না-কারুকে তার দাঁতের জোর বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে!
তারিফ করে তার মাথা চাপড়ে আমি বললুম, “শাবাশ বাঘা, শাবাশ!”, বাঘা আদরে যেন গলে গিয়ে, আমার পায়ের তলায় পড়ে গড়াগড়ি দিতে লাগল!
বিমল বললে, “এবার থেকে বাঘাকেও আমাদের সঙ্গে নিয়ে ঘুমোব! বাঘা আমাদের কাছে ঘরের ভিতর থাকলে এ-বিপদ হয়তো ঘটত না।”
আমি বললুম, “তা তো ঘটত না, কিন্তু এখন ভবিষ্যতের উপায় কি? করালী নিশ্চয়ই আমাদের ছাড়ান দেবে না, এবারে তার চরেরা হয়তো দলে আরো ভারী হয়ে আসবে।”
বিমল সহজভাবেই বললে, “তা আসবে বৈকি!”
আমি বললুম, “আর এটাও মনে রেখো, কাল থেকে আমরা লোকালয় ছেড়ে পাহাড়ের ভেতরে গিয়ে পড়ব! সেখানে আমাদের রক্ষা করবে কে?”
বিমল বন্দুকটা ঠক করে মেঝের উপরে ঠুকে, একখানা হাত তুলে তেজের সঙ্গে বললে, “আমাদের এই হাতই আমাদের রক্ষা করবে! যে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না, তাকে বাঁচাবার সাধ্য কারুর নেই!”
“কিন্তু?”
“আজ থেকে ‘কিন্তু’র কথা ভূলে যাও কুমার, ও হচ্ছে ভীরু, কাপুরুষের কথা!” বলেই বিমল এগিয়ে ঘরের একটা জানলা খুলে দিয়ে আবার বললে, “চেয়ে দ্যাখো কুমার!”
জানালার বাইরে আমার চোখ গেল। নিঝুম রাতের চাদের আলো মেখে স্বর্গের মায়ার মতো খাসিয়া পাহাড়ের স্থির ছবি আঁকা রয়েছে! চমৎকার, শিখরের পর শিখরের উপর দিয়ে জ্যোৎস্নার ঝরনা রুপোলি লহর তুলে বয়ে যাচ্ছে, কোথাও আলো, কোথাও ছায়া-ঠিক যেন পাশাপাশি হাসি আর অশ্রু! বিভোর হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলুম, এমন দৃশ্য আমি আর কখনো দেখিনি!
বিমল বললে, “কী দেখচ?”
আমি বললুম, “স্বপ্ন।”
বিমল বললে, “না, স্বপ্ন নয়, এ সত্য! তুমি কি বলতে চাও এই স্বর্গের দরজায় এসে আবার আমরা ফিরে যাব?”
আমি মাথা নেড়ে বললুম, “না বিমল, না, ফিরব না, আমরা ফিরব না! আমার সমস্ত প্রাণ-মন এখানে গিয়ে লুটিয়ে পড়তে চাইচে! যকের ধন পাই আর না-পাই, আমি শুধু একবার এখানে যেতে চাই।”
বিমল জানলাটা আবার বন্ধ করে দিয়ে বললে, “কাল আমরা ওখানে যাব! আজ আর কোনো কথা নয়, এসো এবার নাক ডাকানো যাক!”, বলেই সে বন্দুকটা পাশে নিয়ে বিছানার উপরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল! খানিক পরেই তার নাকের গর্জন শুরু হল। তার নিশ্চিত ঘুম দেখে কে বলবে যে, একটু আগেই সে সাক্ষাৎ যমের মুখে গিয়ে পড়েছিল! বিমলের আশ্চর্য সাহস দেখে আমিও সমস্ত বিপদের কথা মন থেকে তাড়িয়ে দিলুম। তারপর খাসিয়া পাহাড় আর যকের ধনের কথা ভাবতে ভাবতে
কখন যে ঘুমিয়ে পড়লুম, তা আমি জানি না।
তেরো
খাসিয়া পাহাড়ে
আমরা চেরাপুঞ্জি পার হয়ে অনেকদূর এগিয়ে এসেছি। চেরাপু্ঞ্জি থেকে শিলং শহর প্রায় ষোলো ক্রোশ তফাতে! এই পথটা মোটরগাড়ি করে যাওয়া যায়। আমরা কিন্তু ও-মুখো আর হলুম না। কারণ জানা-পথ ধরলে শত্রুপক্ষের সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনা বেশি।
