ফকির চাঁদ

লেখক : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় 

ফকিরচাঁদ যে একজন অতি সন্দেহজনক লোক তাতে কারও কোনও সন্দেহ নেই। গঙ্গানগর গাঁয়ের শেষপ্রান্তে যে খালটা রয়েছে তার ধার ঘেঁষেই ফকিরের বাড়ি। বাড়ি বলতে যা ঠিক সেরকম নয়। বাঁশ বাঁখারি দিয়ে বানানো ঘর, গোলপাতার ছাউনি, নিতান্তই হতদরিদ্র অবস্থা। সেখানেই ফকিরচাঁদ দিব্যি আপনমনে থাকে। মুখভর্তি কালো কুচকুচে দাড়ি-গোঁফ, পরনে আলখাল্লার মতো একটা বেঢপ পোশাক, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। লোকে তাকে সাধু ভেবে গিয়ে অনেক সময়ে হাত দেখাতে চায়, তাবিজ-কবচ চায়। ফকিরচাঁদ তাদের সটান তাড়িয়ে দেয়। সে বলে, আমি সাধু সিদ্ধাই নাই বাপু, আমি একজন বৈজ্ঞানিক।

তা ফকিরচাঁদ বৈজ্ঞানিকই বটে।

সকালবেলা আলো ফুটবার আগেই সে একখানা থলি নিয়ে বেরিয়ে খালের ওধারে জঙ্গলে গিয়ে ঢোকে। সেখান থেকে রাজ্যের পাতা, ফল, শেকড়বাকড় তুলে নিয়ে আসে। তারপর হামানদিস্তায় থেঁতো করে তাতে কিসব মেশায় কে জানে। তার ঘরে কাঠের তাকে সারি সারি শিশিতে সেইসব পাতার তৈরি তরল ওষুধ, বড়ি, গুঁড়ো ভরা। সেগুলো কার কোন কাজে লাগবে তা কেউ জানে না। ফকিরও কাউকে ডেকে কখনও বলেনি যে, আমার ওষুধ খেয়ে দেখ। সে কারও কাছ থেকে কিছু চায়ও না। তবু যে তার পেট চলে তার কারণ হল, চাষীবাসীরা তাকে একটু ভয়-ভক্তি করে বলে প্রায় রোজই কিছু না কিছু সিধে দিয়ে যায়। কিন্তু ফকিরচাঁদের তাতে কোনও হেলদোল নেই। ভারী নির্বিকার মানুষ।

সনাতন বিশ্বাসের বড় পাজি হাঁপানি রোগ আছে। বহু চিকিৎসাতেও কোনও কাজ হয়নি। গাঁয়ের ডাক্তার কবিরাজ ফেল করাতে সনাতন বড় গঞ্জ শহরে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে এসেছে। বিস্তর ওষুধেও কোনও কাজ হয়নি বলে সনাতনের জীবনের ওপর মায়াটাই চলে গেছে। এই রোগ নিয়ে বেঁচে থাকাটাই তো কষ্টকর। অনেক ভেবেচিন্তে সনাতন একদিন বিকেলে গিয়ে ফকিরের ঘরে হানা দিল।

ফকির আছিস নাকি?

ফকির হাঁক শুনে বেরিয়ে এল। মুখে বিরক্তি, ভ্রূ কোঁচকানো। বাজখাঁই গলায় বলল, কি চাই?
ওরে আমি তো হাঁপানিতে মরতে বসেছি। কোনও ওষুধেই কাজ হচ্ছে না। বলি তুই কি হাঁপানির ওষুধ জানিস?

জবাব না দিয়ে ফকির ঘরের ভিতরে ঢুকে একটা শিশি নিয়ে এসে সনাতনের হাতে দিয়ে বলল, এটা সকালবেলা এক ছিপি খেয়ে নেবেন। রোজ।

শিশির গায়ে কোনো লেবেল নেই। খুব ভয়ের চোখে শিশিটার দিকে চেয়ে সনাতন বলল, ওরে, এতে কোনও বিষ- টিষ নেই তো। খেলে কিছু খারাপ যদি হয়।

ফকির নির্বিকার মুখে বলে, সে আমি জানি না। খারাপও হতে পারে। কোনও গ্যারান্টি নেই।

এটার দাম কত?