পাহাড়ের পর পাহাড়, ছোট, বড়, মাঝারি। যেদিকে চাই কেবলি পাহাড়, কোনো কোনো পাহাড়ের শৃঙ্গের আকার বড় অদ্ভুত, দেখতে যেন হাতির শুঁড়ের চাইচে! পাহাড়গুলিকে দূর থেকে ভারি কঠোর দেখাচ্ছিল, কিন্তু কাছে এসে দেখছি সবুজ ঘাসের নরম মখমলে এদের গা কে যেন মুড়ে দিয়েছে। কত লতাকুঞ্জে কত যে ফুল ফুটে রয়েছে, হাজার হাজার চুনি-পান্না-হীরা-জহরতের মতো তাদের ‘আহা-মরি’ রঙের বাহার, এ যে ফুলপরীদের নির্জন খেলাঘর! কোথাও ছোট ছোট ঝরনা ঝিরঝির করে ঝরে পড়ছে, তারপর পাথরের পর পাথরের উপরে লাফিয়ে পড়ে ঘুমপাড়ানি গান গাইতে গাইতে চোখের আড়ালে তলিয়ে গিয়েছে! কোথাও পথের দুপাশে গভীর খাদ, তার মধ্যে শত শত ডালচিনির গাছ আর লতাপাতার জঙ্গল শীতের ঠাণ্ডা বাতাসে থেকে থেকে কেঁপে কেঁপে উঠছে,, সেসব খাদের পাশ দিয়ে চলতে গেলে প্রতি পদেই ভয় হয়, এই বুঝি টলে পা ফসকে অতল পাতালের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে যাই! সবচেয়ে বিশেষ করে চোখে পড়ে সরল গাছের সার। এত সরল গাছ আমি আর কখনো দেখিনি, সমস্ত পাহাড়ই যেন তারা একেবারে দখল করে নিতে চায়! সেসব গাছে বেশি ডালপালা-পাতার জাল নেই; মাটি থেকে তারা ঠিক সোজা হয়ে উপরে উঠে যেন সদর্পে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
নির্জন পাহাড়, মাঝে মাঝে কখনো কেবল দু-একজন কাঠুরের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। কাঠুরেরা জাতে খাসিয়া, তাদের চেহারার সঙ্গে গুর্খাদের চেহারার অনেকটা মিল আছে, নাক থ্যাবড়া, গালের হাড় উঁচু, চোখ বাঁকা বাঁকা, মাথা ছোট ছোট।
এখানে এসে এক বিষয়ে আমরা নিশ্চিন্ত হয়েছি। এতদিনেও করালীর দলের আর কোনো সাড়াশব্দ পাইনি। আমরা যে পথ ছেড়ে এমন অপথ ধরব, নিশ্চয় তারা কল্পনা করতে পারেনি। হয়তো তারা এখন আমাদের ধরবার জন্যে শিলঙ সহরে গিয়ে খুঁজে মরছে। কেমন জব্দ!
বিমল আজ দুটো বুনো মোরগ শিকার করেছে। সেই মোরগের মাংস কত মিষ্টি লাগবে তাই ভাবতে ভাবতে খুশি হয়ে পথ চলছি!
পশ্চিম আকাশে সিঁদুর ছড়িয়ে সূর্য অস্তে গেল। আমি বললুম, “বিমল, সারাদিন পথ চলে পা টাটিয়ে উঠেছে, খিদেও পেয়েছে খুব। আজকের মতো বিশ্রাম করা যাক।”
বিমল বললে, “কেন কুমার, চারিদিকের দৃশ্য কি তোমার ভালো লাগছে না?”
“ভালো লাগচে না আবার, এত ভালো লাগচে যে দেখে দেখে আর সাধ মিটচে না! কিন্তু এই খিদের মুখে রামপাখির গরম মাংস এর চেয়ে ঢের ভালো লাগবে বলে মনে হচ্ছে!”
এই বলাবলি করতে করতে আমরা একটা ছোট ঝরনার কাছে এসে পড়লুম। ঝরনার ঠিক পাশেই পাহাড়ের বুকে একটা গুহার মতো বড় গর্ত।
বিমল বললে, “বাঃ, বেশ আশ্রয় মিলেচে। এই গুহার ভিতরেই আজকের রাতটা দিব্যি আরামে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। রামহরি, মোটঘাট এইখানেই রাখো।”
আমাদের প্রত্যেকের পিঠেই কম-বেশি মোট ছিল, সবাই সেগুলো একে একে গুহার ভিতরে নামিয়ে রাখলুম। গুহাটি বেশ বড়সড়, আমাদের আরো চার-পাঁচজন লোক এলেও তার মধ্যে থাকবার অসুবিধা হ’ত না।
গুহার ভিতরটা ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করে রামহরি বললে, “খোকাবাবু, এইবার রান্নার উদ্যোগ করি?”
বিমল বললে, “হ্যাঁ, দাঁড়াও, আমি তোমাদের একটা মজা দেখাচ্ছি, এখানে আগুনের জন্য কিছু ভাবতে হবে না!” এই বলে একটা কুডুল নিয়ে বেড়িয়ে গেল!
আমি আর রামহরি ছুরি নিয়ে তখনি মোরগ-দুটোকে রান্নার উপযোগী করে ছুলতে বসে গেলুম। বাঘাও সামনে দুই পায়ে ভর দিয়ে বসে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে লোলুপ চোখে, ঘাড় বেঁকিয়ে একমনে আমাদের কাজ দেখতে লাগল, তার হাব-ভাবে বেশ বোঝা গেল, রামপাখির মাংসের প্রতি তারও লোভ. আমাদের চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়!
খানিক পরেই বিমল একরাশ কাঠ ঘাড়ে করে ফিরে এল। আমি বললুম, “এলে তো খালি কতকগুলো কাঠ নিয়ে। এর মধ্যে মজাটা কী আছে?”
“এই দ্যাখো না” বলেই বিমল কিছু শুকনো পাতা জড়ো করে দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে আগুন জ্বাললে, তারপর একখানা কাঠ নিয়ে তার উপরে ধরতেই ধপ করে জ্বলে উঠল! বিমল কাঠখানা উঁচু করে মাথার উপরে ধরলে, আর সেটা ঠিক মশালের মতোই দাউদাউ করে জ্বলে উঠল!
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, “বাঃ, বেশ মজার ব্যাপার তো! অত সহজে জ্বলে, ওটা কী কাঠ?”
বিমল বললে, “সরল কাঠ। এ-কাঠে একরকম তেলের মতো রস আছে, তাই এমন সুন্দর জ্বলে। এর আর-এক নাম, ধূপকাষ্ঠ!”
রামহরি সেদিন সরল কাঠেই উনুন ধরিয়ে রামপাখির মাংস চড়িয়ে দিলে। আমরা দুজনে গুহার ধারে বসে গল্প করতে লাগলুম।
তখন সন্ধ্যা উতরে গেছে, একটা পাহাড়ের আড়াল থেকে চাঁদ-মামার আধখানা হাসিমুখ উঁকি মারছে, সেই আবছায়া-মাখা জ্যোৎস্নার আলোতে সামনের পাহাড়, বন আর ঝরনাকে কেমন যেন অদ্ভুত দেখাতে লাগল।
বিমল হঠাৎ বললে, “কুমার, তুমি ভূত বিশ্বাস কর?”
আমি বললুম, “কেন বলো দেখি?”
বিমল বললে, “আমরা যাদের দেশে আছি, এই খাসিয়ারা অনেকেই ভূতকে দেবতার মতো পুজো করে। ভূতকে খুশি রাখবার জন্যে খাসিয়ারা মোরগ আর মুরগির ডিম বলি দেয়। যে-মুলুকে ভূতের এত ভক্ত থাকে, সেখানে ভূতের সংখ্যাও নিশ্চয়ই খুব বেশি, কী বল?”
আমি বললুম, “না, আমি ভূত মানি না।”
বিমল বললে, “কেন?”
“কারণ আমি কখনো ভূত দেখিনি। তুমি দেখেচ?”
“না, তবে আমি একটি ভূতের গল্প জানি।”
“সত্যি গল্প?”
“সত্যি মিথ্যে জানি না, তবে যার মুখে গল্পটি শুনেছি, সে বলে এর আগাগোড়া সত্যি।”
“কে সে?”