তাও জানা নেই মশাই।

সনাতন দোলাচল মন নিয়ে বাড়ি ফিরল।

ফকিরচাঁদের ওষুধের কথা শুনে বাড়ির সবাই রে রে করে উঠল, - খবরদার, ওই পাগলের ওষুধ খেও না। মারা পড়বে।

সনাতনও ভয় পেয়ে খেল না। তবে শিশিটি রেখে দিল। কিন্তু হাঁপানির কষ্ট মাঝে মাঝে এমন তুঙ্গে ওঠে যখন মনে হয় এর চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।

তাই দিন তিনেক পরে একদিন মাঝরাতে উঠে মরিয়া হয়ে সে এক ছিপি ওষুধ খেয়ে নিল। স্বাদ একটু তেতো তেতো, আর গন্ধটাও খুব একটা ভালো নয়। খেয়ে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে রইল। বিষক্রিয়া হয়েছে কিনা বুঝতে চেষ্টা করল। কিন্তু তেমন কিছু খারাপ প্রতিক্রিয়া হল না দেখে সে একটু নিশ্চিন্ত হল। একটু ঘুমিয়েও পড়ল।

সকালে যেন মনে হল হাঁফের টানটা একটু কম। তবে সেটা মনের ভুলও হতে পারে। কিন্তু সকালে আর এক ছিপি ওষুধও খেয়ে নিল সে। সারাদিন আর কিছুই ঘটল না। কিন্তু রাতে সনাতনের ভারী সুনিদ্রা হল। হাঁপানির জন্য ঘুমোতেই পারত না এতদিন।
সকালে উঠে সে অবাক হয়ে বুঝতে পারল, তার হাঁফের টান এক্কেবারে নেই। নেই তো নেই। কোনওদিন যে ছিল সেটাই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।

এই ঘটনার পর গাঁয়ে একটা মৃদু শোরগোল পড়ে গেল। তবে কি পাগলটার সত্যিই কোনও বিদ্যে জানা আছে?

ডাক্তার নগেন সরকার শুনে বলল, হুঁ, হাতিঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল। ফকরেটা তো লেখাপড়াই জানে না।

সনাতন ফুঁসে উঠে বলে, দেখ ডাক্তার, হাঁপানি সারাতে তোমার পিছনে আমি কয়েক হাজার টাকা ঢেলেছি। লাভ হয়েছে লবডঙ্কা। ফকরে তো তার ওষুধের জন্য একটা পয়সাও নেয়নি।

নগেন বলল, ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে। ঠিক আছে, আমার মায়ের তো পেটে টিউমার ধরা পড়েছে। সামনের মাসেই অপারেশন। খরচের ধাক্কাও কম নয়! সারাক দেখি আপনার ফকিরচাঁদ আমার মায়ের টিউমার!

ফকিরকে পরদিনই দুপুরবেলা ধরে বেঁধে নিয়ে আসা হল। ফকির সব শুনে তার ঝোলা থেকে একটা শিশি বের করে দিয়ে বলল, রোজ সকালে এক ছিপি করে।

তাতে সারবে তো?

তা কে জানে? ওসব আমি জানি না। ওষুধ চেয়েছো, দিয়েছি।

যদি ওষুধ খেয়ে রুগি মারা যায়?

যেতেও পারে। ভয় পেলে খাইও না। তোমাদের ইচ্ছে।

নগেনের মা বললেন, না বাবা, তোমাকে আমার বিশ্বাস হয়। আমি খাবো।

তিনদিন ওষুধ খাওয়ার পর মা বললেন, ওরে নগেন, আমার পেটের ভিতর সেই চাকাটা যেন নেই বলে মনে হচ্ছে।

নগেন ডাক্তারও পেট টিপে দেখল, নেই। সন্দেহভঞ্জনের জন্য শহরে নিয়ে এক্স-রে, ইউ এস জি করে দেখা গেল, সত্যিই নেই।