“আমাদের বাড়ির পাশে একজন লোক বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকত, এখন সে উঠে গেছে। তার নাম ঈশান।”
“বেশ তো, এখনো রান্নার শেষ হতে দেরি আছে, ততক্ষণে তুমি গল্পটা শেষ করে ফ্যালো- বিশ্বাস না হোক, সময়টা কেটে যাবে।”
একটা বেজায় ঠান্ডা বাতাসের দমকা এল। দুজনেই ভালো করে র্যাপার মুড়ি দিয়ে বসলুম। বিমল এমনভাবে গল্প শুরু করলে, ঈশানই যেন তা নিজের মুখে বলছে,
চোদ্দ
মানুষ না পিশাচ? [ঈশানের গল্প]
আমাদের বাড়ি যে-গ্রামে, তার ক্রোশ-দুয়েক তফাতেই গঙ্গা। কাজেই গাঁয়ে কোনো লোক মারা গেলে, গঙ্গার ধারে নিয়ে গিয়েই মড়া পোড়ানো হত। লোক মিলে মড়া নিয়ে শ্মশানে চললুম। শ্মশানে পৌঁছাতে রাত বারোটা বেজে গেল।
পাড়ার গাঁয়ের শ্মশান যে কেমন ঠাঁই, সহরের বাসিন্দারা তা বুঝতে পারবেন না। এখানে গ্যাসের আলোও নেই, লোকজন গোলমালও নেই। অনেক গাঁয়েই শ্মশানে কোনো ঘরও থাকে না। খোলা, নির্জন জায়গা, চারিদিকে বন-জঙ্গল, প্রতি পদেই হয়তো মড়ার মাথা আর হাড় মাড়িয়ে চলতে হয়। রাতে সেখানে গেলে খুব সাহসীরও বুক রীতিমতো দমে যায়।
আমাদের গাঁয়ের শ্মশানঘাটে একখানা হেলেপড়া দরজাভাঙা কোঠাঘর ছিল। তার মধ্যেই গিয়ে আমরা মড়া নামিয়ে রাখলুম। পাড়ার গাঁয়ের শ্মশানে চিতার জ্বালানি-কাঠ তো কিনতে পাওয়া যায় না, কাজেই আশপাশের বন-জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে আনতে হয়।
ভোলা বললে, “আমি মড়া আগলে থাকি, তোমরা সকলে কাঠ আনো-গে যাও!”
আমি বললুম, “একলা থাকতে পারবে তো?”
ভোলা যেমন ডানপিটে, তার গায়ে জোরও ছিল তেমনি বেশি। সে অবহেলার হাসি হেসে বললে, “ভয় আবার কী? যাও, যাও, দেরি কোরো না!”
আমরা পাঁচজনে জঙ্গলে ঢুকে কাঠ কাটতে লাগলুম। একটা চিতে-জ্বালাবার মতো কাঠ, সে তো বড় অল্প কথা নয়! কাঠ কাটতেই কেটে গেল প্রায় আড়াই ঘণ্টা; বুঝলাম, আজ ঘুমের দফায় ইতি,, মড়া পোড়াতেই সকাল হয়ে যাবে! একজন বলে উঠল, “ওহে দ্যাখো দ্যাখো, শ্মশানের ঘরের মধ্যে কীরকম আগুন জ্বলছে!”
তাই তো, ঘরের ভিতরে সত্যিই দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে যে! অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে আমরা তাড়াতাড়ি এগিয়ে চললুম। ঘরের কাছ-বরাবর আসতেই লন্ঠনের আলোতে দেখলুম, মাটির উপরে কে-একজন উপুড় হয়ে পড়ে আছে। লোকটাকে উল্টে ধরে লন্ঠনটা তার মুখের কাছে নামিয়ে দেখলুম, সে আর কেউ নয়, আমাদের ভোলা! তার মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠেচে, সে একেবারে অজ্ঞান হয়ে গেছে!
ভোলা এখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, আর ওখানে ঘরের ভিতরে আগুন জ্বলছে, এ কেমন ব্যাপার! সকলে হতভম্ব হয়ে ঘরের দিকটায় ছুটে গেলুম। কাছে গিয়ে দেখি, ঘরের দরজার কাছটায় কে তাল তাল মাটি এনে ঢিপির মতো উঁচু করে তুলেছে, আরো খানিকটা উঁচু হলেই দরজার পথ একেবারেই বন্ধ হয়ে যেত! এসব কী কাও কিছুই বুঝতে না পেরে আমরা ঘরের ভিতর উকি মেরে দেখলুম, এককোণে একরাশ কাঠ দাউদাউ করে জুলছে, একটা কাঁচা মাংস-পোড়ার বিশ্রী গন্ধ উঠেছে আর কোথাও মড়ার কোনো চিহ্নই নেই!