পরদিন সকালেই ফকিরের ঘরের দরজায় গিয়ে হামলে পড়ল নগেন ডাক্তার, ও ফকির, তোমার টিউমার সারানোর ফরমুলাটা আমাকে দাও ভাই, আমি তোমাকে হাজার টাকা দিচ্ছি।

ফকির খ্যাঁক করে উঠল, কিসের ফরমুলা? কিসের টিউমার। যাও যাও, ঘ্যানঘ্যান কোরো না।

আচ্ছা, না হয় পাঁচ-নয়, দশ হাজার টাকাই দেবো।

তোমার টাকা বেশি হয়ে থাকলে গরিব-দুঃখীর বিনা পয়সায় চিকিৎসা করো না কেন। এখন বিদেয় হও তো।

ভজহরি গুণের কর্কট রোগ। ডাক্তার জবাব দিয়েই রেখেছে। বড়জোর আর ছ'মাস আয়ু। অথচ তার বয়স বেশি নয়, মাত্র বত্রিশ। এ বয়সে কে মরতে চায়। তাই হাল ছেড়ে ভজহরি শেষের দিন শুনছিল। এমন সময় তার বাবা বলল, ফকির পাগলার ওষুধে নাকি শক্ত ব্যামো সেরে যাচ্ছে। আমাদের ভজুর জন্য একটা শেষ চেষ্টা করে দেখলে হয় না? এখন তো দৈব ছাড়া উপায় নেই।

ফকিরকে বাবা বাছা বলে একদিন ধরে আনল ভজহরির বাবা। ফকির রুগী ভালো করে দেখল না, পরীক্ষা করল না. প্রশ্নও করল না। শুধু একটা শিশি বের করে দিয়ে বলল, রোজ সকালে দুটো করে বড়ি।

আর কিছু করতে হবে না? শুধু দুটো করে বড়ি খেলেই হবে।

হ্যাঁ। এর বেশি আমার কিছু জানা নেই।

ও বাবা ফকির, একটু ভরসা দিয়ে যাও, এই ওষুধে এই ব্যাধি সারবে তো?

সারবে কিনা তা আমিও জানি না। ইচ্ছে হলে খাওয়াবেন।

কারোই ওষুধে তেমন ভরসা হল না। তবে ভজহরি ওষুধটা নিয়মিত খেতে লাগল। দিন সাতেক পরে সে টের পেল, রোজ তার পেট আর পিঠ জুড়ে যে তীব্র ব্যথাটা মাঝে মাঝে হচ্ছিল সেটা আর হচ্ছে না। আরও সাতদিন দেখল সে। পেট শান্ত। ব্যথা নেই। ভজহরিকে নিয়ে তার বাবা ছুটল শহরে। ডাক্তার পরীক্ষা করলেন। ভ্রূ কোঁচকালেন। আরও কয়েকটা টেস্ট করতে বললেন। রেজাল্ট দেখে ফের ভ্রূ কুঁচকে চিন্তিত মুখে বললেন, আশ্চর্য! কোনও কারসিনোজেসিক ট্রেস নেই! কি করে হল বলুন তো! এরকম তো হয় না।

ভজহরি আর তার বাবা ফকিরচাঁদের কথা বিশদ বর্ণনা করল। ডাক্তার অবাক হয়ে বললেন, জরিবুটি! তাতে সেরেছে! চলুন তো, আমিও লোকটার কাছে যাবো।


এইভাবেই রোজ ফকিরচাঁদের ঘরের সামনে ভিড় বাড়তে লাগল। প্রথম অল্প অল্প ভিড়। তারপর বেসামাল ভিড়।

মিটিমিটি চোখে চেয়ে ফকিরচাঁদ ভিড় দেখে, আর ভাবে। কি ভাবে তা বোঝা যায় না। মুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই।

কিন্তু হঠাৎ এক ঝড়বৃষ্টির রাতে ফকিরচাঁদ উধাও হয়ে গেল। পরদিন লোকজন গিয়ে দেখে, ফকিরচাঁদ তো নেই-ই, ঘরটাও কেৎরে হেলে পড়েছে।

সেই থেকে আর ফকিরচাঁদের কোনও খোঁজ নেই।