ভয়, বিস্ময় আর দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে আমরা আবার ভোলার কাছে ফিরে এলুম। তার মুখে ও মাথায় অনেকক্ষণ ধরে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা দেবার পর আস্তে আস্তে সে চোখ চাইলে! তারপর উঠে বসে যা বললে, তা এই :
“তোমরা তো কাঠ কাটতে চলে গেলে, আমি মড়া আগলে বসে রইলুম। খানিকক্ষণ এমনি চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে আমার কেমন তন্দ্রা এল। চোখ বুজে ঢুলচি, হঠাৎ থপ্ করে কী-একটা শব্দ হল। চমকে জেগে উঠে চারিদিকে চেয়ে দেখলুম, কিন্তু কেউ কোথাও নেই। আমারই মনের ভ্রম ভেবে খাটের পায়াতে মাথা রেখে আবার আমি ঘুমোবার চেষ্টা করলুম। খানিকক্ষণ পরে আবার সেই থপ্ করে শব্দ! এবারে আমার সন্দেহ হল হয়তো মড়ার লোভে বাইরে শেয়াল-টেয়াল কিছু এসেছে। এই ভেবে আর চোখ খুললুম না, এমনিভাবে আরো খানিকটা সময় কেটে গেল। ওদিকে সেই ব্যাপারটা সমানেই চলেছে, মাঝে মাঝে সব স্তব্ধ, আর মাঝে মাঝে থপ্ করে শব্দ! শেষটা জ্বালাতন হয়ে আমি আবার চোখ চাইতে বাধ্য হলুম। কিন্তু এ কী! ঘরের দরজার সামনেটা যে মাটিতে প্রায় ভরতি হয়ে উঠেছে,, আর একটু পরেই আমার বাইরে যাবার পথও যে একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে! কে একাজ করলে, এ তো যে-সে কথা নয়! আমার ঘুমের ঘোর চট করে কেটে গেল, সেই কাঁচা মাটির পাঁচিল টপকে তখনই আমি বাইরে বেরিয়ে পড়লুম।
চাঁদের আলোয় চারিদিকে ধবধব করছে। ঘর আর গঙ্গার মাঝখানে চড়া। এদিকে ওদিকে চাইতেই দেখলুম, খানিক তফাতে একটা ঝাঁকড়াচুলো লোক হেঁট হয়ে একমনে দুই হাতে ভিজে মাটি খুঁড়ছে! বুঝলুম তারই এই কাজ! কিন্তু এতে তার লাভ কী? লোকটা পাগল নয় তো?
ভাবছি, এদিকে সে আবার একতাল মাটি নিয়ে ঘরের দিকে অগ্রসর হল। মস্ত লম্বা চেহারা, মস্ত লম্বা চুল আর দাড়ি, একরকম উলঙ্গ বললেই হয়, পরনে খালি একটুকরো কপনি! সে মাথা নিচু করে আসছিল, তাই আমাকে দেখতে পেলে না। কিন্তু সে কাছে আসবামাত্র আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম।
সে তখন মুখ তুলে আমার দিকে চাইলে, উঃ, কী ভয়ানক তার চোখ, ঠিক যেন দুখানা বড় বড় কয়লা দপ্ দপ্ করে জ্বলছে। এমন জ্বলন্ত চোখ আমি জীবনে কখনো দেখিনি।
ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, “কে তুমি?”
উত্তরে মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলো ঝাঁকুনি দিয়ে নেড়ে সে এমন এক ভূতুড়ে চিৎকার করে উঠল যে আমার বুকের রক্ত যেন বরফ হয়ে গেল। মহাআতঙ্কে প্রাণপণে আমি দৌড় দিলুম, কিন্তু বেশিদূর যেতে-না-যেতে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলুম। তারপর আর কিছু আমার মনে নাই।”
ভোলার কথা শুনে বুঝলুম, সে-লোকটা পিশাচ ছাড়া কিছু নয়! দুষ্ট প্রেতাত্মারা সুবিধা পেলেই মানুষের মৃতদেহের ভিতরে ঢুকে তাকে জ্যান্ত করে তোলে। মরা মানুষ এইভাবে জ্যান্ত হলেই তাকে পিশাচ বলে। এইরকম কোনো পিশাচই ভোলার ঠাকুরমার দেহকে আগুন জ্বেলে আধপোড়া করে খেয়ে গেছে। ভোলাকেও নিশ্চয় সে ফলার করার ফিকিরে ছিল, কেবল আমরা ঠিক সময়ে এসে পড়াতেই এ-যাত্রা ভোলা কোনো গতিকে বেঁচে গেল!
সেবারে আমাদের আর মড়া পোড়াতে হল না!
শেষাংশ...
No comments:
Post a Comment